বিকৃত বামন বললে-–এ নাচের নাম শিকলবাঁধা আট ওরাংওটাং। অভিনয়ের ওপর নির্ভর করছে নাচের সার্থকতা।
করব! করব! ভাল অভিনয় করব! লাফ মেরে দাঁড়িয়ে উঠে বললেন রাজা।
এ খেলায় সব চেয়ে বড় মজা হলো, মেয়েরা দারুণ ভয় পায়। বলল হপ-ফ্রগ।
তাই তো চাই! তাই তো চাই! সে কি আনন্দ আটজনের। হপ-ফ্রগ বলল –আপনাদের ওরাংওটাং সাজানোর ভার আমার। অবিকল ওরাংওটাং সেজে ঘরে ঢুকলে অভ্যাগতরা চিনতেও পারবে না আপনাদের মনে করবে সত্যিকারের ওরাংওটাং-পালিয়ে এসেছে খাঁচা ভেঙে। আপনারা মিছিমিছি তাড়া করবেন, বিকট চেঁচাবেন-দারুণ ভয় পাবে সকলে- চেঁচামেচি, হুটোপুটি শুরু হয়ে যাবে। ঘর ভর্তি মেয়ে-পুরুষরা দামী দামী জামাকাপড় পরে থাকবে-অথচ আপনারা আটজনে কদাকার সাজে সেজে থাকবেন। ফারাকটা অবিশ্বাস্য হওয়ায় মজা জমবে আরো বেশি।
ঠিক বলেছো, ঠিক বলেছো, বলে মন্ত্রীদের নিয়ে উঠে পড়লেন রাজা। অনেক দেরি হয়ে গেছে তৈরি হতে হবে তো!
.
খুব সহজেই আটজনকে ওরাংওটাং সাজিয়ে দিল হপ-ফ্রগ। আগে টাইট শার্ট আর পাজামা পরালো প্রত্যেককে। তার ওপর বেশ করে লাগাল আলকাতরা। একজন মন্ত্রী প্রস্তাব করলেন-পালক লাগানো হোক আলকাতরার ওপর। হপ-ফ্রগ আপত্তি করল পালক নয়, ওরাংওটাংয়ের গায়ের লোম নকল করতে পারে শুধু পাট। পাটের পুরু স্তর চেপে চেপে বসিয়ে দেওয়া হলো আলকাতরার ওপর। তারপর একটা শেকল জড়ানো হলো আটজনের কোমরে। গোল হয়ে দাঁড়াল আটজনে-এক শেকলে বাঁধা অবস্থায়। বাড়তি শিকলটা বৃত্তের মাঝখানে কোণাকুণি করে রেখে দুটি ব্যাস তৈরি করল হপ ফ্রগ। বোর্ণিতে শিম্পাঞ্জী ধরা হয় ঠিক এই কায়দায়।
ওরাংওটাং পৃথিবীর খুব কম লোকই দেখেছে। আটজনের অতি কদাকার বীভৎস সাজসজ্জা দেখে তাই কারো বোঝবার উপায় রইল না যে ওরা ছদ্মবেশী মানুষ সত্যিকারের বনমানুষ নয়।
যে ঘরে মুখোশ নাচ হবে, সেটি গোলাকার। ছাদের ঠিক মাঝখানে একটি মাত্র স্কাইলাইট দিয়ে সূর্যালোক আসে। সেখানে দিয়েই একটি শিকল মেনে এসেছে ঘরের মধ্যে। শিকল থেকে ঝোলে প্রকান্ড ঝাড়বাতি। তাতে জ্বলে মোমবাতি। শিকলটা ছাদের ফুটো দিয়ে বাইরে অদৃশ্য হয়েছে। কপিকলের সাহায্যে ভারী ঝাড় বাতিকে তোলা নামা করা হয় বাইরে থেকে।
এ ঘরের সাজসজ্জার ভার ট্রিপেটার ওপর। কিন্তু ঠান্ডা মাথা হপ-ফ্রগ তাকে বুদ্ধি জুগিয়েছে এ ব্যাপারে। তাই ঝাড়বাতিটাকে সরিয়ে ফেলা হলো ঘর থেকে। কারণ, এই গরমে মোমের ফোঁটা পড়ে অভ্যাগতদের মূল্যবান পোশাক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। তার বদলে দেয়ালে জ্বলতে লাগল পঞ্চাশ যাটটা বড় মশাল।
রাত বারোটার সময়ে পাশবিক চিৎকার করতে করতে আটটা ওরাংওটাং ঢুকল সেই ঘরে। ঘরে তখন আর তিল ধারণের জায়গা নেই। সঙ্গে সঙ্গে রাজার হুকুমে সব কটা দরজা বন্ধ করে চাবিটা দেওয়া হল হপ-ফ্রগের হাতে।
আতঙ্ক চরমে উঠল আটটা বীভৎস মূর্তি দেখে আর তাদের অপার্থিব হুঙ্কার শুনে। বুদ্ধি করে আগেই রাজা হুকুম দিয়েছিলেন, অভ্যাগতরা অস্ত্র বাইরে রেখে ঘরে ঢুকবেন। নইলে তৎক্ষণাৎ অস্ত্রাঘাতে নিহত হতেন। সপারিষদ রাজামশায়।
সেকী হট্টগোল! ঠেলাঠেলিতে ছিটকে পড়ল নরনারীরা! ঝনঝন শব্দে শিকল বাজিয়ে এলোপাতারি ছুটছে আট ওরাংওটাং। কারো খেয়াল নেই। ছাদের দিকে। থাকলে দেখতে পেত ঝাড়বাতির সেই শিকলটা আস্তে আস্তে নেমে আসছে মেঝের দিকে-ডগায় ঝুলছে একটা হুক!
ঠিক সেই সময়ে হুল্লোড় করতে করতে আর মনে মনে পেট ফাটা হাসি হাসতে হাসতে রাজা আর মন্ত্রীরা এসে পড়লেন ঝুলন্ত হুকের তলায়। তৈরি হয়ে ছিল হপ-ফ্রগ। টুক করে হুকটা আটকে দিল কোণাকুণিভাবে লাগানো শিকল দুটির ঠিক মাঝখানে। তৎক্ষণাৎ হ্যাঁচকা টানে নাগালের বাইরে উঠে স্থির হয়ে গেল হুকটা। ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য হলো আটজন ওরাংওটাং।
প্রথমে চমকে উঠলেও এখন হো হো করে হেসে উঠল অভ্যাগতরা। এতক্ষণে সবাই বুঝল, পুরো ব্যাপারটা সাজানো এবং হাস্যরসের জন্যই পরিকল্পিত। নরবানরদের দুর্গতি দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেল প্রত্যেকের।
হাসির অট্টরোল ছাপিয়ে শোনা গেল হপ-ফ্রগের তীক্ষ্ণ চীঙ্কার-ওদের ভার আমার! আমি ওদের চিনি–আপনাদেরও চিনিয়ে দেব এখুনি।
বলেই, হঁচড় পাঁচড় করে উঠে গেল অভ্যাগতদের ঘাড়ের ওপর। ঘাড়ে পা দিয়েই লাফাতে লাফাতে গেল দেওয়ালের কাছে-একটা জ্বলন্ত মশাল খামচে ধরে ফিরে এল সেই পথেই। এক লাফে গিয়ে উঠল রাজার মাথায়। সেখান থেকে বিদ্যুৎগতিতে শিকল বেয়ে উঠে গেল খানিকটা ওপরে। তারপর মশালটা নামিয়ে ওরাংওটাংদের মুখ দেখতে দেখতে বলল বিষম তীব্র কণ্ঠে–বলছি, বলছি, এখনি বলছি ওরা কারা!
আটজন ওরাংওটাং সমেত অভ্যাগতরা তখন বেদম হাসিতে লুটিয়ে পড়তে পড়লে বাঁচে। হাসাতেও পারে বটে ভাঁড়টা! ঠিক তখনি তীক্ষ্ম শিষ দিয়ে উঠল হপ-ফ্রগ। সঙ্গে সঙ্গে অদৃশ্য হাতের হ্যাঁচকা টানে তিরিশ ফুট ওপরে উঠে গেল শিকলটা, টেনে তুলে নিয়ে গেল আট ওরাংওটাংকে ছটফট করতে লাগল আটটা মিশমিশে কালো কুৎসিত মূর্তি ছাদের স্কাইলাইটের কাছে।
হপ-ফ্রগ কিন্তু তখনো নির্বিকারভাবে ঝুলছে শিকল ধরে এবং যেন কিছুই হয় নি এমনিভাবে জ্বলন্ত মশাল নাড়ছে ওরাংওটাংদের মুখের কাছে।