কই।…কোথায়া বলে উঠল কিশোর।
দেখি দেখি! বলল মুসা।
দুজনে একই সঙ্গে বুকে এলো জানালার কাছে, রবিনের গায়ের ওপর দিয়ে।
লম্বা, সরু উপসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে প্লেন। আঙুল তুলে দেখাল রবিন। তাদের নিচেই একটা ছোট্ট দ্বীপ। ঠিক যেন একটা মানুষের মাথার খুলি।
ম্যাপের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, বললো রবিন।
কৌতূহলী চোখে অদ্ভুত দ্বীপটার দিকে চেয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। মিস্টার ক্রিস্টোফারের দেয়া ম্যাগাজিন পড়ে জেনেছে। ওরা অনেক কিছু। তিনশো বছরেরও বেশি আগে জলদস্যুদের ঘাঁটি ছিল কঙ্কাল দ্বীপ। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়েছে, পাওয়া যায়নি গুপ্তধন। তার মানে এই নয় যে, ধনরত্ন লুকানো নেই। হয়তো দ্বীপে নেই, কিন্তু উপসাগরের তলায় থাকতে বাধা কোথায়? নিশ্চয় পানির তলায় কোথাও লুকানো আছেই। গুপ্তধন। তিন গোয়েন্দার আশা, খুঁজে পাবে ওরা।
আরেকটা ছোট দ্বীপ নজরে পড়ল।
ওই যে, দ্য হ্যান্ডা বলল কিশোর। হস্ত।
আর ওগুলো নিশ্চয় দ্য বোনস, যোগ করল মুসা। আঙুল তুলে দেখাল। কঙ্কাল দ্বীপ আর হস্তের মাঝামাঝি এক সারি ছোট প্রবাল-প্রাচীর দেখিয়ে বলল মুসা। ইয়াল্লা! এত তাড়াতাড়ি এসে পড়লাম! দুপুরের খাওয়াই হজম হয়নি এখনও!
দেখ, দেখা বলল রবিন। হাতের আঙুল। ওগুলো সরু প্রবালপ্রাচীরা পানির তলায় রয়েছে, অথচ ওপর থেকে কি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!
হস্তে যাব একদিন, বলল কিশোর। প্রাকৃতিক ফোয়ারা দেখব। কখনও দেখিনি।
দ্বীপগুলোকে পেছনে ফেলে এল প্লেন। মূল ভূখণ্ডের ওপর এসে পড়েছে। নিচে একটা গ্রাম। নাম ফিশিংপোর্ট। ওখানেই উঠবে তিন গোয়েন্দা। একটা বোডিং হাউসে ঘর ভাড়া করে রাখা হয়েছে তাদের জন্যে।
ফিশিংপোর্ট ছাড়িয়ে এল প্লেন। দ্রুত উচ্চতা হারাচ্ছে। ডানে ছোট্ট একটা শহর। নাম মেলভিল। এয়ারপোর্ট ওখানেই। কয়েক মুহুরুত পরেই রানওয়ে ছুলো প্লেনের চাকা। এয়ার টার্মিনাল বিল্ডিঙের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
প্লেন থেকে নেমে এল তিন কিশোর। একপাশে তারের জালের বেড়া। বেড়ার ওপাশে লোকের ভিড়।
রাফাত চাচা এসেছেন। কিনা কে জানে! বলল রবিন।
ফোনে তো বলল আসবে, ভিড়ের দিকে চেয়ে হাঁটছে মুসা। কোন কারণে নিজে না আসতে পারলে অন্য কাউকে নিশ্চয়ই পাঠাবে।
বেড়ার বাইরে এসে দাঁড়াল তিনজন। এদিক ওদিক চাইল। মুসার বাবাকে দেখা গেল না।
অন্য কেউই এসেছে, নিচু গলায় বলল রবিন। ওই যে, আমাদের দিকে এগোচ্ছে।
ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে আসছে বেঁটে মোটা এক লোক। লালচে নাক।
এই যে, কাছে এসে বলল লোকটা। নিশ্চয়ই হলিউড থেকে এসেছ? তোমাদেরকে নিয়ে যেতে পাঠানো হয়েছে আমাকে। তিন কিশোরকে দেখছে সে। ছোট ছোট চোখে শীতল চাহনি। কিন্তু তোমরা গোয়েন্দা! বয়স্ক লোক আশা করেছিলাম আমি।
স্থির হয়ে গেল। রবিনের পাশে দাঁড়ানো কিশোর। আমরা গোয়েন্দা আপনার তো জানার কথা নয়!
আরও অনেক কিছুই জানি, দাঁত বের করে হাসল লোকটা। এখন এসো। গাড়ি অপেক্ষা করছে। তোমাদের মালপত্র যাবে অন্য গাড়িতে। আমারটায় জায়গা নেই। হলিউড থেকে অনেক জিনিসপত্র এসেছে, বোঝাই হয়ে গেছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল লোকটা। পেছনে চলল। তিন গোয়েন্দা। পুরানো একটা স্টেশন ওয়াগনের সামনে এসে দাঁড়াল।
জলদি উঠে পড় গাড়িতে। আধা ঘণ্টা লেগে যাবে যেতে। আকাশের দিকে তাকাল। তার আগেই ঝড় এসে পড়বে। কিনা কে জানে!
আকাশের দিকে মুখ তুলল রবিন। পশ্চিম দিগন্তে ছোট্ট এক টুকরো কালো মেঘ, ছড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। ঢাকা পড়েছে সূর্য। আজ আর বেরোতে পারবে বলে মনে হয় না। মেঘের চুড়ার কাছে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। ঝড় আসবে, ভীষণ ঝড়।
পেছনের সিটে উঠে বসল। তিন কিশোর। ড্রাইভিং সিটে বসল। লোকটা। গাড়ি ছাড়ল। এয়ারপোর্ট ছাড়িয়ে এসে রওনা হল উত্তরে।
আপনার সঙ্গে এখনও পরিচয়ই হল না, মিস্টার… থেমে গোল কিশোর।
হান্ট বলেই ডাকবে আমাকে। সবাই তাই ডাকে, বলতে বলতে এক্সিলারেটরে পায়ের চাপ বাড়াল লোকটা। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। দ্রুত নামছে অন্ধকার।
হ্যাঁ, মিস্টার হান্ট, আবার বলল কিশোর, আপনি কি সিনেমা কোম্পানিতে কাজ করেন?
সব সময় না, জবাব দিল হান্ট। এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে আপন মনেই বিড়বিড় করল, ঝড় আসছে। রাত নামতে দেরি নেই। নিশ্চয় বেরোবে আজ নাগরদোলার ভূতা ইস্স্, বোকামিই করলাম! বেরোনোই উচিত হয়নি!
শিরশির করে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। রবিনের মেরুদন্ড বেয়ে। নাগরদোলার ভূত! কঙ্কাল দ্বীপের ওই ভূতের কথা লেখা আছে ম্যাগাজিনে। বাইশ বছর আগে প্লেজার পর্কের নাগরদোলায় চড়েছিল। এক সুন্দরী তরুণী। নাম, স্যালি ফ্যারিংটন। হঠাৎ উঠল ঝড়। পর্কে আরও অনেকেই এসেছিল সেদিন, তাড়াহুড়ো করে পালাল। থেমে গোল নাগরদোলা। স্যালিকে নামতে বলল দোলার চালক। কিন্তু নামিল না। মেয়েটা। দোলা আবার চালাতে অনুরোধ করল। ঝড়ের মধ্যে নাগরদোলায় চড়তে কেমন লাগে, দেখতে চায়।
কিছুতেই মেয়েটাকে নামাতে পারল না চালক। ঝড় বেড়েই চলল। নিরাপদ জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিলো সে। স্যালি বসে রইল কাঠের ঘোড়ার গলা আঁকড়ে ধরে। হঠাৎ পড়ল বাজ। পড়ল এসে একেবারে নাগরদোলার ওপর।
বজ্রপাতে মারা গেল স্যালি। এর কয়েক হস্তপ্ত পরেই আরেক ঝড়ের রাতে নাকি দেখা গেল, আলো জ্বলে উঠেছে নাগরদোলার। পার্ক বন্ধ হয়ে গেছে বিকেলেই। কে জ্বলিলো আলো! কয়েকজন লোক সঙ্গে নিয়ে মোটরবোটে করে দেখতে গেলেন পার্কের মালিক মিস্টার স্মিথ। দ্বীপের কাছে গিয়ে দেখলেন, ঘুরছে নাগরদোলা। একটা কাঠের ঘোড়ায় চেপে বসেছে সাদা একটা মূর্তি। হঠাৎ দপ করে নিভে গেল সমস্ত আলো। থেমে গেল দোলা। কয়েক মিনিট পরে তীরে ভিড়ল বোট। দোলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল লোকেরা। একটা রুমাল খুঁজে পেল, মহিলাদের রুমাল। এক কোণে সুতো দিয়ে তোলা হয়েছে দুটো অক্ষরঃ এস এফ।