এদিকে সৈন্যদের অত্যাচারে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে লোপেজ। এক সৈনিক এক বালতি জল এনে ঢেলে দিল ললাপেজের মাথায়। জ্ঞান ফিরে পেল সে। আবার শুরু হলো নির্যাতন। কিন্তু তার মুখ থেকে কোনো কথা বের করতে না পেরে ধৈর্য হারিয়ে ফেলল সৈন্যরা। ওরা তাকে হত্যা করল।
.
ডি ক্রেসপেডেস রুম থেকে বেরিয়ে দেখে তার সৈন্যরা অপোবদনে দাঁড়িয়ে আছে। সে লোপেজের দিকে তাকিয়ে বুট জুতো দিয়ে ঠেলা মারল। হাতের চেটো দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে হাই তুলল। ও কি কথা বলেছিল? উদাস গলায়। জিজ্ঞেস করল সে। ভাবছিল কতটা লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে ফিরতে হবে ব্যারাকে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে উঁড়িতে শক্ত করে বাঁধল সিটবেল্ট। মাথায় চড়াল ক্যাপ। তারপর আবার ফিরে গেল লোপেজের কাছে। ওর দিকে তাকিয়ে প্রায় আপনমনেই বলল, হয়তো লোকটা অস্ত্র সম্পর্কে সত্যি কিছু জানত না। ওরা এর আগেও এরকম ভুল খবর দিয়েছে। সে ত্যাগ করে ফিরল দরজায়।
সোলজাররা যে যার রাইফেল তুলে নিয়ে তার পেছন পেছন এগোল। বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল লেফটেনেন্ট। ওই মহিলা, খিটখিটে গলায় বলল সে, আমি তো মহিলার কথা ভুলেই গেছিলাম। সে এক সৈন্যের দিকে তাকাল। ওর কাছে যাও। তোমার বেয়োনেট ব্যবহার করবে।
চোখ ঝলসানো রোদে দাঁড়িয়ে লেফটেনেন্ট ভাবছিল কতই না ভালো হতো যদি মহিলা তাকে ভালবাসত। ক্রন্দনরত নারীর কাছ থেকে খুব কমই তৃপ্তি পাওয়া যায়। তবু একেবারে যে মন্দ লেগেছে তা নয়। নারীদেহ তার খুব দরকার হয়।
সৈন্যটি বেরিয়ে এলে তাকে তার বেয়োনেট পরিষ্কার করার সময় দিল ওরা। তারপর এবড়ো খেবড়ো জমিনে পা ফেলে দৃঢ় ভঙ্গিতে এগোল ব্যারাকের দিকে।
হপ ফ্রগ – এডগার অ্যালান পো
রাজামশায় ঠাট্টাতামাসা পেলে দুনিয়া ভুলে যেতেন। বড় রঙ্গপ্রিয় ছিলেন ভদ্রলোক। বেঁচেছিলেন যেন কেবল রঙ্গব্যঙ্গের জন্যেই। তাঁর মন জয় করার নিশ্চিন্ত পন্থা হলো হাসির গল্প বলা এবং জমিয়ে বলে পেটে খিল ধরিয়ে দেওয়া।
রাজামশায় যদি নিজে এত আমুদে হন তো তাঁর পাত্রমিত্র অমাত্যরাও আমুদে হতে বাধ্য। সাতজন মন্ত্রীও নাম কিনেছিলেন ভঁড়ামোর জন্যে। রাজাকে অনুকরণ করতে গিয়ে রাজার মতই নাদাপেটা তেল চকচকে ভুড়িদাস বাবাজী হয়ে গিয়েছিলেন সাতজনই। মানুষ মোটা হলেই ভাঁড়ামো করে, না, ভাঁড়ামো করতে করতে মোটা হয়ে যায়-তা বলতে পারব না। চর্বির মধ্যে সঙ সাজার গুণ আছে কিনা, তাও বলতে পারব না। শুধু জানি, রোগা লিকলিকে হাড্ডিসার ভাঁড়েরা কখনো নাম কিনতে পারেনি।
রাজামশায় কিন্তু স্থূল রসিকতা ভাল বুঝতেন। সূক্ষ্ম রসিকতার কদর বুঝতেন না। কনুইয়ের পুঁতো দিয়ে হাসাতে জানতেন, কথার কারিকুরি। দিয়ে হাস্যরস সৃষ্টি করতে পারতেন না। বেশি সূক্ষ হাস্যপরিহাস সহ্য হত না–হাঁপিয়ে উঠতেন। মোদ্দা কথা, মৌখিক রঙ্গতামাশার চাইতে পছন্দ করতেন গাড়োয়ানি ইয়ার্কি।
এ গল্প যে সময়ের, তখন রাজরাজড়াদের সভাগৃহে মূর্খ ভড়েদের অভাব ছিল না। ভাঁড় না হলে রাজসভা জমত না। তারা চোখা চোখা বুলি আর ধারালো বুদ্ধি দিয়ে হাসির বোমা ফাটিয়ে ছাড়ত সভাগৃহ। রাজার অনুগ্রহ পেতে কে না চায়?
আমাদের এই রাজাটি একজন উজবুক ভাঁড় মোতায়েন রেখেছিলেন। সেরা উজবুক সংগ্রহ করেছিলেন তাঁর উজবুক মন্ত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্যে-নিজেকেও উজবুক শ্রেণী থেকে বাদ দেননি।
তাঁর সংগ্রহীত পেশাদার ভড় শুধু মূর্খ নয়, বিকৃত-অঙ্গ এবং বেঁটে বামন। ভাঁড়ের মত ভাঁড়। এ ভাঁড়ের দাম তিনগুণ তো হবেই। রাজসভায় বেঁটে বামন আকছার দেখা যেত সেকালে। বামনরা মূর্খই হয়। তাই তাকে ছাড়া রাজসভার একঘেয়েমি ঘুচতো না। যে কোন রাজসভার অলস দিনগুলো যেন ফুরতে চায় না–মনে হত বড্ড বেশি লম্বা। এ অবস্থায় রাজারা চাইত ভাঁড় আর বামন–দুজনকেই। ভাঁড় হাসাবে আর বামনকে দেখে হাসবেন। কিন্তু আগেই বলেছি, শতকরা নিরানব্বই জন ভাড়ই চালকুমড়োর মত বেঢপ মোটা হয়। সেক্ষেত্রে হপ ফ্রগ একাধারে তিন তিনটে গুণের অধিকারী হওয়ায় রাজার ভারী পছন্দ তাকে।
হপ-ফ্রগ এই বেঁটে বিকৃতাঙ্গ ভাঁড়ের নাম। এ নাম সাতজন মন্ত্রীর দেওয়া। কারণ, হপ-ফ্রগ সোজা হয়ে হাঁটতে পারে না। এক পায়ে ব্যাঙ তড়কা লাফ আর কেঁচোর মত কিলবিলিয়ে গতি-এই দুটো জুড়ে দিলে যে চলনভঙ্গী, হপ-ফ্রগ হাঁটে সেইভাবে। রাজার ধারণা তিনি অতি সুপুরুষ (যদিও তাঁর মাথা হাঁড়ির মত এবং পেট জালার মত।)-তাই কদাকার হপ ফ্রগকে দেখলেই যেন তাঁর কাতুকুতু লাগে।
পায়ের গড়ন অস্বাভাবিক হওয়ার দরুণ হপ-ফ্রগকে পথ চলতে হত ঐভাবে। কিন্তু ঈশ্বর তাকে দিয়েছিলেন বলিষ্ঠ মাংসপেশী সমৃদ্ধ একজোড়া বাহু। ফলে, গাছে উঠতে বা দড়ি বেয়ে ঝুলতে জুড়ি ছিল না তার। বাচ্চা। বাঁদর আর চঞ্চল বেঁজির মত অদ্ভুত ক্ষিপ্রতায় খেলা দেখাতে পারত দড়ি বা গাছে। তখন আর তাকে ব্যাঙ বলে মনে হত না।
হপ-ফ্রগ কোন দেশে জন্মেছিল জানি না। নিশ্চয় রাজার এলাকা থেকে অনেক দূরে কোন অসভ্য অঞ্চলে। জোর করে ধরে আনা হয়েছিল তাকে তার জন্মস্থান থেকে। আনা হয়েছিল আরো একটি বামন মেয়েকে। মাথায় সে হপ-ফ্রগের চেয়ে সামান্য খাটো। দুজনকেই উপহার পাঠানো হয়। রাজাকে খোসামোদ করার জন্য।