রোষকষায়িত দৃষ্টিতে সে তাকাল চার নিগ্রোর দিকে। তারা শূন্য চোখে চেয়ে আছে মাটির দিকে, যেন নিবীর্য কতগুলো বলদ।
এটাই সেই জায়গা, বুলেটের মতো মাথাটা সামনের দিকে ঝাঁকিয়ে বলল লেফটেনেন্ট। তোমরা দুজনে ডানদিকে যাও, দুজনে বামে। তবে কোনো শব্দ করবে না। ঝামেলা দেখলে বেয়নেট চালাবে কিন্তু কোনো গুলি চলবে না।
খাপ খুলে তরবারি বের করল সে। রোদে ঝিকিয়ে উঠল ধারালো ফলা।
সৈন্যরা দুলকি চালে ছুটল খামারবাড়িটির দিকে। মাথা নিচু, হাতে আলগাভাবে ঝুলছে রাইফেল। এবড়োখেবড়ো মাটিতে হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছে তারা, যেন ডালকুত্তা কিছুর গন্ধ পেয়েছে।
মন্থর গতিতে আগ বাড়ল লেফটেনেন্ট। নিশব্দে হাঁটছে সে, যেন ডিমের খোলার ওপরে পা ফেলছে। একদা ঝকঝকে ইউনিফর্মের ভেতরে মেদবহুল শরীরটা কুঁকড়ে গেল পাছে হুশ করে কোনো বুলেট ছুটে আসে সেই ভয়ে। সে নারিকেল কুঞ্জ আর খামারের মাঝখানে জায়গা রেখে হাঁটছে। তবে নারিকেল গাছগুলো যখন আর তাকে আশ্রয় দিতে পারল না, সে ছুট দিল। কর্কশ জমিনে থপথপ করে দৌড়াচ্ছে, ভয়ানক উত্তাপ তাকে যেন রশির মতো পেঁচিয়ে ধরল।
চার সৈনিক ইতিমধ্যে খামার বাড়িতে পৌঁছে গেছে, একটা অসম বৃত্ত করে দাঁড়াল। অপেক্ষা করছে লেফটেনেন্টের জন্য। তাদের এখন প্রাণবন্ত লাগছে। কারণ জানে দুপুরের খর সূর্য থেকে রেহাই পেতে শীঘ্রি তারা ফিরে যাবে ব্যারাকে।
খামারবাড়িটি চৌকোণা, নারকেল পাতায় ছাওয়া ছাদ, সাদা চুনকাম করা দেয়াল। লেফটেনেন্ট সতর্কভাবে এগোচ্ছে, কুটিরের দরজা খুলে রোদে বেরিয়ে এল লম্বা, গরিবি পোশাক পরা এক কিউবান।
ঝট করে রাইফেল তুলল চার সৈনিক। চকচকে বেয়োনেট বাগিয়ে ভয় দেখাল। নট নড়নচড়ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল কিউবান। বুকে হাত বাঁধা। চেহারা ফ্যাকাশে।
লেফটেনেন্ট জিজ্ঞেস করল, লোপেজ?
চোখ পিটপিট করল কিউবান। সে শুধু তার সামনে বেয়োনেটের ইস্পাতের ফলাগুলোই দেখতে পাচ্ছে। তাকাল লেফটেনেন্টের দিকে।
জি, শুকনো, খসখসে গলায় জবাব দিল সে।
তরবারিটি এক পাক ঘোরাল লেফটেনেন্ট। তুমি বোধহয় আমার নাম শুনেছ। তার মুখে ফুটল নেকড়ের হাসি। আমি রিকার্ডো ডি ক্রেসপেডেস।
বালুতে পা ঘষল লোপেজ। চোখ কুঁচকে গেলেও চেহারা রইল কাষ্ঠবত। আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন বলে সম্মানিতবোধ করছি, সেনর।
লেফটেনেন্ট বলল, আমরা ভেতরে যাব। সে তরবারি বাগিয়ে ধরে লোপেজের পাশ কাটাল। ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে।
দুজন সৈন্যসহ লোপেজ তাকে অনুসরণ করল। বাকি দুজন দাঁড়িয়ে থাকল দরজার বাইরে।
কামরাটির বড়ই দৈন্য দশা। ঘিঞ্জি এবং নোংরা ঘরের মাঝখানে রাখা কাঠের টেবিলটির দিকে এগিয়ে গেল ডি ক্রেসপেডেস। ওখানে বসল। রিভলভার হোলস্টারের ফ্ল্যাপের বোতাম খুলে নিল যাতে প্রয়োজনে ঝট করে অস্ত্রটি বের করে নিতে পারে। একজন সৈন্যকে বলল, জায়গাটা সার্চ করো।
লোপেজ অস্বস্তি নিয়ে বলল, হুজুর, এখানে আর কেউ নেই–আমার স্ত্রী ছাড়া।
পাশের কামরায় ঢুকল নিগ্রো। ডি ক্রেসপেডেস বলল, দ্যাখো তো ওর কাছে কোনো বন্দুক ফন্দুক আছে কিনা।
অপর সৈনিক তার মস্ত হাত দিয়ে লোপেজের শরীর হাতড়ে দেখল। তারপর মাথা নেড়ে পিছিয়ে গেল। একটু ইতস্তত করে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তরবারিটি তুলল লেফটেনেন্ট। একটা দীর্ঘ, অস্বস্তিকর নিরবতা নেমে এল।
পাশের কামরা থেকে নিগ্রোটা বেরিয়ে এল এক কিউবান মহিলাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে।
মহিলার দিকে তাকাতেই ডি ক্রেসপেডেসের চোখ দুটো চকচক করে উঠল। মহিলা দৌড়ে নিয়ে লোপেজকে জড়িয়ে ধরল। ভয়ে সাদা মুখ। তার পরনে সাদা ব্লাউজ এবং স্কার্ট, খালি পা। ডি. ক্রেসপেডেসের মনে হলো এমন সুন্দরী নারী জীবনে দেখেনি। গোঁফ মুচড়ে নিয়ে সে হাসল। তার হাসি দেখে লোপেজ বউকে শক্ত করে বুকের সঙ্গে সেঁটে রাখল।
ডি ক্রোপেডেস বলল, তুমি এখানে অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছ। কোথায় সেগুলো?
ডানে বামে মাথা নাড়ল লোপেজ। আমার কাছে কোনো অস্ত্র নাই, হুজুর। আমি গরিব চাষা অস্ত্র নিয়ে আমার কোনো কাজ কারবার নাই।
মহিলার ওপর চোখ বুলাল ডি ক্রেসপেডেস। মেয়েটার বুক দুটো দারুণ। মেয়েটিকে দেখে সে একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল বলে নিজেরই ওপরেই বিরক্ত হলো। খানিক অধৈর্য গলায় বলল, কথাটা এখুনি স্বীকার করলে তোমার জন্যই ভালো হবে, হে।
মহিলা কাঁদতে শুরু করল। লোপেজ তার কাঁধে হাত রাখল। কেঁদো না, বলল সে। ইনি রিকার্ডো ডি ক্রেসপেডেস।
শিরদাঁড়া টানটান করে দাঁড়াল লেফটেনেন্ট। ও ঠিকই বলেছে। লাল টকটকে চোখ জোড়া ঘোরাল সে। মহিলা তার লালসাপূর্ণ চাউনি দেখেই বুঝে ফেলেছে লোকটার মতলব খারাপ।
মরিয়া সুরে লোপেজ বলল, হুজুর, আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে–
ধৈর্য হারিয়ে ফেলল ডি ক্রেসপেডেস। সে সৈন্যদের আদেশ দিল বাড়ি খুঁজে দেখতে কোথাও অস্ত্র লুকানো আছে কিনা। নিগ্রোরা অনুসন্ধান শুরু করলে সে সজোর টানে লোপেজের কাছ থেকে সরিয়ে আনল মহিলাকে। এদিকে এসো, বলল সে। আমি তোমাকে দেখতে চাই।
মুখ হাঁ করল লোপেজ কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরুল না। তার চোখ আধবোজা হয়ে এল। হাত মুষ্ঠিবদ্ধ। জানে কিছু করার ক্ষমতা তার নেই।
মহিলা ক্রেসপেডেসের পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুই হাতে বুক ঢেকে। ভয় ঢুকে গেছে রক্তে।