মেয়েটির নাম ট্রিপেটা। বামন হলেও নিখুঁত সুন্দরী সে। ভাল নাচতে পারত। সুতরাং সবাই ভালবাসত তাকে। হপ ফ ব্যায়ামবীর হলে কি হবে, কারোর সুনজরে ছিল না। ট্রাপেটা আর হপ-ফ্রগের মধ্যে বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছিল দুজনেই বামন বলে। দুজনেই দুজনকে নানাভাবে উপকার করত।
কি একটা উপলক্ষে রাজার খেয়াল হলো মুখোশ-নৃত্যের আসর বসাবেন। এ সব ক্ষেত্রে হপ-ফ্রগ আর ট্রিপেটার ডাক পড়ে সবার আগে। কেননা দুজনেরই উর্বর মাথা থেকে নানারকম পরিকল্পনা বেরোয়। বিশেষ করে হপ-ফ্রগ এমন সব চরিত্র কল্পনা করত, জামাকাপড় বানাতো, মুখোশ নাচের ছন্দ আবিষ্কার করত-যা কেউ ভাবতেও পারে না।
উৎসবের রাত এসে গেল। কুঁড়েমির জন্যে রাজা এবং তাঁর সাত মন্ত্রী কিন্তু নিজেদের জন্যে কোন যোগাড়যন্ত্র করেননি। অথচ নিমন্ত্রিত অতিথিরা সাতদিন আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে–হরেকরকম পোশাক আর মুখোশ বানিয়ে নিয়েছে। যে ঘরে নাচ হবে, সে ঘরটিও ট্রিপেটার তত্ত্বাবধানে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে। সাজেন নি কেবল রাজা আর তার মন্ত্রীরা। রাত ঘনিয়ে আসতেই টনক নড়ল সবার। ডাক পড়ল দুই বামনের।
ওরা এসে দেখল মন্ত্রীদের নিয়ে মদ্যপানে বসেছেন রাজা। হপ-ফ্রগ মদ সহ্য করতে পারত না একদম। মদ খেলেই মাত্রা ছাড়া উত্তেজনায় তুরুক–নাচ নাচত, রাজা তা জানতেন। মজা দেখাবার জন্যে জোর করে ওকে মদ গেলাতেন।
সেদিনও হইহই করে উঠলেন হপ-ফ্রগকে দেখে–এসো, এসো। এক ঢোক খেয়ে যাও–মগজ সাফ হয়ে যাবে।
হপ-ফ্রগ রসিকতা করে পাশ কাটানোর চেষ্টা করল বটে, কিন্তু পারল না নাছোড়বান্দা রাজার সঙ্গে। সেদিন আবার ওর জন্মদিন। দেশের বন্ধু বান্ধবদের জন্যে মন কেমন করছিল। রাজা তা জেনেই খোঁচা মারলেন অদৃশ্য বন্ধুদের উল্লেখ করে।
বললেন, নাও, নাও। একটু গিলে নাও। মনে কর অদৃশ্য বন্ধুদের সঙ্গে খাচ্ছ?
কথাটা তীরের মত বিধল হপ-ফ্রগের মনে। টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল চোখ বেয়ে।
দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়লেন সপারিষদ রাজামশায়। খুব হাসতে পারে তো হপ-ফ্রগ! হাপুসনয়নে কি রকম কাঁদছে দেখো!
কেঁদেও নিস্তার পেল না হপ-ফ্রগ। রাজার হাত থেকে মদের গেলাস নিয়ে খেতে হলো এক চুমুকে! দুচোখ জ্বলজ্বল করতে লাগল সুরার কারণে।
ভীষণ মোটা প্রধানমন্ত্রী বললেন– এবার কাজের কথা।
হ্যাঁ, এবার কাজের কথা, বললেন রাজা। হপ-ফ্রগ, নতুন কিছু চরিত্র বাতলে দাও তো। বলে হেসে গড়িয়ে পড়লেন রাজা। অগত্যা হাসতে হলো সাত মন্ত্রীকেও।
হাসল হপ ফ্রগও। কিন্তু ফাঁকা হাসি।
হলো কি তোমার? অসহিষ্ণুভাবে বললেন রাজা–মাথা খেলছে না বুঝি?
ভাববার চেষ্টা করছি, বিমূঢ়ভাবে বলল হপ-ফ্রগ। মদ খেয়ে মাথা তার তখন বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে, ভাববার শক্তি নেই।
চেষ্টা করছো? মাথাটা এখনো সাফ হয়নি দেখছি–নাও, আর এক পেয়ালা খাও!
হপ-ফ্রগের তখন দম আটকে আসছে–চেয়ে রইল ফ্যালফ্যাল করে।
রেগে গেলেন রাজা–খেতে বলছি না?
দ্বিধায় পড়ল বামন। রেগে লাল হয়ে গেলেন রাজা। মন্ত্রীরা আরো উস্কে দিলেন তাঁকে। ভয়ে পার হয়ে গেল ট্রিপেটা। সে রাজার পায়ের কাছে বসল-মিনতি করে বলল বন্ধুকে ছেড়ে দিতে।
রাজা তো হতবাক! মেয়েটার স্পর্ধা তো কম নয়! কটমট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ঠেলে ফেলে দিয়ে মদের গেলাসের সবটুকু মদ ছুঁড়ে দিলেন ট্রিপেটার মুখের ওপর।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল ট্রিপেটা। ক্ষীণতম দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল না। গিয়ে বসল টেবিলে।
আধমিনিটটাক কোনো শব্দ নেই। গাছের পাতা পড়লে বা পাখির পালক উড়ে এলেও শোনা যায়, এমনি নৈঃশব্দ। তারপর সেই অসহ্য নীরবতা ভঙ্গ হলো একটা চাপা দাঁত কড়মড়ানির শব্দে। মনে হলো যেন ঘরের চার কোণ থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এল ভয়াবহ শব্দটা।
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন রাজা। তেড়ে গেলেন হপ-ফ্রগকে–ফের যদি ও রকম আওয়াজ করবি তো–
হপ-ফ্রগ মদের নেশা কাটিয়ে উঠেছিল। রাজার চোখে চোখ রেখে বললে শান্তকণ্ঠে, আমি? এমন আওয়াজ করা আমার পক্ষে কি সম্ভব?
একজন মন্ত্রী বলল –আমার তো মনে হলো আওয়াজটা এল ঘরের বাইরে থেকে। কাকাতুয়া জানালা বা খাঁচা ঠোকরাচ্ছে বোধ হয়।
হতে পারে। গরগর করে বললেন নিষ্ঠুর রাজা। আমার কিন্তু মনে হলো ঐ বেঁটে বদমাসের মুখ থেকেই বেরোলো আওয়াজটা।
শুনেই বড় বড় দাঁত বের করে হেসে ফেলল হপ ফ্রগ। রাজা এমন হকচকিয়ে গেলেন যে সভার মাঝে ভাঁড়ের হাসি দেখে প্রতিবাদ করতেও ভুলে গেলেন। তবে হপ-ফ্রগ শক্ত দাঁতের হাসি গোপন করে প্রশান্ত কণ্ঠে আরো মদ্যপান করার ইচ্ছা প্রকাশ করতেই রাজার রাগ জল হয়ে গেল।
এক পেয়ালা মদ চেঁ-চো করে মেরে দিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে মুখোশ নাচের অভিনব পরিকল্পনা শোনাতে বসল হপ-ফ্রগ। মদ খেয়ে তিলমাত্র বিকার ঘটেছে বলে মনে হলো না। জীবনে যেন মদ স্পর্শ করেনি, এমনি শান্ত, সমাহিত কণ্ঠে বললে –আইডিয়াটা মাথায় এল রাজামশায়ের মদ ছোঁড়া দেখে আর জানালার বাইরে কাকাতুয়ার ঠোঁটে বিচ্ছিরি আওয়াজটা শুনে। পরিকল্পনাটা একেবারেই অভিনব-গতানুগতিক নয় মোটেই। এ নাচ আমরা। নাচি আমাদের দেশে। কিন্তু এখানে এ জিনিস একদম নতুন-দরকার কিন্তু আট জন।
হো-হো করে হেসে রাজা বললেন–বারে আমরা তো আটজনই!