ঠিক। দেখছি। অরিজিৎ কফি শেষ করে পাইপ জ্বেলে বললেন, বাট দা পয়েন্ট ইজ বাসুদেব রায়ের আত্মহত্যা কেসের সঙ্গে বিমলবাবুর কেসটা আপাতদৃষ্টে এক হয়েও এক নয়। হ্যাঁবাসুদেববাবু রক্তমাখা পোশাক হারিয়ে সুইসাইড করেছেন। আর বিমলবাবু কী একটা ছবি হারিয়ে সুইসাইড করেছেন। সুইসাইডের পদ্ধতিও এক। অন্তত অ্যাজ ইট অ্যাপিয়ার্স!
কিন্তু বিমলবাবুর কেসটা সুইসাইড না হতেও পারে!
এক্সজ্যাক্টলি। অরিজিৎ নড়ে বসলেন। সেজন্যই দুটোকে লিংক আপ করতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আপনি কিছু গোপন রেখেছেন এবং সময়মতো টেক্কাটি ঝাড়বেন। অরিজিৎ হাসতে লাগলেন।
কর্নেল চোখ বুজে বললেন, বাসুদেব রায় নামে পুলিশ রেকর্ডে কিছু আছে কি না, জানা দরকার। এক সময় তাকে নাকি পুলিশ খুঁজত। সে গা ঢাকা দিয়ে বেড়াত।
অরিজিৎ ভুরু কুঁচকে বললেন, সোর্স?
তপেশ বসাকের স্ত্রী বলেছে। একটু আগে সে এসেছিল।
মাই গুডনেস! আপনি–
এক মিনিট ডার্লিং! বিমলবাবু বামপন্থী রাজনীতি করতেন কাগজে পড়লুম। তার সম্পর্কে পলিটিক্যাল ফাঁইলে কোনো রেকর্ড নিশ্চয় আছে তোমাদের হাতে।
অরিজিৎ হেলান দিয়ে বললেন, তার মানে, পুরো এক দশকের পলিটিক্যাল ফাঁইল খুলে খুঁজতে হবে। বাস্! কিন্তু শেষমেশ লাভটা কী হবে? নাথিং।
ডার্লিং, সুশোভন রায়ের হত্যা রহস্য জানা যায়নি। এখনো বারো বছর পূর্ণ হয়নি, মাইন্ড দ্যাট। সুতরাং এখনও তার খুনীদের ধরার আইনত দায়িত্ব তোমাদের হাতে আছে।
অরিজিৎ চুপচাপ পাইপ টানতে থাকলেন।
কর্নেল ফের বললেন, তোমাকে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতার কথা বলেছিলুম। অতীত বর্তমানের ভেতরও গোপনে কাজ করে চলে। বিমলকুমারের আত্মহত্যা অথবা হত্যা সেই অতীতেরই কাজ করা।
হুম! পাইপ দাঁতে কামড়ে অরিজিৎ বললেন। কিন্তু কী ছবি চুরি গেছে বিমলকুমারের, জানেন? অবশ্য জানলেও বলবেন না বুঝতে পারছি।
কর্নেল একটু চুপ করে থাকার পর বললেন, বিমূর্ত চিত্রকলার ব্যাপারটা আমার মাথায় আসে না। তবে ধরো, যদি কোনো ছবি দেখে মনে হয়, পিঠে ছুরি বেঁধা একটা মানুষ–অতর্কিতে যাকে ছুরি মারা হয়েছে পেছন থেকে–এমন একটা দৃশ্যত বিমূর্ত করে আঁকা হয়েছে এবং সেই ছবিটা চুরি যায়?
আই সি! আপনি ছবিটা দেখেছিলেন, অর্থাৎ আগেও গিয়েছিলেন ভদ্রলোকের স্টুডিওতে। কেন?
সে-কথার জবাব না দিয়ে কর্নেল বললেন, খুনী অথবা খুনীরা বাসুদেবকে প্রচণ্ড ভয় করত। বাসুদেবের কাছে পিস্তল ছিল বলেও নয়, আমার ধারণা বাসুদেবও একজন কিলার চরিত্রের লোক ছিল। তাই তার গায়ে হাত তুলতে সাহস পায়নি। যেন উল্টে খুনী বা খুনীরা তাকে সহযোগিতা করেছে ব্ল্যাকমেলিংয়ে। কিন্তু বিমলকুমার নিরীহ চিত্রকর। তারা আঁকা ছবিটা দেখে প্রথমে তত আমল দেয়নি। কিন্তু আমি ওঁর স্টুডিওতে যাওয়ায় খুনী বা খুনীরা এবার বিপন্ন বোধ করে থাকবে। অর্থাৎ বিমলকুমার একটা খুনের ঘটনা জানতেন। স্বচক্ষে দেখেও থাকতে পারেন। সেটাকে সরাসরি না এঁকে বিমূর্ত রীতিতে এঁকেছেন। অতএব আমি না যাব, বিমলবাবুর না মৃত্যু হবে!
কর্নেলের কণ্ঠস্বরে বিষণ্ণতা লক্ষ্য করে অরিজিৎ একটু হাসলেন। বললেন, অকারণ আত্মগ্লানিতে ভুগছেন, কর্নেল! আপনি নিমিত্ত মাত্র।
কর্নেল চুরুট কামড়ে ধরে বললেন, কেন যে ছাই এ বয়সেও সবতাতে নাক গলাতে যাই। এখনও আমার শিক্ষা হলো না ডার্লিং!
অরিজিৎ ঘড়ি দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হাসতে হাসতে বললেন, আপনার এভাবে দাড়ি ঘেঁড়ার ভঙ্গি দেখলে খুব এনজয় করা যায়। বুঝতে পারি, সব রহস্য ফর্দাফাই হতে চলেছে। ওক্কে, উইশ য়ু গুড লাক, মাই ডিয়ার ওল্ড ডাভ! চলি।
ছাদের প্ল্যান্ট ওয়ার্ল্ডে কিছুক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে থেকে নিচে ব্রেকফাস্ট খেতে এলেন কর্নেল। খাওয়ার পর বুকশেলফ থেকে একটা বই বার করলেন : দা পলিটিক্যাল টারময়েল ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল তিরিং সিক্সটিজ-সেভেনটিজ। পাতা ওল্টাতে থাকলেন। তারপর শেষের দিকে ইনডেক্সে এ হরফ থেকে পড়তে শুরু করলেন শব্দগুলি। শব্দগুলি টার্ম, কোনোটা নামের পদবি।
ফোন বাজল। সাড়া দিলেন, কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বলছি।
অ্যাই বুড়ো! সাবধান! আর এক পা বাড়ালে খতম হয়ে যাবি।
ডার্লিং! রসিকতার জন্য ধন্যবাদ!
শাট আপ শালা বুড়ো ভাম! নাক গলালে গলা ফাঁক করে দেব।
গলা বাড়িয়েই আছি ডার্লিং!
ঠিক আছে। দ্যাখ, কী হয় এবার।
তোমাকে দেখতে পাচ্ছি। আমার জাদু-চোখ আছে ডার্লিং!
তবে মর শালা!
ফোন রাখার শব্দ হলো। কর্নেল হাসলেন। তাহলে ঠিক পথেই পা। বাড়িয়েছেন।…
১২. সরাসরি আক্রমণ
ট্যাক্সি থেকে কর্নেল যখন গে ক্লাবের কাছে নামলেন, তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বাজে। জানুয়ারির দিনশেষে সাড়ে ছটা মানে রাত্রিই। কুয়াশা কিংবা ধোঁয়াশায় ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলি ভুতুড়ে হয়ে উঠেছে। কর্নেলের গায়ে ওভারকোট, মাথায় টুপি, হাতে একটা ছড়ি। সোজা গে ক্লাবে ঢুকে গেলেন।
লেকের কিনারা বরাবর রঙিন ছাতার নিচে মিটমিটে আলোয় একগুচ্ছ করে লোক। হাতে বিয়ার, হুইস্কি বা রাম ভর্তি গেলাস। কিছু মেয়েও আছে, হাতে শ্যাম্পেন অথবা স্রেফ সফ্ট ড্রিংক ভরা গেলাস। টেন্টের গড়ন মূল ক্লাবঘরের ভেতর জমাট ভিড়। শ্যামলকান্তিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। একজন পরিচারককে জিজ্ঞেস করলে সে বাইরে আঙুল তুলে বলল, মজুমদারসাব হুয়াউও দেখিয়ে, পেড়কা নিচে।