কোণ ঘুরে আবার এগোল ওরা। কয়েক পা এগিয়েই থমকে দাঁড়াল কিশোর। হাত চেপে ধরল মুসা। ভাঙা অর্গানের সামনে নড়াচড়া করছে স্নান নীল আলো। অন্ধকারেই বুঝতে পারল মুসা, ক্যামেরা রেডি করছে তার সঙ্গী।
পা টিপে টিপে এগোবে, ফিসফিস করে বলল কিশোর। ওর ঠিক পেছনে গিয়ে দাঁড়াব। ছবি তুলব।
কাঁপা কাঁপা আলোটার দিকে চেয়ে রইল মুসা। হঠাৎই দুঃখ হল জন ফিলবির জন্যে। বেচারা এতগুলো বছর নিরাপদে কাটিয়ে বুড়ো বয়েসে একটা ধাক্কা খাবে। মুখোশ খুলে যাবে টেরর ক্যাসলের ভূতের।
ওকে ভয় পাইয়ে দিতে হবে, ফিসফিসিয়ে বলল মুসা। নাম ধরে ডাকলেই তো পারি। বোঝাতে পারি, আমরা ওর শক্র নই, বন্ধু।
ভাল কথা, সায় দিল কিশোর। তবে এখন না। আরও কাছে গিয়ে ডাকব।
নীল আলোর দিকে আবার এগিয়ে চলল ওরা।
মিস্টার ফিলবি! হঠাৎ জোরে ডাক দিল কিশোর। মিস্টার ফিলবি, আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। বন্ধু।
কিছুই ঘটল না। বেজেই চলল। অর্গান, কাঁপতে থাকল নীল আলো।
মিসটার ফিলবি আরও কয়েক পা এগিয়ে আবার ডাকল কিশোর। আমি কিশোর পাশা। আমার সঙ্গে মুসা আমান। আপনার সঙ্গে শুধু কথা বলতে চাই।
থেমে গেল বাজনা।
জোরে কেঁপে উঠল একবার আলোটা। তারপর চলতে শুরু করল। ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। ছাতের কাছে গিয়ে বুলে রইল।
আলোটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর আর মুসা। এই সময়ই টের পেল, কেউ এসে দাঁড়িয়েছে তাদের পেছনে। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘটল ঘটনা। ক্যামেরা হাতেই ধরা রইল। কিশোরের। জ্বলে উঠল মুসার হাতের টর্চ। জালে আটকা পড়ে গেল দুজনে। মাথার ওপর থেকে নেমে এসেছে জাল। এতই আচমকা, কিছু করারই সুযোগ পেল না। ওরা। কাছেই দাঁড়িয়ে আছে দুজন আরব।
ছুটতে গেল মুসা। জালের খোপে পা বেধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। কার্পেটে ঢাকা মেঝেতে। পড়েই গড়ান খেল। পিছলে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করল জালের তলা থেকে। পারল না। আরও পেচিয়ে গেল। জালে আটকা পড়লে মাছের কেমন লাগে, অনুভব করতে পারল সে।
কি-শো-র! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। আমাকে ছাড়াও!
সাড়া এল না।
ঘাড় ফেরাল মুসা। টাৰ্চটা হাতেই ধরা আছে। জ্বালল আবার। বুঝল, কেন সাড়া দিল না কিশোর।
আরেকটা জালে তারই মত আটকে পড়েছে কিশোর। ময়দার বস্তার মত তকে তুলে নিয়েছে দুই আরব। একজন ধরেছে পায়ের দিক, আরেক জন কাঁধ। এগিয়ে যাচ্ছে দরজার দিকে।
জালের ভেতর আটকা পড়ে ছটফট করছে মুসা। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হল। গড়াগড়ি করে ছাড়াতে গিয়ে আরও জড়িয়ে ফেলল। নিজেকে।
চিত হয়ে পড়ে রইল মুসা। ছাতের কাছে এখনও আছে নীল আলো। কাঁপছে। গোয়েন্দা সহকারীর করুণ অবস্থা দেখে নীরব হাসিতে ফেটে পড়ছে যেন।
১৬
ম্লান হতে হতে এক সময় মিলিয়ে গেল নীল আলো। গাঢ় অন্ধকার চেপে ধরল যেন মুসাকে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল সে আরেকবার। পারল না। আরও বেশি শক্ত হল জালের জন্ট। টর্চটা খসে গেছে হাত থেকে। খুঁজে বের করার উপায় নেই।
কায়দামত আটকেছি—ভাবল মুসা। বুড়ো এক অভিনেতাকে ধরতে এসে নিজেরাই ধরা পড়ে গেছে। খুব সুবিধের লোক মনে হল না দুই আরবকে। ওরা তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল অন্ধকারে।
হ্যানসন আর রবিনের কথা ভাবল মুসা। গিরিখাতে বাঁকের ওপাশে অপেক্ষা করছে ওরা। ওদের সঙ্গে কি আর কখনও দেখা হবে? আর কোন দিন কি বাড়ি ফিরে যেতে পারবে সে? মা-বাবার সঙ্গে দেখা হবে?
জীবনে এমন বিপদে আর পড়েনি মুসা। ভাবছে। এইসময় দেখা গেল আলো। এগিয়ে আসছে দুলেন্দুলে। কাছে এসে দাঁড়াল লম্বা এক লোক। হাতে একটা বৈদ্যুতিক লণ্ঠন। সিল্কের আলখেল্লা গায়ে।
বুকল লোকটা। হাতের লণ্ঠন তুলে ভাল করে দেখল মুসাকে। নিষ্ঠুর এক জোড়া চোখ, কেমন ঘোলাটে চাহনি।
হাসল লোকটা। ঝকঝাঁক করে উঠল সোনার দাঁত। বোকা ছেলে! আর সবার মত ভয় পেয়ে চলে গেলেই ভাল করতে। এখন মরবো। জবাই করার ভঙ্গিতে নিজের গলায় আঙুল চালাল লোকটা। বিচ্ছিরি ঘড়ঘড়ে একটা আওয়াজ করল।
ইঙ্গিতটা বুঝল মুসা। দুরুদুরু করে উঠল। বুকের ভেতর। কে আপনি? গলা দিয়ে কোলা ব্যাঙের আওয়াজ বেরোল তার। এখানে কি করছেন?
কি করছি? হাসল লোকটা। পাতালে গেলেই বুঝতে পারবে।
লণ্ঠন নামিয়ে রাখল লোকটা। উবু হয়ে দুহাতে ধরে তুলে নিল মুসাকে। যেন একটা কোলবালিশ, এমনি ভাবে, কাঁধে ফেলল মুসার ভারি দেহটা। লণ্ঠনটা আবার হাতে তুলে নিয়ে এগোেল যেদিক থেকে এসেছিল।
কাঁধে ঝুলে থেকে চলেছে, কোথায় চলেছে, বুঝতে পারল না। মুসা। একটা দরজা পেরোল লোকটা, প্যাসেজ পেরোল। একটা সিঁড়ির মাথায় এসে পৌঁছুল। ঘুরে ঘুরে নেমে গেছে সিঁড়ি। নেমে চলল। লোকটা। অনেক ধাপ পেরিয়ে একটা করিডরে এসে পৌঁছুল। বাতাস ঠাণ্ডা, কেমন ভেজা ভেজা। করিডর পেরোল, আরও কয়েকটা দরজা পেরিয়ে এসে ছোট একটা ঘরে ঢুকল। জেলখানার সেলের মত ঘর। নিশ্চয় মাটির তলায় অনুমান করল মুসা। দেয়ালে গাঁথা মরচে পড়া কয়েকটা রিং-বোল্ট।
সাদা বস্তার মত কি একটা পড়ে আছে এক কোণে। কাছে বসে আছে। একজন আরব, বেঁটোটা। বিশাল এক ছুরিতে শান দিচ্ছে।
আবদাল কোথায়? আলখেল্লাধারী লোকটা জিজ্ঞেস করল। ধপাস করে সাদা বস্তাটার পাশে নামিয়ে রাখল মুসাকে।
সিলভিয়াকে ডাকতে গেছে, ভারি গলা আরবটার। ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরোয় কথা বলার সময়। সিলভিয়া আর জিপসি কাটি লুকিয়ে রেখেছে মুক্তাগুলো। ছেলেদুটোকে নিয়ে কি করা যায়, সবাই বসে আলোচনা করব।