কেন নয়? ওটাই তো আসল কাজ, সেজন্যেই তো বেরিয়েছি। চল চল, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়া দিল কিশোর।
সারা পথে পাথরের ছড়াছড়ি। হাঁটতেই কষ্ট হচ্ছে। এমনিতে যা লাগার কথা তার দ্বিগুণ সময় লেগে গেল। পথটা পেরোতে।
কাছে এসে ভয়ে ভয়ে দুর্গের সদর দরজার দিকে তাকাল মুসা।
না, আজ আর ঢুকছি না, বন্ধুকে অভয় দিল কিশোর। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। মিস্টার ফিসফিসের সঙ্গে দেখা করাটা বেশি জরুরি।
বাঁক পেরিয়ে এল দুজনে। গাড়িটা দেখা যাচ্ছে। অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। হ্যানসন। উদ্বিগ্ন।
কিশোর আর মুসাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল শোফার। ফিরেছেন তাহলে খুব ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম। দুজনের সারা গায়ে একবার চোখ বোলাল সে। কোন দুর্ঘটনা?
তেমন কিছু না, জবাব দিল কিশোর। আচ্ছা, মিনিট চল্লিশেক আগে দুটো ছেলেকে এদিক দিয়ে যেতে দেখেছেন?
চল্লিশ মিনিট নয়, তারও বেশি আগে, গাড়িতে উঠে বসতে বসতে বলল হ্যানসন। ক্যাসলের দিক থেকে ছুটে এল দুটো ছেলে। আমাকে দেখেই পাশ কেটে একটা ঝোপের ওপাশে চলে গেল। খানিক পরেই ইঞ্জিনের শব্দ শুনলাম। ঝোপের ওপাশ থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল একটা নীল স্পোর্টস কার।
একে অন্যের দিকে চাইল মুসা আর কিশোর। মাথা ঝোঁকাল দুজনেই। টেরিয়ারের গাড়িটাও নীল রঙের স্পোর্টস কার।
তারপর, আগের কথার খেই ধরল হ্যানসন, পাথর গড়িয়ে পড়ার আওয়াজ শুনলাম। অপেক্ষায় রইলাম। আপনাদের। দেরি হচ্ছে দেখে ভাবনায়ই পড়ে গিয়েছিলাম। আমার ওপর হুকুম আছে, কিছুতেই যেন গাড়িটাকে চোখের আড়াল না করি। কিন্তু আপনাদের ফিরতে আরেকটু দেরি হলেই হুকুম অমান্য করতাম, না গিয়ে পারতাম না।
ছেলে দুটো চলে যাবার পর পাথর গড়ানোর আওয়াজ শুনেছেন? ঠিক? নিশ্চিত হতে চাইছে কিশোর।
নিশ্চয়, জবাব দিল হ্যানসন। এখন কোথায় যাব, স্যার?
আটশো বারো উইন্ডিং ভ্যালিরোড, যেখানে রওনা হয়েছিলাম, কেমন আনমনা মনে হল কিশোরকে।
বন্ধুর মনে এখন কিসের ভাবনা চলছে, জানে মুসা। নিশ্চয় ভাবছে, পাথর ধসের আগেই যদি চলে গিয়ে থাকে টেরিয়ার, তাহলে পাথর ঠেলে ফেলল কে? পাশে বসা সঙ্গীর দিকে চাইল সে। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর, গভীর চিন্তায় মগ্ন।
শুটিকে নয়, তাহলে কে করল কাজটা? আপনমনেই বিড়বিড় করল। কিশোর। একটা মানুষকে দেখেছি পাহাড়ের ওপরে, সে-তো মিথ্যে নয়!
না, মিথ্যে নয়, বন্ধুর সঙ্গে একমত হল মুসা। এবং ও মানুষই। ভূত-প্ৰেত কিছু নয়।
ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই। বাস্তবে ফিরে এল যেন কিশোর। জানোলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, হ্যানসন, একটা সার্ভিস স্টেশনে একটু রাখবেন। হাত-মুখ ধুতে হবে।
ঝেড়েঝুড়ে জামাকাপড় যতটা সম্ভব পরিষ্কার করে নিল দুই গোয়েন্দা। হাতমুখ ধুয়ে চুল আঁচড়ে নিল। তারপর আবার এসে উঠল গাড়িতে।
পাহাড়ী পথ ধরে আবার ছুটে চলল রোলস রয়েস। পাহাড়ের ওপাশে নিচের উপত্যকায় নেমে গেছে। পথটা। ডানে মোড় নিয়ে আরও মাইল খানেক এগিয়ে গিয়ে মিশেছে। উইন্ডিং ভ্যালি রোডে।
শুরুতে পথটা বেশ চওড়া, দুধারে সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর। ধীরে ধীরে সরু হয়ে গেছে, হঠাৎ করেই ঢুকে পড়েছে একটা গিরিপথে। দুধারে কোথাও কোথাও খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, দুদিক থেকে চেপে ধরতে চাইছে যেন। অনেক বেশি ঘুরেফিরে এগিয়ে গেছে পথ। হঠাৎ করেই কোন এক পাশের দেয়াল যেন লাফ দিয়ে সরে যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়ছে খানিকটা খোলা জায়গা। ছোটখাট একঅধটা বাংলোমত বাড়ি উঠেছে। ওখানে। তারপরই যেন আবার লাফিয়ে পথের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াচ্ছে পাহাড়। এত বেশি ঘোরপ্যাঁচ বলেই পথটার নাম হয়েছে। উইন্ডিং ভ্যালি রোড।
একটা জায়গায় এসে আবার ওপরের দিকে উঠে চলল। পথ, আরও সরু হয়ে আসতে লাগল। কয়েলের মত ঘুরে ঘুরে উঠে যাওয়া পথ হঠাৎ করে এসে শেষ হয়ে গেছে এক জায়গায়। তারপরেই গোল একটু সমতল জায়গা পাহাড়ের মাথায়, গাড়ি ঘোরানোর জন্যে। তার উল্টোদিকে খাড়া নেমে গেছে দেয়াল, তলায় গভীর খাদ। নিচে কঠিন পাথর। ঘোরানোর সময় ড্রাইভার একটু অসতর্ক হলেই তলায় গিয়ে আছড়ে পড়বে গাড়ি।
গোলমত জায়গাটায় এনে গাড়ি থামিয়ে দিল হ্যানসন। জায়গা দেখে অবাকই হয়েছে যেন সে, চেহারাই জানান দিচ্ছে।
পথের শেষ মাথায় চলে এসেছি এদিক ওদিক চেয়ে বলল হ্যানসন। কই, কোন বাড়িঘর তো চোখে পড়ছে না।
ওই যে, একটা মেলবৰ্ব্বক্স হঠাৎ বলে উঠল মুসা। বাক্সের গায়ের লেখাটা পড়ল, প্রাইস আটশো বারো তার মানে কাছে পিঠেই কোথাও আছে বাড়িটা।
গাড়ি থেকে নেমে এল দুই গোয়েন্দা। ক্ষতবিক্ষত একটা ঝোপের পাশে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেলবৰ্ব্বক্স। ওটার ধার দিয়ে চলে গেছে একটা এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথ। জায়গায় জায়গায় ঝোপঝাড়। ওগুলোর মাঝখান দিয়ে সোজা ওপরের দিকে উঠে গেছে পথটা। উঠে চলল দুজনে। শিগগিরই তাদের অনেক নিচে পড়ে গেল গাড়িটা।
বেশ কয়েকটা ঝোপঝাড় পেরিয়ে এল ওরা। ছোট একটা জংলা মত জায়গা পেরোতেই চোখে পড়ল বাড়িটা। পাহাড়ের ঢালে জোর করে বসিয়ে দেয়া হয়েছে যেন লাল টালির ছাত দেয়া পুরানো টাইপের একটা স্প্যানিশ বাংলো। বাংলোর একপাশে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছে এক বিশাল খাঁচা, ছোটখাট ঘরের সমান। ভেতরে পুরে রাখা হয়েছে অসংখ্য কাকাতুয়া। একনাগাড়ে পরিসরে।