ইয়ার্ডের ভেতরে একধারে একটা ছোট বাংলোমত বাড়ি। তারই একটা ছোট্ট ঘরে ঘুমান চাচা-চাচী। ঘরের জানোলা দিয়ে আলো আসছে। টেলিভিশন দেখছেন দুজনে।
রাত বেশি হয়নি, বলল কিশোর। তাড়াতাড়িই ফিরেছি।
আরও আগে ফেরা উচিত ছিল। তাড়া খাওয়ার আগেই, বলল মুসা। এখনও ফ্যাকাসে হয়ে আছে চেহারা।
কিশোরের চেহারাও ফ্যাকাসে। আমি আশা করেছিলাম। চিৎকারটা রেকর্ড করবে তুমি। তাহলে আবার এখন শোনা যেত। বোঝা যেত কিসের চিৎকার।
তুমি আশা করেছিলো। প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। প্ৰাণ নিয়ে পালাতে দিশে পাচ্ছিলাম না, চিৎকার রেকর্ড করব।
আমার নির্দেশ ছিল, যে-কোন রকমের শব্দ রেকর্ড করার দায়িত্ব তোমার, শান্ত গলায় বলল কিশোর। তবে পরিস্থিতি তো নিজের চোখেই দেখেছি, তোমাকে আর কি বলব!
সহজ তিন-এর দিকে বন্ধুদের নিয়ে গেল কিশোর। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার এটা সবচেয়ে সহজ গোপন পথ। ফ্রেমে আটকানো বিরাট একটা ওক কাঠের দরজা। গ্র্যানাইট পাথরে তৈরি ধসে পড়া একটা বাড়ি থেকে খুলে এনেছেন রাশেদ চাচা। ওটাকেই একটা দানবীয় স্টীম ইঞ্জিনের পুরানো বয়লারে এক প্রান্তে কায়দা করে বসিয়ে নেয়া হয়েছে।
লোহালক্কড়ের মাঝে একটা খোঁড়িলে হাত ঢুকিয়ে দিল। কিশোর। ভেতরে বসানো আছে একটা ছোট বাক্স, তাতে চাবি রাখা। এমন জায়গায় বাক্স, আর তার ভেতর দরজার চাবি থাকতে পারে, কল্পনাই করবে না কেউ। দরজার তালা খুলল কিশোর। টান দিয়ে খুলল পাল্লা। ঢুকে গেল বিরাট বয়লারে।
পুরো সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। মাথা সামান্য নুইয়ে বয়লারের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল। তিন কিশোর। শেষ মাথায় বড় গোল একটা ফুটো। ওটার ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দিল কিশোর। শরীরটা বের করে নিয়ে এল ট্রেলারের ভেতর। তার পেছনে একে একে ঢুকে পড়ল। মুসা আর রবিন।
সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিল কিশোর। ডেস্কের ওপাশে সুইভেল চেয়ারে গিয়ে বসে পড়ল।
এখন, কথা শুরু করল কিশোর, দুর্গে কি কি ঘটেছে, আলোচনা করব আমরা। মুসা, কিসে ছুটি লাগাতে বাধ্য করল তোমাকে?
কেউ বাধ্য করেনি, সাফ জবাব দিল মুসা। আমার নিজেরই ছুটতে ইচ্ছে করছিল।
বুঝতে পারনি। আমার প্রশ্ন। ছুটতে ইচ্ছে হল কেন তোমার? কি হয়েছিল?
শুরুতে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। আস্তে আস্তে বাড়ল অস্বস্তি, ভয় ভয় করতে লাগল। তারপর হঠাৎ করেই চেপে ধরল দারুণ আতঙ্ক। এরপর আর না ছুটে উপায় আছে?
ঠিক, নিচের ঠোঁটে চিমটি কেটে বলল কিশোর, ঠিক একই ব্যাপার ঘটেছে আমার বেলায়ও। শুরুতে অস্বস্তি তারপর ভয় ভয়। শেষে দারুণ আতঙ্ক। কিন্তু আসলে কি ঘটেছিল! প্ৰথম থেকে ভেবে দেখা উচিত। ইকো হল—প্রতিধ্বনি শুনে প্রথম ভয় পাওয়া। জলদস্যুর ছবি। কাছে পরখ করতে যাওয়া। তারপর ঠাণ্ডা বাতাসের স্রোত…
হিম শীতল বাতাসের স্রোতা শুধরে দিল মুসা। ছবিটার কথা নতুন করে ভেবেছ কিছু? ওটার চোখ এত জ্যান্ত মনে হল কেন প্ৰথমে?
হয়ত নিছক কল্পনা, বলল কিশোর। আসলে সত্যি সত্যি এমন কিছু দেখিনি আমরা, কিংবা শুনিনি, যাতে আতঙ্কিত হতে হয়।
নাই বা দেখলাম, টের তো পেয়েছি বলল মুসা। এমনিতেই পুরানো আমলের বাড়িগুলোতে ঢুকতে ভয় ভয় লাগে। আর ক্যাসলটা তো ভূতের আডডাখানা। তা-ও যে সে ভূত না, বাঘা বাঘা সব ব্যাটাদের বাস। মানুষ তো মানুষ, ছোটখাট ভূতেরাই ঢুকতে সাহস করবে না। ওখানে জায়গাটা দেখলেই ভয় লাগে।
আসল রহস্যটা হয়ত ওখানেই বলল কিশোর। আবার টেরার ক্যাসলে ঢুকব… বাধা পেয়ে থেমে গেল। বেজে উঠেছে টেলিফোন।
অবাক হয়ে সেটটার দিকে চেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। মাত্র হাপ্ত খানেক আগে এসেছে ওটা। টেলিফোন বুকে নাম ওঠেনি। এখনও কিশোরের। অফিসের দুচারজন, আর তারা তিনজন ছাড়া আর কেউই জানে না নাম্বারটা। তাহলে! কে করল ফোন!
আবার হল রিঙ। আবার।
তুমিই ধর, ফিসফিস করে কিশোরকে বলল মুসা।
হাত বাড়াল কিশোর। আরেকবার রিঙ হতেই ধরল রিসিভার। তুলে কানে ঠেকাল। হ্যালো বলেই নামিয়ে আনল, ধরল। একটা মাইক্রোফোনের সামনে।
পুরানো মাইক্রোফোনটা জাংক-ইয়ার্ড থেকেই জোগাড় করেছে কিশোর। পুরানো একটা রেডিও থেকে খুলে নিয়েছে স্পীকার। মাইক্রোফোন আর স্পীকারের কানেকশন করে দিয়েছে। টেলিফোন এলে, তিনজনে একই সঙ্গে শোনার জন্যে এই ব্যবস্থা। কথা নেই, শুধু অদ্ভুত একটা গুঞ্জন স্পীকারে। আবার রিসিভার কানে ঠেকাল কিশোর। হ্যালো? নামিয়ে এনে ধরল। মাইক্রোফোনের সামনে।
এবারেও শুধু গুঞ্জন। ক্ৰেডলে রিসিভার রেখে দিল কিশোর। রঙ নাম্বার-টাম্বার কিছু একটা হয়েছে। হ্যাঁ, যা বলেছিলাম। টেরর ক্যাসলে….
আবার বেজে উঠল টেলিফোন।
স্থির চোখে এক মুহূর্ত সেটটার দিকে চেয়ে রইল। কিশোর। ছোঁ। মেরে তুলে নিল রিসিভার।
হা হ্যাল্লো? নামিয়ে আনল মাইক্রোফোনের সামনে।
আবার গুঞ্জন স্পীকারে। না, আগের মত নয়। একটু যেন পরিবর্তন হয়েছে। বহুদূর থেকে আসছে যেন শব্দটা, কাছিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। হঠাৎই গুঞ্জনের ভেতর থেকে ভেসে এল বিদঘুটে একটা অনেক কষ্টে যেন একটা শব্দ উচ্চারিত হল, দূরে… থেমে গোল কথা। শাঁই শাঁই ঝড় বইছে যেন স্পীকারে। আবার উচ্চারিত হলে দুটো শব্দ, দূরে…থাকবে… থেমে গেল কথা। হঠাৎ গলা টিপে ধরে থামিয়ে দেয়া হয়েছে যেন।