কেন বলুন তো?
আপনার পূর্বপুরুষের ঐতিহাসিক বিগ্রহ উদ্ধারের জন্যই শ্যামবাবুর ছবি আমার দরকার।
একটু ইতস্তত করে তরুণবাবু বললেন, ঠিক আছে। নিয়ে যান। অবনীবাবু, ছবিটা ওঁকে কাগজে ভালভাবে প্যাক করে দিন।
কিছুক্ষণ পরে ছবিটা বগলদাবা করে কর্নেল বেরুলেন। রাস্তায় তখন যানবাহনের জ্যাম। আলো আরও ঝলমলে হয়েছে। এবার আমরা বাসে না এসপ্ল্যানেড এবং সেখান থেকে ভিড়েঠাসা ট্রামে চেপে ইলিয়ট রোডে পৌ৮ সারা পথ আমার কিন্তু গা ছমছম করছিল। কেউ যেন হঠাৎ ছবিটা কেড়ে পালাবে মনে হচ্ছিল। কেন কেড়ে নিয়ে পালাবে, তা অবশ্য বুঝতে পার না। তবে আশঙ্কায় বুক দুরদুরু কাঁপছিল। প্রত্যেকটি যাত্রীর গা ঘেঁষে দাঁড় সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল।
কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে ভয়টা কেটে গেল। কর্নেল ষষ্ঠীকে কs, করতে বলে ওঁর স্টুডিওতে ঢুকলেন। ওখানে ওঁর আরেক হবির নিদর্শন। মা জায়গায় তোলা পাখি প্রজাপতি অর্কিড ক্যাকটাসের ছবি নিজেই ডেভালান্স এবং প্রিন্ট করেন। এমন কি, ওঁর একটা পোর্টে স্টুডিও আছে বলা চলে। কতবার ডেভালাপ প্রিন্টের সরঞ্জাম বয়ে নিয়ে নানা জায়গায় পাড়ি জমান। তখন কোনও বাংলোর বাথরুম ওঁর ডার্করুমে পরিণত হয়।
প্রায় আধঘণ্টা পরে কর্নেল বেরিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। বললেন, খব। পাকা ফোটোগ্রাফারের তোলা ছবি। নেগেটিভটা ভালই আসবে আশা করছি। পাসপোর্ট ফোটোর সাইজে ফিগারটা এনেছি।
বললাম, আমি ক্লান্ত। এবার বাড়ি ফিরতে চাই।
ঠিক আছে। কাল সকালে কিন্তু এসো। একটা রহস্য সম্ভবত ফাঁস হবে।
কোন রহস্য?
কর্নেল হাসলেন। সকালে এলে টের পাবে।…
.
পরদিন সকালে কর্নেলের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হয়ে দেখি, উনি কয়েকটা পাসপোর্ট সাইজের ফোটো টেবিলে সাজিয়ে রেখেছেন এবং একটা ছবিতে তুলি বুলোচ্ছেন।
আমাকে দেখে বললেন, অসাধারণ এসেছে।
টেবিলের একটা ফোটো তুলে নিয়ে বললাম, এই শ্যামবাবু? চেহারা কিন্তু অমায়িক প্রকৃতির এক যুবকের।
প্রায় ৮ বছর আগের ছবি। তবে চেহারায় মানুষের চরিত্রের ছাপ ফোটে কি
তা নিয়ে তর্ক চলতে পারে। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, সাদারণত ছ্যাচড়া প্রকৃতির অপরাধী নিজের চেহারায় ইচ্ছে করেই দুৰ্বত্তের ছাপ ফুটিয়ে তোলে। কিন্তু তথাকথিত ভদ্রলোক অপরাধীরা চেহারায় ভেতরকার আসল রূপ ফুটতে দেয় না এবং এ বিষয়ে তারা খুব সচেতন।
পাশের আর একটা ছবি দেখে বললাম, এটা আবার কার? যেন চেনা-চেনা মনে হচ্ছে।
তরুণবাবুর অফিসের এক বেয়ারার।
কিন্তু একে যেন কোথায় দেখেছি। কাল ওই অফিসেই কি?
তা দেখে থাকতে পারো তুমি। আমি লক্ষ্য করিনি।
এর ছবি তুললেন কেন?
কাল তরুণবাবুর অফিসে আমি একে লক্ষ্য না করলেও গ্রুপ ফোটো দেখে আমার চেনা মনে হচ্ছিল। তাই এর ছবিটাও তুলেছি।
ছবিটা তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললাম, আশ্চর্য! একে কোথাও দেখেছি। নাহ্। কাল ওই অফিসে নয়। অন্য কোথাও।
কর্নেল আস্তে বললেন, তা হলে আমি নিঃসন্দেহ হলাম।
কী ব্যাপারে?
তুমি এবং আমি দুজনেরই যখন চেনা লাগছে, তখন এ সেই লোকটাই বটে। তবে ভূত নয়, জলজ্যান্ত মানুষ।
কর্নেল! বরমডিহির পোড়ো বাড়িতে লণ্ঠন হাতে যে লোকটা নিজেকে ভোলা বলেছিল–
কর্নেল আমার কথার ওপর বললেন, হ্যাঁ। এ সেই-ই বটে। মানুষের চেহারা চল্লিশের পর পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত খুব একটা বদলায় না। তবে নাহ্, উত্তেজিত হয়ো না। মুখ বুজে থাকো। লোকটা এখনও তরুণবাবুর অফিসে কাজ করছে। কি না জানা দরকার।
আপনি শ্যামবাবুর ছবিটা রিটাচ করছেন কেন?
বয়স বাড়াচ্ছি। কারণ শ্যামবাবু এই ছবিতে বড়জোর পঁচিশ বছর বয়সী যুবক। আট বছর পরে তার চেহারাটা কেমন দাঁড়াতে পারে, এক্সপেরিমেন্ট করছি ৪টে ছবিতে।
এই সময় টেলিফোন বাজল। কর্নেল ছবি এবং তুলি রেখে নিজেই ফোন ধরলেন…হ্যাঁ। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।…না, না মিঃ মুখার্জি! আমি রাগ করিনি। আপনার অনুতপ্ত হওয়ার কারণ নেই।…ঠিক আছে। অবশ্যই যাব।…না, না। কথা দিচ্ছি।…এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে পৌঁছে যাব।…নাহ্! গাড়ি পাঠাতে হবে না। ধন্যবাদ! রাখছি।
বললাম, অ্যাডভোকেট ভদ্রলোক মনে হল?
কর্নেল হাসলেন। হ্যাঁ!
কর্নেল! সাবধান কিন্তু!
কেন?
আপনি ওঁর বাড়িতে বসে ওঁকে চোর বলেছেন। তার প্রতিশোধ নিতে হয় তো এ একটা ফাঁদ।
কর্নেল স্বভাবসিদ্ধ অট্টহাসি হেসে বললেন ঘুঘুধরা ফাঁদ বলতে চাও! হরিবাবুকে লেখা চিঠিতেও ঘুঘু এবং ফাঁদের কথা ছিল! এই কথাটাও ছিল, এ বড় সেয়ানা ঘুঘু।
হাসতে হাসতে বললাম ভাষাটা কিন্তু কোর্ট চত্বরের সেই ছোকরান।
ছোকরা বোলো না ডার্লিং! ওর প্রতিভা আছে। আমি ওই প্রতি ছেলেটির সঙ্গে আবার দেখা করে তাকে পুরস্কৃত করব ভেবে রেখেছি।
কর্নেল ফোটোশুলো গুছিয়ে টেবিলের ড্রয়ারে ঢোকালেন। তারপর পোয় বদলে এলেন। ওঁর হাতে এবার তরুণবাবুর অফিস থেকে আনা সেই প্রকাণ্ড গ্রুপফোটো। আগের মতো প্যাকেট করা। বললেন, চলো! এই ছবিটা কথামতো ফেরত দিতে হবে। তারপর যাব শচীনবাবুর বাড়ি।…
ব্র্যাবোর্ন রোডের সেই বাড়িতে যখন পৌঁছুলাম, তখন প্রায় সওয়া দশটা বাজে। কর্নেল আমাকে নিচে দাঁড় করিয়ে রেখে লিফটের সামনে লাইন দিলে, বাড়িটাতে অজস্র কোম্পানির অফিস। দেখলাম, অনেকে লিফটের লাইন দেখে পাশের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হল, এ সময় যদি দৈবাৎ বরমডিহিতে দেখা সেই ভোলার দেখা পেয়ে যাই, কী করব? জাপটে ধরে হইচই বাধানো কি ঠিক হবে? তবে এ কথা ঠিক, তাকে এখন মুখোমুখি পেলে সোজাসুজি চার্জ করব। তাতে ভিড় জমে তো জমুক। ব্যাটাচ্ছেলে আমাদের বোকা বানিয়ে ছেড়েছিল!