দীর্ঘ কয়েকটা মুহূর্ত। তারপর কিশোর বলল, আমি বললেই সরাসরি ওটার ওপর আলো ফেলবো ফেল!
নড়ে উঠল মেয়েটা। নড়ে উঠল একটা চকচকে কি যেন।
একই সঙ্গে ঘুরে গেল দুটো টর্চ।
কিন্তু কোথায় মেয়ে! একটা বড় আয়নার ওপর আলো পড়েছে। প্রতিফলিত হয়ে এসে লাগছে দুজনের চোখে।
আয়না অবাক গলায় বলল মুসা। তারমানে আমাদের পেছনে রয়েছে মেয়েটা।
পাই করে ঘুরল মুসা। আলো ফেলল। পেছন দিকে। নেই। কোন মেয়ে নেই। শুধু দেয়াল।
চলে গেছে। মুসার গলায় ভয়। আমিও যাচ্ছি। এই ভূতের আড্ডায় আর আমি নেই। পা বাড়ল সে।
দাঁড়াও! সঙ্গীর হাত চেপে ধরল। কিশোর। আয়নার দিকে চেয়েছিলাম আমরা। মেয়েটেয়ে নয়, চোখের ভুলও হতে পারে। বেশি তাড়াহুড়ো করে ফেলেছি। আরও সাবধান হওয়া উচিত ছিল আমাদের।
হলে না কেন? ক্যামেরা তো তোমার কাঁধেই। ছবি তুললে না কেন?
ভুলেই গিয়েছিলাম। ক্যামেরার কথা। নিজের ওপর ওপরই বিরক্ত কিশোর।
মনে থাকলেও লাভ হত না। ছবি ওঠে না ভুতের। ওরা অশরীরী। ভুতের।
ওরা তো অশরীরীর প্রতিবিম্ব হয় না, মনে করিয়ে দিল কিশোর। মানে দাঁড়াচ্ছে, সে অশরীরী নয়। আয়নার ভেতরে ছিল, তাই বা বিশ্বাস করি কি করে। আয়না-ভূতের কথা শুনিনি কখনও! আবার যদি দেখা দিত মেয়েটা।
দেখা না দিলেই ভাল, জোরে বলল মুসা, ভূতকে শোনাল যেন। আর দাঁড়িয়ে থেকে লাভ কি হবে? কি দেখবে? টেরর ক্যাসলে। ভূত আছে, এটা প্রমাণ হয়ে গেল। চল, ফিরে গিয়ে সব জানাই মিস্টার ক্রিস্টোফারকে।
এখুনি ফিরে যাব কি? মাত্র তো এলাম। আরও অনেক কিছু জানার আছে। নীল ভূতকে না দেখে যাব না। ছবি তুলব। ওটার, স্থির শান্ত গলা কিশোরের।
কিশোর ভয় পাচ্ছে না, সে অত ঘাবড়াচ্ছে কেন?—নিজেকে ধমক লাগাল মুসা। কাঁধ ঝাঁকাল। ঠিক আছে। আচ্ছা, এক কাজ করলে তো পারি? এ ঘর থেকেই চকের চিহ্ন রেখে যাই আমরা।
ঠিক বলেছা হল কি আমার! সব খালি ভুলে যাচ্ছি।
খোলা জানালাটার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। এটা দিয়েই ঢুকেছে। ওরা। পাল্লায় বড় করে একটা প্ৰশ্নবোধক আকল। ডাইনিং টেবিলে আকল একটা। তারপর গিয়ে দাঁড়াল আয়নার সামনে। প্ৰশ্নবোধক আঁকবে। আমরা এ ঘরে ছিলাম, জানবে হ্যানসন আর রবিন।
আমরা আর ফিরে না গেলে, তখন তো? প্রশ্ন করল মুসা।
জবাব দিল না কিশোর। আয়নায় প্রশ্নবোধক আকার চেষ্টা করল। প্রথমবারে চকের দাগ বসল না ঠিকমত। দ্বিতীয়বার জোরে চাপ দিয়ে আঁকতে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঘটল একটা অদ্ভুত কাণ্ড। নিঃশব্দে পেছনে সরে গেল আয়না, দরজার পাল্লার মত। ওপাশে প্যাসেজ। গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা।
১৫
অবাক হয়ে অন্ধকার প্যাসেজের দিকে চেয়ে আছে দুজন।
ইয়াল্লা বলে উঠল মুসা। একটা গোপন পথ!
আয়নার পেছনে লুকানো! ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোরের। ভেতরে ঢুকব, দেখব, কি আছে।
মুসা প্ৰতিবাদ করার আগেই প্যাসেজে পা রাখল কিশোর। টর্চের আলোয় দেখা গেল, সরু লম্বা একটা প্যাসেজ। দুপাশে অমসৃণ পাথরের দেয়াল। প্যাসেজের শেষ মাথায় একটা দরজা।
এস, ফিরে মুসাকে ডাকল কিশোর। কোথায় আমাদেরকে নিয়ে যায় প্যাসেজটা, দেখি।
দ্বিধায় পড়ে গেল মুসা। প্যাসেজে ঢোকাটা মোটেই পছন্দ হচ্ছে না। তার। এদিকে অন্ধকার ঘরে একা থাকতেও চায় না। শেষে ঢুকেই পড়ল।
আলো ফেলে দুপাশের দেয়াল দেখল কিশোর। আয়না বসানো দরজাটা পরীক্ষা করল। সাধারণ দরজা, কাঠের পাল্লা। এক পাশে পাল্লার সমান একটা আয়না বসানো। কোন নব নেই, ছিটিকিনি নেই।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল কিশোর। বন্ধ করে আবার খোলে কি করো নিশ্চয় গোপন কোন ব্যবস্থা আছে।
ঠেলে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল কিশোর। মোলায়েম একটা ক্লিক করে আটকে গেল পাল্লা।
সেরেছো? চেঁচিয়ে উঠল মুসা। বন্দি হয়ে গেলাম!
হুমম। আপনমনেই মাথা দোলাল কিশোর। পাল্লার ধারে আঙুল চালিয়ে দেখল, কোন খাঁজ আছে কিনা, ধরে টান দেয়া যায় কিনা। কিছু নেই। দরজার ফ্রেম, পাল্লা মসৃণ করে চাঁছা। ফ্রেমের মধ্যে নিখুঁত ভাবে বসে গেছে পাল্লাটা, ফাঁক নেই।
কোন না কোন উপায় আছেই খোলার, বিড়বিড় করল। কিশোর। ওপাশ থেকে তো খুব সহজেই খুলে গেলা ব্যাপারটা কি?
সেটা তুমি বোঝ, বলল মুসা। আবার সহজে খুলে গেলেই বাঁচি বেরিয়ে যেতে আমি।
বেশি পুরু না। ভাঙার দরকার পড়বে মনে হয় না। প্যাসেজের আরেক দিকে তো পথ রয়েছেই।
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। ঘুরে রওনা হয়ে গেছে গোয়েন্দাপ্রধান।
এক পা দুপা করে এগিয়ে চলেছে। নিরেট, এক সময় বলল সে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। শুনতে পাচ্ছি।
দাঁড়িয়ে পড়ল। মুসাও। কান পাতল।
অর্গান বাজছে। বহুদূর থেকে ভেসে আসছে যেন শব্দটা। কাঁপা কাঁপা। সেই সঙ্গে মিশেছে তীক্ষ্ম ক্যাঁচকোচ আর চাপা চিৎকার। এর আগের বার যেমন শুনেছিল মুসা, ঠিক তেমনি। পরিবর্তন নেই।
নীল ভুতা চাপা গলায় বলল গোয়েন্দা সহকারী। অর্গান বাজাচ্ছে!
একদিকের দেয়ালে কান চেপে ধরল। কিশোর। ধরে রইল। দীর্ঘ এক সেকেণ্ড। সরে এল। দেয়াল ভেদ করেই যেন আসছে। আওয়াজ! মানে কি? দেয়ালের ঠিক ওপাশেই আছে। অর্গানটা।
বলতে চাইছ, এই দেয়ালের ওপাশেই আছে ভূতটা আঁতকে উঠল মুসা।
আমার তাই ধারণা, বলল কিশোর। যে করেই হোক, আজ ওর ছবি তুলবই। সম্ভব হলে কথাও বলব।