আর ভাবতে চাইল না রবিন। চারদিক নীরব নিঃশব্দ। কানে আসছে। শুধু নৌকার গায়ে ঢেউয়ের বাড়ি লাগার মৃদু ছলছলাৎ।
হঠাৎ আরেকটা শব্দ কানে এলো রবিনের। খুবই মৃদু। বোটের সঙ্গে কিছুর ঘষা লেগেছে, আলতো করে একবার দুলে উঠল। চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেল সে, বোটের ধারে একটা মাথা। আবছা।
অতি সাবধানে উঠতে লাগল। মাথাটা। গলা দেখা গেল. কাঁধ. বোটের ভেতরে চলে এলো সে। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এলো। উঁকি দিয়ে তাকাল একবার তীরের দিকে। আবার মাথা নামাল। রবিন আর মুসার পাশে এসে থামল।
এক মুহূর্ত ঘন ঘন শ্বাস ফেলার শব্দ কানে এলো রবিনের। কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল একটা কণ্ঠ, চুপ! আমি পাপালো!
পাপালো! ও কি করে এলো এখানো অবাক হয়ে গেল দুই গোয়েন্দা। ওর তো এখন জেলে থাকার কথা!
কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল রবিন, গোঙানির শব্দ হল।
চুপ! আবার বলল পাপলো। কোন কথা নয়। ছুরি দিয়ে বাঁধন কাটতে লাগল পাপালো। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু রবিনের মনে হল। কয়েক যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে।
কাটা হয়ে গেল বাঁধন। মাথাতুলতে গেল মুসা। হাত দিয়ে চেপে নামিয়ে দিল পাপালো। ফিসফিস করে বলল, খবরদার, দেখে ফেলবো পেছনের দিকে এগোও। পানিতে নামতে হবে।
হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে গেল মুসা। তার পেছনে রবিন। সবার পেছনে পাপালো।
নেমে পড়া বলল পাপালো। খুব সাবধান! কোন শব্দ যেন না হয়! হালের দন্ডটা ধরে থাকবে। আমি আসছি।
হাজারো প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে মনে, পরে জিজ্ঞেস করবে। পাপালোকে। আস্তে করে নেমে এলো রবিন। শব্দ হল অতি সামান্য, ঢেউয়ের ছলছলাৎ ঢেকে দিল সে শব্দ।
রবিনের পর পরই নামল মুসা। চলে এলো পেছনে। রবিন ধরে রেখেছে হালের দন্ড। সে-ও এসে ধরল।
খাইছে! রবিনের কাছে মুখ এনে বলল মুসা। ও এলো কি করে!
জানি না! তবে এসে পড়ায় বেঁচে গেলাম বোধহয়া ফিসফিস করে বলল রবিন।
বান মাছের মত পিছলে পানিতে নামল পাপালো। নিঃশব্দে। দুই গোয়েন্দার কাছে চলে এলো। এসো আমার সঙ্গে। খুব সাবধানে সাঁতরাবো কোন আওয়াজ যেন না হয়।
তীরের ধার ধরে সাঁতরে চলল পাপালো, নিঃশব্দে। তাকে অনুসরণ করল। দুই গোয়েন্দা। রবিন ভাবছে, জ্যাকেট আর প্যান্ট খুলে নিতে পারলে ভাল হত।
কালো পানি। আবছা কালো তিনটে মাথা, ভাল করে খেয়াল না। করলে দেখাই যায় না। কোনরকম শব্দও করল না ওরা। মিনিট দশেক পরে একটা জায়গায় এসে পৌঁছুল। সাগরের দিকে সামান্য ঠেলে বেরিয়ে আছে এখানে সৈকত। ওটা ঘুরে আরেক পাশে চলে এলো। বোটটা আর দেখা যাচ্ছে না। জিম রিভানের দৃষ্টির বাইরে চলে এসেছে ওরা।
তীরের দিকে ফিরে সাঁতরাতে শুরু করল পাপালো। অনুসরণ করল। দুই গোয়েন্দা।
বালিতে ঢাকা সৈকত নেই এখানে। পানির ওপর নেমে এসেছে ঝোপ ঝাড় আর ছোট ছোট গাছ। একটা শেকড় ধরে উঠে গেল পাপালো। এগিয়ে গিয়ে থামল দুটো বড় পাথরের মাঝে। মুখ বের করে উঁকি দিল। তার পাশে এসে বসেছে দুই গোয়েন্দা। ওরাও উঁকি দিল।
প্রায় তিনশো ফুট দূরে মোটর বোটটা। তারার আলোয় আবছা। জিম রিভানের মূর্তিটা আরও কাছে।
এবার কথা বলতে পারি, নিচু গলায় বলল পাপালো। আমাদেরকে দেখতে পাবে না ওরা।
এখানে এলে কি করে? একই সঙ্গে প্রশ্ন করল দুই গোয়েন্দা।
মুখ টিপে হাসল পাপালো। তোমাদের সঙ্গে কথা বলে শিওর হয়ে এসেছেন হোভারসন, আমি চোর নই। কাজ শেষ করে ফিরে এসেছেন। তখন জিজ সাহেব। নিজের পকেট থেকে জামিনের পঞ্চাশ ডলার দিয়ে দিয়েছেন চীফ। জামিন হয়েছে হাক স্টিভেন। হাজত থেকে বাড়ি নিয়ে গেলেন। আমাকে হোভারসন। খাওয়ালেন। তারপর ছাড়লেন।
কিন্তু এখানে এলে কি করে? কি করে জানলে আমরা এখানে এসেছি? জিজ্ঞেস করল রবিন।
সোজা বাসায় চলে গেলাম, বলল পাপলো। বাবাকে যতটা খারাপ অবস্থায় দেখব ভেবেছিলাম, তত খারাপ নয়। পড়শি এক মহিলা দেখাশোনা করেছেন। বেরিয়ে এলাম। বাইরে। সাগরের দিকে চেয়ে বসে ভাবতে লাগলাম। ছুরিটা ট্রেলারে গেল কি করে? আমাকে চোর বানানোর জন্যে কেউ একজন ফেলে রেখেছিল ওখানে ছুরিটা, কে? ছুরিটা হারিয়েছি। পরশু, যেদিন গুহায় ঢুকেছিলাম। জিম রিভান তাড়া করল, পালালাম। তার পর থেকেই আর পাইনি ছুরিটা। তারমানে তাড়াহুড়োয় খেয়াল করিনি, ওটা রেখেই পালিয়েছিলাম। এরপর একটা মাত্র লোকের হাতেই পড়তে পারে জিনিসটা, জিম রিভান। তার পক্ষেই ট্রেলারে ঢোকা সহজ, অবশ্যই দরজা দিয়ে। লেন্স চুরি করা সহজ। ট্রেলারের জানালা ওই ভেঙেছে, ছুরিটা ফেলে রেখেছে মেঝেতে। ব্যাটার ওপর চোখ রাখা দরকার মনে করলাম। ঘাটে বাঁধা একটা নৌকা চুরি করে নিয়ে চলে এলাম দ্বীপে। থামল সে। তারপর বলল, নৌকাটা একটা ঝোপের ধারে বেঁধে রেখে চলে গেলাম ক্যাম্পের কাছে। পার্কের দিকে এগোতে দেখলাম জিমকে। পিছু নিলাম। পার্কের পরে ছোট একটা জংলা পেরিয়ে সৈকতে বেরোল সে। দূরে একটা মোটর বোট দেখলাম। হাতের টর্চ সেদিকে করে তিনবার জ্বালাল-নেভাল জিম। তীরে এসে ভিড়ল বোট। তাজ্জব হয়ে দেখলাম, নামল। দুই ভাই, ডিক আর বাড ফিশার।
মুসার দিকে ফিরল পাপালো। হাসল। দাঁড় খুব ভাল টানতে পাের। না তুমি, মুসা। ছপাৎ ছপাৎ শব্দ হচ্ছিল। লুকিয়ে পড়ল তিনজনে। তোমাদের তীরে ওঠার অপেক্ষায় রইল। তারপর আর কি? বোকার মত