- বইয়ের নামঃ ভুতুড়ে লাশ
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- বিভাগসমূহঃ কর্নেল সমগ্র
০১. কালোদৈত্য এবং পোডড়াবাড়ির ভূত
মুন লেক দেখে ফেরার পথে সাংঘাতিক ঝড়ের মুখে পড়েছিলাম। বরমডিহি ডাকবাংলোর চৌকিদার পই পই করে বলেছিল, সূর্যাস্তের আগেই যেন ফিরে আসি। কারণ বছরের এই সময়টা এ মুলুকে অচানক কালা দেওপাহাড়ের ওপর থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার পাল্লায় পড়লে নাকি বাঁচার আশা থাকে না। মানুষ তো তুচ্ছ, বাঘের মতো বিরাট জানোয়ারকেও নাকি সেই কালা দেও অর্থাৎ কিনা কালো দৈত্য দুহাতে তুলে এমন আছাড় মারে যে তার হাড়গোড় মাংস দলা পাকিয়ে যায়।
চৌকিদার আরও বলেছিল, চাপা গুডগুড শব্দ শুনলেই যেন আমরা মাটিতে শুয়ে পড়ি। ওই শব্দটা কালো দৈত্যের আসবার সংকেত।
শব্দটা আমি শুনেছিলাম। কিন্তু আমার বৃদ্ধ বন্ধু প্রকৃতিবিদ কর্নেল নীলাদ্রি সরকার তখন একটা প্রজাপতিকে তাড়া করেছেন। তার হাতে প্রজাপতি ধরা জাল। ওঁকে শব্দটার কথা বলেছিলামও। কিন্তু উনি গ্রাহ্য করেননি।
প্রজাপতিটা জঙ্গলের ভেতর নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর শুনতে পেয়েছিলাম, উনি বিড়বিড় করে বলছেন, দোরাইতিস্ আপোলিনাস! এই তুর্কি ঘোড়সওয়ার এখানে এনেছিল কারা? আশ্চর্য তো!
ব্যস্তভাবে বলেছিলাম, তুর্কি ঘোড়সওয়ার নয় কর্নেল! ওই শুনুন কালো দৈত্য গর্জন করছে। আমাদের এখনই মাটিতে শুয়ে পড়া উচিত।
তারপরই দেখলাম কর্নেলের টুপি এবং প্রজাপতি ধরা জাল উড়ে চলে গেল। ওঁর টাক বেরিয়ে পড়ল। আর আচম্বিতে প্রচণ্ড হাওয়ার ঝাঁপটানি প্রথমে আমাকে মাটিতে শুইয়ে দিল। তারপর কর্নেলকেও উপুড় হয়ে পড়তে দেখলাম। ভাগ্যিস, জায়গাটা ছিল মোটামুটি ফাঁকা এবং রাস্তার দুধারে বড় বড় পাথরের চাই পড়েছিল। সেগুলো একেকটা নিশ্চয় একশোটা হাতির মতো ওজনদার। তাই কালো দৈত্য সেগুলোকে নড়াতে পারছিল না। মুহূর্তে গাঢ় অন্ধকার ঢেকে ফেলল আমাদের। আর সেই ভয়ঙ্কর শোঁ-শোঁ শনশন শব্দ যেন সত্যিই দৈত্যের শ্বাসপ্রশ্বাস। সেই সঙ্গে চোখ ঝলসানো বিদ্যুতের ঝিলিক। কানে তালা ধরে যাচ্ছিল মুহুর্মুহু বজ্র গর্জনে। এক পলকের জন্য বিদ্যুতের তীব্র আলোয় দেখলাম একটা বিশাল গাছ আমাদের ওপর দিয়ে উড়ে গেল। তখন বাঁচার আশা ছেড়েই দিলাম।
কতক্ষণ কালো দৈত্য হামলা চালিয়েছিল জানি না। চোখ বন্ধ করে খুদে গুল্ম আঁকড়ে ধরেছিলাম হয়তো আত্মরক্ষার সহজাত প্রবণতায়। এক স্যা কালো দৈত্যের পাঁয়তারা যদি বা থামল, শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি সে ঠাণ্ডা হিম তীক্ষ্ণ সুচ। তারপর কর্নেলের সাড়া পেলাম। জয়ন্ত! উঠে পড়ো।
হামাগুড়ি দিয়ে পাথুরে মাটিতে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। তখন কর্নেল আমদ হাত ধরে ওঠালেন। বললেন, কুইক! শর্টকাটে বাংলোয় ফেরা দরকার। তখনও বিদ্যতের ঝিলিক এবং বজ্র গর্জনের বিরাম নেই, যদিও ঝড়টা থেমেছে। বৃষ্টিটা কিন্তু বেড়েই যাচ্ছিল। এবড়ো খেবড়ো রাস্তার বাঁদিকে পাথরগুলোর ফাঁকে কর্নেলকে অনুসরণ করলাম। এদিকটায় উঁচু গাছপালা তত নেই। ঝোপঝাড় আর নানা সাইজের পাথর পড়ে আছে। মনে হচ্ছিল, বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদের এ তল্লাট যেন নখদর্পণে। কিন্তু তার সাদা দাড়ি কোথায় গেল? দাড়ির জায়গায় চাপ-চাপ কাদা!
দুজনেরই ভিজে জবুথবু অবস্থা। কিছু দূর চলার পর একটা পিচ রাস্তায়। পৌঁছুলাম। এটাই তা হলে সেই বরমডিহি-জাহানাবাদ রোড। রাস্তার দুদিকে উঁচু গাছ। তীব্র বিদ্যুতের ঝিলিক সামান্য দূরে এবং একটা গাছের মাথায় বিকট শব্দে বাজ পড়ল। গাছটা দাউ দাউ জ্বলে উঠল। আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলাম, কর্নেল! আমাদের কোনও পাথরের আড়ালে বসে পড়া উচিত। বৃষ্টি থামলে বরং–
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কর্নেল বললেন, ওই একটা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। আমার সঙ্গ ছেড়ো না!
বিদ্যুতের ছটায় খানিকটা দূরে উঁচু জায়গার ওপর একটা দোতলা বাড়ি দেখতে পেলাম। বাড়িটা পুরনো এবং জরাজীর্ণ। এক সময় সেই বাড়ির বারান্দায় যখন উঠলাম, তখন ধড়ে প্রাণ এল। কিন্তু সেই তীক্ষ্ণ বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিলাম না। বারান্দাটা ছোট। কর্নেল দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকতে থাকলেন, কে আছে বাড়িতে? শিগগির দরজা খুলুন।
আমি তখনও হাঁপাচ্ছি। হাঁসফাস করে বললাম, পোড়োবাড়ি মনে হচ্ছে।
কর্নেল বললেন, না। দোতলায় বন্ধ জানালার ফাঁকে আলো দেখেছি। বলে আবার দরজায় শব্দ করতে থাকলেন।
বললাম, হিন্দিতে বলুন। বাড়ির লোকেরা হয়তো বাংলা বোঝে না।
আমাকে অবাক করে কর্নেল বললেন, বিদ্যুতের ছটায় নেমপ্লেট পড়েছি। এস. এল. মুখার্জি, এম. এ. বি-এল লেখা আছে।
কোথায় নেমপ্লেট?
ওই দেউড়ির গায়ে। বলে কর্নেল এতক্ষণে পকেট থেকে খুদে টচ বের। করে জ্বললেন।
সেই আলোয় দেখলাম বারান্দার নীচে একপাশে সত্যিই একটা দেউড়ি এবং তার গায়ে মার্বেলের ফলক আঁটা। লেখা আছে সন্ধ্যানীড়। তার তলায় ওই নাম। বাড়ির মালিক তাহলে একজন আইনজীবী। কিন্তু বাড়িটার এমন জরাজীর্ণ দশা কেন?
কর্নেল এবার দরজায় জোরালো ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বললেন, দরজা না খুললে ভেঙে ফেলব বলে দিচ্ছি। শিগগির দরজা খুলুন। আমরা ডাকাত নহ, ভদ্রলোক।
এতক্ষণে দরজার ফাটল দিয়ে আলো দেখা গেল। তারপর দরজা খুলে। গেল। একজন প্রৌঢ় শক্তসমর্থ গড়নের লোক লণ্ঠন তুলে বলল, আপনারা কোথা থেকে আসছেন স্যার?
লোকটার চেহারা পোশাক এবং কণ্ঠস্বরে বুঝলাম এ বাড়ির সম্ভবত পুরাতন ভৃত্য। কর্নেল প্রায় তাকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমিও ঢুকলাম। লোকটা একটু হকচকিয়ে গেল। কর্নেল এবার একটু হেসে বললেন, বাইরের অবস্থা দেখেও কি এ কথা জিজ্ঞেস করতে আছে? দেখতে পাচ্ছ তো, আমরা কী বিচ্ছিরি ভিজেছি। যাই হোক, বৃষ্টিটা থামলেই আমরা চলে যাব।
লোকটা ধাতস্থ হল যেন। বলল, তা বসুন আজ্ঞে! আমি কর্তাবাবুর কাছে গিয়ে বসি। ওনার শরীর হঠাৎ অসুস্থ। বাড়িতে আর কেউ নেই যে আপনাদের একটু যত্নআত্তি করবো। বাড়তি একটা আলোও নেই যে—
থাক। তুমি তোমার কামশাইয়ের কাছে যাও। বৃষ্টি থামলে আমি তোমাকে ডাকব। তখন এসে দরজা বন্ধ করবে। কী নাম তোমার?
আজ্ঞে ভোলা স্যার!
তোমার কর্তামশাই কি এস. এল. মুখার্জি?
আজ্ঞে। বলে লোকটা হন্তদন্ত ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকে গেল। তারপর তার পায়ের শব্দ ক্রমশ ওপরদিকে মিলিয়ে গেল। সিঁড়িটা দরজার কাছাকাছি। আছে। কিংবা এ বাড়িতে সব শব্দই বিভ্রান্তিকর যেন। ততক্ষণে ঘরের ভেতরটা দেখে নিয়েছি। কয়েকটা আলমারি, একপাশে একটা খালি তক্তাপোস আর একটা টেবিল ঘিরে চারটে নড়বড়ে চেয়ার। দুটো চেয়ারে আমরা বসেছি। বুঝলাম, আইনজীবী ভদ্রলোকের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। তিনি বৃদ্ধ এবং অসুস্থ। আর কোর্টে যাতায়াতের সামর্থ নেই। আলমারিগুলো প্রায় শূন্য। আইনজীবীদের ঘরের দৃশ্য আমার দেখা আছে। অজস্র আলমারিতে ঠাসবন্দি আইনের বই এবং নথি ভর্তি থাকে। কিন্তু এই মুখার্জিমশাই বিদেশে বিভুয়ে এমন দুরবস্থায় পড়েছেন যে ওঁকে শেষ পর্যন্ত আইনের বই বেচে খেতে হয়েছে। উনি নিশ্চয় কর্নেলের মতো চিরকুমার। তাই কর্নেলের প্রিয় পরিচারক ষষ্ঠীচরণের মতো এই ভোলাই তাঁর দেখাশোনা রান্নাবান্না কাজকর্ম করে।
কর্নেল যেন আমার মনের কথা আঁচ করেই হঠাৎ বললেন, এই ভদ্রলোক অ্যাডভোকেট ছিলেন। কিন্তু যদি ভাবো, পয়সা কামাতে পারেননি ভুল করবে। কারণ এত বড় একটা দোতলা বাড়ি করা সহজ কথা নয়। অথচ বাড়িটার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। ভাড়া দিতেও পারতেন। দেননি। বাড়িটার ॥ অবস্থা– বলে উনি ছাদের দিকে টর্চের আলো ফেললেন। টালিগুলো ফাঁক হয় আছে। কড়িবর্গার অবস্থা শোচনীয়। যে-কোনও সময় ছাদ ধসে পড়তেই পারে।
শিউরে উঠলাম। এসব অলক্ষুণে কথা বলবেন না। কালা দেওয়ের গান থেকে সদ্য প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরেছি।
সেই মুহূর্তে ঝুরঝুর করে কোথায় বালি খসে পড়ল। কানের ভুল কি না কে জানে, মনে হল, ভোলার পায়ের শব্দ হল মাথার ওপর। বললাম, কর্নেল। এখানে আশ্রয় নেওয়ার চেয়ে দেখছি বৃষ্টিতে ভেজা নিরাপদ ছিল।
কর্নেল টর্চ নিভিয়ে বললেন, ওপরের ঘরে হাঁটাচলা করছে কেউ।
ভোলা ছাড়া আর কে?
কর্নেল চুপ করে থাকলেন। বাইরের দরজা দিয়ে বিদ্যুতের মুহুর্মুহু আলোয় জোর বৃষ্টি দেখতে পাচ্ছিলাম। প্যান্টশার্ট ভিজে চবচবে এবং এখন ঘরের ভেতরে ওম পাব কী, বড্ড শীত করছিল। একটু পরে আবার ঝুরঝুর করে কিছু ঝরে পড়ল ছাদ থেকে। চমকে উঠে বললাম, কর্নেল! এ ঘরে বসে থাকা বিপজ্জনক মনে হচ্ছে।
কর্নেলই বললেন, আর কোন ঘরে গিয়ে বসবে ভাবছ? ভেতরে তো আরও ঘর আছে। ভোলাকে ডাকুন।
আমার কথা শেষ হতেই ছাদে চাপা শব্দ হল এবং আবার একরাশ চুন সুরকি ঝরে পড়ল। এবার আমাদের সামনেই টেবিলের ওপর। ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
কর্নেল টর্চ ফেলে ছাদটা দেখে বললেন, হু। ওপরের ঘরে কেউ হাঁটাচলা করলেই এই অবস্থা হয়। টর্চের আলো তিনি টেবিলে এবং টেবিল থেকে মেঝেয় ফেললেন। দেখছ? কত গুড়ো চুনসুরকি ঝরে পড়ে সারাক্ষণ অথচ ভোলা মেঝে পরিষ্কার করে না।
কর্নেল! চলুন, ভেতরে যাই। দেখি কোনও নিরাপদ জায়গা আছে কি না।
হুঁ। থাকা তো উচিত।
তাহলে চলুন না! আমার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে।
জয়ন্ত! অস্বস্তি আমারও হচ্ছে। চলো!
বলে কর্নেল ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকলেন। ওঁর হাতে টর্চ জ্বলছিল। ওঁকে অনুসরণ করে গিয়ে দেখি, একটা বারান্দা এবং তার নীচে উঠোন জঙ্গল হয়ে আছে। বারান্দার শেষদিকে সিঁড়ি। সিঁড়ির কাছে পৌঁছে এক পলকের জন্য বিদ্যুতের আলো এবং বৃষ্টির মধ্যে আবছা একটা মূর্তি দেখতে পেলাম। বললাম, কে?
কর্নেল বললেন, কোথায় কে?
উঠোনের জঙ্গলে কাকে যেন দেখলাম। শিগগির আলো ফেলুন।
টর্চের আলোয় কাউকে দেখা গেল না। কর্নেল একটু হেসে বললেন, তুমি অকারণে ভয় পাচ্ছ জয়ন্ত!
আমার মনে এতক্ষণে সন্দেহ জাগল, এই বাড়িটা কোনও পোড়ো এবং ভুতুড়ে বাড়ি নয় তো? ভোলা কি মানুষ? ওর চেহারা যেন কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছিল না?
চাপা ভয়টা তাড়ানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু থেকেই গেল। সিঁড়িতে যখন কর্নেলের পিছনে উঠছি; তখন প্রতিমুহূর্তে মনে হচ্ছে, কেউ ঠাণ্ডাহিম হাতে আমার গলা টিপে ধরবে, কিংবা সিঁড়িটাই বেঙে পড়বে।
ওপরের জীর্ণ রেলিংঘেরা বারান্দায় পৌঁছে কর্নেল ডাকলেন, ভোলা!
একটা ঘরের দরজা খুলে গেল এবং আলো দেখতে পেলাম। ভোলা সাড়া দিল। বিষ্টি তো এখনও পড়ছে স্যার! বিষ্টির মধ্যে চলে যাবেন কেন?
কর্নেল বললেন, তোমার কর্তামশাইয়ের সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।
ভোলা আস্তে বলল, তা আসুন। কিন্তু উনি ঘুমোচ্ছেন। ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি।
কর্নেলের সঙ্গে সেই ঘরে ঢুকলাম। দেখলাম, একটা তক্তাপোসে নোংরা। বিছানায় একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক পাশ ফিরে শুয়ে আছেন। তার গায়ে নোংরা ছেঁড়া একটা চাঁদর চাপানো। ঘরের ভেতর আর কোনও আসবাব নেই। দেয়ালের তাকে অনেকগুলো শিশিবোতল কৌটো এইসব জিনিস। ভোলার লণ্ঠনটার অবস্থাও শোচনীয়। লণ্ঠনটা যেন অতিকষ্টে সামান্য একটু আলো ওগরাচ্ছে।
কর্নেল বললেন, তোমার কর্তামশাইয়ের চিকিৎসা করছেন কে?
আজ্ঞে বরমডিহি সরকারি হাসপাতালের এক ডাক্তার।
অসুখটা কি?
ধরা যাচ্ছে না। কর্তামশাইয়ের তেমন টাকাকড়িও নেই যে ভাল ডাক্তার দেখাবেন!
ওঁর কোনও আত্মীয়স্বজন নেই?
কলকাতায় আছে। এনার ছোট ভাই। কিন্তু দাদার সঙ্গে বনিবনা নেই।
এই সময় হঠাৎ কোথায় একটা চাপা শব্দ এবং আবছা গোঙানি শোনা গেল। কর্নেল এবং আমি দুজনেই চমকে উঠেছিলাম। কর্নেল বললেন, ও কিসের শব্দ?
ভোলা গম্ভীর মুখে বলল, আজ্ঞে, ভয় পাবেন না। এ বাড়িতে এরকম অনেক শব্দ হয়।
বলো কী!
হ্যাঁ স্যার। প্রথম প্রথম আমি ভয় পেতাম। আর গেরাজ্জি করি না।
তুমি কি ভূতপ্রেতের কথা বলছ?
ভোলা গলার ভেতর বলল, রাতবিরেতে ওসব কথা থাক স্যার! আপনি নীচে গিয়ে বসুন। বিষ্টি কমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে।
কর্নেল টর্চ জ্বেলে অসুস্থ আইনজীবীকে দেখতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভো তক্ষুনি আলোর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আলো ফেলবেন না স্যার! এক্ষুনি চো আলো লাগলে হুলুস্থুল বাধাকেন। সামলাতে পারব না। দয়া করে আপনারা নি গয়ে বসুন। বিষ্টি ছাড়লে চলে যাবেন।
কর্নেলের সঙ্গে নিচের সেই ঘরে যখন ফিরে গেলাম, তখন আমি আতঙ্কে প্রায় হতবুদ্ধি। বললাম, কর্নেল! বৃষ্টি কমেছে। চলুন, কেটে পড়ি। এ বাড়ির হালচাল গোলমেলে মনে হচ্ছে।
কর্নেল একটা চেয়ারে বসে বললেন, আর মিনিট পনের অপেক্ষা করা যাক। প্রায় এক কিলোমিটার আমাদের হাঁটতে হবে।পথে কোনও যানবাহনের আশা নেই। বসো?
বসলাম চেয়ার টেনে। কিন্তু চেয়ারটা এবার কেমন বিচ্ছিরি শব্দ করল। কর্নেল টর্চের আলোয় ঘড়ি দেখে বললেন, মোটে সাড়ে ছটা। অক্টোবরে সাড়ে ছটা মানে অবশ্য সন্ধ্যা। কিন্তু এখানে আবহাওয়ার দরুন মনে হচ্ছে নিশুতি রাত।
একটু পরে টুপ টুপ করে শব্দ হতে থাকল। শব্দটা টেবিলের ওপর। বললাম, কর্নেল! দোতলার ছাদের নিশ্চয় ফাটাফুটি অবস্থা। সেই জল চুঁইয়ে নিচের ঘরে পড়ছে।
কর্নেল টর্চ জ্বাললেন টেবিলের ওপর। অমনি আতঙ্কে গলা শুকিয়ে গেল। ছাদ থেকে চুঁইয়ে টুপ টুপ করে টেবিলে যা পড়ছে তা জল নয়। গাঢ় লাল রক্ত।
হ্যাঁ, তাজা রক্ত। কর্নেলের টর্চের আলো ছাদে পৌঁছুল। টালির ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে রক্তবিন্দু। টেবিলে থকথক করছে রক্ত। থরথর করে কেঁপে উঠলাম। অজানা ত্রাসে। এ এক বিভীষিকা। কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বললেন, এস তো দেখি!
আবার সিঁড়ি বেয়ে দুরুদুরু বুকে ওপরে গেলাম। কর্নেল ডাকলেন, ভোলা! ভোলা! কিন্তু কোনও সাড়া এল না।
সেই ঘরের দরজায় গিয়ে কর্নেল টর্চ জ্বাললেন। দরজা খোলা এবং ভেতরের তত্তাপোসে নোংরা বিছানায় কেউ নেই। বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলাম। কর্নেল সেই ঘরের ভেতর ঢুকে বললেন, আমরা যে ঘরে ছিলাম, সেটা ওই পারে ঘরের নিচে। বলে পাশের ঘরের দরজা ঠেললেন।
ভেজানো দরজা খুলে গেল। তারপর কর্নেলের টর্চের আলোয় দেখলাম, একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় মেঝেয় পড়ে আছে। সে এক বীভৎস দৃশ্য! দেখা মাত্র চোখ বন্ধ করলাম। এ নিশ্চয় কোনও ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখছি!
কর্নেল দেখে নিয়েই বললেন, কুইক জয়ন্ত! ভিজতে ভিজতেই বাংলোয় ফিরতে হবে। তারপর ব্যস্তভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
কাঁপতে কাঁপতে বললাম, অ্যাডভোকেট ভদ্রলোককে ভোলা মার্ডার করেছে!
না। একজন মধ্যবয়সী লোককে জবাই করা হয়েছে।
আর কোনও কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না। বৃষ্টি কমেছে কিন্তু তখনও ক্রমাগত বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছিল। রাস্তায় পৌঁছে কর্নেল বললেন, জায়গাটা চিনতে পারছি। এটাকে একসময় বলা হত বাঙালিটোলা। বাড়িগুলো একটা করে বাগানবাড়ির মতো। দূরে-দূরে ছড়ানো। আজকাল এসব বাড়ির মালিকেরা কলকাতায় চলে গেছেন। কেয়ারটেকার থাকে। বাঙালিরা বেড়াতে এলে এগুলো কেয়ারটেকারই ভাড়া দেয়। কিন্তু ওই সন্ধ্যানীড় নামে বাড়িটা–
কর্নেল হঠাৎ চুপ করলেন। হন্তদন্ত হাঁটতে থাকলেন।
ডাকবাংলোয় পৌঁছুলে আমাদের দেখে চৌকিদার রামভরসা হিন্দিতে বলল, হায় রাম! আপনারা ঠিকই কালা দেওয়ের পাল্লায় পড়েছিলেন। তবে রামজির কৃপায় যে প্রাণে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন, এই যথেষ্ট।
জলদি কফি! বলে কর্নেল বাথরুমে ঢুকলেন পোশাক বদলাতে। একটু পরে বেরিয়ে এসে বললেন, আমি আসছি। তুমি পোশাক বদলে ফেলো ডার্লিং!
কোথায় যাচ্ছেন?
কেয়ারটেকারের অফিসে টেলিফোন আছে। এখনই থানায় ব্যাপারটা জানানো দরকার।
আমার মাথা এবং প্যান্টশার্ট কাদায় মাখামাখি। বাথরুমে ঢুকে ঝটপট স্নান করে নিলাম। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ব্যালকনিতে বেতের চেয়ারে বসলাম। এতক্ষণে শরীর-মন তাজা। সেই হানাবাড়ির দৃশ্যগুলি খুঁটিয়ে স্মরণ করছিলাম। যা দেখেছি, তার কোনও মাথামুণ্ডু খুঁজে পাওয়া যায় না।
এতক্ষণে কর্নেল ফিরলেন। রামভরসা কফির ট্রে রেখে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, থানায় কি জানিয়ে দিলেন ব্যাপারটা?
হুঁ। বলে কর্নেল কফিতে চুমুক দিলেন।
পুলিশ কী বলল?
সন্ধ্যানীড় নাকি একটা পোড়ো বাড়ি। বাড়িটা নিয়ে অ্যাডভোকেট শচীন্দ্রলাল মুখার্জি এবং তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই তরুণকুমার মুখার্জির মধ্যে বহু বছর ধরে মামলা চলছে। তাই বাড়িটার ওই অবস্থা। ওঁরা কলকাতায় থাকেন। অসুখে ভুগে কেয়ারটেকার কবে মারা গেছে। তার নাম ভোলা ছিল কি না পুলিশ জানে না।
তাহলে ঘটনাটা রহস্যময়। বরং বলা চলে রহস্যময় হত্যাকাণ্ড।
হ্যাঁ। তবে আমরা হঠাৎ ওখানে গিয়ে পড়ায় হত্যাকারীরা একটা নাটকীয় দৃশ্য তৈরি করেছিল।
ঠিক বলেছেন। সেই ভোলা ব্যাটালের চেহারা মনে পড়ছে। কেমন ষণ্ডামার্কা।
লোকটা কিন্তু বাঙালি।
আমরা কিছুক্ষণ এইসব আলোচনা চালিয়ে গেলাম। তারপর কর্নেল সেই পলাতক প্রজাপতিটি নিয়ে হাহুতাশ শুরু করলেন। প্রজাতির লাতিন নাম দোরাতিস আপোলিনাস। এই প্রজাতির প্রজাপতি এই অঞ্চলে আবিষ্কার করে সত্যিই আমি বিস্মিত হয়েছি জয়ন্ত! এরা মধ্যএশিয়া–বিশেষ করে তুর্কিভাষী এলাকার বাসিন্দা। সম্ভবত মধ্যযুগে কোনও প্রজাপতিপ্রিয় তুর্কি সুলতান এ ওদের এনে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কলকাতা ফিরে বইপত্তর ঘাঁটতে হবে।
আমার মাথায় সন্ধ্যানীড়ের হত্যাকাণ্ড। রক্তারক্তি অবস্থা। প্রকৃতিবিদের বকবক কানে নিচ্ছিলাম না। বেশ কিছুক্ষণ পরে রামভরসা এসে কর্নেলকে সেলাম দিল। স্যার! আপনার টেলিফোন!
কর্নেল হন্তদন্ত নিচে চলে গেলেন।
যখন ফিরলেন, তখন মুখ একেবারে গম্ভীর। ধপাস করে বসে চোখ বুজে টাকে হাত বুলোতে শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলাম, কার ফোন?
কর্নেল চোখ বুজে টাকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, পুলিশ সন্ধ্যানীড়ে জিপ নিয়ে গিয়েছিল। তন্নতন্ন খুঁজে কোনও ডেডবডি পায়নি। ওপরের ঘরের মেঝেয় এবং নীচের ঘরের টেবিলে এক ফোঁটা রক্তও নেই। সিলিঙের সেই টালিটা অবশ্য ভাঙা দেখেছে। পুলিশের মতে সেটা স্বাভাবিক। পুলিশ অকারণ হয়রানির জন্য আমাকে হুমকি দিল।
রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলাম, কর্নেল! আমরা পোড়োবাড়িতে নির্ঘাত ভূতের পাল্লায় পড়েছিলাম!…
০২. কালো নোট বই
বরমডিহি থেকে কলকাতা ফেরার পর কিছুদিন সেই ঘটনাটা নিয়ে অনেক থিওরি খাড়া করেছিলাম। কিন্তু কোনওটাই যুক্তি দিয়ে দাঁড় করাতে পারছিলাম না। আর কর্নেলকেও তা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে দেখিনি। তিনি প্রজাপতি সংক্রান্ত বইয়ে মগ্ন ছিলেন। কখনও দেখতাম তুর্কিভাষী সুলতানদের ইতিহাসের বইও ঘাঁটছেন।
আমি দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার সাংবাদিক। অফিসে অজস্র খবরের কাগজ আসে। খুঁটিয়ে পড়ি, যদি বরমডিহিতে কোনও খুনখারাপির কিংবা কারও নিরুদ্দেশের খবর চোখে পড়ে। কিন্তু তেমন কোনও খবর চোখে পড়ে না। দেখতে দেখতে শীত এসে গেল। ঘটনাটা গভীরভাবে তবু মনে গাঁথা রইল। দুঃস্বপ্ন দেখতাম কত রাত্রে। অবশেষে কর্নেলকে একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম, অ্যাডভোকেট শচীন্দ্রলাল মুখার্জি বা তাঁর বৈমাত্রেয় ভাইয়ের কলকাতার ঠিকানা যোগাড় করা উচিত ছিল। করেননি কেন?
কর্নেল বললেন, করেছি। ওঁরা বহাল তবিয়তে আছেন এবং মামলা এখন সুপ্রিমকোর্টে উঠেছে। শচীন্দ্রবাবু এখন আর প্র্যাকটিস করেন না। তরুণবাবু ব্যবসাবাণিজ্য করেন। তিনি মিটমাটের পক্ষপাতী। কিন্তু শচীন্দ্রবাবু ভীষণ একগুঁয়ে মানুষ। কারণ তার বক্তব্য, তার বাবা মহেন্দ্রলাল ন্যায্য উইল করে তাকে বরমডিহির বাড়িটা দিয়ে গেছেন। তরুণবাবুর বক্তব্য, উইলটা জাল। এতেই শচীন্দ্র বৈমাত্রেয় ভাইয়ের ওপর খুবই ক্ষুব্ধ।
আপনি কি খুনের ঘটনাটা ওঁদের বলেছেন?
বলেছি। দুজনেরই মতে, ওই এলাকায় খুনখারাপি আকছার হয়। বাড়িটা পোডড়া হয়ে গেছে। কাজেই সেখানে যে যা খুশি করতেই পারে। আর সত্যিই ভোলা নামে শচীন্দ্রবাবুর একজন চাকর ছিল। সে বেঁচে নেই।
কিন্তু প্রায় দু মাস হয়ে গেল। কোনও কাগজে বরমডিহির কোনও—
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, আজকাল সব খবর কাগজে বেরোয়। কাগজের লোক হয়ে এ তোমার জানার কথা। তার চেয়ে বড় কথা, পুলিশ আমার নাম ঠিকানা নিয়েছিল। তেমন কিছু ঘটলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করত।
তাহলে তো ব্যাপারটা সত্যিই ভুতুড়ে বলতে হয়।
এই সময় ডোরবেল বাজল। কর্নেলের ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ এসে বলল, এক ভদ্রলোক এয়েছেন বাবামাশাই! বলছেন, খুব বিপদে পড়ে আপনার সাহায্য নিতে এয়েছেন। বললাম, বাবামশাই ব্যস্ত। উনি বললেন–
চোখ কটমটিয়ে কর্নেল বললেন, ডেকে নিয়ে আয়।…
একটু পরে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে কর্নেলকে নমস্কার করে করুণ হাসলেন, আপনাকে ডিসটার্ব করার জন্য দুখিত। কিন্তু আমার উপায় ছিল না। এতদিন ধরে পুলিশ কোনও কিনারা করতে পারল না। অগত্যা আপনার শরণাপন্ন হলাম।
আপনি বসুন।
ভদ্রলোকের পরনে সাধারণ প্যান্ট-শার্ট। কাঁধে একটা কাপড়ের নকশাদার ব্যাগ। কিন্তু ব্যাগটা পুরনো। তার চেহারা রোগা এবং ঢ্যাঙা। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়িগোঁফ। সোফার কোনায় তিনি আড়ষ্টভাবে বসে বললেন, আমার নাম হরিচরণ গাঙ্গুলি। থাকি পাইকপাড়ায়। মাস দুয়েক আগে আমার মামাতো ভাই শ্যামসুন্দর হঠাৎ নিখোঁজ। তারপর
আমি বলে উঠলাম, বরমডিহি এবং তখনই কর্নেল চোখ কটমট করে আমাকে থামিয়ে দিলেন।
হরিচরণবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বললেন যেন?
কর্নেল যেন কথা ঘুরিয়ে দিতেই বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি।
হরিচরণ নমস্কার করলেন। আপনার কথাও আমাকে মহীবাবু বলেছে কর্নেলসায়েবের ঠিকানা উনিই আমাকে দিয়েছে। রিটায়ার্ড পুলিশ অফিস স্যার। লেকটাউনে থাকেন। তা আপনি কী যেন বললেন কথাটা?
কর্নেল দ্রুত বললেন, সে অন্য কেস। আপনি বলুন।
হরিচরণ বললেন, জয়ন্তবাবু বমডিহি বললেন। আমার কানে কথাটা ২৯ করে বিধল। মানে, আমি স্যার একসময় এক অ্যাডভোকেট ভদ্রলোকের কাষ ছিলাম। তার কিছু বিষয়সম্পত্তি ছিল বমডিহিতে। সেই নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলা মোকদ্দমা। দুই ভাই-ই সমান গোঁয়ার। তাতে পরস্পর বৈমাত্রেয় ভাই।
এবার কর্নেলের চোখ উজ্জ্বল দেখাল। আস্তে বললেন, আপনি কি শচীন্দ্রলাল মুখার্জির ক্লার্ক ছিলেন?
হ্যাঁ স্যার! তবে সে অনেক বছর আগের কথা। উনি ওকালতি থেকে অবসর নিয়েছিলেন। আর আমিও বেকার হয়ে গিয়েছিলাম। তো একটা কিছু না জোটালে বাঁচি কী করে? অগত্যা
টাইপিস্টের কাজ শুরু করেছিলেন?
হরিচরণ ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন। আপনি স্যার সত্যিই অন্তর্যামী। মহীবাবু যা-যা বলেছিলেন, মিলে যাচ্ছে। আপনি কেমন করে জানলেন আমি টাইপিস্টের কাজ করি?
আপনার আঙুল দেখে মনে হল আপনি টাইপিস্ট। কর্নেল হাসলেন। আর বরমডিহির সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে মামলার খবর কাগজে বেরিয়েছিল।
আমি স্যার আলিপুর কোর্ট চত্বরে টাইপরাইটার নিয়ে বসি। স্বাধীনভাবে কাজকর্ম করি। চলে যায় কোনওরকমে।
আপনার মামাতো ভাইয়ের ব্যাপারটা বলুন!
শ্যাম ছিল একের নম্বর বাউণ্ডুলে। মধ্যে মধ্যে আমার কাছে এসে থাকত। আবার কিছুদিনের জন্য কোথায় বেপাত্তা হয়ে যেত। তাই বছর সাত-আট আগে ও যখন উধাও হয়ে গিয়েছিল, গা করিনি। কিন্তু ইদানীং প্রায় ফি সপ্তায় একটা করে উড়োচিঠি আসতে শুরু করল। সব চিঠিতে লাল ডটপেনে লেখা, শ্যামসুন্দরের কালোরঙের নোটবইটা নিয়ে গঙ্গার ধারে আউট্রাম ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমরা চিনে নেব তোমাকে। ওটা পেলে শ্যামসুন্দর প্রাণে বাঁচবে।
হরিচরণ বিষণ্ণমুখে শ্বাস ছেড়ে চুপ করলে কর্নেল বললেন, তারপর?
মহীবাবুকে সঙ্গে নিয়ে অগত্যা লালবাজারে গিয়েছিলাম। শ্যামের কোনও জিনিসপত্র আমার ঘরে ছিল না। তো পুলিশ সাদা পোশাকে দিনকতক ফাঁদ পাতল। কিন্তু কেউ আমার কাছে এল না। আমি স্যার পুলিশের কথা মতো একটা কালো নোটবই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। যাই হোক, শেষে পুলিশ বলল, বোগাস! কেউ জোক করছে। আর তারপর থেকে পুলিশ আমাকে পাত্তা দিল না। কিন্তু তারপর এই চিঠিটা গতকাল ডাকে এসেছে দেখুন!
উনি একটা খাম দিলেন কর্নেলকে। কর্নেল আগে খামের টিকিটে ডাকঘরের ছাপটা আতস কাচ দিয়ে দেখে নিলেন। তারপর চিঠিটা বের করলেন। তার কাঁধের পাশ দিয়ে উঁকি দিলাম। সাদা কাগজে লালকালিতে লেখা আছে
ঘুঘু ধরতে ফাঁদ পেতেছিলে। এ বড় সেয়ানা ঘুঘু। তোমার বদমাইসির জন্য শ্যামকে খতম করে পুঁতে ফেলেছি। এবার তোমার পালা। আগামী ৭ ডিসেম্বরে মধ্যে শ্যামের কালো নোটবইটা না পেলে এবার তুমি খতম হয়ে শ্যামের মতোই মাটির তলায় চলে যাবে। এবার পুলিশকে জানালে ওটা পাই বা না পাই, তোমার নিস্তার নেই। কাজেই সাবধান। কোর্ট চত্বরে কোনও একদিন কোনও এক সময়ে কেউ তোমার কাছে টাইপ করাতে গিয়ে বলবে এন বি। তুমি তক্ষুণি তার হাতে ওটা দেবে। আর তাকে ধরে চ্যাঁচামেচি করলে হাটে ড্যাগার ঢুকে যাবে। বুঝলে বুদ্ধিমান? কেন ঝামেলা করছ? করবেই বা কেন?
কর্নেল চিঠিটা পড়ে বললেন, আজ দোসরা ডিসেম্বর।
হরিচরণ ব্যাকুলভাবে বললেন, আমি স্যার কোনও কালো নোটবই পাইনি। খামোক আমার ঘাড়ে এ কী বিপদ এসে পড়েছে দেখুন। আপনি আমাকে বাঁচান স্যার!
কর্নেল চুরুট ধরালেন। আমি বললাম, লোকটাকে ধরে ফেলতে অসুবিধে কী?
হরিচরণ বললেন, ধরে না হয় ফেললেন। কিন্তু তারপর? তারপর আমার লাইফরিস্ক কি না বলুন? সারাক্ষণ তো কেউ আমার বডিগার্ড হয়ে থাকতে পারে না! তার চেয়ে বড় কথা, শ্যামের তেমন কোনও নোটবই সত্যি আমি খুঁজে পাইনি–বিশ্বাস করুন!
কর্নেল চিঠিটা আতস কাঁচে পরীক্ষা করছিলেন। বললেন, আগের চিঠিগুলো কি আপনি পুলিশকে দিয়েছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ স্যার। নৈলে কিসের বেসিসে পুলিশের সাহায্য চাইব?
কর্নেল কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর বললেন, পাইকপাড়ায় আপনার নিজের বাড়ি, নাকি ভাড়াবাড়িতে থাকেন?
ভাড়া বাড়ি। একখানা মোটে ঘর। আমার ফ্যামিলি থাকে মেদিনীপুরের গ্রামে।
আপনি কত বছর শচীন্দ্রবাবুর ক্লার্কের কাজ করেছেন?
তা বছর দশেকের বেশি হবে।
বিরমডিহিতে কখনও গেছেন?
একবার গেছি। হরিচরণ স্মরণ করার ভঙ্গিতে বললেন,–বছর আষ্টেক আগে। শচীনবাবুর ফ্যামিলির সঙ্গে গিয়েছিলাম। খুব সুন্দর জায়গা স্যার! সিনসিনারি অপূর্ব! একটা লেক আছে পাহাড়ের মাথায়। আধখানা চাঁদের মতো দেখতে। তাই মুন লেক নাম।
ভোলাকে চিনতেন নিশ্চয়?
হরিচরণ মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। খুব চিনতাম। পরে ভোলাকে শচীনবাস বরমডিহির বাড়ির কেয়ারটেকার করেছিলেন। সে সেখানেই থাকত। অসুখবিসুখে মারা যায়। বলে টাইপিস্ট ভদ্রলোক একটু গম্ভীর হলেন। এক ওই বাড়িটা স্যার ভাল নয়।
কেন ভাল নয়।
বাড়িটার বদনাম ছিল। ভূতপ্রেতের ব্যাপার আর কী! রাতবিরেতে কী সৎ শব্দ হত। আমিও শুনেছি স্যার!
কী শব্দ শুনেছেন?
একটা ঘরে হাঁটাচলার শব্দ। গোঙানির শব্দ। যেন কেউ–মানে ঠিক। বোঝাতে পারব না। মরণাপন্ন মানুষের চাপা আর্তনাদ। কিংবা–
হরিচরণের মুখে ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। কর্নেল বললেন, আচ্ছা হরিচরণবাব, ওই বাড়িতে আপনি তো ভৌতিক শব্দ শুনেছেন। কিছু ভৌতিক ব্যাপার কি দেখেছেন?
দেখেছি স্যার! হরিচরণের মুখে আতঙ্কের ছাপ ফুটে উঠল। সেবার দিন দশেক ছিলাম ওখানে। এক রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কে যেন পাশের ঘরে গোঙাচ্ছে। তো এ শব্দ আগের রাত্রেও শুনেছিলাম। তাই সাহস করে উঠে পড়লাম। শব্দটা দোতলার একটা ঘর থেকে আসছিল। ওই ঘরে পুরনো আসবাবপত্র ঠাসা ছিল। দরজা খুলোম। তালা আটকানো ছিল না। তো আমার হাতে টর্চ। টর্চ জ্বেলেই দেখি, ওঃ, সে কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য!
কী দৃশ্য?
একটা রক্তমাখা লোক পড়ে গোঙাচ্ছে।
তারপর?
হরিচরণ শ্বাস ছেড়ে বললেন, কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! এক পলকের দেখা। তারপর দেখি কিছু নেই। তক্ষুণি দরজা বন্ধ করে কাঁপতে কাঁপতে ফিরে এলাম। ওঃ।
এ কথা কাউকে বলেছিলেন?
না স্যার! হেসে উড়িয়ে দেবে বা আমাকে ভীতু বলবে বলে কাউকে বলিনি। আর উঁকিলবাবুর যা মেজাজ! ওঁর বাড়িতে ভূতের বদনাম সহ্য করতে পারতেন না। বলতেন, সব তরুণের চক্রান্ত! এখন আমি যদি ওঁকে বলি, রাত্রে ওই ঘরে রক্তাক্ত বডি দেখেছি, তাহলে কী হত ভাবুন!
আমি উসখুস করছিলাম। কর্নেল আমার দিকে চোখ কটমটিয়ে তাকালেন। বললেন, ঠিক আছে হরিচরণবাবু! আমরা ওবেলা আপনার বাসায় যাব। খুঁজে দেখা দরকার, সত্যি শ্যামবাবু আপনার ঘরে কোনও কালো নোটবই রেখে গেছেন কি না।
আমি খুঁজে দেখেছি স্যার। পাইনি। তবে আপনার চোখ। আপনি ঠিকই বলেছেন। আপনিও খুঁজে দেখবেন। তাহলে উঠি স্যার! আমার প্রাণ আপনার হাতে। অনুগ্রহ করে–
কর্নেল আশ্বাস দিয়ে বললেন, ভাববেন না। আমি আপনাকে সাহায্য করব। আপনার নাম-ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যান। বিকেল চারটে-সাড়ে চারটে নাগাদ আমরা যাব।
হরিচরণ পকেট থেকে একটা ছাপানো নেমকার্ড বের করে দিলেন। তারপর নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
কর্নেল কার্ডটা দেখতে দেখতে বললেন, ভদ্রলোক রীতিমতো পেশাদার। তলায় ইংরেজিতে লেখা আছে, সবরকম আইন-আদালত সংক্রান্ত দলিলপত্র টাইপ করা হয়।
চাপা উত্তেজনায় অস্থির ছিলাম। বললাম, এই ভদ্রলোকও রক্তাক্ত বডি দেখেছিলেন। আমরাও দেখেছি। তারপর পুলিশ গিয়ে কিছু খুঁজে পায়নি। এরপরও কি আপনি বলবেন ব্যাপারটা ভৌতিক নয়?
কর্নেল টাকে হাত বুলিয়ে একটু হাসলেন। ভৌতিকই মনে হচ্ছে, তবে কালো রঙের নোটবইটা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। আর এই উড়ো চিঠিটার ভাষা লক্ষ্য করেছ?
চিঠিতে কোনও বৈশিষ্ট্য নেই। সাদামাঠা চিঠি।
ঠিক। কিন্তু–কর্নেল আবার চিঠিটা পড়লেন। পড়ার পর বললেন, নাহ্। ঠিক নয়। উনি জোরে মাথা নেড়ে বললেন ফের, চিঠিটার বৈশিষ্ট্য আছে। একেবারে মৌখিক ভাষার চালে লেখা। দেখ জয়ন্ত, লিখিত ভাষা এবং মৌখিক ভাষার মধ্যে তফাত আছে। সাধারণত আমরা যখন চিঠি লিখি, তখন কলমের ডগায় ভাষার শব্দচয়ন একরকম এবং মুখে কথা বলি যখন, তখন অন্যরকম। যাঁরা পেশাদার লোক তারাও এর ব্যতিক্রম নন। এই চিঠিটা যেন চিঠি নয়, মুখোমুখি কথা বলা। কর্নেল চোখ বুজে গুম হয়ে গেলেন। কামড়ানো চুরুটের নীল ধোঁয়া ওঁর টাকের ওপর দিয়ে পেঁচিয়ে উঠল এবং সাদা দাড়িতে এক টুকরো ছাই খসে পড়ল।…
০৩. শব্দক্রীড়া এবং অদ্ভুত প্রশ্ন
হরিচরণ গাঙ্গুলির বাসা একটা আঁকাবাঁকা গলির শেষপ্রান্তে। পিছনে একটা খাটাল এবং বস্তি এলাকা। বাড়িটা দোতলা। পাশে একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুরে কচুরিপানা ভর্তি। বিকেলেই মশার প্রচণ্ড উৎপাত।
যে সময়ের কথা বলছি, তখনও এদিকটায় পোমোটারদের নজর পড়েনি। দোতলা বাড়িটার আশেপাশে অনেক একতলা বাড়ি। কোনওটা পুরনো, কোনওটা নতুন। এ বাড়িটা পুরনো। একতলায় একটা প্রেস, মুদির দোকান, পাউs বিস্কুটের দোকান কয়লার ডিপো এইসব।
টাইপিস্ট ভদ্রলোক নিচেই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেখে শশব্যস্তে অভ্যর্থনা করে দোতলায় নিয়ে গেলেন। ঘরে সাধারণ আসবাব। টেবিলে একটা পোর্টবল টাইপরাইটার কভারে ঢাকা। অনেক কাগজপত্রও লক্ষ্য করলাম। বোঝা গেল, বাড়িতেও টাইপের কাজকর্ম করেন।
হরিবাবু বন্ধ জানালা দেখিয়ে বললেন, বড় মশা। তাই জানালা বন্ধ করে রাখি। এখনই কী উৎপাত দেখুন! এমন সাংঘাতিক মশা স্যার, বিষাক্ত ওষুধ স্প্রে করেও কাজ হয় না।
তিনি ঘরে আলো জ্বেলে দিলেন। কর্নেল ঘরের ভেতরটা খুঁটিয়ে দেখছিলেন। বললেন, শ্যামবাবুর কোনও ফোটো নেই আপনার কাছে?
দেয়ালে কয়েকটা বাঁধানো ফোটো ঝুলছিল। হরিবাবু বললেন, না স্যার। ওগুলো আমার ফ্যামিলির ছবি। তবে ওই ছবিটা বরমডিহির মুনলেকের ধারে শচীনবাবুর ফ্যামিলির সঙ্গে তোলা আমার ছবি।
কর্নেল সেই ছবিটার কাছে গেলেন। দেখতে দেখতে বললেন, ভোলা নেই এর মধ্যে?
ওই লোকটা ভোলা স্যার!
রোগা বেঁটে এবং ফো একটা লোক একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কাঁচুমাচু হাসি। পরনে হাতকাটা ফতুয়া এবং খাটো ধুতি। পুরাতন ভৃত্যমার্কা চেহারা। আমরা ঝড়বৃষ্টির সন্ধ্যায় যে ভোলাকে দেখেছিলাম, সে শক্তসমর্থ গড়নের। সে এই ছবির ভোলা নয়। আর অ্যাডভোকেট ভদ্রলোকের তাগড়াই চেহারা। চেহারায় আভিজাত্য ঠিকরে বেরুচ্ছে, যদিও ছবিটা পুরনো। হরিবাবু তার পেছনে। পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। প্রায় আট বছর আগে ভোলা গ্রুপ ফোটো। তবু হরিবাবুকে চেনা যাচ্ছে।
মোট চারটে ছবি। ঝুল জমে আছে। আর একটা ছবি রাধাকৃষ্ণের। কর্নেল সেটার কাছে গেলে হরিবাবু বললেন, শচীনবাবুদের গৃহদেবতার ফোটো স্যার! ওঁদের ভবানীপুরের বাড়ির ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠিত। শচীনবাবুর ইচ্ছে ছিল, শেষজীবনে বরমডিহিতে গিয়ে কাটাবেন। এই বিগ্রহ সেখানে নিয়ে যাবেন। কিন্তু বৈমাত্রেয় ভাইয়ের সঙ্গে মামলা বেধে গেল।
রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহের ছবির নীচের দেওয়ালে সিঁদুরের ছোপ এবং কালো দাগ দেখে বোঝা গেল হরিবাবু ভক্তিমান। তিনি নিশ্চয় কোর্টে যাওয়ার আগে ধূপধুনো জ্বেলে প্রণাম করে তবে বেরোন। কালো দাগগুলো ধূপকাঠিরই হবে।
কর্নেল বললেন, শ্যামবাবু এসে শুতেন কোথায়?
মেঝেয় বিছানা করে দিতাম। মশারি কিনতে হয়েছিল ওর জন্য। যা মশা।
আপনি আপনার তক্তাপোশের তলা খুঁজেছেন?
তন্নতন্ন খুঁজেছি। আপনিও খুঁজে দেখুন। বলে হরিবাবু টর্চ বের করলেন।
থাক। বলে কর্নেল আবার বিগ্রহের ছবির কাছে গেলেন। ছবিটা আন্দাজ ৬ ফুট বাই ৪ ফুট সাইজের ফ্রেমে বাঁধানো। বললেন, এই ছবিটা নামাবেন একটু?
কে-কেন স্যার?
কর্নেল হাসলেন। আপনি ব্রাহ্মণ। এতে পাপ হবে না। ছবিটা নামান।
হরিবাবু ছবিটা সাবধানে দেওয়ালের পেরেক থেকে দুহাতে খুললেন। অমনই কালোরঙের ছোট্ট এবং পাতলা একটা নোটবই–ঠকাস করে পড়ে গেল নিচে।
কর্নেল সেটা দ্রুত কুড়িয়ে নিলেন। হবিবাবু চমকে উঠে বললেন, অ্যাঁ। এ কী!
আপনি সব ছবির ঝুল ঝাড়বেন বা পরিষ্কার করবেন, কিন্তু এটাতে হাত দেবেন না জেনেই শ্যামবাবু নোটবইটা এর আড়ালে লুকিয়ে রেখে গিয়েছিলেন।
হরিবাবু ছবিটা কপালে ঠেকিয়ে যথাস্থানে লটকে দিলেন। ধপাস করে বিছানায় বসে বললেন, শ্যামার কাণ্ড! ওঃ! আগে যদি জানতাম নোটবইটা ওখানেই আছে? তাছাড়া এইটুকু সাইজের নোটবই! আর আমি গঙ্গার ঘাটে বড় সাইজের কালো ডায়রি বই নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। এখন বুঝতে পারছি, বদমাইস লোকটা দূর থেকে দেখেই টের পেত–ওঃ।
উনি কপালে মৃদু থাপ্পড় মারলেন অনুশোচনায়। তারপর কেঁদেই ফেললেন। আমারই বুদ্ধির দোষে শ্যামার প্রাণটা বেঘারে গেছে। হায়! হায়! কেন আমি ওখানে খুঁজিনি?
কর্নেল সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যা হবার হয়ে গেছে। আপনি কীভাবে জানবেন একটা পবিত্র ছবির পেছনে এটা লুকোনো আছে? যাই হোক, আজ আমি এটা নিয়ে যাচ্ছি, আমার দেখা দরকার, এর মধ্যে কী আছে যে কোনও সাংঘাতিক লোকের এটা এতই দরকার এবং বেচারা শ্যামাবাবুকে এর জন্যই প্রাণ হারাতে হল? আপনি কাল সকালে কোর্টে যাওয়ার পথে এটা আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন। তারপর বলব, কী করা দরকার।
হরিবাবু চোখমুছে বললেন, কিন্তু স্যার! বদমাসটার শাস্তি হবে না? ওকে আপনি ছেড়ে দেবেন?
আপনিই বলেছেন, নোটবই যাকে দেবেন, তাকে ধরে ফেললে আপনি পরে বিপদে পড়তে পারেন। আপনার জীবন বিপন্ন হতে পারে।
না, না। ধরবেন না সঙ্গে সঙ্গে। তাকে ফলো করবেন। হরিবাবু চাপা গলায় বললেন, তাছাড়া এ-একটা রীতিমতো রহস্য স্যার। এই রহস্যের কিনারা করা কি উচিত নয়? মহীবাবু বলছিলেন, আপনি বিখ্যাত রহস্যভেদী।
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ। রহস্য আমাকে টানে। তবে সেটা পরের কথা। আপনাকে বাঁচিয়েই রহস্য ফাঁস করা উচিত কি না?
আজ্ঞে! ঠিক বলেছেন স্যার! আমি ছাপোষা মানুষ। দেশের বাড়িতে একদঙ্গল পুষ্যি।…
হরিবাবু চা খাওয়ার জন্য অনুরোধ করছিলেন। কর্নেল মশার উৎপাতের অজুহাত দেখিয়ে চলে এলেন। তবে এ-ও সত্যি, বিকেল যত ফুরিয়ে আসছিল, মশার অত্যাচারও তত বাড়ছিল। শীতে মশার উপদ্রব এমনিতেই বেড়ে যায়। তো এ একটা এঁদো জায়গা।
ইলিয়ট রোডে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। কর্নেল ষষ্ঠীকে কফি করতে বলে নোটবইটা নিয়ে বসলেন। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, শ্যামবাবুর ওয়ার্ডগেম খেলার অভ্যাস ছিল দেখছি। হুঁ, ক্রসওয়ার্ড পাজল। এ একটা বিচিত্র নেশা, জয়ন্ত! তবে এতে ভাষার শব্দজ্ঞান বাড়ে। বাহ! ভদ্রলোক রীতিমতো ইংরেজিতে পাকা ছিলেন। বোঝা যাচ্ছে, ইংরেজি পত্রিকায় ক্রসওয়ার্ড পাজ পাঠাতেন। অ্যাঁ? এটা তো ভারি অদ্ভুত!
কৌতূহলী হয়ে বললাম, দেখি! দেখি!
কর্নেল খুদে নোটবইটার একটা পাতা দেখালেন। তাতে একটা চৌকো ছকে এঁকে ইংরেজি অক্ষর লেখা।
G R A B
R A R E
A R T S
B E S T
বললাম, অসাধারণ! লম্বালম্বি বা পাশাপাশি পড়লেও চারটে একই শব্দ। গ্র্যাব, রেয়ার, আর্ট, বেস্ট। বলেই চমকে উঠলাম। কর্নেল! কিন্তু এই ইংরেজি শব্দগুলোর মানেতে কী যেন সংকেত আছে?
কী সংকেত?
উত্তেজিতভাবে বললাম, গ্রাব মানে–জোর করে দখল বা আত্মসাৎ করা। রেয়ার মানে–দুর্লভ, দুষ্প্রাপ্য। আর্টস–শিল্পকলা। সচরাচর চিত্রকলাই বোঝায়। বেস্ট সর্বোত্তম, সর্বোৎকৃষ্ট। তাহলে মোটামুটি মানে কী দাঁড়াচ্ছে দেখুন দুর্লভ এবং সর্বোৎকৃষ্ট চিত্রকলাগুলো আত্মসাৎ করো! তাই না?
ষষ্ঠীচরণ কফি দিয়ে গেল। কর্নেল তুম্বো মুখে বললেন, কফি খাও ডার্লিং! নার্ভ আরও চাঙ্গা হবে। আরও কিছু মানে বেরুতে পারে।
কফি খেতে খেতে নোটবইটার আরও পাতা ওল্টাচ্ছিলাম। কিন্তু ক্রসওয়ার্ড পাজল ছাড়া আর কিছু নেই। আবার ওই পাতাটায় মন দিলাম। বললাম নাহ। এটা নিশ্চয় কোনও প্রাচীন দুর্লভ ছবি হারানোর কেস। এর মধ্যে কোনও সংকেত অবশ্যই আছে। কিন্তু যে এই নোটবইটা হাতাতে চায়, সম্ভবত সে-ই তার মর্মোদ্ধার করতে পারে। বলে একটুখানি চিন্তাভাবনা করে নিলাম। আচ্ছা। কর্নেল! ইংরেজি হরফগুলো যদি সংখ্যার ভিত্তিতে সাজাই
ডার্লিং! তুমি ওয়ার্ডগেমের পাল্লায় পড়েছ। আজকাল বিদেশে কুইজ খুব চালু। সেই কুইজ!
ওঁর কথা গ্রাহ্য না করে আঙুল গুনে হিসেব করতে থাকলাম। বললাম, একটা কাগজ দিন। দেখি কী দাঁড়াচ্ছে।
কর্নেল টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্যাড বের করে দিলেন। আমি হিসেব করে একটা ছক সাজিয়ে ফেললাম ইংরেজি বর্ণমালার সংখ্যার ভিত্তিতে। এ-কে ১ ধরে ছকটা সাজালাম।
৭ ১৮ ১ ২
১৮ ১ ১৮ ৫
১ ১৮ ২০ ৫
২ ৫ ১৯ ২০
কর্নেলকে কাগজটা দেখিয়ে বললাম, লম্বালম্বি ধরলে ২৮, ৪২, ৫৮ এবং ৩২ পাচ্ছি। পাশাপাশি ধরলে ২৮, ৪২, ৪৪ এবং ৪৬ পাচ্ছি। এবার দেখুন ২৮+৪২+৫৮+৩২=১৬০দাঁড়াচ্ছে। আবার ২৮+৪২+৪৪+৪৬=১৬০ দাঁড়াচ্ছে। কর্নেল! লম্বালম্বি এবং পাশাপাশি যোগ দিলে দুদিকেই যোগফল ১৬০। এটা নিশ্চয় কোনও সংকেত!
কর্নেল কফিতে চুমুক দিয়ে শুধু বললেন, বাহ্!
আরও উৎসাহী হয়ে বললাম, এবার ইংরেজি অক্ষরগুলো দেখা যাক। এই ABEGRST ৭টা অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে।
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল বললেন, ফোনটা ধরো, জয়ন্ত!
টেলিফোন তুলে সাড়া দিতেই কেউ কড়া ধমক দিল, এই ব্যাটা বুড়ো ঘুঘু!
নোটবইটা কেন নিয়ে এসেছিস? হরিকে ফেরত না দিলে টাক ফুটো করে দেব। ব্যাটা ঘুঘু হয়েছ। ফাঁদ দেখনি?
তারপর লাইন কেটে গেল। টেলিফোন রেখে বললাম, হুমকি দিল কেউ।
কী হুমকি?
কথাগুলো বললাম। আমার হাত কাঁপছিল। কর্নেলকে পুলিশ মহলে আড়ালে ঠাট্টা করে বুড়ো ঘুঘু বলে। লোকটা দেখছি কর্নেলকে বিলক্ষণ চেনে এবং হরিবাবুকে ফলো করে এসেও থাকবে। আমাদের গতিবিধির দিকেও নজর রেখেছে। শীতের মধ্যে গায়ে ঘাম ঝরা গরম টের পাচ্ছিলাম।
কর্নেল হাসলেন। হুঁ। রহস্য ঘনীভূত বলা চলে। তবে তোমাকে ওয়ার্ডগেমের ভূতে পেয়েছে জয়ন্ত! সাবধান!
বললাম, ১৬০ নাম্বারটা কি কোনও সংকেত বলে মনে হচ্ছে না আপনার?
কর্নেল দাড়ি নেড়ে বললেন, । তারপর কফি শেষ করে চুরুট ধরালেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ চুরুট টানার পর টেলিফোনের দিকে হাত বাড়ালেন। একটা নাম্বার ডায়াল করে বললেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি। মিঃ মুখার্জিকে দিন না প্লিজ! মিঃ মুখার্জি? হ্যাঁ। আপনার সঙ্গে একটু জরুরি কথা আছে।…না। ফোনে বলা যাবে না। মুখোমুখি…ঠিক আছে। কাল সকালে ৯টায় যাচ্ছি। …ধন্যবাদ রাখছি।
কান খাড়া করে শুনছিলাম। বললাম, মিঃ মুখার্জি মানে কি সেই রিটায়ার্ড অ্যাডভোকেট শচীনবাবু?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। তুমি ইচ্ছে করলে সঙ্গী হতে পারো। না কি উড়োফোনের হুমকিতে ভয় পেয়ে গেছ?
বললাম আপনার সঙ্গে থাকলে যমরাজকেও ভয় পাই না!
কিন্তু তোমার মুখে অস্বস্তির ছাপ!
নাহ্। ও কিছু নয়।
তবে ডার্লিং! ওয়ার্ডগেমের ভূত তোমাকে একটা অঙ্ক উপহার দিয়েছে। সত্যি ওয়ার্ডগেমের ভূত আমাকে পেয়ে বসেছিল। বাড়ি ফিরে অনেক রাত্রি পর্যন্ত সেই ছকটা নিয়ে অনেক জল্পনা এবং আঁক কষাকষি চলেছিল। শেষে ক্লান্ত হয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সে-রাত্রে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম। খুনখারাপি, ভূতপ্রেত, আবার কখনও পরীক্ষার হলে বসে অঙ্কের পরীক্ষা দিচ্ছি কিন্তু কিছুতেই অঙ্ক কষতে পারছি না, এইসব দুঃস্বপ্ন।
সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে শুনলাম, কিছুক্ষণ আগেই হরিবাবু সেই কালো নোটবইটা নিয়ে গেছেন। কর্নেল আমার অপেক্ষা করছিলেন। আমরা ভবানীপুরে অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবীর বাড়ি রওনা হলাম।
বাড়িটা কলকাতার আর সব বনেদি অভিজাত বংশীয়দের বাড়ির মতো বিরাট। মস্ত গেট এবং সুদৃশ্য লন। চারদিকে উঁচু দেওয়াল ঘেরা আছে। মধ্যিখানে দোতলা পুরনো আমলের বিলিতি স্থাপত্য। বড় বড় থাম। ফুলবাগানে মর্মরমূর্তি।
একটা লোক আমাদের বসার ঘরে অপেক্ষা করতে বলে গেল। কর্নেল বললেন, শচীনবাবুর চেম্বার ছিল ওপাশের একটা আলাদা বাড়িতে। সেটা এখন নার্সিংহোম। এক ডাক্তারকে ভাড়া দিয়েছেন। শচীনবাবুর ছেলে নেই। এক মেয়ে। সে স্বামীর কাছে আমেরিকায় থাকে।
ভেতরকার দরজার পর্দা তুলে নাদুসনুদুস চেহারার এক ভদ্রলোক বেরুলেন। তার হাতে একটা ছড়ি। কর্নেল নমস্কার করে বললেন, আলাপ করিয়ে দিই। দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার রিপোর্টার জয়ন্ত চৌধুরি।
শচীনবাবু ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখে বললেন, খবরের কাগজের লোক সঙ্গে এনেছেন কেন কর্নেল সায়েব? পাবলিসিটি ব্যাপারটা আমি পছন্দ করি না।
কর্নেল হাসলেন। না না। ও আমার তরুণ বন্ধু। সময় পেলেই আমার সঙ্গী হয়।
যাক গে। বলুন কী ব্যাপার! বলে আইনজীবী বসলেন। মনে হল বাতের অসুখে ভুগছেন। একটা পা ছড়িয়ে দিলেন। গায়ে গলাবন্ধ লম্বা কোট। মাথায় মাফলার জড়ানো এবং পরনে পাজামা। পায়ে মোজা ও পামসু।
কর্নেল বললেন, হরিচরণ গাঙ্গুলি নামে কেউ একসময় আপনার ক্লার্ক ছিলেন?
হরি? আইনজীবী নিস্পলক চোখে তাকালেন। হরির আবার কী হল? শুনেছি, সে তো এখন আলিপুর কোর্ট চত্বরে বসে টাইপ করে। ভালই কামায়।
মিঃ মুখার্জি! উনি আপনার ক্লার্ক ছিলেন কি না জানতে চাইছি।
ছিল। কিন্তু কেন জানতে চাইছেন?
ওঁকে কি আপনি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছিলেন, নাকি উনি নিজে থেকেই কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন?
শচীনবাবু একটু গুম হয়ে থাকার পর বললেন, ছাড়িয়ে দিয়েছিলাম। প্র্যাকটিস ছেড়ে দিলেও ওকে রাখতাম। অন্য কাজ অনেক ছিল। করাতাম! কিন্তু আমার ঠাকুরঘর থেকে বিগ্রহ চুরি গেল। যাকে-যাকে সন্দেহ হয়েছিল, হরি তাদের একজন।
কী বিগ্রহ?
রাধা-কৃষ্ণ। বলে শচীনবাবু কপালে দুহাত জোড় করে ঠেকালেন। গাঢ় স্বরে ফের বললেন, বংশের প্রাচীন বিগ্রহ। আমরা পুরুষানুক্রমে বৈষ্ণব। পাঁচশো বছরের প্রাচীন বিগ্রহ স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের হাত থেকে আমার পূর্বপুরুষ আশীর্বাদ স্বরূপ পেয়েছিলেন।
কোনও রত্ন ছিল বিগ্রহে?
ছিল। বাজারদরের কথা যদি ধরেন, তবে তার দাম তত কিছু নয়। কিন্তু যদি ইতিহাস এবং আর্টের প্রশ্ন তোলেন, বলব–ওই বিগ্রহ দুর্লভ।
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, রেয়ার আর্ট?
শচীনবাবু সঙ্গে সঙ্গে বললেন, রেয়ার আর্ট কী বলছেন? রেয়ারেস্ট আর্ট!
বেস্ট!
অ্যাঁ? শচীনবাবু রুষ্ট মুখে আমার দিকে তাকালেন।
কর্নেল দ্রুত বললেন, আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, আপনারা ব্রাহ্মণ। তো আপনি ৪ নিজেই পুজো করতেন, নাকি পুজোর জন্য সেবায়েত ঠাকুর রেখেছিলেন?
শচীনবাবু অন্যমনস্কভাবে বললেন, আমি মশাই কোর্টকাছারি করতাম। ওকালতি পেশা। মিথ্যাকে সত্য, আবার সত্যকে মিথ্যা করা ছিল আমার কারবার। আমি স্পষ্ট কথা পছন্দ করি। নিজে পুজোর মতো পবিত্র কর্ম করতে সংকোচ হত তাই ঠাকুর রেখেছিলাম। বংশের আরাধ্য বিগ্রহের সেবা-যত্ন, তারপর দোল বা রাসপূর্ণিমা ইত্যাদির বাৎসরিক সব অনুষ্ঠান ঠাকুরমশাই-ই সামলাতেন। আমার অত সময়ই বা কোথায়?
বিগ্রহ কীভাবে চুরি গিয়েছিল?
ঠাকুরঘরের তালা ভেঙে চোর ঢুকেছিল। ভোরে গঙ্গাস্নান করতে যাওয়ার সময় ঠাকুরমশাই দেখেন দরজার তালা ভাঙা। ভেতরে বিগ্রহ নেই। পুলিশ এল। বাড়ির লোকজন বলতে আমি, আমার স্ত্রী, একমাত্র মেয়ে, এবং কর্মচারী ঝি-চাকর-দারোয়ান এরা। পুলিশ জেরা করে চলে গেল। সন্দেহ করার মতো কাউকে পায়নি। সেই রাত্রে ঠাকুরমশাই মনের দুঃখে আত্মহত্যা করেছিলেন। শচীনবাবু ভিজে কণ্ঠস্বরে বললেন, একটু পাগলাটে সাধকটাইপ লোক ছিলেন। তো হরি যদিও রাত্রে পাইকপাড়ায় নিজের বাসায় থাকত, আমার কেন যেন তার ওপরেও সন্দেহ হয়েছিল। এত বছর পরে আর মনে নেই কেন ওকে সন্দেহ করেছিলাম।
আপনি ওঁর মামাতো ভাই শ্যামসুন্দরকে চিনতেন?
নামটা চেনা ঠেকছে। শ্যামসুন্দর–বলে শচীনবাবু কিছুক্ষণ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, হরি মাঝে মাঝে তার এক আত্মীয়কে এনে চাকরির জন্য সুপারিশ করত মনে পড়ছে। সে-ই কি?
আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, হরিবাবুর এ বাড়িতে গতিবিধি কি অবাধ ছিল?
তা ছিল। আমার কর্মচারীদের আমি নিজের ফ্যামিলির লোক মনে করতাম। এখনও করি। এখন অবশ্য আর অত লোক নেই। দরকারও হয় না।
হরিবাবু তার সেই আত্মীয়কে নিয়ে এ বাড়ি আসতেন কি?
এসে থাকবে। মনে নেই।
কেন হরিবাবুকে সন্দেহ হয়েছিল, মনে পড়ছে না?
শচীনবাবু নড়ে বসলেন। ও! হ্যাঁ। আমার এক কর্মচারী আমার বৈমাত্রেয় ভাই তরুণের বাড়ি থেকে হরিকে বেরুতে দেখেছিল। বিগ্রহ চুরির কিছুদিন আগে। পুলিশ তরুণকে জেরা করেছিল। তরুণ বলেছিল, হরিহ্যাঁ, ওর সেই আত্মীয়ের চাকরির জন্য নাকি গিয়েছিল। তবে আজও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তরুণই বিগ্রহ চুরি করিয়েছিল। ওর মতো বদমাইস আর দুটি নেই। দেশবিদেশে ব্যবসা করে। বিদেশে ওই বিগ্রহ বেচে বহু টাকা দাম পেয়েছে। জানেন? তরুণ দুনম্বরি ব্যবসা করে। নিষিদ্ধ মাদক। বুঝলেন? আমি ওকে এবার ধরিয়ে দেব। জেল খাঁটিয়ে ছাড়ব।
মিঃ মুখার্জি, হরিবাবুর নাকের বাঁ পাশে কি প্রকাণ্ড জডুল ছিল?
আইনজীবী হঠাৎ এই প্রশ্নে খাপ্পা হয়ে গেলেন। আপনি ও মাসে এসে আমার বরমডিহির বাড়ি সম্পর্কে একটা ভুতুড়ে গল্প ফেঁদে গেলেন। আজ এসে আবার হাজারটা প্রশ্ন।
প্লিজ মিঃ মুখার্জি–
শচীনবাবু মুখ বিকৃত করে বললেন, হরির নাকের পাশের জঙুল নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন? হঠাৎ জডুলের কথা আসছে কোথা থেকে, বুঝি না।
তাহলে ছিল?
জডুলটা বিচ্ছিরি দেখাত বলে বলতাম, অপারেশন করে নিও। নিয়েছে কি কে জানে?
অপারেশন করে নিয়েছেন।
তা হঠাৎ জডুল নিয়ে পড়লেন কেন? হরিকে আপনি চিনলেন কী করে?
কর্নেল হাসলেন। আলিপুর কোর্টে আমার এক আত্মীয়ের একটা মামলা চলছে। সেই সূত্রে আলাপ হয়েছে হরিবাবুর সঙ্গে। টাইপিস্টের কাজ করেন। কথায় কথায় বলছিলেন, আপনার ক্লার্ক ছিলেন।
আমার নিন্দে করছিল নাকি?
না, না। খুব সুখ্যাতি করছিলেন।
আইনজীবীর মুখ দেখে মনে হল, কথাটা বিশ্বাস করলেন না। বললেন, যাক গে। আপনার আসার আসল উদ্দেশ্য কী, এবার খুলে বলুন। আমি স্পষ্ট কথা ভালবাসি। আপনি কর্নেল সায়েব বলেই এতক্ষণ কথা বলছি। একজন পরিচারক এতক্ষণে চায়ের ট্রে আনল। আইনজীবী খেঁকিয়ে উঠলেন, তোদের চৌদ্দ মাসে বছর! দুকাপ চা করতেই–নিন কর্নেল সায়েব! চা খান। কিছু মনে করবেন না। মাঝে মাঝে আমার মেজাজ কেমন বিগড়ে যায় আজকাল। কীভাবে যে বেঁচে আছি! একে বাঁচা বলে?
ভদ্রলোকের কথাবার্তার ভঙ্গি দেখে আমারও মেজাজ বিগড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কর্নেলের দেখাদেখি চায়ের কাপ হাতে নিতে হল। তাছাড়া বিগ্রহ চুরির ঘটনা সেই কালো নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেমের সঙ্গে জড়িয়ে রহস্য সত্যিই ঘনীভূত হয়ে উঠেছে এবার।
কর্নেল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, আপনার ঠাকুরঘর থেকে ঐতিহাসিক পবিত্র বিগ্রহ চুরি গিয়েছিল। পুলিশ তা আজ পর্যন্ত উদ্ধার করে দিতে পারেনি। আমার মনে হচ্ছে, বিগ্রহ এখনও বিদেশে পাচার হয়নি। কোথাও তা লুকানো আছে। যদি আপনি এই প্রশ্নটার উত্তর সঠিক দেন, তাহলে আমি হয়তো বিগ্রহ উদ্ধার করে দিতে পারব।
শচীনবাবু ভুরু কুঁচকে তাকালেন কর্নেলের দিকে। আপনি তো নেচারিস্ট। আপনার কার্ডে লেখা আছে কথাটা। তা আপনি ভেতর-ভেতর গোয়েন্দগিরিও করেন বলে সন্দেহ হচ্ছে?
না মিঃ মুখার্জি। আমি মাঝে মাঝে কোনও রহস্যের সঙ্গে জড়িয়ে গেলে সেই রহস্য ফাঁস করতে উঠে পড়ে লাগি। আমার এ-ও একটা হবি বলতে পারেন।
বিগ্রহ চুরিতে রহস্য কোথায় মশাই? স্রেফ চুরি। ওই তরুণের কীর্তি!
আপনার বরমডিহির বাড়িতে যে ঘটনার কথা বলেছিলাম,আমার ধারণা তার সঙ্গে আপনার বিগ্রহ চুরির যোগসূত্র আছে।
অ্যাঁ! বলেন কী?
আপনি আমাকে এবার এই প্রশ্নের উত্তর দিন।
বলুন!
বিগ্রহ কি আপনি বৈমাত্রেয় ভাই তরুণকে ফাঁসানোর জন্য নিজেই চরি করে–
আইনজীবী ফ্যাঁসফেঁসে গলায় আর্তনাদের সুরে চেঁচিয়ে উঠলেন, বেরিয়ে যান আপনারা! গেট আউট ফ্রম মাই হাউস! বেরিয়ে যান বলছি! নইলে দারোয়ান ডেকে বের করে দেব।
কর্নেল তুম্বো মুখে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। আমি যে ওঁকে অনুসরণ করলাম তা বলা নিষ্প্রয়োজন।…
০৪. জড়ুল এবং বিগ্রহ
রাস্তায় গিয়ে বললাম, হঠাৎ উঁকিল ভদ্রলোককে ওই অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন কেন?
কর্নেল একটু হেসে বললেন, গ্র্যাব রেয়ার আর্টস্ বেস্ট।
ভ্যাট! খালি হেঁয়ালি করা অভ্যাস আপনার।
ওয়ার্ডগেম ডার্লিং, ওয়ার্ডগেম!
কথা বললে আরও হেঁয়ালি বাড়বে। তাই চুপ করে গেলাম। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ট্যাক্সির কাছে গিয়ে কর্নেল বললেন, আলিপুর কোর্ট। যাবেন নাকি?
ট্যাক্সি ড্রাইভাররা, বরাবর দেখে আসছি, কর্নেলের কথায় না করে না। পাদরিসুলভ চেহারার জন্য, কিংবা বিদেশি সায়েবের দেশি নমুনায় বশীভূত হয় কি না কে জানে!
আলিপুর কোর্ট চত্বরে নেমে কর্নেল পকেট থেকে হরিবাবুর সেই কার্ডটা বের করে দেখে নিলেন। তারপর হাঁটতে শুরু করলেন। ভিড়ে ভরা সংকীর্ণ রাস্তা, পাশে একটা ড্রেন। একটা ঝাকড়া গাছের তলায় তেরপল টাঙানো ছিল। সেখানে একটা টেবিল-চেয়ার এবং টেবিলে একটা ছোট্ট টাইপ রাইটার। কর্নেল সেখানে দাঁড়ালে এক তরুণ ছুটে এল। হরিকাকুকে খুঁজছেন স্যার? হোটেলে এক্ষুনি খেতে গেলেন। এসে পড়বেন শিগগির। একটু ওয়েট করুন।
কর্নেল বললেন, তুমি কি হরিবাবুর অ্যাসিস্ট্যান্ট নাকি?
আমি স্যার এখানে সবাইকে হেলপ করি।
কী হেল্প করো?
হেলপ্ বোঝেন না স্যার?
কর্নেল হাসলেন। বুঝলাম। কিন্তু ধরো, আমার হঠাৎ এখনই একটা চিঠি লেখানোর দরকার। তুমি কি হেল্প করতে পারবে?
ওই তো মাখনদা টাইপ করছে। চলুন ওখানে।
নাহ্। আমার বাংলায় একটা চিঠি লেখাতে হবে।
এখানে তো বাংলায় টাইপ হয় না স্যার! নাকি হয়–দাঁড়ান, জিজ্ঞেস করে আসি।
হাতের লেখাই চলবে। খুলে বলি। তা হলেই বুঝবে। কর্নেল আমাকে দেখিয়ে বললেন, এই ভদ্রলোক অবাঙালি ব্যবসায়ী। ইংরেজিও ভাল জানেন না। তা না হলে এঁকে দিয়েই লেখাতাম। একটু বুঝিয়ে লিখতে হবে। আর এই দেখ, আমার হাতের অসুখ। সব সময় খালি কঁপে।
কর্নেলের হাতের কাঁপুনি দেখে আমি হতবাক।
স্মার্ট তরুণটি বলল, খামে না পোস্টকার্ডে না ইনল্যান্ডে?
কর্নেল কাঁপা কাঁপা হাতে পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড বের করে দিলেন। বললেন, আমার কাজের লোক বিষ্ণু দেশে গেছে। খুব অসুবিধে হচ্ছে। শিগগির আসতে লেখ। এমন করে লিখতে হবে যেন চিঠি পেয়েই চলে আসে। একটু তাড়াতাড়ি করতে হবে ভাই। ওই পোস্ট অফিসে পোস্ট করে চলে যাব। ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
তরুণটি তক্ষুনি পোস্টকার্ডে দ্রুত কলম চালাল। এক মিনিটেই এক পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেলল। পরে পৃষ্ঠায় আধমিনিট। তারপর চোখ নাচিয়ে বলল, এমন লিখলাম স্যার, চিঠি পেয়েই–হুঁ। ইতি–আপনার নাম বলুন।
শিবপদ মজুমদার, ব্যস! আর কিছু না। ঠিকানা লেখো : বিষ্টুচরণ ধাড়া। গ্রাম আর পোস্ট অফিস গোবিন্দপুর। জেলা বর্ধমান। পিনকোড জানি না।
পোস্টকার্ড নিয়ে কর্নেল তাকে একটা পাঁচটাকার নোট দিলেন। সে টাকা পকেটস্থ করে বলল, হরিকাকু জানতে পারলে রাগ করবে। আপনারা কেটে পড়ুন স্যার। ওর আসার সময় হয়ে গেল।
তুমি হরিবাবুকে কিছু বলবে না। তা হলেই হল।
আমার মাথা খারাপ?
কর্নেল হন্তদন্ত ড্রেন ডিঙিয়ে চলতে থাকলেন। তারপর একটা ট্যাক্সিও ৪ গেল। ট্যাক্সিতে চেপে বললাম, ব্যাপারটা কী?
কর্নেল মিটিমিটি হেসে বললেন, দৈবাৎ একটা চান্স পেয়ে গেলে ছাড়ি না। তবে আমি ঠিক এটাই ভেবে রেখেছিলাম। কোর্ট এলাকা বড় বিচিত্র, জয়ত। কত রকমের পেশার লোক ঘুরে বেড়ায়।
হেঁয়ালি শুনে চুপ করে গেলাম। কর্নেল পোস্টকার্ডে মন দিয়েছেন।
ইলিয়ট রোডের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল বললেন, এ বেলা আমার এখানে তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন। বিকেলে দুজনে একসঙ্গে একবার বেরুব। কিন্তু না, কোনও প্রশ্ন কোরো না। শুধু চুপচাপ দেখে যাও। কেমন?
কর্নেল আমার কাধ চাপড়ে দিলেন। তারপর টেবিলের ড্রয়ার খুলে হরিবাবুকে লেখা লালকালির সেই চিঠিটা বের করে পোস্টকার্ডের লেখার পাশে রাখলেন। হাতে আতসকাঁচ। একটু পরে বললেন, ওই ছোকরা দারুণ চৌকস। হুমকি দেওয়া চিঠিটা ওর হাতেরই লেখা। খামের ঠিকানা অন্য কারও হাতের লেখা। যে হরিবাবুকে হুমকি দেওয়া চিঠিটা ওই ছোকরাকে দিয়ে লিখিয়েছে, সে খুব। সতর্ক। তাই হরিবাবুর ঠিকানাটা নিজের হাতে লিখেছে। পুলিশ যদি হাতের লেখা সনাক্ত করে শেষ পর্যন্ত ছোকরাটিকে পাকড়াও করে, বিপদটা ওর ঘাড় দিয়েই যাওয়ার চান্স ছিল। কিন্তু শেষমেশ হতটা কী? ছোকরাটির তো ওই ধরনেরই পেশা। তবে দেখ জয়ন্ত, ছোকরা বলা মানে গাল দেওয়া। ছেলেটি ভাল বাংলা লেখে। হয়তো খুব গরিব বলে বেশি লেখাপড়ার চান্স পায়নি। কিন্তু চলতি বাংলা চমৎকার আসে ওর হাত দিয়ে। ইচ্ছে করলে ছেলেটি লেখক হতে পারত এবং তোমার চেয়ে অনেক ভাল গদ্য লিখত, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
গম্ভীর হয়ে বললাম, আমি কোনও প্রশ্ন করব না কিন্তু। আপনার নির্দেশ।
আমিই তোমার হয়ে প্রশ্ন তুলছি। ছেলেটি হরিবাবুকে কাকু বলে। তাকে হুমকি দেওয়া চিঠি সে লিখল কেন? এর উত্তর হল, চিঠিতে কাকেও সম্ভাষণ করা হয়নি। কাজেই চিঠিটা যে হরিবাবুকে লেখা হচ্ছে, ছেলেটি জানত না। প্রশ্ন উঠবে, ছেলেটি এমন চিঠি লিখতে রাজি হল কেন? না–ছেলেটি জানে কোর্টের পরিবেশে ক্রিমিন্যালরাও ঘোরাফেরা করে। দ্বিতীয়ত, ছেলেটির টাকার দরকার। ওই পরিবেশটাই টাকা রোজগারের নানা ধান্দা-সুযোগ সামনে এনে দেয়। সেই সুযোগ যারা ওখানে ঘোরাফেরা করে, তারা ছাড়ে না। ছেলেটিও ছাড়েনি।
এবার বললাম, ছেলেটি আপনার কেসে মূল্যবান সূত্র।
হ্যাঁ। তবে এখন এই সূত্রের দিকে আমি হাঁটছি না। কর্নেল ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, তোমার প্রশ্ন ছিল, শচীন্দ্রলাল মুখার্জি নিজের বৈমাত্রেয় ভাইকে চুরির দায়ে ফাঁসানোর জন্য যে বিগ্রহ চুরি করেছিলেন, তা আমি জানলাম কী করে? বিগ্রহ চুরির কথা আমি জানতাম না। তা শোনার পর আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে ওঁর প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেয়েছিলাম।
কী বুঝলেন?
ওঁর ক্ষতস্থানে আঘাত করেছি। চিন্তা করো জয়ন্ত! আফটার অল, আমি। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমার এই চেহারা এবং ব্যক্তিত্বনা, হেসো না, তুমি বাস্তবতার দিক থেকে চিন্তা করেযতই বদরাগী এবং দুদে আইনজীবী হোন কিংবা অভিজাতবংশীয় হোন, কোনও ভদ্রলোক ওই ভঙ্গিতে অভদ্রভাবে আমাকে বেরিয়ে যেতে বা দারোয়ান ডেকে বের করে দেওয়ার কথা তৎক্ষণাৎ মুখ দিয়ে উচ্চারণ করবেন না। তর্ক করতেন ক্রুদ্ধভাবে। কিংবা আমাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমি কথাটা শেষ না করতেই উনি হিংস্র হয়ে উঠলেন। তার মানে, আমার মুখোমুখি আর একমুহূর্ত বসে থাকার ক্ষমতা ওঁর ছিল না। আমি সাধারণ মানুষ হলে অন্য কথা ছিল। কিন্তু আমি কর্নেল নীলাদ্রি সরকার। আমি উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার ছিলাম। আমাকে–
হ্যাঁ। আপনার কথায় যুক্তি আছে।
এবার আমার থিওরি হল, শচীনবাবু বিগ্রহ নিজেই চুরি করে কোনও বিশ্বস্ত লোকের হাত দিয়ে তরুণবাবুর বাড়িতে পাচার করেই পুলিশে খবর দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্বস্ত লোকটির হাত থেকে বিগ্রহ অন্য হাতে চলে যায়। কিংবা এমনও হতে পারে সেই লোকটিই বিগ্রহ আত্মসাৎ করে মিথ্যা কথা বলে শচীনবাবুকে। ক্রুদ্ধ শচীনবাবু তাকে বরখাস্ত করে তাড়িয়ে দেন।
হরিবাবু সেই বিশ্বস্ত লোক নন তো?
এক্ষেত্রে সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ বলা চলে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে হরিবাবুকে কেউ হুমকি দিয়ে শ্যামবাবুর নোটবই চাইছে। তার মানে, হরিবাবুর হাত থেকে শ্যামবাবু তা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়েছিলেন। কিন্তু এ পর্যন্ত কোনও কারণে বেচতে পারেননি। লুকিয়ে রেখেছেন।
কর্নেল বললেন, হুঁ, বলে যাও!
তাহলে নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেমে এমন কোনও সংকেত আছে, যা থেকে শ্যামবাবুর লুকিয়ে রাখা বিগ্রহের খোঁজ মিলবে। এবার কিন্তু তৃতীয় একটি পার্টি এসে যাচ্ছে।
আসছে বটে! কর্নেল হঠাৎ হেসে উঠলেন। ওয়ার্ডগেম ছেড়ে এখন আমরা থিওরিগেম বা তত্ত্বক্রীড়ায় রত হয়েছি। বাজে জল্পনা ডার্লিং, জল্পনা! বলে হাঁক দিলেন, ষষ্ঠী! আমরা খেতে বসব।
ষষ্ঠী পর্দার ফাঁকে মুখ বাড়িয়ে বলল, সব রেডি বাবামশাই!…
খাওয়ার পর ভাতঘুম আমার বহু বছরের অভ্যাস। ডিভানে লম্বা হয়েছিলাম। কর্নেল ইজিচেয়ারে বসে একটা গাদা বইয়ের পাতায় মনোনিবেশ করেছিলেন। কতক্ষণ পরে কর্নেলের ডাকে উঠে বসলাম। সাড়ে তিনটে বাজে। শীতের দিনে সাড়ে তিনটে মানে বিকেল। উঠে পড়ো। গরম কফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নাও। একটু পরে বেরুব।
ষষ্ঠী কফির ট্রে রেখে গিয়েছিল। কর্নেল কফি তৈরি করে আমাকে দিলেন। নিজেরটা তৈরি করে চুমুক দিয়ে বললেন, বরমডিহিতে দেখা সেই তুর্কি ঘোড়সওয়ার সম্পর্কে কিছু তথ্য পেলাম।
সেই অলক্ষুণে প্রজাপতিটা?
অলক্ষুণে কী বলছ ডার্লিং! মধ্যএশিয়ার এই প্রজাতির প্রজাপতি এদেশে আমদানি করেছিলেন স্বয়ং মুগল বাদশাহ্ জাহাঙ্গির। তার একটা চিড়িয়াখানা ছিল। ফুল বাগিচায় ওই প্রজাপতি–
কর্নেলের কথা শেষ হল না। ডোরবেল বাজল। একটু পরে ষষ্ঠীর পাশ কাটিয়ে হরিবাবু ঘরে ঢুকলেন। ধপাস করে সোফার কোনায় বসে ফোঁস করে শাস ফেলে বললেন, নিয়ে গেল স্যার! ওঃ! কী বাঁচা যে বাঁচলাম। আপনাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে আজ সকাল-সকাল চলে এলাম কাজ ছেড়ে।
কর্নেল বললেন, নোটবইটা?
আজ্ঞে! লোকটার চেহারা স্যার একবারে মস্তানমার্কা। এন বি এনেছ বলমাত্র হাতে তুলে দিলাম। চলে গেল। সাহস করে মুখ তুলে তাকাতে পারিনি। পেছনটা দেখেছি। ওঃ! কী বাঁচা বাঁচলাম ঠাকুরই জানেন!
কর্নেল হাঁকলেন, ষষ্ঠী! একটা পেয়ালা দিয়ে যা। গেস্ট এসেছেন। একটুখানি খান হরিবাবু! উত্তেজনা দূর হবে। নার্ভ চাঙ্গা হবে।
হরিবাবু রুমাল বের করে মুখ মুছলেন। ষষ্ঠী একটা পেয়ালা দিয়ে গেল। কর্নেল পট থেকে কফি ঢেলে দুধ চিনি মিশিয়ে ওঁর হাতে তুলে দিলেন। হরিবাবু চুমুক দিয়ে বললেন, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব স্যার! আচ্ছা হরিবাবু, রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ আপনার হাতছাড়া হয়েছিল কীভাবে?
হরিবাবু চমকে উঠলেন। গলায় কফি আটকে কাশতে শুরু করলেন। চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসছিল। সামলে নিয়ে বললেন, বি-বিগ্রহ স্যার?।
হ্যাঁ। অ্যাডভোকেট শচীনবাবু আপনাকে বিগ্রহ তরুণবাবুর বাড়িতে কোথাও লুকিয়ে রেখে আসতে বলেছিলেন। কর্নেল হাসলেন। নানা। লুকোবার কিছু নেই। যা হবার তা হয়ে গেছে।
স্যার! শচীনবাবু আপনাকে তা-ই বলেছেন?
বলেছেন। আপনি কফি খেতে খেতে বলুন। উত্তেজিত হবেন না! হরিবাবু কফির পেয়ালা টেবিলে রেখে বললেন, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়। আর উলুখাগড়ার প্রাণ যায়, সেই অবস্থা। আমি স্যার অত রাত্রে ছোটবাবুর বাড়ি ঢোকার সাহস পাইনি। এইটুকু দুটো বিগ্রহ বেদিতে আটকানো। ব্যাগে ভরা ছিল। রাত্রে বাসায় নিয়ে গিয়ে রেখেছিলাম। দিনের বেলা কোনও এক ছলে ছোটবাবুর বাড়িতে রেখে আসার ইচ্ছে ছিল। সেই রাত্রে শ্যামা আমার বাসায় ছিল। বদমাস শ্যামা কী করে টের পেয়েছিল জানি না। ভোরবেলা বাথরুমে গেছি। তারপর এসে দেখি শ্যামা নেই। বিগ্রহও নেই।
কিন্তু শ্যামবাবুর নোটবইটা বিগ্রহের ছবির পেছনে পাওয়া গেল। এর ব্যাখ্যা কী?
সেটাই তো বুঝতে পারছি না স্যার!
আপনি কফি খান। আপনার আর ভয় কিসের? নোটবই দিয়েছেন। হ্যাঁ, কফি খান।
হরিবাবু আড়ষ্ট হাতে কফির পেয়ালা তুলে নিলেন। তাঁকে নার্ভাস দেখাচ্ছিল।
কর্নেল বললেন, আপনি সকালে গিয়ে শচীনবাবুকে ঘটনাটা জানিয়েছিলেন। তাই না?
আজ্ঞে। শুনেই উনি আমাকে চড়থাপ্পড় মেরে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। পুলিশে দেবেন বলে শাসাচ্ছিলেন। কিন্তু আমি আসল কথা ফাঁস করে দিতে পারি ভেবে অত দূর এগোননি।
আপনার নাকের বাঁ-পাশের জডুলটা কতদিন আগে অপারেশন করেছে?
হরিবাবু চমকে উঠলেন। জ-জডুল সার?
হ্যাঁ। জডুল। শচীনবাবু বলছিলেন, আপনার জডুল অপারেশন করাতে বলতেন। আপনি নাকি ভয়ে অপারেশন করাননি। আপনার সেই বরমডিহির গ্রুপ ফোটোতে জডুলটা দেখেছি। কবে অপারেশন করালেন?
হরিবাবুর নাকের বাঁ-পাশে একটুখানি ক্ষতচিহ্ন দেখতে পেলাম। কাল ওটা লক্ষ্যই করিনি।
হরিবাবু বললেন, বছরখানেক আগে স্যার! মরিয়া হয়ে অপারেশন করিয়েছি।
ভাল করেছে। বড় মোটা জড়ুল ছিল। তাই ছবিতে চোখে পড়েছিল।
হ্যাঁ স্যার! মাঝে মাঝে ফেঁড়ার মতো টনটন করত।
কফি খান। আর চিন্তা কী? বলে কর্নেল নিজের পেয়ালা শেষ করে চুরুট ধরালেন। একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, শ্যামবাবুর নোটবইটা আমি খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেছি। নোটবইয়ে বিগ্রহ লুকিয়ে রাখার গোপন সূত্র ছিল। আমি তার অর্থ উদ্ধার করেছি।
হরিবাবু আবার চমকে উঠলেন। কোথায় লুকোনো আছে বুঝতে পেরেছেন?
হুঁউ। বরমডিহিতে শচীনবাবুর বাড়িতেই লুকোনো আছে।
হরিবাবু তাকিয়ে রইলেন। নিষ্পলক চাউনি।
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত এবং আমি নোটবইয়ে লেখা ওয়ার্ডগেম থেকে সূত্র টের পেয়েছি। জয়ন্ত, তুমি ওঁকে বুঝিয়ে দাও সূত্রটা। তোমার সংখ্যাভিত্তিক হিসেবও দাও।
আমি কর্নেলের কথার লক্ষ্য কী বুঝতে পারছিলাম না। তবু কর্নেল য়ামার হাতে প্যাড গুঁজে দিলে আমি আগের মতো ইংরেজিতে শ্যামবাবুর গ্র্যাব রেয়ার আর্টস বেস্ট শব্দগুলো সাজালাম। তারপর সংখ্যাগুলোও সাজিয়ে ফেললাম। যোগ করে দেখালাম ১৬০ হচ্ছে।
এবার কর্নেল বললেন, শচীনবাবু বলছিলেন, বরমডিহিতে নাকি ওঁর বাড়ি দুইতলায় মোট ২০টা ঘর। ১৬০-কে ২০ দিয়ে ভাগ করলে ৮ হয়। ৮ নম্বর ঘরের মেঝেয় তাহলে বিগ্রহ পোঁতা আছে।
হরিবাবু শুকনো হাসি হাসলেন। আজ্ঞে আমি স্যার ওসব সাতে-পাঁচে নেই। শচীনবাবুদের বিগ্রহ। ওঁদের বলুন। উদ্ধার করে পুজো দিক। আমি উঠি স্যার। নমস্কার।
হরিবাবু চলে যাওয়ার পর বললাম, বেচারাকে খামোকা ভড়কে দেওয়ার কারণ কী? নিরীহ ছাপোষা মানুষ!
কর্নেল চুরুটের ধোঁয়ার মধ্যে বললেন, আমার থিওরি যাচাই করে নিলাম। শুধ। এটাই জানা গেল না, শ্যামবাবু নোটবইটা ওখানে রেখেছিলেন কেন? যদি বিগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কই থাকবে, তা হলে–নাহ। মাথামুণ্ডু কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কোথায় বেরুবেন বলছিলেন যে?
বেরুব। বলে কর্নেল পোশাক বদলাতে ভেতরের ঘরে ঢুকে গেলেন।
০৫. হারাধনের অন্তর্ধান
যে সময়ের কথা বলছি, তখন খবরের কাগজের অফিস থেকে আমি কোনও গাড়ি পাইনি এবং কর্নেল তার লাল রঙের পুরনো ল্যান্ডরোভার গাড়িটিও বেচে দিয়েছেন। তাই কোথাও যেতে হলে ট্রাম বাস ট্যাক্সি দুজনেরই সম্বল। তবে আগেই বলেছি কর্নেলকে কোনও রহস্যময় কারণে কোনও ট্যাক্সি না বলে না।
ব্র্যাবোর্ন রোডে যেতে যেতে একখানে ট্যাক্সি থামিয়ে কর্নেল নামলেন। তখন বিকেল পৌনে পাঁচটা বাজে। শীতের শেষ বেলায় এখনই রাস্তার ধারে আলো জ্বলে উঠেছে। দোকানপাটেও আলো জ্বলেছে। কর্নেল মুখ তুলে সাইনবোর্ডে দেখে নিয়ে বললেন, পেয়ে গেছি। এস।
আগেই জিজ্ঞেস করেছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি। কিন্তু কর্নেল শুধু বলেছেন, এস তো! এতক্ষণে একটা সাততলা বাড়ির সিঁড়িতে উঠে বিশাল দরজার পর লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল বললেন, তরুণ মুখার্জির কোম্পানির অফিসে যাচ্ছি।
পাঁচতলায় করুণাময়ী ট্রেডিং কোম্পানির অফিস। বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থায় কর্মচারীদের দেখেছি ঘাড় গোঁজ করে কাজ করতে হয়। বাঁধা কাজের সময় বলে কিছু থাকে না। তখনও পুরোদমে কাজ চলেছে। কর্নেল একজন বেয়ারাকে তার নেমকার্ড দিলেন। একটু পরে তরুণবাবুর ঘরে আমাদের ডাক পড়ল।
বৈমাত্রেয় দাদার একেবারে উল্টো স্বভাবের মানুষ তরুণ মুখার্জি। বছর তিরিশ-বত্রিশ বয়স। ফিটফাট ধোপদুরস্ত পোশাক এবং স্মার্ট চেহারা। পরনে স্যুট-টাই। মুখে পাইপ। ইংরেজিতে সম্ভাষণ এবং করমর্দন করে আমাদের বসতে বললেন। দেখলাম কর্নেল তার পরিচিত।
তরুণবাবু সহাস্যে বললেন, আবার কোথাও ডেডবডি দেখেছেন নাকি কর্নেল সরকার?
কর্নেল একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, না। আমি একটা কথা জানতে এসেছি।
আর কী কথা?
আপনাদের বংশের বিগ্রহ রাধাকৃষ্ণ সম্পর্কে।
আমাকে তো দাদা তাঁর বংশের লোক বলে স্বীকারই করেন না। তরুণবাবুর মুখে হঠাৎ বিকৃতি ফুটে উঠল। আপনাকে বলেছিলাম, ছাত্রাবস্থায় আমাকে এবং মাকে ওই ভদ্রলোক আমার পৈতৃক বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। অনেক লড়াই করে আমি এই অবস্থায় পৌঁছেছি। আপনাকে এ-ও বলেছিলাম, প্রকাশ্য আদালতে উনি আমার মাকে আমার বাবার বিবাহিতা স্ত্রী বলে মানতে চাননি।
প্লিজ মিঃ মুখার্জি! আমি আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রশ্ন তুলতে আসিনি। আমি ওই বিগ্রহ সম্পর্কে আপনার কাছে কিছু তথ্য জানতে এসেছি। কারণ এ ব্যাপারে আপনি আমাকে কিছু জানাননি।
আপনি জিজ্ঞেস করেননি, তাই বলিনি।
এখন জিজ্ঞেস করছি।
তরুণবাবু গুম হয়ে বললেন, কফি খাবেন, না চা?
কিছু না। আপনি বিগ্রহ সম্পর্কে বলুন।
হরি গাঙ্গুলি নামে দাদার একজন ক্লার্ক ছিল। সে—
তরুণবাবু থেমে গেলেন। কর্নেল বললেন, বলুন।
সে–গোপন করতে চাই না, আমাকে দাদার লিগ্যাল লড়াইয়ের প্ল্যান সম্পর্কে আগাম খবর পাচার করত। তাকে টাকা দিতাম। তার এক আত্মীয়কে আমার ফার্মে চাকরিও দিয়েছিলাম।
শ্যামসুন্দর নাম ছিল তার?
আপনি জানেন দেখছি!
জেনেছি। আপনি বলুন।
অনেক বছর আগের কথা। হঠাৎ একদিন কাগজে পড়লাম ভবানীপুরে আমাদের পৈতৃক বাড়ি থেকে রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ চুরি গেছে। মা তখন বেঁচে নেই। আমি বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম। ওই বিগ্রহ নাকি স্বয়ং শ্রীচৈতন্যের আশীর্বাদ–
শুনেছি। আপনার দাদার সঙ্গে আমি দেখা করেই আপনার কাছে এসেছি।
তো কদিন পরে হরি এসে একটা সাংঘাতিক কথা বলল। দাদা নাকি নিজেই বিগ্রহ চুরি করে আমাকে ফাঁসানোর জন্য তার হাত দিয়ে আমার বাড়িতে পাচার করতে চেয়েছিলেন। সেই বিগ্রহ হরির ঘর থেকে চুরি গেছে। হরির বাসাতেই শ্যামসুন্দর থাকত। সে নাকি পালিয়েছে বিগ্রহ নিয়ে।
শ্যামবাবু হরিবাবুর বাসায় থাকতেন?
হ্যাঁ। শ্যাম সেখানে থেকেই আমার অফিসে কাজ করতে আসত। তবে এর সত্যমিথ্যা জানি না।
হরিবাবু আমাকে অন্য কথা বলেছেন। শ্যামবাবু নাকি বাউণ্ডুলে ছিলেন এবং মাঝে মাঝে ওঁর বাসায় হাজির হতেন!
তরুণবাবু রুষ্টমুখে বললেন, হরি বড্ড পাচালো স্বভাবের লোক। হবে না কেন? হাড়ে-হাড়ে প্যাঁচালো বুদ্ধির এক আইনকারবারির সঙ্গদোষে সেও ওইরকম হয়ে পড়েছিল।
তারপর কী হল বলুন?
ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে বাধ্য হলাম। শ্যাম তারপর থেকে উধাও। আমার অফিসে আসছে না দেখে বুঝলাম হরি ঠিক বলেছে। তারপর এতগুলো বছর চলে গেল। আর শ্যামের পাত্তা নেই।
হরিবাবু আপনার কাছে আসেন?
নাহ্। তার সম্পর্কে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই। এলেও তার সঙ্গে দেখা করব না। বাই-দাবাই, এখন কোথায় আছে সে? কী করে?
পাইকপাড়ায় সেই বাসায় আছেন। আলিপুর কোর্ট চত্বরে স্বাধীনভাবে টাইপিংয়ের কাজ করেন।
তরুণবাবু আস্তে বললেন, কিন্তু আপনি আমাদের ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড কেন?
আপনাকে বলেছিলাম বরমডিহিতে আপনাদের বাড়িতে—
হ্যাঁ। কিন্তু বাড়িটার ভুতুড়ে বলে বদনাম আছে। আমি যে মামলা লড়ছি, তা নিছক ওই পোডড়া বাড়ির জন্য নয়। আমার মায়ের সম্মান রক্ষার জন্য। এটা আপনার বোঝা উচিত
বুঝি মিঃ মুখার্জি! আসলে আমি আগে ওই ভৌতিক রহস্য সম্পর্কে আগ্রহী ছিলাম। এবার আমি বিগ্রহ চুরি এবং শ্যামবাবুর অন্তর্ধান সম্পর্কে আগ্রহী। আমার ধারণা, এই ঘটনাগুলোর মধ্যে যোগসূত্র আছে।
তরুণবাবু ঘড়ি দেখে বললেন, ওয়েল, কর্নেল সরকার। আমার সহযোগিতা পাবেন। বিগ্রহ উদ্ধার করলে আমি আপনাকে—
হাত তুলে কর্নেল বললেন, পুরস্কৃত করবেন তো? না মিঃ মুখার্জি! আমার এই এক স্বভাব। রহস্য ফাঁস করা আমার হবি। যাই হোক, শ্যামবাবু আপনার কর্মচারী ছিলেন। তার কোনও ছবি আপনার অফিসে কি আছে?
থাকা সম্ভব। জাস্ট আ মিনিট। বলে উনি টেবিলের সুইচ টিপে বেয়ারাকে ডাকলেন। সে এসে সেলাম দিলে, বললেন, অবনীবাবুকে ডাকো।
একটু পরে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক চেম্বারে ঢুকে আড়ষ্টভাবে দাঁড়ালেন। তরুণবাবু বললেন, আচ্ছা অবনীবাবু! সেই শ্যামসুন্দর–আই মিন, যে ক্লার্ক নিপাত্তা হয়ে গিয়েছিল–
অবনীবাবু বললেন, শ্যামসুন্দর ভট্টাচার্যের কথা বলছে কি স্যার? হ্যাঁ। তার কোনও ছবি অফিসে আছে? থাকা তো উচিত। পার্সোনেল ডিপার্টমেন্টের ফাঁইলে খুঁজলে নিশ্চয় পাবেন। তবে সাত-আট বছর আগের ফাইল ঘাঁটতে হবে। সময় লাগবে। তাই না?
স্যার! একটা গ্রুপ ফোটোতে শ্যামবাবুর ছবি আছে মনে হচ্ছে।
দেখুন তো! এখনই চাই কিন্তু। আমি বেরুব।
অনীবাবু বেরিয়ে গেলেন। তারপর দু-মিনিটের মধ্যে একটা প্রকাণ্ড বাঁধানো গ্রুপ ফোটো ঝাড়তে ঝাড়তে ঘরে ঢুকলেন। বললেন, পেছনের সারিতে দাঁড়ানো বাঁ-দিকের থার্ড ম্যান স্যার!
ওঁকে দেখান। বলে তরুণবাবু কর্নেলের দিকে আঙুল তুললেন। কর্নেল ছবিটা দেখার পর বললেন, একটা অনুরোধ মিঃ মুখার্জি! এটা আমার এক রাত্রির জন্য দরকার। আপনি আগামীকালই অফিস খোলার সময় ফেরত পাবেন। কথা দিচ্ছি।
কী করবেন ওটা নিয়ে?
আমার ক্যামেরা এবং নিজস্ব ডার্করুম আছে। শ্যামবাবুর ছবিটা থেকে একটা পোট্রেট করে নেব।
কেন বলুন তো?
আপনার পূর্বপুরুষের ঐতিহাসিক বিগ্রহ উদ্ধারের জন্যই শ্যামবাবুর ছবি আমার দরকার।
একটু ইতস্তত করে তরুণবাবু বললেন, ঠিক আছে। নিয়ে যান। অবনীবাবু, ছবিটা ওঁকে কাগজে ভালভাবে প্যাক করে দিন।
কিছুক্ষণ পরে ছবিটা বগলদাবা করে কর্নেল বেরুলেন। রাস্তায় তখন যানবাহনের জ্যাম। আলো আরও ঝলমলে হয়েছে। এবার আমরা বাসে না এসপ্ল্যানেড এবং সেখান থেকে ভিড়েঠাসা ট্রামে চেপে ইলিয়ট রোডে পৌ৮ সারা পথ আমার কিন্তু গা ছমছম করছিল। কেউ যেন হঠাৎ ছবিটা কেড়ে পালাবে মনে হচ্ছিল। কেন কেড়ে নিয়ে পালাবে, তা অবশ্য বুঝতে পার না। তবে আশঙ্কায় বুক দুরদুরু কাঁপছিল। প্রত্যেকটি যাত্রীর গা ঘেঁষে দাঁড় সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল।
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে ভয়টা কেটে গেল। কর্নেল ষষ্ঠীকে কs, করতে বলে ওঁর স্টুডিওতে ঢুকলেন। ওখানে ওঁর আরেক হবির নিদর্শন। মা জায়গায় তোলা পাখি প্রজাপতি অর্কিড ক্যাকটাসের ছবি নিজেই ডেভালান্স এবং প্রিন্ট করেন। এমন কি, ওঁর একটা পোর্টে স্টুডিও আছে বলা চলে। কতবার ডেভালাপ প্রিন্টের সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে নানা জায়গায় পাড়ি জমান। তখন কোনও বাংলোর বাথরুম ওঁর ডার্করুমে পরিণত হয়।
প্রায় আধঘণ্টা পরে কর্নেল বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। বললেন, খব। পাকা ফোটোগ্রাফারের তোলা ছবি। নেগেটিভটা ভালই আসবে আশা করছি। পাসপোর্ট ফোটোর সাইজে ফিগারটা এনেছি।
বললাম, আমি ক্লান্ত। এবার বাড়ি ফিরতে চাই।
ঠিক আছে। কাল সকালে কিন্তু এসো। একটা রহস্য সম্ভবত ফাঁস হবে।
কোন রহস্য?
কর্নেল হাসলেন। সকালে এলে টের পাবে।…
.
পরদিন সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হয়ে দেখি, উনি কয়েকটা পাসপোর্ট সাইজের ফোটো টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন এবং একটা ছবিতে তুলি বুলোচ্ছেন।
আমাকে দেখে বললেন, অসাধারণ এসেছে।
টেবিলের একটা ফোটো তুলে নিয়ে বললাম, এই শ্যামবাবু? চেহারা কিন্তু অমায়িক প্রকৃতির এক যুবকের।
প্রায় ৮ বছর আগের ছবি। তবে চেহারায় মানুষের চরিত্রের ছাপ ফোটে কি
তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সাদারণত ছ্যাচড়া প্রকৃতির অপরাধী নিজের চেহারায় ইচ্ছে করেই দুৰ্বত্তের ছাপ ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু তথাকথিত ভদ্রলোক অপরাধীরা চেহারায় ভেতরকার আসল রূপ ফুটতে দেয় না এবং এ বিষয়ে তারা খুব সচেতন।
পাশের আর একটা ছবি দেখে বললাম, এটা আবার কার? যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।
তরুণবাবুর অফিসের এক বেয়ারার।
কিন্তু একে যেন কোথায় দেখেছি। কাল ওই অফিসেই কি?
তা দেখে থাকতে পারো তুমি। আমি লক্ষ্য করিনি।
এর ছবি তুললেন কেন?
কাল তরুণবাবুর অফিসে আমি একে লক্ষ্য না করলেও গ্রুপ ফোটো দেখে আমার চেনা মনে হচ্ছিল। তাই এর ছবিটাও তুলেছি।
ছবিটা তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললাম, আশ্চর্য! একে কোথাও দেখেছি। নাহ্। কাল ওই অফিসে নয়। অন্য কোথাও।
কর্নেল আস্তে বললেন, তা হলে আমি নিঃসন্দেহ হলাম।
কী ব্যাপারে?
তুমি এবং আমি দুজনেরই যখন চেনা লাগছে, তখন এ সেই লোকটাই বটে। তবে ভূত নয়, জলজ্যান্ত মানুষ।
কর্নেল! বরমডিহির পোড়ো বাড়িতে লণ্ঠন হাতে যে লোকটা নিজেকে ভোলা বলেছিল–
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, হ্যাঁ। এ সেই-ই বটে। মানুষের চেহারা চল্লিশের পর পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত খুব একটা বদলায় না। তবে নাহ্, উত্তেজিত হয়ো না। মুখ বুজে থাকো। লোকটা এখনও তরুণবাবুর অফিসে কাজ করছে। কি না জানা দরকার।
আপনি শ্যামবাবুর ছবিটা রিটাচ করছেন কেন?
বয়স বাড়াচ্ছি। কারণ শ্যামবাবু এই ছবিতে বড়জোর পঁচিশ বছর বয়সী যুবক। আট বছর পরে তার চেহারাটা কেমন দাঁড়াতে পারে, এক্সপেরিমেন্ট করছি ৪টে ছবিতে।
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ছবি এবং তুলি রেখে নিজেই ফোন ধরলেন…হ্যাঁ। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…না, না মিঃ মুখার্জি! আমি রাগ করিনি। আপনার অনুতপ্ত হওয়ার কারণ নেই।…ঠিক আছে। অবশ্যই যাব।…না, না। কথা দিচ্ছি।…এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব।…নাহ্! গাড়ি পাঠাতে হবে না। ধন্যবাদ! রাখছি।
বললাম, অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক মনে হল?
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ!
কর্নেল! সাবধান কিন্তু!
কেন?
আপনি ওঁর বাড়িতে বসে ওঁকে চোর বলেছেন। তার প্রতিশোধ নিতে হয় তো এ একটা ফাঁদ।
কর্নেল স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হেসে বললেন ঘুঘুধরা ফাঁদ বলতে চাও! হরিবাবুকে লেখা চিঠিতেও ঘুঘু এবং ফাঁদের কথা ছিল! এই কথাটাও ছিল, এ বড় সেয়ানা ঘুঘু।
হাসতে হাসতে বললাম ভাষাটা কিন্তু কোর্ট চত্বরের সেই ছোকরান।
ছোকরা বোলো না ডার্লিং! ওর প্রতিভা আছে। আমি ওই প্রতি ছেলেটির সঙ্গে আবার দেখা করে তাকে পুরস্কৃত করব ভেবে রেখেছি।
কর্নেল ফোটোশুলো গুছিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন। তারপর পোয় বদলে এলেন। ওঁর হাতে এবার তরুণবাবুর অফিস থেকে আনা সেই প্রকাণ্ড গ্রুপফোটো। আগের মতো প্যাকেট করা। বললেন, চলো! এই ছবিটা কথামতো ফেরত দিতে হবে। তারপর যাব শচীনবাবুর বাড়ি।…
ব্র্যাবোর্ন রোডের সেই বাড়িতে যখন পৌঁছুলাম, তখন প্রায় সওয়া দশটা বাজে। কর্নেল আমাকে নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে লিফটের সামনে লাইন দিলে, বাড়িটাতে অজস্র কোম্পানির অফিস। দেখলাম, অনেকে লিফটের লাইন দেখে পাশের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, এ সময় যদি দৈবাৎ বরমডিহিতে দেখা সেই ভোলার দেখা পেয়ে যাই, কী করব? জাপটে ধরে হইচই বাধানো কি ঠিক হবে? তবে এ কথা ঠিক, তাকে এখন মুখোমুখি পেলে সোজাসুজি চার্জ করব। তাতে ভিড় জমে তো জমুক। ব্যাটাচ্ছেলে আমাদের বোকা বানিয়ে ছেড়েছিল!
একটু পরে অবশ্য উত্তেজনাটা চলে গেল। কর্নেল নিজস্ব লাইন ধরে এগোচ্ছেন। কাজেই আমার চুপচাপ থাকাই উচিত।
কর্নেল ফিরলেন প্রায় আধঘণ্টা পরে। তাঁকে দেখামাত্র আবার উত্তেজনাটা ফিরে এসেছিল। ফুটপাতে নেমে জিজ্ঞেস করলাম, সেই দুনম্বর ভোলাকে দেখলেন তরুণবাবুর অফিসে?
নাহ্। হারাধন কাল বিকেলে নাকি বউয়ের সাংঘাতিক অসুখের খবর পেয়ে বর্ধমানের গ্রামে গেছে। বর্ধমান থেকে ট্রাঙ্ককল এসেছিল। অবনীবাবু বললেন।
লোকটার নাম তাহলে হারাধন?
হ্যাঁ। হারাধন বাগ। কর্নেল হাসলেন। বাঘ বলা চলে। চেহারা দেখে আমার ওইরকম ধারণা হয়েছিল।
আমারও।
তবে হাবভাব বেশ অমায়িক ছিল। ঠিক পুরাতন ভৃত্যমার্কা।
কর্নেল! আমার ধারণা, কাল বিকেলে ওই অফিসে আপনাকে ঢুকতে দেখেই ব্যাটাচ্ছেলে কিছু আঁচ করেছিল। তাই গা-ঢাকা দিয়েছে। আপনার মার্কামারা চেহারা তার মনে থাকারই কথা।
কর্নেল হাসলেন। অবনীবাবুর সঙ্গে কৌশলে কথা বলে জেনেছি, আমি যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে ভোলার কাছে টেলিফোন এসেছিল। তবে সত্যি ট্রাঙ্ককল। কি না বলা কঠিন। মোট কথা, টেলিফোন এসেছিল।
তরুণবাবুর সঙ্গে দেখা হল?
নাহ্। উনি আসেন বারোটায়।
হাঁটতে হাঁটতে বললাম, হঠাৎ লোকটা ঠিক এই সময়ই দেশের বাড়িতে গেল? মুখোমুখি তাকে পেলে আপনার সুবিধে হত!
কর্নেল বললেন, কিছু হত না। অস্বীকার করত। বলে, ট্যাক্সি! ট্যাক্সি! চিৎকার করে উনি প্রায় ঝাঁপিয়ে রাস্তায় গেলেন। একটুর জন্য একটা প্রাইভেট কারের ধাক্কা থেকে বেঁচে গেলেন।
কিন্তু কথাটা বললেই তো বর্মার জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিংয়ের পুরনো কথা তুলবেন। এরকম কত চুলচেরা হিসেবি ঝাঁপ দিয়ে নাকি জাপানি গুলি থেকে বেঁচেছিলেন।…..
০৬. হরিবাবুর অন্তর্ধান
ভবানীপুরের অবসরপ্রাপ্ত আইনজীবী শচীন্দ্রলাল মুখার্জি আজ একেবারে উল্টো মানুষ হয়ে গেছেন দেখে অবাক লাগছিল। প্রথমে কর্নেলের হাত ধরে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে আদর করে পাশে বসালেন। তারপর চোখ মুছে বললেন, আমি পাপী! মহাপাপী! তাই আমার এই অথর্ব অবস্থা হয়েছে। হাজারটা অসুখে। ভুগছি। ওদিকে গিন্নিও পক্ষাগাতে শয্যাশায়িনী হয়ে আছেন। আমার মনের অবস্থা বলার মতো নয় কর্নেল সায়েব!
কর্নেল বললেন, বুঝতে পেরেছি। পেরেছি বলেই আবার আপনার কাছে। আসতে দ্বিধা করিনি।
শচীনবাবু এবার চাপা গলায় বললেন, আপনি যে বিচক্ষণ মানুষ, তা আমি প্রথমদিনই টের পেয়েছিলাম। আপনি কাল ঠিকই বলেছিলেন। কার্যত আমি নিজেই বিগ্রহ চুরি করেছিলাম। কিন্তু সেটা যে অমন একটা সাংঘাতিক রিস্কের ব্যাপার, তা আমার মাথায় আসেনি। কারণ ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে। আমি ভাবতেই পারিনি হারামজাদা হরি বোকামি করে বসবে। আমার প্ল্যানটা ছিল সোজা। আফটার অল, তরুণের দেহে আমার বাবার রক্ত আছে। তার বাড়িতে একটা রাত্তির গৃহদেবতাকে রাখা যেত। তারপর পুলিশ সকালে ওটা উদ্ধার করে দিত। তরুণও ফেঁসে যেত। কিন্তু হতচ্ছাড়া হরিটা–
শচীনবাবু কপালে করাঘাত করলেন। কর্নেল বললেন, আসলে রিস্কটা আপনি যত তুচ্ছ ভেবেছিলেন, ততটা ছিল না।
হ্যাঁ। কিন্তু তা তো পরে বুঝেছিলাম। তখন ক্রোধান্ধ হয়ে একটা প্ল্যান ছকেছি। তখন মনে হয়েছিল, গৃহদেবতা একই পরিবারের এক গৃহ থেকে আর। এক গৃহে যাচ্ছেন। সক্কালে আবার ফেরত পাব।
হরিবাবুর ওপর আপনার বিশ্বাস গভীর ছিল বোঝা যাচ্ছে?
হ্যাঁ। তা তো ছিলই। যদি বলেন এখনও কি নেই? আছে। কারণ আমি মানুষ চিনি। সারাজীবন আদালতে আসামি জেরা করে কাটিয়েছি। ক্রিমিন্যাল দেখলেই ধরতে পারি। তাছাড়া হরি একটু সাদাসিধে ধরনের গোবেচারা টাইলস লোক। খুব পরিশ্রমীও বটে। সকাল আটটায় কাজে আসত। রাত দশটা কোনও-কোনও রাতে এগারোটা পর্যন্ত থেকে যেত। কোনওরকম তঞ্চকতাম কাজ করেনি আমার সঙ্গে। আমি মানুষ চিনি কর্নেলসায়েব।
মনে মনে বললাম, ঘোড়ার ডিম চেনেন! তরুণবাবুর চর ছিলেন হরিবার। বিরক্ত হয়ে কর্নেলের দিকে তাকালাম। ভাবলাম, হরিবাবুর চরিত্র ফাস করে দেবেন শচীনবাবুকে। কিন্তু কর্নেল ক্রমাগত দাড়ি নেড়ে সায় দিচ্ছিলেন। এবার বললেন, হরিবাবু আপনার মতোই সব্রাহ্মণ। ওঁর ঘরে আপনার গৃহদেবতার ফোটো বাঁধানো আছে দেখেছি!
আইনজীবী আবেগে বললেন, আমার সব কর্মচারীকে এককপি করে গৃহদেবতার ফোটো আমিই বাঁধিয়ে দিয়েছিলাম।
হরিবাবুর ঘর থেকে ওঁর মামাতো ভাই শ্যামসুন্দরবাবু বিগ্রহ চুরি করে। পালিয়েছিলেন।
হ্যাঁ। হরি বলেছিল। ওর মুখ দেখে মনে হয়েছিল, সত্যি কথা বলেছে। তাহলে ওঁকে বরখাস্ত করেছিলেন কেন?
ওই যে তরুণের বাড়ি গিয়েছিল, সেইজন্য। ওর আত্মীয়ের চাকরির চেষ্টায় গিয়েছিল। সেটা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আমার রাগ হয়েছিল, তরুণকে সাধতে গেল কেন?
কর্নেল হাসলেন। আপনি কাল বলেছিলেন, বিগ্রহ চুরির জন্য যাকে-যাকে। সন্দেহ হয়েছিল, তাদের মধ্যে হরিও একজন।
শচীনবাবু কর্নেলের হাত চেপে ধরলেন। ভিজে গলায় বললেন, কালকের কথা ভুলে যান। আজ আমি কনফেস করার জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম। তাছাড়া একটা কৌতূহলও হয়েছে।
বলুন মিঃ মুখার্জি।
আইনজীবী আবার চাপা গলায় বললেন, প্লিজ কর্নেলসাহেব! গোপন করবেন না। তরুণই কি আপনাকে বিগ্রহ উদ্ধারের জন্য ধরেছে? তার মানে, আপনার ক্লায়েন্ট কি তরুণ?
নাহ। আমি আপনাকে বলেছি, কোথাও রহস্য দেখলেই তা ফাঁস করা আমার হবি।
তা করুন। কিন্তু আপনার হাতে ধরে বলছি, আমার গৃহদেবতাকে উদ্ধার করে দিন।
চেষ্টা করব। তবে আপনার সহযোগিতা চাই।
পাবেন। সব রকমের সহযোগিতা পাবেন।
ট্রে ভর্তি স্ন্যাক্স, সন্দেশ এবং চায়ের কাপ-প্লেট এনে রাখল কালকের সেই পরিচারক। কর্নেল বললেন, কিছু মনে করবেন না। আমরা ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়েছি। তবে শুধু চা খাব।
আপনার ইচ্ছে। বলে শচীনবাবু ছড়িয়ে রাখা বাঁ পা সোজা করলেন এবং এবার ডান পা ছড়িয়ে দিলেন। মুখে কষ্টের ছাপ।
কর্নেল চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বরমডিহির সন্ধ্যানীড়ের চাবি কার কাছে আছে?
বরমডিহির জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে তাকে মামলার মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত বাড়ির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু খবর পাই, তিনি কিছুই দেখেন না। সরকারি ব্যাপার যা হয় আর কী। বাড়িটার নাকি পড়ো-পড়ো দশা। শুনে কষ্ট হয়। কিন্তু কী করব?
বাড়ির নিচের তলায় কখানা ঘর?
১০ খানা।
কর্নেল জিজ্ঞেস করলেন, দোতলায়?
দোতলাতেও ১০ খানা।
কর্নেল আমার দিকে তাকালেন। বললাম, পিওর ম্যাথ। বিশুদ্ধ গণিত মনে হচ্ছে।
শচীনবাবু বললেন, গণিত? গণিত মানে?
কর্নেল বললেন, জয়ন্ত ভাল অঙ্ক কষতে পারে তো! তাই ও বলতে চায়–
শচীনবাবু তার কথার ওপর বললেন, বাবা ছিলেন সে-আমলের নামকরা আর্কিটেক্ট। বরমডিহিতে যত কোর্ট কাছারি বা পুরনো সরকারি বাড়ি আছে, সব ওঁর নকশায় তৈরি। জয়ন্তবাবু ঠিক ধরেছেন। অঙ্ক কষে বাবা বাড়ির নকশা তৈরি করতেন। লক্ষ্য করে থাকবেন, বাড়িটা ইংরেজি এল প্যার্টেনের। ওপরে নিচে এল প্যাটার্ন বারান্দা। বাবা যে আমার জন্যই বাড়িটা করেছিলেন, তার প্রমাণ, তাঁর জীবদ্দশায় দেউড়িতে আমার নেমপ্লেট লাগানো হয়েছিল। এখনও তা অক্ষত আছে। তখন তরুণ কোথায়?
ভোলা নামে একজন লোককে সন্ধ্যানীড়ের কেয়ারটেকার রেখেছিলেন। তাই না?
হ্যাঁ। কিন্তু আপনি যে ভূতপ্রেত দেখেছিলেন–
সে ভোলা নয়। আপনি তা আমাকে বলেছিলেন। কর্নেল চায়ের কাপ। নামিয়ে রেখে বললেন, ভোলা কত বছর আগে মারা গেছে?
বছর দুই হয়ে এল প্রায়। সুপ্রিম কোর্টে গেল তরুণ, সেই বছর।
হাইকোর্টে আপনি মামলা জিতেছিলেন?
হ্যাঁ। তরুণ লোয়ার কোর্টে হেরে হাইকোর্ট করেছিল। হাইকোর্টে হেরে। এখন সুপ্রিম কোর্টে। পাজির পা ঝাড়া! বংশের কলঙ্ক!
তা হলে মামলা তরুণবাবুই করেছিলেন প্রথমে?
তাকে সন্ধ্যানীডে ঢুকতে চাবি দিইনি। এতেই বাবুর মেজাজ খাপ্পা। তো আমি হলাম নিজেই আইনজ্ঞ। আমাকে আইন দেখাচ্ছে!
আজ চলি মিঃ মুখার্জি। দরকার মতো যোগাযোগ করব। আপনিও করবেন। কর্নেলের একটা হাত দুহাতে চেপে ধরে শচীনবাবু বললেন, আমিই পাপ রেছিলাম কর্নেলসায়েব! এ তারই শাস্তি। আপনি আমার গৃহদেবতাকে উদ্ধার করে দিন।
বললাম তো! চেষ্টা করব।…
বড় রাস্তার মোড়ে গিয়ে কর্নেল বললেন, এবার আলিপুর কোর্টে যাব। ছেলেটিকে পুরস্কৃত করতে হবে।
আমার বৃদ্ধ বন্ধুর খেয়ালের ব্যাপারটা আমার জানা। তাই বাধা দিলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। কোর্টের দিকে ছুটে চলল।
ট্যাক্সি থেকে নেমে কর্নেল ট্যাক্সি চালককে বললেন, একমিনিট ভাই। এক্ষুনি আসছি। জয়ন্ত, তুমি বসে থাকো।
ট্যাক্সি থেকে ড্রেনের ওপারে গাছতলায় হরিবাবুর ডেরা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু হরিবাবু নেই। হয়তো খেতে গেছেন ভাবছিলাম। পরক্ষণে দেখলাম টেবিলে টাইপরাইটার নেই এবং চেয়ারে সেই চৌকস ছোকরা বসে আছে।
কর্নেল তার কাছে গেলে সে উঠে দাঁড়িয়ে সেলাম দিলো। তারপর কর্নেলের সঙ্গে তার কথাবার্তা চলতে থাকল। এতদূর থেকে শোনা যাচ্ছিল না। একটু পরে কর্নেলকে দেখলাম, তার হাতে একটা দশটাকার নোট গুঁজে দিচ্ছেন। ছোকরা রীতিমতো মিলিটারি কায়দায় সেলাম ঠুকল। কর্নেল ফিরে এলেন।
ট্যাক্সিতে বসে কর্নেল বললেন, পার্ক স্ট্রিট হয়ে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট দিয়ে ইলিয়ট রোড।
ট্যাক্সি ঘুরল। জিজ্ঞেস করলাম, হরিবাবু আজ আসেননি নাকি?
নাহ্। অসুখবিসুখ হয়েছে হয়তো!
ছোকরাটির সঙ্গে—
ও জয়ন্ত! হি ইজ আ জিনিয়াস চ্যাপ।
হাসতে হাসতে বললাম, কী কথা হল জিনিয়াসের সঙ্গে?
নামঠিকানা জেনে নিলাম। ওকে একটা স্থায়ী কাজ জুটিয়ে দেওয়ার আশ্বাসও দিলাম।
এবং দশটা টাকা পুরস্কার দিলেন।
ওটা ওর পক্ষে নগণ্য। ওকে দশ-বিশ হাজার টাকা দেওয়া উচিত ছিল। আমার তো অত দেওয়ার মতো অবস্থা নয়। পেনসন আর বিদেশি কাগজে প্রজাপতি নিয়ে প্রবন্ধ লিখে রোজগার।
ব্যাপারটা কী খুলে বলুন তো?
কর্নেল চুরুট ধরিয়ে বললেন, আজও তোমার লাঞ্চের নেমন্তন্ন।
সর্বনাশ! আমাকে অফিস যেতে হবে না? এই সপ্তাহে বিকেলে ডিউটি। কাল কামাই করেছি।
তোমার চিফ অব দা নিউজ ব্যুরোকে টেলিফোনে জানিয়ে দাও একটা রোমহর্ষক স্টোরির পেছনে দৌডুচ্ছ। বলল, দৈনিক সত্যসেবক পত্রিকার জন্য এক্সকুসিভ স্টোরি। রাতারাতি প্রচার-সংখ্যা এক লক্ষ বেড়ে যাবে।
চুপ করে গেলাম। এই খামখেয়ালি রহস্যভেদীর পাল্লায় পড়েছি। রহস্য ফদাই না হওয়া পর্যন্ত ছাড়া পাব না। তবে এ-ও সত্যি, বরমডিহির পোড় বাড়ির ভুতুড়ে হত্যাকাণ্ড আমাকেও ধাঁধায় ফেলেছিল। ধাঁধার জট না খুললে ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করতে হবে। এটাই সমস্যা। ভূতের ভয় যতই পাই, ভূতে বিশ্বাস করাটা কেমন বিচ্ছিরি লাগে যেন। তাছাড়া আমার মতে, গল্পের ভূতে মজা আছে। সত্যিকারের ভূতে মজা কোথায়?…
এদিনও কর্নেলের বাড়ি লাঞ্চ খেয়ে ড্রয়িং রুমের ডিভানে লম্বা হয়েছিলাম। কর্নেল কোথায়-কোথায় টেলিফোন করছিলেন এবং চাপা গলায় কথা বলছিলেন, তারপর হঠাৎ ডাকলেন, উঠে পড়ো জয়ন্ত! বেরুনো যাক।
ভাতঘুমের রেশ ছিঁড়ে গেল। বিরক্ত হয়ে বললাম, ওঃ কর্নেল! খালি ছুটোছুটি আর কথাবার্তা!
কর্নেল হাসলেন। ছুটোছুটি না করে উপায় কী? আমরা ভুতুড়ে খুনখারাপি দেখে এসেছি। হরিবাবুও একই দৃশ্য দেখেছিলেন। ছুটোছুটি করে খুনী ভূতটাকে তো ধরতে হবে। আর কথাবার্তার কথা বলছ? কথা বলতে বলতে অনেক কথা বেরিয়ে আসে। আসলে আমরা জানি না যে কী জানি। তাই অনর্গল কথা বলতে হয়। জানা কথাটা এভাবেই মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে চলে আসে। এই দুদিনে পুরো একটা ইতিহাস বেরিয়ে এল এবং একজোড়া বিগ্রহ!
কিন্তু এবার বেরুবেন কোথায়? নতুন কোনও সূত্র পেয়েছেন নাকি?
নাহ্। বেচারা হরিবাবুর খবর নেওয়া দরকার। কোর্টে যাননি। ওঁর পেছনে শত্রু লেগেছিল। নোটবইটা পেয়েও যদি সে খুশি না হয়? কিংবা যদি সে দেখে যে এটা সেই নোটবই নয়? হরিবাবুর কী দশা হবে ভাবো!
বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। সত্যিই তো! যদি ওটাই সেই কালো নোটবই না হয়?…
পাইকপাড়ার সেই ঠিকানায় কালকের চেয়ে আজ আগেই পৌঁছুলাম। ঝলমলে মিঠে রোদ্দুর খেলছে। মশা নেই। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে হরিবাবুর ঘরের সামনে কর্নেল থমকে দাঁড়ালেন। দরজায় তালা ঝুলছে।
পাশের ঘরের এক ভদ্রমহিলা আমাদের দেখতে পেয়ে বললেন, হরিদার কাছে এসেছেন আপনারা? সে তো কাল সন্ধ্যায় দেশের বাড়িতে গেছে। বউদি নাকি খুব অসুখ। আমাকে বলে গেছে, কেউ তার খোঁজে এলে যেন জানিয়ে দিই।
কর্নেল বললেন, কবে ফিরবেন কিছু বলে গেছেন?
ঠিক নেই। অসুখবিসুখের ব্যাপার।
ওঁর দেশের ঠিকানা জানেন?
না তো! মেদিনীপুরে কোন গ্রামে যেন।
কর্নেল একটু কাচুমাচু মুখ করে বললেন, একটা জরুরি কাগজ টাইপ করতে দিয়েছিলাম। বড় সমস্যায় পড়া গেল দেখছি। আচ্ছা, হরিবাবুর কোনও অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকা উচিত। তার হাতেও আমার কাগজটা দিয়ে যেতে পারেন। তেমন কেউ কি এ ঘরে ওঁর সঙ্গে থাকেন না?
ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে বললেন, এ ঘরে হরিদা একা থাকে।
ওঁর মামাতো ভাই শ্যামসুন্দরবাবু ওঁর সঙ্গে থাকেন শুনেছিলাম। তিনি–বলে কর্নেল ভদ্রমহিলাকে হাঠৎ জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কতদিন এখানে আছেন?
অনেকদিন। আপনি শ্যামবাবুর কথা বলেছেন? শ্যাম নামে একজন হরিদার কাছে থাকত। সে তো অনেক বছর আগের কথা। হরিদার কাছে শুনেছিলাম, লোকটা ভাল না। মানে, হরিদার টাকাকড়ি চুরি করে পালিয়েছিল। আমার কিন্তু লোকটাকে একেবারে পছন্দ হত না।
আচ্ছা চলি! বলে কর্নেল সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালেন।
নিচে নেমে বললাম, জাল ভোলা ওরফে হারাধন কাল সন্ধ্যায় বউয়ের অসুখ বলে দেশে চলে গেছে। এদিকে হরিবাবুও কাল সন্ধ্যায় বউয়ের অসুখ বলে দেশে চলে গেছেন। টাইমিংটা লক্ষ্য করুন কর্নেল! ব্যাপারটা গোলমেলে মনে হচ্ছে। দুজনেই হঠাৎ একই সঙ্গে গা-ঢাকা দিয়েছে যেন। কিন্তু কেন?
কর্নেল তুম্বো মুখে হাঁটছিলেন। আমার প্রশ্নের জবাবে কিছু বললেন না।
বললাম, অবশ্য নেহাত কাকতালীয় ঘটনাও হতে পারে। কারও বউয়ের অসুখ হতেই পারে। আবার অফিসের কর্মীরা বউয়ের অসুখের কথা না বললে ছুটি পায় না।…
ইলিয়ট রোডে তিনতলার অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে কর্নেল যথারীতি ষষ্ঠীকে কফির হুকুম দিয়েছিলেন। আজ সন্ধ্যায় শীতের ঈষৎ আমেজ পাওয়া যাচ্ছিল। কলকাতায় ডিসেম্বরের গোড়ায় শীতের চেহারা পুরো দেখা যায় না, যদিও বহু লোক গায়ে সোয়েটার-জ্যাকেট চড়ায়।
কফি খেতে খেতে কর্নেল হঠাৎ বললেন, দুই ভাইয়ের একভাই কোনও একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা আমার কাছে গোপন করছেন। শচীনবাবু কিংবা তরুণবাবু যে কোনও একজন। সেই গোপন কথাটা আমি জানতে পারলে এ রহস্য ফাঁস করা সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হল, ওঁরা কি ইচ্ছে করেই গোপন করছেন, নাকি ওঁরা জানেন না ওটা আমার কাছে মূল্যবান সূত্র হতে পারে?
জিজ্ঞেস করলাম, গোপন কথাটা কী হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
শ্যামবাবুর হত্যাকাণ্ড।
চমকে উঠে বললাম, শ্যামবাবুকে খুন করা হয়েছে বলতে চান?
তুমিও দেখেছ জয়ন্ত।
অ্যাঁ? আমি দেখেছি? কবে? কোথায়?
২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ঝড়বৃষ্টির সময় বরমডিহির সন্ধ্যানীড়ে।
কর্নেল! সেই রক্তাক্ত বডিটা শ্যামবাবুর নাকি?
হ্যাঁ। টর্চের আলোয় মুখটা দেখেছিলাম। তুমি তো জানো, যে মুখ একবার দেখি, তা আমি ভুলি না। তরুণবাবুর অফিসের গ্রুপ ফোটো থেকে শ্যামবাবুর যে ছবিটা তুলেছি, তা নিঃসন্দেহে সন্ধ্যানীড়ের দোতলার সেই ঘরে টর্চের আলোয় দেখা নিহত লোকটিরই ছবি।
শুকনো গলায় বললাম, হরিবাবুকে লেখা উড়ো চিঠিতে শ্যামবাবুকে খতম করে পুঁতে ফেলার করা ছিল বটে! সেখানে আমরা জাল ভোলা অর্থাৎ হারাধনকে দেখেছিলাম। তা হলে হারাধন…
আমার কথার উপর কর্নেল বললেন, হারাধন অন্যতম খুনী।
আর তক্তাপোসে নোংরা বিছানায় অসুস্থ শচীনবাবু সেজে যে লোকটা শুয়েছিল, সে-ও খুনী।
হ্যাঁ। আমি টর্চের আলো তার মুখে ফেলার আগেই হারাধন তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছিল।
কর্নেল চোখ বুজে ইজিচেয়ারে হেলান দিলেন। আমি দৃশ্যটা স্মরণ করছিলাম। একটু পরে বললাম, আপনার ফোন পেয়ে পুলিশ সেখানে গিয়ে কিছু দেখতে পায়নি। অন্তত রক্ত চোখে পড়া উচিত ছিল?
কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, ডাকবাংলো পৌঁছুতে আমাদের সময় লেগেছিল। সেই সময়ের মধ্যে বডি সরানো এবং রক্ত ধুয়ে ফেলা সহজ ছিল। বিশেষ করে বৃষ্টি হচ্ছিল এবং ছাদ ছিল ফাটা। তাই জল দেখে পুলিসের সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া তখন রাত্রিকাল।
পুলিশেরও লক্ষ্য ছিল একটা লাশ। তাই লাশ দেখতে না পেয়ে খাপ্পা হয়ে চলে যায়।
ঠিক বলেছ। পুলিশ আমাকে ফোনে বলছিল টালি এবং সুরকি ধোয়া জল দেখে আমি নাকি রক্ত ভেরেছি। ওই বাড়িটা নাকি ভুতুড়ে। বলে কর্নেল চোখ খুলে একটু হাসলেন। পুলিশের আইনে ভূত বলে কিছু নেই। কিন্তু পুলিশও তো মানুষ। মানুষের মনে ভূতপ্রেতে বিশ্বাস থাকা স্বাভাবিক। চিন্তা করো নির্জন এলাকায় একটা পোড়ো জরাজীর্ণ বাড়ি। এমন বাড়ি সম্পর্কে ভতে ছড়াতেই পারে।
কর্নেল! হরিবাবুও নাকি একই দৃশ্য দেখেছিলেন!
হুঁ। বলে কর্নেল টেলিফোন তুলে ডায়াল করতে থাকলেন। একটু পরে বললেন মিঃ এস. এল. মুখার্জির সঙ্গে কথা বলতে চাই।… বলুন, কর্নেল জীs. সরকার কথা বলবেন। জরুরি কথা। বলে কর্নেল কাঁধে টেলিফোন আটকে কে নিভে যাওয়া চুরুট ধরালেন। কিছুক্ষণ পরে বললেন মিঃ মুখার্জি? আপনাকে একটু বিরক্ত করছি।… আপনি গৃহদেবতা ফেরত চান… না, না। এখনও আমি সন্ধান পাইনি। কিন্তু আপনার সহযোগিতা চাইছি। …হ্যাঁ। প্লিজ আমার প্রশ্নের জবাব দিন। আশা করি, সঠিক জবাব পাব। আচ্ছা, আপনি কি হরিবাবুকে বিগ্রহ উদ্ধার করে দিতে বলেছিলেন? বলেননি?.হ্যাঁ, হ্যাঁ। তা ঠিক। …অ্যাঁ? প্লিজ রিপিট। …অনুতপ্ত হতেই পারেন। স্বাভাবিক। কিন্তু এ কথাটা আপনি কি ইচ্ছে করেই আমাকে আমাকে জানানি? …হ্যাঁ, হ্যাঁ। আপনার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ার কারণ ছিল না। …ঠিক। আচ্ছা মিঃ মুখার্জি, আর একটা প্রশ্ন। শ্যামবাবু– মানে হরিবাবুর সেই আত্মীয় খুন হওয়ার কথা আপনি জানেন? …জানেন না? হ্যাঁ। ওঁর রক্তাক্ত লাশই আমি দেখেছিলাম… জানেন না তাহলে? রাখছি।
বলে কর্নেল টেলিফোন রাখলেন। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। বললাম কী বললেন?
কর্নেল চোখ কটমটিয়ে বললেন, বরমডিহি।
তার মানে?
আমরা আজ রাতের ট্রেনে বরমডিহি যাচ্ছি। শীতটা ওখানে বড্ড বেশি। গরম জামাকাপড় সঙ্গে নেবে। চিন্তা কোরো না! দুপুরে পূর্বরেলের পি. আর. ও. কে ফোন করে ফার্স্টক্লাসে দুটো বাৰ্থ রাখতে বলেছি। দশটা পঁয়ত্রিশে ট্রেন ছাড়ার কথা। তুমি এখনই গিয়ে রেডি হও। আমি তোমাকে ট্যাক্সিতে তুলে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে যাব। কর্নেল মিটিমিটি হাসলেন। আবার ভূত দেখতে পাবে ডার্লিং! পোভড়া বাড়ির ভূত।
০৭. কর্নেলের হেঁয়ালি
হাড়কাঁপানো শীতের সকালে বরমডিহি রেলস্টেশনে যখন ট্রেন থেকে নামলাম, তখনও চারদিকে গাঢ় কুয়াশা। কয়েক হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। কর্নেল হনুমানটুপি পরেছেন। তাই ওঁর দাড়ি ঢেকে গেছে এবং মুখের খানিকটা মাত্র দেখা যাচ্ছিল। সম্ভবত এখন এটাই ওঁর ছদ্মবেশ! একটা ওভারকোটও চাপিয়েছেন। গায়ে। প্রকাণ্ড শরীর আরও প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে। পিঠে আটকানো বোঁচকা এবং হাতে সুটকেস। গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার ওভারকোটের ভেতর লুকিয়ে আছে।
আমার মাথায় টুপি এবং আষ্টেপিষ্টে জড়ানো মাফলার। পুরু জ্যাকেটের ভেতরও শীতের ঠাণ্ডা হিম থাবা টের পাচ্ছি। কর্নেলের পরামর্শে পশমের দস্তানা পরেছি। হাতে একটা হাল্কা সুটকেস।
বরমডিহি একটা হিলস্টেশন। পাহাড় দুভাগ করে রেললাইন চলে গেছে। পাড়ের গায়ে জঙ্গল কুয়াশায় ঢাকা। অক্টোবরে আমরা এখানকার নিসর্গের অন্যরূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ডিসেম্বরের সকালে এখানকার নিসর্গের অন্য রূপ দেখে আমি ভড়কে গেলাম। এর চেয়ে দার্জিলিং-কালিম্পং অনেক আরামদায়ক, যদিও সেখানে বরফ পড়ে। এখানে বরফ পড়ে না। কিন্তু এ কী বিচ্ছিরি ঠাণ্ডা!
কিন্তু এই সাংঘাতিক ঠাণ্ডার মধ্যেও কী ভিড়! কর্নেল হনুমানটুপির আড়াল থেকে বললেন, শীতে মুনলেক ট্যুরিস্টদের বড় আকর্ষণ। এ সময় কালো দৈত্যের উপদ্রব হয় না। তবে বেশিরভাগই বাঙালি। পিকনিক করতে আসে আশেপাশের শিল্পাঞ্চল থেকে। সব হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ, সরকারি বাংলো গিজগিজ করে। কলকাতার বাবুদের বাড়িগুলো ভাড়া দিয়ে কেয়ারটেকাররা এ সময় প্রচুর কামিয়ে নেয়।
উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, তা হলে এবার আমরা উঠব কোথায়?
তরুণবাবুর বাংলোবাড়িতে।
তরুণবাবু? কোন তরুণবাবু?
তোমাকে যখন তরুণবাবু বলছি, তখন তোমার বোঝা উচিত এখন একজন তরুণবাবুই আছেন, যাঁকে তুমিও চেনো।
অবাক হয়ে বললাম, শচীনবাবুর ভাই তরুণবাবু? ওঁর এখানে বাংলোবাড়ি আছে নাকি?
থাকা স্বাভাবিক। বৈমাত্রেয় দাদা ওঁকে পৈতৃক বাড়িতে ঢুকতে দেননি। কাজেই বিত্তবান ছোটভাই ক্ষোভে দুঃখে এবং জিদ করেই এখানে সুদৃশ্য বাংলোবাড়ি তৈরি করেছেন।
কিন্তু তরুণবাবুর সঙ্গে আপনার এ ব্যাপারে কখন কথা হল?
কাল দুপুরে তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে, তখন টেলিফোনে কথা হয়েছে। কর্নেল হনুমানটুপির আড়ালে হাসলেন এবং চোখে সেই কৌতুকের হাসি জ্বলজ্বল করে উঠল। দাদাকে চিট করার জন্য তরুণবাবু সব সময় তৈরি। কাজেই আমি সেই সুযোগটা নিয়েছি আর কী! এবার দেখা যাক, ঝুলির ভেতর থেকে কার বেড়াল বের হয়।
আপনি ওঁকেও কি বলেছেন শ্যামবাবুরই রক্তাক্ত লাশ দেখেছিলেন?
বলেছি। তাই শুনেই উনি–যাক্। এখন এসব কথা নয়। যা অবস্থা দেখছি, যানবাহন পাব না। পায়ে হেঁটে যেতে হবে।
বাংলোবাড়িটা কোথায়? কত দূরে?
এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার হবে। শচীনবাবুর সেই বাড়ির উল্টোদিকে কিছুটা দূরে একটা টিলার মাথায়। বাড়িটার নাম হিলটপ। তরুণবাবু জিদ করে আস্ত একটা পাহাড় কিনে ফেলেছিলেন।
সেই কনকনে ঠাণ্ডা এবং কুয়াশায় বাঁদিকে নতুন টাউনশিপ এবং বাজার এলাকা ছাড়িয়ে আমরা যে রাস্তায় মোড় নিলাম, সেটাই বরমডিহি-জাহানাবাদ রোড। সৌভাগ্যক্রমে একটা খালি ট্রাক পাওয়া গেল। ট্রাকটা একটা কাঠগোলা থেকে সবে স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় উঠেছিল। ট্রাক ড্রাইভাররাও যে এই মরশুমে বেশ কামিয়ে নেয়, তা বুঝলাম। পঞ্চাশ টাকা হেঁকেছিল। তিরিশে রফা হল। তখন তিরিশ টাকা অনেক টাকা!
কিন্তু কী আর করা যাবে? কর্নেল যা পারেন, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। মিলিটারির লোক। তার ওপর এই বয়সেও গায়ে সাংঘাতিক জোর। এদিকে ওইটুকু হেঁটেই আমি ভিজে বেড়ালছানা হয়ে গেছি।
কুয়াশার মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে ট্রাকটা সাবধানে যাচ্ছিল। প্রায় আধঘণ্টা পরে ড্রাইভার বলল, হিলটপ বাংলো বোলা? উতারিয়ে।
টাকা মিটিয়ে দুজনে নামলাম। ততক্ষণে কুয়াশা কিছুটা কমেছে। সূর্যের চেহারা বিবর্ণ হলুদ থালার মতো এবং মাঝে মাঝে কুয়াশার প্রবাহ চলেছে। ট্রাকটা চলে গেল। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন জয়ন্ত! তোমার দুর্ভাগ্য! হাঁটতেই হবে।
কেন?
মনে হচ্ছে, আধ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছি। হু! ওই তো মুনলেক যাওয়ার রাস্তা!
খাপ্পা হয়ে বললাম, ট্রাক ড্রাইভারটা তো মহা পাজি!
নাহ। ওর দোষ নেই। আমিও তো কুয়াশায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। চলো, মুনলেক রোড দিয়ে ঘুরে শর্টকাট করি। ওই রাস্তার উত্তরে হিলটপ বাংলো। সেবার বাইনোকুলারে দূর থেকে দেখেছিলাম। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, এস। জগিং করা যাক্। তা হলে ঠাণ্ডাটা কেটে যাবে। কাম অন!
বলে সত্যিই উনি জগিং শুরু করলেন। অগত্যা আমিও শুরু করলাম। কিন্তু সুটকেস হাতে জগিং বা দৌড়ব্যায়াম সহজ নয়। তাতে পাথর, ঝোপঝাড়, উঁচুউঁচু গাছের জঙ্গল। একবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। দ্বিতীয়বার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। কর্নেল আমাকে টেনে ওঠালেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশা মোটামুটি কেটে গেল। হিলটপ বাংলো কর্নেলের বাইনোকুলারে ধরা পড়ল। তারপর কী করে যে চড়াই বেয়ে বাংলোর গেটে পৌঁছুলাম কে জানে! কর্নেল হয়তো একটা আস্ত চুম্বক।
কেয়ারটেকার আমাদের দেখে দৌড়ে এলেন। আপনি কি কর্নেল সায়েব? নমস্কার স্যার। সায়েব ট্রাঙ্কল করেছিলেন ওঁর লোকাল ব্রাঞ্চ অফিসে। সেখান থেকে কাল সন্ধ্যায় আমাকে খবর দিয়ে গেছে। কিন্তু ওখান থেকে স্টেশনে গাড়ি পাঠানোর কথা। যায়নি গাডি? কী আশচর্য! বৈজু! বৈজু! ইধার আও।
একজন লোক দৌড়ে এল। কেয়ারটেকারের নির্দেশে সে আমাদের সুটকেস দুটো নিয়ে গেল। কর্নেল সহাস্যে বললেন, গাড়ি নিশ্চয় গিয়েছিল। তবে গাড়ি সম্ভবত সাদা দাড়ি খুঁজছিল এবং দাড়ির দর্শন পায়নি। কারণ তা ঢাকা ছিল।
কেয়ারটেকার হেসে ফেললেন।
সুন্দর সাজানো একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে তিনি রুম হিটার চালিয়ে ঘর গরমের ব্যবস্থা করলেন। কর্নেল বললেন, আপনিই নন্দবাবু?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম নন্দকুমার রায়। সায়েব কিংবা তাঁর গেস্ট এলে আমি আগাম চলে আসি। নৈলে বৈজই সব দেখাশোনা করে। বেজু জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবেতেই এক্সপার্ট। চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।
কফি পেলে ভাল হয়। আমি কিন্তু কফিরই ভক্ত।
নন্দবাবু হাসলেন। কফিও আছে। কোনও অসুবিধা নেই স্যার! সায়েবও আসবেন বলেছেন। তাই সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
নন্দবাবু চলে গেলে বললাম, আপনি ভবিষ্যতে আর দাড়ি ঢাকবেন না। ওঃ! আপনি দাড়ি না ঢাকলে এই কষ্টটা পেতাম না।
ডার্লিং! কথায় আছে না কেষ্ট পেতে হলে কষ্ট করতে হয়?
কী কেষ্ট পেলেন শুনি?
কর্নেল চোখে হেসে বললেন, শুধু কেষ্ট নয়, তার সঙ্গিনী রাধাকেও।
অ্যাঁ?
চেপে যাও, ডার্লিং! স্পিকটি নট। বলে ওভারকোট এবং হনুমানটুপি খুলে ফেললেন কর্নেল। চাপা স্বরে ফের বললেন, ট্রাক ড্রাইভারকে বখশিস দেওয়া উচিত। আমাকে ঠিক জায়গায় সে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
নন্দবাবু এলেন। কফি এসে যাচ্ছে। ব্রেকফাস্ট কখন খাবেন স্যার?
ঘড়ি দেখে কর্নেল বললেন, এখন সাড়ে আটটা। ন-টায় খাব বরং।
বৈজু আছে। কোনও অসুবিধে হবে না। আমি একবার বাড়ি ঘুরে বাজার টাজার করে আসছি।
আপনি কি বরমডিহির বাসিন্দা?
আজ্ঞে তিনপুরুষের বাসিন্দা। বলে নন্দবাবু ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। আমি বাথরুমে যাচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, নন্দবাবু সাইকেল নিয়ে লনে হাঁটছেন। বোঝা গেল, ভদ্রলোক যদিও কেয়ারটেকার, এই বাংলোয় আসেন কদাচিৎ। সম্ভবত বৈজুই কার্যত কেয়ারটেকারের সব দায়িত্ব পালন করে।
বাথরুম থেকে ফিরে দেখি, টেবিলে কাপ, ট্রেতে কফির পট, দুধ, চিনি এবং দুটো মস্ত পেয়ালা। প্লেট ভর্তি নানারকম স্ন্যাক্সও আছে। রুম হিটারের কাছাকাছি বসে আরামে কফি খেতে খেতে বললাম, দা হলে দৈবাৎ বিগ সন্ধান পেয়ে গেছেন?
কর্নেল চোখ কটমট করে তাকালেন।
বললাম, সরি! স্পিকটি নট।
কিছুক্ষণ পর বৈজু ট্রে নিতে এল। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আচ্ছা বৈজু! দেখো তো ইধার। ইয়ে আদমিকো পহচানতা তুম?
কর্নেল পকেট থেকে শ্যামবাবুর ছবি বের করে তাকে দেখালেন। বৈজু ঝুঁকে ছবিটা দেখল। গম্ভীর মুখে বলল, মালুম, কোহি জগাহ্ পর দেখা। লেকিন য়্যাদ নেহি আতা।
খ্যালসে দেখো, বৈজু!
সে মাথা চুলকে বলল য়্যাদ নেহি আতা হজুর!
আচ্ছা! ইয়ে চার পিকচার দেখো!
কর্নেল পকেট থেকে শ্যামসুন্দরের চারটে রিটাচ করা ছবি টেবিলে সাজালেন। এইসব ছবিতে বয়সের ছাপ দেওয়া হয়েছে এবং কোনও ছবিতে গোঁফ, কয়েকরকম ছাঁটের দাড়ি আঁকা।
বৈজু ঝুঁকে ছবিগুলো দেখছিল। চিবুকে দাড়িওয়ালা ছবিটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে একটু হাসল। ইয়ে তো ওহি আদমি।
কৌন?
দেড়-দো মাহিনা আগে সাব কা সাথ মুলাকাত করনে আয়া।
উসটাইম তুমকা সাব হেঁয়া থা?
সাব দো-দিনকে লিয়ে আয়া, হজুর! ফির চলা গেয়া কলকাত্তা।
ইয়ে আদমি উনহিকা সাথ চলা গেয়া?
নেহি হুজুর! সাব একেলা চলা গেয়া। ইয়ে আদমিকা সাথ সাবকা বহত বাতচিত করার হুয়া। সাব ইসকো নিকাল দিয়া ঘরসে।
দো মাহিনা নেহি! দেড় মাহিনা আগে।
বৈজু একটু হাসল। হোগা দেড় মাহিনা। তো কাহে হামকো ইয়ে সব বাত পুছতা হুজুর?
কর্নেল পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে বললেন, বখশিস্ বৈজু। কিসিকো মাত বোলো হাম তুমকো পিকচার দেখায়, কী ইস্ তরাহ কোই বাত কিয়া। সমঝা?
হাঁ হুজুর!
সে সেলাম ঠুকে সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বললাম, তা হলে দেখা যাচ্ছে, তরুণবাবুও আপনাকে অনেক কথা গোপন করছেন! অক্টোবরে শ্যামবাবুর সঙ্গে তরুণবাবুর এখানে দেখা করার কথা ছিল এবং দেখা হয়েছিল। সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সম্ভবত বিগ্রহের দরদাম নিয়ে তর্ক হয়েছিল। বেশি দাম চাওয়ায় চটে গিয়ে তরুণবাবু তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কিও আমার অবাক লাগছে, তরুণবাবু বিগ্রহচোরকে তক্ষুনি পুলিশে দেননি। কেন? তারও পূর্বপুরুষে অমূল্য সম্পদ ওই বিগ্রহ। চোরকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দিলেন কেন?
কর্নেল চোখ বুজে চরুট টানছিলেন। আমার কথাগুলো যেন ওর কানে ঢুকল না। হঠাৎ চোখ খুলে বেমক্কা হাঁক দিলেন, বৈজু! ইধার আও! বৈজু কিচেনের দিক থেকে সাড়া দিল। তারপর তেমনই সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে আড়ষ্টভাবে ঘরে ঢুকে সেলাম দিল।
কর্নেল বললেন, ঔর এক পিকচার দেখো বৈজু!
উনি এবার পকেট থেকে জাল ভোলা ওরফে হারাধনের ছবি বের করে দেখালেন। বৈজু কঁচুমাচু হেসে বলল, হুজুর। ইয়ে তো সাবকা সাথ কলকাত্তাসে আয়া। সাবকা সাথ চলাভি গেয়া। ইস্কা নাম–
হারাধন।
হাঁ হুজুর! সাবকা নোকর-উকর হোগা। লেকিন বলে সে হাত জোড় করল। হুজুর! মুঝে মালুম নেহি পড়ে, কাহে আপ ইয়ে সব বাত পুছতা! হাম গরিব আদমি হুজুর! নোকরি চলা যায় তো ভুখসে মর যায়েগা।
কর্নেল আর একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে ওকে আশ্বস্ত করলেন। বৈজু আড়ষ্টভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কর্নেল হিন্দিতে বললেন, তোমার সায়েব থাকার সময় কি এখানে কালো দৈত্যের উপদ্রব হয়েছিল?
বৈজু বলল, হ্যাঁ হুজুর! তার পরদিন সায়েব কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন।
কর্নেল আপন মনে বললেন, ২৬শে অক্টোবর তরুণবাবু কলকাতা ফিরে যান।
হুজুর?
কিছু না তুমি এস বৈজু। চিন্তা কোরো না। এসব কথা কেউ জানবে না।
বৈজু চলে গেল। কর্নেলকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বাইনোকুলার হাতে বাইরের বারান্দায় গেলেন উনি। বাইরে ততক্ষণে রোদ ফুটেছে।
একটু পরে বারান্দায় গেলাম। দেখলাম লনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বাইনোকুলারে কিছু দেখছেন। জায়গাটা উঁচু বলে চারদিকে বহু দূর দেখা যাচ্ছে। পূর্বদিকে গাছপালার ফাঁকে একটা চওড়া পিচের পথ দেখতে পেলাম। তারপরই চোখে পড়ল–হ্যাঁ, ওই তো সেই পোড় দোতলা বাড়িটা! অত দূর থে যেন হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে। কঙ্কালের মতো ভয়ঙ্কর একটা বাড়ি।
কর্নেল হঠাৎ ঘুরে একটু হেসে বললেন, বাইনোকুলারে ভুতুড়ে বাড়িটা দেখবে নাকি জয়ন্ত?
নাহ্! আপনি দেখুন!
ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে এল। খেয়ে নিয়ে বেরুব। তুমি—
ঝটপট বললাম, নাহ্। ঘুমোব।
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। তোমার মনে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, আমার মনেও এসেছে। তবে এখন এ নিয়ে মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। তরুণবাব। আসুন। তারপর আশা করি, ব্যাখ্যা পেয়ে যাব। ওঁর এখানে আসার উদ্দেশ্য আমাকে ব্যাখ্যা দেওয়া এবং বৈমাত্রেয় দাদাকে চিট করা। এক ঢিলে দুই পাখি বধ। ওয়েট অ্যান্ড সি।
আপনি বলেছিলেন বিগ্রহের খোঁজ পেয়ে গেছে। কোথায় কীভাবে পেলেন?
সমস্যা হল, জয়ন্ত! কখন আমার মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে যায় এবং তুমি তা নিয়ে বড় বেশি চিন্তাভাবনা করে ফেলো! ওটা একটা আইডিয়া।
আহা, খুলে বলতে অসুবিধা কী?
কর্নেল বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে বসলেন। আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, বনজঙ্গল, পাথর, তার ফের চড়াই ভেঙে ওঠার সময় বাংলা প্রবচনটা আমার মাথায় এসেছিল : কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। হ্যাঁ, কষ্ট কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একবার হোঁচট খেতে দেখলাম তোমাকে। দ্বিতীয়বার হোঁচট খেয়ে তুমি পড়ে গেলে। তোমাকে টেনে ওঠালাম। ওঠাতে গয়ে আইডিয়াটা মাথায় এল।
উনি থেমে গেলেন হঠাৎ। হাঁক দিলেন, বৈজু ব্রেকফাস্ট লাও!
মাঝে মাঝে কর্নেলের এইসব হেঁয়ালি ন্যাকামি মনে হয়। বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকলাম।
কর্নেল বললেন, যা বলছিলাম। কষ্ট করে আরোহণের সময় পদঙ্খলন হতেই পারে। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে কষ্ট করে মানুষ এগোচ্ছে। হঠাৎ পা পিছলে পতন। দা আইডিয়া!
বৈজু বারান্দার টেবিলে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল।
মাখনটোস্টে কামড় দিয়ে কর্নেল বললেন, তো যেখানেই কেষ্ট সেখানেই রাধা।
ওঃ কর্নেল! আপনি বিগ্রহ পেয়ে গেছেন বলছিলেন?
দা আইডিয়া! আইডিয়া যদি সঠিক হয়, তা বাস্তবে কাজে লাগালেই সঠিক প্রাপ্তি। যা চাইছি, তা পেয়ে যাবই। তোমার পতনের সময় যে আইডিয়া মাথায় এসেছিল তা সঠিক বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কাজেই বিগ্রহ পেয়ে গেছি, এটা নিশ্চিত। শুধু উদ্ধারের অপেক্ষা মাত্র।
নাহ্। আর মুখ খুললে আবার ক্রমাগত হেঁয়ালি শুনতে হবে। কাজেই চুপচাপ ব্রেকফাস্টে মন দেওয়াই উচিত।……
০৮. শত্রুপক্ষের কবলে
ট্রেন জার্নির ধকল এবং প্রচণ্ড শীতের দরুন কর্নেলের সঙ্গে বেরুনোর ইচ্ছে ছিল না। কম্বলমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কর্নেল সেই তুর্কি প্রজাপতির খোঁজে বেরুচ্ছেন বলে গিয়েছিলেন। এই সাংঘাতিক শীতেও নাকি ওই প্রজাতির প্রজাপিত কাবু হয় না। ধরতে না পারুন, ক্যামেরায় তার ছবি না তুলে ছাড়বেন না।
একটা নাগাদ প্রকৃতিবিদ ফিরলেন। ততক্ষণে আমি গরম জলে স্নান করে। ফিট হয়ে গেছি। কর্নেল সপ্তাহে একদিন স্নান করেন। আজ তার মানের দিন নয়। পোশাক বদলে বৈজুকে লাঞ্চ রেডি করতে বললেন।
জিজ্ঞেস করলাম, তুর্কি ঘোড়সওয়ারের দেখা পেলেন নাকি?
নাহ্। সারা তল্লাটে পিকনিকবাজদের হুল্লোড়। আর মাইক্রোফোনে ফিল্মি। গান! মুনলেকের চারদিকেও একই অবস্থা, কালো দৈত্য হানা দিলে খুশি হব।
সন্ধ্যানীড়ে যাননি?
কর্নেল হাসলেন। একটা উঁচু টিলার মাথায় চড়ে বাইনোকুলারে বাড়িটার ওপর লক্ষ্য রেখেছিলাম কিছুক্ষণ। সন্দেহজনক কিছু দেখিনি। দেখলে ক্যামেরায় টেলিলেন্স ফিট করে ছবি তুলে নিতাম।
কথাটা সেই মুহূর্তে মাথায় এল। বললাম, আচ্ছা কর্নেল, ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় আপনার সঙ্গে ক্যামেরা ছিল। কিন্তু শ্যামবাবুর লাশের ছবি তোলেননি কেন?
এতদিন পরে কথাটা তুমি জিজ্ঞেস করছ?
খেয়াল হয়নি। আপনার কথায় এটা এতদিন পরে মাথায় এল।
কর্নেল আস্তে বললেন, তখন ক্যামেরায় আর ফিল্ম ছিল না। তুমি তো দেখেছিলে, সেদিন বিকেলে মুনলেকে ফিল্মের রোলটা উজাড় করে ফেলেছিলাম। পাখি আর প্রজাপতির অবাধ রাজত্ব তখন। কালো দৈত্যের ভয়ে শরৎকালে তল্লাটে তখন ট্যুরিস্ট বা পিকনিকবাজরা পা বাড়ায় না।
ডাইনিং রুমে জোরা কৃপাসে পায়ের ধুলো দেওয়ার জন্য ডাকতে এল বৈজু। লোকটি অত্যন্ত বিনয়ী এবং সত্যিকার সেবাভক্তিপরায়ণ।
খাওয়ার সময় এতক্ষণে সাইকেলে চেপে নবাবু এলেন। নমস্কার করে বললেন, বাজার-টাজার করে দিয়ে গিয়েছিলাম। দেখলাম ইনি ঘমোচ্ছেন। ডিসটার্ব করলাম না। বৈজু বলল, কর্নেলসায়েব বেরিয়েছেন। আপনারা খাওয়া-দাওয়া করুন স্যার। আমি চৌহদ্দি ঘুরে দেখি, সব ঠিকঠাক আছে কি না। সায়েব বড্ড খুঁতখুঁতে মানুষ। লনে একটু কিছু পড়ে থাকলে কিংবা বাগানের গাছপালার তলায় আবর্জনা দেখলে খাপ্পা হন। লোক আসছে। বিকেলের মধ্যে সব ঝকঝকে তকতকে করে ফেলবে।
খাওয়ার পর ফুলবাগানের মধ্যে একটা গোলাকরা খোলামেলা বেদিতে গিয়ে। বসলাম দুজনে। ততক্ষণে এক ঝাড়ুদারনী এবং একজন লোক এসে গেছে। মনে হল, দরকার ছিল না ওদের। বৈজু সব ঝকঝকে করেই রেখেছে।
নন্দবাবু তদারক করছিলেন। কর্নেল ডাকলেন, আসুন নন্দবাবু! একটু গপ্প করা যাক।
নন্দবাবু কাছাকাছি এসে দাঁড়ালেন।
কর্নেল বললেন, আচ্ছা নন্দবাবু, আপনি শ্যামসুন্দরবাবু নামে কাউকে চেনেন?
শ্যামসুন্দর স্যার?
হ্যাঁ। আপনার সায়েবের কলকাতার অফিসে একসময় চাকরি করতেন ভদ্রলোক।
নন্দবাবু বিকৃত মুখে বললেন, একের নম্বর ধড়িবাজ। সায়েবের মুখে শুনেছি, চুরিচামারি করে পালিয়েছিল।
আপনার সায়েব বলছিলেন গত অক্টোবরে এই বাংলোবাড়িতে সে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল।
হ্যাঁ স্যার। দুপুরে এসেছিল। সেই প্রথম ওকে মুখোমুখি দেখেছি। খুব ভঁট দেখাচ্ছিল এসে।
কী ব্যাপারে?
নন্দবাবু গম্ভীর মুখে বললেন, সেটা ঠিক বলতে পারব না স্যার! মনে হচ্ছিল খুব ভঁটের সঙ্গে কথাবার্তা বলছে। সায়েব ওকে ঘরে ঢুকিয়ে দরজা এঁটে কথা বলছিলেন। আবছা কানে এসেছিল খুব তর্কাতর্কি হচ্ছে। তারপর হঠাৎ দরজা খুলে সায়েব ওকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন। হুমকি দিয়ে বললেন, ফের যদি আমার সামনে কখনও দেখি, গুলি করে মারব। শ্যামসুন্দর চুপচাপ চলে গেল।
আপনি সায়েবকে জিজ্ঞেস করেননি কিছু?
না স্যার! আমি ওঁর কর্মচারী। উনি আমার রুজির মালিক। তবে সায়েব পরে শুধু বললেন, জানো, নন্দ? এই বদমাইসটা আমার কলকাতার অফিসে ক্লার্ক ছিল। খুব বিশ্বাস করতাম ওকে। আমার একটা ইমপর্ট্যান্ট ফাইল চুরি করে পালিয়েছিল। তো সায়েবের এই কথা শুনে মনে হয়েছিল, শ্যামসুন্দর সায়েবকে ব্ল্যাকমেল করতেই এসেছিল। সায়েবের দেশবিদেশে ইমপোর্ট-এক্সপোর্টের কারবার আছে। বুঝতেই পারছেন, আজকাল এই কারবারে অনেক বে-আইনি কাজকর্ম হয়। আমি আদার ব্যাপারী। জাহাজের খবরে আমার কাজ কী?
আপনার সায়েবের সঙ্গে তার বৈমাত্রেয় দাদার এখানকার একটা বাড়ি নিয়ে নাকি মামলা চলছে?
সন্ধ্যানীড় নিয়ে। সব জানি। এখন মামলা সুপ্রিম কোর্টে উঠেছে। তবে স্যার বাড়িটার খুব বদনাম আছে। বাড়ি ফেলে রাখলেই ভূতপ্রেতের আখড়া হয়। বুঝি না, সায়েবের কেন এত জিদ!
আপনি কখনও ঢুকেছেন ও বাড়িতে?
নন্দবাবু হাসলেন। আমার মাথা খারাপ হয়েছে? দিনদুপুরেই ওই হানাবাড়ির। কাছ ঘেষে না স্থানীয় লোকেরা। তাছাড়া দরজায় তালা বন্ধ। আদালতের হাতে। বাড়িটার জিম্মা। পুলিশ আর ভূত উভয়কেই মানুষ ভয় করে স্যার!
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। ঠিক বলেছেন! বলে বাইনোকুলারে সম্ভবত কোনও পাখি দেখতে থাকলেন।
নন্দবাবু ঝাড়ুদারনীকে তম্বি করতে গেলেন। লক্ষ্য করলাম, অনবরত কোনও না-কোনও গাছে হলুদ পাতা খসে পড়ছে। শীতের হাওয়া এই উঁচুতে বেশ জোরে বইছে। কাজেই বেচারির দোষ কী? একটু পরে নন্দবাবু আবার আমাদের সঙ্গে গল্প করতে এলেন। বরমডিহিতে একসময় বাঙালিদের কত রবরবা ছিল, কত দাপট ছিল এবং কোন পুজোয় কত ধুমধাম হত, এইসব নিয়ে বকবক করে চললেন।
বাইনোকুলার নামিয়ে কর্নেল তাঁর কথা শুনছিলেন। বললেন, আচ্ছা নন্দবাবু, আপনার সায়েবের দাদা শচীনবাবু–
বৈমাত্রেয় স্যার! সেইজন্যেই তো এই মামলা মোকর্দমা!
শচীনবাবু আর এখানে আসেন না?
কই, তাকে তো অনেক বছর এখানে আসতে দেখি না। ওই বাড়িটা নিয়ে মামলা খুব বেশিদিনের নয়। কিন্তু আমি তো স্যার, বাড়িটার চেহারা বরাবর একইরকম দেখছি। সায়েবের বাবার তৈরি বাড়ি। কখনও-সখনও কলকাতা থেকে বড়সায়েবের লোকজন এসে থাকত দেখেছি। কিন্তু ভূতের বদনাম ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি।
এই বাড়িটা হিলটপ–দেখলাম তিন বছর আগে তৈরি হয়েছে। আপনি কি গোড়া থেকেই কেয়ারটেকারের কাজ করছেন?
না স্যার! আমি আমার সায়েবের ব্রাঞ্চ অফিসে চাকরি করতাম। বছর দুই হয়ে এল, সায়েব আমাকে এই কাজ দিয়েছে।
কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। আমরা একটু বেড়িয়ে আসি। মিঃ মুখার্জি সম্ভবত সন্ধ্যার আগে পৌঁছুতে পারবেন না। আমরা তার আগেই ফিরে আসব। বলে লনে হাঁটতে থাকলেন।
ওঁকে অনুসরণ করে বললাম, বাপস্! কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছিল। আপনিও কিন্তু আজকাল বড্ড বেশি কথা বলেন।
কর্নেল হাসলেন। তোমাকে বলেছিলাম, কথা বলতে বলতে দরকারি কথা বেরিয়ে আসে। মোটামুটি একটা ছবি পাওয়া গেল কি না বলো? তবে সবচে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, কালো দৈত্যের হামলার দিন অর্থাৎ ২৫ অক্টোবর শ্যামসুন্দর এই বাংলোবাড়িতে এসেছিল এবং তরুণ মুখার্জির সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়েছিল। তারপর সেদিনই সন্ধ্যায় সে সন্ধ্যানীড়ের দোতলায় খুন হয়েছিল। আমরা দৈবাৎ ওই সময় গিয়ে পড়ায় ঝটপট একটা নাটকের দৃশ্য অভিনীত হয়।
তা ঠিক। তাতে হারাধন অন্যতম অভিনেতা। কিন্তু শচীনবাবুর ভূমিকায় কে ছিল?
তুমি নাকি উঠোনের জঙ্গলে একটা ছায়ামূর্তি দেখেছিলে বিদ্যুতের ছটায়?
হ্যাঁ ঠিকই দেখেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে বলেছিলাম।
তাহলে তিনজন ভিলেন, একজন ভিকটিম। ভিকটিম শ্যামসুন্দর। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, সে একটা ফাঁদে পা দিয়েছিল। কর্নেল গেট থেকে বেরিয়ে বললেন, ও সব কথা এখন থাক। আমরা প্রকৃতিকে কলুষিত করতে চাই না খুনোখুনির কথা বলে। চলো, নিষ্পাপ সৌন্দর্যের মধ্যে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করি।
প্রকৃতি এখন বেজায় হিংস্র। ভীষণ ঠাণ্ডা।
কর্নেল চুপচাপ বাঁদিকে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলেন। আমরা আজ সকালে এই জঙ্গলের উল্টোদিক হয়ে এসেছি। এদিকে পাথর নেই। গাছগুলো উঁচু। শীতে পাতা ঝরে প্রায় ন্যাড়া হয়ে গেছে এবং ভেতরটা অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। কিন্তু শুকনো পাতার স্তূপ সর্বত্র। পা ফেললেই বিচ্ছিরি শব্দ হচ্ছে।
কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করলাম, এদিকে যাচ্ছিটা কোথায়?
একটা ঝরনা আছে এদিকে। ছোট্ট হলেও সুন্দর। তবে টুরিস্ট বা পিকনিকবাজদের ওটা পছন্দসই নয়। পাথর আর বালির ওপর দিয়ে ছটফটিয়ে চলা একফালি স্রোত ত্র। কর্নেল চোখ নাচিয়ে বললেন, ঝরনার ধারে পাথরের ফাঁকে এক বিরল প্রজাতির ক্যাকটাস দেখেছি। এসব ক্যাকটাস বালি পাথর এবং জল এই তিনটেই চায়। রোদ্দুরও চায় এরা–ওয়াটার ক্যাক্টি বলা হয়। সচরাচর মরূদ্যানেই এদের দেখা মেলে। তাই আমার অবাক লেগেছে।
ক্রমশ ঢালু হয়ে নেমে গেছে জঙ্গলটা। তারপর সতেজ গুল্মলতা চোখে পড়ল পাথরের ফাঁকে-ফাঁকে। আবছা জলের শব্দ কানে এল। কিছুক্ষণ পরে ঝরনাটা দেখতে পেলাম। সুন্দর ঝরনা তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুধারে ঘন কাটাঝোপ। কর্নেল কাটাঝোঁপের সমান্তরালে ঝরনার ভাটির দিকে হাঁটছিলেন। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গিয়ে বললেন, ভুল করছি না তো? দুপুরে দেখে গেছি। ছবি। তুলেছি। তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি খুঁজে দেখি।
বলে কর্নেল কাঁটাঝোপ সাবধানে ফাঁক করে ঝরনার পিচ্ছিল পাথরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে পা ফেলতে ফেলতে অদৃশ্য হলেন। বুঝলাম, ওইভাবে চলা আমার পক্ষে সম্ভব নয় বলেই কর্নেল একা গেলেন। মিলিটারির লোক বলে কথা।
অবশ্য আমিও কিছুদিন মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলাম ওঁর পরামর্শে। কি খবরের কাগজের একজন রিপোর্টারের পক্ষে সেই ট্রেনিং কী কাজে লাগবে ভেবে পুরো কোর্স শেষ করিনি।
তবে কর্নেলের ওইভাবে পিছল পাথরে নেচে-নেচে চলা সম্ভবত পর্বতারোহীদেরও দুঃসাধ্য। সত্যিই যেন ঝরনার সঙ্গে ব্যালে নৃত্য করতে গেলেন।
গেলেন তো গেলেনই। আর ফিরে আসার নাম নেই। একবার ডাকলাম, কর্নেল!
কোনও সাড়া এল না। তখন কয়েক পা এগিয়ে গেলাম। এখানে মাটিটা ভেজা এবং পাথরের ফাঁকে ঘন সবুজ ঘাস গজিয়েছে। বাঁদিকে কাটাঝোঁপের নীচে ঝরনা। ডানদিকে নিরেট পাথরের পাঁচিল মতো।
আচমকা সেই পাঁচিল থেকে দুটো লোক ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। এক পলকের জন্য দেখলাম তাদের মুখে রাক্ষসের বা ভয়ঙ্কর কিছুর মুখোস।
ভিজে ঘাসে পড়ে গিয়েছিলাম। আমার পিঠে বসে একজন ছুরির ডগা ঠেকাল গলায়। অন্যজন মুখে টেপ সেঁটে দিল। চোখে রুমাল বাঁধল। তারপর পিঠমোড়া করে আমার দুটো হাত দড়ি দিয়ে বাঁধল। পা দুটোও বেঁধে ফেলল। আমি আতঙ্কে হতবুদ্ধি হলেও চেঁচানোর চেষ্টা করিনি। কারণ গলায় ছুরির ডগা।
ওই অবস্থায় তারা আমাকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল। কখনও টের পেলাম চড়াইয়ে উঠছি, কখনও বুঝলাম ঢাল বেয়ে নামছি। ভাগ্যের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না।
কতক্ষণ পরে একখানে আমাকে মড়ার মতো নামিয়ে রেখে একজন চাপা স্বরে বলল, একটু পরে রাস্তা পেরোতে হবে। এখনও পিকনিকওয়ালাদের গাড়ি যাচ্ছে।
এখানেই শেষ করে দে না খুদে টিকটিকিটাকে।
নাহ্। বুড়ো টিকটিকিটার সঙ্গে রফা করতে হলে এটাকে এখনও জ্যান্ত রাখতে হবে। ও ব্যাটা এক ঘুঘু। মালের হদিস ও ব্যাটা ঠিকই জানে।
বুঝতে পারলাম, কর্নেলের ওপর আমার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে।
০৯. বিগ্রহ এবং CL-X
ওরা আমাকে একটা ঘরের মেঝেয় মড়ার মতো চিৎ করে শুইয়ে রেখেছিল। চোখের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঘর। কিছুক্ষণ পরে আমার মাথার দিক থেকে একজন গলায় ছুরির ডগা ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই ব্যাটা! বাঁচতে যদি চাস, ওই ঘুঘু ব্যাটাচ্ছেলেকে একটা চিঠি লেখ।, বলব লিখবি। কৈ হে? কাগজ কলম দাও। দেরি করা যাবে না।
মাথার দিকে টর্চের আলো জ্বলল। পুরনো জরাজীর্ণ ঘর। পলেস্তারা খসে গেছে। এটা সেই সন্ধ্যানীড় নয় তো?
খসখস করে কাগজ ছেঁড়ার শব্দ হল। তারপর একজন আমাকে কাত করে হাতের বাঁধন খুলে দিল। আগের জন তেমনই ভুতুড়ে গলায় বলল, কিসের ওপর কাগজ ফেলে লিখবে? নোটবইটা দাও। ওটার ওপর লিখুক।
আমার চোখের সামনে ফুলহাতা সোয়েটার পরা একটা হাতে শ্যামসুন্দরের সেই কালো নেটবইটা এবং তারই একটা ঘেঁড়া পাতা দেখতে পেলাম। বুঝলাম, হরিবাবুর কাছ থেকে এরাই তা হলে নোটবইটা হাতিয়েছিল। গলায় ছুরির ডগা এবং মুখে টেপ সাঁটা। চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় কী?
যা বলছি লেখ। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বরাবরেষু।
লিখলাম। হাতের লেখা জড়িয়ে যাচ্ছিল।
এবার লেখ। আপনি অত্র পত্রপাঠকপূর্বক মাল মুনলেক রোডের মোডে মাইল স্টোনের পিছনে রাখিয়া দিবেন। সাবধান! কাহাকেও জানাইবেন না। আমি বন্দী হইয়াছি। মাল পাইলে আমার প্রাণ বাঁচিবে। আপনি পুলিশ কিংবা নিজের জোরে হস্তক্ষেপ করিলে আমার গলা শ্যামসুন্দরের মতো ফাঁক হইয়া যাইবে। ইহারা নজর রাখিয়াছে। আমার প্রাণরক্ষা করুন। ইতি। নাম সই কর। হ্যাঁ– জয়ন্ত চৌধুরি।
অন্যজন ভুতুড়ে গলায় বলল, পুনশ্চ লেখাও। টাইম দিতে হবে না?
ঠিক, ঠিক। এই ব্যাটা! পুনশ্চ লেখ। রাত্রি দশটা পর্যন্ত সময়। দশটা বাজিয়া গেলেই আমার গলা ফাঁক। হুঁ। ফের সই কর। তারিখ লেখ। গুড! এই! এক্ষুণি চলে যাও। হিলটপের গেটের সামনে ঢিল চাপা দিয়ে রেখে এসো। সাবধান। গুঁড়ি মেরে ঝোঁপের মধ্যে এগোবে। বুঝেছ? তুমি ধরা পড়লে মাল পাব না। কিন্তু এ ব্যাটার গলা ফাঁক হবে এই যা!
শুনেই আমার মাথা ঘুরে উঠল। টর্চ ততক্ষণে নিভে গেছে। আবার আমাকে কাত করে হাত দুটো বাঁধল ওরা। ছুরির ডগা সরে গেল। অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে গেল। দরজা আবার বন্ধ হল। মাথার কাছের লোকটা হুমকি দিল, নড়বে না। নড়লেই গলা ফাঁক। কারণ চিঠি তো লিখেই দিয়েছ। আর তুমি বাঁচলেই বা কী, মরলেই বা কী? তবে খামোকা এই শীতের রাত্তিরে ছুরি চালাতে ইচ্ছে করছে না। ইস! হাত দুটো ঠাণ্ডায় পাথর হয়ে গেছে। একটু আগুন জ্বেলে সেঁক দিতে পারলে হত। দেখা যাক।
এতক্ষণে গলাটা একটু চেনা মনে হল, যদিও ফিসফিস করে কথা বলছিল সে। হারাধন নাকি? কে জানে! চুপ করে পড়ে থাকাই ভাল। কর্নেলের পাল্লায় পড়ে এমন ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়, কিন্তু এবার যা বুঝছি, বাঁচার আশা কম। কারণ কর্নেল সহজে হার স্বীকার করতে চাইবেন না। দুর্ভাবনায় বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল।
মাথার কাছের লোকটা ফস্ করে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল। যেন ইচ্ছে করেই আমার মুখের দিকে ধোঁয়া ছাড়ছিল সে। মুখে টেপ সাঁটা। কাশি আসছিল। কাশবার চেষ্টা করতেই আবার গলায় ছুরির ডগা। চুপ ব্যাটা! টু শব্দ করলেই জবাই করব।
সময় কাটছিল না। ফাঁসির আসামীদের মনের অবস্থা বুঝি এইরকমই হয়। শেষ পর্যন্ত হয়তো তারা আমার মতোই মরিয়া হয়ে ওঠে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য।
কতক্ষণ–কতক্ষণ পরে বাইরে কোথাও দুবার কেউ শিস দিল। আমার মাথার কাছে বসে থাকা লোকটাও পাল্টা দুবার শিস দিল।
তারপর দরজা খুলে একটা ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকল এবং দরজা বন্ধ করল। টর্চের আলো জ্বলছিল। তাই সেই রাক্ষুসে মুখোশে ঢাকা মুখটা দেখতে পেয়েছিলাম। গায়ে ফুলহাতা বেঢপ নীলচে সোয়েটার। পরনে নোংরা প্যান্ট কাদায় বিচিত্তির।
টর্চ নিভে গেল। পেয়েছ? দিয়েছে ব্যাটা ঘুঘু?
হুঁঃ!
এদিকে নিয়ে এস। মালটা দেখি।
আমার নড়া বারণ। তবে টের পেলাম আমার মাথার দিকে টর্চ জ্বেলে ওরা। মাল পরীক্ষা করছে।
এটাই বটে তো?
হুঁউ। একই প্যাকেট। খুলে দেখে নিয়েছি। গয়নাটয়না সব আছে।
শ্যামা হারামজাদা ট্রেচারি না করলে মারা পড়ত না।
ছাড়ো! বেরুনো যাক।
শোনো! এই খুদে টিকটিকিটাকে বরং শেষ করে ফেলো।
না, না। খুনখারাপি করার রিস্ক আছে।
শ্যামার মতো ইদারায় বডি ফেলে দিলেই হবে। তারপর পাথর ফেলে ঢেকে দেব। শ্যামার বডি এখনও ইদারার তলায় আছে। টের পেয়েছে কেউ?
বোকামি হবে বুঝছ না কেন? বুড়ো টিকটিকিকে সেবার ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়নি। এ ব্যাটা ওর কাছের লোক। তাছাড়া রক্তটক্ত পড়ে থাকবে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। ইদারায় জলও ছিল। এখন ইঁদারায় পাথর ভর্তি। রক্ত কিসে? চলো! এ ব্যাটা এমনিভাবে পড়ে থাক।
ওরা বেরিয়ে গেল। দরজা ভেজিয়ে দিয়েই গেল।
কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলাম। হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করলাম। দ্বিতীয় বারের বাঁধনটা আগের মতো মজবুত ছিল না। গিট টানাটানি করে কবজিতে ব্যথা ধরে গেল। তারপর অবশেষে খুলে গেল। এবার পায়ের বাঁধন খুলে ফেললাম। তারপর মুখের টেপ খুলতে সে এক যন্ত্রণা!
ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে সাবধানে পা বাড়িয়ে এবং টলতে টলতে দেওয়াল হাতড়ে দরজা পেলাম। আমার বরাত! দরজা ওরা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে যায়নি।
হাতের যন্ত্রণা তেমন কিছু নয়। কিন্তু পায়ে খিল ধরে গেছে। বেরিয়ে গিয়ে বারান্দা পেলাম। এবার অন্ধকার কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে উঠল। একটু পরেই জায়গাটা চিনতে পারলাম। সন্ধ্যানীড়ের একতলার একটা ঘরে ছিলাম।
কিন্তু বেরুনোর দরজা বন্ধ। অগত্যা উঠোনে নেমে গিয়ে পাঁচিল আঁকড়ে অনেক কষ্টে ওপরে উঠলাম। তারপর ঝাঁপ দিলাম। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম।
গাড়ির হেডলাইট লক্ষ্য করে বরমডিহি-জাহানাবাদ রোডে পৌঁছুলাম। তারপর উল্টোদিকে হিলটপ বাংলোর আলো চোখে পড়ল।
বাংলোর গেটে পৌঁছুতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল জানি না। আমাকে দেখতে পেয়েছিল বৈজু। সে দৌড়ে এল। তারপর চাচামেচি শুরু করল, হুজুর। কর্নিলসাব! হুজুর। ছোটাসাব আয়া!
আশ্চর্য! কর্নেলের কোনও সাড়া পেলাম না। টলতে টলতে বারান্দায় উঠলাম। তারপর ঘরে ঢুকে দেখলাম, কর্নেল হেলান দিয়ে বসে চুরুট টানছেন।
উনি মুখ তুলে আমাকে দেখে একটু হাসলেন। আগে পোশাক বদলাও, ডার্লিং! বাথরুমে গরম জলে হাত-পা-মুখ ধুয়ে নাও! একেবারে পোডড়া বাড়ির ভূত হয়ে ফিরেছ। বলে হাঁক দিলেন, বৈজু! জলদি কফি লাও!
ক্ষোভে অভিমানে গুম হয়ে বাথরুমে গেলাম। একটু পরে পোশাক বদলে সোফায় বসলাম। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। বৈজু এক পেয়ালা কফি রেখে গেছে। কফি পানের দরকার ছিল।
কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, একটু রিস্ক ছিল তা অস্বীকার করছি না। তবে প্ল্যানমাফিক কাজ হয়েছে। তরুণবাবু যে ফাঁদ পেতেছিলেন, তা অনবদ্য। ওঁর সহযোগিতা না পেলে শ্যামবাবুর খুনীদের ধরার চান্স ছিল না। হ্যাঁ, খুনীরা এতক্ষণ অবশ্যই ধরা পড়ে গেছে। প্রতি মূহূর্তে আশা করছি, তরুণবাবুর গাড়ির হর্ন বেজে উঠবে।
এতক্ষণে মুখ খুলতে হল। আপনার সঙ্গে এই শেষ।
কর্নেল চোখ খুলে হাসলেন। শেষ কী জয়ন্ত? শুরু বলো!
আশ্চর্য! আপনি আমাকে একলা ফেলে রেখে—
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তরুণবাবুর প্ল্যান!
তার মানে?
তরুণবাবু গত রাত্রে আমাদের সঙ্গে ট্রেনেই এসেছেন। এ. সি. কামরায় ছিলেন। ওঁর জিপে আসানসোল হয়ে আসার ব্যাপারটা একটা চাল মাত্র। তাছাড়া আমার সঙ্গে পরামর্শেরও দরকার ছিল। কিন্তু তখনও আমি বিগ্রহ কোথায় আছে জানতাম না। আজ সকালে এখানে আসার পথে দৈবাৎ যখন বিগ্রহের সন্ধান পেলাম, তখন আবার নতুন প্ল্যান ছকতে হল। চলে গেলাম ওঁর কাছে। কথা মতো উনি উঠেছিলেন ওঁর এক বন্ধুর বাড়িতে। উনি বললেন, পুরো প্ল্যান সত্যি বদলানো দরকার। খুনীদের একবারে হাতেনাতে ধরতে হবে নইলে পুলিশ নিছক সন্দেহক্রমে ওদের ধরার ঝুঁকি নেবে না। আদালতে কিছু প্রমাণ করাও কঠিন হবে। শ্যামসুন্দরের লাশই তো পাওয়া যায়নি। ওদের হাতে যাওয়া দরকার। কিন্তু কী ভাবে তা ওদের হাতে যাবে? তখন তরুণবাবু বললেন, জয়ন্তবাবুকে কাজে লাগানো যাক। হাতার আগে বলা দরকার, বিগ্রহচোর শ্যামবাবুর খুনীদের একজন কলকাতাতেই তরুণবাবুর সঙ্গে ইদানীং ফোনে যোগাযোগ রাখত। সে বলত, বিগ্রহ উদ্ধার করতে পারলে তরুণবাবুকেই সে দেবে। তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। তরুণবাবু প্রথমে রাজি হননি। পরে রাজি হন। কেন রাজি হন, বলছি। উনি ঠিক করেন, বিগ্রহ পেলে বেনামী চিঠি লিখে ওঁর দাদা শচীনবাবুকে জানাবেন, মামলা মিটমাট করে নিলে বিগ্রহ ফেরত পাবেন। আর মামলা মিটমাট করার মানে তরুণবাবুর মাকে মহেন্দ্রবাবুর বিবাহিতা স্ত্রী বলে স্বীকার করে নেওয়া। এখানেই তো তরুণবাবুর যত ক্ষোভ!
বললাম, কিন্তু আমাকে কাজে লাগানো ব্যাপারটা কী? কী বাঁচা বেঁচেছি, এখনও তো শোনার মর্জি নেই আপনার।
শুনবখন। আগে তুমি ব্যাকগ্রাউন্ডটা শুনে না। কাল দুপুরে তো তরুণবাবুর সঙ্গে আমার বরমডিহি আসার কথা হয়ে গেছে। বিকেলে সেই লোকটা ট্রাঙ্ককল করে তরুণবাবুকে জানায়, বিগ্রহ উদ্ধারের কাজ চলছে। তরুণবাবু যেন বরমডিহি চলে আসেন। সে তার সঙ্গে এখানে যোগাযোগ রাখবে। কিন্তু তরুণবাবু হিলটপে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তাই তাকে বলেন, তিনি বরমডিহি যেতি রাজি। রাতের ট্রেনেই যাবেন। তবে হিলটপে যোগাযোগ করার ঝুঁকি আছে। দৈবাৎ তার দাদা শচীনবাবুর কোনও বন্ধুর চোখে পড়ে গেলে ঝামেলা হবে। তার চেয়ে বরং তাঁর সঙ্গে সে যেন রেল স্টেশনেই যোগাযোগ করে। লোকটা বলে, তার পরনে থাকবে নীলচে সোয়েটার। মাথায় মাংকিক্যাপ। চোখে সানগ্লাস। মুখে দাড়ি। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে ফের বললেন, দুপুরে তরুণবাবুর কাছে গিয়ে শুনলাম দেখা হয়েছে। লোকটাকে খুব চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু স্মরণ করতে পারেননি। সে ফিসফিস করে কথা বলছিল। বিগ্রহ উদ্ধারের কাজ নাকি পুরোদমে চলছে। উদ্ধার হলেই সে যোগাযোগ করবে। তবে তরুণবাবুর ঠিকানা তার জানা দরকার। তরুণবাবু তাকে তার বন্ধুর বাড়ি ঠিকানা দেন এবং দুটো নাগাদ সেখানে দেখা করে কাজ কত দূর এগোলো তা জানাতে বলেন। এটা তরুণবাবুর একটা আইডিয়া। কারণ লোকটার সঙ্গে আরও কথা বলা দরকার। কেন তাকে তার চেনা মনে হয়েছে, এই খটকা দুর করার ইচ্ছে ছিল। ইতিমধ্যে আমি গিয়ে সব জানালাম তাকে। তখন উনি বললেন লোকটা এলে তাকে এখানে আমার আসার কথা জানাবেন। আমিই যে বিগ্রহ উদ্ধার করেছি, তাও জানাবেন। আমার হাত থেকে বিগ্রহ উদ্ধারের ফন্দি বাতলাবেন। অর্থাৎ তোমাকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে।
কর্নেল সকৌতুকে হাসলেন। লোকটা এই টোপ গিলবে কি না তরুণবাবুর অবশ্য সন্দেহ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সে টোপ গিলেছিল। এক সাঙ্যাতকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। বাইনোকুলারে দূর থেকে তোমার দুর্দশা দেখে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে? ওই সময় ওদের পুলিশ ধরলে বড় জোর একটা ছিনতাই কেট-টেস হত। তোমাকে কিডন্যাপ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখানো যেত না। আবার বিগ্রহের প্রসঙ্গ তুললে বিগ্রহ রহস্য ফাঁস হয়ে যেত। শচীনবাবু নিশ্চয় এসে নাক গলাতেন। অনেক হ্যাঁপা ছিল না কি? তাঁর অলরেডি পুলিশের কাছে এ বিষয়ে ডায়েরি করা আছে।
এ-ও কম হ্যাঁপা গেল না আমার ওপর!
তা একটু থ্রিলিং অভিজ্ঞতা হল। মন্দ কী?
এইসময় বাইরে হর্ন বাজল। কর্নেল নড়ে বসলেন। একটু পরে বাংলোর পোর্টিকোতে গাড়ি থামার শব্দ হল। তারপর তরুণবাবু ঘরে ঢুকে ধপাস করে বসে বললেন, কর্নেল সায়েব। শেষ পর্যন্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল! এতক্ষণ অপেক্ষা করেও বদমাসটা এল না। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। আর কী করা যাবে? বিগ্রহ হাতে পেয়েই কেটে পড়েছে! আমারই বোকামি হয়ে গেল।
কর্নেল হঠাৎ হা-হা করে হেসে উঠলেন।
তরুণবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, হাসছেন যে?
ওটা নকল বিগ্রহ মিঃ মুখার্জি।
নকল? সে কী!।
হ্যাঁ। হরিবাবুর বাসায় আপনাদের গৃহদেবতার ছবি দেখে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছিল। জয়ন্ত যেদিন ওয়ার্ডগেম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, সেইদিন ও বাড়ি যাওয়ার পর আমি বৈষ্ণবদের আরাধ্য রাধাকৃষ্ণের প্রাচীন বিগ্রহ সংক্রান্ত বই পড়ছিলাম। ষোড়শ শতকে একই ছাদের বিগ্রহ তৈরি হত। সেই রাত্রে আমার স্নেহভাজন এক ভাস্করকে ফোনে ডেকে পাঠাই। তাকে একটি বিগ্রহ পরদিন তৈরি করে দিতে বলি। সাধারণ কালো পাথরের বিগ্রহ তৈরি করে নকল অলঙ্কারে সাজিয়ে দিয়েছিল সে। আমার স্মৃতি প্রখর। কী কী অলঙ্কার আপনাদের বিগ্রহে ছিল, আমার মনে স্পষ্ট। কাজেই নকল প্রাচীন শৈলীর বিগ্রহ তৈরিতে অসুবিধে হয়নি। অবশ্য তখনও জানতাম না, কেন এটা করলাম। হয়তো ভেবেছিলাম, এটা কোনও কাজে লাগতেও পারে। তবে–নাহ। সঠিক জানি না। ইনটুইশন বলতেও পারেন!
তরুণবাবু শুনছিলেন অবাক হয়ে। আবার বললেন, তা হলে ওটা নকল বিগ্রহ?
আমি বললাম, খুনী দুটো বলছিল, একই প্যাকেটে মোড়া আছে। প্যাকেট পেলেন কোথায়?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। প্যাকেটটা একই। যে প্যাকেটে শচীন্দ্রলাল মুখার্জি–
তরুণবাবু তার কথার ওপর বললেন, আগে বলুন, আসলটা কি সত্যিই আপনার কাছে আছে?
আছে। দেখাচ্ছি। তার আগে বলি, কীভাবে ওটার খোঁজ পেলাম। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। সংক্ষেপেই বলি। শ্যামসুন্দরের নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেম গ্র্যাব, রেয়ার, আর্টস, বেস্ট শব্দছকের কথা আজ দুপুরে আপনাকে বলেছিলাম। জয়ন্ত অক্ষরগুলো সংখ্যায় রূপান্তরিত করে টোটাল ফিগার ১৬০ দেখিয়েছিল। জয়ন্ত ইজ রাইট। এই সংখ্যাটা সত্যিই একটা সংকেত। এটাকে রোমানসংখ্যায় দেখলে হবে [ ঈ অর্থাৎ সি ১০০, এল ৫০ এবং এক্স ১০। তো আজ সকালে কুয়াশার মধ্যে ট্রাক ড্রাইভার আমাদের মুনলেক রোডের মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিল। জঙ্গল এবং পাথরে ভর্তি চড়াই ভেঙে শর্টকাটে আসার সময় জয়ন্ত একখানে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। ওকে টেনে তুলতে গিয়ে একটা পাথর চোখে পড়ল। পাথরটা ছোট্ট একটা মাইলস্টোনের মতো মাটিতে পোঁতা ছিল। ঘাসের মধ্যে ইঞ্চি ছয়েক বেরিয়েছিল। ওতেই হোঁচট খেয়েছিল জয়ন্ত। চমকে গেলাম। পাথরটায় খোদাই করা আছে [ ঈ!ৈ সন্দেহ চেপে রাখলাম তখনকার মতে। দুপুরে আপনার সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় পাথরটা টানাটানি করে উপড়ে ফেললাম। এ আমার পক্ষে সহজ কাজ। তলায় নাইলনের দড়িতে বাঁধা পলিথিন পেপারে মোড়া একটা প্যাকেট ছিল। টেনে তুললাম। বাঁধন খুলে পলিথিন পেপারের মোড়ক ছাড়িয়ে আরও একটা মোড়ক দেখলাম। সেটা শক্ত খাকি রঙের প্যাকিং পেপার। ব্যস! বেরিয়ে পড়ল রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। ছোট্ট বিগ্রহ। ৯ ইঞ্চি বাই ৬ ইঞ্চি সাইজ। তবে গয়নাগুলো নেই। শ্যামসুন্দর রত্নের লোভ সামলাতে পারেনি। বেচে দিয়েছিল নিশ্চয়।
বলে কর্নেল তার স্যুটকেস খুলে সাদা পলিথিন পেপারে মোড়া বিগ্রহ বের করলেন। মোড়ক খুলতেই কষ্টিপাথরের তৈরি রাধাকৃষ্ণের প্রাচীন বিগ্রহ বেরিয়ে পড়ল। তরুণবাবু গৃহদেবতাকে দুহাতে তুলে মাথায় ঠেকিয়ে তারপর টেবিলে রাখলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, অক্টোবর মাসে শ্যাম টেলিফোনে আমার সঙ্গে এখানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল। এত বছর গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর হঠাৎ তার ফোন এবং হারানো গৃহদেবতা উদ্ধারের গল্প! স্বাভাবিকভাবে আমি আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। কিন্তু সে এসে এক লক্ষ টাকা ক্যাশ দাবি করল। তার স্পর্ধা দেখে রাগ হয়েছিল। উপরন্তু সে হুমকি দিতে শুরু করল। দাদাকে সে জানিয়ে দেবে আমিই বিগ্রহ চুরি করেছিলাম তাকে দিয়ে। সেই বিগ্রহ কোথায় আমি লুকিয়ে রেখেছি, তা-ও নাকি জানিয়ে দেবে। দাদা নাকি বরমডিহিতে এসেছেন এবং এক বন্ধুর বাড়িতে আছে। বুঝুন তাহলে! আমার মনে হল এটা ব্ল্যাকমেল করার শামিল। আমি ওকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, শ্যামসুন্দর এর পর আপনার দাদার কাছে গিয়ে ফাঁদে পড়েছিল। সেদিন ২৫ অক্টোবর। তবে এটা ঠিক, শচীনবাবু খুনখারাপি চাননি। ওঁর অত্যুৎসাহী সাঙ্গোপাঙ্গ ওকে খুন করে ওর পকেট হাতড়ে কালো একটা নোটবই পেয়েছিল মাত্র। যাই হোক, রাত হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়া যাক। আপনি কি এখানে থাকবেন, নাকি বন্ধুর বাড়ি ফিরে যাবেন?
তরুণবাবু বললেন, নাহ্। আমি ব্রতীনের কাছে বিদায় নিয়ে এসেছি। গাড়িটা নিতে সকালে ওর ড্রাইভার আসবে।…
১০. নাটকের তৃতীয় চরিত্র
ঘুম ভেঙেছিল কর্নেলের ডাকে। তখন প্রায় দশটা বাজে। উনি অভ্যাসমতো প্রাতঃভ্রমণ থেকে ফিরেছিলেন। বাইরে রোদ্দুর ঝলমল করছে। তবে দুরে ইতস্তত ঘন কুয়াশা। বারান্দায় বসে ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে বললেন, তরুণবাবু ওঁর ব্রাঞ্চ অফিসের জিপ নিয়ে কলকাতা রওনা হয়ে গেছেন।
বললাম, বিগ্রহ ওঁকে দিয়েছেন নাকি?
কেন দেব না? ওঁদেরই পূর্বপুরুষের ঐতিহাসিক বিগ্রহ।
আমার আর এখানে থাকতে একেবারে ইচ্ছে করছে না!
কর্নেল হাসলেন। পায়ের ব্যথা কমেছে?
নাহ।
তোমাকে নিয়ে গিয়ে দেখাতাম সন্ধ্যানীড়ের কোন ঘরে বন্দী ছিলে।
দেখতে চাইনে।
আমি দেখে এসেছি। দুটো দড়ি, একটা রুমাল এবং একটুকরো টেপ ওই ঘরে পড়ে ছিল। কুড়িয়ে এনেছি। স্যুভেনির ডার্লিং! যত্ন করে সাজিয়ে রেখো।
আপনি রাখবেন।
দুটো ছেঁড়া মুখোশ উঠোনের জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছি। ইঁদারায়—
আপনি তো আমার মুখে কিছু শোনেননি এখনও।
বুঝতে পেরেছি। শুনবখন। তো যা বলছিলাম। ইদারায় উঁকি মেরে দেখলাম পাথরে ভর্তি। কেমন একটা বিচ্ছিরি গন্ধ।
শ্যামসুন্দরের লাশ উঁদারার তলায় আছে। ওরা বলাবলি করছিল।
পুলিশকে জানিয়ে এসেছি। পুলিশ ইদারা থেকে শ্যামসুন্দরের কঙ্কাল উদ্ধার করতে ব্যস্ত। কর্নেল ডিমের পোচ চেটেপুটে খেয়ে ফের বললেন, তুমি যে ঘরে ছিলে, তার পাশের একটা ঘরের মেঝে খোঁড়া হয়েছে দেখলাম। এল প্যাটার্নের বাড়ি। সামনে দাঁড়িয়ে ডানদিক থেকে গুনলে ওটা ৮ নম্বর ঘর। আবার বাড়ির ভেতর উঠোনে দাঁড়িয়ে ডান দিক থেকে গুনলে যেটা ৮ নম্বর ঘর, সেটারও মেঝে খোঁড়া দেখতে পেলাম।
এক পলকের জন্য কথাটা মাথার ভেতর ঝিলিক দিয়েছিল। বললাম, ৮ নম্বর ঘর! মাই গুডনেস! কর্নেল, আপনি হরিবাবুকে বলেছিলেন না ৮ নম্বর ঘরের মেঝেয় বিগ্রহ পোঁতা আছে?
কর্নেল এবার আস্তে সুস্থে কফিতে চুমুক দিয়ে বললেন, । হরিচরণ গাঙ্গুলি। কাল তার এবং হারাধনের তোমাকে মড়ার মতো কাঁধে বইতে একটু কষ্ট হয়ে থাকবে। আহা বেচারারা খামোকা কষ্ট করল। বিগ্রহ যদি বা হাতাল, তা-ও নকল!
উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু হরিচরণকে তো অন্য কোন পার্টি শ্যামসুন্দরের কালো নোটবই ফেরত চেয়েছিল।
ওটা হরিচরণের চালাকি। আলিপুর কোর্টচত্বরে সেই ছেলেটি আমাকে বলেছে, হরিচরণই তাকে দিয়ে একটা মাত্র চিঠি লিখিয়েছিল। হরিচরণের মুখে শোনা মহীবাবু নামে কোন রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার এবং আউট্রাম ঘাটে সাদা পোশাকের পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার ঘটনা স্রেফ গুল। মহীবাবু নামটাও তার বানানো। আসলে ২৫ অক্টোবর ঝড়বৃষ্টির সময় হারাধন এবং সে শ্যামসুন্দরকে ফঁদে ফেলে খুন করে তার পোশাক খুঁজে বিগ্রহের সূত্র পেতে চেয়েছিল। কালো নোটবইটা পেয়ে যায় শ্যামসুন্দরের পকেটে। সাংকেতিক ছকটা নিয়ে মাথা ঘামায়। তারপর আমার শরণাপন্ন হয়। বাকিটা কলকাতা ফিরে বুঝবে। তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হরিচরণের নাকে বাঁ পাশে বেঢপ গড়নের জডুল। সে যখন সন্ধ্যানীড়ের দোতলায় একটা ঘরে পাশ ফিরে চাঁদর মুড়ি দিয়ে এম. এল. মুখার্জি সেজে শুয়ে ছিল, তখন জডুলটা আমি দেখে ফেলেছিলাম। তাই কলকাতা ফিরে সে মরিয়া হয়ে জডুলটা অপারেশন করিয়েছিল।
কিন্তু বিদ্যুতের ছটায় উঠোনে আর একজনকে আমি দেখেছিলাম।
তাকে কলকাতা ফিরে আবার দেখাব। কফি শেষ করে কর্নেল চুরুট ধরালেন। বললেন, হরিচরণ এবং হারাধনের ফোটো পুলিশকে দিয়েছি। তার কোনওনা-কোনও সময় ধরা পড়বে। তরুণবাবুরও এখানে প্রভাব আছে। পলি শ্যামসুন্দরের কঙ্কাল পেলেই এবার অ্যাকশন নোবে। কারুর বিরুদ্ধে এতে অভিযোগ করতে গেলে কেউ যে সত্যিই খুন হয়েছে, তা দেখানো দরকা কাজেই অক্টোবরে যে অভিযোগ করতে আইনগত বাধা ছিল, এখন আর নেই।
একটু পরে বললাম, হরিচরণের ঘরে শ্যামসুন্দরের কালো নোটবই পাওয়ার রহস্য ফাস হল তা হলে। কিন্তু কর্নেল, হরিচরণ আপনার শরণাপন্ন হল কেন, সন্ধ্যানীড়ে আপনার পেটেন্ট সান্তা ক্লজ মার্কা চেহারা হারাধন এবং তার দেখা।
কর্নেল গম্ভীর মুখে বললেন, দুটো কারণে। একটা কারণের কথা আগেই বললাম। সাংকেতিক সূত্র কৌশলে জেনে নেওয়া। কিংবা ভেবেছিল, আমিই ওকে সেই সূত্রর সাহায্যে বিগ্রহ উদ্ধার করে দেব। তবে এটা গৌণ কারণ। মুখ্য। কারণ হল ওর জডুল। তার নাকের পাশে জডুল নেই, এটা দেখাতে গিয়েছিল। অতি বুদ্ধির গলায় দড়ি।
তার মানে, সে আপনার সবিশেষ পরিচয় ২৫ অক্টোবরের আগে থেকেই জানত?
নাহ। সে জনত না। পরে জেনেছিল। আমি শচীনবাবুর বাড়িতে প্রথম যাওয়ার পরই সে জানতে পারে আমি কে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় প্ল্যান করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়েছিল। কিন্তু যেদিন আমি তাকে জডুলের কথা জিজ্ঞেস করলাম, সেদিনই সে গা ঢাকা দিল এবং বরমডিহিতে চলে এল। তাকে সন্ধ্যানীড়ের ৮ নম্বর ঘরের মেঝেয় বিগ্রহ পুঁতে রাখার মিথ্যা সূত্র দিয়েছিলাম। তাই গা ঢাকা দিয়ে সে বিগ্রহ উদ্ধারের ফিকির করেছিল। জয়ন্ত! রেলস্টেশনে তরুণবাবুকে এই হরিচরণ দেখা করেছিল। ক্লিয়ার?
ক্লিয়ার। তবে এখনও কিছু–
বাকিটা কলকাতায় ক্লিয়ার হবে।
.
আমরা সেদিনই দুপুরের বাসে আসানসোল এবং সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতা ফিরেছিলাম। কর্নেল বলেছিলেন, সময়মতো আমাকে ডাক দেবেন। সেই ডাক পেলাম দুদিন পরে সকালবেলায়।
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দেখি, তরুণ মুখার্জি বসে আছেন। বেশ হাসিখুশি মুখ।
কর্নেল বললেন, তরুণবাবুর বেনামী চিঠিতে কাজ হয়েছে, জয়ন্ত! শচীনবাবু আমাকে ডেকেছে। এখন আমার ভূমিকা মিলম্যানের। দেখা যাক। সাড়ে দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। এখন দশটা বাজে। বেরুতে হবে।
তরুণবাবু বললেন, জয়ন্তবাবু! হরি এবং আমার অফিসের বজ্জাত বেয়ারা অবাধন বরমডিহি রেলস্টেশনেই ধরা পড়েছে।
বললাম, সুখবর! কিন্তু মিঃ মুখার্জি, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। হারাধন তো ২৫ অক্টোবর হিলটপ বাংলোয় আপনার কাছে ছিল। সে কী করে—
শুনুন। শ্যামসুন্দরকে গলাধাক্কা দিয়ে তাড়ানোর কিছুক্ষণ পর হারাধন বাংলো থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরেছিল রাত নটা-সাড়ে নটা নাগাদ। ফিরে বলল, ঝড়বৃষ্টিতে বাজারে আটকে গিয়েছিল। যাই হোক, হারাধন আমাদের গৃহদেবতা চুরি হওয়ার কথা জানত। আমার অফিসের সবাই জানে সে কথা। কিন্তু হারাধন যে সাংঘাতিক লোক, কেমন করে জানব? হরির সঙ্গে সে, কিংবা হরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে দল বেঁধেছিল আর কী! পুলিশ জেরা করে কথা আদায় করবে। তবে আমার ধারণা, সে শ্যামসুন্দরের পিছু নিয়েছিল। তারপর শ্যামসুন্দরকে সে হরির কাছে নিয়ে যায়। নিশ্চয় একটা প্ল্যান ছিল। বলে ঘড়ি দেখে তিনি বললেন, চলুন। আপনাদের দাদার বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে দেব।…
ভবানীপুরে আমাদের নামিয়ে দিয়ে তরুণবাবু চলে গেলেন। আমরা প্রাক্তন আইনজীবী শচীনবাবুর বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকলাম।
শনিবাবু ব্যস্তভাবে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের অভ্যর্থনা করে বসতে বললেন তার মুখে উদ্বেগের ছাপ। পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে কর্নেলকে দিলেন। বললেন, আমার দৃঢ় ধারণা, এটা তরুণেরই একটা ফাঁদ।
কর্নেল চিঠিটা পড়ে গম্ভীর মুখে বললেন, কিন্তু আপনি বিপন্ন মিঃ মুখার্জি।
শচীনবাবু চমকে উঠে বললেন, বিপন্ন?
হ্যাঁ। শ্যামসুন্দরের লাশ আপনার সন্ধ্যানীড়ের ইদারার তলায় পুলিস আবিষ্কার করেছে। হরিবাবুকে অ্যারেস্ট করেছে। হরিবাবু কবুল করেছেন, খুনের রাত্রে আপনিও বরমডিহিতে ছিলেন। এমন কি সন্ধ্যানীড়েই লুকিয়ে ছিলেন।
শচীনবাবু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, ছিলাম। হরি বলেছিল, শ্যামা বিগ্রহ ফেরত দিতে চেয়েছে। তার বদলে ওকে দশহাজার টাকা দিতে হবে। বিকেলে পাঁচটা নাগাদ শ্যামা নাকি বিগ্রহ নিয়ে আসবে। শচীনবাবু বিকৃত মুখে ফের বললেন, কিন্তু হরি ব্যাটাচ্ছেলে তার এক স্যাঙাতকে নিয়ে যে শ্যামাকে খুন করে ফেলবে, তা কি আমি জানতাম? দোতলার একটা ঘরে অপেক্ষা করছি। ওরা শ্যামাকে পাশের ঘরে নিয়ে ঢুকেছে। তারপর হঠাৎ ঝড়বৃষ্টি এসে গেল। আমি তো চুপচাপ বসে ইষ্ট নাম জপ করছি। কতক্ষণ পরে ঝড় থামল, বৃষ্টি থামতে চায় না। হঠাৎ পাশের ঘরে ঝগড়া বেধে গেল। তারপর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। আমি উঁকি মেরে টর্চ জ্বেলে দেখি, ওঃ! হরির স্যাঙাত শ্যামার বুকে বসে তার গলায়–ওঃ! কী সাংঘাতিক দৃশ্য! আমি ভয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে নেমে গেলাম। উঠোনে ইদারার পাশে খিড়কির দরজা খুলে পালানোর চেষ্টা করছি। সেই সময় বাইরে হাঁকডাক। আপনারা এসে দরজায় ধাক দিচ্ছিলেন। যাই হোক, অনেক কষ্টে দরজার হুড়কো খুলে বেরুলাম। আমার এক ধনী মক্কেলের বাড়িতে উঠেছিলাম। তো অনেক রাত্রে হরি গিয়ে বলল বাধ্য হয়ে শ্যামাকে খুন করেছে। তার বডি এমন জায়গায় লুকিয়েছে, কেউ খুঁজে পাবে না। তারপর আপনাদের কথা বলল। আপনার চেহারার বর্ণনা দিয়ে বলল, এক দাড়িওয়ালা সায়েবের মতো চেহারার ভদ্রলোককে বোকা বানিয়েছে। সকালে আপনাকে আমার মক্কেলের বাড়ির দোতলা থেকে দেখলাম, বাইনোলাকে কী দেখছেন। মক্কেলের নাম অরিজিৎ সিংহ। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই ভদ্রলোককে চেনে কি না। অর্থাৎ লোকাল লোক, না টুরিস্ট? অরিজিৎ বলল ওরে বাবা! উনি তো বিখ্যাত লোক। আপনার সবিশেষ পরিচয় পেলাম।
কর্নেল বললেন, অরিজিৎ সিংহ আমার পরিচিত। বারুইপুর এরিয়ার ওঁর নার্সারি আছে। একটা বিদেশি ক্যাকটাস সাপ্লাই করেছিলেন আমাকে। তবে। বরমডিহিতে ওঁর বাড়ি আছে জানতাম না।
শচীনবাবু রুমালে মুখ মুছে বললেন, অরিজিৎ আপনাকে দেখে বেরুতে যাচ্ছিল। ওকে বাধা দিলাম। সব ঘটনা খুলে বললাম। শুনে ও পরামর্শ দিল, আপনি আজই কলকাতা ফিরে যান। তো কলকাতা ফেরার কদিন পরে আপনি আমার কাছে এলেন।
হ্যাঁ। আমাকে দেখে আপনার অস্বস্তি আঁচ করেছিলাম। তবে আমার দেখার ইচ্ছে ছিল আপনার নাকের পাশে জডুল আছে কি না। দেখলাম, নেই। তখন বুঝলাম, একটা সাজানো নাটক দেখেছি।
ঠিক। হরির বড্ড প্যাঁচালো বুদ্ধি। আপনি ও বাড়িতে আসার পর আপনার পরিচয় দিয়ে ওকে সাবধান হতে বললাম।
কর্নেল হাসলেন। হরিচরণের বুদ্ধি প্যাঁচালো। তবে অতিবুদ্ধি এবং লোভ মানুষকে ঝামেলায় ফেলে। জডুল অপারেশন করে সে আমার কাছে একটা গল্প ফঁদতে গিয়েছিল। তার উদ্দেশ্য ছিল দুটো। মুখ্য উদ্দেশ্য, আমি তাকে চিনতে পেরেছি কি না জানা এবং গৌণ উদ্দেশ্য শ্যামসুন্দরের নোটবইয়ে লেখা একটা সাংকেতিক সূত্রের অর্থ বোঝ। তার নাকের পাশে ক্ষতচিহ্ন দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই তার কেস আমি নিয়েছিলাম। কর্নেল চুরুট ধরালেন। তারপর ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, যাই হোক, আশা করি বুঝতে পেরেছেন শ্যামসুন্দরের খুনের মামলায় আপনি জড়িয়ে পড়েছেন। হরির জবানবন্দীর সূত্রে পুলিশ যে কোনও সময় আপনার কাছে আসবে। তা আমি বলি কী, আপনি মামলা মিটিয়ে নিন।
মামলা তো তরুণ করেছে। প্রায় আর্তনাদ করলেন শচীনবাবু।
তাতে কী? আপনি তার মাকে আপনার বাবার বিবাহিত স্ত্রী বলে স্বীকার করে নিন। আমি আপনাদের দুই ভাইকে আমার অ্যাপার্টমেন্টে ডেকে মিটমাট করে দেব। তরুণবাবু রাজি। আর আপনাদের গৃহদেবতা আমিই উদ্ধার করেছি! তা-ও ফেরত পাবেন। এরপর আসছে পুলিশের ঝামেলা। আপনি পুলিশকে সব কথা খুলে বলবেন। আপনি আইনজীবী। আপনি রাজসাক্ষী হবেন। আমিও আপনাকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দেব। পুলিশের কিন্তু এ মামলায় আমাকে খুব দরকার। আশা করি তা বুঝতে পারছেন। বিশেষ করে আমার হাতে ভাইটাল সাক্ষ্য প্রমাণ আছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর শচীনবাবু বললেন, আপনি যখন বলছেন, তখন তা-ই হবে। কিন্তু আমাদের গৃহদেবতা কী ভাবে আপনি উদ্ধার করলেন?
কর্নেল থামলেন। শ্যামসুন্দরের নোটবইয়ে লেখা শব্দছক থেকে। তবে আমার এই তরুণ সাংবাদিক বন্ধুই সূত্রটা ধরিয়ে দিয়েছিল। কর্নেল ঘটনাটা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। শোনার পর শচীনবাবু বললেন, গৃহদেবতা কার কাছে আছে?
আমার অ্যাপার্টমেন্টে আজ সন্ধ্যা ৬টায় আসুন। তরুণবাবু আসবেন। দুই ভাইয়ের সামনে গৃহদেবতা রাখব। হ্যাঁ–গৃহদেবতা আপনার এই বাড়ির মন্দিরেই ফিরে আসবেন। কারণ মন্দিরটা আপনার পূর্বপুরুষের তৈরি। বলে কর্নেল উঠে দাঁড়ালেন। চলি। নাহ। চা-ফা খাব না। আজ সন্ধ্যা ৬টায় আমার ঘরে বরং উৎকৃষ্ট কফি খাওয়াব আপনাকে।
রাস্তায় গিয়ে কর্নেল বললেন, চলো জয়ন্ত। আলিপুর কোর্ট চত্বর হয়ে যাই। ছেলেটি–তপন দাশ তার নাম, এই কেসে ভাইটাল সাক্ষী। তার সঙ্গে দেখা করে যাওয়া উচিত।…