গর্তের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে ডাকল, মুসা রবি-ই- ন! তোমরা আছ ওখানে? বলেই কান রাখল গর্তের ওপর।
এক মুহূর্তনীরবতা। বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করছে কিশোরের। তবে কি ভুল করেছে সে? অনুমান ঠিক হয়নি?
হঠাৎ শোনা গেল। জবাব। চাপা, কিন্তু পরিষ্কার। মুসার গলা। কিশোরা ফাঁদে আটকে গেছি। তাড়াতাড়ি বের করা আমাদের! জোয়ার এসেছে পানি আরও বেড়ে গেলে ড়ুবে মরব। জলদি, জলদি করা কি-শো-ও-র-র-র…
১৫
দ্রুত বাড়ছে পানি।
গুহার দেয়ালে জন্মে থাকা জলজ আগাছা আঁকড়ে ধরে আছে ওরা। ঝাঁপাঝাঁপি করছে পানি দেয়ালে দেয়ালে। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইছে ওদেরকে তাক থেকে। আর বেশি বাকি নেই, ছাতে গিয়ে ঠেকবে পানি। এত দেরি করছে কেন বিড়বিড় করল মুসা। কাঁপছে ঠাণ্ডায়, ভয়ে। তার মনে হচ্ছে, এক যুগ আগে গড়িয়ে পড়েছিল ছোট পাথরটা। চমকে উঠেছিল ওরা। খানিক পরেই ডাক শোনা গিয়েছিল। কিশোরের। বিপদে আছে, জানিয়েছে মুসা। তার মানে সাহায্য আসবেই। কিন্তু আর কত দেরি?
অপেক্ষা ছাড়া করার আর কিছুই নেই। কাজেই অপেক্ষা করতে লাগল ওরা। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে দেখে নিচ্ছে, ছাতে পানি ঠেকতে আর কত বাকি ব্যাটারিও ফুরিয়ে এসেছে। আলোর উজ্জ্বলতা নেই। তবু, অন্ধকারে স্নান ওই আভাটুকুই সাহায্য করছে অনেক।
শোন! হঠাৎ বলল পাপালো। মোহর পেয়েছি, এটা ফাঁস করব না আমরা।
কেন?? জানতে চাইল রবিন। এখানে কি করতে এসেছি, বলতে হবে না?
বলব ড়ুবে ড়ুবে সাঁতার কাটছিলাম। হঠাৎ নজরে পড়ে গেল গর্তটা! বুঝলাম সুড়ঙ্গ। ভেতরে কি আছে দেখার জন্যে ঢুকে পড়লাম, বলল পাপালো। মোহর পেয়েছি বললে ফিরে এসে আবার খোঁজার সুযোগ হারাবা।
হারালে হারাব, বলল রবিন। এখানে দ্বিতীয়বার আর ঢুকতে চাই না। আমি। মোহরের বস্তা পড়ে থাকলেও না। যার খুশি এসে নিয়ে যাক।
আমারও একই কথা, সায় দিয়ে বলল মুসা। পাপালোকে বলল, এত ভাবছ কেন? যা মোহর ছিল, সব তুলে নিয়েছি আমরা। আর নেই। জোয়ারের সময় কোনভাবে এসে পড়েছিল হয়ত। ভেবো না, সিন্দুকফিন্দুক নেই এখানে।
তা হয়ত নেই, কিন্তু বালির তলায় আরও মোহর থাকতে পারে, বোঝানোর চেষ্টা করল পাপালো। এটাই আমার শেষ সুযোগ। আরেকটা নৌকা কিনতে হবে, বাপকে বাঁচাতে হবে। কটা মোহর পেয়েছি? চল্লিশ? পঞ্চাশ? তিন ভাগের এক ভাগ কাটা হবে? নৌকাই তো কিনতে পারব না।
ঠিক আছে, পাপালোর কথা মেনে নিল রবিন। আপাতত ব্যাপারটা ফাঁস করব না আমরা। আরেকবার খুঁজে দেখার সুযোগ…
মুসা আমান আর আসছে না। এই গুহায়া বাধা দিয়ে বলল গোয়েন্দা সহকারী। তুমি আসতে চাইলে আসতে পার, পাপু। কোথায় মোহর পেয়েছি কাউকে না বললেই তো হল।
মোহর পেয়েছি, এই কথাটাও গোপন রাখতে চাই এখন, থলেতে আঙুলের চাপ শক্ত হল পাপালোর। একবার কেন, আরও দশবার আসতেও ভয় পাব না। আমি। কপাল খারাপ তাই বিপদে পড়ে গেছি। কে ভাবতে পেরেছিল, সুড়ঙ্গমুখে এসে নৌকা আটকাবে? এমন ঘটনা সব সময় ঘটে না।
জোসেফ আর কিশোর কতখানি কি করছে, কে জানে! গুঙিয়ে উঠল মুসা। কোস্ট গার্ডকে খবর দিতে গিয়ে থাকলেই সেরেছে। ফিরে এসে আর পাবে না আমাদেরকে।
নৌকাটা সরাতে শক্তি দরকারম বলল রবিন। ভেঙে ফেলতে হবে, কিংবা শাবল দিয়ে চাড় মেরে বের করে নিতে হবে।
অনেক সময় লেগে যাবে তাতে, ঢেউয়ের ধাক্কায় কাত হয়ে গেল মুসা। আগাছা আঁকড়ে ধরে সামলে নিল। তাক থেকেই ফেলে দেবে। দেখছি… হ্যাঁ, যা বলছিলাম। কমসে কম দুঘণ্টা তো লাগবেই। ততক্ষণে আমরা শেষ।
কিশোর জেনেছে আমরা এখানে আছি, নিরাশ হচ্ছে না রবিন। কিছু একটা ব্যবস্থা করে ফেলবেই ও। ঠিক বের করে নিয়ে যাবে। আমাদের, দেখা।
সেই প্রার্থনাই কর, নিচু গলায় বলল পাপালো।
***
মুসার কাছ থেকে সাড়া পাবার পর মাত্র পনেরো মিনিট পেরিয়েছে।
তীর থেকে শখানেক ফুট দূরে ভাসছে এখন মোটর বোট। ইঞ্জিন নিউট্রাল। হাল ধরেছে কিশোর। জোসেফ ডুবুরির পোশাক পরছে।
পাগলামির সীমা থাকা উচিত। আপনমনেই বিড়বিড় করল। জোসেফ। ওয়েট বেল্ট আটল কোমরে। বোটের কিনারে গিয়ে দাঁড়াল। ফিরে চাইল। এখানেই থাক। পরিস্থিতি দেখে আসি আমি। কোস্ট গার্ডকে খবর দেয়ার সময় আছে কিনা কে জানে! ফেস মাস্ক টেনে দিল সে। একটা আন্ডারওয়াটার টর্চ হাতে নিয়ে নেমে গেল পানিতে।
বড় একা একা লাগছে কিশোরের। দক্ষিণে অনেক দূরে এক সারি নৌকা, মাছ ধরা শেষ করে ফিরে চলেছে ফিশিংপোর্টে। এদিকে কেউ আসবে না। গুহায় আটকা পড়ে মরতে বসেছে তিন বন্ধু। ওদেরকে কি উদ্ধার করতে পারবে শেষ পর্যন্ত? মুসা যা বলল, সুড়ঙ্গমুখে বেশ শক্ত করেই আটকেছে। ভাঙা নৌকা।
অতি ধীরে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে যেন সময়। কিশোরের মনে হল এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, জোসেফ গেছে মাত্র পাঁচ মিনিট আগে। আরও পাঁচ মিনিট পরে ভেসে উঠল। জোসেফের মাস্কে ঢাকা মুখ। দ্রুত উঠে এল সে বোটে। মাস্ক সরাল মুখ থেকে। চেহারা ফ্যাকাসে, উদ্বিগ্ন।
সাংঘাতিক শক্ত হয়ে আটকেছে। বলল জোসেফ। কোথাও ধরে যে টান দেব, সে জায়গাই নেই। কোস্ট গার্ডকেই খবর দিতে হবে। শাবল কিংবা ক্রো-বার ছাড়া হবে না।
জোসেফের মুখের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। তাতে তো অনেক সময় লাগবো কমপক্ষে দুঘণ্টা!