ওদিক থেকে আসছে, আঙুল তুলে একটা দরজা দেখিয়ে বলল মুসা।
তাহলে চল ওদিকে যাই। উল্টো দিকের আরেকটা দরজা দেখাল। রবিন।
না, ওটা দিয়েই যাওয়া উচিত, আগের দরজাটা আবার দেখাল মুসা। নিশ্চয় প্রোজেকশন রুমে ঢুকব গিয়ে। ঘরটা চেনা। অচেনা কোন ঘরে ঢুকতে আর রাজি নই। আমি। এখন তো নয়ই।
দরজা খুলল মুসা। অন্ধকার একটা ঘরে ঢুকল দুজনে। স্নান আলোয় পথ দেখে এগিয়ে চলল। বাড়ছে বাজনার শব্দ। এখনও অনেক দূরে মনে হচ্ছে। তীক্ষ্ণ ক্যাঁচক্যাঁচ। আর চাপা চিৎকার কেমন ভূতুড়ে করে তুলেছে। অর্গানের বাজনাকো
এগিয়ে চলেছে দুজনে। সামনে মুসা। তার ঠিক পেছনেই রবিন। যতই এগোচ্ছে, বাড়ছে অস্বস্তি-বোধ।
হলের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল ওরা। একটা দরজা। ঠেলে দিল মুসা। খুলে গেল পাল্লা। প্রোজেকশন রুমে ঢুকল দুজনে।
সামনেই পোড়ে আছে সারি সারি চেয়ার। ম্লান আলোয় সামনের কয়েকটা চেয়ার দেখা যাচ্ছে। আবছাভাবে। অর্গান পাইপটা রয়েছে। অন্য প্রান্তে। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। যেদিক থেকে বাজনার শব্দ আসছে, সেদিকে তাকাল মুসা। খপ করে চেপে ধরল রবিনের একটা হাত।
রবিনও তাকাল। স্থির হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। মেঝের ফুট চারেক উঁচুতে বাতাসে ঝুলে আছে অদ্ভুত নীল আলো। নির্দিষ্ট কোন আকার নেই। মুহূর্তে মুহূর্তে বিভিন্ন আকৃতি নিচ্ছে আলোটা, কাঁপছে থিরথির করে। ক্রমেই বাড়ছে অর্গান পাইপের বাজনা, সেই সঙ্গে তীক্ষা ক্যাঁচকোঁচ। আর চাপা চিৎকার যেন সঙ্গত করছে।
নীল ভূতা ফিসফিস করে বলল রবিন। অস্বস্তিবোধ উৎকণ্ঠায় রূপ নিয়েছে। ভয়ে বুক কাঁপছে দুরু-দুরু। তীব্র আতঙ্কে রূপ নিতে বেশি দেরি নেই। আর। কোন দরজা দিয়ে গেলে ইকো রুমে যাওয়া যায়, আন্দাজ করে নিল ওরা। ছুটল।
ধাক্কা দিয়ে পাল্লা খুলে ফেলল। মুসা। প্রায় ছিটকে এসে পড়ল ইকো রুমে। হলের দিকে ছুটল।
হল, সদর দরজা পেরিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এল দুজনে তবু থামল না। সিঁড়ি টপকে নেমে চলল। মুসার সঙ্গে পেরে উঠছে না। রবিন, পা ভাঙা। পেছনে পড়ে গেল সে।
খিঁচে দৌড়াচ্ছে মুসা। পা টেনে টেনে যত জোরে সম্ভব, ছুটছে রবিন।
অন্ধকার। ঢাল বেয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পা পিছলাল রবিন। হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বার দুই ডিগবাজি খেল, তারপর গড়াতে শুরু করল। তার দেহ। কিছুতেই ঠেকাতে পারছে না। কয়েক গড়ান দিয়ে একটা পাথরের ভূপে এসে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল দেহটা। কান্নার মত ফোঁপানি বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
ধরেই নিয়েছে। রবিন, পেছনে তাড়া করে আসছে নীল অশরীরী। অপেক্ষা করছে। ওটার জন্যে। বুকের ভেতরে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন। হাপরের মত ওঠা নামা করছে বুক।
শব্দটা হঠাৎ কানে এল রবিনের। পায়ের আওয়াজ। চাপা। এক কদম… দুই কদম করে এগিয়ে আসছে। নিশ্চয় নীল ভূতা অন্ধকারে খুঁজছে তাকো
থামছে না, এগিয়েই আসছে শব্দটা। কাছে, আরও কাছে। ঠিক পেছনে। থেমে গেল শব্দ।
ফিরে চাইবার সাহস নেই রবিনের। পাথরে মুখ গুজে পড়ে আছে।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল মূর্তিটা। তার শ্বাস ফেলার চাপা ফোঁস ফোঁস কানে আসছে। রবিনের। হঠাৎ পিঠে ছোঁয়া লাগল, হাতের তালুর আলতো চাপ। তারপর আলতো ঘষা, ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। নিশ্চয় গলা খুঁজছে, আন্দাজ করল রবিন। নড়ার শক্তি নেই যেন, অবশ আসছে দেহ।
ঘাড়ের কাছে এসে থামল হাতটা। চাপ বাড়ল একটু। চেঁচিয়ে উঠল। রবিন। তীক্ষ্ণ তীব্র চিৎকারে খান খান হয়ে ভেঙে গেল অখণ্ড নীরবতা। প্ৰতিধ্বনি তুলল পাহাড়ে পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে।
১৩
তারপর? নীল ভূত তোমার ঘাড়ে হাত রাখল, তারপর কি হল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
হেডকোয়ার্টারে বসে আছে তিন গোয়েন্দা। তিন দিন পর আবার এক জায়গায় মিলতে পেরেছে তিনজনে। বাবা-মার সঙ্গে স্যান ফ্রান্সিসকোয় আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিল মুসা। লাইব্রেরিতে কাজের চাপ পড়েছিল রবিনের। এক সহকমী ছুটি নিয়েছিল, ফলে দুজনের কাজ একাই করতে হয়েছে তাকে। কিশোর পড়েছিল বিছানায়, একনাগাড়ে তিনটে দিন। কথা বলার কেউ ছিল না। খালি বই পড়ে কাটিয়েছে।
তারপর কি হল, বললে না? রবিনকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করল। কিশোর।
মানে.আমি চেঁচিয়ে উঠার পর? ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে চাইছে না। রবিন, বোঝা যাচ্ছে।
নিশ্চয়। চেঁচিয়ে উঠলে, তারপর?
মুসাকেই জিজ্ঞেস কর না, এড়িয়ে যেতে চাইছে। রবিন। ও- ও তো ছিল সঙ্গে।
ঠিক আছে। মুসা, কি ঘটেছিল?
ঢোক গিলল একবার মুসা। ইয়ে…আমি পড়লাম…মানে…
পড়ল। তো রবিন, তুমি পড়লে কি করে?
ওর ঘাড়ে হাত রাখতেই চেঁচিয়ে উঠল। জোরে লাথি মেরে বসল আমার পায়ে। পায়ের তলায় পাথর ছিল, সামলাতে পারলাম না। পড়ে গেলাম ওর পিঠে। নিচে পড়ে ছটফট করতে লাগল ও, একেবেঁকে সরে যাবার চেষ্টা করল। গলা ফাটিয়ে চোঁচাতে লাগল। বললঃ আমাকে ছেড়ে দাও, ভূত, প্লাজ! খামোকা ছুচো মেরে হাত গন্ধ করবে কেন…
কক্ষণো বলিনি। আমি একথা! চেঁচিয়ে প্রতিবাদ করল রবিন।
হ্যাঁ, বলেছ। ভুলে গেছ এখন।
না, বলিনি!
বললেই বা কি হয়েছে? রবিনের পক্ষ নিল কিশোর। ওর সাহস আছে, স্বীকার করতেই হবে। ওই অবস্থায় আমি পড়লেও ভয় পেতাম। ও তো প্যান্ট খারাপ করেনি। হ্যাঁ, তারপর?