চোখ মিটমিট করে তাকাল কিশোর। তাই তো! লাঞ্চের সময় তো ওদের ফিরে আসার কথা! মোহরের খোঁজ করতে করতে খিদেই ভুলে গেল!
বাইরে গেছে, মিসেস ওয়েলটনকে বলল কিশোর। এসে যাবে। যে-কোন মুহূর্তে। আমার খাবার দিন। ডাক্তারের কাছে যাবার সময় হয়ে গেছে।
নাক দিয়ে অনবরত পানি গড়াচ্ছে। রুচি নেই। এক গ্লাস দুধ দিয়ে কোনমতে একটা স্যান্ডউইচ গিলে নিলো কিশোর। তারপর বেরিয়ে পড়ল।
বোর্ডিং হাইসের কয়েকটা বাড়ি পরেই ডাক্তার রজারের চেম্বার, মিসেস ওয়েলটনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছে কিশোর।
রাস্তায় লোকজন কম। কলোনি টাইপের কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে এলো কিশোর। রঙ চটে গেছে, প্লাস্টার উঠে গেছে জায়গায় জায়গায়। কয়েকটা খালি দোকান পেরোল। দরজায় ঝুলছে ভাড়া দেওয়া হইবে নোটিশ। পরিষ্কার বোঝা যায়, ফিশিংপোর্টের সময় খুব খারাপ যাচ্ছে।
আশেপাশের বাড়িগুলোর তুলনায় ডাক্তার রোজারের বাড়িটা নতুন। লাল ইটের তৈরি, ছোটখাট, ছিমছাম। ওয়েটিং রুমে ঢুকল কিশোর। দুটো বাচ্চা নিয়ে বসে আছে এক মহিলা। খানিক দূরে বসেছে দুজন বৃদ্ধ, শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দেয়ালের দিকে।
কিশোরের দিকে তাকাল ডেস্কের ওপারে বসা নার্স। ডাক্তারের চেম্বারের দরজা দেখিয়ে দিল। সোজা ঢুকে যেতে বলল।
মাঝারি আকারের একটা কামরা। এক পাশে একটা ছোট ডেস্ক। কাছেই একটা বিছানা, ওতে শুইয়ে পরীক্ষা করা হয় রোগীকে। দুপাশের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা আলমারি। সাদা রঙ করা। ওষুধের শিশি বোতলে ঠাসা।
ডেস্কের ওপাশে বসে আছেন ডাক্তার রোজার। ধূসর হয়ে এসেছে চুল। একটা স্যান্ডউইচ খাচ্ছেন।
অপেক্ষা করছি। এসো, বসে।
স্যান্ডউইচটা খেয়ে নিলেন ডাক্তার। এক ঢোক কফি খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বিছানায় গিয়ে শুতে ইঙ্গিত করলেন কিশোরকে।
দ্রুত অভ্যস্ত হাতে কিশোরের নাক গলা কান পরীক্ষা করলেন ডাক্তার। গলায় স্টেথো লাগিয়ে হাটবিট শুনলেন। টোকা দিয়ে পরীক্ষা করলেন বুক। তারপর ব্লাডপ্ৰেশার দেখলেন।
হুমম, মাথা ঝোঁকালেন ডাক্তার। ঠাণ্ডা লাগিয়েছ ভাল মতই। এখানকার আবহাওয়া সহ্য হয়নি…
আলমারি খুলে একটা শিশি বের করলেন ডাক্তার। একটা ছোট খামে কয়েকটা বড়ি ঢেলে নিলেন। খামটা কিশোরের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ভাবনা নেই। চার ঘণ্টা পর পর দুটো করে বড়ি খেয়ো। দুদিনেই সেরে যাবে। তবে হ্যাঁ, নড়াচড়া বেশি করে না, বিশ্রাম নেবে। সাগরের ধারে কাছে যাবে না।
ঠিক আছে, বলল কিশোর। এক মুহূর্ত দ্বিধা করল। আচ্ছা, স্যার, আমাকে কয়েক মিনিট সময় দিতে পারবেন? কিছু কথা…
লাঞ্চ টাইম, কিশোরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ডাক্তার। খেতে খেতে কথা বলতে পারব। ওইটুকু সময় পাবে। ঘুরে ডেস্কের ওপাশে চেয়ারে বসে পড়লেন আবার তিনি। হ্যাঁ, শুরু কর। কি জানতে চাও?
আমি মানে…কিছু তথ্য দরকার, বলল কিশোর। শুনলাম আপনি স্কেলিটন আইল্যান্ডের মালিক…
স্কেলিটন আইল্যান্ড! হাত তুললেন ডাক্তার। ওই হতচ্ছাড়া দ্বীপের কথা রাখা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। মরার আর জায়গা পেল না হতভাগিটা! মরে নাকি ভূত হয়েছে।
তাহলে ভূত মানেন না আপনি? জেলেদের কথা বিশ্বাস করেন না? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আরে দূত্তোর! ভূত আছে নাকি! সব ব্যাটা জেলেদের কুসংস্কার। স্যালি মারা যাবার পর কোন পাঁজি লোক ভূত সেজে গিয়ে নাগরদোলায় চড়েছিল হয়ত। মেয়েটার একটা রুমাল জোগাড় করে নিয়ে ফেলে। এসেছিল পার্কে। সব সাজানো ব্যাপার। জানি কার কাজ। কিন্তু প্ৰমাণ করতে পারব না। দ্বীপে যাতে লোকজন না যায়, সেজন্যেই এই শয়তানী।
মাথা ঝোঁকাল কিশোর। ডাক্তারের কথায় যুক্তি আছে।
দুর্ঘটনায় মারা গেল একটা মেয়ে, আবার বললেন ডাক্তার। কয়েক রাত পরে দেখা গেল তার ভূত। ব্যস, আর কি যেতে চায় কেউ ওখানে। ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল প্লেজার পার্ক। জাঁকিয়ে উঠল মেলভিলের আরেকটা পার্ক। প্লেজার পার্কের সব কাস্টেীমার চলে গেল ওখানে। ব্যাটারা মনে করেছে, আমি কিছু বুঝি না।
কাপে কফি ঢাললেন ডাক্তার। আরেকটা স্যান্ডউইচ তুলে নিলেন। সামনের প্লেট থেকে। নাও, তুমি খাও।
মাথা নাড়ল কিশোর। না, আপনি খান। আমি খেয়ে এসেছি।
পার্কটা চালাত আমার বাবা, স্যান্ডউইচ চিবাতে চিবাতে বলল ডাক্তার। আমি তখন ছাত্র। বাবার মৃত্যুর পর দ্বীপের মালিক হলাম আমি। কিন্তু ওই পর্যন্তই। একটা কানাকড়িও এল না। ওখান থেকে। …অনেক বছর পর সিনেমা কোম্পানি এসে ভাড়া নিল দ্বীপটা। কিছু পয়সা পাব। এবার। হঠাৎ সামনে বুকে এলেন তিনি। আচ্ছা, সত্যি শুটিঙের জন্যেই এসেছে তো দলটা? গুজব শুনছি, ওয়ান-ইয়ারের ম্যাপ নিয়ে নাকি…
ভুল শুনেছেন, বাধা দিয়ে বলল কিশোর। ছবির শুটিং করতেই এসেছে দলটা।
হুমম! সত্যি হলেই ভাল। দ্বীপটা আমার। ওতে গুপ্তধন থাকলে ওগুলো আমারই হওয়া উচিত, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আমার মনে হয়, নেই। কোন জায়গা তো আর খোঁজা বাদ রাখেনি। লোকে। থাকলে, পেয়ে যেতই।
তা-ও ঠিক, আবার স্যান্ডউইচে কামড় দিলেন ডাক্তার।
আচ্ছা, ডক্টর, বলল কিশোর, সিনেমা কোম্পানির জিনিসপত্র চুরি যাচ্ছে, নিশ্চয় শুনেছেন। কারা, কেন চুরি করছে, কিছু অনুমান করতে পারেন?