বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করাতে পারল বট কিশোর, কিন্তু সন্দেহ গেল না মেরিচাচীর। গাড়ি এসে গেছে। রাজকীয় রোলস রয়েসের দিকে চেয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন। তিনি। এর পর কি করবি কিশোর, তুইই জানিসা এই বয়েসেই রোলস রয়েস. তা-ও আবার আরব শেখের ফরমাশ দেয়া! নষ্ট হয়ে যাবি তো!
আবার যদি মত পাল্টে ফেলে মেরিচাচী, এই ভয়ে কিশোর তাড়াতাড়ি গিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে। মুসা উঠে বসতেই দ্রুত ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যাবার নির্দেশ দিল হ্যানসনকে।
কোথায় যেতে হবে শোফারকে জানাল কিশোর।
ম্যাপ বের করে দেখে নিল হ্যানসন উইন্ডিং ভ্যালিটি কোথায়। রকি বীচ থেকে বেশ দূরে একটা পর্বতমালার ধারে উপত্যকাটা। নিঃশব্দে ছুটে চলল রোলস রয়েস।
পাহাড়ী পথ ধরে উঠে যাচ্ছে গাড়ি। সেদিকে চেয়ে বলল কিশোর, হ্যানসন, ব্ল্যাক ক্যারিয়নের দিকে যাচ্ছি কেন?
ওদিক দিয়েই যেতে হবে, মাস্টার পাশা। ক্যানিয়নের মাইলখানেক দূর দিয়ে বেরিয়ে যাব।
ভালই হল। আবার একবার ঢুকব ব্ল্যাক ক্যানিয়নে। কয়েকটা ব্যাপারে শিওর হওয়া দরকার।
মিনিট কয়েক পরেই গিরিপথের প্রবেশমুখে পৌঁছে গেল ওরা। ভেতরে ঢুকে পড়ল গাড়ি। পরিচিত পথ, অথচ কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে এখন দিনের আলোয় একেবারে অন্যরকম লাগছে। পথটাকে।
ভেঙে পড়া ক্রসবার আর পাথরের স্তুপের কাছে এনে গাড়ি রাখল হ্যানসন। পথের দিকে চেয়ে বলে উঠল, দেখুন দেখুন, আরেকটা গাড়ির টায়ারের দাগ, গতরাতেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি। কেউ অনুসরণ করেছিল আমাদেরকে।
অনুসরণা কে? একে অন্যের দিকে চাইল মুসা আর কিশোর।
আরেক রহস্য মাথা চাড়া দিচ্ছে, বলল কিশোর। যাকগে। আগের কাজ আগে শেষ করি। টেরর ক্যাসলের বাইরেটা ঘুরে দেখব চল।
চল, বলল দ্বিতীয় গোয়েন্দা। বাইরে দিয়ে ঘুরতে আমার কোন আপত্তি নেই।
দিনের আলোয় অনেক সহজে অনেক কম সময়ে দুর্গের কাছে পৌঁছে গেল ওরা। বিশাল টাওয়ার, আকাশ ছুতে চাইছে যেন।
গতরাতে ওই ভূতের আডডায় ঢুকেছিলাম, ভাবলে এখনও গা ছমছম করে, বলল মুসা।
দুর্গের বাইরের দিকে পুরো একপাক ঘুরে এল কিশোর। তারপর আবার চলল। পেছনে। ওখান থেকে প্ৰায় খাড়া নিচে নেমে গেছে পাহাড়টা।
বাড়িটাতে মানুষ থাকে। কিনা বুঝতে চাইছি, বলল কিশোর। তাহলে তার কিছু না কিছু চিহ্ন থাকবেই। জুতোর ছাপ…সিগারেটের পোড়া টুকরো…
পাওয়া গেল না তেমন কিছু। পরিশ্রান্ত হয়ে পড়ল দুজনেই। দুর্গের পাশে বিশ্রাম করতে বসল।
নাহ, মানুষ থাকে না। এখানে, বলল কিশোর। ভূত আছে, তা-ও বিশ্বাস করতে পারছি না…
হঠাৎ তীক্ষ্ণ এক চিৎকারে চমকে উঠল দুজনেই। মানুষ মানুষের গলা লাফিয়ে উঠে। ছুটল ওরা। কয়েক পা এগিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল। দুর্গের সদর দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে দুটো মানুষ। আতঙ্কিত গলায় চোঁচাচ্ছে। হঠাৎ কিসে হোচট লেগে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল একজন। চকচকে কিছু একটা ছিটকে পড়ল। হাত থেকে। কিন্তু ওটা তুলল। না সে। হাঁচড়ে-পাঁচড়ে কোনমতে উঠেই সঙ্গীর পেছনে ছুট লাগাল আবার।
ভুত না! বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই বলে উঠল মুসা। তবে ছোটার ধরন দেখে মনে হচ্ছে ভূতের সঙ্গে দেখা হয়েছে।
জলদি বলেই ছুটতে শুরু করল কিশোর। ব্যাটাদের চেহারা দেখা দরকার।
দ্রুত দৌড়াচ্ছে কিশোর। পেছনে মুসা।
প্রায় চোখের আড়ালে চলে গেছে। বাঁকটা ঘুরলেই অদৃশ্য হয়ে যাবে, ধরা যাবে না। ওদেরকে। বুঝে ছোটার গতি কমিয়ে দিল। কিশোর। দাঁড়িয়ে পড়ল এসে, যেখানে আছাড় খেয়েছিল। একজন। কাছেই পড়ে আছে চকচকে জিনিসটা। টর্চ। নিচু হয়ে তুলে নিল কিশোর। খুদে একটা নেমপ্লেট আটকানো টর্চের গায়ে। তাতে দুটো অক্ষর খোদাই করা।
টি ডি! জোরে জোরে পড়ল কিশোর। কে হতে পারে, বল তো, মুসা?
টেরিয়ার ডয়েল প্রায় ফেটে পড়ল। মুসা। শুটিকে টেরিা কিন্তু তা কি করে হয়? ব্যাটা এখানে আসবে কেন?
এসেছে লাইব্রেরিতে রবিনের কাজকর্ম দেখছিল, ভুলে গেছ? আমাদের কার্ড ওই ব্যাটাই চুরি করেছে। গতরাতে ফলো করেছিল। ওই। সব সময়েই তো পেছনে লেগে থাকে শুটিকো। কি করি না করি জানার চেষ্টা করে। এবারেও নিশ্চয় একই ব্যাপার। আমাদের কাজে গোল বাধানোর তালে আছে।
তা হতে পারে, চিন্তিত দেখাচ্ছে সহকারী গোয়েন্দাকে। রাতে আমরা ঢুকেছি, দেখেছে। তখন সাহস করেনি। দিনের বেলা দেখতে এসেছে, কেন গিয়েছিলাম দুর্গের ভেতরে। কেমন মজা! খেলি তো ভূতের তাড়া। হাসি একান-ওকান হয়ে গেল মুসার।
ব্যাপারটাকে এত হালকাভাবে নিতে পারল না কিশোর। টৰ্চটা পকেটে ঢুকিয়ে রাখতে রাখতে বলল, এত হাসির কিছু নেই। ভূত আমাদেরকেও ছাড়েনি। তবে আমরা আবার ঢুকব ওদের আডডায়, কিন্তু শুটিকে আর এদিক মাড়াবে না। ভাবছি, এখুনি আবার ঢুকব দুৰ্গে। দিনের আলোয় ভাল করে দেখতে চাই সব।
প্রতিবাদ করতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। ভারি কিছু ধসে। পড়ার শব্দ কানে আসছে। চমকে চোখ তুলে চাইল দুজনেই। ঠিক মাথার ওপরে পাহাড়ের চূড়ার কাছ থেকে গড়িয়ে নেমে আসছে বিশাল এক পাথর।
ছুট লাগাতে যাচ্ছিল মুসা, খপ করে তার হাত ধরে ফেলল। কিশোর। থাম! আমাদের ওপর পড়বে না! কয়েক গজ দূর দিয়ে চলে যাবে।
ঠিকই। ওদের কয়েক গজ দূর দিয়ে তুমুল গতিতে ছুটে গোল পাথরটা, দশ গজ নিচের রাস্তায় আছড়ে পড়ল। পথের সর্বনাশ করে। দিয়ে, চারদিকে কংক্রীটের গুড়ো ছড়িয়ে ফেলে গড়িয়ে নেমে চলে গেল। ঢালু পথ বেয়ে।