ঠিকই বলেছ বলল রবিন। কিন্তু কেন? তোমার নৌকা ভেঙে দিল কেন? কার কি লাভ?
আমি মোহর খুঁজে বেড়াই, এটা লোকের পছন্দ না, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল পাপালো। জেলেরা দেখতে পারে না। আমাকে। এই উপসাগর ওদের। এতে বাইরের কারও ভাগ বসানো সইতে পারে না। দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতা। যতদূর চোখ যায়, কোন নৌকা বা জাহাজের চিহ্নও নেই। আর কতক্ষণ থাকতে হবে এ-দ্বীপে?
তোমার নৌকা গেল, অবশেষে বলল রবিন। দামি অনেক জিনিসপত্র গেল আমাদেরও।
হ্যাঁ, গম্ভীর হয়ে আছে মুসা। অনেক দামি। একে অন্যের দিকে চেয়ে আছে দুই গোয়েন্দা। দুজনের মনে একই ভাবনা। এক সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল দুজনে, ওগুলো তো তুলে আনতে পারি। আমরা!
বিষণ্ণতা ঝেড়ে ফেলল পাপালো। হাসল। নিশ্চয় পারি। চল। আমি সাহায্য করব তোমাদেরকে।
মুসা। পানিতে নামল। হেঁটে চলল। ডুব দিল গভীর পানিতে এসে।
পানির ওপরে রোদ। ছোট ছোট ঢেউ। তলার বালিতে শুয়ে থাকা নৌকার গায়ে বিচিত্র ভঙ্গিতে নাচছে সূর্যের আলো। ফ্লিপার নাচিয়ে দ্রুত নেমে চলেছে। রবিন আর মুসা। পাপালোর ওসব দরকার নেই। ভারি একটা পাথর ধরে রেখেছে দুহাতে। দুই সঙ্গীর চেয়ে অনেক দ্রুত নামছে
পাথরের ভারে।
নৌকার কাছে পৌঁছে গেল পাপালো। অর্ধেক পথও নামতে পারেনি এখনও অন্য দুজন। এক পাশে কাত হয়ে আছে নৌকাটা। জিনিসপত্র ভেতরে কিছু কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আশপাশে। দুহাতে যা পারল, নিয়ে রওনা হয়ে গেল। আবার ওপরে।
পাশ দিয়ে নামার সময় পাপালোকে হাসতে দেখল দুই গোয়েন্দা। সাগরের শান্ত তলদেশে এসে কেমন এক ধরনের অনুভূতি জাগল। বিপদে পড়েছে, ভুলেই গেল। পাশাপাশি নেমে এল নৌকাটার ধারে। সাপের মত নাচছে পালের দড়ি। দড়ির কাছ থেকে দূরে থাকল রবিন। কি জানি, আবার যদি পায়ে পেচিয়ে যায়! নিজের একটা প্যান্ট পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিল। পাপালোর জুতো জোড়া তুলে নিল মুসা। আরও জিনিসের জন্যে চাইল এদিক ওদিক।
খুব ধীরে ধীরে এপােশ ওপােশ দোল খাচ্ছে নৌকাটা, ছেড়া পালটাও দুলছে তালে তালে। বেশ জোরালো স্রোত বইছে পানির তলায়।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই যা তোলার, তুলে ফেলল ওরা। অগভীর পানিতে এসে দাঁড়াল। তিনজনেরই দুহাত বোঝাই জিনিসপত্রে।
মনে হয়। আর কিছু নেই, হেসে বলল পাপালো। সবই তুলে এনেছি।
তই তো মনে হচ্ছে, বলল মুসা। ছপাৎ ছপাৎ আওয়াজ তুলে হেঁটে চলল। ওরা তীরের দিকে। তীরে পৌঁছে ভেজা জিনিসপত্র নামিয়ে রাখল। বসে পড়ল। ওগুলোর পাশে।
হঠাৎ কি মনে পড়তেই কাপড়ের স্তুপে খুঁজতে শুরু করল পাপালো। পেল না। আরে! আমার কম্পাস কই! তোমরা তোলনি?
এদিক ওদিক মাথা নাড়ল দুই গোয়েন্দা।
তোমরা বস। আমি নিয়ে আসছি। আবার পানিতে নামল গিয়ে পাপালো।
কাপড়গুলো চিপে ছড়িয়ে দেয়া দরকার। শুকাক। বলল মুসা।
মাথা বুকিয়ে সায় দিল রবিন।
কাপড় শুকাতে দিয়ে এসে আবার আগের জায়গায় বসল ওরা।
খবর পাঠানোর কোন উপায় নেই সাগরের দিকে চেয়ে বলল রবিন। রাফাত চাচা গাধা ভাববেন আমাদেরকে। বোকার মত আবার আটকা পড়েছি এসে এই দ্বীপে।
এটা আমাদের দোষ নয়, পাপালোরও না, ভারি একটা টর্চের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে বলল মুসা। এখন না পারলেও অন্ধকার হলে পারব। টর্চের সাহায্যে।
কিন্তু অন্ধকার হতে এখনও অনেক দেরি, আকাশের দিকে তাকাল একবার রবিন। খিদেয় পেট জ্বলছে। এতক্ষণ সইব কি করো
কাপড়গুলো শুকাক আগে। খিদের ব্যাপারটা নিয়ে পরে ভাবা যাবে, পাপালো আসুক।
এই সময় মনে হল ওদের, পাপালো গেছে অনেকক্ষণ। এতক্ষণ ফিরে আসার কথা তার। ফিরে তো এলই না, একবার ভাসেওনি এপর্যন্ত। সঙ্গে গ্যাস ট্যাংক নেই। একটানা পনেরো মিনিট দিম আটকে রাখতে পারে না কোন মানুষ সতর্ক হয়ে উঠল ওরা। বিপদের গন্ধ পেল। নিশ্চয়, বিড়বিড় করে বলল রবিন। নিশ্চয় কোন বিপদে পড়েছে!
কোন কিছুতে আটকে যায়নি তো! ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুসার মুখ। জলদি চল, দেখি কি ঘটেছে।
দ্রুত আবার ডুবুরির সরঞ্জাম পরে নিল দুজনে। পানিতে এসে নামল। হেঁটে চলে এল গভীর পানির ধারে। সবুজ পানিতে উজ্জ্বল রোদ নিচের দিকে তাকাল ওরা একবার। পেছন ফিরে চিত হয়ে পড়ল পানিতে। ডুব দিল।
আগের মতই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তলার বাকি। কিন্তু পাপালো কোথায়? নৌকাটাও নেই। দ্রুত নেমে চলল দুজনে। ধড়াস ধড়াস করছে বুকের ভেতর।
ওপরের দিকে কয়েক ফুট ঢালু হয়ে নেমেছে পাথরের দেয়াল, তারপর একেবারে খাড়া। ছোটবড় অনেক গর্ত দেয়ালে। ওগুলোর পাপালোকে টেনে নিয়েছে, ভাবল রবিন।
না, নৌকাটা আছে। আগের জায়গায় নয়। ওখান থেকে বিশ ফুট দূরে। দেয়ালের গা ঘেঁষে পড়ে আছে। দুলছে ধীরে ধীরে। বাড়ি খাচ্ছে পাথুরে দেয়ালে।
তাড়াতাড়ি নৌকার দিকে সাঁতরে চলল দুই গোয়েন্দা। কাছে চলে এল। কিন্তু কোথায় পাপালো? নৌকার তলায় মরে পড়ে নেই তো?
বালিতে এসে ঠেকল রবিন। ভয়ে ভয়ে উঁকি দিল নৌকার তলায়। না, নেই। ওখানে পাপালো। গেল কোথায়! এখানকার পানিতে হাঙর নেই, জানা আছে। রবিনের। অক্টোপাস বা ওই ধরনের কোন ভয়াবহ সামুদ্রিক জীবও নেই। তাহলে?
বাহুতে ছোঁয়া লাগতেই প্ৰায় চমকে উঠল রবিন। ফিরে চাইল মুসা। দুটো আঙুল জড়ো করে দেখাল গোয়েন্দা সহকারী। ইঙ্গিতটা বুঝল রবিন। পাশাপাশি থাকতে বলছে। আঙুল তুলে একটা গর্ত দেখােল মুসা। তারপর সাঁতরাতে শুরু করল ওদিকে।