ওঁরা তিনজন চুপচাপ দেখলেন বাচ্চাটি নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে মিসেস ব্যাঙ্কসের দিকে। রুপার্ট ব্যাঙ্কস তার মায়ের সামনে এসে দাঁড়াল। হাসল। তবে কোনো সাড়া পেল না। আরও দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করল সে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেল। তাকে ঠিক যেভাবে করতে বলা হয়েছিল সেভাবেই করল। মিসেস ব্যাঙ্কসের চাউনি স্থির হয়ে আছে স্যার ম্যাথিউ এবং মি. ক্যাসনের মাঝখানে।
ক্যাসনের মুখের হাসিতে এবার প্রায় বিজয় উল্লাস ফুটে ওঠার জোগাড়।
ঘরে কেউ এসেছে নাকি? জিজ্ঞেস করলেন মিসেস ব্যাঙ্কস। দরজা খোলার শব্দ পেলাম যেন।
না, বললেন স্যার ম্যাথিউ। শুধু আমি আর মি. ক্যাসন ছাড়া আর কেউ নেই এ ঘরে। উইদারিংটন এখনও নিজের জায়গায় প্রস্তরবৎ বসে আছে।
আবার মিসেস ব্যাঙ্কসকে ঘিরে চক্কর দিতে লাগলেন স্যার ম্যাথিউ। জানেন এটাই শেষ সুযোগ। তিনি প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছেন ভদ্রমহিলাকে বোধহয় ভুল বিচারই করেছেন। মিসেস ব্যাঙ্কসের ঠিক পেছনে আবার এসে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকালেন জুনিয়রের উদ্দেশ্যে। সে ভদ্রমহিলার সামনেই বসে আছে।
উইদারিংটন তার ব্রেস্ট পকেট থেকে সিল্কের রুমালটি বের করল। ধীরে সুস্থে ভাঁজ খুলল। তারপর টেবিলে সমান করে বিছাল। মিসেস ব্যাঙ্কসের চেহারায় কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
উইদারিংটন ডান হাতের আঙুলগুলো প্রসারিত করল, মৃদু আঁকাল মাথা, তারপর বাম চোখের ওপর হাত রাখল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে চট করে কোটর থেকে চোখের মণিটি খুলে বের করে সিল্কের রুমালের ওপর রাখল। ঝাড়া ত্রিশ সেকেন্ড চোখের মণিটি পড়ে রইল রুমালের ওপর, তারপর সে ওটা মুছতে লাগল। বৃত্ত ঘেরা শেষ করলেন স্যার ম্যাথিউ, বসলেন চেয়ারে। দেখলেন ঘাম ফুটেছে মিসেস ব্যাঙ্কসের কপালে।
উইদারিংটন বাদাম আকারের কাঁচের জিনিসটি রুমাল দিয়ে মোছা শেষ করে মুখ তুলে সরাসরি তাকাল মিসেস ব্যাঙ্কসের দিকে। তারপর মণিটি তার শূন্য কোটরে ঠেসে ঢোকাল। মিসেস ব্যাঙ্কস ঝট করে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিলেন মুখ। নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেন দ্রুত, কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
চেয়ার ছাড়লেন স্যার ম্যাথিউ। হাসলেন তাঁর ক্লায়েন্টের দিকে তাকিয়ে। ক্লায়েন্টও ফিরিয়ে দিলেন হাসি।
মন থেকেই বলছি, মিসেস ব্যাঙ্কস, বললেন তিনি, মানুষ হত্যার জন্য গিল্টি প্লি করা হলে আমি সত্যি খুব আশ্বস্তবোধ করব।
(সত্যি ঘটনা অবলম্বনে)
আ টাফ টাসল – অ্যামব্রোস বিয়ার্স
১৮৬১ সালের শরতের এক রাত। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কেন্দ্রেস্থলের এক জঙ্গলে বসে আছে লোকটা। ওই সময় তো বটেই, এখনো ওই এলাকা চিট মাউন্টেন এলাকার সবচে দুর্গম অঞ্চল বলে পরিচিত। যেখানে লোকটা একা বসে আছে, তার কাছ থেকে মাইল দুয়েক দূরে ফেডারেল ব্রিগ্রেডের ক্যাম্প। লোকটা শত্রুর হামলার আশঙ্কা করছে। সে ফেডারেল ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের একজন তরুণ অফিসার, নাম ব্রেইনার্ড বাইরিং। পদবি তার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, এ মুহূর্তে সে তার ঘুমন্ত কমরেডদের পাহারার দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। বিচ্ছিন্ন একটা দলের প্রতিনিধিত্ব করছে সে আসলে।
তার রেজিমেন্টের লোকগুলোকে সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসার পরপরই একটা ইরেগুলার লাইনে ক্যাম্প করার ব্যবস্থা করেছে। রাস্তাটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঢুকে, পাহাড় আর ঘন ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে গিয়ে মিশেছে। লোকগুলো পনেরো বা বিশ গজ পর-পর অবস্থান নিয়েছে।
আগামী চার-ঘণ্টার ভেতরে যদি অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা না ঘটে তা হলে নতুন আরেকটি দল এসে এদের জায়গায় পাহারায় বসে যাবে। রিজার্ভ দলটি বর্তমানে এক ক্যাপ্টেনের অধীনে খানিক দূরে বিশ্রাম নিচ্ছে। তরুণ অফিসার তার দুজন সার্জেন্টকে বলে রেখেছে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লেই সাথে-সাথে যেন তাকে জানিয়ে রাখে।
যে জায়গায় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পাহারা দিচ্ছে, ওটা বেশ নির্জন। তবে বেইনার্ড বাইরিং-এর ভয়ডর কম। বয়সেও তরুণ হলেও যুদ্ধ করার প্রচুর অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। বহু শুঁকে সে নিজের হাতে নিধন করেছে, বুক কাঁপেনি একটুও। কিন্তু লাশকে তার সাংঘাতিক ভয়। কারণটা লেফটেন্যান্টের নিজেরও জানা নেই। লাশের দিকে তাকাতে পারে না সে। বমি আসে। হয়তো মৃত্যুকে ভয় করে বলেই লাশ দেখতে পারে না বাইরিং। তাকে রেজিমেন্টের অত্যন্ত সাহসী একজন সৈনিক বলে জানে সবাই, কিন্তু লাশের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা এবং আতঙ্কের কথা জানে না। কেউ।
নিজের লোকদের যথাযথ স্থানে বসিয়ে, সার্জেন্টদের দায়িত্ব ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়ে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ব্রেইনার্ড বাইরিং। আরাম পেতে কোমরে আটকানো তরবারির বেল্টটা ঢিলে করে দিল সে, হোলস্টার থেকে ভারী পিস্তলটা খুলে পাশে রাখল। এখন বেশ ভাল লাগছে। তবে কান খাড়া করে আছে বাইরিং। মাটিতে গাছের পাতা পতনের শব্দও তার কান এড়িয়ে যাচ্ছে না।
চাঁদের আলোয় আশপাশের সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। তবে এত বেশি নির্জন পরিবেশ যেন কেমন কেমন লাগে। মাঝে-মাঝে অবশ্য একটা দুটো পাখি রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে ডেকে উঠছে। প্রতিধ্বনিটা মিলিয়ে যাবার পরে আবার সব চুপ। নিজেকে বিশাল প্রকৃতির মাঝে বড় একা লাগল বাইরিং-এর। সে আনমনা হয়ে কীসব ভাবছিল, হঠাৎ জঙ্গলের ধারে, রাস্তায় জিনিসটার দিকে চোখ পড়তে সতর্ক হয়ে উঠল। বাইরিং শপথ করে বলতে পারে একটু আগেও ওটা ওখানে ছিল না। গাছের ছায়ায় জিনিসটার অর্ধেক অংশ ঢাকা পড়েছে, তবে যেটুকু চাঁদের আলোয় দেখা গেল, বোঝা গেল ওটা আসলে একটা মানুষ। চট করে তরবারির বেল্টে একটা হাত চলে গেল বাইরিং-এর, বাকি হাতটা দিয়ে চেপে ধরল পিস্তল শত্রওর হামলার জন্যে প্রস্তুত।