জুলি তার পুতুলটি বুকে চেপে ধরে অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ল। সে এবার হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। পুতুলটি তার বাবা তাকে ফুকেট থেকে কিনে দিয়েছে। তাকে দেখে কয়েক গজ দূরে বসা এক লোক ডাক দিল।
এই যে খুকী, খুব সুন্দর পুতুল তো!
দাঁড়িয়ে পড়ল জুলি, চোখ কুঁচকে তাকাল লোকটার দিকে। লোকটার পায়ে কাউবয় বুট, ভেঁড়া, মলিন জিনস, গায়ে ডেনিম শার্ট, গলায় জপমালা। তার চেয়ারের পাশে একটি ছোট হ্যাঁভারস্যাক। চুলগুলো ফ্যাকাশে, গোসল করেনি বোধহয়, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি।
আট বছরের জুলির জানার কথা নয় এ একজন হিপ্পি। দূরপ্রাচ্য হিল্পিদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় জায়গা। এর কারণ এখানকার জীবনযাত্রা সহজ এবং সস্তা, তাছাড়া এসব দেশে মাদকও মেলে সহজে।
ও আমার নতুন পুতুল, বলল জুলি। ওর নাম পুকি।
বেশ নাম। কিন্তু ওকে পুকি বলো কেন? জিজ্ঞেস করল হিপ্পি।
কারণ ড্যাডি ওকে পুন্ড কেট থেকে কিনে দিয়েছে। আমি চিনি জায়গাটা। চমৎকার সাগর সৈকত আছে। তোমরা ওখান থেকে ছুটি কাটিয়ে এলে বুঝি?
হুম। আমি ড্যাডির সঙ্গে সাঁতার কেটেছি। কত মাছ দেখলাম!
মিসেস হিগিন্স বুড়ো আঙুলের খোঁচা দিল তার স্বামীর পায়ে, ইঙ্গিতে দেখাল তাদের মেয়েকে।
জুলি, এখানে এসো, ডার্লিং, মিসেস হিগিন্স ডাকল তার মেয়েকে। মায়ের এ গলার স্বরটি চেনে জুলি। রাগ করলে বা অসন্তুষ্ট হলে মা এভাবে ডাকে। সে লাফাতে লাফাতে চলে গেল তাদের কাছে। হিগিন্স কটমটে চোখে তাকাল হিপ্পির দিকে। হিপ্লিদের সে মোটেই পছন্দ করে না। এরা বদ, নোংরা এবং মাদকসেবী। এরকম একটা লোকের সঙ্গে তার মেয়েকে কথা বলতে দেয়ার প্রশ্নই নেই। হিপ্পি অগ্নিদৃষ্টির মাজেজা বুঝতে পারল। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট বের করল। তবে মাথার ওপর ধূমপান নিষেধ-এর সাইনবোর্ডে চোখ পড়তে পা বাড়াল স্মোকিং এরিয়ায়। নাক সিটকাল মিসেস হিগিন্স। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা করা হলো এখনওই বোর্ডিং শুরু হবে, চেক করা হবে ৩৪ থেকে ৫৭ সারির বোর্ডিং পাস। মি. হিগিন্স তার বোর্ডিং পাস বের করল। ৩৪ নং সারি, সিট D,E এবং F। পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে সে চূড়ান্ত লাইনটিতে গিয়ে দাঁড়াল।
.
প্লেন ছাড়ার সময় রাত ১১.৪৫। ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটের যাত্রা। ক্যাপ্টেন ফ্যালনের বিমান কাল সকাল ৬টা ২০ মিনিটে লণ্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌঁছানোর কথা। তখন ওখানকার তাপমাত্রা থাকবে শূন্যের কাছাকাছি, আর ব্যাংককে এ মুহূর্তের তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, হিউমিডিটি ৯০ ডিগ্রির ওপরে।
কেবিন ডোরে নক হলো। CSD ভেতরে ঢুকলেন প্যাসেঞ্জার ম্যানিফেস্ট বা যাত্রী তালিকা নিয়ে।
চারশ পাঁচ জন, স্কিপার, বললেন তিনি।
তালিকায় সই করে ওটা CSD পালফ্রেকে ফিরিয়ে দিলেন ফ্যালন। ইনি এটা তুলে দেবেন BAর গ্রাউণ্ড স্টাফকে। বিশাল ফ্লাই মেশিনটির লোকজন তাদের সার্ভিলেন্সের কাজ শেষ করছে। ব্যাগেজ হোন্ড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, হোস পাইপগুলো ডিসকানেক্টড, গাড়িগুলো সম্মানজনক দূরত্বে সরে গেছে। দানবটি তার চারটি প্রকাণ্ড রোলসরয়েস ইঞ্জিন চালু করে দৌড় দেয়ার জন্য প্রস্তুত।
প্রথম শ্রেণীর কেবিনে মি. সিমুর তাঁর সিল্ক জ্যাকেটটি খুলে সামনের ওয়ার্ডরোবে রেখেছেন। ঢিলে করে দিয়েছেন টাই। তাঁর কনুইয়ের কাছে বুদ্বুদ তোলা শ্যাম্পেনের গ্লাস, CSD তাঁকে তাজা ফিনান্সিয়াল টাইমস এবং ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা দিয়ে গেছেন।
৩৪ নং সারিতে হিগিন্স পরিবার জাঁকিয়ে বসেছে। তারা ভাগ্যবান। কারণ G নম্বর আসনটি খালি। ফলে চার আসনের এই সারিটি তারা একান্ত ই নিজের করে পাচ্ছে। জন হিগিন্স D নম্বর সিটে বসল। এটি আইলের এক পাশে, তার স্ত্রী দখল করল G নম্বর আসন, আইলের অপর পাশে। তাদের মাঝখানে বসল জুলি। কোলে তার পুকি।
স্পিডবার্ড ওয়ান জিরো স্টার্ট নিয়েছে। ট্যাক্সিং করে যাচ্ছে টেক অফ পয়েন্টের দিকে। ক্যাপ্টেন ফ্যালন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন টাওয়ার কন্ট্রোলের সঙ্গে। মেইন রানওয়ের দূর প্রান্তে পৌঁছে তিনি টেক অফের অনুমতি চাইতেই পেয়ে গেলেন।
রানওয়েতে ঘুরল জাম্বো, নাকটা খাড়া হয়ে আছে সেটার লাইন বরাবর এবং টারমাক থেকে উঁচুতে। ক্যাপ্টেন লিভার ঠেলে দিলেন সামনের দিকে, আঙুল বাঁকা করলেন Toga (Take off/ Go Around) সুইচে চাপ দিতে। চারটে ইঞ্জিনের পাওয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে গেছে প্লি সেট ফিগারে।
জাম্বোর গতি দ্রুততর হলে যাত্রীরা গুড়গুড় শব্দ শুনতে পেল। দশ সেকেণ্ড পরে বোয়িংটি ডানা মেলল আকাশে।
প্লেন মাটি ছাড়তেই ফ্যালনের নির্দেশে তার কো-পাইলট সুইচ টিপে গোটা আণ্ডারক্যারেজ তুলে নিল। ঘটাংঘট কয়েকবার শব্দ হলো, তারপর সমস্ত আওয়াজ এবং ভাইব্রেশন বন্ধ হয়ে গেল। বিমানটি প্রতি মিনিটে ১৩০০ ফুট ওপরে উঠছে, তারপর ১৫০০ ফুট, শেষে আরও সহজ হয়ে এল তার শূন্যে উড্ডয়ন।
প্লেন আকাশে ওঠার পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জন হিগিন্স। সে প্লেনে চড়তে ভয় পায়, বিশেষ করে টেক অফের সময় তার বুক শুকিয়ে যায় ডরে। এতক্ষণ সে সিটের আর্মরেস্ট চেপে ধরে রেখেছিল। এইমাত্র ছেড়ে দিয়েছে। তবে ভয় পেলেও সে তার পরিবারকে ভয়ার্ত চেহারা দেখাতে চায় না।