- বইয়ের নামঃ পরগাছা
- লেখকের নামঃ সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
- বিভাগসমূহঃ কর্নেল সমগ্র
১. কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে
কর্নেল নীলাদ্রি সরকারের সঙ্গে অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের মঞ্চে গ্রুপ থিয়েটারের একটা নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। নাটকের নাম পরগাছা।
পরগাছার প্রতি আমার খেয়ালি প্রকৃতিবিদ বন্ধুর আসক্তিকে প্রায় পাগলামি বলা চলে। এই বৃদ্ধ বয়সেও বিরল প্রজাতির পরগাছার খোঁজে দুর্গম বনজঙ্গল পাহাড়ে হন্যে হয়ে ঘোরা ওঁর স্বভাব। কিন্তু এক্ষেত্রে ওঁর সেই প্রিয় উদ্ভিদটি তো নিছক একটি নাটকের নাম! নামটিই কি ওঁকে টেনেছিল?
প্রশ্নটি অবশ্য নাটক দেখে বেরিয়ে আসার পর তুলেছিলাম। তবে তার আগে নাটকটির বিষয়বস্তু সংক্ষেপে বলা উচিত।
মঞ্চের মাঝখানে একটি ক্ষয়াখর্বুটে গাছ, যার অল্প কিছু বিবর্ণ পাতা বোঁটায় টিকে আছে মাত্র। গাছটার তলায় হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকে একটা আধপাগলা লোক। সে মাঝে মাঝে বেসুরো গলায় অদ্ভুত কী সব গান গায়। মঞ্চের ডানদিকে কয়েকটি কুঁড়েঘরের অংশ দেখে বোঝা যায় একটি ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের লোকের জীবনের সঙ্গে গাছটার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য। কাজকর্মের শেষে তারা গাছটার তলায় এসে ভিড় জমায়। আড্ডা দেয়। রসিকতা করে। আধপাগলা লোকটাকে নিয়েও তাদের হাসি-তামাশা চলে।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। হঠাৎ একদিন গ্রামের লোকের তুমুল কৌতুক আর হাসিতে অতিষ্ঠ সেই আধপাগলা বুড়ো চেরা গলায় ঘোষণা করে, সাবধান! এ গাছই তোদের জীবন। এর একটি করে পাতা তোদের একেক জনের জীবনের পরমায়ু। একটি করে পাতা ঝরবে। তোরা একজন করে মারা পড়বি।
অবিশ্বাসের হা হা হা হা অট্টহাসির মধ্যে দেখা যায় একটা পাতা খসে পড়ল এবং আচম্বিতে একটা লোক বুক চেপে ধরে আর্তনাদ করে পড়ে গেল।
এবার নাটকের গতি হয়ে উঠল জোরালো। প্রথমে সন্দেহ এবং দ্বিধা, তারপর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল প্রচণ্ড আতঙ্ক। আবার একটা পাতা খসে পড়ে। একটা মৃত্যু আসে। বিভীষিকার প্রতীক হতে থাকে জীর্ণ প্রাচীন সেই গাছ। একটার পর একটা পাতা ঝরে যায়। একের পর এক জীবনের পতন ঘটে। আধপাগলী লোকটা বারবার গলায় ঘোষণা করে, সাবধান! সাবধান!
রাগী যুবকরা কুড়ুল হাতে ছুটে আসে। আধপাগলা লোকটা বলে, খবর্দার! গাছটা কেটে ফেললে একসঙ্গে তোরা সবাই মারা পড়বি।
যুবতীরা ঘটে জল নিয়ে এস বলে, তাহলে আমরা একে বাঁচিয়ে তুলি। তারা গাছের গোড়ায় জল ঢালে। গাছটিকে ঘিরে তারা নেচেনেচে গান গায়। আধপাগলা লোকটা বলে, ভুল! ভুল! তোদের জলে গাছটায় নতুন পাতা গজাবে, আর তোদের। গর্ভে আসবে সন্তান। কিন্তু তারাও বাঁচবে না। পাতা ঝরবে। তারা মরবে।
তা হলে উপায়?
এবার নাটকের ক্লাইম্যাক্স। লোকটা আঙুল তুলে বলে, ওই দ্যাখ সবাই। গাছের ডালে একটা বিষাক্ত পরগাছা গজিয়ে আছে। গাছের সব রস শুষে নিয়ে ডাগর হয়ে ফুল ফোঁটাচ্ছে। ওই পরগাছা ওপড়াতে হবে। তবেই তোরা বাঁচবি।
যাই হোক, আরও কয়েকটি মৃত্যু এবং প্রবল হাঙ্গামার পর পরগাছাটা ওপড়ানো হলো। হাততালির মধ্যে নাটকও শেষ হলো। পাশের এক দর্শককে বলতে শুনলাম, সর্বহারা শোষিতশ্রেণী এবং পরগাছারূপী শোষক শ্রেণীর সংগ্রাম হে কালীপদ! বুঝলে তো?
কালীপদ কী বলল শুনতে পেলাম না। কর্নেল আমার কাঁধে হাত রেখে ভিড় ঠেলে আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন। ওঁর মুখটা রীতিমতো গম্ভীর।
অক্টোবর মাসের রাত সাড়ে আটটায় টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছিল সবে। গাড়িতে উঠে কর্নেল চুরুট ধরালেন। স্টার্ট দিয়ে বললাম, বোগাস! একেবারে প্রচারধর্মী। তবে নাচগান অভিনয় দিয়ে জমিয়েছে বেশ।
কর্নেল সাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, হঁ, নাটক মানে তো তাই। কিন্তু আমার অবাক লাগছে। পরগাছা আপনার প্রিয়, তা জানি। তাই বলে পরগাছা নামের রদ্দি তত্ত্বে ঠাসা নাটক দেখতে আপনার এত উৎসাহ রহস্যময়।
কর্নেল তেমনই গম্ভীরমুখে বললেন, রহস্যময় বলতেও পারো। তবে বিষয়টি সত্যি সিরিয়াস।
অবাক হয়ে বললাম, তার মানে?
নাটকটার অন্য একটা মাত্রা আছে। আমার প্রাজ্ঞ বন্ধু হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, ওই মাত্রাটা অত্যন্ত বাস্তব এবং সত্যি ভয়ঙ্কর। বিষাক্ত পরগাছা! হ্যাঁ, জয়ন্ত। কোনও কোনও পরগাছায় লাক্ষা জাতীয় কীটের জীবাণু থাকে। আমি দেখেছি, লাক্ষার লোভে ওই অর্কিড জাতীয় পরগাছা এনে বিশাল গাছের ডালে আটকে দেওয়া হয়। কালক্রমে গাছটা শুকিয়ে মারা পড়ে। শুধু তা-ই নয়, ক্রমশ পাশের গাছগুলোতেও সেই বিষাক্ত অর্কিড় ছড়িয়ে পড়ে। কী ভাবে বলি। একটা অর্কিডের ফুলের রেণু থেকে প্রায় ৪৭ লক্ষ বীজকণিকা বাতাসে ছড়িয়ে যায়। গাছ থেকে গাছে এভাবে অর্কিড ছড়ায়। তো আমি দেখেছি, এক অসাধু লাক্ষা ব্যবসায়ী লাক্ষার লোভে একটা রাস্তার ধারে অসংখ্য গাছ ওই বিষাক্ত অর্কিডের সাহায্যে মেরে ফেলেছে। লাক্ষাটা তার লাভ। শুকনো গাছগুলো কাঠের ব্যবসায়ীর লাভ। তুমি যদি তোমার খবরের কাগজের কাজে কখনও মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুর থেকে সড়ক ধরে কান্দি যাও, লক্ষ্য কোরো সারবন্দি গাছের কঙ্কাল …
এক্সকিউজ মি।
চমকে উঠে বাঁদিকে তাকালাম। আমাদের গাড়ি থিয়েটার রোডে পৌঁছে একটা রাস্তার মোড়ে ঈষৎ জ্যামের দরুন থেমে গিয়েছিল। বৃষ্টিটা বেড়ে গেছে। ঝিরঝিরে বৃষ্টি। এক সিক্তবসনা যুবতী কর্নেলের কাছে ঝুঁকে কথাটি উচ্চারণ করেছিল। কর্নেল চোখ খুলে সোজা হয়ে বসে বললেন, বলুন কী করতে পারি আপনার জন্য।