জোরে জোরে বললাম, অত ভয় পাবার কিছু নেই। আমি মুসা। আমার কথা কানেই ঢুকাল না যেন রবিনের। কানের কাছে মুখ নিয়ে চোঁচাতে তবে থামল। শান্ত হল। ওকে ধরে তুললাম।
ইচ্ছে করেই ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা করেছ। আমাকে তুমি! রবিনের গলায় অনুযোগ।
কসম খোদার, রবিন, তোমাকে ভয় পাওয়াব কি, আমারই তো অবস্থা তখন কাহিল। পেছন ফিরে দেখলাম তুমি নেই। ফিরতেই হল। খুব ভয়ে ভয়ে পা ফেলেছি। সারাক্ষণই মনে হয়েছে, এই বুঝি ধরল এসে নীল ভূতের বাচ্চা।
দুজনেই তাকাল কিশোরের দিকে।
ওদের কথা শুনছে না গোয়েন্দাপ্রধান। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে চুপচাপ।
দুজনেই উঠে দাঁড়ালে তোমরা, তারপর? হঠাৎ প্রশ্ন করল কিশোর। আবিষ্কার করলে আতঙ্ক, ভয়, কিছুই নেই। এমনকি অস্বস্তিবোধও চলে গেছে, তাই না?
চাওয়া চাওয়ি করল মুসা আর রবিন। কি করে আন্দাজ করল। কিশোর? এই কথাটা সব শেষে বলে চমকে দেবে প্রধানকে, ভেবে রেখেছে ওরা।
ঠিক, জবাব দিল মুসা। কিন্তু তুমি জানলে কি করে?
মুসার প্রশ্নটা যেন শুনতেই পায়নি। কিশোর। আপনমনে বলল, তারমানে, টেরর ক্যাসলের বাইরে এলেই চলে যায়। ওসব অনুভূতি গুড। একটা কাজের কাজ করে এসেছি।
তাই? রবিনের প্রশ্ন।
তাই। হ্যাঁ, ছবিগুলো নিশ্চয় শুকিয়েছে এতক্ষণে। আন না, দেখি। নাহ, জ্বলিয়ে মারবে চাচা ভেন্টিলেটর বন্ধ করতে উঠে গেল কিশোর।
অর্গান পাইপ বসানোর কাজ শেষ করে ফেলেছেন রাশেদ চাচা। বোরিস আর রাভার তাঁকে সাহায্য করেছে। কিশোরও করেছে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে। অর্গান পাইপের ওপর লেখা একটা বই খুঁটিয়ে পড়েছে সে। চাচাকে জানিয়েছে, কোন জোড়াটা কোথায় কিভাবে লাগাতে হবে। কাজ শেষ করেই বাজাতে বসে গেছে। চাচা। ইয়ার্ডের আর সব কাজ বাদ দিয়ে তাঁর সঙ্গে জুটেছে বোরিস আর রোভার।
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বাজছে অর্গান। ভয়াবহ। আওয়াজ। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি-র সুর বাজানোর চেষ্টা করছেন চাচা আনাড়ি হাতে। ঠিক হচ্ছে না। তবু তালে তালে মাথা দোলাচ্ছে দুই ব্যাভারিয়ান ভাই। তারিফ করছে সুরের। ওদের ধারণা, বাদক হিসেবে জুড়ি নেই রাশেদ পাশার।
শব্দের ধাক্কায় কাঁপছে পুরো ইয়ার্ড। ট্রেলারের ছাতের খোলা ভেন্টিলেটর দিয়ে আসছে আওয়াজ। কান ঝালাপালা করে দিতে চাইছে। সুর চড়া পর্দায় যখন উঠছে, থারথার করে কেঁপে উঠছে। ট্রেলারের দেয়াল।
ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দিয়ে ফিরে এল কিশোর।
ডার্করুম থেকে ছবি নিয়ে ফিরল রবিন।
ছবি পরীক্ষা করে দেখতে বসল। কিশোর। ভেজা ভেজা রয়েছে এখনও। একটা করে ছবি টেনে নিয়ে বড় রীডিং গ্লাসের তলায় ফেলছে সে, ভাল করে দেখছে, তারপর ঠেলে দিচ্ছে রবিন আর মুসার দিকে।
অনেক সময় লাগিয়ে পরীক্ষা করল আর্মার সুট আর জন ফিলবির লাইব্রেরির ছবি। মুখ না তুলেই বলল, ভাল ছবি তুলেছ, রবিন। তবে আসল কাজটাই পারনি। নীল ভূতের ছবি তোলা দরকার ছিল।
ভাল বলেছ! অন্ধকারে কয়েক ডজন চেয়ার ডিঙিয়ে অর্গানের কাছে। যাই। ছবি তোলার আগেই তো আমার ঘাড়টা মটকে দিত নীল হারামজাদা!
পালাতে পেরেছি। এই যথেষ্ট, আবার ছবি! যোগ করল মুসা। তীব্র আতঙ্ক চেপে ধরেছে। দিশেহারা হয়ে পড়েছি। তুমিও ছবি তুলতে পারতে না তখন।
ঠিকই, পারতাম না, স্বীকার করল কিশোর। আতঙ্কিত হয়ে পড়লে মাথার ঠিক থাকে না। তবে, তুলে আনা গেলে খুব সুবিধে হত। কিনারা করা যেত রহস্যটার।
চুপ করে রইল মুসা আর রবিন।
অদ্ভুত একটা ব্যাপার ভেবে দেখেছ? বলল কিশোর। টেরর ক্যাসলের ভূত সূর্য ডোবার আগেই দেখা দিয়েছে।
কিন্তু ক্যাসেলের ভেতরে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, প্রতিবাদ করল মুসা। বেড়ালেও দেখতে পেত কিনা সন্দেহ!
তবু, বাইরে তখনও সূর্য ডোবেনি। রাত নামার আগে ভূত বেরিয়েছে, এমন শোনা যায়নি। কখনও। যাকগে। ওসব নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন ছবিগুলো দেখি।
আর্মর সুটের ছবির দিকে আবার চাইল কিশোর। এখনও চকচকে আছে সুন্টটা। মরচে পড়েনি।
ঠিকই, সায় দিল রবি। দুয়েকটা জোড়ায় মরচে দেখেছি শুধু। এছাড়া পুরো সুটটাই চকচকে।
আর এই যে, লাইব্রেরির বইগুলো। ধুলোয় মাখামাখি হয়ে থাকার কথা ছিল। নেই।
হালকা ধুলো ছিল, বলল মুসা। তবে অনেক দিন পড়ে থাকলে যতটা থাকার কথা, ততটা নয়।
হুমম! মমি-কেসে রাখা কঙ্কালের ছবিটা টেনে নিল কিশোর। নিজের কঙ্কাল উপহার দেয়া! সত্যি অদ্ভুত।
ঠিক এই সময় দাড়াম করে শব্দ হল একটা! জঞ্জালের স্তুপ থেকে লোহার ভারি কিছু খসে পড়েছে, আছড়ে পড়েছে ট্রেলারের গায়ে। কারণ-অর্গান পাইপ। আরও জোরে বাজছে এখন।
সর্বনাশ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ভূমিকম্প শুরু হবে!
কান খারাপ হয়ে গেল নাকি চাচারা ভুরু কোঁচকাল কিশোর। আর সইতে পারছি না! বেরিয়ে যেতে হবে! জিনিসটা দিয়েই বেরিয়ে পড়ব।
অপেক্ষা করে রইল রবিন আর মুসা, উৎসুক দৃষ্টি।
টেবিলের ড্রয়ার থেকে তিনটে লম্বা চক বের করল। কিশোর। সাধারণ চক। একটা নীল, একটা সবুজ, অন্যটা সাদা।
এগুলো কেন? জানতে চাইল মুসা।
আমাদের চিহ্ন রেখে যাবার জন্যে, বলতে বলতেই সাদা চক দিয়ে দেয়ালে বড় একটা প্ৰশ্নবোধক আকল কিশোর। সাদা প্ৰশ্নবোধক, আমার চিহ্ন। সবুজ রবিনের, আর নীল তোমার। কোথাও পথ হারিয়ে ফেললে, এই চিহ্ন রেখে যাব আমরা। কে হারিয়েছি, কোন পথ দিয়ে গেছি, খুব সহজেই বুঝতে পারব অন্য দুজন। অনুসরণ করা সহজ হবে।