নাহ। আমি আপনাকে বলেছি, কোথাও রহস্য দেখলেই তা ফাঁস করা আমার হবি।
তা করুন। কিন্তু আপনার হাতে ধরে বলছি, আমার গৃহদেবতাকে উদ্ধার করে দিন।
চেষ্টা করব। তবে আপনার সহযোগিতা চাই।
পাবেন। সব রকমের সহযোগিতা পাবেন।
ট্রে ভর্তি স্ন্যাক্স, সন্দেশ এবং চায়ের কাপ-প্লেট এনে রাখল কালকের সেই পরিচারক। কর্নেল বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। তবে শুধু চা খাব।
আপনার ইচ্ছে। বলে শচীনবাবু ছড়িয়ে রাখা বাঁ পা সোজা করলেন এবং এবার ডান পা ছড়িয়ে দিলেন। মুখে কষ্টের ছাপ।
কর্নেল চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বরমডিহির সন্ধ্যানীড়ের চাবি কার কাছে আছে?
বরমডিহির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে তাকে মামলার মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খবর পাই, তিনি কিছুই দেখেন না। সরকারি ব্যাপার যা হয় আর কী। বাড়িটার নাকি পড়ো-পড়ো দশা। শুনে কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব?
বাড়ির নিচের তলায় কখানা ঘর?
১০ খানা।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, দোতলায়?
দোতলাতেও ১০ খানা।
কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। বললাম, পিওর ম্যাথ। বিশুদ্ধ গণিত মনে হচ্ছে।
শচীনবাবু বললেন, গণিত? গণিত মানে?
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত ভাল অঙ্ক কষতে পারে তো! তাই ও বলতে চায়–
শচীনবাবু তার কথার ওপর বললেন, বাবা ছিলেন সে-আমলের নামকরা আর্কিটেক্ট। বরমডিহিতে যত কোর্ট কাছারি বা পুরনো সরকারি বাড়ি আছে, সব ওঁর নকশায় তৈরি। জয়ন্তবাবু ঠিক ধরেছেন। অঙ্ক কষে বাবা বাড়ির নকশা তৈরি করতেন। লক্ষ্য করে থাকবেন, বাড়িটা ইংরেজি এল প্যার্টেনের। ওপরে নিচে এল প্যাটার্ন বারান্দা। বাবা যে আমার জন্যই বাড়িটা করেছিলেন, তার প্রমাণ, তাঁর জীবদ্দশায় দেউড়িতে আমার নেমপ্লেট লাগানো হয়েছিল। এখনও তা অক্ষত আছে। তখন তরুণ কোথায়?
ভোলা নামে একজন লোককে সন্ধ্যানীড়ের কেয়ারটেকার রেখেছিলেন। তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি যে ভূতপ্রেত দেখেছিলেন–
সে ভোলা নয়। আপনি তা আমাকে বলেছিলেন। কর্নেল চায়ের কাপ। নামিয়ে রেখে বললেন, ভোলা কত বছর আগে মারা গেছে?
বছর দুই হয়ে এল প্রায়। সুপ্রিম কোর্টে গেল তরুণ, সেই বছর।
হাইকোর্টে আপনি মামলা জিতেছিলেন?
হ্যাঁ। তরুণ লোয়ার কোর্টে হেরে হাইকোর্ট করেছিল। হাইকোর্টে হেরে। এখন সুপ্রিম কোর্টে। পাজির পা ঝাড়া! বংশের কলঙ্ক!
তা হলে মামলা তরুণবাবুই করেছিলেন প্রথমে?
তাকে সন্ধ্যানীডে ঢুকতে চাবি দিইনি। এতেই বাবুর মেজাজ খাপ্পা। তো আমি হলাম নিজেই আইনজ্ঞ। আমাকে আইন দেখাচ্ছে!
আজ চলি মিঃ মুখার্জি। দরকার মতো যোগাযোগ করব। আপনিও করবেন। কর্নেলের একটা হাত দুহাতে চেপে ধরে শচীনবাবু বললেন, আমিই পাপ রেছিলাম কর্নেলসায়েব! এ তারই শাস্তি। আপনি আমার গৃহদেবতাকে উদ্ধার করে দিন।
বললাম তো! চেষ্টা করব।…
বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে কর্নেল বললেন, এবার আলিপুর কোর্টে যাব। ছেলেটিকে পুরস্কৃত করতে হবে।
আমার বৃদ্ধ বন্ধুর খেয়ালের ব্যাপারটা আমার জানা। তাই বাধা দিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। কোর্টের দিকে ছুটে চলল।
ট্যাক্সি থেকে নেমে কর্নেল ট্যাক্সি চালককে বললেন, একমিনিট ভাই। এক্ষুনি আসছি। জয়ন্ত, তুমি বসে থাকো।
ট্যাক্সি থেকে ড্রেনের ওপারে গাছতলায় হরিবাবুর ডেরা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু হরিবাবু নেই। হয়তো খেতে গেছেন ভাবছিলাম। পরক্ষণে দেখলাম টেবিলে টাইপরাইটার নেই এবং চেয়ারে সেই চৌকস ছোকরা বসে আছে।
কর্নেল তার কাছে গেলে সে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিলো। তারপর কর্নেলের সঙ্গে তার কথাবার্তা চলতে থাকল। এতদূর থেকে শোনা যাচ্ছিল না। একটু পরে কর্নেলকে দেখলাম, তার হাতে একটা দশটাকার নোট গুঁজে দিচ্ছেন। ছোকরা রীতিমতো মিলিটারি কায়দায় সেলাম ঠুকল। কর্নেল ফিরে এলেন।
ট্যাক্সিতে বসে কর্নেল বললেন, পার্ক স্ট্রিট হয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট দিয়ে ইলিয়ট রোড।
ট্যাক্সি ঘুরল। জিজ্ঞেস করলাম, হরিবাবু আজ আসেননি নাকি?
নাহ্। অসুখবিসুখ হয়েছে হয়তো!
ছোকরাটির সঙ্গে—
ও জয়ন্ত! হি ইজ আ জিনিয়াস চ্যাপ।
হাসতে হাসতে বললাম, কী কথা হল জিনিয়াসের সঙ্গে?
নামঠিকানা জেনে নিলাম। ওকে একটা স্থায়ী কাজ জুটিয়ে দেওয়ার আশ্বাসও দিলাম।
এবং দশটা টাকা পুরস্কার দিলেন।
ওটা ওর পক্ষে নগণ্য। ওকে দশ-বিশ হাজার টাকা দেওয়া উচিত ছিল। আমার তো অত দেওয়ার মতো অবস্থা নয়। পেনসন আর বিদেশি কাগজে প্রজাপতি নিয়ে প্রবন্ধ লিখে রোজগার।
ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আজও তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন।
সর্বনাশ! আমাকে অফিস যেতে হবে না? এই সপ্তাহে বিকেলে ডিউটি। কাল কামাই করেছি।
তোমার চিফ অব দা নিউজ ব্যুরোকে টেলিফোনে জানিয়ে দাও একটা রোমহর্ষক স্টোরির পেছনে দৌডুচ্ছ। বলল, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য এক্সকুসিভ স্টোরি। রাতারাতি প্রচার-সংখ্যা এক লক্ষ বেড়ে যাবে।
চুপ করে গেলাম। এই খামখেয়ালি রহস্যভেদীর পাল্লায় পড়েছি। রহস্য ফদাই না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া পাব না। তবে এ-ও সত্যি, বরমডিহির পোড় বাড়ির ভুতুড়ে হত্যাকাণ্ড আমাকেও ধাঁধায় ফেলেছিল। ধাঁধার জট না খুললে ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করতে হবে। এটাই সমস্যা। ভূতের ভয় যতই পাই, ভূতে বিশ্বাস করাটা কেমন বিচ্ছিরি লাগে যেন। তাছাড়া আমার মতে, গল্পের ভূতে মজা আছে। সত্যিকারের ভূতে মজা কোথায়?…