কিছুই করার দরকার নেই। বলল এশিয়ান। এই ঘরে রেখে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে চলে যাব। কেউ কখনও খুঁজে পাবে না ওদেরকে। মরে ভূত হয়ে যাবে শিগগিরই। টেরর ক্যাসল আগলে রাখবে।
মন্দ হবে না, হাসল আরব। গলায় কফ আটকে আছে যেন। তবে, ছুরিটায় কষ্ট করে শান দিয়েছি। একটু ব্যবহার না করলে কেমন দেখায়?
দেখছে মুসা, বুড়ো আঙ্গুলে ছুরির ধার পরীক্ষা করছে আরবটা। সামান্য নড়ে উঠল সাদা বস্তা। আড়চোখে দেখল মুসা। বুঝল, ওটা বস্তা নয়। জালে আটকানো গোয়েন্দাপ্রধান কিশোর পাশা।
বড় দেরি করেছ, বলল আরবটা। যাই দেখি সিলভিয়া কোথায়, উঠে দাঁড়াল সে। ছুরিটা ঢুকিয়ে রাখল কোমরের খাপে। একবার চাইল মেঝেতে পড়ে থাকা ছেলে দুটোর দিকে। আলখেল্লাধারীকে বলল, এস আমার সঙ্গে। গোপন পথটা পরিষ্কার করতে হবে। আমরা এসেছিলাম, তার কোন প্ৰমাণ থাকা চলবে না। এদেরকে নিয়ে ভাবনা নেই। বেরোতে পারবে না জাল থেকে।
ঠিক। তাড়াতাড়ি করা দরকার আমাদের, লণ্ঠনটা দেয়ালের বোল্ট রিঙে ঝোলাল আলখেল্লা। আলো পড়ছে এখন ছেলেদুটোর ওপর।
বেরিয়ে গেছে লোকদুটো। মিলিয়ে গেল ওদের পায়ের আওয়াজ। ভারি পাথর ঘষা লাগার আওয়াজ হল। তারপর সব চুপচাপ।
মুসা, ডাকল কিশোর, ঠিকঠাক আছ?
ঠিকঠাক বলতে কি বোঝাতে চাইছ? নিরস গলায় বলল মুসা। হাড়টাড় ভাঙেনি, এটুকু ঠিক আছি।
ভাল, কিশোরের গলায় ক্ষোভ, নিজের প্রতি! বোকার মত তোমাকে এই বিপদে এনে ফেললাম! নিজের বুদ্ধির ওপর খুব বেশি। ভরসা ছিল আমার!
খামোকা ভেবে মন খারাপ কোরো না, বলল মুসা। একদল ডাকাত এসে আস্তানা গেড়েছে টেরর ক্যাসলে, কি করে জানবে? কোন প্ৰমাণ তো পাওয়া যায়নি আগে।
হাঁ। আমি শিওর ছিলাম, টেরর ক্যাসলের সব কিছুর মূলে শুধু জন ফিলবি। কল্পনাই করিনি, আর কেউ থাকতে পারে। যা হবার হয়ে গেছে, ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তা হাত-পা নাড়াতে পারছ কিছু?
পারছি। শুধু বাঁ হাতের কড়ে আঙুল।
আমি ডান হাত নাড়াতে পারছি, বলল কিশোর। নিজেকে ছাড়াতে পারব মনে হয়। ঠিক জায়গায় পোঁছাচ্ছি কিনা, দেখ।
কাত হয়ে পড়ে আছে কিশোর। মুসা আছে চিত হয়ে। শরীরিটাকে বান মাছের মত বাঁকিয়ে-চুরিয়ে অনেক কষ্টে কাত হল। কিশোরের পিঠ এখন তার দিকে। দেখল, কোমরের বেল্টে আটকানো সুইস ছুরিটা খুলে ফেলতে পেরেছে কিশোর। বিভিন্ন আকারের ছোটবড় আটটা ব্লেড, ছোট একটা স্ক্রু-ড্রাইভার আর একটা কাঁচিও লাগানো আছে বিশেষ কায়দায়।
কাঁচি দিয়ে জালের কয়েকটা ঘর কেটে ফেলল। কিশোর। কাটা জায়গা দিয়ে বের করতে পারছে ডান হাত।
বাঁ পাশে কাটতে পাের। কিনা দেখ, ফিসফিস করে বলল মুসা। ওই হাতটা বের করতে পারলেই কেল্লা ফতে।
ছোট্ট কাঁচি। নাইলনের শক্ত সুতায় তৈরি জাল। এগোতে চাইছে না। কাজ। থামল না কিশোর। চেষ্টা চালিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত মুক্ত করে ফেলল দুই হাত। কোমরের কাছে কাটা শুরু করল। নিচের দিকে ফুট খানেক কেটে ফেলেছে, এই সময় শোনা গেল পায়ের আওয়াজ। তাড়াতাড়ি কাটা জায়গাটা টেনে পিঠের দিকে নিয়ে গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে। দুহাত ঢুকিয়ে নিল জালের ভেতর।
কয়েক মুহূর্ত পরেই ঘরে এসে ঢুকল এক বুড়ি। হাতে বৈদ্যুতিক লণ্ঠন। পরনে জিপসি আলখেল্লা। কানে সোনার বড় বড় রিঙ।
বেশ বেশ, হাঁসের মত প্যাঁকপ্যাঁক করে উঠল যেন বুড়িটা। খুব আরামেই আছ দেখছি, বাছারা। জিপসি কাটির হুঁসিয়ারি তো মানলে না, বিপদে পড়বেই। আমার কথা শুনলে আর এ-অবস্থা হত না।
লণ্ঠন তুলে দেখছে বুড়ি। হঠাৎই মনে হল তার, বড় বেশি স্থির হয়ে আছে ছেলেদুটো। কােন কথা বলছে না, নড়ছে না চড়ছে না। সন্দেহ হল। মুসার কাছে এসে দাঁড়াল। সন্দেহজনক কিছু দেখল না। ঘুরে কিশোরের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তুমি একটু কাত হও তো বাছা, প্যাঁকপ্যাঁক করে উঠল। হাসের গলা। পারছি না? বেশ এই যে, আমি সাহায্য করছি। লণ্ঠনটা নামিয়ে রাখল সে।
জালের কাটা দেখে ফেলল বুড়ি। কিশোরের ডান হাতের কজি চেপে ধরল। মোচড় দিয়ে মুঠো থেকে নিয়ে নিল ছুরিটা। বাহ চমৎকারী পালানোর চেষ্টা করছিলে, ছানারাঃ হঠাৎ গলা চড়িয়ে ডাকল সে, সিলভি। দড়ি, দড়ি নিয়ে এস! শক্ত করে বাঁধতে হবে। ছানাদুটোকে, নইলে উড়ে যাবে।
আসছি, সাড়া এল মহিলাকণ্ঠে। কথায় ব্রিটিশ টান।
খানিক পরেই লম্বা একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল দরজায়। হাতে দড়ির বাণ্ডিল।
চালাক, ভীষণ চালাক ছানাদুটো, বলল বুড়ি। শক্ত করে। বাঁধতে হবে। এস, সাহায্য করা আমাকে।
অসহায় ভাবে চেয়ে চেয়ে সব দেখল মুসা। কোন সাহায্যই করতে পারল না বন্ধুকে। কিশোরের মাথা, গলা আর পিঠের জাল কাটল ওরা প্ৰথমে। দুহাত পিঠের কাছে নিয়ে শক্ত করে বাঁধল দড়ি দিয়ে। টেনে হিঁচড়ে জল খুলে নিল। তারপর বাঁধল পা। কব্জির বাঁধনের ওপর আরেক টুকরো দড়ি বাঁধল। একটা রিং বোল্টের সঙ্গে বেঁধে দিল দড়ির আরেক মাথা।
লম্বা এক টুকরো দড়ি দিয়ে মুসাকে বাঁধা হল এরপর। ওর জাল কাটা নেই কোন জায়গায়। কাজেই জাল ছাড়িয়ে নেবার দরকার মনে করল না বুড়ি। ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল কয়েক প্যাঁচ। বেঁধে দিল দড়ির দুই প্রান্ত।
আর পালাতে পারবে না। ছানারা, বলল হাঁস-গলা। কোন দিনই আর বেরোতে পারবে না। এখান থেকে। ওরা জবাই করে। ফেলতে চাইছে, কিন্তু তার দরকার হবে বলে মনে হয় না। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে গেলে, এই পাতাল থেকে কখনই আর বেরোতে পারবে না এরা।