খবরটা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করলেন মিস্টার স্মিথ, নইলে বন্ধ হয়ে যাবে পার্ক। কিন্তু গুজব ঠেকানো গেল না। পরদিন সকাল হতে না। হতেই ছড়িয়ে পড়লা খবর। লোকে জানল, ভূতের উপদ্রব শুরু হয়েছে পার্কে। ওটার কাছ থেকে দূরে রইল সবাই। পড়ে পড়ে নষ্ট হতে লাগল নাগরদোলা, নাগরদোলা, দোলনা।
স্যালি ফ্যারিংটনের ভূত নাকি আজও দেখা যায়। ইদানীং নাকি বেড়েছে। প্রায় ঝড়ের রাতেই জেলেরা দেখতে পায়, সাদা একটা মূর্তি। ঘুরে বেড়াচ্ছে দ্বীপে। নষ্ট হয়ে গেছে নাগরদোলা। লোকের ধারণা, ওটা আবার চালু হবার অপেক্ষায় আছে স্যালির প্ৰেতাত্মা।
বহু বছর ধরে নির্জন পড়েছিল। কঙ্কাল দ্বীপ। গ্ৰীষ্মকালে মাঝে মধ্যে দুচারজন বিদেশী যেত ওখানে পিকনিক করতে, তবে দিনের বেলা।
সিনেমা কোম্পানি ঠিক করছে আবার নাগরদোলাটা, বলল হান্ট। স্যালির প্ৰেতাত্মা তাহলে খুব খুশি হবে। আবার চড়তে পারবে… থেমে গেল সে। জানালার কাচে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে ঝড়ো বাতাস। গাড়ি চালনায় মন দিল হান্ট।
পথের দুধারে জলাভূমি, লোক বসতির চিহ্নও নেই। আধা ঘণ্টা পর একটা জায়গায় এসে পৌঁছুল গাড়ি। সামনে দুদিকে ভাগ হয়ে গেছে রাস্তাটা। বাঁদিকের পথের পাশে মাইলপোস্ট। লেখাঃ ফিশিংপোর্টঃ ২ মাইল। ছেলেদেরকে অবাক করে দিয়ে ডানে গাড়ি ঘোরাল হান্ট। খানিক পরেই শেষ হয়ে এল পিচঢালা পথ। সামনে কাঁকর বিছানো ধুলোভরা কাঁচা রাস্তা।
মাইলপোস্ট বসানো বাঁয়ের রাস্তার পাশে, বলেই ফেলল মুসা। এ পথে যাচ্ছি কেন আমরা, মিস্টার হান্ট?
দ্বীপে নিয়ে যেতে বলেছেন, মিস্টার আমান, কাঁধের ওপর দিয়ে বলল হান্ট। আজ রাতে বোডিং হাউসে যেতে মানা করেছেন।
অ! চুপ করে গেল মুসা। কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারল না। কোথায় যেন একটা খটকা রয়ে গেল!
ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগোল গাড়ি। গতি কম। মাইল দুয়েক এসে থেমে পড়ল। হেডলাইটের আলোয় চোখে পড়ল একটা নড়বড়ে জেটি। ছোট, ঝরঝরে একটা মাছ ধরা বোট বাঁধা আছে জেটিতে। জলদি বেরোও! বলল হান্ট। গড নোজা ঝড় এসে গেলেই…
গাড়ি থেকে নামল তিন গোয়েন্দা। বোটটা দেখে অবাক। এতবড় মুভি-কোম্পানি, এর চেয়ে ভাল কোন বোট জোগাড় করতে পারল না! নাকি হান্টের নিজের বোট ওটা?
আমাদের মালপত্র? হান্ট নামতেই জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওগুলোর জন্যে ভাবতে হবে না তোমাদের, বলল হান্ট। নিরাপদেই পৌঁছে যাবে বোর্ডিং হাউসে। জলদি এসো, বোটে ওঠ। এখনও অনেক পথ বাকি।
বোটে উঠল ওরা। মোটরের ওপর বুকল হান্ট। একটা বোতাম টিপে দিতেই স্টার্ট হয়ে গেল পুরানো ইঞ্জিন। ঢেউ কেটে ধুঁকতে ধুঁকতে এগিয়ে চলল বোট। একবার। এদিক কাত হচ্ছে একবার ওদিক। ড়ুবেই যাবে যেন। ভয়ে বুক কাঁপছে তিন কিশোরের।
এলো বৃষ্টি। প্রথমে গুড়ি গুড়ি, জোর বাতাসের ধাক্কায় রেণু রেণু হয়ে আছড়ে পড়ল গায়ে। তারপর নামল বড় বড় ফোঁটায়। পাতলা ক্যানভাসের ঢাকনার তলায় গুটিসুটি হয়ে বসল। তিন কিশোর। অল্পক্ষণেই ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।
রেনকোট নেই? চেঁচিয়ে বলল মুসা। এভাবে বসে থাকলে বোট ড়ুবে যাবার আগেই মরব।
মাথা ঝোঁকাল হান্ট। দড়ি দিয়ে বাঁধল হুইলের একটা স্পোক। দড়ির অন্য মাথা দিয়ে বাঁধল বোটের গায়ে একটা খুঁটির সঙ্গে। কোনদিকেই এখন ঘুরতে পারবে না হুইল। উঠে গিয়ে একটা ছোট আলমারি খুলল। বের করে আনল চারটে হলুদ রেনকোট। একটা নিজে পরল। বাকি তিনটে দিল তিন কিশোরকে।
পরে ফেল, চেঁচেইয়ে বলল হান্ট। বাতাসের গর্জন, আস্তে কথা বললে শোনা যায় না। বোটেই রাখতে হয়। এগুলো। কখন বৃষ্টি আসে, ঠিকাঠিকানা তো নেই।
মুসার গায়ে ঠিকমত লাগল কোট, কিশোর আর রবিনের গায়ে বড় হল। তাতে কিছু যায় আসে না এখন। গায়ে পানি না লাগলেই হল।
আবার গিয়ে হুইল ধরল হান্ট। অনবরত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বেড়েছে বাতাসের বেগ। আকারে বড় হয়েছে ঢেউ। ধরেই নিয়েছে ছেলেরা, যে কোন মুহূর্তে উল্টে যেতে পারে বোট।
বিদ্যুতের আলোয় ডাঙা দেখা গেল সামনে। ছেলেদের মনে হল, জেটি ছাড়ার পর কয়েক যুগ পেরিয়ে গেছে।
ডাঙার কাছে চলে এলো বোট। জেটি চোখে পড়ল না। অবাক হয়ে দেখল ছেলেরা, চ্যাপ্টা একটা পাথরের ধারে এসে বোট রেখেছে হান্ট। পানির তলা থেকে বেরিয়ে আছে পাথরটা।
লাফাও, লাফিয়ে নাম! চেঁচিয়ে বলল হান্ট। গড নোজ!
নীরবে একে একে লাফিয়ে তীরে নেমে এলো ছেলেরা।
আপনি নামবেন না? চেঁচিয়ে বলল কিশোর।
ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে বোট। নামা যাবে না, চেঁচিয়ে জবাব দিল হান্ট। পথ ধরে এগোও। ক্যাম্পে পৌঁছে যাবে।
ইঞ্জিনের আওয়াজ বাড়ল। দ্রুত সরে গেল বোট। দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল ঝড়ো রাতের অন্ধকারে।
বাতাসের তাড়নায় গায়ে যেন সুচ ফুটাচ্ছে বৃষ্টি। মাথা নুইয়ে রাখতে হল তিন কিশোরকে।
চল, পথটা খুঁজে বের করিা বলল মুসা।
মাথা বুকিয়ে সায় দিল কিশোর।
হঠাৎ শোনা গেল শব্দটা। অদ্ভুত। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে যেন কোন বিশাল দানব। হু-উ-উ-উ-উ-হু-ই-শ-শ! হু-উ-উ-উ-উ-হু-ই-শ-শ!
শুনছ! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। কিসের শব্দ!
আবার শোনা গেল অদ্ভুত আওয়াজ।
কিছু একটা আছে দ্বীপো বলল কিশোর। আবার বিদ্যুৎ চমকালেই দেখার চেষ্টা করব! তোমরাও কর।
যেদিক থেকে শব্দ এসেছে, সেদিকে তাকিয়ে রইল তিন গোয়েন্দা। বিদ্যুৎ চমকাল। ক্ষণিকের জন্যে দেখল। ওরা, ছোট্ট এক দ্বীপে দাঁড়িয়ে আছে। এটা অন্য কোন দ্বীপ, কঙ্কাল দ্বীপ। এত ছোট না।