সে তোমার মনে হচ্ছে। ওটা রঙে আঁকা চোখই। চল, কাছ থেকে দেখি।
ছবিটার কাছে এগিয়ে গেল কিশোর। একমুহূর্ত দ্বিধা করে শেষে তাকে অনুসরণ করল মুসা। দুজনেই আলো ফেলল। ছবির ওপর ঠিক, কিশোরের কথাই ঠিক। রঙে আঁকা চোখ ওটা। তবে আঁকা হয়েছে দক্ষ হাতে। একেবারে জ্যান্ত মনে হচ্ছে।
হ্যাঁ রঙে আঁকা। চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল মুসা। কিন্তু মেনে নিতে পারছি না! চোখের পাতা পলক ফেলতে দেখছি..আরে। হঠাৎ যেন কথা আটকে গেল তার। কিছু টের পাচ্ছি।
ঠাণ্ডা, অবাক শোনাল কিশোরের গলা। ঠাণ্ডা একটা অঞ্চলে এসে ঢুকেছি। আমরা। এরকম ঠাণ্ডা আবহাওয়া সব পোড়ো বাড়িতেই কিছু কিছু জায়গায় থাকে।
তাহলে স্বীকার করছি এটা পোড়ো বাড়িা রীতিমত কাঁপছে মুসা। দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাওয়া শুরু হয়েছে। ভীষণ শীত করছে। মেরু অঞ্চলে এসে ঢুকলাম নাকিরে বাবা। ভূত, সব ভুত এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে আমার ওপর। কিশোর, ভয় পাচ্ছি আমি।
নিজেকে স্থির রাখার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে মুসা। কিন্তু দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাওয়া রোধ করতে পারছে না। কোথা থেকে গায়ে এসে লাগছে। তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত। তারপরই চোখে পড়ল, বাতাসে। হালকা ধোঁয়া। সূক্ষ্ম, অতি হালকা ধোঁয়ার ভেতর থেকে ধীরে ধীরে রূপ নিচ্ছে যেন একটা শরীর। মুহূর্তে ভয় প্রচণ্ড আতঙ্কে পরিণত হল। পাই করে ঘুরল মুসা। কথা শুনল না পা। তাড়িয়ে বের করে নিয়ে এল তাকে ঠাণ্ডা অঞ্চল থেকে। হল পার করে এনে বারান্দায় ফেলল। সেখান থেকে প্ৰায় উড়িয়ে নামিয়ে আনল সিঁড়ির নিচে, প্রাঙ্গনে, পথে। পেছনে তাড়া করে আসছে পায়ের শব্দ। আরও জোরে ছুটল মুসা।
ক্রমেই কাছে এসে যাচ্ছে পায়ের শব্দ। দেখতে দেখতে পাশে এসে গেল। হাল ছেড়ে দিল মুসা। পাশে চাইল। আরো কিশোর
অবাকই হল মুসা। তিন গোয়েন্দার নেতাকে কোন কারণে এত ভয় পেতে এর আগে কখনও দেখেনি সে।
কি হল? তোমার পা-ও হুকুম মানছে না? ছুটতে ছুটতেই জিজ্ঞেস করল মুসা।
মানছে তো। ওদেরকে ছোেটার হুকুম দিয়েছি। আমি, চেঁচিয়ে জবাব দিল কিশোর।
থামল না। ওরা। ছুটেই চলল। হাতে ধরা টর্চে ঝাঁকুনি লাগছে অনবরত, পথের ওপর অদ্ভূত ভঙ্গিতে নাচছে আলোর রশ্মি। টেরর ক্যাসলের কাছ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে ওরা।
৬
ছুটতে ছুটতে বাঁকের কাছে চলে এল ওরা। গতি কমাল একটু। বাঁক ঘুরল। পেছনে ফিরে চাইল একবার কিশোর। বাঁকের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেছে টেরর ক্যাসলের গর্বিত টাওয়ার।
সামনে অনেক নিচে উপত্যকায় লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের আলো মিটমিট করছে। থামল না। ওরা। ছুটতে ছুটতে পাথর-মাটির স্তুপের কাছে চলে এল। এখানেও থামল না। চলে এল ওপাশে। একশো গজ নিচে দাঁড়িয়ে আছে কালো রোলস-রয়েস।
গতি একটু কমল দুজনে। ঠিক এই সময়ই শোনা গেল তীক্ষ্ণ প্ৰলম্বিত একটা চিৎকার। অনেক পেছনে ক্যাসলের দিক থেকে আসছে। থেমে গেল। হঠাৎ করেই। যেন দম আটকে গেছে গলায়। চমকে উঠে আবার ছোটার গতি বাড়িয়ে দিল দুই গোয়েন্দা। এক ছুটে এসে দাঁড়াল গাড়ির কাছে।
তারার আলোয় চিকচিক করছে বিশাল রোলস-রয়েসের সোনালি হাতল। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল এক পাশের দরজা। হাত বাড়িয়ে মুসাকে ভেতরে টেনে নিল রবিন। মুসার পরই উঠে বসল। কিশোর। হ্যানসন চেঁচিয়ে উঠল সে, জলদি গাড়ি ছাড়ুন। বাড়ি ফিরে চলুন।
যাচ্ছি, মিস্টার পাশা, শান্ত গলায় বলল হ্যানসন।
মৃদু গুঞ্জন তুলে স্টার্ট হয়ে গেল ইঞ্জিন। প্রায় নিঃশব্দে পাহাড়ী পথ ধরে ছুটল গাড়ি। যতই নামছে, গতি বাড়ছে ততই। আরও বেশি, আরও।
কি হয়েছিল? সিটে এলিয়ে পড়া দুই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করল রবিন। ওই চিৎকারটা কিসের?
জানি না, বলল কিশোর।
এবং আমি জানতে চাই না, কিশোরের কথার পিঠে বলল মুসা। যদি কেউ জানেও, আমাকে বলতে মানা করব।
কিন্তু হয়েছিল কি? আবার জিজ্ঞেস করল রবিন। নীল ভূতের দেখা পেয়েছ?
মাথা নাড়ল কিশোর। কিছুই দেখিনি। তবে ভয় পাইয়ে ছেড়েছে আমাদের কিছু একটা।
ভুল হল, শুধরে দিল মুসা। আতঙ্কিত করে ছেড়েছে।
তাহলে গালগল্পগুলো সব সত্যি? হতাশ হয়েছে যেন রবিন। ভূতের উপদ্রব আছে দুর্গে।
আছে মানে! সারা আমেরিকার যত ভূতপ্ৰেত, জিন, ভ্যাম্পায়ার, ওয়্যারউলফ সবকিছুর আডডা ওটা। হেডকোয়ার্টার শ্বাসপ্রশ্বাস সহজ হয়ে আসছে মুসার। ওই ভূতের খনিতে আর কখনও ঢুকাছি না। আমরা, কি বল?
সমর্থনের আশায় নেতার দিকে চাইল মুসা।
কিশোর শুনল কি-না বোঝা গেল না। হেলান দিয়ে বসে আস্তে আস্তে চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে। গভীর চিন্তায় মগ্ন।
আর ওই দুর্গে ফিরে যাচ্ছি না। আমরা, তাই না? আবার জিজ্ঞেস করল মুসা।
কিন্তু এবারেও সাড়া নেই কিশোরের। ছুটন্ত গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। একনাগাড়ে চিমটি কেটে যাচ্ছে নিচের ঠোঁটে।
ইয়ার্ডে এসে পৌঁছুল গাড়ি।
ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে পড়ল তিন গোয়েন্দা।
পরেরবার বেটার লাক আশা করছি, মাস্টার পাশা, জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বলল হ্যানসন। সত্যি খুব ভাল লাগছে আপনাদের সঙ্গ। বুড়ো ব্যাংকার আর ধনী বিধবাদের কাজ করে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। একঘেয়েমী কাটছে।
গাড়ি নিয়ে চলে গেল। ইংরেজ শোফার।
বন্ধুদের নিয়ে জাংক-ইয়ার্ডে এসে ঢুকল কিশোর।