মোহর খুঁজতে খুঁজতে খিদে ভুলে গেল ওরা। সময়ের হিসেব রাখল না। এক ধার থেকে প্রতিটি ঝিনুক-শামুক উল্টে দেখতে লাগল। ফ্লিপার কিংবা হাতের নাড়া লেগে বালির মেঘ উঠছে মাঝে মাঝে, আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে দৃষ্টি। থেমে, বালি নেমে যাবার অপেক্ষা করতে হচ্ছে তখন। তারপরই আবার শুরু হচ্ছে খোঁজা।
দেখতে দেহকতে প্রায় দেড় ডজন মোহর বের করে ফেলল মুসা আর রবিন। একেকজনের ভাগে ছয়টা করে। হাতে আর জায়গা নেই। মুসার গায়ে টোকা দিল রবিন। ওঠার ইঙ্গিত করল। দাম ফুরিয়ে যাওয়ায় ওদের আগেই উঠে গেছে পাপালো।
তাকে উঠে এল তিন কিশোর। পানি থেকে দূরে তাকের এক জায়গায় রাখল। মোহরগুলো।
ঠিকই বলেছ, পাপু মাস্ক সরিয়ে বলল রবিন। মোহর আছে এখানে আরও আছে।
হ্যাঁ, আছে। আরও আছে, বলল পাপালো। হাসল। হাতের মুঠো খুলে দেখাল। শেওলার তলায় এই তিনটে পেয়েছি আমি।
মোট হল চব্বিশটা বলল রবিন। কিন্তু মোহরগুলো এই গুহায় এল কি করে!
সেটা পরে ভাবলেও চলবে, বলল মুসা। চল, আরও কিছু তুলে আনি।
নেশা বড় ভয়ানক ব্যাপার, বিশেষ করে গুপ্তধনের নেশা। হুশ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মানুষ। সেই নেশায় পেয়েছে তিন কিশোরকে। পাগল হয়ে উঠেছে যেন ওরা। পুরো গুহার প্রতি বর্গ ইঞ্চি জায়গা খুঁজে দেখতে লাগল ওরা। কি ভীষণ বিপদে পড়তে যাচ্ছে, জানতেই পারল না।
স্রোতের টানে আস্তে আস্তে কাছে চলে এসেছে পাপালোর ভাঙা নৌকা। ছেলেদের বেরোনোর পথ বন্ধ করে দিয়ে বোতলের মুখে কর্কের ছিপির মত আটকে গেছে সুড়ঙ্গমুখে।
১৪
উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কিশোর। লাঞ্চের সময় ফেরার কথা, অথচ বিকেল হয়ে গেল, এখনও ফেরেনি। রবিন আর মুসা। কোন অঘটন ঘটেনি তো?
ম্যাগাজিনটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল কিশোর। জানালার সামনে এসে দাঁড়াল। উপসাগরের পুরো উত্তর প্রান্তটা চোখে পড়ে এখান থেকে। কিন্তু কই, কোন ছোট পালের নৌকা তো চোখে পড়ছে না!
ঘরে এসে ঢুকল মিসেস ওয়েলটন। হাতে দুধের গ্লাস আর কিছু বিস্কুট। টেবিলে নামিয়ে রাখল।
নিশ্চয় খিদে পেয়েছে তোমার, কিশোর, পেছন থেকে বলল বাড়িওয়ালি। নাও, এগুলো খেয়ে নাও। রবিন আর মুসা ফেরেনি এখনও?
না, ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। লাঞ্চের সময়ই ফেরার কথা, এখনও ফিরছে না! কোন বিপদেই পড়েছে মনে হয়।
এত ভাবছ কেন? বলল মিসেস ওয়েলটন। হয়ত বড়শি ফেলে মাছ ধরছে। ভুলেই গেছে ফেরার কথা।
বেরিয়ে গেল বাড়িওয়ালি।
নিশ্চিন্ত হতে পারল না কিশোর। বসে পড়ল টেবিলের সামনে। বিস্কুট চিবোতে চিবোতে ম্যাগাজিনটা টেনে নিলো আবার। কঙ্কাল দ্বীপ নিয়ে লেখা ফিচারের জায়গায় জায়গায় পেন্সিল দিয়ে দাগ দিয়েছে। আবার দেখতে লাগল ওগুলো। ভাবনা চলছে। মাথায়।
বাইশ বছর আগে বজ্রপাতে মারা গেছে স্যালি ফ্যারিংটন। সুযোগটা নিয়েছে মেলভিলের পর্কের মালিক। গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে স্যালির ভূত দেখা গেছে প্লেজার পর্কে। তারপর? প্রায় বিশ বছর আর ভূতের দেখা নেই। হঠাৎ করেই দেখা দিতে শুরু করেছে। আবার বছর দুই আগে থেকে। দেখেছে অশিক্ষিত, কুসংস্কারে ঘোর বিশ্বাসী জেলেরা। তাদের কথায় বিশ্বাস করে কঙ্কাল দ্বীপে লোক যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে।
এলো সিনেমা কোম্পানি। প্লেজার পার্কে কয়েকটা দৃশ্য শুটিং করবে। তাদেরকে উত্যক্ত করা শুরু হল। কেন? দ্বীপে ক্যাম্প করে তারা কার কি ক্ষতি করছে? মালিক বিরূপ নয়। তাদের ওপর, তাহলে ভাড়াই দিত না। তাহলে কে?
ঝটিকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এলো কিশোর। ঘরে এসে ঢুকল জোসেফ গ্র্যাহাম। উত্তেজিত।
কিশোর, বলল জোসেফ। পাপালো হারকুসকে দেখেছ?
সকালে দেখেছি, জবাব দিল কিশোর। ওর নৌকায় করে সাঁতার কাটতে গেছে। রবিন আর মুসা। ফেরেনি এখনও।
সারাদিন পাপালোর সঙ্গো প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল। জোসেফ। ওরা দুসেট একোয়ালঙ নিয়ে গেছে। প্র্যাকটিস করবে বলল, দিয়ে দিলামা কালো হয়ে গেছে তার মুখ। ওই হারামি গ্রেসানটার সঙ্গে গুপ্তধন খুঁজছে না-তো ওরা?
জবাব দিল না কিশোর। চেয়ে আছে জোসেফের মুখের দিকে। সতর্ক হয়ে উঠেছে।
ওদেরকে খুঁজতে যাওয়া দরকার। আবার বলল জোসেফ, ওই গ্রেসানের বাচ্চা এমনিতেই যা করেছে, তার ওপর আরও কিছু… থেমে গেল সে। কিশোরের দিকে তাকাল। আমি চললাম খুঁজতে।
আমিও যাব, সর্দি লেগেছে, ভুলে গেল কিশোর। তার এখন ভাবনা, তিন বন্ধুকে খুঁজে বের করা।
এসো, বলেই ঘুরে দাঁড়াল জোসেফ।
জেটিতে বাঁধা আছে ছোট একটা মোটর বোট। উঠে বসিল জোসেফ আর কিশোর। ইঞ্জিন গর্জে উঠল। ছুটে চলল বোট।
এমনিতেই যা করেছে… কথাটার মানে কি, জানার কৌতূহল হচ্ছে কিশোরের। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারল না। কথা বলার মেজাজে নেই জোসেফ। থমথমে গভীর মুখ। হুইলে চেপে বসেছে আঙুল।
কঙ্কাল দ্বীপের জেটিতে এসে বোট রাখল জোসেফ। একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলল।
পাঁচজনের জায়গা হবে না। এই বোটে, বলল জোসেফ। তাছাড়া সব সরঞ্জাম নিয়ে তৈরি হয়ে যেতে চাই। ডুব দেবার দরকার পড়বে। কিনা কে জানে!
কি ব্যাপার? এত দুশ্চিন্তা কেন জোসেফের?—ভাবল কিশোর। পাপালোর সঙ্গে ডুব দিতে গেছে। রবিন আর মুসা, কি হয়েছে তাতে? কোন অঘটন। আশা করছে জোসেফ?
পাশের বড় বোটটায় উঠে গেল জোসেফ। কিশোরও উঠল।