খোঁড়াতে-খোঁড়াতে সে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে। হাঁটা দিল ডেপুটি কমিশনারের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওই দিন দুপুরবেলা আমাকে বাজার সওদা করতে যেতে হলো সদর রাস্তায়। দেখলাম রাস্তায় দাঁড়িয়ে, কাঁপতে কাঁপতে ভিক্ষা চাইছে কার্নেহান। কিন্তু কেউ ওকে ভিক্ষা দিচ্ছে না। দেখে আমার খুব মায়া হলো। ওকে জোর করে গাড়িতে তুলে কাছের একটা মিশনারীতে নিয়ে গেলাম। গাড়িতে যাবার পথে কার্নেহান করুণ গলায় গান গাইতে থাকল, আমাকে চিনতে পারল না।
দিন দুই পরে কার্নেহানের খবর নিতে মিশনারীতে গেলাম। সুপারিনটেনডেন্ট বললেন, ওর ভয়ানক সানস্ট্রোক হয়েছিল। গত কাল সকালেই মারা গেছে লোকটা। আচ্ছা, লোকটা নাকি দুপুরবেলা প্রখর রোদে রাস্তায় দাঁড়িয়ে গান গাইছিল?
হ্যাঁ, বললাম আমি। আচ্ছা, মারা যাবার সময় ওর সঙ্গে কোনো জিনিস ছিল?
আমার জানামতে ছিল না, জবাব দিলেন সুপারিনটেনডেন্ট।
দ্য সিটিজেন – ফ্রেডরিক ফোরসাইথ
বাড়ি পালানো ছিল তার সবসময়ই প্রিয় বিষয়। ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্রকাণ্ড অ্যালুমিনিয়াম টিউবগুলো চালিয়ে আসছেন। দেখেছেন সত্তরটিরও বেশি বড় বড় শহর, এর বেশিরভাগই রাজধানী।
ত্রিশ বছর আগে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল চোখের, ঝাঁকড়াচুলো, দুই আস্তি নে সাঁটানো নতুন, ঝকঝকে জুনিয়র ফাস্ট অফিসারের দুটি রিংয়ের এক তরুণ, যিনি দূর দেশে যেতে খুব পছন্দ করতেন। স্টপ-ওভারগুলোতে তিনি উপভোগ করেছেন ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈশ জীবন, গিয়েছেন দূর প্রাচ্যের মন্দিরে। এখন তিনি ডকিংয়ে, নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য মুখিয়ে থাকেন।
ওই দিনগুলোতে সুন্দরীতমা স্টুয়ার্ডেসদের সঙ্গে তাঁর উষ্ণ সম্পর্ক ছিল তবে সুসান তাকে বিয়ে করার পরে তিনি ওইসব ত্যাগ করেন। পাঁচ হাজার রাত হোটেলের বিছানায় কাটানোর পরে তাঁর একমাত্র আকুলতা ছিল বাড়ি ফিরে সুসানের গায়ের ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ নেয়া।
তিনি এখন এক কন্যা এবং এক পুত্রের জনক। ছেলে চার্লসের বয়স তেইশ, পেশায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার, মেয়ে জেনিফার, আঠারো, হিস্টোরি অব আর্ট নিয়ে পড়াশোনার জন্য ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ঢুকছে। এরা তাকে সুস্থিত একটি অবস্থা এবং বাড়ি ফেরার আরেকটি কারণ দিয়েছে। আর দুবছর পরে তিনি অবসরে যাবেন। ইনি ক্যাপ্টেন আড্রিয়ান ফ্যানন। এ মুহূর্তে একটি ক্রু বাসে রয়েছেন। আর কিছুক্ষণ পরে তিনি একটি বোয়িং ৭৪৭-৪০০ জাম্বো বিমানে ব্যাংকক বিমান বন্দর থেকে ৪০০ যাত্রী নিয়ে উড়াল দেবেন লণ্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টের উদ্দেশে।
ক্রুবাসটি এ মুহূর্তে ব্যাংকক বিমান বন্দরে যাচ্ছে। বাসে তিনি, দুজন ফার্স্ট অফিসার ছাড়া আরও আছেন কেবিন সার্ভিস ডিরেক্টর বা CSD, পনেরজন স্টুয়ার্ড, এদের চারজন পুরুষ, বাকি এগারজন নারী। দিন দুই আগে তিনি এদেরকে নিয়ে হিথ্রো থেকে উড়ে এসেছেন, জানেন CSD মি.হ্যারি পালফ্রে ফ্লাইট ডেকের দরজা থেকে শুরু করে প্লেনের লেজ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক সামাল দেবেন। কারণ পালফ্রে অতিশয় অভিজ্ঞ একজন বিমান কর্মী।
বাইরে ব্যাংককের আবহাওয়া আর্দ্র এবং গরম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্রু বাসটির ভেতরে তাই আরাম লাগছিল যাত্রীদের। টেক অফের দুই ঘণ্টা আগেই ক্রু বাস ঢুকে পড়ছে এয়ারপোর্ট পেরিমিটারে। বাসটি এগোল BA (ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ) অফিস অভিমুখে। BA অফিস জানিয়েছে সিডনি থেকে যাত্রা করা স্পিডবার্ড ওয়ান জিরো ব্যাংককের স্থানীয় সময় রাত ৯৯ ৪৮-এ এয়ারপোর্টে অবতরণ করবে। আসলে এটি প্রায় চলেই এসেছে বলা যায়।
ক্রু বাসের এক মাইল পেছনে একটি কালো লিমুজিন। এর একমাত্র যাত্রী উর্দিপরা ড্রাইভারের পেছনে বসে আছেন। তাঁরা আসছেন অভিজাত ওরিয়েন্টাল হোটেল থেকে। ওখানে সিনিয়র এক্সিকিউটিভটি তিনদিন ধরে অবস্থান করছিলেন। গাড়ির বুটে রাখা আছে তার সুটকেস, খাঁটি চামড়ার তৈরি সলিড পিতলের লক, দেখেই বোঝা যায় এর মালিক খুব বেশি ভ্রমণ করেন না বটে তবে সফরকালে সস্তা জিনিসও ব্যবহার করেন না। তার পাশে, সিটের ওপর পড়ে আছে কুমিরের চামড়ার অ্যাটাচি কেস।
তাঁর চমৎকার ছাঁটাইয়ের ক্রিম সিল্ক সুটের ব্রেস্ট পকেটে শুয়ে আছে একটি ব্রিটিশ পাসপোর্ট যাতে নাম লেখা হিউগো সিমুর এবং রয়েছে ব্যাংকক থেকে লণ্ডন যাত্রার রিটার্ন হাফ টিকেট। অবশ্যই ফার্স্ট ক্লাস। স্পিড়বার্ড ওয়ান জিরো যখন রানওয়ে থেকে ট্যাক্সি রোল করে BA ডিপারচার লাউঞ্জের দিকে যাচ্ছে, ওইসময় লিমোজিনটি মৃদু গরগর শব্দে চেক-ইন হলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মি. সিমুর তাঁর লাগেজ ট্রলিতে তুললেন না। ম্যানিকিওর করা একটি হাত তুলতেই এক থাই পোর্টার ছুটে এল। ড্রাইভারকে বকশিস দিয়ে ব্যবসায়ীটি ভোলা বুটে রাখা তাঁর সুটকেসটির দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা ঝাঁকালেন, তারপর পোর্টারের পেছন পেছন চেক ইন হলে ঢুকলেন। এগোলেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফার্স্ট ক্লাস ডেস্কে। গাড়ি থেকে নেমে ট্রপিকাল হিটের মধ্যে মাত্র ত্রিশ সেকেণ্ড সময় তাঁকে থাকতে হলো।
ফার্স্ট ক্লাস চেক ইনে এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগে না। ডেস্কের পেছনে তরুণ ক্লার্কটি অন্য কারও জন্য ব্যস্তও ছিল না। দশ মিনিটের মধ্যে সুটকেসটি ব্যাগেজ-হ্যাণ্ডলিং এরিয়ায় রওনা হয়ে গেল যেখানে ওটার ট্যাগ দেখিয়ে দেবে যে ওটা BA লণ্ডন ফ্লাইটে যাচ্ছে। মি. সিমুরকে বোর্ডিং কার্ড দেয়া হয়েছে এবং পাসপোর্ট কন্ট্রোলের পেছনে ফাস্ট ক্লাস লাউঞ্জটি তাঁকে দেখিয়ে দেয়া হলো।