একটা টিলা, উটের কুঁজের মত ঠেলে বেরিয়ে আছে দ্বীপের গা থেকে। আশপাশে ছোটবড় পাথরের ছড়াছড়ি। এদিক ওদিক দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা গাছ, বাতাসের ঝাপটায় মাথা নুইয়ে ফেলেছে। কোন পথ চোখে পড়ল না, দেখা গেল না ক্যাম্প।
অদ্ভুত শব্দ হল আবার। ঠিক এই সময় আবার বিদ্যুৎ চমকাল। অবাক হয়ে দেখল তিন কিশোর, কুঁজের ঠিক মাঝখান থেকে তীব্ৰ গতিতে আকাশে উঠে যাচ্ছে পানি, বিশাল এক ফোয়ারা। বাতাসের আঘাতে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছিটকে পড়ছে পানি, অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছে সে-জন্যেই।
প্রাকৃতিক ফোয়ারা বলে উঠল কিশোর। কঙ্কাল দ্বীপ না, এটা হস্ত!
স্তব্ধ হয়ে গেল অন্য দুজন।
তাদেরকে হস্তে নামিয়ে দিয়ে গেল কেন হান্ট? এই ভয়াবহ ঝড়ের রাতে নির্জন দ্বীপে ফেলে রেখে গেল কেন?
৩
কুঁজের গায়ে একটা ছোট্ট খোঁড়ল। ওতেই ঠাঁই নিল তিন গোয়েন্দা। কোনমতে গাদাগাদি করে বসল। কষ্ট হচ্ছে বটে, কিন্তু বাতাস আর বৃষ্টির কবল থেকে রেহাই মিলল এখানে।
কয়েক মিনিট আগে খোঁড়লটা খুঁজে বের করেছে ওরা। নিশ্চিত হয়ে গেছে, এটা হস্ত দ্বীপ। দ্বীপে ক্যাম্প নেই, মানুষ নেই, জেটি নেই, বোট নেই।
এখানে নামিয়ে দিয়ে গেল কেন হান্ট, কপালে লেগে থাকা পানির কণা মুছতে মুছতে বলল মুসা, বুঝতে পারছি না।
ভুল করেছে। হয়ত, বলল রবিন। কঙ্কাল দ্বীপ ভেবে হন্তে নামিয়ে দিয়ে গেছে।
না, মাথা নাড়ল কিশোর। ভুল করেনি। ইচ্ছে করেই এখানে ফেলে গেছে ব্যাটা। প্রথম থেকেই লোকটাকে ভাল লাগেনি। আমরা গোয়েন্দা, জানল কি করে! কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।
যা খুশি হোকগে, মুসার গলায় হতাশা। না খেয়ে না মরলেই হল।
সকালে খুঁজে পাবে, বলল কিশোর। ভর রাতেই মাছ ধরতে বেরোয় জেলেরা।
কিন্তু এদিকে কোন জেলে-নৌকা আসার কথা না, রবিনের গলায় সন্দেহ। পড়নি, এক ধরনের লাল পরজীবী কীটের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে। এখানকার ঝিনুক? খাওয়া নিরাপদ নয়। মেলভিলের একেবারে দক্ষিণে ঝিনুক তুলতে যায় এখন জেলেরা। ফিশিংপোর্টের এদিকে আসে না। আর কিছুদিন এভাবে চললে গ্রাম ছেড়ে চলে যাবে সবাই।
তবু, কেউ না কেউ আসবেই, জোর দিয়ে বলল কিশোর। আমরা নিরুদ্দেশ হয়েছি, জানবেন। রাফাত চাচা। খোঁজখবর শুরু হয়ে যাবে। আজ এখানে নেমে বরং ভালই হল। ফেয়ারাটা দেখতে পেলাম।
আর বিশেষ কিছু বলার নেই কারও। চুপ হয়ে গেল ওরা। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে, কিন্তু খোঁড়লের ভেতর মোটামুটি নিরাপদ। যেমন হঠাৎ আসে, তেমনি হঠাৎই আবার চলে যায়, এ-অঞ্চলের ঝড়। তিন কিশোর আশা করল, সকাল নাগাদ থেমে যাবে। শিগগিরই ঢুলতে শুরু করল ওরা।
হঠাৎ তন্দ্ৰা টুটে গেল মুসার। কোথায় আছে বুঝতেই পেরিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত। তারা চোখে পড়ল। ঝড় থেমে গেছে। তন্দ্ৰা ছুটে যাবার এটাই কি কারণ? না। চোখে আলো পড়েছিল। এখন আবার পড়ল। শখানেক গজ দূর থেকে আসছে, তীব্র আলোর রশ্মি। এক মুহূর্ত স্থির থাকিল, তারপরই সরে গেল। আবার আলো।
লাফিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে মাথায় বাড়ি খেল মুসা। ইয়াল্লা বলে চেঁচিয়ে উঠে আবার বসে পড়ল। সাবধানে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এল খোঁড়লের বাইরে।। গা থেকে রেনকোট খুলে নাড়তে নাড়তে চেঁচিয়ে বলল, এখানে আমরা এ-খা-নে!
মুসার পাশে এসে দাঁড়াল রবিন আর কিশোর।
আবার আলো পড়ল মুসার গায়ে। তারপরই সরে এসে পড়ল। রবিন আর কিশোরের ওপর। এক মুহূর্ত স্থির রইল। চকিতের জন্যে একবার উঠে গেল আকাশের দিকে। একশো গজ দূরে নৌকার পাল দেখতে পেল তিন গোয়েন্দা।
দ্বীপের গায়ে ভিড়েছে নৌকা বলে উঠল মুসা। আমাদেরকে যেতে বলছে…
আকাশে তারার আলো। আবছা অন্ধকার। হাঁটতে শুরু করল তিন গোয়েন্দা।
আবার জ্বলে উঠল টর্চ।
দেখ দেখ! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আমাদেরকে পথ দেখাচ্ছে।
বৃষ্টিতে ভিজে পিচ্ছিল হয়ে আছে মাটি। দৌড়ানো তো দূরের কথা, তাড়াতাড়ি হাঁটাই যাচ্ছে না। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে একবার আছাড় খেল মুসা। পাথরে ঘষা লেগে ছড়ে গেল হাঁটু।
পানির কিনারে এসে থামল তিন গোয়েন্দা। তীরে ভিড়েছে ছোট একটা পালতোলা নৌকা। পাশে বালিতে দাঁড়িয়ে আছে তাদেরই বয়েসী। এক কিশোর। পরনে পানি নিরোধক জ্যাকেট। প্যান্টটা গুটিয়ে হাঁটুর কাছে তুলে নিয়েছে।
তিন গোয়েন্দার মুখে আলো ফেলল। ছেলেটা। দেখল। তারপর নিজের মুখে আলো ফেলে দেখাল ওদেরকে। হাসিখুশি একটা মুখ। রোদোপোড়া তামাটে চামড়া। কোঁকড়া কালো চুল। কালো উজ্জ্বল এক জোড়া প্ৰাণবন্ত চোখ।
হাল্লো! ইংরেজিতে বলল ছেলেটা। কথায় বিদেশী টান। তোমরা তিন গোয়েন্দা, না?
অবাক হল তিন কিশোর। তাদের পরিচয় এখানে গোপন নেই কারও কাছেই! ঢোল পিটিয়ে জানানো হয়েছে যেন!
হ্যাঁ, আমরা তিন গোয়েন্দা, বলল কিশোর। খুঁজে পেলে কি করে?
কোথায় খুঁজতে হবে, জানতাম, বলল ছেলেটা। মুসার সমান লম্বা। হালকা-পাতলা। আমি পাপালো হারকুস। পাপু ডাকে বন্ধুরা।
তো, পাপু, বলল মুসা। হাসিখুশি ছেলেটাকে ভালই লাগছে তার। কোথায় খুঁজতে হবে, কি করে জানলে?
অনেক লম্বা কাহিনী, বলল পাপালো। এসো, নৌকায় ওঠ। সিনেমা কোম্পানির লোকজন খুব ভাবনায় পড়ে গেছে।
এসকেপ ছবিতে কোন কাজ করছ তুমি? নৌকায় উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল রবিন।