রাতে ভালমত দেখতে পারেনি, দিনের আলোয় এখন দেখল। ওরা দ্বীপটা। সোয়া এক মাইল লম্বা, শদুয়েক গজ চওড়া। রুক্ষ, পাথুরে, মানুষ বসবাসের অযোগ্য। ফোয়ারা দেখা যাচ্ছে না এখন, শুধু ঝড়ের সময় দেখা যায়।
ফোয়ারার কথা পাপালোকে জিজ্ঞেস করল রবিন।
সাগর আজ শান্ত, বলল পাপালো। খুব বেশি অশান্ত হলে তবেই পানি ছিটায় ওই ফোয়ারা।…দ্বিীপের তলায় কোন ধরনের সুড়ঙ্গ আছে। ওটা দিয়েই পানি ঢুকে ছিটকে বেরোয় টিলার ওপরের ছিদ্র দিয়ে। তিমির ফেয়ারার মত।
দ্বীপের মূলভূমির একশো গজ দূরে নৌকা রাখল পাপালো। পাল নামিয়ে নোঙর ফেলল। এখন ভাটা। পানি কম। এদিকে। পুরো জোয়ারের সময়ই কেবল দ্বীপ পর্যন্ত নৌকা নিয়ে যাওয়া যায়।
ঢেউয়ে নাচছে নোঙরে-বাঁধা নৌকা। সাজ-সরঞ্জাম পরে নিল রবিন আর মুসা। পাপালোর ওসব দরকার নেই। নিজের ফেস মাস্কটা শুধু পরে নিয়েছে।
আস্তে করে নৌকা থেকে পানিতে পড়ল পাপালো। আগে আগে সাঁতরে চলল। তাকে অনুসরণ করল দুই গোয়েন্দা।
কয়েক গজ গিয়ে থেমে গেল পাপালো। দাঁড়িয়ে পড়ল। কয়েক ফুট এগিয়েই হাঁটু পানিতে উঠে এল। ফিরে চেয়ে দুই সঙ্গীকে বলল, বলেছি না, পানি একেবারে কম। যা চোখা পাথর। খোঁচা লাগলে নৌকা শেষ। এজন্যেই ওখানে রেখে আসতে হয় নৌকা।
ছপাৎ ছপাৎ আওয়াজ তুলে হেঁটে চলল ওরা। দ্বীপে উঠল। একপাশে একটা ছোট খাঁড়ি। তলায় বালি। বিশ ফুট গভীর। তল দেখা
যায়।
গত হাপ্তায় ওই খাঁড়িতেই দুটো মোহর পেয়েছি, পাপালো বলল। কপাল ভাল হলে আজও পেয়ে যেতে পারি কয়েকটা।
খাঁড়িতে নেমে পড়ল তিন কিশোর। ডুব দিল।
এখানে ওখানে পড়ে আছে ছোটবড় পাথর। পাথর ঘিরে জন্মেছে নানারকম সামুদ্রিক আগাছা। হলদে বালিতে পড়ে আছে উজ্জ্বল রঙের তারা মাছ। আশপাশে ঘুরছে ছোট রঙিন মাছের দল। আর আছে কাঁকড়া। অগুণতি। বিচিত্র ভঙ্গিতে পাশে হেঁটে এগোচ্ছে, তাড়া করলেই সুড়ুৎ করে লুকিয়ে পড়ছে ছোট ছোট গর্তে। অনেক কিছুই দেখল তিন ডুবুরি, কিন্তু একটা মোহরও চোখে পড়ল না।
ওঠার ইশারা করল মুসা। ভুসস করে ভেসে উঠল তিনজনে।
বেশি গভীর না, মাউথপিস খুলে নিয়ে বলল মুসা। এখানে গ্যাস নষ্ট করে লাভ নেই। এক কাজ করলেই তো পারি। সব কিছু রেখে পাপুর মত শুধু মাস্ক পরে ডুব দিলে অসুবিধে কি? ও পারছে, আমরা পারব না কেন?
রাজি হল রবিন। তীরে এসে উঠল। দুজনে। মাস্ক ছাড়া আর সব সরঞ্জাম খুলে রাখল পাথরের ওপর। আবার নেমে এল খাঁড়িতে।
পুরো খাঁড়ির কোথাও খোঁজা বাদ রাখল না ওরা। কিন্তু মোহরের চিহ্নও চোখে পড়ল না।
ক্লান্ত হয়ে তীরে এসে উঠল তিনজনে, বিশ্রাম নিতে।
আজ ভাগ্য বিরূপ, হতাশ কণ্ঠে বলল পাপালো। তবে পেলে কাজ হত। বাবার অসুখ বেড়েছে। চল, আরেক জায়গায় যাই। একটা জায়গা চিনি। অনেক দিন আগে ওখানে একটা মোহর পেয়েছিলাম। ওখানে গিয়ে… হঠাৎ থেমে গেল সে। চেয়ে আছে উপসাগরের দিকে।
কানে ঢুকল ইঞ্জিনের শব্দ। ফিরে চাইল রবিন। ধূসর একটা মোটর বোট। পুরানো। দ্রুত গতিতে ছুটে আসছে।
এদিকেই আসছে। বলল পাপালো। ওরাও মোহর খুঁজতে আসছে কিনা কে জানে!
দ্রুত এগিয়ে আসছে বোট। গতি কমছে না মোটেই। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল পাপালো। আরে, পাথরে বাড়ি লাগবে তো! তলা খসাবে! চেঁচিয়ে উঠল সে। এ-ই-ই বোট থামাও! বাড়ি লাগবে পাথরে!
কমল না বোটের গতি। ইঞ্জিনের শব্দে পাপালোর চিৎকার কানে গেল না হয়ত চালকের।
উঠে দাঁড়াল মুসা আর রবিন। তিনজনে হাত নেড়ে নেড়ে চিৎকার করতে লাগল, বোট থামাতে বলল।
আরও এগিয়ে এলো বোট। হুইল ধরে রাখা চালককে দেখা যাচ্ছে। মাথার বড় হ্যাটের কাণা টেনে নামানো। চেনা গেল না লোকটাকে। ছেলেদের চিৎকার তার কানো গেল। কিনা বোঝা গেল না, তবে হঠাৎ বদলে গেল ইঞ্জিনের শব্দ। গতি কমে গেল বোটের। ব্যাক গীয়ার দিয়েছে হয়ত।
সাঁ করে ঘুরে গেল বোটের নাক। গতি এখনও অনেক। কান্ত হয়ে গেল একপাশে, উল্টেই যাবে যেন। সোজা হয়ে গেল। আবার। তারপরই ঘটল অঘটন।
বোটের ঠিক সামনেই পাপালোর নৌকা। শেষ মুহূর্তে নৌকাটা দেখতে পেল বোধহয় চালক। সরে যাবার চেষ্টা করল। কিনা, বোঝা গেল। না। প্ৰচণ্ড জোরে আঘাত হানল ইস্পাতের তৈরি ভরি বোটের নাক, নৌকার মাঝামাঝি। ঢুকে গেল ভেতরে। একটা মুহূর্ত এক হয়ে রইল দুটো জলযান! জোরে গর্জে উঠল মোটর বোটের ইঞ্জিন। ঝটিকা দিয়ে। নৌকার ভেতর থেকে বের করে আনল নাক। মোড় ঘুরে সোজা ছুটীল খোলা সাগরের দিকে।
বোবা হয়ে গেছে যেন ছেলে তিনটে। হাঁ করে চেয়ে আছে ভাঙা নৌকাটার দিকে। দ্রুত তলিয়ে যাচ্ছে ওটা।
ইয়াল্লা! গুঙিয়ে উঠল মুসা। কাপড়-চোপড়, ঘড়ি, সব গোল আমাদের!
বাড়ি ফেরার পথ বন্ধা বিড়বিড় করল রবিন। আটকা পড়লাম এই দ্বীপে। দ্বিতীয়বারা
স্তব্ধ হয়ে গেছে পাপালো। কিছুই বলার নেই তার। মুঠো হয়ে গেছে হাত। বোবা চোখে চেয়ে আছে সাগরের দিকে। তার সব আশা সব ভরসা যেন তলিয়ে গেছে। ওই ছোট নৌকাটার সঙ্গে সঙ্গে।
১১
পুরো ফিচারটা আরেকবার খুঁটিয়ে পড়ল কিশোর। এতই মগ্ন রইল পড়ায়, সময় কোনদিক দিয়ে বেরিয়ে গেল টেরই পেল না।
দুপুরের খাবার দেবে কিনা জিজ্ঞেস করতে এল মিসেস ওয়েলটন। মুসা আর রবিনকে না দেখে ওরা কোথায় গেছে জানতে চাইল।