ইউনিফর্ম পরা থাই ইমিগ্রেশন অফিসার বার্গাণ্ডি রঙের পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং পাসে চোখ বুলিয়ে অবশেষে তাকাল গ্লাস স্ক্রিনের ওপাশে দাঁড়ানো লোকটির দিকে।
দ্রলোক মধ্যবয়সী, হালকা রোদে পোড়া চামড়া, সদ্য কামানো মুখ, লৌহ ধূসর চুল, পরনে নরম, ঘামশূন্য সাদা সিল্ক শার্ট, জিম থম্পসনের দোকান থেকে কেনা সিল্ক টাই এবং ক্রিম সিল্ক সুট যেটি ব্যাংককের সেরা এক দর্জি বানিয়েছে, যারা ত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে সেভিল রোর নকল তৈরি করে দিতে পারে। সে আইডেন্টিটি ডকুমেন্ট ঠেলে দিল কাঁচের পর্দার নিচে।
Sawat-di, krab, বিড়বিড় করে বললেন ইংলিশম্যান। থাই অফিসার ভদ্রতা দেখিয়ে হাসল। থাই ভাষায় খুব কম মানুষই ধন্যবাদ জানাতে পারে, বিশেষ করে বিদেশীদের জন্য এটি প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।
ওদিকে সিডনি থেকে ব্যাংকক আসা প্লেনটি থেকে যাত্রীরা নামতে শুরু করেছে। লম্বা করিডর ধরে তারা ইমিগ্রেশনে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন খালি হয়ে গেল। এখন ওতে ক্লিনিং স্টাফরা উঠবে আবর্জনা পরিষ্কার করতে। অন্তত চোদ্দটি বিনলাইনার ভরে যাবে আবর্জনায়।
এদিকে মি. সিমুর তাঁর কুমিরের চামড়ার অ্যাটাচি কেস নিয়ে ফাস্ট ক্লাস লাউঞ্জে পা বাড়ালেন। তাঁকে বসার জায়গা দেখিয়ে দিয়ে এক গ্লাস হোয়াইট ওয়াইন নিয়ে এল। তিনি ফোর্বস ম্যাগাজিনের মধ্যে ডুবে গেলেন। শীতল, বিলাসবহুল, সুপরিসর এ লাউঞ্জে আরও জনাকুড়ি যাত্রী রয়েছে।
তিনি যখন পত্রিকা পড়ছেন ওই সময় বোয়িং ৭৪৭-৪০০র ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীরা চেক ইন হলে ভিড় জমিয়েছে। এ বিমানটিতে চোদ্দটি প্রথম শ্রেণীর আসন রয়েছে, তেইশটি আছে ক্লাব ক্লাস সিট। এগুলো সবই ভরে যাবে। এর পরের আসনগুলো হলো ইকোনমি ক্লাস বা ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার ক্লাস। এর যাত্রী সংখ্যা সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০০। চেক ইন হল এর দশটি ডেস্ক এতগুলো যাত্রীকে সামাল দিতে গলদঘর্ম হয়ে গেল। এই যাত্রীদের মধ্যে হিগিন্স পরিবারও আছে। এই যাত্রীরা সবাই নিজেদের লাগেজ বহন করছে। তারা এসেছে কোচে চড়ে। গরমে এবং ঘামে এদের বেসামাল দশা। ডিপারচার লাউঞ্জে পৌঁছাতে হিগিন্স পরিবারের এক ঘণ্টা সময় লেগে গেল।
.
ক্যাপ্টেন এবং তাঁর ক্রুরা অফিসে পনেরো মিনিট সময় কাটালেন প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে চোখ বুলানোর জন্য। এখানে ফ্লাইট প্ল্যান রয়েছে যাতে বলা হয়েছে ফ্লাইটে কতটা সময় লাগবে, মিনিমাম কতটুকু জ্বালানি নিতে হবে এবং বেশ কয়েকটি কাগজে রুট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে যা আজ রাতে অনুসরণ করবেন ক্যাপ্টেন। এ তথ্যগুলো যুগিয়েছে ব্যাংকক এবং লণ্ডনের বিভিন্ন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টার। UK রুটের আবহাওয়া বার্তা বলছে আজ রাতের আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকবে।
কাগজপত্রে সইটই করে চার পাইলট প্লেনে ওঠার জন্য প্রস্তুত হলেন। সিডনি থেকে আসা যাত্রীরা অনেক আগেই চলে গেছে। ক্লিনাররা এখনও প্লেনে আছে তবে সেটা CSD র বিষয় এবং মি. হ্যারি পালফ্রে দক্ষতার সঙ্গে যথারীতি ওসব ঝামেলা চোকাবেন।
থাই ক্লিনাররাই CSD র কেবল চিন্তার বিষয় নয়। তাঁকে অন্যান্য সমস্ত দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। ল্যাভেটরি ঠিকঠাক পরিষ্কার হলো কিনা দেখতে হবে। ৪০০ যাত্রীর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য এবং পানীয় নিয়ে আসা হচ্ছে। এমনকী তিনি লণ্ডনের লেটেস্ট খবরের কাগজের ব্যবস্থাও করেছেন। এগুলো মাত্রই হিথ্রো থেকে আরেকটি জেট বিমান করে এল। মি. পালফ্রে যখন এসব তদারকি করছেন ওইসময় ক্যাপ্টেন এবং তাঁর ক্রুরা প্লেনে উঠে বসলেন।
ক্যাপ্টেন ফ্যালন সিঁড়ি বেয়ে তার এলাকায় চলে এলেন। এন্ট্রি লেভেল থেকে আপার কেবিন এবং সেখান থেকে হেঁটে ফ্লাইট ডেক ডোরে। তাঁর দুই ক্যাপ্টেন এবং একজন ফাস্ট অফিসার যে যার জ্যাকেট খুলে ফেলে রেস্টরুমের দরজার পেছনে ওগুলো ঝুলিয়ে রেখে নিজেদের আসনে বসল।
সামারের সময় ক্যাপ্টেন ফ্যালনকে সাধারণত দুজন ফার্স্ট অফিসার সঙ্গ দেয়। তবে এটা জানুয়ারি শেষ এবং টানা তের ঘণ্টার এ জার্নিতে তাঁর সঙ্গে একজন ফাস্ট অফিসার আছে। অপরজন ছুটিতে।
ক্যাপ্টেন ফ্যালনের বামে বসল একজন পাইলট, ডানে সিনিয়র ফার্স্ট অফিসার। ফ্লাইট ডেকের পেছনে, বাম দিকে, দুইট বাঙ্কসহ ছোট একটি কামরা আছে। ক্যাপ্টেন অটোমেটিক পাইলটে প্লেন চালাতে দিয়ে, তার অপর দুই পাইলটের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে নিশ্চিন্ত মনে চার পাঁচ ঘণ্টা ওখানে নিদ্রা যেতে পারেন। তিনি দুই পাইলটকে কন্ট্রোলে রেখে বাঙ্করুমে ঢুকলেন কাগজে স্টক মার্কেটের খবরে চোখ বুলাতে।
গোটা এয়ারক্রাফ্ট এখন পরিচালিত হচ্ছে Auxiliary Power Unit বা APU দ্বারা। এটি আসলে পঞ্চম জেট ইঞ্জিন যার সম্পর্কে খুব কম যাত্রীই জানে। এই দানব এয়ারক্রাফট যে APU দ্বারা চলছে তার পাওয়ারের সাহায্যে একটি ছোটখাট ফাইটার একাই চলতে সঙ্গম। এই পাওয়ার বিমানটির বাইরের সবকিছু স্বাধীনভাবে কাজ চালানোর সামর্থ দিচ্ছে– আলো, বাতাস, ইঞ্জিন স্টার্টসহ আরও অনেক কিছু।
ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার ডিপারচার লাউঞ্জে মি., মিসেস হিগিন্স এবং তাদের মেয়ে জুলি ইতিমধ্যে ক্লান্ত এবং মেয়েটির মেজাজ খিটখিটে হতে শুরু করেছে। তারা চার ঘন্টা আগে তাদের দুই তারকা হোটেলটি ছেড়ে এসেছে। এখানে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছে। কোচে লাগেজ তোলো, কোনোকিছু ফেলে গেলে কিনা তা পরীক্ষা করো, লাইনে দাঁড়াও, ছোট একটি সিটে বসো, ট্রাফিক জ্যাম, দেরি হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা, আবার যানজট, কোচ থেকে এয়ারপোর্টে নামমা, লাগেজ খুঁজে বের করো, তারপর ট্রলির সন্ধান, বাচ্চাটা আবার কোথাও ছুটে গেল কিনা সেদিকেও লক্ষ রাখো, চেক ইনের এক মাইল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকো, কিউতে দাঁড়াও, অপেক্ষা করো, তারপর সিকিউরিটি এক্স-রে মেশিন, বডি সার্চ কারণ বেল্ট বাকলের কারণে বেজে উঠেছে অ্যালার্ম, জুলির চিৎকার কারণ তার পুতুলটা পাঠানো হয়েছে এক্স-রের জন্য, ডিউটি ফ্রি শপে কিছু হাবিজাবি কেনাকাটা, আবার কিউ এবং অপেক্ষা … অবশেষে বোর্ডিংয়ের আগে লাস্ট স্টপে শক্ত প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে থাকো।