খাঁচার কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল দুজনে। চেয়ে আছে উজ্জ্বল রঙের পাখিগুলোর দিকে। এই সময় পেছনে শোনা গেল পায়ের আওয়াজ।
প্রায় একই সঙ্গে ঘুরে দাঁড়াল দুজনে। যে পথে এসেছে ওরা, সেপথেই আসতে দেখল লোকটাকে। লম্বা, পুরো মাথা জুড়ে টাক, বিরাট সানগ্রাসের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চোখ। এক কানের নিচ থেকে শুরু হয়েছে গভীর কাটা একটা দাগ, গলা বেয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে, বুকের হাড়ের কাছে গিয়ে ঠেকেছে।
কথা বলে উঠল। লোকটা। গা ছমছম করা কেমন এক ধরনের ফিসফিসে আওয়াজ। খবরদার, যেখানে আছ দাঁড়িয়ে থাকা একচুল নড়বে না কেউ।
স্থির হয়ে গেল দুজনেই।
ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল লোকটা। বাঁ হাতে বাগিয়ে ধরে আছে একটা মাচেটে। রোদ লেগে ঝিলিক দিয়ে উঠছে বিশাল ছুরির তীক্ষ্ণধার ফলা।
৯
এক পা দুপা করে এগিয়ে আসছে লোকটা।
একটু নড়বে না ফিসফিসিয়ে উঠল আবার সে। প্ৰাণের ভয় থাকলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা।
মুসার কাছে এই হুশিয়ারি অহেতুক। নড়ছে না। সে এমনিতেই। হঠাৎ বিদ্যুতের চমক দেখা দিল তার আর কিশোরের মাঝামাঝি। দুজনের উরুর কাছ দিয়ে উড়ে চলে গেল মাচেটে। ঘাঁচ করে গিয়ে বিধল মাটিতে।
হতাশ গলায় বলে উঠল। লোকটা, উহহঁ, গেল মিস হয়ে। সানগ্লাস খুলে আনল চোখের ওপর থেকে। নীল আন্তরিক চোখে চেয়ে আছে ছেলেদের দিকে। খানিক আগের মত ভয়াবহ। আর লাগছে না এখন তাকে।
তোমাদের পেছনে ঘাসের ভেতরে ছিল সাপটা, সাফাই গাইল লোকটা। র্যাটলার কিনা বুঝতে পারলাম না। বেশি তাড়াহুড়ো করে। ফেলেছি, সেজন্যেই ফসকে গেল নিশানা।
সাদায়-লালে মেশানো একটা রুমাল বের করে ভুরুর কাছের ঘাম মুছল লোকটা। পাহাড়ের ওপাশে ঝোপঝাড় পরিষ্কার করছিলাম। বাজে জিনিস। দাবানল ছড়ানোর ওস্তাদ। ইসস, ঘেমে নেয়ে গেছি। একেবারে। এক গ্রাস করে লেমোনেড খেলে কেমন হয়, অ্যাঁ?
লোকটার ফিসফিসানিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইতিমধ্যে দুই গোয়েন্দা। মুসা আন্দাজ করল, গলার বিচ্ছিরি কাটাটাই ওই স্বর বিকৃতির জন্যে দায়ী।
বাংলোর দিকে হাঁটতে শুরু করল হ্যারি প্রাইস। পিছু পিছু চলল দুই গোয়েন্দা। একটা ঘরে এসে ঢুকল। একপাশে লম্বালম্বি পর্দা ঝোলানো। এপাশে একটা টেবিল ঘিরে কয়েকটা ইজি চেয়ার। টেবিলে বড়সড় একটা জগে বরফ দেয়া লেমোনেড। পর্দার ওপার থেকে ভেসে আসছে কাকাতুয়ার কর্কশ কিচির-মিচির।
পাখি পুষে, পাখি বিক্রি করেই পেট চালাই আমি, জগ থেকে তিনটে গ্লাসে লেমোনেড ঢালতে ঢালতে বলল প্রাইস। দুটো গ্লাস তুলে দিল দুই কিশোরের হাতে। তোমরা খাও। আমি আসছি, এক মিনিট। সানগ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে পাশের ঘরে চলে গেল সে।
ধীরে ধীরে লেমোনেডে চুমুক দিতে লাগল কিশোর। চিন্তিত। মিস্টার প্রাইসকে দেখে কি মনে হয়?
ভালই তো, জবাব দিল মুসা। ফিসফিসানিটাই শুধু খারাপ লাগে। এমনিতে লোকটা মন্দ না।
হ্যাঁ, বেশ মিশুক। কিন্তু মিথ্যে কথা বলল কেন? হাত তো দেখলাম পরিষ্কার। ঝোপঝাড় কাটলে কিছু না কিছু লেগে থাকতই।
কিন্তু মিথ্যে কথা বলবে কেন? এর আগে কখনও দেখেনি। আমাদের। কোন কারণ নেই।
মাথা নাড়ল কিশোর। বুঝতে পারছি না। আরও একটা ব্যাপার। ঝোপ কাটতেই যাক আর যেখানেই যাক, বেশিক্ষণ যায়নি। লেমোনেডে বরফের টুকরো রেখে গিয়েছিল। খুব একটা গলেনি।
তই তো।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিশোর, প্রাইসকে ঢুকতে দেখে থেমে গেল।
কাপড় বদলে এসেছে প্রাইস। গায়ে স্পোর্টস শার্ট। গলায় জড়িয়ে নিয়েছে একটা স্কার্ফ।
কাটা দাগটা দেখলে অনেকেরই অস্বস্তি লাগে, ফিসফিস করে। বলল লোকটা। কারও সঙ্গে কথা বলার সময় তাই স্কাফ জড়িয়ে নিই। অনেক বছর আগে মালয়ের এক দ্বীপে দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। তখন কেটেছে। সে যাকগে। তা তোমরা এখানে কি মনে করে?
একটা কার্ড বের করে প্রাইসের দিকে বাড়িয়ে ধরল কিশোর।
হাতে নিয়ে দেখল প্ৰাইস। তিন গোয়েন্দা! বেশ বেশ! তা এখানে কি তদন্ত করতে এসেছ?
কিশোর জানাল, জন ফিলবির ব্যাপারে কিছু আলোচনা করতে চায়।
সানগ্লাসটা তুলে নিয়ে পরল। প্রাইস। দিনের আলো সইতে পারি না। রাতে ভাল দেখি। …তো ফিলবির ব্যাপারে হঠাৎ এত আগ্ৰহ কেন তোমাদের?
একটা আজব কথা কানে এসেছে, বলল কিশোর। জন ফিলবি নাকি মরার পরে ভূত হয়ে গেছে। ঠাঁই নিয়েছে ক্যাসলেই। লোককে থাকতে দেয় না। জোর করে কেউ থাকতে চাইলে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
কালো কাচের ওপাশে চোখ দুটো আবছা। দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। দেখছে কিশোরকে।
আমিও শুনেছি, ফিসফিসিয়ে বলল লোকটা। ছবিতে ভূতপ্ৰেত দৈত্য-দানবের অভিনয় করেছে জন। ভয় পাইয়েছে দর্শককে। কিন্তু আসলে সে ছিল খুবই ভদ্র, লাজুক। খালি ফাঁকি দিত তাকে লোকে। ঠকাতো। বাধ্য হয়ে শেষে আমাকে ম্যানেজার রেখেছিল। এই যে, এই ছবিটা দেখ।
পেছনে টেবিলে রাখা ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা দেখাল। প্রাইস। তুলে বাড়িয়ে ধরল। কিশোরের দিকে।
হাতে নিল কিশোর। মুসাও দেখল, দুজন মানুষ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। হাত মেলাচ্ছে। একজন প্রাইস। আরেকজন তার চেয়ে বেঁটে, বিয়েসও কম। এই ছবিটাই পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, ফটোকপি করেছে। রবিন।
ছবির তলায় লেখাঃ প্রিয় বন্ধু হ্যারিকে।—জন।
ছবি দেখেই আন্দাজ করতে পারছ, কেমন লোক ছিক জন, বলল প্রাইস। লোকের সঙ্গে তর্ক করতে পারত না সে, রাগারগি করতে পারত না, কানের নিচে কাটা জায়গায় একবার আঙুল ছোঁয়াল সে। আমাকে কেন জানি ভয় পায় লোকে। বেশি গোলমাল করে না। জনের অনুরোধে নিলাম তার ম্যানেজারি। অভিনয়ে আরও বেশি মন দিতে পারল সে। কাজটা শুধু তার পেশাই না, নেশাও ছিল। হলে বসে। তার অভিনয় দেখে শিউরে উঠত দর্শক। সবাক চলচ্চিত্রের কদর বাড়ল। দেখা দিল বিপত্তি। ভীষণ চেহারার ভূতের তোতলামিতে লোকে হেসেই খুন। ভেঙে পড়ল জন। তখনকার তার মনের অবস্থা নিশ্চয় বুঝতে পারছ?