কথা বলবে? গোঙানি বেরোল মুসার গলা থেকে। ভূতের সঙ্গে কথা বলবে!
যদি ধরতে পারি।
আমরা ধরার আগেই যদি আমাদেরকে ধরে? ঘাড় মটকে দেয়?
সে-ভয় কম, জোর দিয়ে বলল কিশোর। এ-পর্যন্ত কারও কোন ক্ষতি করেনি। ওটা। রেকর্ড নেই। এর ওপর অনেকখানি নির্ভর করছি আমি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অনেক ভেবেছি। একটা ধারণা জন্মেছে মনে। পরীক্ষা করে দেখব। আজ। আর খানিক পরেই জানব, ধারণাটা ঠিক কিনা।
যদি ভুল হয়? হঠাৎ যদি আজ ঠিক করে ভূতটা, তার দল বাড়াবে, তাহলে?
তখন মেনে নেব ভুল করেছি, শান্ত গলায় বলল কিশোর। একটা আগাম কথা বলছি। আর কয়েক মুহূর্ত পরেই তীব্র আতঙ্ক এসে চেপে ধরবে। আমাদেরকে।
কয়েক মুহূর্ত পরো প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। তাহলে এখন কি বোধ করছি?
অস্বস্তি।
চল পালাই। দুজনে ছুটে গিয়ে ধাক্কা দিলে ভেঙে যাবে পাল্লা। লাগবে ছুট?
না, মুসার হাত চেপে ধরল। কিশোর। অস্বস্তি, ভয় কিংবা আতঙ্ক কারও কোন ক্ষতি করে না। ওগুলো এক ধরনের অনুভূতি। আতঙ্কিত হয়ে উল্টোপাল্টা কিছু করে না বসলে, কোন ক্ষতিই হবে না তোমার।
জবাবে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। অদ্ভুত এক পরিবর্তন ঘটছে প্যাসেজে। বাজনার শব্দ আর নিজেদের কথাবার্তায় মগ্ন থাকায় এতক্ষণ খেয়াল করেনি। ব্যাপারটা। কুয়াশা! আজব এক ধরনের ধোঁয়াটে কুয়াশা উদয় হয়েছে হঠাৎ । মেঝেতে কুয়াশা, দেয়ালের ধার ঘেঁষে কুয়াশা, সিলিঙে কুয়াশা।
ওপরে নিচে আলো ফেলল। মুসা। উজ্জ্বল আলোয় দেখা গেল, পাক খাচ্ছে কুয়াশা, কুণ্ডলী পাকিয়ে ভাসছে বাতাসে। কোথা থেকে আসছে, বোঝা যাচ্ছে না। বাড়ছে ধীরে ধীরে কুয়াশার ভেতর অদ্ভুত কিছু আকৃতি দেখতে পেল যেন সে।
দেখ দেখা কাঁপা গলায় বলল মুসা। বিচ্ছিরি সব মুখ্যা ওই, ওই যে একটা ড্রাগন. একটা বাঘ. ওরেকবাপারে! ভয়ানক এক জলদস্যু…
থাম! বাধা দিয়ে বলল কিশোর। আমিও দেখছি ওসব ছাতে বসে ভেসে যাওয়া মেঘের দিকে চাইলেও দেখতে পাবে ওই কাণ্ড। এই কুয়াশা কোন ক্ষতি করবে বলে মনে হয় না। তবে আতঙ্ক আসছে।
সঙ্গীর হাতে হাতের চাপ বাড়াল কিশোর। কিশোরের হাত চেপে ধরল মুসা। ঠিকই বলেছে গোয়েন্দাপ্রধান। হঠাৎ তীব্র আতঙ্ক এসে ভর করল মনে, ছড়িয়ে পড়তে লাগল যেন সারা শরীরে। পায়ের তালু থেকে মাথার চাঁদি পর্যন্ত সব জায়গায়। অদ্ভুত শিরশিরে এক অনুভূতি চামড়ায়, কুঁচকে যাবে যেন। ছুটে পালাতে চাইছে সে। শক্ত করে তার হাত ধরে রেখেছে কিশোর, যেতে দিচ্ছে না। একই অনুভূতি হচ্ছে কিশোরেরও, কিন্তু পাথরের মত অটল দাঁড়িয়ে আছে সে।
আতঙ্কের একটা স্রোতের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে যেন ওরা। খেয়াল করল, কুয়াশা বাড়ছে, ঘন হচ্ছে। কুণ্ডলী পাকাচ্ছে, ঘুরছে ফিরছে, ভাসছে বাতাসে। সৃষ্টি করছে আজব আজব সব আকৃতি। কুয়াশাতঙ্ক, অল্প অল্প কাঁপছে কিশোরের গলা। কিন্তু মুসার বাহুতে আঙুলের বাঁধন শিথিল হচ্ছে না। সামান্যতম। অনেক বছর আগে এখানে ঢুকে এর কবলে পড়েছিল কে একজন। রেকর্ড আছে। লোক তাড়ানোর শেষ অন্ত্র টেরর ক্যাসলের। চল, ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে পড়ি এবার। নীল ভূতকে ধরতে হবে। ও হয়ত ভেবে বসে আছে, এতক্ষণে ভয়ে অবশ হয়ে গেছি আমরা।
আমি যাব না, কোনমতে বলল মুসা। দাঁতে দাঁত ঠোকাঠুকি করছে। আমার শরীর অবশ্য কিছুতেই পা নাড়াতে পারছি না!
কি ভাবল কিশোর। তারপর বলল, শোন, খামোকা ভয় পেয় না। ভাবনা-চিন্তা করে কি বুঝেছি আমি জান? বুঝেছি, টেরর ক্যাসল সত্যিই ভূতুড়ে…
সেকথাই তো তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি। এত দিন।
…তবে ভূতুড়ে করে তোলার পেছনে রয়েছে। একজন মানুষ। জীবন্ত মানুষ। জন ফিলবি নিজে। যে আত্মহত্যা করেছে বলে লোকের ধারণা।
বল কি? এতই অবাক হয়েছে মুসা, আতঙ্ক ভুলে গেছে।
ঠিকই বলছি। ভূত সেজে এতগুলো বছর বাস করে আসছে টেরার ক্যাসলে। লোককে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়েছে।
কিন্তু তা কি করে হয়? বিশ্বাস করতে পারছে না মুসা। আমরাও তো কয়েকবার ঢুকলাম ক্যাসলে। কখনও তার দেখা পাইনি। তাছাড়া খাবার? লোকের চোখ এড়িয়ে কি করে জোগাড় করে?
জানি না। দেখা হলে জিজ্ঞেস করব। আসলে লোককে ভয় দেখিয়ে তাড়ানো পর্যন্তই, এর বেশি কিছু করে না সে। কারও কোন ক্ষতি করে না। ক্যাসলটা তার দখলে থাকলেই খুশি। আতঙ্ক গেছে?
আরো হ্যাঁ! চলে গেছে! আর ভয় পাচ্ছি না। পা-ও উঠছে। যেদিকে নিয়ে যাব, যাবে।
চল তাহলে। নীল ভূতের সঙ্গে দেখা করি।
পা বাড়াল কিশোর। পেছনে চলল। মুসা। ভয় কেটে গেছে। অবাক হয়ে ভাবছে, এতগুলো বছর একা টেরর ক্যাসলে কি করে বাস করল। জন ফিলবি আরও অনেক প্রশ্ন এসে ভিড় করছে মনে, কিন্তু জবাব খুঁজে পাচ্ছে না ওগুলোর।
প্যাসেজের শেষ মাথায় দরজার কাছে চলে এল ওরা। অবাক কাণ্ড ধাক্কা দিতেই খুলে গেল পাল্লা। ওপাশে গাঢ় অন্ধকার। কি আছে না আছে, আলো না জ্বেলে বোঝার উপায় নেই। হঠাৎ বেড়ে গেল যেন বাজনার শব্দ। দেয়ালে প্ৰতিহত হচ্ছে। একটা বড় ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা।
প্রোজেকশনরুম, ফিসফিস করে মুসার কানের কাছে বলল কিশোর। আলো জ্বেল না। চমকে দিতে হবে ওকে।
দেয়ালের ধার ঘেঁষে পাশাপাশি এগিয়ে চলল দুজনে। একটা কোণে এসে ঠেকল।
হঠাৎ গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল মুসা। নরম হালকা কিছু একটা তার মুখ-মাথা পেচিয়ে ধরেছে। টেনে সরাতে গিয়েই বুঝল, মখমলের ছেড়া পর্দার কাপড়।