- বইয়ের নামঃ ভুতুড়ে লাশ
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- বিভাগসমূহঃ কর্নেল সমগ্র
০১. কালোদৈত্য এবং পোডড়াবাড়ির ভূত
মুন লেক দেখে ফেরার পথে সাংঘাতিক ঝড়ের মুখে পড়েছিলাম। বরমডিহি ডাকবাংলোর চৌকিদার পই পই করে বলেছিল, সূর্যাস্তের আগেই যেন ফিরে আসি। কারণ বছরের এই সময়টা এ মুলুকে অচানক কালা দেওপাহাড়ের ওপর থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পাল্লায় পড়লে নাকি বাঁচার আশা থাকে না। মানুষ তো তুচ্ছ, বাঘের মতো বিরাট জানোয়ারকেও নাকি সেই কালা দেও অর্থাৎ কিনা কালো দৈত্য দুহাতে তুলে এমন আছাড় মারে যে তার হাড়গোড় মাংস দলা পাকিয়ে যায়।
চৌকিদার আরও বলেছিল, চাপা গুডগুড শব্দ শুনলেই যেন আমরা মাটিতে শুয়ে পড়ি। ওই শব্দটা কালো দৈত্যের আসবার সংকেত।
শব্দটা আমি শুনেছিলাম। কিন্তু আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তখন একটা প্রজাপতিকে তাড়া করেছেন। তার হাতে প্রজাপতি ধরা জাল। ওঁকে শব্দটার কথা বলেছিলামও। কিন্তু উনি গ্রাহ্য করেননি।
প্রজাপতিটা জঙ্গলের ভেতর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর শুনতে পেয়েছিলাম, উনি বিড়বিড় করে বলছেন, দোরাইতিস্ আপোলিনাস! এই তুর্কি ঘোড়সওয়ার এখানে এনেছিল কারা? আশ্চর্য তো!
ব্যস্তভাবে বলেছিলাম, তুর্কি ঘোড়সওয়ার নয় কর্নেল! ওই শুনুন কালো দৈত্য গর্জন করছে। আমাদের এখনই মাটিতে শুয়ে পড়া উচিত।
তারপরই দেখলাম কর্নেলের টুপি এবং প্রজাপতি ধরা জাল উড়ে চলে গেল। ওঁর টাক বেরিয়ে পড়ল। আর আচম্বিতে প্রচণ্ড হাওয়ার ঝাঁপটানি প্রথমে আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিল। তারপর কর্নেলকেও উপুড় হয়ে পড়তে দেখলাম। ভাগ্যিস, জায়গাটা ছিল মোটামুটি ফাঁকা এবং রাস্তার দুধারে বড় বড় পাথরের চাই পড়েছিল। সেগুলো একেকটা নিশ্চয় একশোটা হাতির মতো ওজনদার। তাই কালো দৈত্য সেগুলোকে নড়াতে পারছিল না। মুহূর্তে গাঢ় অন্ধকার ঢেকে ফেলল আমাদের। আর সেই ভয়ঙ্কর শোঁ-শোঁ শনশন শব্দ যেন সত্যিই দৈত্যের শ্বাসপ্রশ্বাস। সেই সঙ্গে চোখ ঝলসানো বিদ্যুতের ঝিলিক। কানে তালা ধরে যাচ্ছিল মুহুর্মুহু বজ্র গর্জনে। এক পলকের জন্য বিদ্যুতের তীব্র আলোয় দেখলাম একটা বিশাল গাছ আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তখন বাঁচার আশা ছেড়েই দিলাম।
কতক্ষণ কালো দৈত্য হামলা চালিয়েছিল জানি না। চোখ বন্ধ করে খুদে গুল্ম আঁকড়ে ধরেছিলাম হয়তো আত্মরক্ষার সহজাত প্রবণতায়। এক স্যা কালো দৈত্যের পাঁয়তারা যদি বা থামল, শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি সে ঠাণ্ডা হিম তীক্ষ্ণ সুচ। তারপর কর্নেলের সাড়া পেলাম। জয়ন্ত! উঠে পড়ো।
হামাগুড়ি দিয়ে পাথুরে মাটিতে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। তখন কর্নেল আমদ হাত ধরে ওঠালেন। বললেন, কুইক! শর্টকাটে বাংলোয় ফেরা দরকার। তখনও বিদ্যতের ঝিলিক এবং বজ্র গর্জনের বিরাম নেই, যদিও ঝড়টা থেমেছে। বৃষ্টিটা কিন্তু বেড়েই যাচ্ছিল। এবড়ো খেবড়ো রাস্তার বাঁদিকে পাথরগুলোর ফাঁকে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। এদিকটায় উঁচু গাছপালা তত নেই। ঝোপঝাড় আর নানা সাইজের পাথর পড়ে আছে। মনে হচ্ছিল, বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদের এ তল্লাট যেন নখদর্পণে। কিন্তু তার সাদা দাড়ি কোথায় গেল? দাড়ির জায়গায় চাপ-চাপ কাদা!
দুজনেরই ভিজে জবুথবু অবস্থা। কিছু দূর চলার পর একটা পিচ রাস্তায়। পৌঁছুলাম। এটাই তা হলে সেই বরমডিহি-জাহানাবাদ রোড। রাস্তার দুদিকে উঁচু গাছ। তীব্র বিদ্যুতের ঝিলিক সামান্য দূরে এবং একটা গাছের মাথায় বিকট শব্দে বাজ পড়ল। গাছটা দাউ দাউ জ্বলে উঠল। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম, কর্নেল! আমাদের কোনও পাথরের আড়ালে বসে পড়া উচিত। বৃষ্টি থামলে বরং–
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, ওই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আমার সঙ্গ ছেড়ো না!
বিদ্যুতের ছটায় খানিকটা দূরে উঁচু জায়গার ওপর একটা দোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম। বাড়িটা পুরনো এবং জরাজীর্ণ। এক সময় সেই বাড়ির বারান্দায় যখন উঠলাম, তখন ধড়ে প্রাণ এল। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিলাম না। বারান্দাটা ছোট। কর্নেল দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকলেন, কে আছে বাড়িতে? শিগগির দরজা খুলুন।
আমি তখনও হাঁপাচ্ছি। হাঁসফাস করে বললাম, পোড়োবাড়ি মনে হচ্ছে।
কর্নেল বললেন, না। দোতলায় বন্ধ জানালার ফাঁকে আলো দেখেছি। বলে আবার দরজায় শব্দ করতে থাকলেন।
বললাম, হিন্দিতে বলুন। বাড়ির লোকেরা হয়তো বাংলা বোঝে না।
আমাকে অবাক করে কর্নেল বললেন, বিদ্যুতের ছটায় নেমপ্লেট পড়েছি। এস. এল. মুখার্জি, এম. এ. বি-এল লেখা আছে।
কোথায় নেমপ্লেট?
ওই দেউড়ির গায়ে। বলে কর্নেল এতক্ষণে পকেট থেকে খুদে টচ বের। করে জ্বললেন।
সেই আলোয় দেখলাম বারান্দার নীচে একপাশে সত্যিই একটা দেউড়ি এবং তার গায়ে মার্বেলের ফলক আঁটা। লেখা আছে সন্ধ্যানীড়। তার তলায় ওই নাম। বাড়ির মালিক তাহলে একজন আইনজীবী। কিন্তু বাড়িটার এমন জরাজীর্ণ দশা কেন?
কর্নেল এবার দরজায় জোরালো ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বললেন, দরজা না খুললে ভেঙে ফেলব বলে দিচ্ছি। শিগগির দরজা খুলুন। আমরা ডাকাত নহ, ভদ্রলোক।
এতক্ষণে দরজার ফাটল দিয়ে আলো দেখা গেল। তারপর দরজা খুলে। গেল। একজন প্রৌঢ় শক্তসমর্থ গড়নের লোক লণ্ঠন তুলে বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন স্যার?