ছাই দেখা যাচ্ছে, বলল কিশোর। কোন কারণে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। কেউ। বলতে বলতেই উঠে গিয়ে ছাইয়ের কাছে বসল সে। এক হাতে টর্চ নিয়ে অন্য হাতে খুঁড়তে শুরু করল। ছাই আর ধূলোর গাদা। আধা ইঞ্চিমত বেরিয়েছিল, খুঁড়ে খুঁড়ে প্রায় ইঞ্চি চারেক বের করে ফেলল ওটার মাথা। একটা শক্ত ডাল। টোনাহেঁচড়া করে। ডালটা বের করে নিয়ে এল সে। ফুট চারেক লম্বা, ইঞ্চি দুয়েক পুরু। এক মাথা পোড়া।
কপাল ভাল আমাদের, বলে উঠল কিশোর। ডালটা পেয়ে গেছি। নিশ্চয় এর মাথায় খাবার গেথে পুড়িয়ে খেয়েছিল লোকটা।
ডালটার দিকে হাবার মত চেয়ে রইল মুসা। পুরানো, আধপোড়া ওই লাঠি তাদের কি কাজে লাগবে বুঝতে পারছে না।
এটা দিয়ে চাড় লাগিয়ে পাথর সরানোর কথা ভাবছ নাকি? জানতে চাইল মুসা। খামোকাই খাটবে তাহলে।
না, চাড় দেব না।
কোন কথা মনে এলে আগেভাগেই সেটা জানিয়ে দেয়ার পক্ষপাতী নয় কিশোর। আগে দেখে নেয়, তার পরিকল্পনায় খুঁত বেরোয় কিনা, তারপর দরকার হলে প্ৰকাশ করে। এটা জানে মুসা, তাই, ডালটা দিয়ে কি করবে না করবে। সে ব্যাপারে। আর কোন প্রশ্ন করল না সঙ্গীকে।
কোমরের বেল্টে ঝোলানো আটফলার ছোট সুইস ছুরিটা খুলে নিল কিশোর। একটা কাটিয়ং ব্লেড বের করে কাজে লেগে গেল।
ডালের পোড়া মাথাটা চেছে চোখা করে ফেলল। কিশোর। ছুরিটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিয়ে ডাল হাতে করে গিয়ে দাঁড়াল পাথরের দেয়ালের সামনে। আলো ফেলে ভালমত পরীক্ষা করে। দেখল দেয়ালটা। বোঝার চেষ্টা করল কোন দিকে পাথরে সংখ্যা কম। তারপর লাঠির চোখা মাথা দিয়ে খোঁচা লাগাল দেয়ালের একপাশে। কয়েক ইঞ্চি ঢুকেই ঠেকে গেল। লাঠির মাথা। জোরাজুরি করেও আর ঢোকানো গেল না। নিশ্চয় পাথরে আটকে গেছে। টেনে বের করে। এনে আবার খানিকটা ওপরে ঢোকাল সে। আবার কয়েক ইঞ্চি ঢুকে ঠেকে গেল মাথা। আবার বের করে এনে আরেক জায়গায় ঢোকাল। এবার আর ঠেকাল না। ওপাশে বেরিয়ে গেল চোখা মাথাটা। হ্যাঁচকা টানে বের করে আনতেই হড়বড় করে ঝরে পড়ল কিছু বালি মাটি।
আপন মনেই মাথা ঝোঁকাল কিশোর। ছিদ্রটাতে আবার লাঠি ঢোকাল। আস্তে আস্তে চাড় দিতে লাগিল চারদিকে। বালি-মাটি ঝরে। পড়তে লাগল। হাত ঢোকানো যায় এমন একটা গর্ত হয়ে গেল। দেয়ালের গায়ে শিগগিরই। আলো চুইয়ে ঢুকছে গুহার ভেতর।
আবার কাজে লেগে গেল কিশোর। কয়েক মিনিটেই গর্তটিার পাশে ওরকম আরেকটা গর্ত করে ফেলল। দুটো গর্তের মাঝামাঝি আবার লাঠি ঢুকিয়ে দিল। খোঁচাতে খোঁচাতে বালি-মাটি ফেলে এক করে ফেলল দুটো গর্ত। বেশ বড় একটা ফোকর হয়ে গেছে এখন। ফোকরের কাছে চোখ নিয়ে গিয়ে বাইরে তাকাল সে। চোখের সামনে ফুটে উঠল। গোল একটা বড় পাথর।
এবার, সন্তুষ্ট গলায় বলল কিশোর, এস, হাত লাগাও। ফোকর দিয়ে লাঠি ঢুকিয়ে দিল আবার। পাথরে ঠেকাল লাঠির মাথা। দুজনে মিলে এপাশ থেকে ঠেলা লাগাল জোরে।
প্ৰথমে নড়তে চাইল না পাথর শেষ অবধি পরাজিত হতেই হল। চাপা ভোঁতা একটা আওয়াজ তুলে বালি মাটি আর সঙ্গী পাথরের আলিঙ্গন থেকে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে, গড়িয়ে পড়তে লাগল। পড়ার সময় কিছু আলগা সঙ্গীকে নিয়ে গেল সাথে করে। ফোকরের বাইরের মুখটা বড় হল আরেকটু।
ফোকরের ওপর দিকে একটা পাথর বেছে নিল কিশোর। কতখানি বড় পাথর, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। লাঠির মাথা পাথরের নিচের দিকে ঠেকিয়ে ঠেলে যেতে লাগল। দুজনে। এক চুল নড়ল না। পাথর। পরিশ্রমে দরদরি করে ঘামছে দুজনে। পিচ্ছিল হয়ে আসছে লাঠি ধরা হাত। কিন্তু বিরত হল না। বেশিক্ষণ আর অনড় থাকতে পারল না পাথর। হড়াৎ করে একটা শব্দ তুলে খুলে এল বালিমাটির আকর্ষণ থেকে। বিশাল পাথর। ধুপ করে আছড়ে পড়ল নিচের সঙ্গী সাখীদের ওপর। অনেকগুলো পাথরকে নড়িয়ে ফেলল। ধাক্কা দিয়ে, সঙ্গে নিয়ে গড়াতে গড়াতে চলে গেল ঢাল বেয়ে।
বেশ প্রশস্ত হয়ে গেছে এখন ফোকরের বাইরের দিকটা। এপাশটাও প্রশস্ত করতে লেগে গেল ওরা। খুব বেশিক্ষণ লাগল না। ক্রল করে বেরিয়ে যাবার উপযোগী একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করে ফেলল ওরা।
কিশোর, তুমি একটা জিনিয়াস। প্ৰশংসা না করে পারল না মুসা।
বেশি বাড়িয়ে বলছি, প্রতিবাদ করল কিশোর। যা করেছি, এর জন্যে প্ৰতিভার দরকার পড়ে না। বাঁচার তাগিদেই মাথায় এসে গিয়েছিল বুদ্ধিটা।
কিন্তু আমার মাথায় তো আসেনি…
হয়েছে হয়েছে, বেরোও এখন। বেশি নড়াচড়া কোরো না। ওপর থেকে পাথর পড়ে থেতলে। যেতে পারে মাথা।
খুব সাবধানে পাঁকাল মাছের মত দেহটাকে মুচড়ে মুচড়ে গর্তের বাইরে বের করে নিয়ে এল মুসা। সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে মাথা ঢোকাতে বলল বন্ধুকে।
বেশি কষ্ট করতে হল না কিশোরকে। হাত ধরে টেনে ওকে। গুহার বাইরে বের করে নিয়ে এল মুসা।
ঢাল বেয়ে নিরাপদ জায়গায় সরে এল দুজনে। নিজেদের দিকে তাকাবার সময় পেল এতক্ষণে।
সেরেছে? চেঁচিয়ে উঠল মুসা। কেউ দেখলে আমাদেরকেই ভূত ঠাউরাবে এখন।
ও কিছু না, বলল কিশোর। কোন সার্ভিস স্টেশনে থেমে হাত-মুখ ধুয়ে নিলেই হবে। ভাল করে ঝাড়লে কাপড়েও বালি থাকবে না। আর তেমন। এ অবস্থায় দেখা করতে হচ্ছে না মিস্টার ফিসফিসের সঙ্গে!
এত কিছুর পরেও দেখা করতে যাচ্ছি। আমরা অবাক হয়ে বন্ধুর দিকে চাইল মুসা।