অবশিষ্ট স্যান্ডউইচটুকু মুখে পুরলেন ডাক্তার। চিবিয়ে গিলে ফেললেন। কফির কাপ টেনে নিতে নিতে বললেন, অনুমান তো কত কিছুই করা যায়। এই যেমন, কেউ একজন চায় না, দ্বীপে শুটিং করুক। সিনেমা কোম্পানি। মেলভিলের সেই পার্কের মালিকও হতে পারে। দ্বীপটািতে লোক যাতায়াত শুরু করলে হয়ত আবার চালু হতে পারে। প্লেজার পার্ক। সেজন্যেই তাড়াতে চাইছে সিনেমা কোম্পানিকে। অন্য কারণেও হতে পারে চুরি। এখানকার লোক বড় গরীব। ঝিনুকে রোগ দেখা দেবার পর থেকে অনেকেরই রুটি জোটে না। ওদের কেউ পেটের দায়ে চুরি করছে হয়ত জিনিসপত্র।
কিন্তু ঠিক যেন মিলছে না চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল কিশোর।
রহস্যের সমাধান করতে চাইছ না? হাসলেন ডাক্তার। গোয়েন্দাগিরি?
পকেট থেকে একটা কার্ড বের করল কিশোর। ডাক্তারের দিকে বাড়িয়ে ধরল।
কার্ডটা নিয়ে পড়লেন ডাক্তার। হাসলেন আবার। ফিরিয়ে দিতে দিতে বললেন, তাহলে সত্যিই তোমরা গোয়েন্দা? বেশ বেশ। আত্মবিশ্বাস থাকা ভাল। তোমাদেরকেই তাহলে দ্য হ্যান্ডে ফেলে রেখে এসেছিল হান্ট গিল্ডার। কেন, বল তো?
হয়ত ভয় দেখাতে, বলর কিশোর। কেউ একজন হয়ত চায়, আমরা আবার হলিউডে ফিরে যাই। এখানে থাকলে, খোঁজখবর করলে, তার অসুবিধে হবে।
হুমম ভুরু কুঁচকে কিশোরের দিকে চেয়ে আছেন ডাক্তার। তোমার কথায় যুক্তি আছে। ফেলে দেয়া যায় না।
আচ্ছা, স্যার, আরেকটা কথা, ডাক্তারের দিকে তাকাল কিশোর। ঠিক কবে থেকে আবার দেখা দিতে শুরু করেছে নাগরদোলার ভূত? বলতে পারবেন?
কবে থেকে? নিজের চিবুকে আলতো টোকা দিলেন ডাক্তার। দুই. হ্যাঁ, দুবছরই হবে। হঠাৎ দেখা দিতে শুরু করল ভূতটা। বেশ ঘন ঘন। কেন, একথা জানতে চাইছ কেন?
শিওর না হয়ে বলা উচিত না, স্যার। আচ্ছা, উঠি। আপনার অনেক সময় নষ্ট করে দিলাম।
না না, ও কিছু না, উঠে দাঁড়ালেন ডাক্তার। ভূত রহস্যের সমাধান করতে পারলে জানিও আমাকে। আর হ্যাঁ, আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, দ্বীপে গুপ্তধন থাকলে, তার মালিক কিন্তু আমি।
ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল কিশোর। চিন্তিত। বেশ কয়েকটা রহস্য একসঙ্গে এসে জড় হয়েছে। কিছুতেই জট ছাড়ানো যাচ্ছে না। এ-নিয়ে আরও অনেক বেশি ভাবতে হবে।
পথে এসে নামল কিশোর। পাশ কাটিয়ে চলে গেল একটা গাড়ি। ঘ্যাঁচ করে ব্ৰেক কষার আওয়াজ হল। পিছিয়ে এলো গাড়িটা। কিশোরের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
এই যে, খোকা, জানোলা দিয়ে মুখ বের করে ডাকলেন পুলিশ চীফ হোভারসন, কোথায় গিয়েছিলে?
ডাক্তারের কাছে, বলল কিশোর।
কেন?
সর্দি।
ও। হ্যাঁ, শুনেছি, হান্টকে ধরতে পারিনি। ব্যাটা পালিয়েছে।
পালিয়েছে? একটা মালবাহী জাহাজে কাজ নিয়েছে। আজ সকালে ছেড়ে গেছে জাহাজটা। কয়েক মাসের মধ্যে ফিরবে না। ওর এক বন্ধুকে ধরেছিলাম। ওই ব্যাটা বলল, গোয়েন্দা জেনে তোমাদেরকে নিয়ে একটু মজা করছে হান্ট। আমার কিন্তু বিশ্বাস হচ্ছে না।
আমারও না, বলল কিশোর।
কিন্তু কি আর করা? ব্যাটাকে তো ধরতে পারলাম না, বললেন হোভারসন। ঠিক আছে, চলি। তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। নতুন কিছু জানতে পারলে জনাব।
গাড়ি চালিয়ে চলে গেলেন হোভারসন। আবার বোডিং হাউসের দিকে হাঁটতে লাগল কিশোর। চিমটি কাটছে নিচের ঠোঁটে।
লোকটার ওপর প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর। পাশের এক গলি থেকে আচমকা বেরিয়ে এসে পথ রোধ করেছে তার। হালকা-পাতলা। কুৎসিত হাসিতে বিকৃত হয়ে আছে মুখ।
এই ছেলে, দাঁড়াও, আঙুল তুলল লোকটা। তোমাকে কিছু উপদেশ দেব।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, বলুন কি বলবেন? চেহারা বোকা বোকা করে রেখেছে কিশোর। ইচ্ছে করলেই চেহারাটাকে এমন হাবাগোবা করে তুলতে পারে সে। এতে কাজ দেয় অনেক সময়, দেখেছে।
আমার উপদেশ, হাড়গোড় আস্ত রাখতে চাইলে হলিউডে ফিরে যাও। সঙ্গে নিয়ে যাও সিনেমা কোম্পানিকে। ফিশিংপোটে তোমাদেরকে কেউ চায় না।
দুদিকের কান পর্যন্ত বিস্তৃত হল লোকটার কুৎসিত হাসি। তার হাতের দিকে চোখ পড়ল। কিশোরের। বাঁ হাতের উল্টো পিঠে উল্কিতে আঁকা ছবি। স্পষ্ট নয়। তবে বুঝতে অসুবিধে হয় না, ছবিটা জলকুমারীর। ভয়ের ঠাণ্ডা একটা শিহরণ উঠে গেল কিশোরের মেরুদন্ড বেয়ে।
ঠিক আছে, স্যার, ভোঁতা গলায় বলল কিশোর। বলব ওদেরকে। কিন্তু কে যেতে বলছে, কার নাম বলব?
বেশি চালাকির চেষ্টা কোরো না, ছেলে’ কর্কশ গলায় বলল লোকটা। ভাল চাইলে আজই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও।
হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল লোকটা। গট গট করে হেঁটে আবার ঢুকে পড়ল গলিতে।
লোকটা চলে যাবার পরও কয়েক মুহূর্ত তার গমন পথের দিকে চেয়ে রইল কিশোর। চেপে রাখা শ্বাসটা ফেলল শব্দ করে। তারপর আবার হাটতে শুরু করল বোডিং হাউসের দিকে।
একটা ব্যাপারে এখন নিশ্চিত কিশোর। দ্বীপে সিনেমা কোম্পানির থাকাটা বরদাস্ত করতে পারছে না কেউ একজন।
১২
আমার নৌকা, বিড়বিড় করে বলল পাপালো। জোর করে ঠেকিয়ে রেখেছে চোখের পানি। নৌকা নেই। গুপ্তধন খোঁজার আশা শেষ।
তই তো! পাপালোর কত বড় ক্ষতি হয়ে গেছে, এতক্ষণে বুঝতে পারল যেন রবিন। কিন্তু একাজ করল কেন লোকটা? দুর্ঘটনা, নাকি ইচ্ছে করেই?
ইচ্ছে করে! রাগ প্ৰকাশ পেল পাপালোর গলায়। নইলে থামত ও। এসে জিজ্ঞেস করত, বোটটা কার। দুঃখ প্রকাশ করত।