এভাবে তেরো-পনেরো শতকের মধ্যে বাঙলার নিম্নবর্ণের গণদেবতা জাতীয় ইষ্টদেবতার মর্যাদায় উন্নীত হলেন। তখন এসব লৌকিক দেবতায় আভিজাত্য দানের জন্যে আর্যীকৃত প্রাচীন দেবতা সূর্য ও শিবের সঙ্গে এদের সম্পর্ক পরিকল্পিত হল। এভাবে ধর্মঠাকুর হলেন স্বয়ং সূর্য; চণ্ডী বা কালী হলেন শিবপত্নী; মনসা, লক্ষ্মী, সরস্বতী হলেন শিবকন্যা।
কাজেই বৌদ্ধযুগ থেকেই লৌকিক দেবতার পূজা-পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য-কথা মুখে মুখে চালু ছিল। পাল আমলের শেষের দিকে তাঁদের কেউ কেউ পৌরাণিক মর্যাদা লাভ করেন এবং তুর্কী শাসনকালে নির্বিঘ্ন প্রচার পেয়ে উন্নীত হন জাতীয় দেবতার স্তরে, সে-সঙ্গে তাদের মাহাত্ম্য-কথাও বৈচিত্র্য এবং বিপুলতা লাভ করে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকালে তাই —
ধর্ম কর্ম লোক সবে এই মাত্র জানে
মঙ্গলচণ্ডীর গীত করে জাগরণে।
দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোনো জন
পুত্তলি করএ কেহ দিয়া বহু ধন।
বাশুলী পূজএ কেহ নানা উপহারে
মদ্য মাংস দিয়া কেহ যক্ষ পূজা করে।
যোগিপাল ভোগিপাল মহীপাল গীত
ইহা শুনিবারে সলোক আনন্দিত।
কিন্তু পাল আমলে অবহট্ঠে কিংবা সেন আমলের বাঙলা বুলিতে এগুলো লিখিত হয়নি। একে তো সেনরাজারা নিম্নবর্ণের লেখাপড়া শেখার বিরোধী ছিলেন, তার উপর সমাজের উচ্চবিত্তের লোকেরা রাজশক্তির প্রভাবে পড়ে লৌকিক দেবতা ও প্রাকৃতজনের ভাষা এড়িয়ে চলতেন এবং তাঁদের সংস্কৃত-প্রীতিও এসময়ে বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেল; তাই জয়দেব, সন্ধ্যাকর নন্দী, সর্বানন্দ,– হলায়ুধ মিশ্র, ঘোয়ী, মুরারি মিশ্র প্রভৃতি অবহটঠের বাক্-রীতিতে রচনা করেছেন সংস্কৃত।
কাজেই বাঙলায় লেখার রেওয়াজ যত আগে চালু হওয়া সম্ভব ছিল, তত আগে হয়নি। তবে এই সময়ে মনসার কাহিনী, ধর্মের কাহিনী, চণ্ডীর কাহিনী ইত্যাদি দেশীয় বস্তু এবং রামায়ণ কাহিনী, কৃষ্ণলীলা কাহিনী ইত্যাদি পৌরাণিক বস্তু ছোট বড় গানে অথবা পাচালিতে বাদ্য ও নৃত্যের যোগে পরিবেশিত হইত গ্রামোৎসবে অথবা দেবপূজা উপলক্ষে দেবমন্দিরে। ….. রামায়ণ মহাভারত কাহিনী ও কৃষ্ণলীলা গান রাজসভায় ও সামন্তসভায় প্রধানভাবে অনুশীলিত ছিল। সমাজের নিম্নস্তরে অর্থাৎ দেশী-ভাষাবলম্বী লোকসাহিত্যে বিশেষভাবে কৃষ্ণের ব্রজলীলা এবং মনসা চণ্ডী ধর্মদেবতার মাহাত্ম্য কাহিনী প্রচলিত ছিল। এই অনুমানের সমর্থন মিলে ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে। যুধিষ্ঠির অর্জুন ভীম দ্রেীপদী দশরথ রাম সীতা ইত্যাদি মহাভারত রামায়ণ কাহিনীর নামগুলি তৎসম (সংস্কৃত) রূপেই প্রচলিত। কিন্তু কানু বা কানাই (কৃষ্ণ), রাই (রাধিকা), আয়ান (অভিমন্যু), গোই, গুই (গোপী, গোপিকা), ফুল্লরা, খুল্লনা (ক্ষুদ্র), লহনা (লোভনা), বেহুলা (বিহ্বলা) ইত্যাদি নামগুলি, তদ্ভবরূপেই মিলিতেছে। ইহা হইতে এ অনুমান অপরিহার্য যে শেষের সব কাহিনী ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃত অপভ্রংশ অবহট্ঠ ও প্রাচীন বাঙ্গালার মধ্যে দিয়াই আসিয়াছে।
লিখিত বাঙলা সাহিত্য
বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ দেব-গাথাগুলো পাঁচালি পর্যায়ে উন্নীত হয়ে লিখিত রূপ পায়নি। কিন্তু হিন্দু দেব-কাহিনী চৌদ্দ শতক থেকে লিখিত রূপ পেতে থাকে। মানিকদত্ত, কানাহরি দত্ত প্রভৃতির নামসার স্মৃতি থেকে এবং শূন্য পুরাণের ভাষার কাঠামো থেকে এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের (শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ) পুঁথি প্রাপ্তি থেকে আমরা তা অনুমান করতে পারি। আমরা নাথ কাহিনী-বিধৃত সমাজ পরিবেশের আভাস থেকেও আমাদের এ অনুমানের সমর্থন পাই। লিখিত বাঙলা সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবে তথা আদি বাঙলা কাব্য হিসেবে শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা কাহিনী স্বীকৃতি পাচ্ছে সম্প্রতি। কিছুটা তথ্য ও কিছুটা অনুমানের উপর নির্ভর করে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন এটি সুলতান গিয়াসুদ্দিন আযম শাহের আমলে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত হয়। ভাষা কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো প্রাচীন নয়। তবে শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ের ভাষা স্মরণে রেখে এর প্রাচীনত্ব স্বীকার করতে দ্বিধা হয় না।
মহানরপতি গ্যেছ পিরথিম্বীর সার।
ঠাঁই ঠাঁই ইচ্ছে রাজা আপনা বিজএ
পত্র সিস্য হন্তে তিই মাগে পরাজএ।
মোহাজন বাক্য ইহ পুরন করিয়া
লৈলেন্ত রাজ্যপাট বঙ্গাল গৌড়িয়া।
এর মধ্যেই সোনারগাঁয়ের যুদ্ধে পিতৃহন্তা গিয়াসুদ্দীন আযম শাহকে নির্দেশ করা হয়েছে বলে ডক্টর হক অনুমান করেছেন।
লিখিত বাঙলা সাহিত্যের সর্বজন-স্বীকৃত আদি নিদর্শন হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি সম্পাদক প্রদত্ত নাম। রচয়িতা বাসুলীর সেবক অনন্ত বড় চণ্ডীদাস। আনুমানিক রচনাকাল চৌদ্দ শতকের শেষার্ধ বা পনেরো শতকের প্রথমার্ধ। জয়দেবের গীতগোবিন্দেই প্রথম রাধাকৃষ্ণলীলার পর্বানুগ বিভাগ লক্ষ্য করা যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রসানুগ লীলাবিভাগ এবং পর্ব বিন্যাস রয়েছে। এতে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক রাগানুগ সুফী সাধনা-পদ্ধতির প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। তবে এসময়ে যে শাসক-শাসিতের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, তার, আভাস পাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সাহিত্যিক ভাষায় তুর্কী-ফারসি-আরবি শব্দের মিশ্রণে। এই রাধাকৃষ্ণলীলা মহাভারতীয় নয়, লৌকিক কাহিনী প্রসূত। আভীর জাতির লোকগাথার নায়ক কৃষ্ণ কালে লোকস্মৃতিতে মহাভারতের নায়ক কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে ওঠেন। নয়-দশ শতক থেকেই এ লীলার লিখিত সাক্ষ্য মেলে। যদিও লৌকিক ধামালী ভিত্তি করেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের গীতিনাট্য রচিত এবং এর সঙ্গে বৈষ্ণবীয় রাধাকৃষ্ণ লীলাতত্ত্বের ভাব ও তত্ত্বগত তফাৎ বিস্তর, তবু পরবর্তী বৈষ্ণবতত্ত্বে ও সাহিত্যের এ গ্রন্থের প্রভাব বিপুল। এটি পৌরাণিক আবরণে লৌকিক প্রণয়-কাহিনী। নায়ক দেবকল্প বলে মধ্যে মধ্যে আধ্যাত্মিকতার আভা আছে। কেবল পদাবলী নয়, রাধাকৃষ্ণ লীলারস কল্পনাও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আদলে গড়ে উঠেছে। রূপ-সনাতন-জীব-রঘুনাথ আদি গোস্বামীর তাত্ত্বিক রচনায় এর প্রভাব দৃশ্যমান। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মূলত আধ্যাত্মিকতা বর্জিত আদিরসাত্মক রচনা হলেও এর বিশেষ গুরুত্ব অবশ্য স্বীকার্য। এটি গীতিনাট্য, বিভিন্ন ছন্দ ও রাগ-রাগিণীযুক্ত এবং ভাষা প্রাথমিকতার আড়ষ্টতা মুক্ত। এতে বোঝা যায়, এর আগে মুখে মুখে বাঙলা ভাষা শব্দে সমৃদ্ধি এবং প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেছে। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনও মূলত লোকসাহিত্য এবং কথকতারই লেখ্যরূপ। তাই বক্তব্যের ভাষা ও ভঙ্গি প্রায়ই পৌনপুনিকতা দোষে দুষ্ট।