না, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল রবিন। পা ভাঙা। উঠতে কষ্ট হচ্ছে তার, কিন্তু মুসাকে বুঝতে দিচ্ছে না। আমি খেয়াল রেখেছিলাম। ওর নীল গাড়ির ছায়াও দেখিনি। কিশোরের ধারণা, টেরর ক্যাসলের ধার মাড়াবে না। আর শুটকি।
আমরাও মাড়াতে চাইনি, জোর করে পাঠানো হয়েছে। তবে, শুটকিকে হয়ত জোর করেও পাঠানো যাবে না।
রবিনের কাঁধে বুলছে ক্যামেরা। মুসার হাতে টেপ রেকর্ডার। কোমরের বেল্টে আটকে নিয়েছে টৰ্চ, দুজনেই। টেরর ক্যাসলের বারান্দায় উঠে এল ওরা। হলে ঢোকার বড় দরজাটা বন্ধ।
তাজ্জব ব্যাপার তো! ভুরু কুঁচকে গেছে মুসার। শুটকি দরজা খোলা রেখেই পালিয়েছিল, দেখেছি।
বাতাসে বন্ধ হয়ে গেছে হয়ত, বলল রবিন।
হাত বাড়িয়ে দরজার নব চেপে ধরল। মুসা। ঘোরাল। ঠেলা দিতেই তীক্ষ্ণ ক্যাঁ-অ্যাঁ-চ্- চ্- চ্ শব্দ করে খুলে গেল ভারি দরজা।
মরচে পড়ে গেছে কবজায়, মন্তব্য করল রবিন। ওই শব্দে ভয় পাবার কিছু নেই, নিজেকেই যেন বোঝাল সে।
কে বলল, ভয় পেয়েছি? স্বীকার করতে রাজি না মুসা।
দরজা খোলা রেখেই হলে ঢুকে পড়ল। ওরা। হলের এক পাশে একটা বড় ঘর। ঢুকাল ওরা। পুরানো আসবাবপত্রে বোঝাই। কাঠের ভারি ভরি চেয়ার টেবিল, বিরাট ফায়ার প্লেস। রহস্যজনক কিছু দেখলেই ছবি তুলে নিতে বলে দিয়েছে কিশোর। কিন্তু তোলার মত তেমন কিছুই চোখে পড়ল না রবিনের। তবু ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ঘরের গোটা দুয়েক ছবি তুলে নিল সে।
তারপর ইকো রুমে এসে ঢুকাল ওরা। ঘরে আবছা আলো আঁধারির খেলা! গা শিরশিরে একটা অনুভূতি আবহাওয়ায়, অস্বস্তিকর। বিচিত্র আর্মার স্যুট আর বিভিন্ন ভঙ্গিতে তোলা জন ফিলবির ছবিগুলোর দিকে চাইলে আরও বেড়ে যায় অস্বস্তি ভাবটা। একপাশে সিঁড়ি, দোতলায় উঠে গেছে। মাঝামাঝি জায়গায় একপাশের দেয়ালে কয়েকটা জানালা। কাচের শার্শি। ধুলোর পুরু আস্তরণ। ওপথেই আসছে আলো।
মিউজিয়ম মনে হচ্ছে, বলল রবিন। জানই তো, যে-কোন মিউজিয়মে ঢুকলেই কেমন জানি হয়ে যায় মন।
ঠিক, সায় দিল মুসা। ঠিক ধরেছ। সেই অনুভূতি। মিউজিয়মে ঢুকলে এমন হয়। কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেল সে। ধুলো-বালি, পুরানো, কেমন যেন মরা মরা…।
মরা-অরা-অরা-অরা-অরা-অর!
ঘরের ঠিক মাঝামাঝি গিয়ে শেষ শব্দটা উচ্চারণ করছে মুসা, বেশ জোরে। এক লাফে পিছিয়ে এল।
ওরে-ব্বাপরে! এত জোরালা বলতে বলতেই ঘরের ঠিক মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল রবিন। প্ৰতিধ্বনি।
ধ্বনি-অনি-অনি-অনি-অনি-অনি!
হাত চেপে ধরে একটানে রবিনকে সরিয়ে আনল। মুসা। ওখানে দাঁড়িয়ে জোরে কথা বললেই ওই কাণ্ড ঘটে।
প্ৰতিধ্বনি পছন্দ করে রবিন। জোরে হাল্লো বলার ইচ্ছেটা চাপা দিতে হল। ইকো হলের প্রতিধ্বনি মজার নয়, বরং কেমন অস্বস্তি জাগায়।
চল, ছবিটা দেখি, বলল রবিন। ওই যে, যেটা চোখ টিপেছিল তোমার দিকে চেয়ে।
ওই তো, হাত তুলে দেখাল মুসা। জলদস্যুর সাজে জন ফিলবি।
চল, ভালমত দেখি, বলল রবিন। একটা চেয়ারে দাঁড়িয়ে দেখ তো, নাগাল পাও কিনা।
ভারি, পিঠবাঁকা একটা কাঠের চেয়ার ছবিটার তলায় নিয়ে এল মুসা। উঠল চেয়ারে। পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েও নাগাল পেল না ছবিটার।
ওই যে একটা ব্যালকনি, ছবিটার ওপর দিকে চেয়ে বলল রবিন। ওখান থেকে লম্বা তার দিয়ে বুলিয়ে দেয়া হয়েছে ছবি। চল উঠে যাই। তার ধরে টেনে তুলে নিতে পারব ছবিটা।
সিড়ির দিকে এগোনোর জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে গেল। রবিন। আধাপাক ঘুরেছে, এই সময় তার ক্যামেরা-কেসের চামড়ার ফিতে আটকাল কেউ। চমকে ফিরে চাইল রবিন। ঠিক তার পেছনে, আবছা! অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা এক মূর্তি। গলা চিরে বিকট চিৎকার বেরিয়ে এল। তার, খিচে দৌড় মারতে চাইল দরজার দিকে।
পারল না। ফিতোয় হ্যাঁচকা টান লাগল, আবার পিছিয়ে গেল। রবিন। ভারসাম্য হারাল। কান্ত হয়ে গেল এক পাশে। মুখ ফিরিয়ে চাইল কি আছে পেছনে। আর্মর সুট পরা এক বিরাট মূর্তি, কোপ মারার ভঙ্গিতে মাথার উপর তুলে রেখেছে তলোয়ার।
আবার চিৎকার বেরোলি রবিনের গলা চিরে। পড়ে গেল। মার্বেলের মেঝেতে। সঙ্গে সঙ্গে গড়ান দিয়ে সরে গেল একপাশে।
খটাং করে মেঝেতে পড়ল তলোয়ার, মুহূর্ত আগে ঠিক ওই জায়গাতেই ছিল রবিন। তলোয়ারের পাশেই পড়ল। মূর্তিটা। বদ্ধ ঘরে বিকট আওয়াজ হল। ইস্পাতের খালি ড্রােম পড়ল যেন একটা।
ফিতেয় টান নেই। আর এখন। গড়িয়ে দূরে সরে গেল। রবিন। দেয়ালে এসে ঠেকার আগে থামল না। ফিরে চাইল। খাড়া হয়ে গেছে ঘাড়ের চুল। তার দিকে তেড়ে আসছে না। আর্মর সুট পরা মূর্তি। ধড় থেকে মাথা আলাদা হয়ে গেছে। ওটার। গড়াতে গড়াতে চলে যাচ্ছে মেঝের ওপর দিয়ে। থেমে গোল দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে।
আরও কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে উঠল রবিন। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল পড়ে থাকা ধড়টার দিকে। পাশে গিয়ে বসল ভয়ে ভয়ে। ধড়ের গলার ভেতরে একবার উঁকি দিয়েই হাঁপ ছাড়ল। খালি। আসলে ওটা একটা আর্মর সুট। আস্ত। কায়দা করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল দেয়ালে ঠেকা দিয়ে। একটা হাত ওপরের দিকে তুলে আটকে দেয়া হয়েছিল কোনভাবে। হাতের মুঠোয় ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল তলোয়ার। খুব কাছাকাছি গিয়েছিল রবিন। বেঁধে গিয়েছিল ফিতে। রবিন পাশে ঘোরার সময় টান লেগেছে, পড়ে গেছে মূর্তিটা। চোট সইতে না পেরে গলা থেকে আলগা হয়ে গেছে লোহার শিরস্ত্ৰাণ।