নিচু হয়ে একমুঠো মাটি তুলে নিলো কিশোর। আঙুলের ফাঁক দিয়ে ছাড়তে ছাড়তে বলল, গুপ্তধন খুঁজেছে লোকে। গত সোয়াশো বছরে কয় সোয়াশো বার খোঁড়া হয়েছে। এখানকার মাটি, আল্লাই জানে! সব গাধা! এমন একটা খোলা জায়গায় এনে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখবে, জলদস্যুদের এত বোকা ভাবল কি করে!
ঠিক, মাথা ঝাঁকাল মুসা। আঙুল তুলে সরু প্ৰান্তটা দেখিয়ে বলল, ভেতরে আরও গুহা আছে মনে হচ্ছে টর্চ আনলে ঢুকতে পারতাম।
গোয়েন্দাগিরি করছ, গুহায় ঢুকতে এসেছ, টর্চ আননি কেন? হাসল কিশোর। রবিনের দিকে ফিরল, তুমি এনেছ?
গুহায় ঢুকব, ভাবিনি।
আমিও ভাবিনি, বলল রবিন।
গোয়েন্দাদের জন্যে টর্চ একটা অতি দরকারি জিনিস, সব সময় সঙ্গে রাখা উচিত, আবার হাসল কিশোর। তবে, আমিও রাখতে ভুলে যাই। আজ গুহায় ঢুকব, জানি, তাই মনে করে সঙ্গে নিয়ে এসেছি!
গুহার সরু প্ৰান্তে এসে দাঁড়াল ওরা। টর্চ জ্বালল কিশোর। পাথুরে দেয়াল। দেয়ালে অসংখ্য তাক, প্রাকৃতিক। মসৃণ। এখানেই ঘুমাত হয়ত জলদস্যুরা, ঘষায় ঘষায় মসৃণ হয়ে গেছে। কে জানে, বন্দিদেরকে হয়ত হাত-পা বেঁধে এখানেই ফেলে রাখা হত। অসংখ্য ফাটল, খাঁজ দেখা গেল। দেয়ালের এখানে ওখানে। একপাশে, মাটি থেকে ফুট ছয়েক উচুতে একটা খাঁজে এসে স্থির হয়ে গেল টর্চের আলো। সাদা একটা বস্তু। ওপরের দিকটা গোল।
খাইছে রে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ঘুরে দাঁড়িয়েই ছুটি লাগাতে গেল। তারপরেই ঘটল অদ্ভুত একটা কান্ড চমকে থেমে গেল সে।
তাকের ওপর বসে আছে যেন মানুষের মাথার খুলিটা। চক্ষু কোটির দুটো এদিকে ফেরানো। দাঁতগুলো বীভৎস ভঙ্গিতে হাসছে নীরব হাসি, দুই পাটি দাঁতের মাঝে সামান্য ফাঁক। ওই ফাঁক দিয়েই এলো যেন কথাগুলোঃ ভাগ, ভোগে যাও জলদি। দীর্ঘশ্বাস পড়ল। আমাকে শান্তিতে একা থাকতে দাও! এখানে কোন গুপ্তধন নেই।
৬
কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই ছুটতে শুরু করল মুসা। ঠিক তার পেছনেই রবিন। প্রায় উড়ে চলে এল যেন সুড়ঙ্গমুখের কাছে। পাথরে হোচট খেল মুসা। হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তার গায়ে পা বেধে গিয়ে গোয়েন্দা সহকারীর ওপরই পড়ল নথি। দুই সহকারীর গায়ে হোচট খেতে গিয়েও কোনমতে নিজেকে সামলে নিল গোয়েন্দাপ্রধান।
হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে দুই সহকারী। ফিরে চাইল একবার কিশোর। না, তাড়া করে আসছে না খুলি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল আবার। নিচু হয়ে তুলে নিল টৰ্চটা। ভয়ে হাত থেকে খসে পড়েছিল।
মড়ার খুলি কথা বলতে পারে না, সময় পেয়ে সামলে নিয়েছে আবার কিশোর। উঠে দাঁড়িয়েছে দুই সহকারী, পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের দিকে ফিরে বলল, কথা বলতে হলে জিহবা দরকার, কণ্ঠনালী দরকার। খুলির ওসব কিছুই নেই।
হা হা করে হেসে উঠল খুলি। চমকে আবার দৌড় দিতে যাচ্ছিল দুই সহকারী, থেমে গেল খাঁজের পেছনে চোখ পড়তেই। না, খুলি হাসেনি। একটা মাথা দেখা যাচ্ছে। কোঁকড়া চুল। খুলি হাতে নিয়ে লাফিয়ে নেমে এল মাথার মালিক। আবার হাসল জোরে জোরে। নিম্পাপ। কালো দুটো চোখের মণি জ্বলজ্বল করছে টর্চের আলোয়।
তারপর? খুলিটা পেছনে ছুড়েঁ ফেলে দিল পাপালো হারকুস। চিনতে পার?
নিশ্চয়, জবাব দিল কিশোর। প্ৰথমে দৌড় দিয়েছিলাম, তারপরই মনে হল গলাটা কেমন চেনা চেনা। টর্চ তুলে নিতে আসার সাহস করেছি সেজন্যেই।
তারমানে, ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছি। তোমাদের? আবার হাসল পাপালো। জলদস্যুর ভূত ভেবে কি একখান কান্ডই না করলে! মুসা আর রবিনের গোমড়া মুখের দিকে চেয়ে আবার হা হা করে হেসে উঠল সে।
আমি ভয় পাইনি, গম্ভীর গলায় বলল কিশোর। শুধু চমকে গিয়েছিলাম। মুসা আর রবিন… দুই সহকারীর পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে থমকে গেল সে। ভেড়া বনে গেছে যেন মুসা আর রবিন।
আমিও ভয় পাইনি, বিড়বিড় করে বলল রবিন। পা দুটো কথা শুনল না, কি করব! খালি ভাগিয়ে নিয়ে যেতে চাইল…
আমারও একই ব্যাপারা বলল মুসা। খুলির ওদিক থেকে কথা শোনা যেতেই পা দুটো চনমান করে উঠল। ছুটিয়ে বের করে নিয়ে যেতে চাইল গুহার বাইরে। তাই, ইচ্ছে করেই তো হোচট খেলাম…
হো হো করে হেসে উঠল পাপালো। দারুণ কৌতুক! হাঃ হাঃ হাঃ…
কিশোরও হেসে ফেলল। হাসিটা সংক্রমিত হল মুসা আর রবিনের মাঝেও ।
চল, বাইরে যাই, হাসি থামিয়ে বলল কিশোর। খোলা হাওয়ায় বসে আলাপ করি।
বাইরে বেরিয়ে এল। চার কিশোর। পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসল।
এখানে কখন এলে? পাপালোকে জিজ্ঞেস করল কিশোর। কি করে জানলে, আমরা গুহায় ঢুকব?
সহজ, বলল পাপালো। নৌকা নিয়ে ঘোরাফেরা করছিলাম। তোমাদের বোট চোখে পড়ল। কোথায় যাবে, বুঝতে পারলাম। দ্বীপের উল্টো দিকে বোট ভিড়িয়ে নেমে পড়লাম। গাছপালার আড়ালে আড়ালে চলে গেলাম ক্যাম্পের কাছে। দেখলাম, পার্কের দিকে যাচ্ছি। নাগরদোলাটার কাছেই একটা ঝোপের ভেতর লুকিয়ে বসে রইলাম। জানলাম, গুহায় ঢুকবে তোমরা। চট করে ঝোপ থেকে বেরিয়ে গাছের আড়ালে আড়ালে চলে এলাম এখানে। লুকিয়ে বসে রইলাম খাঁজের আড়ালে। খুলিটা ছিল অন্য একটা তাকে। খাঁজে নিয়ে গেছি। আমিই।
কিন্তু লুকিয়ে দ্বীপে নামতে গেলে কেন?? জানতে চাইল রবিন। জেটিতে নৌকা বেঁধে এসে আমাদের সঙ্গে দেখা করলেই পারতে? এতসব লুকোচুরি কেন?