রান্না ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মোনা। বেটি ফেয়ারচাইল্ড আবার ঘাস কাটার কাঁচে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। প্রতিবেশীদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর বদভ্যাস আছে বেটির। বিশেষ করে মোনার ব্যাপারে আগ্রহ তার প্রবল।
একটা হাইবল তৈরি করে সিগারেট ধরাল মোনা। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা পনেরো। আরও মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর বাসায় ফিরবে হ্যারী।
ড্রিঙ্কটা নিয়ে কিচেন টেবিলে বসল মোনা হাঁটু ভাঁজ করে। ওর পা একটু পরপর ঝাঁকি খেলো, জোর করে স্থির হয়ে থাকল মোনা। এয়ারকুলারের থার্মোস্টাটের ক্লিক শব্দে হঠাৎ চমকে উঠল। আবার পা ঝাঁকি খেতে শুরু করেছে। মোনা এবার আর ঝাঁকুনি থামাতে চেষ্টা করল না। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ঘড়ির দিকে চোখ তুলল। পাঁচটা ষোলো এখনও চল্লিশ মিনিট। ওর হাতের লোমের গোড়ায় ফুটে উঠেছে স্বেদ বিন্দু। সিঙ্কে গিয়ে মুখ ধুলো মোনা, কলের নিচে হাত মেলে ধরল। গড, এত ঘামছে কেন সে? ঘর তো ঠাণ্ডা। নাকি খুনের আগে সব খুনীরই এ রকম অবস্থা হয়?
আরেকটা হাইবল তৈরি করল মোন প্রচুর সময় নিয়ে, আগেরটার চেয়ে বড়। হ্যারী নিখোঁজ হলে পুলিশ প্রথমেই তার কারণ জানতে চাইবে। ষোলো বছরের দাম্পত্য জীবনে, বিখ্যাত জুতো তৈরির কারখানা পাইপার এ যে মানুষটা সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে আঠারো বছর কাজ করে গেছে সে কেন হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে যাবে?
হ্যারী রোপের কোনও পাওনাদার নেই, যাদের ভয়ে সে বাড়ি ছেড়ে পালাবে। টাকা পয়সারও অভাব নেই তার। ব্যাঙ্কে মোটা অঙ্কের অর্থ গচ্ছিত আছে, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। আছে চমৎকার একটি বাড়ি, দামী আসবাবপত্র, দুটো গাড়ি। হ্যারী রোপ জুয়া খেলে না, মদ্যপ নয়, অসৎ পথে টাকাও ওড়ায় না। প্রতিবেশীদের সঙ্গে হ্যারীর সম্পর্ক খুবই ভালো। তারা জানে, স্বর্ণকেশী মোনা রোপা চল্লিশোর্ধ্ব বয়সেও যৌবনকে ধরে রেখেছে শক্ত হাতে এবং স্বামীর প্রতি সে খুবই বিশ্বস্ত।
আচ্ছা, এক মিনিট। হ্যারীর স্ত্রীর ব্যাপারে একটা কথা বলা যাক। মোনা রোপ কি তার স্বামীকে কোন কারণে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে? নাকি এমন কোন কারণ থাকতে পারে যে মোনা হ্যারীকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলল, তারপর হ্যারী নিখোঁজ বলে পুলিশকে জানাল?
কিন্তু মোনা তার স্বামীকে খুন করবে কেন? সেফ ডিপোজিটের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে যে টাকা আছে, ওটার জন্য? উঁহু, বিশ্বাস হয় না। জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের টাকা দিয়ে মোনা বড়লোক হতে পারবে না। জীবন বীমা? হ্যারী রোপ জীবন বীমা করেনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে স্বামী নিখোঁজ হলে কিংবা মারা গেলে মোনা রোপ কোনদিক থেকেই লাভবান হতে পারছে না।
আয়নায় নিজেকে মুখ ভেঙচাল মোনা, তাকাল বাইরে। বেটি ফেয়ারচাইল্ড ঘাস কাটছে না, কিন্তু এখনও বাগানে আছে। ও কেন ওখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছে বুঝতে কষ্ট হয় না। পঁচিশের কোঠায় বয়স, হালকা পাতলা বেটির মনে রাজ্যের সন্দেহ আর অবিশ্বাস বাসা বেঁধে আছে। মেয়েটাকে দুই চোখে দেখতে পারে না মোনা।
আরও পাঁচ মিনিট পর হ্যারীর কনভার্টিবলটাকে আসতে দেখল মোনা। বেটিদের বাগানের বেড়ার সামনে দিয়ে আসার সময় কি যেন বলল সে। বেটিকে। বেটি হাতের হলদে দড়ির ফাঁসটা দুলিয়ে হাসল। হ্যারী ওর দিকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত নেড়ে গাড়ি ঢোকাল গ্যারেজে।
হ্যারী যখন কিচেনে ঢুকল মোনা ততক্ষণে তার জন্য একটা নতুন ড্রিঙ্ক নিয়ে তৈরি। হ্যারীর বয়স মোনার সমান হলেও খাটো, রোগা আর মাথায় ছোট চুল বলে ওকে আরও কম বয়েসী দেখায়। কাঁধে কোট, আলগা টাই, জামার বোতাম খুলতে খুলতে হ্যারী মোনার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাই, সইটি। আমার জন্যই ড্রিঙ্কটা বানিয়েছ বুঝি?
মাথা দোলাল মোনা।
তুমি বিকেলে সাঁতার কেটেছ?
হ্যাঁ।
রান্না ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে হ্যারী বলল, ড্রিঙ্কটা বাথটাবে দিয়ে যাও। আমি গোসল করব। ঘেমে একেবারে নেয়ে গেছি?
এটা হ্যারীর বহুদিনের অভ্যাস। শীত হোক আর গ্রীষ্মই-ঘরে ফেরার পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার গোসল করা চাই।
মোনা হাত মুঠি করল, প্রাণপণে চেষ্টা করল স্বাভাবিক থাকতে। কান পাতল। কোন সাড়াশব্দ নেই। কপালে ভাঁজ পড়ল মোনার, সাবধানে লিভিং রুমে গেল। ওর বিপরীত দিকে বেডরুম, দরজা খোলা। হ্যারী করছেটা কি?
এখনও টাবে ঢুকছে না কেন? এই সময় বাথরুম থেকে জল পড়ার শব্দ শুনতে পেল সে। ঢিল পড়ল পেশীতে কিছুক্ষণ পর থেমে গেল শব্দটা। হ্যারী টাবে ঢুকেছে।
রান্না ঘরে ফিরে এল মোনা, ড্রয়ার খুলে বাঁকানো একটা হাতুড়ি বের করল, জুতো খুলে নিঃশব্দে পায়ে ঢুকল শোবার ঘরে। বাথরুমের দরজা ভেজানো। গলা ছেড়ে গান গাইছে হ্যারী। একটানে দরজা খুলে ফেলল মোনা। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে হ্যারী, মোনার দিকে পিঠ।
সোজা খুলির ওপর প্রথম আঘাতটা করল মোনা। আঘাতের চোটে সামনের দিকে ছিটকে গেল হ্যারী, কোমর ভেঙে পড়ে গেল বাথরুমের মধ্যে। গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বেরুল না। উন্মাদিনীর মতো হাতুড়ি চালাতে লাগল মোনা, হ্যারী মারা গেছে বুঝতে পেরে এক সময় থামল।
এই সময় গম্ভীর কণ্ঠটা শুনতে পেল মোনা।
হ্যারী, বাড়ি আছ?
মুখ সাদা হয়ে গেল মোনর, শূন্য দৃষ্টিতে চাইল।