ইংরেজ জাহাজের ক্যাপ্টেন প্রথমেই জানতে চাইল, মোহরগুলো কোথায়?
খিকখিক করে হেসে উঠল এক-কান-কাটা। বলল, সাগর দেবতার খাজাঞ্চিখানায়। চাওগে ওর কাছে। হাতে পায়ে ধরলে দিয়েও দিতে পারে।
অনেক নির্যাতন করা হল এক-কান-কাটা আর তার সহচরদের ওপর। কিন্তু কেউ মুখ খুলল না। ফাঁসির দড়িতে ঝোলার আগেও বলল না কেউ কোথায় আছে মোহরগুলো। তন্নতন্ন করে খোঁজা হল হস্ত আর তার আশপাশের দ্বীপগুলো। কিন্তু মোহরের চিহ্নও মিলল না। ধরেই নিল ইংরেজ ক্যাপ্টেন, মোহরগুলো সব উপসাগরে ফেলে দিয়েছে এক-কানকাটা। ওগুলো আর উদ্ধারের কোন আশা নেই। খানিকটা হতাশ হয়েই দেশে ফিরে গেল ক্যাপ্টেন।
এদিককার সাগর নিশ্চয় তোমার চেনা, তাই না, পাপু? সামনের অন্ধকারের দিকে চেয়ে বলল কিশোর।
নিজের হাতের তালুর মত, জবাব দিল পাপালো। সুযোগ পেলেই এদিকে চলে আসি। ডুব দিই সাগরে। মোহর খুঁজি।
শুনেছি, অনেকেই মোহর খোঁজে। এখানে, বলল রবিন। পায়ও কেউ কেউ।
তুমি পাও-টাও? পাপালোকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
দ্বিধা করল পাপালো। তারপর বলল, পাই। তবে ওটাকে না পাওয়া বললেও চলে।
শেষ কবে পেয়েছ? জানতে চাইল কিশোর।
গত হপ্তায়, বলল পাপালো। কোথায় পেয়েছি, বলব না। এটা আমার সিক্রেট। শক্ত হয়ে বস, মোড় ঘোরাব।
মোড় ঘোরালে কেন শক্ত হয়ে বসতে হবে, জিজ্ঞেস করতে গিয়েও থেমে গেল মুসা। জোরে একবার কেঁপে উঠল নৌকা। একপাশে কাত হয়ে গেল পাল, সেই সঙ্গে নৌকাটাও। পাশে আঘাত হানল ঢেউ। ছিটকে পানি এসে লাগল ছেলেদের গায়ে। শক্ত করে দাঁড় ধরে রইল পাপালো।
আরেকবার কেঁপে উঠেই সোজা হয়ে গেল নৌকা। এগিয়ে চলল আবার। সামনে দেখা যাচ্ছে ফিশিংপোটের আলো।
স্কেলিটন আইল্যান্ড এখন পিছনে, বলল পাপালো। গাঁয়ের দিকে এগোচ্ছি আমরা।
পেছনে ফিরে চাইল তিন গোয়েন্দা। দেখা যাচ্ছে না দ্বীপ। শুধু কালো অন্ধকার।
হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন, দেখ দেখা আলো!
একসঙ্গে জ্বলে উঠেছে অনেকগুলো আলো, ঘুরছে। শোনা যাচ্ছে অদ্ভুত একটা ধাতব শব্দ। আস্তে আস্তে বাড়ছে ঘোরার বেগ। দেখতে দেখতে আলোর এক বিশাল আংটি তৈরি হয়ে গেল।
ইয়াল্লা! ফিসফিস করে বলল মুসা। নাগরদোলা নিশ্চয় ঘোড়ায় চেপে বসেছে স্যালি…
পাপু মুসার কথা শেষ হবার আগেই বলল কিশোর। নৌকা ঘোরাও! দেখব, কিসে ঘোরাচ্ছে নাগরদোলা!
আমি পারব না। মাথা নাড়ল পাপালো। স্যালির ভূত; ঝড় থেমেছে একটু আগে। এখন এসেছে দোলায় চড়তো ইসস, নৌকাটা আরও জোরে চলছে না কেন! একটা মোটর যদি থাকত…
সোজা ফিশিংপোর্টের দিকে ছুটে চলেছে নৌকা। খুশিই হয়েছে মুসা। আর রবিন। হতাশ হয়ে কিশোর। সত্যিকারের ভূত দেখার ইচ্ছে তার অনেক দিনের। এমন একটা সুযোগ হাত-ছাড়া হয়ে গেল।
অন্ধকারে উজ্জ্বল আলোর রিঙ তৈরি করে ঘুরেই চলেছে নাগরদোলা। বাইশ বছর আগে মরে যাওয়া তরুণীর প্ৰেতাত্মা. কথাটা ভাবতেই শিউরে উঠল রবিন।
হঠাৎ থেমে গেল ধাতব শব্দ। নিভে গেল। আলো। এত তাড়াতাড়ি নাগরদোলা চড়ার শখ মিটে গেল স্যালির প্ৰেতাত্মার. আশ্চর্যা-ভাবলী কিশোর। অন্ধকারের দিকে চেয়ে বসে আছে সে। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে।
আরও আধা ঘণ্টা পর মিসেস ওয়েলটনের বোডিং হাউসে এসে উঠল তিন গোয়েন্দা। সঙ্গে সঙ্গে টেলিফোনে সিনেমা কোম্পানিকে জানিয়ে দিল মিসেস।
গরম পানিতে গোসল করল তিন গোয়েন্দা। খাওয়া সারল। গরম বিছানায় উঠল।
কম্বলটা গায়ের ওপর টেনে দিতে দিতে বলল কিশোর, ভূতটা দেখতে পারলে ভাল হতা
আমার তা মনে হয় না, ঘুমজড়িত গলায় বলল মুসা। শুয়ে পড়ে কম্বলটা টেনে নিল গায়ের ওপর।
রবিন কিছু বলল না। ঘুমিয়ে পড়েছে।
৪
ঘুম ভাঙল রবিনের। চোখে পড়ল ঢালু হয়ে নেমে যাওয়া চাল। মনে পড়ল, বাড়িতে নেই সে। রকি বীচ থেকে তিন হাজার মাইল দূরে ফিশিংপোটের এক বোডিং হাউসে শুয়ে আছে।
উঠে বসে চারদিকে তাকাল রবিন। একটা ডাবল-বাংকের ওপরের তাকে রয়েছে। নিচের তাকে ঘুমাচ্ছে মুসা। কয়েক ফুট দূরে আরেকটা বাংকে কিশোর।
আবার শুয়ে পড়ল রবিন। আগের রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো ছবির মত খেলতে লাগল। মনের পর্দায়।
দরজায় টোকা দেবার শব্দ হল। খুলে গেল পাল্লা। ঘরে এসে ঢুকল হাসিখুশি, বেঁটে-মোটা এক প্রৌঢ়া। মিসেস ওয়েলটন, বাড়িওয়ালি। রবিনকে জেগে থাকতে দেখে বলল, এই যে, ওঠ, উঠে পড়। নাস্তা তৈরি। নিচে দুজন লোক দেখা করতে এসেছেন তোমাদের সঙ্গে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসো।
বেরিয়ে গেল মিসেস ওয়েলটন।
লাফ দিয়ে বাংক থেকে নেমে এল রবিন। মুসা কিংবা কিশোরকে ডাকতে হল না। বাড়িওয়ালির গলা শুনে জেগে উঠেছে দুজনেই।
দ্রুত তৈরি হয়ে নিচে নেমে এল ওরা। উজ্জ্বল হলুদ রঙ করা ডাইনিং রুমের দেয়াল, ছাত। সামুদ্রিক জীবজন্তুর খোলস দিয়ে সাজানো হয়েছে। টেবিলে নাস্তা তৈরি। এক ধারে দুটো চেয়ারে বসে কফি খাচ্ছে দুজন লোক। কথা বলছেন নিচু গলায়।
ছেলেদেরকে ঢুকতে দেখেই উঠে দাঁড়াল একজন। বিশালদেহী! কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। কোঁকড়া চুল। হাসলেন। ঝিকি করে উঠল। ঝকঝকে সাদা দাঁত। কেমন আছ তোমরা, মুসা ঠিক প্রশ্ন নয়। জবাবের অপেক্ষা না করেই বললেন মিস্টার রাফাত আমান, গতরাতেই এসেছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলে। আর জাগালাম না। তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে হয়েছে আবার দ্বীপে। উফফ, যা ভাবনায় পড়েছি না প্রতিটি মিনিটই পাহারা দিয়ে রাখতে হয় জিনিসপত্র। কাঁহাতক আর পারা যায়। থামলেন তিনি। তিন কিশোরের ওপর চোখ বুলিয়ে আনলেন একবার। তারপর বললেন, তারপর? তোমাদের কাহিনী বল। গতরাতে কি হয়েছিল?