চলুন, বল সহকারী-পরিচালক। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল জেটির দিকে।
ছেলেদের দিকে ফিরলেন মুসার বাবা। চল, পার্কটা দেখিয়ে আনি তোমাদের। জোসেফ ফিরে এলে ডাইভিং করাতে নিয়ে যাবে।
খুব ভাল হবে, বাবা, চল, বলল মুসা।
খুব বেশি হাটতে হল না। ধসে পড়া একটা বেড়া ডিঙিয়ে পার্কে ঢুকাল ওরা। পরিত্যক্ত পার্ক। এককালে সাইনবোর্ডে নাম ছিলঃ প্লেজার পার্ক। এখন আর সাইনবোর্ড নেই, অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। দুটো খুঁটির একটা আছে, তা-ও হেলে রয়েছে। সিমেন্টে তৈরি বিশ্রাম নেবার আসনগুলো বেশিরভাগই ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। বেঁকেচুরে মরচে অংশ খুলে ভেঙে পড়ে আছে কাঠামোর কাছেই। খুব শক্ত করে তৈরি নাগরদোলাটাকে। দাঁড়িয়ে আছে এখনও, তবে শরীরের বেশিরভাগই ক্ষতবিক্ষত। একই অবস্থা হয়েছিল হয়ত নাগরদোলাটারিও, কিন্তু এখন মেরামত হয়েছে। জায়গায় জায়গায় নতুন কাঠ। সিরিষা দিয়ে ঘষে তুলে ফেলা হয়েছে রঙ, নতুন করে লাগানো হবে। কেমন যেন ভূতুড়ে চেহারা। এই দিনের বেলায়ও গা ছমছম করে উঠল মুসার।
এই পার্ক আর এর প্রমোদ্যযন্ত্রগুলো কি কাজে লাগবে, খুলে বললেন মিস্টার আমানঃ একটা লোককে ভুল করে খুনের দায়ে দণ্ডিত করা হয়েছে, সে-ই নায়ক। আসল খুনী অন্য লোক। পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে গেল দণ্ডিত লোকটা। খোঁজখবর নিয়ে বের করে ফেলল। কে খুনী। পিছু নিল। টের পেয়ে পালাতে চাইল খুনী। কিন্তু পারল না। তার পেছনে লেগে রইল নায়ক। শেষে স্কেলিটন আইল্যান্ডে এসে লুকাল খুনী। শেষ দৃশ্যটা এরকমঃ একদল লোক আসবে এই পুরানো পার্কে পিকনিক করতে। তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে গা ঢাকা দিতে চাইবে খুনী। কিন্তু নায়কের চোখ এড়াতে পারবে না। নাগরদোলায় চড়ার সময় ঠিক তাকে চিনে ফেলবে। তাড়া করবে। মারপিট গোলাগুলি শুরু হবে। ভয় পেয়ে হুড়াহুড়ি ছুটাছুটি শুরু করবে পিকনিকে আসা দলটা। কিছুতেই নায়কের সঙ্গে পেরে উঠবে না খুনী। শেষে গিয়ে উঠবে নাগরদোলায়। দোলাটা চলতেই থাকবে, ওই অবস্থায়ই নায়কের সঙ্গে মারপিট হবে তার। দোলা থেকে পড়ে গিয়ে মরবে খুনী।
খাইছে! দারুণ কাহিনী প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ছবিটা দেখতেই হবে!
এখানে শুটিং করা গেলে, দৃশ্যটা আরও আগেই দেখতে পারবে, হেসে বললেন মিস্টার আমান। তো আমি যাই। কিছু কাজ করি গিয়ে। তোমরা ঘুরেফিরে দেখ। আধঘণ্টার ভেতরেই ফিরে আসব জোসেফ। পা বাড়াতে গিয়েও থেমে পড়লেন। আর হ্যাঁ, খবরদার, গুপ্তধনের খোঁজখবর বেশি কোরো না! লোকে ঘুণাক্ষরেও যদি ভেবে বসে মোহরের খোঁজ পেয়ে গেছ তোমরা, তাহলে সর্বনাশ হবো দলে দলে লোক ছুটে আসবে। মোহর খুঁজতে শুরু করবে। বারোটা বাজবে শুটিঙের। গত পঞ্চাশ বছরে খুব একটা খোঁজাখুঁজি হয়নি, মোহর পাওয়া যায়নি সৈকতে। লোকে ভুলেই গেছে ব্যাপারটা। ভুলেই থাকতে দাও।
পাহাড়ের ওদিকে গেলে কোন ক্ষতি আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ওতে নাকি একটা গুহা আছে। কথিত আছে, জলদস্যুরা বন্দীকে ধরে এনে ওখানে পুরে রাখত।
আমিও শুনেছি, বললেন মিস্টার আমান। যেতে চাইলে যাও। কিন্তু আধঘণ্টার ভেতর ফিরবে। ঘুরে হাটতে শুরু করলেন তিনি।
ঘুরে ঘুরে পার্কটা দেখতে লাগল তিন কিশোর।
জায়গাটা কেমন যেন ভূতুড়ো বিড়বিড় করে বলল মুসা। গা ছমছম করছে আমার।
কিশোর, তুমি চুপ করে আছ কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন। কিছু ভাবছ মনে হচ্ছে?
অ্যাঁ…হ্যাঁ, নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা থামাল কিশোর। রাফাত চাচার ধারণা, চুরি করছে জেলেরা। সিনেমা কোম্পানির আর সবারও তাই ধারণা, তোমরা দুজনও হয়ত এটাই ভাবছ।
ভাবছি তো। জেলে ব্যাটাদেরই কাজ, বলল মুসা। ব্যবসা খারাপ। খেতে পায় না। সেজন্যেই চুরি করছে।
আমার কিন্তু তা মনে হয় না, বলল কিশোর।
অপেক্ষা করে রইল রবিন আর মুসা।
যন্ত্রপাতি চুরি করার পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে, বলল গোয়েন্দাপ্রধান। কঙ্কাল দ্বীপ থেকে সিনেমা কোম্পানিকে তাড়াতে চাইছে হয়ত কেউ। বাইশ বছর ধরে নির্জন পড়ে আছে দ্বীপটা। তা-ই থাকুক, এটাই হয়ত চায় ওই লোক।
টেরর ক্যাসলের ওপর জন ফিলবির যেমন মায়া বসে গিয়েছিল, হাসল মুসা। কঙ্কাল দ্বীপের ওপরও তেমনি কারও আকর্ষণ আছে বলতে চাইছ? নইলে সিনেমা কোম্পানিকে তাড়াতে চাইবে কেন?
সেটাই রহস্য, মাথা ঝোঁকাল কিশোর। চল, গুহাটা দেখে আসি।
পার্ক থেকে বেরিয়ে এল ওরা। গাছপালার ভেতর দিয়ে পাহাড়ের দিকে উঠে গেছে একটা পায়ে চলা পথ। আগের রাতের ঝড়ে ভেঙে পড়েছে অনেক গাছপালা। পথের ওপর ডালপাতা বিছিয়ে আছে। ওসবের মধ্যে দিয়ে চলতে অসুবিধে হচ্ছে, বিশেষ করে রবিনের। তার ভাঙা পা সারেনি পুরোপুরি।
দশ মিনিট পর পাহাড়ের মাথার কাছে উঠে এলো ওরা। পাহাড় না। বলে বড় টিলা বলাই উচিত। কিন্তু নাম পাহাড়, জলদসু্যুর পাহাড়। ঠিক চুড়ার কাছে গুহামুখ, খুদে একটা আগ্নেয়গিরি যেন। ভেতরে উঁকি দিল তিন গোয়েন্দা। অন্ধকার।
ভেতরে পা রাখল ওরা। তেরছা হয়ে নেমে গেছে। সুড়ঙ্গ। সুড়ঙ্গ পেরিয়ে একটা গুহায় এসে ঢুকল তিন কিশোর। বেশ বড় হলরুমের মত গুহা। লম্বাটে। শেষ প্রান্তটা সরু। সুড়ঙ্গ দিয়ে আলো এসে পড়ছে, গুহার ভেতরে আবছা অন্ধকার।
গুহার মাটি আলগা, হাঁটতে গেলে পা দেবে যায়। অসংখ্যবার খোঁড়া হয়েছে প্রতিটি ইঞ্চি, তার প্রমাণ।