কিন্তু নড়ল না লোকটা। পিস্তল হাতে তার দিকে পা বাড়াল বাইরিং। লোকটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, উর্ধ্বাংশ ছায়ায় ঢাকা, তার সামনে গিয়ে ঝুঁকে। দেখল বাইরিং। লাশ একটা।
ভয়ানক কেশে উঠল সে, ঘৃণা এবং ভয়ে দ্রুত পিছিয়ে এল ওখান থেকে, আবার গিয়ে বসে পড়ল গুঁড়িতে। সামরিক সাবধানবাণী ভুলে গিয়ে কাঁপা হাতে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগার ধরাল। দেশলাই নিবে যাবার সাথে সাথে অন্ধকারে স্বস্তি অনুভব করল সে; ওটাকে আর দেখতে হবে না। কিন্তু তারপরও চুম্বকের মতো যেন তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল লাশটার গায়ে। মনে হলো ওটা যেন একটু এগিয়ে এসেছে তার দিকে।
দুত্তেরি! বিড়বিড় করল লেফটেন্যান্ট। লাশটা কী চায় আমার কাছে?
সে ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে গুনগুন করে একটা সুর ভাজতে লাগল। হঠাৎ মাঝপথে গান থামিয়ে আবার তাকাল লাশের দিকে। লাশটার উপস্থিতি একই সাথে তাকে ভীত এবং বিরক্ত করে তুলছে। ছায়া থেকে সরে এসেছে লাশ। চেহারাটাকে এখন স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় বিকট সাদা লাগল মরা মুখটাকে। লাশের কোট এবং ওয়েস্ট কোট খোলা, ভেতরে সাদা শার্ট দেখা যাচ্ছে। হাত দুটো শরীরের দুপাশে ছড়ানো, বা হাঁটুটা উঠে আছে ওপর দিকে। গোটা অবয়ব এবং আকৃতি বাইরিং-এর কাছে রোমহর্ষক এবং ভয়াবহ ঠেকল।
সে আবার লাশটা থেকে চোখ সরিয়ে নিল, আগডুম-বাগডুম ভাবছে। মানুষ কেন মরে, মরা লাশকে কেনই বা তারা ভয় পায়, তাদের ভেতরে এত কুসংস্কার কেন কাজ করে, এইসব চিন্তা।
নানা দার্শনিক চিন্তা করেও লাশটার উপস্থিতির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না বাইরিং। একবার ভাবল এখান থেকে চলে যাবে। এজন্যে উঠেও দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু কমরেডদের কাছে গেলে একটা লাশের ভয়ে সে পাহারা বাদ দিয়ে পালিয়ে এসেছে শুনলে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, তার চরিত্রের দুর্বলতম দিকটি প্রকাশিত হয়ে পড়বে, এই চিন্তা করে সে দমে গেল।
সে যে কাপুরুষ নয়, সাহসী এটা প্রমাণ করার জন্যে আবার লাশের দিকে ফিরল বাইরিং। লাশটার ডান হাতটা ছায়ায় পড়ে আছে, এ ছাড়া সব আগের মতোই আছে। মনে-মনে স্বস্তি বোধ করল বাইরিং।
হঠাৎ ডান হাতে তীব্র ব্যথা অনুভব করল সে। লাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে হাতের দিকে তাকাল। এত জোরে সে তরবারি চেপে ধরেছে যে ব্যথা হয়ে গেছে হাত। ভঙ্গিটা মারমুখী গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো, যেন এক্ষুনি। ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর ওপর। দাঁতে দাঁত চেপে বসেছে ওর, ঘন-ঘন শ্বাস পড়ছে। ধীরে-ধীরে নিজেকে স্বাভাবিক হতে দিল বাইরিং, লম্বা করে দম নিল। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলো নিজের কাছে। হাস্যকরই তো। একটা লাশ, প্রাণহীন একটা জড় পদার্থকে সে কেন জানের শত্রু ভাবছে? হঠাৎ কে যেন হেসে উঠল খলখল করে। লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল বাইরিং, সভয়ে তাকাল চারপাশে, বুঝতে পারল না আসলে সে নিজেই হেসে উঠেছে মনের অজান্তে।
এবার ভয় পেল বাইরিং। তীব্র ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করল, কিন্তু বিদ্রোহ ঘোষণা করল পা দুটো, নড়তেই চাইছে না। ঝি ঝি ধরে গেছে। বাধ্য হয়ে ধপ করে আবার বসে পড়ল সে গুঁড়ির ওপর। ঘামে ভিজে গেছে মুখ, সারা শরীরও ভিজে গেছে ঠাণ্ডা ঘামে। দাঁত কপাটি লেগে গেছে ওর, চিৎকার দিতে পারছে না। খরখর আওয়াজ উঠল পেছনে, ঘাড় ফিরে দেখার সাহস হলো না বাইরিং-এর। লাশটার ভৌতিক সঙ্গীরা কি কবর থেকে উঠে এসেছে ওর ওপর চড়াও হতে? নাকি কোনো নিশাচর প্রাণী? কিন্তু সাহসই পেল না সে পেছন ফিরে দেখতে। আঠার। মতো তার চোখ লেগে রয়েছে লাশের দিকে।
এমন সময় নড়ে উঠল লাশ। বাইরিং কি প্রচন্ড ভয়ে দৃষ্টি ভ্রমের শিকার হয়েছে? মরা মানুষ আবার নড়াচড়া করতে পারে নাকি? কিন্তু বাইরিং স্পষ্ট দেখছে নড়ছে লাশটা। ওই তো হাত নাড়ল। ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপটা মারল বাইরিং-এর মুখে। ভয়ে শিউরে উঠল সে। মাথার ওপর গাছের ডালপালাগুলো বাতাসে আন্দোলিত হলো। বাইরিং-এর মনে হলো ওগুলো মৃত্যু যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। কোত্থেকে একটা ছায়া এসে পড়ল লাশের গায়ে। তারপর সরে গেল। ভয়ঙ্কর জিনিসটা উঠে দাঁড়াচ্ছে! ঠিক তখন গুলির আওয়াজ শোনা গেল পিকেট লাইন থেকে অনেক দূরে, কিন্তু জোরে।
গুলির শব্দ বাইরিং-এর দুঃস্বপ্নটাকে ভেঙে দিল খানখান করে। লাফ মেরে সিধে হল সে। আর তখনি বৃষ্টির মতো গুলি হতে লাগল তার সামনে থেকে। চিৎকার চেঁচামেচি, হৈ-হল্লা, আর্তনাদ ইত্যাকার বিচিত্র সব শব্দও ভেসে এল। জঙ্গলের পেছন দিকে, ঘুমন্ত ক্যাম্পে আকস্মিক হামলা করেছে শত্রুপক্ষ। শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধ। জঙ্গলের মধ্য থেকে গুলি করতে-করতে বেরিয়ে এল ফেডারেল সৈন্যরা। একদল সশস্ত্র পাহাড়ি লোক, বাইরিং যেখানে বসে ছিল, সেদিকে গুলি চালাতে-চালাতে অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তার বাঁকে। তার কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল রিজার্ভ বাহিনীকে। দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। জঙ্গলের এখানে সেখানে বন্দুকের খালি কার্তুজ, স্যাডেল, গুলিবিদ্ধ ঘোড়া পড়ে আছে দেখতে পেল তারা। ফেডারেল কমান্ডার এলাকায় সংক্ষিপ্ত সফরে এসে অধীনস্তদের দুএকটা হুকুম দিয়ে চলে গেল। সৈনিকরাও ঘণ্টাখানেক পর আর কোনো হামলার আশঙ্কা দেখতে না পেয়ে ফিরে গেল যে যার বিছানায়।