দুটো টর্চের জোরালো আলোয় অন্ধকার কেটে গেল। পরিষ্কার পানি, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সামনের অনেক দূর পর্যন্ত। ধীরে ধীরে প্রশস্ত হচ্ছে সুড়ঙ্গ। পাথুরে দেয়ালের খাঁজে খাঁজে ভরি হয়ে জন্মেছে শেওলা। উজ্জ্বল আলোয় চমকে গেল মাছের দল। এদিক ওদিক ছুটে পালাল। অন্ধকার ছোট একটা গুহার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল একটা সবুজ মাথা।। হাঁ করা কুৎসিত মুখে খুরের মত ধারালো দাঁতের সারি। কুতকুতে চোখ। বান পরিবারের এক ভয়ানক সদস্য, মোরে ঈল। মাছটার ওপর চোখ রেখে অনেক দূর দিয়ে সরে এল দুই গোয়েন্দা।
পাপালোকে দেখা যাচ্ছে। অনেক সামনে রয়েছে সে। ওর মত তাড়াতাড়ি সাঁতার কাটতে পারছে না। দুই গোয়েন্দা। পাথুরে দেয়ালে ঘষা লাগলে ছল চামড়া উঠে যাবে। টিউব কিংবা পিঠের ট্যাংকের ক্ষতি হতে পারে। তাই সতর্ক থাকতে হচ্ছে ওদের।
মাঝে মধ্যে উপরের দিকে টর্চের আলো ফেলছে ওরা। হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল পাথরের দেয়াল। উঠতে শুরু করল দুই গোয়েন্দা। বিশ ফুট. তিরিশ ফুট… আচমকা মাস্ক বেরিয়ে এলো পানির ওপরে।
টর্চের আলো ফেলল দুজনে। একটা পাথরের তাকে উঠে বসে আছে পাপালো। পা দুটো বুলছে পানিতে। মাথার চার পাঁচ ফুট ওপরে গুহার ছাত এবড়োখেবড়ো, রুক্ষ। পিচ্ছিল শেওলায় ঢাকা তাকে পাপালোর পাশে সাবধানে উঠেবসলো দুই গোয়েন্দা।
দ্য হ্যান্ডের পেটে এসে ঢুকেছি। আমরা, বলল পাপালো। কেমন লাগছে। গুহায় ঢুকে?
বেশ ভালই তো! জবাব দিল রবিন। আমাদের আগে নিশ্চয় এখানে কেউ ঢোকেনি!
চারদিকে টর্চের আলো ঘুরিয়ে আনল একবার রবিন। নির্দিষ্ট কোন আকার নেই গুহাটার। পানির সমতল থেকে ছাতের উচ্চতা একেক জায়গায় একেক রকম, চার থেকে ছয় ফুটের মধ্যে। গুহার এক প্রান্তে দুদিকের দেয়াল অনেক কাছাকাছি, মাঝে পরিসর কম। আলো আসছে ওদিক থেকেই।
টর্চ নিভিয়ে নিলো ওরা। আবছা আলো গুহার ভেতরে। পাথরে পাথরে ধাক্কা খেয়ে কুলকুল শব্দ তুলছে পানি। দেয়ালের গা আঁকড়ে ধরে আছে সরু শেওলা জাতীয় উদ্ভিদ। ঢেউয়ের তালে তালে দুলছে, ওঠানামা করছে ভয়াবহ কোন অজানা দানবের রোম যেন। শিউরে উঠল রবিন। নিশ্চয় কোন ফাটল আছে গুহার ছাতে। আলো আসছে ওপথেই। গুহার দূরতম প্রান্তের দিকে চেয়ে বলল সে।
ফোয়ারা! প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল পাপালো। এবার বুঝেছি। ওই ফাটল দিয়েই পানি ছিটকে বেরোয় ঝড়ের সময়। কেউ জানে না, তলায় একটা গুহা আছে। লোকের ধারণা, ফাটলাটা সাগরের অতলে কোথাও নেমে গেছে।
ঠিক ঠিক! বলে উঠল রবিন। মনে পড়ল, দুরাত আগে ঝড়ের সময় কি করে পানি ছিটকে উঠেছিল টিলার চুড়ার ছিদ্র দিয়ে। অনেক আগেই ওই ফোয়ারা আবিষ্কার করেছে লোকে। জানত না, কেন শুধু ঝড়ের রাতেই পানি ছিটায় ওটা।
একটা কথা। হতাশ কণ্ঠে বলল রবিন। আমরাই যদি গুহাটা প্ৰথম আবিষ্কার করে থাকি, গুপ্তধন আসবে কোথা থেকে এখানে?
তাই তো! গুঙিয়ে উঠল মুসা। এটা তো ভাবিনি।
আমরাই প্রথম নই, তাই বা জনছি কি করে? প্রশ্ন রাখল পাপালো। এত হতাশ হবার কিছু নেই। একটা মোহর যখন পেয়েছি, আরও পাবার আশা আছে। রবিন, টর্চটা দাও তো, দেখে আসি।
ওপরে বসে ধীরে ধীরে পানির তলায় আলো নেমে যেতে দেখল দুই গোয়েন্দা।
মোহর লুকানোর জন্যে এরচে ভাল জায়গা আর হয় না, বলল মুসা। কিন্তু রবিন, মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। আমাদের আগেও কেউ এসেছিল এখানে।
তলায় নেমে গেছে পাপালো। এদিক ওদিক আলো নড়তে দেখল মুসা আর রবিন।
সময় কেটে যাচ্ছে। পাপালো আর ওঠে না। নিচে আলো নড়াচড়া করছে। নাহ্, দাম রাখতে পারে বটে। গ্ৰীক ডুবুরির ছেলে। ঝাড়া আড়াই মিনিট পরে উঠে এলো পাপালো। উঠে বসিল দুই গোয়েন্দার পাশে।
ঠিকই বলেছি, রবিন, বলল পাপালো। গুপ্তধন নেই এখানে। শামুক-গুগলির সঙ্গে কিছু কিছু এ-জিনিস আছে। মুঠো খুলে দেখাল সে।
অবাক হয়ে দেখল দুই গোয়েন্দা, পাপালোর হাতে দুটো মোহর।
ইয়াল্লা! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। গুপ্তধন নেই, তাহলে এগুলো কি?
আমি বলতে চাইছি, হাজার হাজার মোহর এক জায়গায় স্তুপ করে রাখা নেই। একটা দুটো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বালিতে।
হাত থেকে হাতে ঘুরতে লাগিল মোহর দুটো। ভারি। ধারগুলো বেশি ক্ষয়ে যায়নি এ-দুটোর।
মোট তিনটে পেলাম! বলল পাপালো। একেকজনের ভাগে একটা করে।
না, তুমি পেয়েছ। ওগুলো, প্রতিবাদ করল রবিন। তিনটেই তোমার।
এক সঙ্গে এসেছি। যে-ই পাই, সমান ভাগে ভাগ করে নেব, দৃঢ় গলায় বলল পাপালো। চল, তিনজনে যাই এবার। আরও পাওয়া যাবে। হয়ত নতুন আরেকটা নৌকা কিনতে পারব। বাবার চিকিৎসা করতে পারব। চল চল!
দ্রুত হাতে ফেস মাস্ক পরে নিল মুসা আর রবিন। পাপালোর সঙ্গে সঙ্গে নেমে পড়ল পানিতে।
তলার বালিতে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য শামুক-গুগলি, ঝিনুক। নামার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পাথুরে দেয়ালের কাছে চকচকে বস্তুটা দেখতে পেল মুসা। কান্ত হয়ে আছে একটা ডাবলুন, অর্ধেকটা ড়ুবে আছে বালিতে।
আলতো করে ফ্লিপার নেড়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে লাগল রবিন। শিগগিরই একটা ঝিনুকের তলা থেকে বেরিয়ে থাকা মোহরের অর্ধেকটা চোখে পড়ল। তুলে নিল ওটা।
উত্তেজিত হয়ে পড়ল তিন কিশোর। আরও মোহর আছে। এই গুহায়, বুঝতে পারল। সেগুলো খুঁজে বের করতেই হবে।