কিশোরদের জন্যে পরম লোভনীয় জায়গাটা। খুঁজলেই বেরিয়ে পড়ে প্রচুর খেলার জিনিস।
ইয়ার্ডের আরও কাছে চলে এসেছে। রবিন। চোখে পড়ছে রঙচঙে টিনের বেড়ার গায়ে আঁকা বিচিত্র সব ছবি। স্থানীয় শিল্পীদের আঁকা।
বেড়ার গায়ে সামনের দিকে আঁকা রয়েছে গাছপালা, ফুল, হ্রদ। হ্রদের পানিতে সাঁতার কাটছে রাজহাঁস। পাশে পাহাড়ের ওপারে। সাগর। সাগরে পালতোলা জাহাজ, নৌকা। কেমন একটা হাসি হাসি ভাব ছবিগুলোতে, ভারিক্কি কিছু নয়।
লোহার বিরাট সদর দরজা। পুড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল কোন প্যালেস। ওখান থেকেই কিনে আনা হয়েছে পাল্লাজোড়া। রঙ করতেই আবার প্রায় নতুন হয়ে গেছে। ইয়ার্ডের শোভা বাড়াচ্ছে এখন।
দরজার কাছে গেল না। রবিন। পাশ কাটিয়ে চলে এল। বেড়ার ধার ধরে ধরে এগিয়ে গেল শখানেক গজ। এখানে বেড়ার গায়ে আকা নীল সাগর। দুই মাস্তুলের পালতোলা একটা জাহাজ ঝড়ের কবলে পড়েছে। মাথা উচু করে দেখছে একটা বড় মাছ।
সাইকেল থেকে নামল রবিন। হ্যাণ্ডেল ধরে ঠেলে নিয়ে এল বেড়ার কাছে। হাত বাড়িয়ে মাছের চোখ টিপে ধরল।
নিঃশব্দে ডালার মত উঠে গেল বেড়ার গায়ে লেগে থাকা দুটো সবুজ বোর্ড। কয়েকটা গোপন প্রবেশ পথের একটা সবুজ ফটক এক।
সাইকেল নিয়ে ইয়ার্ডে ঢুকে পড়ল। রবিন। আবার নামিয়ে দিল। বোর্ডদুটো। কানে আসছে ঘটাং-ঘট ঘটাং-ঘাট আওয়াজ। কোণের আউটডোর ওয়ার্কশপের দিকে চেয়ে মুচকে হাসল। রবিন। ভাঙা মেশিনটা তো মেরামত হয়েছেই, কাজও শুরু হয়ে গেছে।
মাথার ওপরে টিনের চাল। ছয় ফুট চওড়া। টিনের এক প্রান্ত আটকে দেয়া হয়েছে বেড়ার মাথায়, আরেক প্রান্ত খুঁটির ওপর। ভেতরের দিকে বেড়ার ঘরের প্রায় পুরোটার মাথায়ই টানা রয়েছে এই চাল। ভাল আর দামি জিনিসগুলো এই চালার নিচে রাখেন রাশেদ পাশা। একপাশে খানিকটা জায়গার মালপত্র সরিয়ে তার ওয়ার্কশপ বসিয়েছে কিশোর।
সাইকেল স্ট্যান্ডে তুলে রাখতে রাখতে একবার পেছনে ফিরে চাইল রবিন। দৃষ্টি বাধা পেল পুরানো জিনিসপত্রের স্তুপে। ইয়ার্ডের মূল অফিস আর কিশোরের ওয়ার্কশপের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওই স্তুপ। অফিসের রঙিন টালির চুড়াটা শুধু চোখে পড়ে এখান থেকে। মেরিচাচীর কাচে ঘেরা। চেম্বারটা দেখা যায় না।
পুরানো জিনিস কেনার কাজে প্রায় সারাক্ষণই বাইরে বাইরে থাকেন রাশেদচাচা, ইয়ার্ড আর অফিসের ভার থাকে তখন মেরিচাচীর ওপর।
ওয়ার্কশপে ঢুকে পড়ল। রবিন। ছোট প্রিন্টিং মেশিনটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে লম্বা, বলিষ্ঠ এক কিশোর। কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। মাথায় কোঁকড়া কালো চুল। আমেরিকান মুসলমান, মুসা আমান।
মহা ব্যস্ত মুসা। ঘামছে দরদরি করে। সাদা একগাদা কার্ড পড়ে আছে পাশের একটা ছোট টুলে। একটা করে কার্ড তুলে নিয়ে মেশিনে চাপাচ্ছে, ছাপা হয়ে গেলেই আবার বের করে নিচ্ছে দ্রুত হাতে।
পাশে তাকাল রবিন। পুরানো একটা সুইভেল চেয়ারে বসে আছে কিশোর পাশা। হালকা-পাতলা শরীরের তুলনায় মাথাটা বড়। ঝাঁকড়া চুল। চওড়া কপালের তলায় অপূর্ব সুন্দর দুটো চোখে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ঝিলিক। বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর সাহায্যে চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। ভাবনার ঝড় বইছে মাথায়, বুঝতে পারল রবিন।
কি ছাপাচ্ছ? মেশিনের কাছে এগিয়ে গেল রবিন।
এই যে, এসে গেছে, ফিরে চেয়েই বলে উঠল মুসা।
ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল কিশোর। রবিনের দিকে চেয়ে বলল, মেসেজ পেয়েছ?
পেয়েই তো এলাম, জবাব দিল রবিন।
গুড, ভারিক্কি চালে বলল কিশোর। মুসা, একটা কার্ড দেখাও ওকে।
মেশিন বন্ধ করে দিল মুসা। একটা কার্ড তুলে বাড়িয়ে ধরল। রবিনের দিকে। নাও।
বড় আকারের একটা ভিজিটিং কার্ড। ইংরেজিতে লেখাঃ
তিন গোয়েন্দা
??
প্রধানঃ কিশোর পাশা
সহকারীঃ মুসা আমান
নথি গবেষকঃ রবিন মিলফোর্ড
বাহ, সুন্দর হয়েছে তো। প্রশংসা করল রবিন। এগিয়ে যাওয়াই ঠিক করলে তাহলে?
হ্যাঁ, ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি খোলার এই-ই সুযোগ, বলল কিশোর। স্কুল ছুটি। তিরিশ দিনের জন্যে একটা গাড়ি হয়ে গেল। খুব কাজে লাগবে, থামল একটু সে। সরাসরি রবিনের দিকে তাকাল। আমরা এখন তিন গোয়েন্দা। এজেন্সির চার্জে থাকছি। আমি। তোমার কোন আপত্তি আছে?
না, মাথা নাড়ল রবিন। ডিটেকশনের কাজ আমার চেয়ে ভাল বোঝ তুমি।
গুড। সহকারী হতে মুসারও আপত্তি নেই, বলল কিশোর। তোমার এখন সময় খারাপ। পা ভাঙা। দৌড়বীপের কাজগুলো খুব একটা করতে পারবে না। বসে বসেই কিছু করা। আপাতত লেখাপড়া আর রেকর্ড রাখার দায়িত্ব রইল তোমার ওপর।
আমি রাজি, বলল রবিন। এবং খুশি হয়েই। লাইব্রেরিতে কাজের ফাঁকে ফাঁকেই পড়াশোনাটা সেরে ফেলতে পারব। রেকর্ড রাখাটাও এমন কিছু কঠিন না।
গুড, মাথা ঝোঁকাল কিশোর। ভেবে বস না, খুব হালকা কাজ পেয়ে গেছ। তদন্তের নিয়মকানুন অনেক বদলে গেছে আজকাল। এ-কাজে এখন প্রচুর পড়াশোনা আর গবেষণা দরকার। …কি হল, কার্ডের দিকে ওভাবে চেয়ে আছ কেন?
তিনটে প্ৰশ্নবোধক চিহ্ন কেন?
সূক্ষ্ম একটা হাসির আভাস খেলে গেল কিশোরের মুখে। চট করে একবার চাইল মুসার দিকে।
ঠিকই বলেছ, কিশোর, মুসার চোখে বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা। ঠিক অনুমান করেছ তুমি!
কি? জানতে চাইল রবিন।
তুমিই বল, কিশোরকে বলল মুসা। গুছিয়ে বলতে পারব না। আমি।