আমার দুঃখ হচ্ছে ওদের জন্যে, বলল। ইংরেজ মেয়েটা। চেহারা দেখে ভাল ছেলে বলেই মনে হচ্ছে।
খামোকা দরদ দেখিও না, তীক্ষা হল হাঁসের গলা। সবাই একমত হয়েছে, ওদেরকে ছেড়ে দেয়া চলবে না। দলের সবার বিরুদ্ধে যেতে পার না তুমি। চল, কেটে পড়ি। সময়ই নেই। চিহ্নটিহ্নগুলো মুছে দিয়ে যেতে হবে। আবার।
দেয়ালে ঝোলানো লণ্ঠনটা নামিয়ে নিল বুড়ি। বেরিয়ে গেল।
মেঝেতে রাখা লণ্ঠনটা তুলে ছেলে দুটোর দিকে আবার তাকাল মেয়েটা। কেন এলে, ছেলেরা? কেন আর সবার মত দূরে থাকলে না? অর্গানের বাজনা একবার শুনেই পালায় লোকে, আর ফেরে না। কিন্তু তোমরা ঠিক ফিরে এলে আবার।
তিন গোয়েন্দা কখনও হাল ছাড়ে না, গম্ভীর গলা কিশোরের।
অনেক সময় হাল ছেড়ে দেয়াই ভাল, বলল মেয়েটা। তো থাক, আমরা যাই। আশা করি, অন্ধকারে ভয় পাবে না। গুডবাই।
যাবার আগে, বলল কিশোর। আশ্চর্য শান্ত গলা। অবাক হল মুসা। একটা প্রশ্নের জবাব দেবে?
কি? জানতে চাইল মেয়েটা।
এখানে কি কুকাজ করছ তোমরা? কিসের দল?
বাহ, সাহস আছে তোমার, ছেলে! হাসল মেয়েটা। কুকাজ, না? হ্যাঁ, কুকাজই। আমরা স্মাগলার। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে দামি জিনিসপত্র স্মাগল করে আনি, বিশেষ করে মুক্তো। টেরর ক্যাসল আমাদের হেডকোয়ার্টার। লোকে জানে ভূতুড়ে বাড়ি। ধারেকাছে ঘেঁষে না। লুকানোর দারুণ জায়গা। বহু বছর ধরে আছি আমরা এখানে।
কিন্তু ওই বিচিত্র পোশাক পরে আছ কেন? যেন সার্কাসের সং। লোকের নজরে পড়ে যাবে সহজেই।
আমাকে দেখলে তো নজরে পড়ব, বলল মেয়েটা। হয়েছে, আর না। একটার জায়গায় তিনটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে ফেলেছি। এবার যেতে হচ্ছে। গুডবাই।
লণ্ঠন হাতে বেরিয়ে গেল মেয়েটা। শব্দ তুলে বন্ধ হয়ে গেল সেলের দরজা। ঘুটঘুটে অন্ধকার চেপে ধরল। দুই গোয়েন্দাকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে মুসার। শুকনো ঠোঁটের ওপর একবার বুলিয়ে আনল জিভ।
কিশোরা খসখসে গলা মুসার। চুপ করে আছ কেন? কিছু বল। নইলে পাগল হয়ে যাব যা নীরব।
উ! আনমনা শোনাল কিশোরের গলা। ভাবছিলাম। খাপেখাপে মেলাতে চাইছি। কিছু ব্যাপার।
ভাবছিলে! এই সময়ো!
হ্যাঁ। খেয়াল করেছ, এখান থেকে বেরিয়ে ডানে ঘুরেছে জিপসি কাটি? ওদিকে করিডর ধরে এগিয়েছে?
তাতে কি?
আমরা যেদিক থেকে এসেছি তার উল্টো দিকে গেল। সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠেনি। সে। আরও পাতালে নেমেছে। এর মানে কি? মাটির তলা দিয়ে বেরোনোর কোন গোপন পথ আছে। কোন গোপন সুড়ঙ্গ। ওই পথে বেরোলে লোকের চোখে পড়বে না।
কিশোরের মাথা ঠাণ্ডা রাখার ক্ষমতা দেখে অবাক না হয়ে পারল না মুসা। পাতালের এই সেলে, এই বিপদে থেকেও ঠিক খাটিয়ে নিচ্ছে মগজের ধূসর কোষগুলোকে!
অনেক কিছুই তো ভাবছ, বলল মুসা। এখান থেকে কি করে বেরোনো যায়, ভেবেছ কিছু?
না, সোজাসাপ্টা জবাব দিল কিশোর। ভেবে লাভ নেই। পরিষ্কার বুঝতে পারছি, বাইরের সাহায্য ছাড়া এখান থেকে বেরোনোর কোন উপায় নেই। আমাদের। বাস্তবকে স্বীকার করে নেয়াই ভাল। আমাকে ক্ষমা কর, মুসা। আমার ভুলের জন্যেই ঘটল এটা।
চুপ করে রইল মুসা। বলার নেই কিছুই। কি বলবে?
ঘুটঘুটে অন্ধকার। অখণ্ড নীরবতা। কাছেই কোথাও হুটোপুটি করছে একটা ইদুর, শোনা যাচ্ছে। আরেকটা একঘেয়ে শব্দও কানে আসছেঃ টুপ্… টুপ্… টুপ্…!
সময় নিয়ে খুব আস্তে আস্তে পড়ছে পানির ফোঁটা। তারই আওয়াজ।
১৭
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে রবিন আর হ্যানসন। এক ঘন্টা হল গেছে মুসা আর কিশোর, ফেরার নাম নেই। প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর রোলস রয়েস থেকে বেরিয়ে আসছে। রবিন, ব্ল্যাক ক্যানিয়নের দিকে তাকাচ্ছে। বন্ধুরা আসছে কিনা দেখছে। প্ৰতি দশ মিনিট পর পর বেরোচ্ছে হ্যানসন।
মাস্টার রবিন, আর থাকতে না পেরে বলল হ্যানসন। মনে হয় এবার যাওয়া উচিত।
দিল রবিন। চোখের আড়াল করা নিষেধ।
তা হোক, বলল হ্যানসন। মানুষের জীবনের কাছে রোলস রয়েস কিছু না। আমি ওঁদের খুঁজতে যাব।
গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। হ্যানসন। বুট খুলে বড় একটা বৈদ্যুতিক লণ্ঠন বের করল। পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। রবিন। তার দিকে চেয়ে বলল, আমি যাচ্ছি।
আমিও যাব, বলল রবিন।
ঠিক আছে, আসুন যাই।
বুট বন্ধ করতে গিয়েও থেমে গেল হ্যানসন। বড় একটা হাতুড়ি বের করে নিল, দরকার পড়তে পারে। একটা অস্ত্ৰ তো বটেই।
রওনা হয়ে পড়ল দুজনে। দ্রুত হাঁটছে। হ্যানসন। ভাঙা পা নিয়ে তার সঙ্গে পেরে উঠছে না। রবিন। তবু কাছাকাছি থাকার যথেষ্ট চেষ্টা করছে।
টেরার ক্যাসলের বারান্দায় এসে উঠল দুজনে। দরজা বন্ধ। হাতল বুলে পড়ে আছে। খোলা যাবে না পাল্লা।
এদিক দিয়ে ঢোকেননি, বলল হ্যানসন। তাহলে? কোনদিক দিয়ে গেলেন? এদিক ওদিক তাকাল সে। ওই জানালাগুলো দেখা দরকার!
পাল্লাখোলা জানালাটার সামনে এসে দাঁড়াল দুজনে। আলো ফেলল রবিন। চোখে পড়ল সাদা চকে বড় করে আকা একটা ?। এদিক দিয়েই গেছে ওরা সংক্ষেপে চিহ্নটার মানে বুঝিয়ে বলল রবিন।
জানোলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল হ্যানসন, রবিনকে ঢুকতে সাহায্য করল। লণ্ঠনের আলোয় বুঝতে পারল ওরা, একটা ডাইনিং রুমে এসে ঢুকেছে।
এরপর? এরপর কোনদিকে গেলেন খুঁজছে। হ্যানসন। কয়েকটা দরজা। কোথাও চিহ্ন নেই।
এই সময় রবিনের চোখ পড়ল আয়নার ওপর। বড় করে। আকা রয়েছে প্ৰশ্নবোধক চিহ্ন। দেখাল। হ্যানসনকে।