না না, ধাক্কা দিয়ে নৌকাটা বালির ওপর থেকে পানিতে ঠেলে দিল পাপালো। লাফ দিয়ে উঠে পড়ল। গলুইয়ে। দাঁড় ধরল। পালে হাওয়া লাগতেই তরতর করে ছুটে চলল হালকা নৌকা। দূরে দেখা যাচ্ছে ফিশিংপোট গ্রামের আলো।
কথায় কথায় তিন গোয়েন্দার কাছে নিজের পরিচয় দিল পাপালো। বাড়ি গ্ৰীসের এক ছোট্ট গাঁয়ে। বড় হয়েছে ভূমধ্যসাগর উপকূলে। মা নেই। বাবা স্পঞ্জ শিকারি জেলে। সাগরের তল থেকে স্পঞ্জ তুলে বিক্রি করত। এই ছিল জীবিকা।
খুব দরিদ্র গ্ৰীসের স্পঞ্জ শিকারিরা। ডুবুরির সাজ-সরঞ্জাম কেনার পয়সা নেই তাদের। ফলে কোন যন্ত্রপাতি ছাড়াই ডুব দিতে হয়। দুহাতে একটা ভারি পাথর নিয়ে পানিতে ছেড়ে দেয় শরীর। দ্রুত ড়ুবে যায় তলায়। পাথর ছেড়ে দিয়ে স্পঞ্জ কুড়িয়ে নিয়ে ভেসে ওঠে ওপরে। পাপালোর বাবাও এই কায়দায় স্পঞ্জ তুলে আনত। হঠাৎ একদিন আক্রান্ত হল স্পঞ্জ-শিকারির অভিশাপ বেণ্ড রোগে। অকেজো হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল রোজগার। কিছুদিন চলল সঙ্গী জেলেদের দয়ায়। ওই সময় ফিশিংপোটে জেলের কাজ করত পাপালোর চাচা। ভাইয়ের দুরবস্থার খবর পেয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিল। ভাই ভাতিজাকে নিয়ে এল নিজের কাছে।
কয়েক বছর ভালই কাটল, বলল পাপালো। তারপরই দেখা দিল দুৰ্ভাগ্য। লাল কীট আক্রমণ করল। ঝিনুককে। ব্যবসা খতম। নৌকা বেচে দিয়ে নিউ ইয়র্কে চাকরি নিয়ে চলে গেল। চাচা। আমি আর বাবা রয়ে গেলাম এখানে। না থেকেই বা কি করব। মাছধরা ছাড়া আর কোন কাজ জানি না। বাবা পঙ্গু। তাকে নিয়ে কোথায় যাব? চাচার ঘাড়ে গিয়ে সওয়ার হতে ইচ্ছে হল না। নিজেরই চলে না, তবু কিছু কিছু করে বাঁচিয়ে মাসে মাসেই টাকা পাঠায় বাবাকে। খুব কষ্টে দিন কাটে আমাদের। একদিন খবর পেলাম, ফিশিংপোটে এক সিনেমা কোম্পানি আসছে। দ্বীপে ক্যাম্প করবে ওরা, ছবির শুটিং করবে। ডুবুরির কাজটা খুব ভাল পারি। আশা হল, একটা কাজ পেয়ে যাব সিনেমা কোম্পানিতে। দ্বীপে ক্যাম্প করবে যখন, নিশ্চয় সাগরের তলায় শুটিং করবে। ডুবুরির দরকার হবে। এল ওরা। গেলাম। কিন্তু কাজ দিল না। আমি বিদেশী। বিদেশীকে দেখতে পারে না। এখানকার লোকে। তবে, আশা ছাড়িনি আমি এখনও।
এগিয়ে চলেছে নৌকা। কানে আসছে কঠিন কিছুতে ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ।
কোথায় আছি। এখন? জানতে চাইল মুসা। অন্ধকারে নিশানা ঠিক রাখতে পার? অন্ধকারে ডুবো পাহাড়ে বাড়ি লেগে যেতে পারে নৌকা!
শব্দ শুনেই বুঝতে পারি। আমি, কোন পথে চলেছি, বলল পাপালো। ওই যে, ঢেউ আছড়ে পড়ছে প্রবাল প্রাচীরে, বাঁয়ে। দ্য বোনস-এর পাশ দিয়ে চলেছি আমরা। সামনে স্কেলিটন আইল্যান্ড।
সামনে তাকাল তিন গোয়েন্দা। অন্ধকারে পরিষ্কার দেখা গেল না। কঙ্কাল দ্বীপ। কিন্তু অবয়বটা মনে গাঁথা আছে। ওদের। প্লেন থেকে দেখেছে, খুলির আকার। ম্যাপে দেখেছে। মিস্টার ক্রিস্টোফারের দেয়া ম্যাগাজিন পড়ে জেনেছে অনেক খুঁটিনাটি।
আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে এই দ্বীপ। একে ঘিরে আছে আটলান্টিক উপসাগর। ১৫৬৫ সালে আবিষ্কার করেছিলেন এক ইংরেজ নাবিক, ক্যাপ্টেন হোয়াইট। দ্বীপে নেমেছিলেন ক্যাপ্টেন। এটা ছিল তখন স্থানীয় ইণ্ডিয়ানদের গোরস্থান। কবর বেশি গভীর করে খুড়ত না ইণ্ডিয়ানরা। ফলে পানি আর বাতাসে কবরের ওপরের বালিমাটি সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ত মরার হাড়গোড়। অনেক কঙ্কাল দেখেছিলেন তিনি। দ্বীপের নাম রাখলেন, স্কেলিটন আইল্যান্ড। তারপর কাছের আরেকটা দ্বীপে নামলেন। অনেকটা চৌকোণা ওই দ্বীপ, এক প্ৰান্ত থেকে লম্বা হয়ে বেরিয়ে গেছে সরু সরু পাঁচটা প্রবাল প্রাচীর। ওটার নাম রাখলেন দ্য হ্যান্ড। দুটো দ্বীপের মাঝের একসারি প্রবাল-প্রাচীরের নাম রাখলেন দ্য বোনস। তারপর একদিন আবার জাহাজ নিয়ে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন।
এর অনেক বছর পর দ্বীপগুলোর খোঁজ পেল জলদস্যুরা। ওগুলোকে শীতকালের ঘাঁটি বানাল ওরা। আশপাশে তখনও শহর ছিল। ডাকাতি করে আনা সোনার মোহর খরচ করতে যেত ওরা ওসব শহরে। দুৰ্দান্ত জলদসু্যু ব্ল্যাকবিয়ার্ডও এক শীতে বেরিয়ে গিয়েছিল এখান থেকে।
উৎপাত বেড়ে গেল জলদস্যুদের। ইংরেজ নৌ-বাহিনী তাদেরকে তাড়া করে আনল। এখান পর্যন্ত। দলবল সহ একে একে মেরে শেষ করল দস্যু সর্দারদের। ১৭১৭ সালে মারা পড়ল ব্ল্যাকবিয়ার্ড। এ-অঞ্চলে বাকি রইল। শুধু তখন দুর্দান্ত দস্যু ক্যাপ্টেন ওয়ান-ইয়ার (এক কান কাটা বলেই এই নাম) আর তার দল। ঠাঁই নিল এসে কঙ্কাল দ্বীপে।
গোলমাল শুনে এক রাতে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠল। দস্যুরা। দেখল, তাদেরকে ঘিরে ফেলেছে নৌ-বাহিনীর লোক।
নির্বিচারে ডাকাত জবাই শুরু করল নৌ-বাহিনীর লোকেরা। ওয়ানইয়ার বুঝল, লড়াই করে টিকতে পারবে না। গোলমালের ফাঁকে একটা লংবোটে করে কেটে পড়ল সে। সঙ্গে নিল তার মোহরের সিন্দুক, আর অতি বিশ্বস্ত কয়েকজন সহচর।
দ্বীপে যে কজন ডাকাত ছিল, একটাকেও ছাড়ল না নৌ-বাহিনী, সবকটাকে হত্যা করল। এরপর খেয়াল হল ওদের, এক-কান-কাটা মারা পড়েনি। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। বুঝে ফেলল ওরা, পালিয়েছে ওয়ান-ইয়ার। জাহাজ নিয়ে তাড়া করল পেছনে। বেগতিক দেখে নৌকার মোড় ফেরাল ডাকাত সর্দার। হস্তে এসে লুকানোর চেষ্টা করল। শেষরক্ষা করতে পারল না সো। ধরা পড়ল নৌ-বাহিনীর হাতে।