কোলের ওপর একটা ম্যাপ বিছিয়ে নিয়েছে কিশোর। একটা জায়গায় আঙুল রেখে হ্যানসনকে দেখিয়ে বলল, ব্ল্যাক ক্যানিয়ন। এই যে, এ পথে যেতে হবে।
ঠিক আছে, মিস্টার পাশা।
অন্ধকারে নিঃশব্দে ছুটে চলল রোলস রয়েস। ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যাচ্ছে পাহাড়ী পথ ধরে। এক পাশে নিচে গভীর খাদ। খানিক পর পরই তীক্ষ্ণ মোড় নিয়েছে পথ। কিন্তু দক্ষ ড্রাইভার হ্যানসন। তার হাতে নিজেদের ভার ছেড়ে দিয়ে একেবারে নিশ্চিন্ত তিন কিশোর।
আজ রাতে তদন্ত করার ইচ্ছে নেই, পাশে বসা দুই সঙ্গীকে বলল কিশোর। শুধু দেখে আসব দুর্গটা। উদ্ভট কিছু চোখে পড়লে তার ছবি তোলার চেষ্টা করব। আর তুমি, মুসা, আজব যে-কোন শব্দ রেকর্ড করে নেবে টেপে।
আমাকে রেকর্ড করতে দিলে, থেমে গেল মুসা। আরেকটা তীক্ষ্ণ মোড় নিল গাড়ি। নিচের অন্ধকার খাদের দিকে চেয়ে শিউরে উঠল একবার। তারপর ফিরল আবার কিশোরের দিকে। হ্যাঁ, আমাকে রেকর্ড করতে দিলে শুধু দাঁতে দাঁতে বাড়ি খাবার শব্দ উঠবে, আর কিছু না।
রবিন, মুসার কথায় কান না দিয়ে বলল কিশোর। তুমি গাড়িতে থাকবে। আমাদের ফেরার অপেক্ষা করবে।
এক্কেবারে আমার পছন্দসই কাজ, খুশি হয়ে বলল রবিন জানোলা দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। ইসস, দেখেছ কি অন্ধকারা
অন্ধকার গিরিপথে ঢুকে পড়েছে গাড়ি। দুধারে খাড়া উঠে গেছে পাহাড়। বার বার একেবেঁকে এগিয়ে গেছে। পথটা। কোথাও একবিন্দু আলো দেখা যাচ্ছে না। ঘুটিযুট অন্ধকার। একটা বাড়ি-ঘর চোখে পড়ছে না কোথাও।
ব্ল্যাক ক্যানিয়নের নাম যে-ই রাখুক, ঠিকই রেখেছে, চাপা। গলায় বলল মুসা।
সামনে বাধা দেখতে পাচ্ছি! বলে উঠল কিশোর।
ঠিকই সামনে পথ বন্ধ। পাথর আর মাটির স্তুপ। দুধারে পাহাড়ের গায়ে ঘন হয়ে জন্মে আছে মেলকোয়াইটের ঝোপ, কিন্তু ঘাসের নাম গন্ধও নেই। ফলে রোদ-বৃষ্টি বাতাসে আলগা হয়ে গেছে মাটি, পাথর। গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ে জমা হয়েছে পথের ওপর। স্তুপের ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে আছে একটা ক্রসবারের মাথা। কোন এককালে লোক চলাচল ঠেকানোর জন্যে লাগানো হয়েছিল। এখন আর বারের দরকার নেই। তার চেয়ে ভাল ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে মাটি আর পাথর।
স্তুপের কাছে এসে গাড়ি থামিয়ে দিল হ্যানসন। আর যাবে। না, বলল সে। তবে আপনাদের তেমন অসুবিধে হবে বলেও মনে হয় না। ম্যাপে দেখছি, কয়েকশো গজ এগিয়ে একটা মোড় ঘুরলেই পৌঁছে যাবেন ক্যাসলে।
তা ঠিক, সায় দিল কিশোর। আমরা নেমেই যাচ্ছি। মুসা, এস।
নেমে এল দুজনে। গাড়ি ঘুরিয়ে রাখছে হ্যানসন।
এগিয়ে চলল দুই গোয়েন্দা।
খাইছে! শঙ্কিত গলায় বলে উঠল মুসা। দেখেই গা ছমছম করছে। দাঁড়িয়ে পড়েছে সে।
দাঁড়িয়ে পড়ল কিশোরও। অন্ধকারে সামনে তাকাল। গিরিপথের শেষ প্রান্তে একটা পাহাড়ের ঢালে দাঁড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক কাঠামো। তারাখচিত আকাশের পটভূমিতে বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে ওটা। বিশাল মোটা পাথরের একটা থাম যেন উঠে গেছে আকাশের দিকে। থামের চুড়ায় একটা রিঙ পরিয়ে দেয়া হয়েছে যেন। টেরার ক্যাসলের টাওয়ার। শুধু টাওয়ারটাই, ক্যাসলের আর বিশেষ কিছুই নজরে পড়ছে না। এখান থেকে।
দিনের বেলা এলেই ভাল হত, বিড় বিড় করে বলল মুসা। মাথা নাড়ল কিশোর। না। দিনে কিছু ঘটে না ক্যাসলে। ভূতপ্ৰেতগুলো বেরোয় রাতের বেলা।
ভূতের তাড়া খেতে চাই না। আমি। এমনিতেই প্যান্ট নষ্ট করার সময় হয়ে এসেছে।
আমারও, স্বীকার করল। কিশোর। পেটের ভেতর কেমন সুড়সুড়ি লাগছে। কয়েক ডজন প্রজাপতি ঢুকে পড়েছে যেন!
তাহলে চল ফিরে যাই, সুযোগ পেয়ে বলল মুসা। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে যেন। এক রাতে অনেক দেখা হয়েছে। চল, হেডকোয়ার্টারে ফিরে গিয়ে নতুন কোন প্ল্যান ঠিক করি।
প্ল্যান তো ঠিকই আছে, বলল কিশোর। একটা শেষ না করেই আরেকটা কেন?
পা বাড়াল কিশোর। এগিয়ে চলল ক্যাসলের দিকে। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে। প্রায় খাড়া হয়ে উঠে গেছে। পথটা। আলগা পাথরের ছড়াছড়ি। ছোট বড় মাঝারি, সব আকারের। হড়কে যাচ্ছে পা, কখনও হোচট খাচ্ছে। কিন্তু থামল না গোয়েন্দা প্ৰধান।
কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করল মুসা। তারপর পিছু নিল কিশোরের। তার হাতেও টর্চ।
এমন অবস্থায় পড়বা জানলে কিশোরের কাছাকাছি হয়ে ক্ষুন্ন গলায় বলল মুসা। গোয়েন্দা হওয়ার কথা কল্পনাও করতাম না!
কেসটা মিটে গেলেই অন্য রকম মনে হবে, বলল কিশোর। কেউকেটা গোছের কিছু মনে হবে নিজেকে। প্রথম কেসেই কিরকম নাম হবে তিন গোয়েন্দার, ভেবে দেখেছ?
কিন্তু ভূতের সামনে যদি পড়ে যাই? কিংবা নীল অশরীরী তাড়া করে? দুয়েকটা দৈত্য-দানবের বাচ্চা এসে ঘাড় চেপে ধরলেও আশ্চর্য হব না।
ওরা আসুক, তা-ই আমি চাই, বলতে বলতে কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরার গায়ে আলতো চাপড় দিল কিশোর। ব্যাটাদের ছবি তুলে নেব। বিখ্যাত হয়ে যাব। রাতারাতি।
বিখ্যাত হবার আগেই যদি ঘাড়টা মটকে দেয়?
শ শ শ! ঠোঁটে আঙুল রেখে হুশিয়ার করে দিল সঙ্গীকে কিশোর। আচমকা দাঁড়িয়ে পড়েছে। নিভিয়ে দিয়েছে টর্চ।
পাথরের মত স্থির হয়ে গেল মুসা। হঠাৎ আলো নিভে যাওয়ায় অন্ধকার যেন আরও বেশি করে চেপে ধরল। চারদিক থেকে।
কেউ, কিংবা কিছু একটা, এদিকেই নেমে আসছে। সোজা ছেলে দুটোর দিকে।