অপারেশন তেলআবিব-১
ডাইরীর সাদা বুক। খস্ খস্ শব্দ তুলে এগিয়ে চলেছে একটি কলমঃ
‘… সিং কিয়াং-এর ধুসর মরুভূমি। দূরে উত্তর দিগন্তের তিয়েনশান পর্বতমালা কালো রেখার মত দাঁড়িয়ে আছে। অর্থহীনভাবে শুধু চেয়ে থাকি চারিদিকে। কোন কাজ নেই। জীবনের গতি যেন আমাদের স্তব্ধ হয়ে গেছে। আজ ক’দিন হল যুগ-যুগান্তরের ভিটে মাটি ছেড়ে আমরা ৫ হাজার মুসলমান আশ্রয় নিয়েছি আমাদের জাতীয় ভাইদের কাছে এ সুদূর মরুদ্যানে। অত্যাচারীর চকচকে রক্ত পিপাসু বেয়নেট আর রাইফেলের গলিত সীসা ছিনিয়ে নিয়েছে আমাদের বহু ভাই বহু বোনকে। চোখে আর কারো পানি নেই। শুকিয়ে গেছে অশ্রুর ধারা।
মরু-ঘেরা এ দূর্গম মরুদ্যানে এসে আমাদের যারা একটুখানি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল, ভুল ভেঙ্গে গেল তাদের অচিরেই। একদিন সকালে উঠে শুনলাম এদেশের সে ফেরাউন বাহিনীও এগিয়ে আসছে এদিকে। আব্ব চিৎকার করে বললেন, ‘আমরা বাঘের মুখ থেকে খসে কশাই এর হাতে পড়েছি। আমাদের মাতৃভূমি তুর্কিস্তানের একখন্ড ভূমিতেও আজ আমাদেরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দিবে না শয়তানরা। বুঝলাম আব্বার সহ্য নিঃশেষ হতে চলেছে।
আব্বার আয়োজন শুরু হ’ল যাত্রার। নারী আর শিশুদের চোখের পানিতে ভারি হয়ে উঠল মরুভূমির শুষ্ক বাতাস। এবার শুধু আমরাই নই, মরুদ্যান ও আশে পাশের আরো ৪৫ হাজার মুসলিম নর নারীর উদ্বাস্তু মিছিল এসে শামিল হল আমাদের সাথে।
আমার চার বছরের ভাই ইউসুফ এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমরা আবার কোথায় যাব ভাইজান! বাড়ী গেলে সেই মানুষরা যে আবার মারবে আমাদের? আমি অভয় দিয়ে বললাম, ‘না ভাই আমরা বাড়ী যাচ্ছি না।’
কিন্তু কোথায় যাচ্ছি বলতে পারলাম না। কোথায় যাব আমরা? তাজিকিস্তান কিংবা উজবেকিস্তান। সেতো আর এক সিংকিয়াং। অবশেষে সবাই বুক ভরা আশা নিয়ে তাকালো দক্ষিণের দিকে। উচ্চারিত হলো ভারতের নাম-মুহাম্মদ বিন কাসিমের এ ভারত, মাহমুদ, বাবর, ঈসা খাঁ, টিপু, তিতুমীরের এ ভারত।
মরুভূমির সাদা বালুর উপর দিয়ে এগিয়ে চলল ছিন্নমূল মানুষের আদিগন্ত মিছিল। পিছনে পড়ে রইল সহস্র শতাব্দির স্মৃতি বিজড়িত মাতৃভূমি সিংকিয়াং। কেন এমন হ’ল? কি করেছি আমরা? শুধু তো স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছি। মানুষের এ চাওয়া তো চিরন্তন। মুসলমান হওয়ার অপরাধে কি এ অধিকার আমাদের থাকবে না?
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ধীরে ধীরে তিব্বতের দিকে এগিয়ে চলেছি আমরা। হঠাৎ একদিন কয়েকটি সামরিক বিমান খুব নীচু দিয়ে আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল গোটা কাফেলায়। তাহলে কি ওরা এখনো পিছু ছাড়েনি আমাদের?
মরুভূমির নিঝুম-নিস্তব্ধ রাত। বাতাসের একটানা শোঁ শোঁ নিঃশ্বাস নিস্তব্ধতার মাঝে তরঙ্গ তুলছে শুধু। উপরে লক্ষ কোটি তারার মেলা। কাফেলার পরিশ্রান্ত পথিকরা কেউ জেগে নেই বোধ হয়। হঠাৎ উত্তর দিগন্ত থেকে ভেসে এল কয়েকটি জেট ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর শব্দ। তারপর বুম! বুম! বুম……
চিৎকার ছুটোছুটি আর্তনাদে গভীর রাত্রির নিশুতি প্রহর ভেঙ্গে পড়ল টুকরো টুকরো হয়ে। ঘুম ভেঙে গেল আমার। বিছানায় উঠে বসেছি। বোবা হয়ে গেছি যেন। আব্বার চিৎকার ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস হয় না আমার। কি বিভৎস সে দৃশ্য! আব্বার তাবু জ্বলছে। টলতে টলতে আব্বা ইউসুফকে টেনে নিয়ে আসছেন। ইউসুফের কোমর থেকে পিছন দিকটা নেই, কয়লার মত হয়ে গেছে ওর শরীর। একটি অষ্ফুট চিৎকারই শুধু আমার মুখ থেকে বেরুল …।
যখন জ্ঞান ফিরল, বেলা হয়ে গেছে তখন অনেক। আব্বার দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে তিনি আমায় ডাকছেন। আমি কাছে যেতেই তিনি বললেন ‘মুসা, কাফেলা নিয়ে যত সত্ত্বর পার এখান থেকে সামনে এগিয়ে যাও। মনে …..?
আমি বাধা দিয়ে বললাম, এ সব কি বলছেন আব্বা? আপনি ভাল হয়ে যাবেন। আব্বা ম্লান হাসলেন। বললেন, তাঁর ডাক এলে কেউ সে ডাকে সাড়া না দিয়ে কি পারে মুসা?
একটু থেমে তিনি বললেন, মুসা, ইউসুফ নাই; দুঃখ করো না। পৃথিবীর সমস্ত নিপীড়িত শিশুর মাঝে তোমার ইউসুফকে খুঁজে পাবে। তোমার মা, বাবা নেই বলে কখনো ভেবনা, পৃথিবীর নির্যাতিত মানষের মধ্যে তোমার মা-বাবাকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করো।’ অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে পড়ল আব্বার কণ্ঠ। আব্বার মুখ থেকে অষ্ফুটে তাঁর কথা বেরিয়ে এল, মনে রেখ মুসা; শুধু সিংকিয়াং এর মুসলমানদের একার এ দূর্দশা নয়, পৃথিবীর কোটি কোটি তোমার ভাই-বোন এমনিভাবেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। আরও মনে রেখ, তোমার এ মজলুম মুসলিম ভাই বোনদের অশ্রু মোছানোর দায়িত্ব, তাদের অবস্থার পারিবর্তন আনার দায়িত্ব তোমাদের মত তরুণদের। তোমরা স্রষ্টার নির্দেশগুলোর আর তোমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে সর্বদা সামনে রেখো। খালেদ, তারিক, মুসা, মুহাম্মদ বিন কাসিমের তলোয়ার যেদিন তোমরা আবার হাতে তুলে নিতে পারবে, দেখবে সেদিন আল্লাহর সাহায্য কত দ্রুত নেমে আসে তোমাদের উপর।
আব্বা তাঁর নিঃসাড় দুর্বল হাত দিয়ে আমার অশ্রু মোছানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে বললেন, মুসা, অশ্রু তো মুসলমানদের জন্য নয়। তোমরা সেই জাতি যারা হাত কেটে গেলে পা দিয়ে পতাকা ধরে রাখে। পা কেটে গেলে দাঁত দিয়ে পতাকা ধরে রাখে। আমি অশ্রু মুছে বললাম, আব্বা আমি আর কাঁদব না। দোয়া করুন – ঘরের কোণে বসে কাপুরুষের মত যেন না মরি।
চারিদিকে চেয়ে দেখলাম, গতকাল যারা দুনিয়ার আলো বাতাসে বিচরণ করেছে, তাদেরই হাজার হাজার বিকৃত লাশে মরুভুমির বুক কালো হয়ে উঠেছে। শত শত পোড়া তাঁবুর খন্ড খন্ড অংশ ছিটিয়ে, ছড়িয়ে পড়ে আছে। শত শত এতিম শিশুর সব হারানোর কান্না চারিদিকে মাতম তুলেছে। আবার যখন আব্বার দিকে চাইলাম, চোখ দু’টি তাঁর বুজে গেছে। চোখ দু‘টি আর কোনদিন চাইবে না পৃথিবীর দিকে। একটি অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাস যেন ভেঙ্গে চুরমার করে দিতে চাইল আমার সমগ্র হৃদয়কে। চারিদিক থেকে অন্ধকার এসে সংকীর্ণ করে দিতে চাইল আমার পৃথিবীকে। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হতে চেষ্টা করলাম আমি।
কাঁধের উপর একটি কোমল স্পর্শে চমকে উঠলাম। ফিরে দেখলাম ‘ফারজানা’। শুভ্র গন্ড দু‘টি চোখের পানিতে ভেসে যাচ্ছে তার। অশ্রু-ধোয়া কালো চোখ দু’টিতে কি নিঃসীম মায়া। এমন নিবিড়ভাবে ফারজানাকে কোনদিন আমি দেখিনি। ফারজানা সিংকিয়াং এর প্রধান বিচারপতি আমির হাসানের কন্যা।
আমি বললাম, ফারজানা কোন দুঃসংবাদ নেই তো? সে বলল, আমরা ভাল আছি। আব্বা আপানাকে আমাদের তাঁবুতে ডেকেছেন।
মরু সূর্য তখন আগুন বৃষ্টি করছে। আমি জানতাম, ফারজানাদের ছোট্ট একটি তাঁবু। আমি বললাম, চারিদিকে চেয়ে দেখো ফারজানা, তাঁবুর ছায়া আমরা কতজনকে দিতে পারব। যা হোক এদিকের একটা ব্যবস্থা করা যাবেই। তুমি যাও ফারজানা। আমি চাচাজানের সাথে পরে দেখা করব।
আমরা আমাদের দশ হাজার ভাই বোনকে মরু বালুর অনন্ত শয্যায় ঘুমিয়ে রেখে এগিয়ে চললাম সামনে। একদিন গোধূলী মুহুর্তে আমরা পৌঁছুলাম তিব্বত সীমান্তে। দেখলাম তিব্বত সরকার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। জানলাম সিংকিয়াং এর মাটি যাদেরকে আশ্রয় দিতে পারেনি তিব্বতের মাটিতেও তাদের পা রাখবার কোন জায়গা নেই। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত ছিন্নমূল বনি আদমের কোন আবেদন নিবেদন কোন কাজে এল না। আশা ভঙ্গের চরম হতাশায় মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এল কাফেলা ঘিরে।
এবার কোথায় যাব আমরা? উত্তরে মৃত্যু হাতছানি দিয়ে ডাকছে, দক্ষিণে তিব্বত সীমান্তের দুর্ভেদ্য দেয়াল। আশার একটি ক্ষীণ আলোক বর্তিকা তখন জ্বলছে-কাশ্মীর হয়ে আফগানিস্তান। পথ অত্যন্ত দুর্গম। কিন্তু উপায় নেই তবু।
হিমালয়ের ১৮ হাজার ফিট উঁচু বরফ মোড়া মৃত্যু-শীতল পথ ধরে আফগানিস্তানের দিকে যাত্রা শুরু হল আমাদের। দিন, মাস গড়িয়ে চলল। পার্বত্য পথের কষ্টকর আরোহণ অবরোহণ নিঃশেষ করে দিল মানুষের প্রত্যয়ের শেষ সঞ্চয়টুকু। তার উপর দুঃসহ শীত। প্রতিদিনই শত শত পরিশ্রান্ত মানুষের উপর নেমে আসতে লাগলো মৃত্যুর হিমশীতল পরশ। দুর্বল বৃদ্ধ, কোমল দেহ নারী, অসহায় শিশুরাই প্রধান শিকারে পরিণত হল এর। সবার মত ফারজানার বৃদ্ধ পিতাকেও একদিন হিমালয়ের এক অজ্ঞাত গুহায় সমাহিত করে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। ফারজানার অবস্থাও হয়ে উঠেছে মর্মান্তিক। তার আব্বার মৃত্যুর পর সে পাষাণের মত মৌন হয়ে গেছে। বোবা দৃষ্টির শূন্য চাহনির মাঝে কোন ভাবান্তরই খুঁজে পাওয়া যায় না। ওর একটি হাত ধরে আমি পাশাপাশি চলছিলাম। কয়েকদিন পর হাত ধরে নিয়ে চলাও অসম্ভব হয়ে উঠতে লাগল। ভীষণ জ্বর উঠল ফারজানার। পা দু’টি আর উঠতে চায় না ওর।
সেদিন গভীর রাত। ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয় সবাই। জ্বরের তীব্র ব্যাথায় ফারজানা কাতরাচ্ছে; একটু দূরে বসে অসহায়ভাবে সে দৃশ্য দেখছি আমি। হিমালয়ের নিঃসীম মৌনতার মাঝে ফারজানার অষ্ফুট কাতরানি তীব্র আর্ত বিলাপের মত আমরা সমগ্র হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে উঠে গিয়ে ওর মাথার পাশে বসলাম। ধীরে ধীরে হাত বুলালাম ওর আগুনের মত ললাটে। ওর দুর্বল দু’টি হাত উঠে এল। তুলে নিল আমার হাত ওর দু’হাতের মুঠোয়। তারপর হাত মুখে চেপে ধরে বাঁধ ভাঙা নিঃশব্দ কান্নায় ভেঙে পড়ল ফারজানা। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, কেঁদোনা ফারজানা, কষ্ট এতে আরও বাড়বে।
ফারজানা বলল, আমাকে ভুলাতে চেষ্টা করো না। আমি জানি, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তারপর একটু থেমে ধীরে ধীরে বলল, মুসা ভাই, সজ্ঞানে কখনও কোন পাপ করেছি বলে মনে পড়ে না। তুমি কি আমাকে আশ্বাস দিতে পার-অমর জীবনের সেই জগতে আবার আমি তোমাকে খুঁজে পাব। আব্বার কাছে বলেছিলাম, কাঁদব না। কিন্তু চোখের পাতা দু’টি সহসা ভারি হয়ে উঠল। আমি বললাম, একথা শুধু তিনিই জানেন ফারজানা। তবে বলতে পারি আমি- তিনি তাঁর বান্দার কোন একান্ত কামনাকেই অপূর্ণ রাখেন না।
ফরজানা যেন গভীর পরিতৃপ্তির সাথে চোখ বুজল। অষ্ফুটে তার মুখ থেকে বেরিয়ে এল, আল্লাহই তো আমাকে সবচেয়ে ভালো জানেন। চোখ দু’টি আর খুললো না ফারজানা। কোনদিনই তা আর খোলার নয়।
হিমালয়ের বুক চিরে দীর্ঘ পথ চলার পর আমরা যখন আফগান সীমান্তে পৌঁছলাম, ৫০ হাজার মানুষের মধ্যে আমরা তখন বেঁচেআছি মাত্র ৮৫০ জন……।
খস্ খস্ শব্দ বন্ধ হল।
হঠাৎ থেমে গেল কলমটি!
টেবিলের একপাশে রাখা একটি ক্ষুদ্র যন্ত্রে হঠাৎ লালবাতি জ্বলে উঠল। আর সেই সাথে অয়্যারলেস গ্রাহকযন্ত্র থেকে ‘ব্লিৎস ব্লিৎস’ শব্দ ভেসে এল। আহমদ মুসা লেখা থামিয়ে ডাইরীটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। প্রায় সাড়ে ছ’ফুট লম্বা লোকটি। মধ্য এশিয়ার ঐতিহ্যবাহী তুর্কি স্বাস্থ্য দেহে। সকল প্রকারের কষ্ট এবং যে কোন প্রতিকূল অবস্থা মোকাবিলার যোগ্যতা দিয়ে যেন আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন একে। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখ দু’টি উজ্জ্বল এবং দৃষ্টি অতি তীক্ষ্ণ। শান্ত দর্শন মুখাবয়বে অনমনীয় ব্যক্তিত্বের সুস্পষ্ট ছাপ। এ লোকটি বিশ্বের সবচেয়ে বেশী আলোচিত এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাথা ব্যথা। সাইমুমের মধ্যমনি। মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া এবং উত্তর ককেশিয়া থেকে তানজানিয়া পর্যন্ত সুবিস্তৃত মুসলিম সমাজের প্রতিটি মজলুম মানুষ তার নাম গর্বের সাথে স্মরণ করে এবং স্বাধীন দেশ আর স্বাধীন জীবনের স্বপ্ন দেখে। আহমদ মুসা উঠে গিয়ে অয়্যারলেসের কাছে বসল। বলল, আহমদ মুসা স্পিকিং।
ওপার থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে এল, ‘আমি ফারুক আমিন বলছি।’
-কি খবর বল।
-বাংলাদেশ সিক্রেট সার্ভিস একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমাদের দিয়েছে। আমি এক্ষুণি আসতে চাই।
– এস। ৪০১১ অপারেশনের খবর?
– পনর মিনিট হল ফিরেছে। জেরুজালেমে ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি তৈরীর সাধ ওদের অনেক দিনের জন্য মিটে গেছে। মাউন্ট গুলিভিয়রের ক্ষেপণাস্ত্র বেদিটি ধূলা হয়ে গেছে প্রচন্ড ডিনামাইটের বিষ্ফোরণে। আর ইহুদী ক্ষেপণাস্ত্র বিশারদ মাইকেল শার্পের দেহটিও উড়ে গেছে তার সাথে।
মুহূর্তের জন্য আহমদ মুসার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, বিজয়ী ভাইদের আমার সালাম দাও ফারুক। আর শোন-কোন প্রকার আত্মতৃপ্তির অবকাশ আমাদের নেই। লক্ষ্য আমাদের বহুদূর পথ অত্যন্ত দূর্গম। এ পর্যন্ত যা আমরা করেছি তার চেয়ে ভবিষ্যতে যা আমাদের করতে হবে তা হাজারো গুণ বেশী। আচ্ছা , তুমি এস।
এবার অয়্যারলেসটির কাঁটা ঘুরিয়ে আর একটি চ্যানেল তৈরী করল। নতুন ঠিকানায় কয়েকবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করল। সফল হলো না। উঠে দাঁড়ালো আহমদ মুসা। ভ্রুদু’টি তার কুঞ্চিত হয়ে উঠল। টেলিফোনটি তুলে নিয়ে একটি পরিচিত নাম্বারে ডায়াল করে বলল, শফিক তুমি একটু উপরে এস।
আহমদ মুসা খস্ খস্ করে একটি কাগজে লিখলঃ
‘‘হাসান তারিকের অয়্যারলেস অস্বাভাবিকভাবে নীরব।
সে কোথায় খোঁজ নাও। এখন নয়, আগামিকাল ভোর পাঁচটায় আমাকে হেডকোয়ার্টারে পাবে।’’
একটু পরেই নীল বাতি জ্বলে উঠল ঘরে। পর্দা ঠেলে প্রবেশ করল শফিক। সামনের চেয়ারটায় বসতে ইংগিত করল আহমদ মুসা। তারপর চিঠিটি ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পররাষ্ট্র দফতরের ঠিক বিপরীতে রাস্তার উত্তর পার্শ্বে ৩২২ নং বাড়ী। বাড়ীটিতে ঢুকে সোজা তিন তলায় উঠে যাবে। তাঁর এ চিঠি। সাবধানে যেয়ো।
২
আম্মানের অভিজাত এলাকার একটি দ্বিতল বাড়ী। চারপাশে কোন বাড়ী নেই। আট ফুট উঁচু দেয়ালে ঘেরা বাড়ীটি। বাড়ীর বাইরের সব আলো নিভানো হলেও রাস্তার সরকারী আলোতে বাড়ীর উত্তর দিকের সম্মুখ ভাগটা উজ্জ্বল। রূপালী রং করা লোহার গেটে আলো পড়ে চিক চিক করছে।
আহমদ মুসার চিঠি নিয়ে গেট দিয়ে ধীর পদে বেরিয়ে এল শফিক। গাড়ী ষ্টার্ট নিতেই শফিক চকিতে একবার পিছনে ফিরে দেখল, কালো রংএর একটি ল্যান্ড রোভার পাশের অন্ধাকারের বুক থেকে বেরিয়ে এল তাদের পিছনে। সন্দেহ সম্পর্কে নিশ্চত হবার জন্য শফিক ড্রাইভারকে ফুলস্পীডে গাড়ী ছাড়তে বলল, ড্রাইভার আপত্তি জানিয়ে বলল, এ আঁকা বাঁকা রাস্তায় এর চেয়ে বেশী স্পীড দেওয়া সহজ নয় সাহেব।
শফিক ড্রাইভারের চোখের সামনে সাংকেতিক চিহ্ন তুলে ধরে বলল, এর প্রয়োজন আছে ড্রাইভার। ড্রাইভার সাইমুমের সাংকেতিক চিহ্ন দেখে মাথা ঝাঁকিয়ে একটি সশ্রদ্ধ সালাম জানিয়ে বলল, এ গাড়ীকে এবং আমাকে এখন থেকে নিজের মনে করুন জনাব।’
শফিক রিয়ারভিউয়ে চোখ রেখে বলল, তোমার মত কি এমনি করে সবাই ভাবে ড্রাইভার?
-সবাই আরও সুন্দর করে ভাবে। আমার মত হতভাগ্য আর কেউ নেই। একমাত্র পেট পূজা ছাড়া জাতির এই সংকট মুহূর্তে আমার দ্বারা কিছুই হল না।
শফিক ড্রাইভারের পিঠে একটি হাত রেখে বলল, কে বলল কিছু করছ না ভাই? তোমাদের সমর্থন আর ভালোবাসাই তো আমাদের শক্তি ও প্রেরণা যোগাচ্ছে।
শফিক রিয়ারভিউ থেকে চোখ সরিয়ে বলল, পিছনের গাড়ীটি আমাদের অনুসরণ করছে ড্রাইভার।
ড্রাইভার একবার চিন্তিত মুখে ‘রিয়ারভিউ’ এর দিতে তাকিয়ে বলল, শহরের প্রতিটি গলি কুজো পথ আমার নখদপর্ণে, যদি বলেন তো ৫ মিনিটে ওদের এড়িয়ে বেরিয়ে যাব, আমরা।
– না তা হয় না ড্রাইভার। শত্রুকে পিঠ দেখানো আমাদের ঐতিহ্যের বিপরীত। সাইমুমের কোন সদস্যই শত্রুকে জীবিত রেখে সামনে এগোয় না। তুমি সামনের গাছটার কাছে মোড় ঘুরবার সময় গাড়ির গতি একটু কমিয়ে দিবে। আমি নেমে গেলে তুমি গাড়ী চালিয়ে যাবে। সুলতান সারাহ উদ্দিন রোডের মুখে আমার জন্য অপেক্ষা করো।
গাছটির কাছে একটু অন্ধকার মত জায়গায় খোলা দরজা দিয়ে চলন্ত গাড়ী থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল শফিক। পিছনে তাকিয়ে আশ্বস্ত হল সে। পিছনের গাড়ীর হেড লাইট এখনো অনেক পিছনে। নিশ্চিন্ত মনে পকেট থেকে একটা হ্যান্ড গ্রেনেড বের করে সেফটিপিন ঠিক করে রাখল। অন্য হাতে রিভলভার।
সামনের গাড়ী লক্ষ্য করে পিছনের গাড়ীটি নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাচ্ছে। গাছের নীচে একটি পাথরের আড়ালে লুকিয়ে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে শফিক।
গাড়ী গাছের সমান্তরালে আসতেই সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার থেকে ধীরে সুস্থে প্রথম গুলিটি ছুঁড়লো সে। দুপ করে মৃদু শব্দ উঠল। প্রচন্ড শব্দে পিছনের একটি টায়ার বার্ষ্ট করল। কিছুদূর যেয়ে থেমে গেল গাড়ীটি।
শফিকের ধারণা সত্য হ’ল। সাধারণ টায়ার বার্ষ্ট মনে করে গাড়ীর দু’ধারের দরজা খুলে দু’জন বেরিয়ে এল। একজন বেঁটে ধরণের। নাক চেপ্টা, মুখ গোল, রং হলুদ একবার চাইলেই বোঝা যায় চীনা লোক। আর একজন লম্বা। রং সাদা। দু’জনের পরনে কালো প্যান্ট, কালো কোট। ওরা টায়ার পরীক্ষা করেই চমকে উঠল। মুহুর্তে হাত পকেটে চলে গেল ওদের। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। শফিকের রিভলভার দু’বার মৃদু শব্দ করে উঠল। ঢলে পড়ল দু’টি দেহ।
শফিক দ্রুত চলে গেল ওদের কাছে। পকেটে রিভলভার, সিগারেট কেস, লাইটার, হাত বোমা ছাড়া অন্য কোন কাগজ পত্র পেলনা।
গাড়ীতে একটি সাব মেশিনগার, একটি চামড়ার ছোট এটাচি কেস পড়ে ছিল। কোন তথ্য পাওয়া যেতে পারে মনে করে এটাচি কেসটি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল শফিক।
চলে যাবার আগে মোড়ে ডিউটিরত পুলিশকে দু’টি লাশের কথা জানিয়ে তাড়াতড়ি ওগুলোর ব্যবস্থা করার জন্য বলে গেল।
শফিককে পাঠিয়ে দেবার পর আহমদ মুসা অস্থিরভাবে কিছুক্ষণ পায়চারী করল। কি যেন সমাধান খুঁজছে সে মনে মনে। কোন কাজে হঠাৎ করে কোথাও চলে যাওয়াও হাসান তারিকের পক্ষে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তাই বা কি করে হয়? এখন রাত ১২টা। তার এখানে পৌঁছবার কথা ছিল ১১ টায়। তাছাড়া সবচেয়ে আশ্চর্য তার অয়্যারলেসের নীরবতা। তাহলে……..ভাবতেই চোখ দু’টি জ্বলে উঠল মুসার। প্রতিশোধের আগুন যেন তাতে ঠিকরে পড়ছে। পরে ধীরে ধীরে সে চোখ নেমে এল অদ্ভুত এক তন্ময়তা। জানালা দিয়ে বাইরে চলে গেল তার চোখ। অন্ধকার দিগন্তের কাল পর্দা ছাড়িয়ে তিবেক, হিন্দুকুশ, কারাকোরাম পর্বতমালা পেরিয়ে ছুটে গেল তার মন। পূর্ব্ব তুর্কিস্তানের কানশু এলাকার একটি সুন্দর জনপদে। কি হাসি -আনন্দ আর সমৃদ্ধি ভরা দিনগুলো। মরুভূমির একখন্ড দুরন্ত হাওয়ার মতই তারা ঘুরে বেড়াত চারিদিকে। কাঁটার ঝোঁপে সারাদিন চলত লুকোচুরি খেলা। রাতের বেলা বাবার উষ্ণ কোলে বসে আকাশের তারার দিকে চেয়ে কত গল্প শুনত। শুনতে শুনতে জগৎ পেরিয়ে মন চলে যেত আর এক জগতে। অন্ধকার গোটা পৃথিবী। একজন মহাপুরুষ এলেন আরব দেশে। তাঁর হাতে নেমে একখন্ড আলো। অনেক ঘৃর্ণাবর্ত আর ঝড়ের মাঝেও তা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। তার এক খন্ড এসে ছড়িয়ে পড়ল তুর্কিস্তানেও। অনেক সময় গল্প শেষ না করেই বাবাকে উঠকে হত। মসজিদ থেকে ভেসে আসতো বড় চাচাজনের এক পশলা মিষ্টি সুর। বুঝতো না সে এক বর্ণও কিন্তু ভাল লাগতো খুব। এমনি করে দিন চলে এসেছিল, চলতও এভাবেই কিন্তু সাজানো গোছানো এক জীবনে এল ঝড়। পিছনে অবশিষ্ট থাকল রক্ত, হাহাকার জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে থাকা আহমদ মুসার মুখ কি এক অব্যক্ত বেদনায় আর দৃঢ়তায় শক্ত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সে বলল, ‘মধ্য এশিয়া সিংকিয়াংএ, ফিলিপাইনে, ফিলিস্তিনে, ইথিওপিয়ায়, চাদে মুসলমানদের উপর যে নির্যাতন তোমরা চালাচ্ছ তার হিসাব অবশ্যই দিতে হবে। তোমার ‘সিয়াটো’ সেন্টো, ন্যাটো’ গড়তে পারো, ‘ওয়ারস’ চুক্তি করতে পারো, কিন্তু আমরা কিছু করতে গেলেই তা হবে ‘ফ্যানাটিক’ আর ‘গোড়ামি’?
জানালার পাল্লা দু’টো টানতে গিয়ে নীচের চোখ পড়তেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। বাইরে প্রাচীরের পাশে বিড়ালের চোখের মত এক টুকরো ক্ষীণ আলো হঠাৎ জ্বলে উঠে নিভে গেল। পেন্সিল টর্চ নয়তো। সচকিত হয়ে উঠল আহমদ মুসা। অন্ধকারের জন্য বিশেষভাবে তৈরী বাইনোকুলার চোখে লাগাল দ্রুত। বাইরের অন্ধকার অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে উঠল। দেখা গেল হুক লাগানো দড়ি বেড়ে একটি ছায়ামূর্তি প্রাচীরে উঠে বসেছে। কালো পোশাকে আবৃত সর্বাঙ্গ। ছায়ামূর্তিটি ধীরে ধীরে নামল নীচে। তারপর দেয়ালের পাশ ঘেঁষে শিকারী বিড়ালের মত এগিয়ে এল ধীরে নিঃশব্দ গতিতে।
প্রস্তুত হয়ে মুসা নেমে এল নীচে। সিঁড়ির মুখে সুইচ বোর্ডের পাশে একটি খামের আড়ালে দাঁড়াল সে।
নিঃশব্দ পায়ে ছায়ামূর্তিটি উঠে এল বারান্দায়। তাকে এক খন্ড জমাট অন্ধকার ছাড়া কিছু বুঝবার উপায় নেই। প্রায় দশ বারো হাতের মধ্যে সে চলে এসেছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়ালো ছায়ামূর্তি। আহমদ মুসা বাম হাতের বুড়ো আঙ্গুলের সুইচে চাপ দিয়ে ডানহাতে রিভলভার ধরে বের হয়ে এল আড়াল থেকে। ঘটনার আকস্মিকতায় ছাড়ামূর্তিটি মুহূর্তের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ল। রিভলভারের নলটি স্থির লক্ষ্যে তুলে ধরে মুসা বলল, নিশানা আমার প্রায়ই ভুল হয় না, ফেলে দিন রিভলভার। বোম হাতের পেন্সিল হেডেড রিভলভারটিও ফেলে দিন।
ছায়ামূর্তিটি স্থির নিষ্কম্প চোখ দু’টি আহমদ মুসার চোখে কি যেন পাঠ করল। তারপর একটু দ্বিধা করে হাতের দু’টি অস্ত্র ছেড়ে দিল মেঝেয়।
পাশে মানুষের একটি ছায়া নড়ে উঠতে দেখে চমকে উঠল আহমদ মুসা। প্রায় ছিটকে এক পাশে শুয়ে পড়ল সে। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে দুপ্ করে একটি শব্দ হল,তীব্র আর্তনাদ করে পড়ে গেল সামনের লোকটি। আহমদ মুসার রিভলভারও গর্জে উঠল। কিছু বুঝবার আগেই পিছনের লোকটির হাত থেকে রিভলভার ছিটকে পড়ে গেল। বাম হাতটি উপরে তুলতে চেষ্টা করল লোকটি। আহমদ মুসা গর্জে উঠল। হাত নামিয়ে নাও, নাহলে দ্বিতীয় গুলিটি এবার হাত নয় হৃদপিন্ড ভেদ করে বেরিয়ে যাবে।
আদেশ পালন করল লোকটি। তার ডান হাত থেকে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরে পড়ছিল এ সময় বাইরের গেটে গাড়ী দাঁড়ানোর শব্দ হল। উৎকর্ণ হয়ে উঠল আহমদ মুসা। কিন্তু রিভলভারের নল তার একটুও নড়ল না। বাইরে থেকে একটি পরিচিত সংকেত এল, আহমদ মুসা তার উত্তর দিতেই কয়েক সেকেন্ডর মধ্যে সেখানে হাজির হল ফারুক। এসেই বলল, ঠিক, আমার কান ভুল শোনেনি, যা ভেবেছিলাম তাই।
ওসব এ্যানালেসিস পরে করো ফারুক। আগে আমাদের এ মেহমানটির পকেট থেকে দ্বিতীয় রিভলবারটি বের করে নাও। সাবধানে হাত দিও পকেটে হয়তো আরো কিছু থাকতে পারে।
রাত তখন একটা। আহমদ মুসা আর ফারুক আমিন মুখোমুখি একটি টেবিলে বসে। আহমদ মুসার সামনে ছোট্ট একটি চিরকুটঃ
“A quite new element. WRF is active – Amman being their target at present – two alpin at trouser band as a “v” make their identity”
ধীরে ধীরে চিরকুট থেকে মুখ তলে আহমদ মুসা বলল, ইহুদীদের ‘মোসাদ’ আর পশ্চিমা সি, আই, এ, এর সাথে এসে জুটল কে আবার এই WRF? কি চায় ওরা? ফারুকের দিকে চেয়ে মুসা বলল, আমাদের আজকের মেহমান কোন দলের খোঁজ নিলে ফারুক?
ফারুক বলল, হ্যাঁ, WRF। ট্রাউজারের ব্যান্ডে ‘ভি’ আকারের দু’টো পিন দেখেছি।
ঘড়ির দিকে চেয়ে আহমদ মুসা বলল, সময় বেশী হতে নেই। তাছাড়া ওর ব্যবস্থা এখনই প্রয়োজন – কোন ব্যাপারকেই – বিশেষ করে এসব বিপদজনক বোঝা বেশীদূর টেনে নেওয়া ঠিক নয়। কিন্তু তার আগে চল পরীক্ষা করা যাক লোকটিকে।
ডিপ নীল আলো চারদিকে। বক -সাদা দেয়াল সে আলো প্রতিফলিত হয়ে স্বপনের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আধ -শোয়া অবস্থায় ইজি চেয়ারে পড়ে থাকা লোটির ডান বাহু থেকে পেন্টাখল ইনজেকশনের সূচ ধীরে ধীরে টেনে বের করল। তারপর মৃদু হেসে আহমদ মুসা বলল, বেশ কিছু একটু ক্লান্তি, একটু একটু ঘুম ঘুম ভাব বোধ করবেন মিনিট খানেক তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। আগের সবগুলো কথা মনে পড়বে। আর বলতেও কোন কষ্ট হবে না।
লোকটির চোখ বুজে গিয়েছিল। আহমদ মুসা একটি চেয়ার টেনে নিয়ে তার সম্মুখে বসল। তারপর ধীরে ধীরে বলল, – চোখ খুলুন, আমার চোখেন দিকে দেখুন। আস্তে আস্তে চোখ খুলে গেল লোকটির। আহমদ মুসা বলল, আপনার নাম কি?
-মিখাইল ইয়াকুবভ।
-আপনি কোন দেশী?
-ইউক্রাইনি।
-কিন্তু দেখে তো তুর্কী মনে হয়?
-আমার পিতা – মাতা নাকি তুর্কী ছিলেন।
-ছিলেন কেমন?
-আমি সাইবেরিয়ার শিশু উদ্বাস্তু শিবিরের মানুষ।
-আপনার পিতা মাতা কি তাহলে মুসলমান ছিলেন?
-জানি না। তবে সেই উদ্বাস্তু শিবিরে আমর ট্রেনিং গ্রহণ কালে একবার অদ্ভুত এক বৃদ্ধ আমাকে বলেছিলেন যে, ১৯১৭ এর অক্টোবর বিপ্লবের পরে যে সব তুর্কী মুসলমানদের কে সাইবেরিয়ার চালান করা হয়েছিল, আমি তাদেরই কোন এক জনের সন্তান।
-এখন আপনি কি মনে করেন নিজের পরিচয় সম্বন্ধে?
-পূর্ব পরিচয়ে আমার প্রয়োজন নেই।
-আচ্ছা WRF কি?
-World Red Forces বিশ্ব কম্যুনিস্ট আন্দোলনের অগ্রবাহিনী।
-আপনি কি এর সদস্য?
-হ্যাঁ।
-কেন আপনি এখানে এসেছিলেন আজ?
-বহুদিন ধরে WRF আপনাকে খুঁজছে। আমাদের উপর নির্দেশ ছিল আপনাকে হত্যা করার অথবা সম্ভব হলে ধরে নিয়ে যাবার।
-সাইমুমের প্রতি আপনাদের এ শুভ দৃষ্টি কেন?
-সাইমুম বিশ্ব কম্যুনিষ্ট আন্দোলনের নাম্বার ওয়ান এনিমি।
-WRF এর কেন্দ্র কোথায়? কাদের নিয়ে গঠিত?
-এর নির্দিষ্ট কোন কেন্দ্র নেই। কেন্দ্রীয় কাউন্সিল যখন যেখানে থাকে সেখানেই এর কেন্দ্র। WRF কমিউনিষ্ট শক্তিগুলোর সম্মিলনে গঠিত একটি বেসরকারী সংস্থা।
-আবার কোথায় কিভাবে WRF কাজ করছে?
-আমি জানি না। শুধু এটকুই জানি, মুসলিম দেশগুলোকে এজন্য বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করা হয়েছে।
-আজকে এখানের খোঁজ কে দিয়েছে আপনাদের?
-আমি জানি না। আদেশ পালন করেছি শুধু।
-আদেশ কোত্থেকে এসেছে?
-আল কবির রোডের ২৩৩ নং বাড়ীর একটি ঘরে রক্ষিত কাঠের বাক্স থেকে নির্দেশ লিখিত চিঠি পেয়েছি?
-হাসান তারিককে চিনেন?
-নাম শুনেছি।
-গত ১০ ঘন্টা থেকে তার খোঁজ নেই। তার সম্বন্ধে কিছু জানেন?
-যে টুকুর সাথে আমরা সংশ্লিষ্ট তার বেশী কোন কিছুই আমাদের জানতে দেওয়া হয় না।
যেন অসীম ক্লান্তিতে চোখ দু’টি আবার বুজে আসছিল। ফারুকের দিকে তাকিয়ে মুসা বলল, এবার সরিয়ে নিয়ে যাও। হ্যাঁ এদের পূর্ব – পুরুষদের ঐতিহ্যের কথা একে স্মরণ করিয়ে দিয়ে একবার শেষ সুযোগ দিবে।
৩
কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকার চারিদিকে। দুর্গম পার্বত্য পথ। পশ্চিম দিক থেকে জর্দান নদীর স্পর্শ চিহ্নিত ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে। নদীর পূর্ব তীরের বিভিন্ন স্থানে অস্পষ্ট আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে্। ওগুলো জর্দান সীমান্তরক্ষীদের ছাউনি। জর্দান নদীর ওপারে থেকেও ইসরাইলের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ঘাটির ক্ষীণ আলোক রেখা দেখা যাচ্ছে।
পার্বত্য পথ ধরে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে চারটি ছায়ামূর্তি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ। মাথায় ছোট ছোট কোঁকড়ানো চুল, ঠোঁট পুরু, মুখ লম্বাটে, বিশাল সুগঠিত দেহ। এর নাম আবু বকর সেনৌসি। দ্বিতীয় জন তীর্গ রোদ – পোড়া লাল মুখ, সযত্ব রক্ষিত দাড়ি। এর নাম আবদুর রহমান। এরা হলেন UMLLA (United Muslim Liberation League of Africa ) এর প্রতিনিধি।
তৃতীয় জন প্রায় সাড়ে ছ’ফুট উঁচু। রং হলদে, তুর্কী টুপি মাথায়, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে মুখে ক্ষীপ্রতার ভাব সব সময় পরিস্ফুট। ইনি হলেন তুরস্ক থেকে আগত তুর্কিস্থান আযাদ আন্দোলনের নেতা মোস্তফা আমিন চুগতাই। এরা এসেছেন আজকে সাইমুমের পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা কমিটির বিশেষ বৈঠকে তাদের আবেদন নিয়ে। আর চতুর্থ ব্যক্তি সাইমুমের সদস্য আবদুর রশিদ তাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছেন।
আবদুর রশিদকে খুব চিন্তান্বিত মনে হচ্ছিল। সে হঠাৎ চুগতাই -এর দিকে চেয়ে বলল, আচ্ছা জনাব আমিন, হাসান তারিক চিঠি দেওয়ার পর আপনাকে কি মুখে কিছু বলেনি?
আমিন চুগতাই দ্রুত অথচ অত্যন্ত শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, হাসান তারিককে অত্যন্ত ব্যস্ত মনে হচ্ছিল, চিঠি দিয়ে ৫ মিনিটের বেশী অপেক্ষা করেনি।
আমি তাকে কোন কিছু জিজ্ঞাসা করতেও সংকোচ বোধ করেছি। আজ ভোরে জনাব আলি এফেন্দির কাছে তাঁর নিখোজের খবর শুনে হতবাক হয়েছি। আজ বুঝতে পারছি, তার অস্বাভাবিক অস্থিরতাকে আমাদের অনুসরণ করা উচিৎ ছিল।
কিছুক্ষণ পথ চলার পর নীচে পাহাড়ের ঢালুতে অসংখ্য আলো দেখা গেল। ওগুলো আকাশের ছায়াপথের ন্যায় উত্তর দিকে এগিয়ে এক সরল রেখার মত। আবদুর রশিদ ওদিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে বলল, ইহুদী বর্বরতার সাক্ষ্য দেখুন। নিজের দেশ, নিজের সকল সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়ে একটুকরো কুঁড়েঘড়ে পশুর মত এরা বাস করছে বছরের পর বছর ধরে। বাস্তুহারা এ লক্ষ লক্ষ মুসলমান জাতিসংঘের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল বিশটি বছর ধরে। অনাহার, অখাদ্য, অপুষ্টি ও অচিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে তারা ক্রমশঃ। কিন্তু এদের আর্তক্রন্দন আর মুমূর্ষ চিৎকার বিশ বছরেও জাতিসংঘের কানে পৌঁছেনি। বলতে বলতে থামল আবদুর রশিদ। তারপর আবার বলল, কিন্তু অপেক্ষার দিন শেষ হয়েছে, ধৈর্য্যের সকল বাদ ভেঙ্গে গেছে। আমরা মানুষের উপর নির্ভর করে খেশারত দিয়েছি বহু। আর নয়। অস্ত্র তুলে নিয়েছি এবার আমরা দু’টো পথ আমাদের সামনে হয় শহীদ না হয় গাজী।
আমিন চুগতাই বলল, জনাব রশিদ, আপনাদের উদ্বাস্তুদের মধ্যে শিক্ষা ও সংগঠনের কোন ব্যবস্থা ছিল না বলেই জানি, কিন্তু এমন বিস্ময়করভাবে সংগঠিত হতে পারলেন কেমন করে আর এমন ট্রেনিংইবা পেলেন কোথা থেকে?
আবদুর রশিদ মৃদু হেসে বলল, আমাদের শিক্ষা ও সংগঠন সম্বন্ধে আপনার ধারণা কিছুটা সত্য, কিন্তু সবটুকু সত্য নয়। যে সময় হাজার হাজার আহত ও ছিন্নমূল মানুষের স্রোত জর্দান, সিরিয়া, ইরাক আর সিনাইয়ে প্রবেশ করে, তখন আমাদের বিশ্রামের জন্য মাটির শয্যা, খাওয়ার জন্য কুপের পানি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমাদের এ চরম দুর্দিনে অনেকেই আমাদের সাহায্য করেছিল, কিন্তু সেদিন অদ্ভুত একদল কর্মী ভাইদের আমরা একান্ত করে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম। মা’র কাছে গল্প শুনেছি। শুনতাম মা প্রায়ই বলতেন, মদিনার আনসারদের আল্লাহ আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন। এদের আপনারা সকলেই আজ চিনেন-ইখওয়ানুল মুসলিমুন। ইখওয়ান ভাইরা সেদিন শুধু আমাদের জন্য চিকিৎসা, খাদ্য আর তাঁবুরই ব্যবস্থা করেছিলেন না। উদ্বাস্তু পল্লীগুলোকে বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ করে প্রত্যেকটিতে একটি করে শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছিল দীর্ঘমেয়াদী সামরিক ট্রেনিং এর ব্যবস্থা। শিবিরগুলিতে ইখওয়ান কমীরা শিক্ষক ও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁরা বলতেন বলে শুনেছি, বিশ্ব -রাজনীতিতে অনুন্নত ও অন্তর্দ্বন্দ্বে মুসলিম দেশগুলো যে ভাবে মার খেয়ে যাচ্ছে, তাতে ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য তাদের সামরিক শক্তির উপর নির্ভর করা যেতে পারে না। ফিলিস্তিনের প্রকৃত মুক্তি অকুতোভয মুসলিম তরুণদের বেসরকারী সংগ্রামেই অর্জিত হবে।’ আজকের সাইমুমের জন্ম হয়েছিল সেদিন আমাদের ইখওয়ান ভাইদের হাতইে। হয়ত অনেক আগেই তেলআবিবের প্রাসাদ শীর্ষ থেকে ইহুদী – পতাকা ভুমধ্যসাগরে ডুবে যেত, কিন্তু হঠাৎ করে আমাদের আশার আলোক বর্তিকা রাগুগ্রস্থ হল। ইখওয়ান নেতা হাসানুল বান্না মিশরের রাজপথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন। হঠাৎ আমিন চুগতাই এর কনুই এ গুতা খেয়ে সম্মুখে তাকিয়ে রশিদ দেখতে পেল, পাহাড়ের অন্ধকার গুহা থেকে আলোক সংকেত হল নির্দিষ্ট নিয়মে কয়েকবার। সে তার সাথীদের জানাল আমরা প্রথম চেকপোষ্টে এসে গেছি। কয়েক গজ সামনে দেখা গেল উদ্ধত মেশিন গান হাতে পথ রোধ করে দাড়িয়ে আছে দু’টি ছায়ামূর্তি।
আবদুর রশিদ বিচিত্র স্বরে একটি শীষ দিয়ে উঠল। আর সঙ্গে সঙ্গে গোটা দেহ কালো কাপড়ে আবৃত একজন বিশালকায় প্রহরী একটি প্লেটে করে কতগুলি কাঠের অক্ষর এনে আবু বকর সেনৌসির সামনে তুলে ধরল। সেনৌসি তার থেকে W অক্ষরটি তুলে নিল। অমনি লোকটি রিভলভার নামিয়ে ছালাম দিয়ে হ্যান্ডশেক করল সকলের সাথে। প্রথম চেকপোষ্ট পেরিয়ে এল ওরা।
বিস্মিত আমিন চুগতাই প্রশ্ন করল, কি ব্যাপার?
আবদুর রশিদ হেসে বলল, তিন নম্বরে আপনার পালাও আসছে। ঘাটিতে ঢোকার জন্য এ ধরনের টেষ্টে আপনাকেও উত্তীর্ণ হতে হবে। চিন্তিত আমিন চুগতাই বলল, কিন্তু আমি তো এ সংকেত জানতে পারিনি হাসান তারিক আমাকে ………..।
-তা আমি বুছলাম। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি আপনার মতই অজ্ঞ। দেখা যাক, আমি মুসা ভাইকে জানিয়েছি আপনার কথা।
আরও কয়েক মাইল কষ্টকর আরোহন-অবতরণের পর তারা দ্বিতীয় চেক পোষ্টে পৌঁছল। সেখাসে আগের মত করেই প্লেটে কতগুলো কাঠের অক্ষর আনা হল আব্দুর রহমানের সামনে। তা থেকে তিনি A অক্ষরটি তুলে নিলেন।
তৃতীয় চেকপোষ্ট গিয়ে আমিন চুগতাই প্রহরীদের হাতে আটকা পড়ে গেল। হেড কোয়ার্টার থেকে নূতন নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তাদেরকে ওখানে অপেক্ষা করতে আদেশ করা হল।
প্রায় পনর মিনিট পর আহমদ মুসার বিশেষ নির্দেশে আমিন চুগতাইকে ছাড়া হল।
আম্মান থেকে ১২ মাইল উত্তরে জর্দান নদী থেকে ২০ মাইল পূর্বে একটি সংকীর্ণ পার্বত্য উপত্যকার পাশে পর্বত গাত্রের কয়েকটি গোপন প্রকোষ্ঠ আলোকিত হয়ে উঠেছে। পর্বত গুহার চতুর্দিকে মাইলের পর মাইল ধরে ‘সাইমুম’ মুক্তি সেনার ঘাঁটি ও পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র ছড়িয়ে আছে। এখান থেকে পরিচালিত গেরিলাভিযান ইসরাইলের ইলাত থেকে গাজা, হাইফা থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত ইহুদী সম্রাজ্যবাদীদের সুখনিদ্রাকে চিরতরে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। রাতের অন্ধকারে রাইফেল নিয়ে পাহারায় বসতেও তাদের বুক আজ দুরু দুরু করে। যেন তার বুঝতে পারছে, হিসাবের দিন আসন্ন। প্যালেষ্টাইনী মুসলমানদের প্রতিটি ফোটা রক্তের শোধ আজ তাদের দিতে হবে।
উজ্জ্বল প্রকোষ্ঠগুলির একটিতে বিরাট এক গোল টেবিলের চারদিকে চেয়ার পাতা। ঘরের প্রতিটি চিনিস ঝকঝক তকতক করছে। টিবিল ঘিরে ১০ টি চেয়ার। ৮ জন লোক বসে আছে। এক পাশের দু’টি চেয়ার তখন ও খালি – একটি হাসান তারিকের অপরটি মেজর জেনারেল আলী এফেন্দির। হাসান তারিক নিখোঁজ। আর আলী এফেন্দী এখনো পৌঁছুতে পারেনি। সাইমুমের তিনজন সদস্য ছাড়াও যারা আজকের বৈঠকে এসছে, তারা হলো আফ্রিকার দু’ জন, তুরষ্ক থেকে একজন। UMLLA কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের পাঠানো রিপোর্ট পড়ছিলেন আফ্রিকার অন্যতম প্রতিনিধি আবদুর রহমান। এ শীতের রাতেও তার কপালে জমে উছেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আহমদ মুসার মুখ নিচু। তন্ময়তার কোন অতল গভীরে যেন হারিয়ে গেছে সে। আবদুর রহমান তাঁর রিপোর্টে বলছিলেনঃ -‘‘আফ্রিকার মোট ৩২২০ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা হল ১৯৪ মিলিয়ন। আর বহিরাগত ঔপনিবেশিক খৃষ্টানদের নিয়ে মোট খৃষ্টান জনসংখ্যা হল ৪৭ মিলিয়ন। এ খৃষ্টানরা দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে রয়েছে। এ অঞ্চলের কোন মুসলিম দেশেই এদের সংখ্যা ১৫% এর বেশী নয়। অথচ এ সামান্য সংখ্যক হয়েও তারা স্বগোত্রীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তায় ইথিওপিয়া, চাঁদ, মালি, নাইজেরিয়া, তানজানিয়া, ঘানা, সিয়েরলিওন, ডাহোমী, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক, আপার ভোল্টা, আইভরি কোষ্ট, সেগোল প্রভৃতি মুসলিম দেশে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ আর নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে। এসব দেশে শিক্ষার দ্বার মুসলমানদের জন্য প্রায় অবরুদ্ধ। অবশ্য কোন মুসলিম সন্তান যদি একান্তই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কখনও ঢুকবার সুযোগ পায়, তাহলে তাকে মুসলমান নাম বদল করে খৃষ্টান নাম গ্রহণ করতে বাধ্য হন এবং অবশেষে খৃষ্টানই হয়ে গেছেন। অর্থনৈতিক কায়কারবার ব্যাবসায় বাণিজ্যের সব সুযোগই খৃষ্টানদের কুক্ষিগত। রাজনীতি ক্ষেত্রে মুসলমানরাতো অস্পৃশ্য। এভাবে সর্বমুখী শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়ে মুসলমানদের অস্তিত্ব আজ নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে, এসব কিছুর উপরে রয়েছে আবার রাজনৈতিক নির্যাতন। মাত্র কিছুদিন আগে চাদের লিবারেশন ফ্রন্টের সহস্র সহস্র কর্মীকে অমানুষিক যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইথিওপিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদেরকে হত্যা করে গাছে গাছে লটকিয়ে রাখা হয়েছিল যা দেখে নিরপেক্ষ বিদেশীরাও চোখের পানি রোধ করতে পারেনি। জাঞ্জিবারের মুসলিম জননেতা কাশিম হাঙ্গা, আলি মহসিন, সালাম বাম্ব, ইবনে সালেহ্ আবদার জুমা, খাতির মুহাম্মদ সামত, জুমা আলই, আমিরাল আল্লারখিয় বছরের পর বছর ধরে কারাগারে যন্ত্রণা ভোগ করেছে। শুধু তাঞ্জানিয়ার কারাগারেই নয়, এমনই সহস্র সহস্র নরনারী আফ্রিকার বিভিন্ন কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর প্রহর গুনছে।
আমরা ঠেকে ঠেকে বুঝেছি এবং একথা আমরা নিশ্চিতভাবে আজ বিশ্বাস করি যে, ভিক্ষা করে সুবিচার আদায় করা যাবে না কিংবা আন্তর্জাতিক ন্যায় বিচারের মহড়াও এসব নির্যাতিত মানুষের কোন কাজে আসবে না। মজলুম মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ -সংগ্রাম। এ সংগ্রামকে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে নেওয়ার জন্য আমাদের আবেদন ৫ টিঃ
(১) দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক সাহায্য।
(২) মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র – শস্ত্রের সরবরাহ।
(৩) আহত মুক্তিযোদ্ধাদের যথাযথ আধুনিক চিকিৎসার ব্যবস্থা।
(৪) মুক্তিযোদ্ধাদের শিক্ষা ও ট্রেনিং এর জন্য উপদেষ্টা প্রেরণ।
(৫) সাইমুম কর্তৃক নির্যাতিত মানুষের মুক্তি আন্দোলন গুলোর নেতৃত্ব গ্রহণ।
সুদীর্ঘ দশ পৃষ্ঠাব্যাপী লিখিত রিপোর্ট শেষ করলেন আবদুর রহমান। কয়েক মুহূর্ত সবাই চুপচাপ। ধীরে ধীরে টেবিলে রাখা আফ্রিকার একটি বিশেষ মানচিত্র থেকে মুখ তুলল আহমদ মুসা। আর লিবিয়া ও চাদের পর্বতমালাকে আপনাদের প্রধান ও স্থায়ী ঘাঁটি হিসেবে মনোনীত করেছেন কোন কারণে? এর চেয়ে সমুদ্র কুলবর্তী কোন স্থানকে নির্বাচন করলে যুক্তিযুক্ত হতো না কি?
আহমদ মুসার প্রশ্নের উত্তর দিতে এগিয়ে এলেন আবু বকর সেনৌসি। তিনি বললেন এর কারণ তিনটি। প্রথম কারণ উভয় স্থানই অত্যন্ত দুর্গম এবং যে কোন বিরূপ মনোভাবাপন্ন শত্রু রাজধানী থেকে বহুদূরে। শুধু স্থান দুটি ভৌগলিক দিক দিয়ে দুর্গমই নয়, এর চারিদিকে হাজার হাজার মাইল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন পার্বত্য আর বেদুঈন গোত্র। তারা আমাদের বন্ধু এবং আমাদের সংগ্রামী শক্তির বিশিষ্ট অঙ্গ।
দ্বিতীয় কারণ ¬এখান থেকে অতি সহজেই বিভিন্ন আফ্রিকান মুসলিম দেশের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখা যাবে।
তৃতীয় কারণ – অস্ত্র-পাতির সরবরাহও এখানে নিরাপদ হতে পারবে। বন্ধুদেশ সুদানের পথে, লোহিত সাগরের পথে সহজেই আমরা কোন সরবরাহ পেতে পারি। আর উত্তরদিকে ভূমধ্যসাগরের পথে সাইরেনিকা ও লিবিয়া মরুভূমির মধ্য দিয়ে সকল রকমের সরবরাহ নিরাপদে আসতে পারে। সাইরেনিকার নির্জন ও দুর্গম সমুদ্রতীর এবং এর গভীর পার্বত্য বনাঞ্চল এ কাজের খুবই অনুকুল। সাইরেনিকার আরব বেদু্ঈনদের অমূল্য সাহায্য আমরা এ কাজে পাব। বেদুঈনরা সাম্রাজ্যবাদীদেরকে মজ্জাগত ভাবে ঘৃণা করে। ইতালীয় কোম্পানীদের উপনিবেশী নির্যাতনের কথা বেদুঈনরা আজও ভুলে নাই। আজও সাইরেনিকা আর লিবিয়ার পথেঘাটে প্রান্তরে নির্যাতনের সাক্ষর জীবন্ত হয়ে আছে। বেদুঈনদের পানি কষ্ট দিয়ে মেরে ফেলার জন্য যে অসংখ্য কূপ সিমেন্ট দিয়ে বুজিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তা আজ ও তেমনি আছে। লিবিয়া ও সাইরেনিকার বহুস্থানে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এমন বহু জনপদ পাওয়া যাবে যেগুলো একমাত্র পানির অভাবে বিরাণ হয়ে গেছে। ঘাঁটি হিসাবে ‘কুফরা’ আর লিবিয়ার মরুভূমির দক্ষিণ সীমান্তের পর্বতমালাকে নির্বাচনের আর একটি বড় কারণ হল, আজও এ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মুসলিম বৃদ্ধ ও তরুণদের মনে সেনৌসী আন্দোলনের আদর্শ ও আবদুল করিম রিনফের জ্বালাময়ী প্রেরণা রূপকথার মত হলেও জীবন্ত হয়ে আছে।
আহমদ মুসার চোখ দু’টি খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। সে বলল, আপনাদের দূরদৃষ্টি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমি বিশ্বাস করি বিজয় আপনাদের সুনিশ্চিত। আপনাদের পিছনে সেনৌসী আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে, আবদুল করিম রিফের প্রেরণা রয়েছে, আর রয়েছে, হাসানুল বান্নার সংগঠন ও আত্মত্যাগের শিক্ষা।
মোস্তফা আমিন চুগতাই বললেন, তিনি রিপোর্ট এখনও শেষ করতে পারেননি, রিপোর্ট তিনি সমাপ্তি অধিবেশনে পেশ করবেন।
রিপোর্ট অধিবেশন তখনকার মত স্থগিত হল। আহমদ মুসা টেবিলের পাশে একটি বোতাম টিপে ধরল। কিছুক্ষণ পর একজন লোক প্রবেশ করে ছালাম জানাল। মুসা বলল – আলি এফেন্দির কোন খবর নেই?
-জি না।
-আমরা কন্ট্রোল রুমে যেতে চাই, তুমি জামিলকে বলে সত্তর ব্যবস্থা কর।
তারপর সকলের দিকে ফিরে হেসে বলল, ভাই আমিন চুগতাই জানতে চেয়েছেন কিভাবে আমরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে অগ্রসর হচ্ছি। তার জন্যই এ ব্যবস্থা। আবু বকর সেনৌসি মৃদু হেসে বলল, আমরা আমিন ভাই এর কাছে এজন্য কৃতজ্ঞ।
পাহাড়ের কয়েকটি অন্ধকার আকাবাঁকা গলি পেরিয়ে আটটি ছায়ামূর্তি ত্রিকোণ একটি জায়গায় এসে দাঁড়াল। জায়গাটি স্বল্প পরিসর। একটি প্রকান্ড পাথর উত্তর দিক থেকে এসে মাথার উপর ছাদের মত আড়াল সৃষ্টি করেছে, তারা ওখানে পৌঁছাতেই উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে একটি পাথর সরে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে এক ঝলক সন্ধানী আলো এসে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিল। আহমদ মুসা সবাইকে নিয়ে সে উন্মক্ত পথ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। আবার পূর্বের মতই সে গলি পথ শুরু হল। দু’ধারে পাহাড়ের দেয়াল। অন্ধকারে কিছুক্ষন চলার পর এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল আহমদ মুসা। পাশে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় প্রথমে তিনটি জোরে এবং পরে পাঁচটি আস্তে টোকা দিল। টোকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রায় বিশ গজ উপরে একটি ম্লান নীল বাল্ব জ্বলে উঠল।
আহমদ মুসা পুনরায় প্রথমে পাঁচটি ও পরে তিনটি টোকা দিল নির্দিষ্ট জায়গায়। এবার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আটটি দড়ির মই নেমে এল নিচে। ঢাকনীর বিপ্লব পরিষদের মওলানা ফারুক হেসে বললেন, আবার একি ট্রেনিং এ পাল্লায় ফেল্লেন?
পাহাড় দেশের মানুষ হয়ে আমাদের এ ক্ষুদে পাহাড়কে আর লজ্জা দিবেন না মওলানা। হেসে আহমদ মুসা জবাব দিল।
দড়ির মইগুলি নেমে এল। সেগুলোতে উঠতেই মুহূর্তে তাদেরকে উপরে নিয়ে এল। তারা একটি কংক্রিটের ছাদে গিয়ে দাঁড়াল। ছাদটি বিরাট প্রশস্ত। ছাদে উঠে দাঁড়াতেই এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে গায়ে হিমেল পরশ বুলিয়ে গেল।
জর্দান নদীর এ সওগাত। রাত্রির অন্ধকার না থাকলে দেখা যেত কিছু দূর দিয়ে রূপালী ফিতার মত জর্দান নদী বয়ে যাচ্ছে। আহমদ মুসা সবাইকে নিয়ে ছাদটি পেরিয়ে একটি সিঁড়ি মুখে প্রবেশ করল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল মওলানা ফারুক, আবু বকর সেনৌসি ও আবদুর রহমানের মুখ। তারা দেখল সিঁড়ির প্রান্তে হাসি মুখে দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশ্ব মুসলিম সম্মেলনের বিশিষ্ট কর্ণধার আশিন আল – আজহারী এবং বিশ্ব মুসলিম কংগ্রেসের সামরিক বিশেষজ্ঞ আবদুল্লাহ অতিথিদেরকে জড়িয়ে ধরল আনন্দে।
সকলে মিলে আবার তারা চলতে শুরু করল। আবু বকর সেনৌসিদের বিস্ময়ের ঘোর তখনও কাটেনি। আহমদ মুসা তাদের তিকে চেয়ে হেসে বলল – জনাব আমিন আল আজহারী সাইমুমের পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান এবং জনাব আবদুলাহ আমর এ বিভাগের প্রধান উপদেষ্টা।
তারা সকলে পার্শ্বস্থ একটি প্রায়ান্ধকার কক্ষে প্রবেশ করল। দরজা দিয়ে বাহির থেকে এক টুকরো আলো এসে বৃহৎ লম্বা টেবিলটির একাংশ আলোকিত করেছে। তারা লম্বা টেবিলটির দক্ষিন পার্শে গিয়ে তারপর দরজাটি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতেই অল্প আলোর রেশটুকুও মিলিয়ে গেল। ঘরটি হয়ে গেল সম্পূর্ণ অন্ধকার।
আহমদ মুসার গম্ভীর কণ্ঠ শুনা গেল। সে বলল, বিজ্ঞ ইহুদী মুরুব্বিদের পরিকল্পিত বহু বছর ধরে গড়ে তোলা বিশ্বজোড়া ইহুদী চক্রান্তের বিষফল ইসরাইলের বিরুদ্ধে কিভাবে আমরা অগ্রসর হচ্ছি তা এবার আপানদেরকে বুঝিয়ে দিবেন জনাব আমিন আল – আজহারী।
আমিন আল আজহারী টেবিলের উপর দু’টি কনুই রেখে সামনের দিকে এইটু ঝুকে বসলেন তাঁর শান্ত কন্ঠে শোনা গেল – সাইমুমের মূল পরিকল্পনার বিষয়ে কিছু বলার আগে প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা বলা দরকার। আরব দেশগুলোর লক্ষ্যগত অনৈক্য, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে দুর্বলতা এবং সামরিক ক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতার জন্য আজও ইহুদীদের হাত থেকে আরবভূমি মুক্ত করতে পারা যায়নি। এ পরিস্থিতিতে নিয়মিত পদ্ধতিতে যুদ্ধ করে ইহুদীদের উৎখাত করা যাবে না। তাদের পিছনে রয়েছে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় শক্তি জোট। আরব ভূমিকে মুক্ত করতে চাইলে এবং কয়েক যুগ ধরে মুসলমানদের উপর কৃত সকল জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হলে ইসরাইলকে ভিতর থেকে আঘাত হেনে টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে। এ ধারণার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে সাইমুম। সাইমুমের পরিকল্পনাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। কথাগুলো বলে থামলেন তিনি একটু। আবার বললেন – চেয়ে দেখুন সামনে।
সবাই সামনে তাকাল। কোথায় যেন খুট করে একটু শব্দ হল দেয়ালের কাল সীমান্ত রেখায় ইসরাইলের একটি বিরাট মানচিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর মানচিত্রের বিভিন্ন স্থানে ফুটে উঠল অসংখ্য নীল বিন্দু।
আমিন আল-আজহরী শুরু করলেন, ইসরাইলের মানচিত্রে যে নীল বিন্দুগুলো দেখছেন ওগুলো ইসরাইলের গ্রাম। গুনে গুনে দেখুন ওদের সংখ্যা ২৩৯৯ টি হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে ৭ সদস্যের একটি করে বিপ্লবী ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেছি আমরা। ইউনিটের অধিকাংশ সদস্য প্যালেষ্টাইনের ছদ্মবেশী আরব মুসলমান। সুদীর্ঘ ৬ বৎসর অবিরামভাবে কাজ করেছি আমরা এ ইউনিটগুলো প্রতিষ্ঠা করতে। প্রতিটি গ্রামের মাটির তলায় একটি করে ক্ষুদ্র অস্ত্রাগার তৈরী করেছি। পূর্বে অস্ত্রাগারগুলো প্রায় শূন্য ছিল কিন্তু গত ১৯৬৭ সালের জুন যুদ্ধের পর সিনাই মরুভূমি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া অস্ত্র দিয়ে তা আমরা পূর্ণ করে ফেলেছি। প্রত্যেকটি অস্ত্রগারে রয়েছে দু’ডজন হাতবোমা, ৫ টি রাইফেল, ৬ টি পিস্তল ও ১টি সাবমেশিনগান। বিপ্লবী ইউনিটগুলো প্রতিষ্ঠার সময় ইসরাইলী গোয়েন্দা ও সৈন্য বিভাগের দৃষ্টি দেশের অভ্যন্তর থেকে সরিয়ে নেবার জন্য আমরা ইসরাইলের সীমান্ত এলাকায় চালিয়েছি হাজার হাজার অভিযান। ইসরাইল পাগল হয়ে উঠেছিল তার সীমান্ত নিয়ে। তাদের উন্মত্ত মানসিকতার পূর্ণ পরিচয় ফুটে উঠে ‘‘সাইমুমের’’ ঘাঁটি সন্দেহে জর্দানের ‘‘কারামা’’ আক্রমণের মধ্যে।
খুট করে আর একটি শব্দ হল। মানচিত্রে সিনাই মালভূমির অভ্যন্তরে এবং গোলান হাইট থেকে প্রায় ৫০ মাইল ভিতরে দু’টি বড় নীল আলো ফুটে উঠল। জনাব আজহারী বললেন – ইসরাইলের অভ্যন্তরে এ দু’টি আমাদের মূল সরবরাহ ঘাঁটি। দু’টি পুরান গির্জার নীচে মাটির তলায় এ দু’টি ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে।
প্রথম পর্যায়ের কাজ আমাদের সমাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা প্রবেশ করেছি। তার কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানচিত্রে চারটি লাল বিন্দ স্পষ্ট হয়ে উঠল। জনাব আল আজহারী আবার শুর করলেন, লাল বিন্দু চারটি হল ইসরাইলের ইলাত, লুদ, তেলআবিব আর হাইফা এ চারটি স্থানে ইহুদীরা ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন করেছি। এ ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটিগুলির আওতায় রয়েছে হেজাযের দু’টি পবিত্র শহর। তুরস্ক আর আরব রাষ্ট্রগুলির রাজধানী এবং সবগুলো গুরুত্বপূর্ণ শহর। দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল ইসরাইলের চরম আঘাত হানার ঠিক পূর্বমুহূর্তে একটি নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটিগুলি বিনষ্ট করে দেয়া। অবশ্য আমরা জানি ইসরাইলের কমপক্ষে ১১টি আণবিক বোমা রয়েছে কিন্তু ওগুলো ব্যবহার করতে সমর্থ হবে না ইসরাইল। কারণ তার উপর আঘাত হানা হবে ভিতর থেকে -কোন আরব রাষ্ট্র থেকে নয়। তবুও আমরা এ বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখব এবং আনবিক অস্ত্র ব্যবহারের যে কোন প্ল্যান আমরা বিনষ্ট করে দেব।
জনাব আজাহারির শেষের বাক্যটি শেষ হবার সাথে সাথে আমিন চুগতাই যেন অনেকটা সঙ্কোচ জড়িত কন্ঠে বললো, আপনাদের আপত্তি না থাকলে আমি একটি সিগারেট ………।
দ্রুত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল আহমদ মুসার মনে। অবশেষে সে পরিস্কার গলায় বলল, না না আমাদের আপত্তি থাকবে কেন?
আমিন চুগতাই একটি সিগারেট মুখে পুরে লাইটার জ্বালল। লাইটারটি জ্বলে উঠতেই চমকে উঠল আহমদ মুসা। এক ঝলক তীক্ষ্ণ আলো আর লাইটার থেকে ভেসে আসা অতি সুক্ষ্ণ একটি পরিচিত শব্দ আহমদ মুসার দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারলো না। ইতিমধ্যে জনাব আজহারি আবার বলতে শুরু করেছেন ‘দ্বিতীয় পর্যায় সমাপ্ত হবার পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হবে আমাদের সর্বাত্মক সংগ্রাম। ভিতর থেকে যে দুর্বার আঘাত আমরা হানব তা রোধ করার সাধ্য ইসরাইলের নেই। তার বিদেশী মুরব্বীরা তার পাশে এসে দাঁড়াবার পূর্বেই সে খতম হয়ে যাবে।
আমিন আল আজহারির কথার শেষ রেসটুকু ইথারে মিলিয়ে যাবার আগেই উজ্জ্বল সাদা আলোয় ঘরটি যেন হেসে উঠল। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়েছিল আগেই। সে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল চুগতাই এর দিকে। ভাবলেশহীন মুসা। চুগতাই টেবিলের উপর হাত রেখে বসে ছিল। তার চোখ দু’টি ঘরের চারদিকে ঘুরছিল। অনুসন্ধিৎসা সে চোখে। মনে তার প্রচন্ড ঝড় – শামিল এফান … “দেশের ইন্টারনাল সিকিউরিটির দায়িত্ব ঐ বুড়োটার উপরই তো ছিল। শুধু গাদা গাদা বেতন মেরেছে আর নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছে বুড়ো … আচ্ছা দ্বিতীয় পর্যায়ের কতদূর পৌঁছেছে এরা। পরিকল্পনা এদের নিখুঁত। ভাবতে আতঙ্ক লাগে -প্রতি গ্রামে এরা ছড়িয়ে আছে …।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে একটি হাত রাখল চুগতাই এ কাঁধে । তার হাতে একটি সিগারেট। চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল চুগতাইয়ের । প্রচন্ড এক হোঁচট খেল যেন সে। ভীষণ চমকে উঠল। ফিরে তাকিয়ে আহমদ মুসাকে দেখে ঠোঁটের প্রান্তে হাসি টেনে নিল। সামলে নিয়েছে সে নিজেকে। বলল, খুব চমকে দিয়েছেন তো আমাকে? আপনাদের বিস্ময়কর পরিকল্পনার রঙীন জগতে ঘুরছিলাম আমি এখনও।
– আমি দুঃখিত ভাই। বলল আহমদ মুসা। তারপর সিগারেটের একটি শলা বাম থেকে ডান হাতে নিয়ে সে বলল, আপনার লাইটারটি কি পেতে পারি? কথাটি শোনার সাথে সাথে ঠোঁটের কোনের হাসিটি দপ করে যেন নিভে গেল। এক টুকরো তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মুহূর্তের জন্য আহমদ মুসার চোখে এসে স্থির হল। কিন্তু ক্ষণিকের জন্যই। তারপরই আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল মোস্তফা আমিন চুগতাই। বলল, নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। বলে পকেট থেকে লাইটারটি বের করে জ্বালিয়ে আহমদ মুসার মুখের কাছে তুলে ধরল। সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে আহমদ মুসা বলল, বাঃ লাইটারটির সিষ্টেম তো খুব সুন্দর। জার্মানির তৈরী না? দেখতে পারি একটু?
মোস্তফা আমিন চুগতাই এই অবস্থার জন্য বোধ হয় প্রস্ত্তত ছিল না মোটেই্। কেমন একটি বিমূঢ় ভাব চোখে মুখে ফুটে উঠল তার। সে দ্বিধাজড়িত হাতে লাইটারটি তুলে দিল আহমদ মুসার হাতে।
আহমদ মুসা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিল চুগতাইকে। দেখল একটি হাত তার কোটের পকেটে। এর অর্থ মুসার অজানা নয়। সূক্ষ্ম এক টুকরো হাসি ফুটে উঠতে চাইল তার মুখে। সে লাইটারের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়েই বুঝতে পারল, একটি শক্তিশালী ক্যামেরা সংযোজন করা আছে ওতে।
একগাল ধোয়া ছেড়ে একটু ঝুঁকে পড়ে দু’টি কনুই টেবিলে রেখে মুফতি আল আজহারির দেকে একটু তাকিয়ে মৃদু হেসে আহমদ মুসা বলল, জনাব আমিন এ সামান্য ধরনের নেশাকেও ভালো চোখে দেখেন না। তবু রক্ষে যে আজ আপানাকে একজন সাথী হিসেবে পাওয়া গেল। এ অভ্যেস আপনার কত দিনের?
শুধু আমিন আল আজহারিই নয়, আবু বকর সেনৌসি, আবদুর রহমান এবং মওলানা ফারুকসহ সকলেই আহমদ মুসার জলজ্যান্ত মিথ্যা কথা আর এ অস্বাভাবিক ব্যবহার বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে। আহমদ মুসা সিগারেট খায় না এটা সকলেই জানে। আহমদ মুসার এটি ছেলেমি না কোন বিশেষ অভিনয়? এ ধরনের ছেলেমি করার মতো লোক তো আহমদ মুসা নয়। তাহলে … সকলের চোখে একরাশ বিস্ময়ভরা প্রশ্ন।
আহমদ মুসার কথায় চুগতাইকে একটু খুশী মনে হল। যেন এক খন্ড মেঘ তার মুখের উপর থেকে সরে গেল। মুফতি আমিন আল আজহারির দিকে একটু চোরা দৃষ্টিতে চেয়ে সকৌতুকে নিচু গলায় বলল, এ বদ অভ্যেসটি আমার ছোট বেলার। বন্ধুদের সংসর্গ দোষও বলতে পারেন একে।
আহমদ মুসা হেসে বলল, বন্ধুরা অনেক উপকারও করেছে আপনার। তা না হলে দেশের সেরা ফুটবল খেলোয়াড় কি হতে পারতেন আপনি।
-ভালো দিকগুলো অস্বীকার আমিও করি না। হেসে বলল চুগতাই। আহমদ মুসা আবার শুরু করল, আমার মনে হয় কি জানেন, আপনি চেষ্টা করলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মল্লযোদ্ধা হতে পারতেন। এ প্রচেষ্টা ছেড়ে দিলেন কেন?
হঠাৎ চুগতাই এ চোখ মুখ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। কি যেন বুঝতে চেষ্টা করল। মুহূর্তকাল পরে শান্ত কন্ঠে বলল, কিন্তু আপনি এ সব প্রশ্ন করছেন কেন?
আহমদ মুসা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, মোস্তফা আমিন চুগতাই -এ সাথে আপনাকে মিলিয়ে নিতে চেষ্টা করছিলাম। আমিন চুগতাই এর ডসিয়ার থেকে জানি, উনি জীবনে ফুটবলে পা রাখেননি। আর সত্যিই একজন শ্রেষ্ঠ মল্লযোদ্ধা তিনি। অথচ আপনি …….।
আহমদ মুসার কথা শেষ হবার আগেই স্প্রীং এর মত ছিটকে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল চুগতাই। কিন্তু দেরী হয়ে গেছে তখন। আহমদ মুসার ছয়ঘরা রিভলভারের চকচকে নল স্থির লক্ষ্যে চেয়ে আছে চুগতাই এর দিকে।
আহমদ মুসার গম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল, পকেট থেকে হাত বের করে নিন। মৃত্যু না চাইলে আত্মসর্পণ কারাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
-মৃত্যুকে আমি ভয় করি না মুসা। কিন্তু তোমরা জীবিত থাক তাও আমার কাম্য নয়। বলে সে বিদ্যুৎ বেগে পকেট থেকে হাত বের করল, হাতে ডিম্বাকৃতির একটি গ্রেনেড।
বিমূঢ় হয়ে পড়েছে সবাই ঘটনার এ অবিশ্বাস্য আকস্মিকতায়। বেপরোয়া ঐ লোকটির দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল সবাই। তারা জানে হাতের ঐ বিশেষ হ্যান্ডে গ্রেনেডটি দিয়ে শুধু গুহার এ কয়জন মানুষই নয়, পাহাড়ের একটি অংশ সহজেই উড়িয়ে দেয়া যাবে।
কিন্তু গ্রেনেডটি ছুড়বার অবসর পেল না চুগতাই। আহমদ মুসার রিভলভার নিঃশব্দে একরাশ ধুম্র উদগিরণ করল। হ্যান্ডে গ্রেনেডটি হাতেই রইল, টেবিলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল চুগতাই – এর দেহ। ঠিক এ সময় দরজা ঠেলে প্রবেশ করল আলী এফেন্দি এবং তার সাথে সাথে মোস্তফা আমিন চুগতাই। ওদের দিকে তাকিয়ে একমাত্র আহমদ মুসা ছাড়া সকলের মুখ বিস্ময়ে হা হয়ে উঠল।
গত একরাত একদিনের কাহিনী শেষ করে চুপ করল মেজর জেনারেল আলী এফেন্দি। একটি গোল টেবিল ঘিরে সবাই বসে আছে নির্বাক হয়ে।
কথা বলল আহমদ মুসা প্রথম। বলল, পরশু দুপুরেই ইস্তাম্বুল গেছে হাসান তারিক। অথচ এত অল্প সময়ের মধ্যে হাসান তারিকের আটক থেকে শুরু করে মোস্তফা আমিনের কিডন্যাপ, একজন ইহুদি স্পাইকে নিখুঁত প্লাষ্টিক অপারেশন দ্বারা মোস্তফা আমিন চুগতাই এর পরিবর্তন কেমন করে সম্ভব হল? তাহলে আমাদের আজকের এ অধিবেশনের কথা এবং মোস্তফা আমিন চুগতাই এ এখানে যোগদানের কথা কি ওরা আগেই জানতে পেরেছিল?
আলী এফেন্দি বলল, যতদূর জানতে পেরেছি WRF এবং ‘মোসাদে’র সম্মিলিত তৎপরতায় এটা সম্ভব হয়েছে। টার্কিস সিক্রেট সার্ভিস জানিয়েছে, গতকাল তুরস্ক ইরাক সীমান্ত থেকে একটি কফিন ইরান দিয়ে কাস্পীয়ান সাগরে অপেক্ষমান একটি সাবমেরিনে উঠেছে। সে কফিনের আবরণে যদি হাসান তারিককে পাচার করা হয়ে থাকে, তাহলে বলা যায়, আমাদের এ অধিবেশন সংক্রান্ত সকল খবর ও তথ্য দিয়ে ডজঋ ‘মোসাদ’কে সাহায্য করেছে, বিনিময়ে ‘‘মোসাদ’’ হাসান তারিককে তাদের হাতে তুলে দিয়েছে।
-WRF এর এ তৎপরতার কথা আরও সূত্র থেকে আমরা জানতে পেরেছি। কিন্তু বুঝতে পারছি না হাসান তারিকের উপর WRF এর এ বিশেষ আগ্রহ কেন? বলল আহমদ মুসা।
একটু চিন্তা করে আলি এফেন্দি বলল, আপনার নিশ্চয় মনে আছে, দু’ বছর আগে জর্দানে বিদেশী কূটনীতিক মার্থাল খিরভ গুপ্তচর বৃত্তির দায়ে ধরা পড়েছিলেন। একমাত্র হাসান তারিকের কৃতিত্বেই দলিল দস্তাবেজসহ খিরভ হাতে নাতে ধরা পড়ে এবং সে দুর্ঘটনার সময় বিশ্বব্যাপী বহু আলোচিত দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা কূটনীতিক ব্রিগেডিয়ার ক্লিমোভিচ হাসান তারিকের গুলিতেই নিহত হয়েছিল। আমার মনে হয় হাসান তারিকের উপর তারই প্রতিশোধ নিতে এসেছে বেসরকারী আন্তর্জাতিক কম্যুনিষ্ট সন্ত্রাসবাদী সংস্থা WRF। খিরভ ও ক্লিমোভিচ উভয়েই যে এ বেসরকারী কম্যুনিষ্ট সংগঠন WRF এরও সদস্য ছিল, তা আমরা আজ নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারি।
আলী এফেন্দি থামল। ধীরে ধীরে মুখ তুলল আহমদ মুসা। মনে হল চিন্তার কোন অতল থেকে জেগে উঠল সে। বলল ধীরে ধীরে, ক্লিমোভিচকে অনুসরণ করে তার গোপন আড্ডার হানা দিয়ে একটি পরিকল্পনার দুর্বোধ্য নক্সা পেয়েছিল হাসান তারিক। কিন্তু নক্সাটি হাসান তারিক রাখতে পারেনি। সে দিনই গভীর রাতে আক্রান্ত হয়েছিল সে। ক্লিমোভিচের লাশ পেছনে রেখে তারা নক্সাটি নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। কিছুক্ষণ থামলো আহমদ মুসা। আবার শুরু করল সে, পরিকল্পনার মূল কপি আমাদের কাছে না তাকলেও এর একটি ফটো কটি আমাদের কাছে আছে। এ কথা ওরা জানে কিনা জানি না, তবে আমার মনে হয় যদি প্রতিশোধ গ্রহণই WRF এর লক্ষ্য হত, তাহলে হাসান তারিককে ধরে না নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে পারত। কিন্তু তা তারা করেনি। এ থেকে প্রমাণ হয়, পরিকল্পনার নক্সা সম্পর্কে হাসান তারিককে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। হাসান তারিক পরিকল্পনার কতদূর জেনেছে, আর কেউ এর কোন কিছু জানতে পেরেছে কিনা, ইত্যাদি জেনে না নেয়া পর্যন্ত তারা হাসান তারিককে কিছুতেই হত্যা করবে না।
-পরিকল্পনা কি সম্পর্কিত এবং আপনারা কি জানতে পেরেছেন তা থেকে? উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে মোস্তফা আমিন।
-পরিকল্পনাটির অর্থ আজও আমাদের কাছে পরিস্কার নয়। মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো থেকে আফ্রিকার মুসলিম অধ্যুষিত তানজানিয়া এবং মরক্কো থেকে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত অধ্যুষিত মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র। এর মাঝে অসংখ্য সাংকেতিক চিহ্ন এবং লাল ও কালো রেখার অসংখ্য সারি। সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে নিঃসন্দেহে আমরা বুঝতে পারছি, পরিকল্পনাটি আসলে WRF এর এবং তা যদি হয়, এর অর্থ আমাদের কাছে পরিস্কার, সমগ্র মুসলিম বিশ্ব জুড়ে ওরা চক্রান্তের জাল বিছিয়ে রেখেছে। পরিকল্পনাটির নক্সাটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের। কিন্তু তার আগে হাসান তারিক সম্বন্ধে আমাদের … কথা শেষ হলো না আহমদ মুসার। ঘরে পাথরের দেয়ালে এক বিশেষ স্থানে লাল সংকেত জ্বলে উঠল। আহমদ মুসা সেদিকে তাকিয়ে বলল, আকাশে নিশ্চয় কোথাও হানাদার ইসরাইলী বিমান দেখা গেছে। আমাদের রাডারের সংকেত ওটা। আসুন বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। সবাই উঠে এল ছাদে। পশ্চিম আকাশ তখন লাল হয়ে উঠেছে।
জর্দান নদীর ওপারে বোমা ফেলেছে ইহুদিরা নিশ্চয়। বলল আহমদ মুসা।
ঘড়ি দেখে আব্দুর রশিদ বলল, আজ রাত ১২ টায় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ইউনিট জেরুজালেমের তিন মাইল পশ্চিমে নতুন ইসরাইল ঘাঁটি আক্রমণ করেছে। মনে হয় তার দায়িত্ব পালন করে ইতিমধ্যেই নদীর ওপারে ফিরে এসেছে। ইসরাইলী বিমানগুলো মনে হয় তাদেরকেই তাড়া করে এসেছে। এসময় রাডার পর্যবেক্ষক আবদুল্লাহ মাসুদ এসে জানাল, জর্দান নদীর আড়াই মাইল পশ্চিমে আরব পল্লীর উপর বোমা ফেলেছে ইসরাইলীরা। সবাই চোখ ফিরাল লাল হয়ে ওঠা দিগন্তের দিকে। ঐ লাল আগুন কত অসংখ্য নারী পুরুষ আর অসহায় শিশুর রক্ত চুষে নিল কে জানে। কারো মুখে কোন কথা জাগলো না। বোধ হয় সবার মনে একই প্রশ্নঃ এ অগ্নি পরীক্ষা আর কতদিন চলবে? এ কোরবানীর শেষ হবে কবে?
৪
রাতের তেলআবিব। রাস্তার জন সমাগম কমে গেছে। পিচ ঢালা কালো মসৃণ রাস্তা। পাশে সরকারী বিজলি বাতিগুলো আলো আঁধারীর সৃষ্টি করেছে। বাতাস গায়ে লাগে না, কিন্তু কেমন যেন একটু ঠান্ডার আমেজ অনুভূত হয়। সাগর ভেজা বাতাসের স্বাদ এতে অনেকটা। এ বাতাসে নরম ঘুমের পরশ অনুভব করা যায়।
এক অভিজাত আবাসিক এলাকা। কদাচিত দু’একটি বাড়ির জানালা দিয়ে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। এ এলাকার রাস্তায় লোকের চলাচল প্রায় নেই বললেই চলে। ডি,বি, রোড। মাঝে মাঝে দু’একটা গাড়ী চোখ ধাঁধিয়ে তীব্র গতিতে ছুটে চলে যাচ্ছে। ডি,বি, রোড থেকে একটা ছোট রাস্তা বেরিয়ে কিছু দক্ষিণে গিয়ে শেষ হয়েছে। রাস্তাটি যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে সুন্দর একাট দু’তালা বাড়ী।
দূরের কোন একটি পেটা গড়িতে ঢং ঢং করে ১২টা বেজে গেল। ধীরে ধীরে একটা কালো রং এর গাড়ী এসে অন্ধকারে দাঁড়ানো বাড়ীটির গেটে এসে থামল। কালো পোশাক দেহ ঢাকা এক ছায়ামূর্তি গাড়ী থেকে নেমে এল।
ঠক্ ঠক্ ঠক্। বন্ধ জানালার শক্ত কবাটে ধীরে ধীরে তিনটি শব্দ হল।
ছায়ামূর্তিটি বাড়ীটির সম্মুখের বাগানটি পেরিয়ে নীচের তলার একটি বন্ধ জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। ছায়ামূর্তিটির তর্জ্জনী আবার শব্দ করল বন্ধ জানালার গায়ে – ঠক্ ঠক্ ঠক্।
ধীরে ধীরে এবার জানালার একটি পাল্লা খুলে গেল ভিতরে জমাট অন্ধকার। অন্ধকারের ভিতর থেকে একটি হাত বেরিয়ে এল, ছায়ামূর্তিটি সে হাতে তুলে দিল ভাজ করা এক টুকরো কাগজ। সঙ্গে সঙ্গে জানালাটি আবার বন্ধ হয়ে গেল। জানালাটি বন্ধ করে দিয়েই কর্ণেল মাহমুদ দোতলার ব্যালকনিতে উঠে এল। আকাশ থেকে একটি বড় উল্কা পিন্ড খসে পড়ল। মনে হল উল্কাটি যেন সামনের ২২তলা দালানটির ছাদের উপর এসে নামল। ব্যালকনি থেকে ডি,বি, রোড়ের মোড় পর্যন্ত দেখা যায়। মাহমুদ দেখলো কাল গাড়ীটি ছোট রাস্তা পেরিয়ে ডি,বি, রোডে গিয়ে পড়ল। গাড়ীটির পিছনে রক্তাভ আলো দু’টি ক্রমে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। মাহমুদ সেখানে থেকে দৃষ্টি ফিরাতে গিয়েও পারল না। দেখল ছোট রাস্তা পেরিয়ে আর একটি গাড়ী গিয়ে ডি,বি, রোডে পড়ল।
চমকে উঠল মাহমুদ। বিদ্যুৎ খেলে গেল মনে -অনুসরণ। তর তর করে সে নেমে এল সিঁড়ি দিয়ে। গ্যারেজ থেকে গাড়ী বের করে খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল। ডি,বি, রোডে যখন কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী বেরিয়ে এল, তখনও দীর্ঘ পথের প্রান্তে অনুসরণকারী গাড়ীটির পিছনের রক্তাভ আলো দেখা যাচ্ছে। কর্ণেল মাহমুদের ছোট্টগাড়ীটি তীব্র গতিতে ছুটে চলল। সামনের অনুসরণকারী গাড়ীটির স্পীড ছিল মাঝারী গোছের। অল্প সময়ের মধ্যেই কর্ণেল মাহমুদের গাড়ীটি অনুসরণকারী গাড়ীটির দুশো গজের মধ্যে এসে পড়ল। কিছুক্ষণ চলার পর সামনের গাড়ীটির স্পীড হঠাৎ বেড়ে গেল। কর্ণেল মাহমুদও তার গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে দিল। মাহমুদ বুঝতে পারল সামনের অনুসরণকারী গাড়ীটি তাকে সন্দেহ করেছে। মাহমুদ ভেবে খুশি হল যে গাড়ীটি হয়তো এবার সামনের সাইমুমের গাড়ীটির অনুসরণ পরিত্যাগ করে অন্য পথ ধরবে। কারণ দু’দিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার পরিস্থিতি সে সৃষ্টি হতে দিবে না, কিন্তু অল্পক্ষণেই ভুল ভেঙ্গে গেল মাহমুদের। সে দেখলো সমান গতিতে গাড়ীটি সামনের গাড়ীটির অনুসরণ করে যাচ্ছে। সামনের অনুসরণকারী গাড়ী থেকে মাহমুদরে গাড়ীর দুরত্ব কমপক্ষে দু’শ গজের মত। আর সে গাড়ী থেকে তার সামনের গাড়ীটির দূরত্ব কমপক্ষে একশত গজ। এ সময় গাড়ীর রিয়ারভিউ এ চোখ পড়তেই চমকে উঠল মাহমুদ, দেখলো পিছন থেকে পাশাপাশি জ্বলন্ত চোখের মত দু’টি অগ্নিপিন্ড তার দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে মাহমুদের কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝতে পারল সামনের অনুসরণকারী ‘মোসাদের’ (ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা) গাড়ীটি বেতারে চতুর্দিকে খবর পাঠিয়েছে। পিছনের মত সামনে থেকেও হয়তো অনুরূপভাবে গাড়ী তাদের দিকে ছুটে আসছে। মুহূর্তে তার করণীয় ঠিক করে নিল কর্ণেল মাহমুদ। দেখতে দেখতে গতি নির্দেশক গাড়ীর কাঁটা ৫০ থেকে ৯০ এ গিয়ে পৌঁছল। মোসাদের গাড়ী সাইমুমের যে গাড়ীটি অনুসরণ করছিল, তা একই গতিতে চলছিল। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই তেলআবিবের সাইমুম প্রধান কর্ণেল মাহমুদরে গাড়ী মোসাদের গাড়ীটির সমান্তরালে গিয়ে পৌঁছল। মাত্র কয়েক সেকেন্ড, কর্ণেল মাহমুদরে গাড়ী থেকে একটি ডিম্বাকৃতি বস্তু তীব্র বেগে ছূটে গিয়ে মোসাদের গাড়ীটিকে আঘাত করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচন্ড বিষ্ফোরণের শব্দ হল। ততক্ষণে কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী তার সহকর্মীটির গাড়ীর সমান্তরালে গিয়ে পৌঁছল। কর্ণেল মাহমুদ একবার পিছনে ফিরে দেখল, মোসাদের গাড়ীটিতে আগুন জ্বলছে। পিছনের অনুসরণকারী গাড়ীটিও তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো। কর্ণেল মাহমুদ ও তার সহকর্মীর গাড়ী পাশাপাশি সমান গতিতে এগিয়ে চলছে। সামনেই ভিক্টোরী স্কোয়ার। এখানে পশ্চিম দিক থেকে হায়কল এভিনিউ উত্তর দিক থেকে গোলান রোড এবং পূর্ব থেকে ডি,বি, রোড এসে মিশেছে। হায়কল এভিন্যুকে দক্ষিণ পার্শ্বে এবং গোলান রোডকে পূর্ব পার্শ্বে রেখে ইসরাইলীরা এখানে গড়ে তুলেছে স্বাধীন ও সার্বভৌম ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্টার স্মারক স্তম্ভ। স্মৃতি স্মারক কেন্দ্রটিতে স্মরক স্তম্ভ ছাড়াও আছে সুপরিকল্পিতভাবে সাজান সুন্দর বাগান, বিশ্রামাগার, পাঠাগার এবং জাতীয় ইতিহাসের এক প্রদর্শনী কেন্দ্র। সর্বসাধারণের জন্য এ কেন্দ্রটি সর্বদা উন্মুক্ত থাকে।
কর্ণেল মাহমুদের গাড়ী ভিক্টোরী স্কোয়ারে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে তার নজরে জড়ল পশ্চিম দিক থেকে চারটি অগ্নি গোলক ছুটে আসছে। উত্তর দিকে গোলান রোডের দিকে তাকিয়েও একই দৃশ্য নজরে পড়ল কর্ণেল মাহমুদের। কর্ণেল মাহমুদ মুহূর্তের মধ্যে তার কর্তব্য স্থির করে নিল। গাড়ীর ডান দিকের দরজা খুলে চলন্ত গাড়ী থেকে ছিটকে নেমে পড়ল সে। তারপর চোখের নিমিষে ভিক্টোরী স্কোয়ারের পাঁচিল টপকে সে ভিতরে ঢুকে পড়ল। কর্ণেল মাহমুদের চালকহীন গাড়ীটি প্রায় গজ পঞ্ঝাশেক দুরে গিয়ে এক লাইট পোষ্টের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উন্টে গেল। কিছু দূর গিয়ে কর্ণেল মাহমুদের সহকর্মীর গাড়ীটিও থেমে গেল। ইতিমধ্যে তিন দিক থেকে মোসাদের গাড়ী ভিক্টোরী স্কোয়ারে এসে পড়েছে। এই সময় গাঢ় কাল সামনের রাস্তাঘাট আচ্ছন্ন হয়ে গেল। মোসাদের কুকুরদের কাচকলা দেখিয়ে তার সহকর্মীও সরে পড়তে পেরেছে বলে কর্ণেল মাহমুদ একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কর্ণেল মাহমুদ ভিক্টোরী পার্কের আরও অভ্যন্তরে ঢুকে গেল। সে জানত মোসাদের লোকেরা কিছুক্ষণের মধ্যেই গোটা ভিক্টোরী পার্ক চষে ফেলবে। তার আগেই পার্ক থেকে সরে পড়তে হবে। কর্ণেল মাহমুদ সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে উত্তর দিকে এগুচ্ছিল, এমন সময় পাশের বিশ্রামাগার থেকে ধ্বস্তাধ্বস্তি তারপর নারী কন্ঠের চাপা চীৎকার শুনতে পেল সে। দ্রুত সে ওদিকে এগুলো। দেখতে পেল একটি নগ্ন প্রায় নারী দেহের উপর একটি লোক চেপে বসেছে। নারীটি মুক্তি পাবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হচ্ছে। কর্ণেল মাহমুদ কক্ষে প্রবেশ করল। পায়ের শব্দ থেকেই লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছে। মাহমুদের দিকে নিবদ্ধ চোখ দু’টি তার হিংস্রতায় জ্বলছে। মাহমুদকে লক্ষ্য করে সে বলল, বেরিয়ে যা কুকুর, নইলে… উত্তেজনায় সে কথা শেষ করতে পারল না।
মাহমুদ এক নিমিষে লোকটির আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করে বুঝলো লোকটি তৃতীয় কোন অমানুষ। সে শান্ত কন্ঠে বলল, ‘বেরিয়ে যাব কিন্তু তোমাকে নিয়ে।’ লোকটি পকেটে হাত দিতে যাচ্ছিল। মাহমুদ এর অর্থ বুঝে। সে এক লাফে লোকটির নিকটবতী হল। লোকটি পকেট থেকে হাত বের করবার আগেই মাহমুদের প্রচন্ড একটি লাথি গিয়ে তার তলপেটে পড়ল। কোঁথ করে একটি শব্দ বেরুল লোকটির মুখ দিয়ে। তার সাথে গোটা দেহটি তার সামনের দিকে বেঁকে গেল। পর মুহুর্তে আর একটি প্রচন্ড ঘুষি গিয়ে পড়ল লোকটির চোয়ালে। এবার নিঃশব্দে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কর্ণেল মাহমুদ এতক্ষণ পরে প্রথমবারের মত মেয়েটির মুখের দিকে তাকাল। মেয়েটি ইতিমধ্যে পোশাক ঠিক করে নিয়েছে। অবিন্যস্ত স্বর্ণাভ চুল কপালের একাংশ ঢেকে রেখেছে। নীল চোখ দু’টি থেকে আতংকের ঘোর তখনও কাটেনি। ইহুদীদের স্বভাবজাত উন্নত নাসিকার নীচে পাতলা রক্তাভ ঠোঁট দু’টি তার কাঁপছে। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট লম্বা শ্বেত স্বর্ণাভ মেয়েটি অদ্ভুত সুন্দরী। মাহমুদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বাইরে পদশব্দ শুনে সে থেমে গেল। পকেট থেকে রিভলভার বের করে সে দ্রুত দরজার আড়ালে সরে গেল এবং ইঙ্গিতে সে মেয়েটিকে বসে পড়তে বলল, দরজার ফাঁক দিয়ে মাহমুদ দেখলো, দু’জন লোক ঘরের কিছুদূর সামনে দিয়ে সুইমিং পুলের পূর্ব পাশ দিয়ে ঘুরে আবার দক্ষিণ দিকে চলে গেল। মাহমুদ মনে মনে হাসল, সাইমুমের লোক যে ভিক্টোরী পার্কের বিশ্রামাগারে আশ্রয় নিয়ে মোসাদের লোকের হাতে পড়ার মত বোকামী করবে না – ইসরাইলী গোয়েন্দাদের এই স্বাভাবিক বিশ্বাসই তাকে আজ এক অঘটন থেকে বাঁচাল। কর্ণেল মাহমুদ ফিরে দাঁড়িয়ে মেয়েটিকে বলল, দেখনু আমি একটা এ্যাকসিডেন্ট করেছি, ‘পুলিশের লোক আমার পিছু নিয়েছে, আমাকে এখনই সরে পড়তে হবে। আপনি পুলিশের সাহায্যে বাড়ী ফিরতে পারেন।’ বলে মাহমুদ বাইরের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল।
মেয়েটি ডাকল,শুনুন।
মাহমুদ ফিরে দাঁড়াল। মেয়েটি বলল, বাগানে আমার গাড়ী আছে। চলুন গাড়ীতে যাবেন। মাহমুদ বলল, এখন এখান থেকে গাড়ীতে যাওয়া আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। তাহলে আমাকে পৌঁছে না দিয়ে আপনি যেতে পারেন কেমন করে? গাড়ী নিয়ে যাবেন, কোন বিপদ আপনার হবে না। কোন বিপদের ভয় না করেই তো হোটেল থেকে বাড়ীতে পথে বেরিয়ে ছিলাম, কিন্তু বিপদ তো হল। একটু থেমে মেয়েটি বলল,আমার সঙ্গে গাড়ীতে চুলন। আমি নিশ্চিত আশ্বাস দিতে পারি, পুলিশের লোক আমার গাড়ী সার্চ করবে না। দু’জন ঘর থেকে বেরুল। বাগানের এক অন্ধকার কোণে রাখা গাড়ী নিয়ে তারা খোলা গেট দিয়ে রাস্তায় বেরুল।
গাড়ী পূর্ণ গতিতে গোলান রোড ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে চলল। দু’জনেই চুপচাপ। মাহমুদ তখন অন্য চিন্তা করছে। তাকে দেওয়া চিরকুটটি সে এখন ও পড়তে পারেনি। তাতে জরুরী কোন নির্দেশ থাকলে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
গাড়ী চালানোর ফাঁকে মেয়েটি ইতিমধ্যে কয়েকবার মাহমুদের দিকে তাকিয়েছে। সুন্দর শান্ত দর্শন লোকটির অদ্ভুত বলিষ্ঠ গড়ন। ঐ শান্ত দর্শন দেহে যে অবিশ্বাস্য রকমের সাহস ও বিদ্যুৎ গতি রয়েছে, তা সে নিজ চোখেই দেখেছে। চোখ মুখ থেকে প্রতিভা তার যেন ঠিকরে পড়ছে। সবচেয়ে আশ্চর্য মাহমুদের নির্বিকার ভাব।
নির্জন রাজ পথের উপর দিয়ে তীর বেগে গাড়ী এগিয়ে যাচ্ছে। সামনে একটি মোড়। গাড়ী থামানোর লাল সংকেত জ্বলে উঠল। সাদা পোশাকধারী পুলিশ হাত উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। গাড়ী তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটি গাড়ী থেকে মুখ বের করল। সে কিছু বলার আগেই পুলিশ স্যালূট দিয়ে গাড়ীর সামনে থেকে সরে দাঁড়াল। গাড়ী আবার ছুটে চলল। মেয়েটি এবার মুখে একটু হাসি টেনে কর্ণেল মাহমুদের দিকে চেয়ে বলল, কেমন ভয় পাননি তো?
মাহমুদ বুঝলো মেয়েটি সরকারী মহলে শুধু সুপরিচিতাই নয়, সম্মানিতাও। উত্তরে বলল, বেকায়াদায় পড়লে ভয় না পায় কে?
মাহমুদ আবার চুপচাপ। গড়ীর বাইরে আলো আঁধারের খেলা। নির্জন রাতের নিঃশব্দ পরিবেশের মধ্যে মৃদু স্পন্দন তুলে এগিয়ে চলছে গাড়ী। মেয়েটি স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে সামনে তাকিয়ে আছে। মনে তার চিন্তার ঝড় পাশে বসা এই লোকটি কে? টাকা, প্রশংসা ও সুন্দরী নারীদেহের প্রতি লোভ মানুষের চিরন্তন। এই লোকটি কি সব কিছুর উর্ধ্বে? এতক্ষণের মধ্যে লোকটি তার পরিচয় এমন কি নামটি পর্যন্ত জিজ্ঞেস করেনি। ডেভিড বেনগুরিয়ানের সুন্দরী মেয়ে এমিলিয়া কোন যুবকের মনে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে না – এমন কথা অবিশ্বাস্য। শুনেছি, অর্থ সুনাম ও নারীদেহের মোহ যে কাটিয়ে উঠতে পারে, সে লোক অতি মানব। মেয়েটি আবার মাহমুদের দিকে তাকায়। সেই প্রশান্ত মুখ, সামনে প্রসারিত সেই অচঞ্চল দৃষ্টি।
গাড়ী এসে এক বিরাট প্রাসাদ তুল্য বাড়ীর ফটকে দাঁড়াল। বাড়ী দেখে মাহমুদ চমকে উঠল। এ যে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এবং ইসরাইলী রাষ্ট্রের অন্যতম কর্ণধার ডেভিড বেনগুরিয়ানের বাড়ী। মেয়েটি সাম্পর্কে মাহমুদের মনে নতুন আগ্রহের সৃষ্টি হল। মুহুর্তের জন্য মেয়েটির দিকে মাহমুদ তার চোখ দু’টি তুলে ধরল। মেয়েটি কি তাহলে ডেভিড বেনগুরিয়ানের কেউ? সরকারী মহলে সম্মানিতা হবার কারণ তাহলে কি এইটিই? মাহমুদকে তাকাতে দেখে মেয়েটি বলল, বাড়ী এসে গেছি?
বাড়ীর ফটক খুলে গেল। মাহমুদ কিছু বলার আগেই ছুটে গিয়ে গাড়ী বারান্দায় দাঁড়াল।
মেয়েটি গাড়ী থেকে নেমেই গাড়ীর পাশ ঘুরে এসে দরজা খুলে দিল।
মাহমুদ গাড়ী থেকে বেরিয়ে মেয়েটির দিকে আর এক পলক তাকিয়ে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, এবার আসি।
মাহমুদ যাবার উদ্যোগ করতেই মেয়েটি পথ আগলে দাঁড়িয়ে বলল, দয়া করে একটু বসবেন, অন্ততঃ এক কাপ চা খাবেন চলুন। আমার জরুরী কাজ আছে, ক্ষমা করুন আমাকে। বলল মাহমুদ।
মেয়েটি এক মুহূর্ত থামল। তারপর ধীরে গম্ভির কন্ঠে বলল, আপনি যে উপকার আমার করেছেন সে ঋণ অপরিশোধ্য। কৃতজ্ঞতা প্রকাশের … মাহমুদ বাধা দিয়ে বলল, মানুষের প্রতি মানুষের যে দায়িত্ব, তার বেশিকিছু আমি করিনি। বলেই মাহমুদ গেটের দিকে পা বাড়াল।
– শুনুন, আপনার পরিচয় দয়া করে কি বলবেন? মেয়েটির কন্ঠে এবার অনুনয়ের সুর।
মাহমুদ ফিরে দাঁড়িয়ে একটু হেসে বলল, আমরা সামান্য ব্যক্তি, দিবার মত কোন পরিচয় আমাদের নেই। তবে বেঁচে থাকলে দেখা হবে, এখন আসি।
ডেভিড বেনগুরিয়ানের গেট পেরুবার আগেই মাহমুদ একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ১ টা। মাহমুদের মন আনচান করে উঠল। কিছুক্ষণ আগের পাওয়া চিঠিটি তার এখনও পড়া হয়নি। জরুরী কোন সংবাদ বা নির্দেশ তাতে থাকতে পারে। চলতে চলতেই মাহমুদ বাম পকেট থেকে চিঠিটি বের করে একবার তাতে চোখ বলাল। সাইমুমের সাংকেতিক অহ্মরে লেখাঃ
“আগামী সতের তারিখে ওসেয়ান কিং জাহাজে ইসরাইলের জন্য ইউরেনিয়াম, হেভিওয়াটার ও অন্যান্য আনবিক গবেষণার বহু মূল্যবান মাল মসলা আসছে। জাহাজটি রাত নয়টায় জাফা বন্দরে ভিড়বে। রাত এগারটায় জাহাজে প্রীতিভোজের অনুষ্ঠান।’’
চিঠি পড়ে মাহমুদ মনে মনে তারিখ গুনল। আজ পনের তারিখ, হাতে সময় মাত্র দু’দিন। মাহমুদ গেটে আসতেই গেটম্যান গেট খুলে দিয়ে স্যালুট করে দাঁড়াল।
৫
সূর্য তখনো উঠেনি। রক্তিম পূর্বাকাশ। মাহমুদ কোরআন পড়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর ড্রেসিং রুমে প্রবেশ করে, কিছুক্ষণ পর ধনী ইহুদী ব্যবসায়ীর সাজ পরে বেরিয়ে এল এবং পশ্চিমের ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
জাফা বন্দরে মাহমুদের এটি একটি নতুন আস্তানা ভূমধ্যসাগরের তীরে পাঁচতলা এই বাড়ী। ইজি চেয়ারে অর্ধশায়ীত মাহমুদ পলকহীন দৃষ্টিতে ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশির দিকে চেয়ে ছিল। দূরে পশ্চিম দিগন্তে একটি জাহাজের চিমনি দেখা যাচ্ছিল। ধীরে ধীরে পশ্চিম দিগন্তে তা মিলিয়ে গেল। জাহাজটির সাথে যেন মাহমুদের মনটিও ছুটে গেল দীগন্ত পেরিয়ে জীব্রালটার অতিক্রম করে। জিব্রালটার – জাবালুৎ তারিকের কথা মনে পড়তেই মাহমুদের মন ছুটে গেল চৌদ্দ শ’ বছর আগের একটি ঘটনার দিকে। সিপাহসালার তারিক সাতশ’ সৈন্য নিয়ে শত্রু অধ্যুষিত স্পেনের মাটিতে নামলেন। তারপর পুড়িয়ে দিলেন ফেরবার একমাত্র উপায় নৌযানগুলো। তাদের সামনে রইল সুসজ্জিত অগণিত শত্রু সৈন্য আর পেছনে তরঙ্গ – বিক্ষুব্ধ সমুদ্র। আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় সম্পর্কে কি দৃঢ় প্রত্যয়। মুসলিম সিপাহসালার তারিকের এ আত্মপ্রত্যয় অবাস্তব ছিল না। শীঘ্রই সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক মুসলমানদের হেলালী নিশান স্পেনের সীমানা পেরিয়ে ফ্রান্সের প্রান্তদেশ পারেনিজ পর্বতমালার বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ইসলামের জয় বার্তা ঘোষনা করল। শুধু কি তাই? মুসা আর তারিককে যদি দামেস্কের দরবারে ফিরিয়ে না আনা হতো, তাহলে ‘ওয়াশিংটন আরভিং এর ভাষায়, ‘‘আজ প্যারিস ও লন্ডনের গীর্জাসমূহে ক্রসের বদলে হেলালী নিশানই শোভা পেত।’’ এই ভূমধ্যসাগরের প্রতিটি ইঞ্চি স্থানে একদিন মুসলমানদেরই হুকুম চলত। কিন্তু আজ? মাহমুদের মন বেদনায় ভরে যায়, যে স্পেনকে মুসলমানরা আট শত বছর ধরে গড়ে তুলল আপন করে, সেই স্পেনে আজ মুসলমানদের সাক্ষাত মিলে না। তারা বিধ্বস্ত ও বিতাড়িত। কিন্তু কেন এই পতন? ইতিহাস মুসলমানদের দুর্বলতা আত্মকলহকেই এর জন্য দায়ী করেছে। কিন্তু এই আত্মকলহ আর দুর্বলতা এল কোত্থেকে? সে কি আদর্শচ্যুতি থেকে নয়? মাহমুদের মনে পড়ে যায় একজন লেখকের কথা, ‘‘মুসলমানরা আপন উসূল এবং ইসলামী জোশ হতে যখন দূরে সরে পড়ল, তখন খোদা তাদের এ নিয়ামত কেড়ে নিলেন। এরই ফলে আবার একদিন খৃষ্টান শক্তি সেই বিজয়ী মুসলমানদের উত্তরাধিকারীদেরকে এসব দেশ হতে এমনই ভবে বের করে দিল যে, সে সব দেশের মুসলমানদের নামের আর কোন চিহ্নই থাকল না।’’ পূর্বসুরীদের ভুল কি আমরা শুধরে উঠতে পেরেছি? মাহমুদ ভেবে চলে। যদি পারতাম, তাহলে ক্ষুদ্র ইসরাইলের হাতে এমন করে আমরা মার খাব কেন? আফ্রিকা আর এশিয়ার বিভিন্ন দেশে মুসলমানরা এমনই করে নির্যাতীতই বা হতে থাকবে কেন? মধ্য এশিয়া, ফিলিপাইন, সাইপ্রাস, ইরিত্রিয়া, চাঁদ, নাইজেরিয়া, মোজাম্বিক প্রভৃতি দেশের মজলুম মানুষের আমানুষিক দুর্দশা মাহমুদের মনকে ভারি করে তুলে। প্রশ্ন জাগে তার মনে, এদের মুক্তি কত দূরে? মুসলিম তরুণরা কি জাগবে না? তারা কি এগিয়ে আসবে না মজলুম মানুষের মুক্তির জন্য? আমাদের চেষ্টা কি বৃথা যাবে?
এই সময় ধীর পায়ে নাস্তা নিয়ে সেখানে প্রবেশ করল আফজল। আফজল এই বাড়ীর প্রহরী, দারোয়ান, রাধুনী, পরিবেশক সবকিছু। পায়ের শব্দে মাহমুদের চিন্তা সূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। মাহমুদ পিছনে ফিরে আফজলকে দেখে মৃদু হেসে বলল, আজকে নাস্তা খুব সকাল সকাল মনে হচ্ছে না?
-সকালেই তো জনাবের কোথাও বেরুবার কথা ছিল।
মাহমুদের মনে পড়ে গেল, আগামীকালের ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের প্রোগ্রামের ব্যাপারে অনেক কাজ আছে বাইরে। যেমন করে হোক সহজ উপায়ে ওসেয়ান কিং জাহাজের ভোজসভায় প্রবেশের একটি পথ করে নিতেই হবে। গভীর রাত পর্যন্ত মাহমুদ এইবষয় নিয়ে চিন্তা করছে, কোন সহজ পথ সে খুঁজে পায়নি। হঠাৎ এ সময় এমিলিয়ার কতা মনে পড়ে গেল মাহমুদের। ওসেয়ান কিঙ জাহাজের প্রীতিভোজে কাদের নিমন্ত্রণ করা হবে? সে প্রীতিভোজ থেকে ডেভিড বেনগুরিয়ানের পরিবার কি বাদ পড়তে পারে? মাহামুদের মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। নাস্তা শেষ করে মাহমুদ আফজলকে বলল, এখন আর বাইরে যাচ্ছি না, তুমি ডিকশনারীটা বের কর। ডিকশনারী ডসিয়ারের ছদ্মনাম। নাস্তা শেষ করে রুমালে মুখ মুছতে মুছতে সে উঠে দাঁড়াল। প্রবেশ করল তার ষ্টাডি রূমে।
ডসিয়ারের পাতা উলটিয়ে বের করল এমিলিয়ার নাম। তার পুরো নাম ‘পলিন ফ্রেডম্যান’ এমিলিয়ার অভ্যেস আচরণ সম্পর্কে বিবরণীকার লিখেছেন, উঁচু মহলে অবাধ গতি। অত্যন্ত মিশুক। কিন্তু আত্মমর্যাদা সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতেন। মুক্তি ও সৌন্দর্যের পূজারী। গোঁড়া জাতীয়তাবাদীদের সাথে তার কোন মিল নেই। … হোটেল বারগুলো তার কাছে ড্রইং রুমের মতো। সাগর বেলার দি মিষ্টী হোটেলে তাকে রাত ৯ টার পরে প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায় ’’।
মাহমুদ ডসিয়ারের পাতা বন্ধ করল। মনে মনে বলল, খোদা সহায় হলে আজ দি মিষ্টীতে আবার এমিলিয়ার সাথে দেখা হবে। রাত ন’টা। দি মিষ্টী’র বলরুম। বিরাট হলঘর। অর্ধেক চেয়ার টেবিল এখনও খালি পড়ে আছে। দরজা থেকে পরিস্কার চোখে পড়ে এমন একটি চেয়ারে মাহমুদ বসে আছে। এমিলিয়া তখনো আসেনি। মাহমুদের স্বভাব শান্ত মনে কোন চাঞ্চল্য নেই বটে, কিন্তু মনে তার প্রশ্ন জাগছে, সে আসবে কি?
অবশেষে পরম লগ্নটি এল। বলরুমের দরজায় এসে মুহূর্তের জন্য দাঁড়াল এমিলিয়া। লাল পোশাকে এমিলিয়াকে অদ্ভুত সুন্দরী মনে হচ্ছে। মাহমুদ চোখ সরিয়ে নিল। ইচ্ছা মাহমুদের আগ্রহ যাতে প্রকাশ না হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পরে চোখ তুলে মাহমুদ দেখল, কয়েক টেবিল সামনে একটি খালি টেবিলে এমিলিয়া এসে বসেছে। এমিলিয়ার দিকে তাকাতে গিয়ে হঠাৎ তার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। চোখাচোখি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্প্রিং এর মতো এমিলিয়া উঠে দাঁড়াল। মাহমুদ ঈষৎ হেসে উঠে দাঁড়াল। এমিলিয়া মাহমুদের পাশে এসে বলল কেমন আছেন? আপনাকে দেখে যে কতো খুশি হয়েছি তা বোঝাতে পাবো না। বলে মাহমুদের সামনের চেয়ারে এমিলিয়া বসে পড়ল। বলল, আপনার টেবিলে একটু বসতে পারি?
-এ ধরনের বৃটিশ এটিকেট কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে খুবই খারাপ, অভদ্রতা সূচক।
-যেমন? এমিলিয়া ঈষৎ হেসে বলল।
-যেমন আমাদের এই ক্ষেত্রে। ‘আপনার টেবিলে কি একটু বসতে পারি’ বললে কি আপনি খুশি হতেন? বিশেষ করে সম্পর্ক যেখানে ঘণিষ্ঠতর সেখানে … … মৃদু হেসে কথা অসম্পূর্ণ রেখে মাহমুদ চুপ করল।
-সত্যই তাই। এ ধরনের ফর্মালিটি আমার কাছে খুবই পীড়াদায়ক। একটু থেমে এমিলিয়া বলল, কি অর্ডার দেব বলুন, হুইস্কি, জিন, ভারমুখ।
-আমি মদ খাই না।
-সত্যি? বলে বিস্ময়ের সাখে মাহমুদের দিকে চোখ তুলল এমিলিয়া।
-সত্যি। আপনার নিশ্চয় অসুবিধা করলাম।
-অসুবিধা নয়। কিন্তু আমি অবাক হচ্ছি। এই সমাজে এটা কম বিস্ময়ের কথা নয়। বলে এমিলিয়া ওয়েটারকে ডেকে দু’বোতল কোকা কোলার অর্ডার দিল। মনে হল পরিচিত ওয়েটার কিছুটা বিস্মিত হলো। ওয়েটার চলে গেলে মাহমুদ বলল, ‘বোধ হয় আজকের সন্ধ্যা আপনার আমি নষ্ট করলাম।’
-কৃত্রিম আনন্দের উৎসের চেয়ে অকৃত্রিম আনন্দের উৎসই কি বেশী সুখকর নয়? মুখ টিপে হেসে বলল এমিলিয়া।
-উৎসটি যদি অকৃত্রিম হয় তবেই।
-উৎসটিতে যেহেতু কৃত্রিমতা নেই, তাই ওকথা নিঃসন্দেহেই বলা যায়।
-না পরখ করেই কি এত বড় সার্টিফিকেট দেয়া চলে
-পরখ করতে কত সময় লাগে বলুন?
ইতিমধ্যে ওয়েটার দু’বোতল কোকো কোলা এনে দিল। কোকা কোলা পান করতে করতে তাদের অনেক আলাপ হলো মাহমুদ অনুভব করল, মেয়েটির মধ্যে তীব্র আকর্ষণী শক্তি রয়েছে, আর রয়েছে মানুষকে আপন করে নেবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা। মাহমুদের মনে পড়েছে ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের অনুষ্ঠানের কথা কিন্তু প্রাসঙ্গিক কোন আলোচনা না তুলে তা জেনে নেয়া যাবে না। কিন্তু এসব কিছুর পূর্বে মেয়েটির সাথে আরো কিছু ঘনিষ্ঠতর হতে হবে।
মাহমুদরা ঠান্ডা পানীয় ছাড়া আর কিছুই খেল না। জিন, হুইস্কি, ভারমুখ প্রভৃতি বিভিন্ন রকমের দামী মদের ফেনিল উচ্ছ্বাসে তখন হল ঘরটি পূর্ণ। প্রায় প্রতিটি টেবিলেই একটি যুগল মুখোমুখি। তাদের প্রকৃত সম্পর্ক কি, তা করো জানার উপায় নেই। কিন্তু যে সম্পর্কই থাক, আজ এ হল ঘরে এ চত্তরে এক সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা। তাদের ইচ্ছার সামনে বাধ সাধবার কেউ নেই। ঐ যে সামনের শ্বেতাংগ তরুণ যুগলটি। শ্বেতাংগিণীর ঠোঁটের লিপষ্টিক শ্বেতাংগটির ঠোঁটকে ও রঞ্জিত করেছে। প্রত্যেকের চোখেই আদিম নেশা।
এমিলিয়া বলল, এমন সুস্থ চোখে কখনো কোন দিন আমি হল ঘরের এ পরিবেশকে দেখিনি। মদ আমাকে মাতাল করে না বটে, কিন্তু নেশায় কাতিয়ে দেয়।
এই সময় হলের উজ্জ্বল আলো নিভে গিয়ে ম্লান নিলাভ আলোতে ভরে গেল হল ঘরটি। হলের কোণের ষ্টেজ থেকে ইংরেজী সুরে বাজনা বেজে উঠল। প্রতিটি যুগল হাত ধরাধরি করে উঠে নাচের জন্য হলের মাঝখানে গিয়ে জমা হতে এমিলিয়া তার ডান হাত মাহমুদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, চলুন।
মাহমুদ এমিলিয়ার হাত ধরে উঠে ধরে উঠে দাঁড়াল। এই স্পর্শের জন্যই হোক বা মাহমুদের নৈতিকতা বোধে আঘাত লাগার জন্যই হোক মাহমুদের হাত যেন কেমন কেঁপে উঠল। এই কম্পনই এমিলিয়ার মধ্যে সংক্রামিত হলো। তার দেহের জাগল শিহরণ। মাহমুদের দিকে চেয়ে মুখ টিপে একটু হাসল এমিলিয়া।
নাচ শুরু হল। নেচে চলছে সবাই। মাহমুদরাও নাচছে। এমিলিয়ার তপ্ত নিঃশ্বাস মাহমুদের গলায় এসে লাগছে। দু’টি দেহের মধ্যে যে ব্যবধান, তা বেশী কিছু নয় মোটেই। দু’জনেই দু’জনের দেহের উত্তাপ অনুভব করতে পারে। আর মানুষ যদি ফেরেশতা না হয়, তাহলে এ উত্তাপ নারী পুরুষের হৃদয়ে রোমাঞ্চ জাগাবেই। মাহমুদ জানে, মানুষ মানুষই, ফেরেশতা নয়। এ কারণেই আল্লাহ স্বামী-স্ত্রী ছাড়া অন্য নারী পুরুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও মেলামেশার একটি সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। সীমারেখাতিক্রম করলে সামাজিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে। মদের টেবিল আর এই বল নাচের মঞ্চ কত স্বামী স্ত্রীর বিচ্ছেদ এবং কত কুমারীর কুমারীত্বের অপকৃত্যুর যে উৎস তার ইয়ত্তা নেই। তবুও এটা চলছে চলবে। মাহমুদের চিন্তা স্রোতে বাধা পড়ল। এমিলিয়া ফিস ফিস করে বলল, তোমাকে কেমন উদাসীন দেখাচ্ছে। কিছু ভাবছ? ভালো লাগছে না বুঝি?
মাহমুদ এমিলিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল, ভাবছি আজকে আমিই বোধ হয় সবচেয়ে বেশী ভাগ্যবান।
-কেন?
-ডেভিড বেনগুরিয়ানের নাতনী এমিলিয়াকে আমার চেয়ে নিবিড় করে কে পেয়েছে আজ? এমিলিয়া মাহমুদের কাঁধে মৃদু চাপ দিয়ে বলল, কথাটা কিন্তু সৌজন্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল।
-মাফ চাচ্ছি।
-মাফ চাইলেই বুঝি কথা উঠে গেল?
-তাহলে কি করব?
-কিছু করার দরকার … এমিলিয়ার কথা শেষ হলো না। বিজলি বাতি নেভে গেল। হল ভরে গেল নিকষ কালো অন্ধকারে। মাহমুদরা থেমে গেছে। বাজনা কিন্তু তখনো বেজে চলেছে। বোঝা গেল এ আলো নিভে যাওয়া অস্বাভাবিক।
পরমুহূর্তেই ঘোষকের কণ্ঠ শোনা গেলঃ ভদ্র মহিলা ও ভদ্র মহোদয়গণ, আমরা দুঃখিত যে, যান্ত্রিক গেলিযোগের জন্য আলো নিভে গেছে, এক মিনিটের মধ্যেই আলো ব্যবস্থা হচ্ছে। মনোযোগ নিজের দিকে কেন্দ্রীভূত হতেই মাহমুদ অনুভব করল, এমিলিয়া মাহমুদের বুকে মুখ গুঁজে রয়েছে এবং দু’হাতে জড়িয়ে ধরেছে তাকে। মাহমুদ তার অভিনয়ের এ পর্যায়ে এসে কেঁপে উঠল অপরাধ বোধের এক তীব্র খেলায়।
কট করে একটি শব্দ হল, তারপর আলো জ্বলে উঠল আবার। এমিলিয়া আগেই সরে দাঁড়িয়েছিল। মুখ তার আনত, আরক্ত। কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিল। মুখ তুলে হেসে মাহমুদকে বলল, চলুন এবার যাওয়া যাক।
দু’জন হাত ধরাধরি করে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল। মাহমুদের হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল এমিলিয়া, কোলাহল ভাল লাগছে না, চলুন পার্কে যাই।
-কোন পার্ক?
-ভিক্টোরিয়া।
গাড়ীতে উঠে মাহমুদ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ী ষ্টার্ট দিতে দিতে বলল –
পার্কটা বড় কুলক্ষণে। এমিলিয়া মাহমুদের কাছে সরে এসে তার কাঁধে মাথাটি হেলান দিয়ে বলল, কিন্তু ঐ পার্কটিতেই তোমার সাথে আমার সাক্ষাত!
-তা বঠে। মাহমুদ অনুচ্চ সুরে বলল। তার মনে তখনো ঝড়। ওসেয়ান কিং জাহাজে যাবার উপায় কি? এমিলিয়ারা কি আমন্ত্রিত সেখানে? ওদের সাথে ওখানে প্রবেশের কোন পথ করা যায়? পার্কে এসে তারা একটি ছায়া ঘেরা জায়গা দেখে বসে পড়ল। আকাশে তখন নবমীর চাঁদ। সামনের গাছটিকে আলোকিত করেছে। মাহমুদের কোলে মাথা রেখে এমিলিয়া শুয়ে পড়েছে। মাহমুদের একটি হাত এমিলিয়ার দু’হাতের মুঠোয়।
ধীরে ধীরে এমিলিয়া বলল, দানিয়েল। তুমি হয়তো ভাবছ মেয়েটি কি নির্লজ্জ। কিন্তু বিশ্বাস করো তুমি, তুমি আমাকে মাতাল করেছ। মদও কোনদিন আমার আমিত্বকে এমন করে কেড়ে নিতে পারেনি। বল নাচে অংশ নিয়েছি অসংখ্যবার, কিন্তু কোন পুরুষ আমাকে তার বুকে টানতে পারেনি। তুমি কি যাদু জান দানিয়েল?
-যাদু নয় এমিলিয়া, নারী পুরুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ। বলল মাহমুদ।
-আমি এটা মানিনা পুরুষের সাথে অনেক মিশেছি। কিন্তু এমনতো হয়নি। প্রথম সাক্ষাতের দিন থেকেই আমি বারবার হারিয়ে ফেলছি নিজেকে।
-এটা হয়তো স্রষ্টার ইচ্ছা এমিলিয়া। বলে কিন্তু মাহমুদ নিজেই চমকে উঠল? একি, এমিলিয়ার জীবনের সাথে সে কি তাহলে জড়িয়ে যাচ্ছে না? চাঁদ আর একটু পশ্চিমে সরে গেল। চাঁদের যে আলোটুকু ছিলো, তা সরে গেল। যতই সময় যাচ্ছে মাহমুদের মন উদ্বেগে ভরে ইঠছে ওসেয়ান কিং জাহাজের ব্যাপারটা নিয়ে। কিভাবে সে কথাটা তুলতে পারে? হঠাৎ মাথায় তার একটা বুদ্ধি খেলে গেল। মাহমুদ কোল থেকে এমিলিয়ার মাথা তুলে নিল। বলল, কাল রাত্রের খানা আমার ওখানে খাবে এমিলিয়া?
-তুমি বললে যাবো অবশ্যই। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় একটি পার্টি আছে, আব্বা কাল সকালে বিলেতে যাচ্ছেন বলে তিনি যেতে পারছেন না। তাই আমার যাওয়া সেখানে জরুরী ছিল।
মাহমুদ বলল -কোথায় পার্টি জানতে পারি কি?
-নিশ্চয়ই, ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজে। তুমি বরং চল না দানিয়েল সেখানে আমার সাথে?
-মাহমুদের গোটা শরীর শীর শীর করে উঠল। মনে মনে আলহামদু লিল্লাহ উচ্চারণ করল। মুখে বলল, আমি কি সেখানে অনাহূত হব না?
-নিশ্চয় না। আব্বা যাচ্ছেন না, মা অসুস্থ। আমি ইচ্ছামত সাথী নিতে পারি। নিমন্ত্রণ পত্রও আছে সে রকম। মাহমুদ মুখটি একটু নিচু করে বলল, ঠিক আছে আমার আপত্তি নেই। এমিলিয়া? কিন্তু আমার ওখানে যাচ্ছ কবে তুমি?
-এমিলিয়া মুখটি উঁচু করল। এমিলিয়ার ঈষৎ কম্পনরত ঠোঁট দু’টি মাহমুদের মুখের কাছাকাছি এল। মাহমুদ মুখ উঁচু করল। এমিলিয়া তার মুখটি আবার নামিয়ে নিয়ে বলল, আমি যত কাছে আসছি তুমি তত সরে যাচ্ছ দূরে।
-আরো কাছে টানতে চাই হয়তো। বলল মাহমুদ।
-আমি জানি দানিয়েল, বুঝি। কিন্তু তোমার চরিত্রের এ পবিত্রতাই আমাকে মুগ্ধ করেছে সবচেয়ে বেশী। এমিলিয়ার কথাগুলি গম্ভীর। দূরের কোন পেটা ঘড়িতে ১২টা বেজে গেল। মাহমুদ বলল, চল আজ উঠা যাক। দু’জনই উঠে দাঁড়াল। এক ঝলক দমকা বাতাস এসে ঝাউ গাছে শোঁ শোঁ শব্দ তুলল। চারিদিক নিঝুম নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে নিঃশব্দে ছুটে চলা মোটর কারের ভেঁপুর নীরবতার মাঝে কম্পন তুলছে শুধু। মাহমুদরা হাত ধরাধরি করে বেরিয়ে এল পার্ক থেকে।
৬
গভীর রাত। মাহমুদ তখনো তার টেবিলে বসে। চারিদিক নিঝুম -নিস্তব্ধ। রাস্তার বিজলি বাতিগুলি চাঁদের আলোয় ফিকে মনে হচ্ছে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। দূরে ভূমধ্যসাগরের জলরাশির উপর চাঁদের এক মায়া রাজ্যের সৃষ্টি করেছে। মাহমুদ সেদিকে তাকিয়ে আছে ঠিকই কিন্তু মনে তার চিন্তার ঝড়। সে মনে মনে ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের দৃশ্যটা কল্পনা করে নেয়। কাপ্তান কক্ষ, ইঞ্জিন রুম, ফুয়েল ট্যাঙ্ক, বহনকৃত মালপত্রের সেল, ষ্টাফদের কক্ষ, প্রশস্ত উন্মুক্ত ডেক প্রভৃতি নিয়ে জাহাজ। জাহাজটি ধ্বংস করার জন্য ফুয়েল ট্যাঙ্কে বিষ্ফোরণ ঘটাতে হবে। ইউরেনিয়াম ও আণবিক গবেষণার অন্যান্য মাল-মসলা যাতে সরিয়ে নেবার কোন সুযোগ না পায় সেজন্য সেখানেও দ্রুত আগুন ধরাবার ব্যবস্থা করতে হবে। এবং এসব কাজ অবশ্যই জাহাজে পৌঁছার পর ভোজ অনুষ্ঠানের আগেই সম্পন্ন করতে হবে। পরিকল্পিত সময়ে বিষ্ফোরণের জন্য ডেজিচেইনের ব্যবহারই উপযুক্ত বিবেচনা করল সে। ডেজিচেইনের একপ্রান্তে জুড়ে দেয়া যাবে ডেটানেটর। ডেটোনেটরের সাথে ইচ্ছামত সময়ের টাইম ইগনেটর ব্যবহার করা যায়। সেফটীপিন তুলে নেবার পর টাইম ইগনেটরে নির্দিষ্ট সময়ে বিষ্ফোরণ ঘটে থাকে। মাহমুদ চিন্তা করল, ১১টা ভোজ, ১২টা বাজার আগে নিশ্চয়ই তা শেষ হয়ে যাবে। সোয়া বারটায় বিষ্ফোরণ ঘটাতে চাইলে ২ ঘন্টা সময়ের টাইম ইগনেটার ব্যবহার করলেই চলতে পারে। কিন্তু সে আবার ভাবল, ডেজিচেইন পাততে গিয়ে যদি বাধা কিংবা অস্বাভাবিক কিছুর মোকাবিলা করতে হয়, তাহলে দু’ঘন্টা পর্যন্ত ডেজিচেইন পেতে রাখা নিরাপদ হবে না, কারণ এ সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান হতে পারে এবং ডেজিচেইন তাদের চোখে পড়ে যেতে পারে।
সুতরাং সিদ্ধান্ত নিল, ১১টা থেকে ১১ -১৫ মিনিটের মধ্যেই বিষ্ফোরণ ঘটাতে হবে। এতে অবশ্য ঝুঁকি আছে। তার এবং এমিলিয়ার নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে। এ ঝুঁকি তবু নিতে হবে।
‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের ডেকে যখন মাহমুদরা পা রাখল, তখন ১০টা বেজে ২৯ মিনিট হয়েছে। আজকের এ প্রীতি ভোজ ইসরাইলী স্বরাষ্ট্র বিভাগ কর্তৃক ইসরাইলী পারমাণু বিজ্ঞানী এবং ইসরাইলের জন্য আণবিক গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ মালমসলা ও যন্ত্রপাতি বহনকারী ওসেয়ান কিং জাহাজের ক্যাপটেন ক্রুদের সম্মানে আয়োজিত। অবশ্য এ ভোজ এমিলিয়াদের মত বাছাই করা কিছু অতিথিদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।
জাহাজে উঠবার সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে ইসরাইলী স্বরাষ্ট্র বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মচারী ও জাহাজের ক্যাপটেন অতিথিদের সম্ভাষণ জানাচ্ছেন। মাহমুদ ও এমিলিয়া ওদের সাথে করমর্দন করে উপরে উঠে গেল। মাহমুদ লক্ষ্য করল, স্বরাষ্ট্র বিভাগীয় অফিসার মিঃ গ্রিনবার্জ ও ক্যাপ্টেন মিঃ আদ্রে সাইমনের পিছনে আর একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। তিনি হলেন ইসরাইলী আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিভাগ ‘সিন বেথের’ সহকারী পরিচালক মিঃ হফম্যান। মাহমুদের ছোঁটের কোণে এক টুকরো বাঁকা হাসি খেলে গেলে।
টেবিল আর চেয়ার দিয়ে সুন্দর করে ডেক সাজানো হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিদের অনেকেই এসে গেছেন। কেউ কেউ জাহাজের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে চন্দ্রালোকিত সাগরের শোভা দেখছেন। আর অবশিষ্টরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বসে জটলা করছেন। মাহমুদ এমিলিয়াকে নিয়ে গোটা ডেকটা একবার চক্কর দিলো। সশস্ত্র কোন প্রহরীকে উপরে দেখা গেল না। মাহমুদ ভবল, নিশ্চয় তাহলে ভিতরে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ সময় মাহমুদ লক্ষ্য করল একটি প্লেটে To Lavatory লিখে জাহাজের অভ্যন্তরে নামবার সিঁড়ির দিকে তীর এঁকে দেয়া হয়েছে। মাহমুদের মুখ খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে এমিলিয়াকে নিয়ে জাহাজের সামনের প্রান্তে রেলিং এর পার্শ্বস্থিত একটি চেয়ারে এসে বসল। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল ১০ টা ৩২ মিনিট বেজে গেছে। মাহমুদ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, বাথরুম থেকে একটু আসি।
মাহমুদের পরনে চকলেট সুট। পায়ে ক্রেপসু। মাহমুদ সিঁড়ি দিয়ে ডেক থেকে নিচে নেমে এল। ভিতরে কিন্তু বাইরের মত উজ্জ্বল আলো নেই। মাহমুদ সিঁড়ি থেকে নেমে যেখানে এসে দাঁড়াল, সেখান থেকে জাহাজ লম্বালম্বি দীর্ঘ করিডোর, দু’পাশে কেবিন-কার্গো কেবিন। মাহমুদ করিডোরে দাঁড়াতেই একজন ষ্টেনগানধারী প্রহরী মাহমেুদকে জিজ্ঞাসা করল -ল্যাভেটরী স্যার?
-হাঁ। মাহমুদ বলল।
-আসুন। বামে কয়েক পা এগিয়ে একটি বন্ধ ঘর দেখিয়ে দিল। মাহমুদ হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলল। তারপর পিছন ফিরে দেখল, প্রহরীটি পিছন ফিরে কয়েক পা এগিয়েছে। মাহমুদ দেখল, করিডোরে আর কেউ নেই। তারপর পকেট থেকে একটি রুমাল ও শিশি বের করে বিড়ালের মত নিঃশব্দ পায়ে প্রহরীর দেক এগুতে লাগল। নিকটবর্তী হয়ে অত্যন্ত দ্রুত বাম হাত দিয়ে লোকটির কন্ঠনালি চেপে ধরল, অন্য হাতে ক্লোরোফরম সিক্ত রুমালটি লোকটির নাকে চেপে রাখল। কয়েকবার কোক কোক শব্দ করার পর তার দেহটি নিস্তেজ হয়ে এল। ষ্টেনগানটি হাত থেকে পড়ে গিয়ে ঠক করে একটি শব্দ হল। মাহমুদ তার দেহটি টেনে নিয়ে গিয়ে ল্যাভেটরী ও কার্গো কেবিনের মাঝের সরু গলির মধ্যে রেখে দিল। স্থানটি একটু অন্ধকার। সেখানে একটি সোফাও দেখল মাহমুদ। বুঝল প্রহরীরা এখানে বসে বিশ্রাম নেয়।
মাহমুদের হাতে সাইলেন্সার লাগানো নিভলবার। মাহমুদ ইঞ্জিন রুমের সিঁড়িতে পা রাখতে যাবে, এমন সময় পেছন থেকে শব্দ ভেসে এল, ‘হ্যাঁন্ডস আপ’।
মাহমুদ হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল। মাহমুদ তার পিঠে রিভলভারের ভারী স্পর্শ অনুভব করল। মাহমুদ আশু কর্তব্য ভেবে নিল, তারপর এক ঝটকায় বসে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গেই পিছনে দাঁড়ানো লোকটির দু’টি পা ধরে সামনে মারল হেচকা টান। লোকটি কাত হয়ে পড়ে গেল। রিভলভার ও ছিটকে গেল তার হাত থেকে। বজ্র মুষ্টিতে চেপে ধরল কণ্ঠনালি। মাত্র কয়েক মুহূর্ত। তারপর নিস্তেজ হয়ে এলো লোকটির দেহ। মাহমুদ তাড়াতাড়ি লোকটিকে টেনে এনে ইঞ্জিন রুমের এক কোণে গুঁজে রেখে দিল। লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে মাহমুদ চমকে উঠল। একি? মিঃ হফম্যান? উজ্জ্বল হাসিতে মাহমুদের মুখ ভরে গেল। অগণিত মুসলিম বাস্ত্তত্যাগী আর বহু সাইমুম কর্মীর রক্তে রঞ্জিত ইসরাইলী গোয়েন্দা এই হফম্যানের হাত। এতদিনে সব লীলা অবসান হলো শয়তানের।
মাহমুদ দ্রুত ইঞ্জিন রুমের পাশ দিয়ে জ্বালানি সঞ্চয় কক্ষে প্রবেশ করল এবং দ্রুত কাজে লেগে গেল। তিনটি বৃহদাকার ট্যাঙ্ক। সৌভাগ্যক্রমে ট্যাঙ্কগুলি ঈষৎ উঁচু সারিবদ্ধ কতগুলি ইস্পাত বেজের উপর রাখা। মাহমুদ দ্রুত ডেজিচেইন পেতে তার মাথায় ডেটোনেটর ও টাইম ইগনেটর জুড়ে দিল। প্রত্যেকটি ট্যাঙ্কের জন্য দু’টি করে ডেজিচেইন পাতল মাহমুদ। তারপর ফিরে এল আবার ইঞ্জিন রুমে। সেখান থেকে উঠে এর পূর্বের করিডোরে। করিডোরে কেউ নেই। মাহমুদ বুঝল প্রহরী ও জাহাজের ক্রুরা সবাই নিশ্চিন্তে ভোজ সভার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। মাহমুদ কার্গো কেবিনে ডেজিচেইন পাতার বিষয় বিবেচনা করে দেখল। কিন্তু এর প্রয়োজন হবে বলে মনে হলো না মাহমুদের।
এবার নিশ্চিন্ত হয়ে সে প্রবেশ করল ল্যাভেটরীতে। বেশ করে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এল সেখান থেকে। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল ১০ টা বেজে ৪৭ মিনিট। মাহমুদ ভবল, এমিলিয়া নিশ্চয় এই দেরীতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
মাহমুদ সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। সোজাসুজি এমিলিয়ার কাছে না গিয়ে রেলিং এর ধারে গিয়ে দাঁড়াল। সে লক্ষ্য করল, সে এখনো এমিলিয়ার দৃষ্টিতে পড়েনি।
সাগরে চাঁদের স্থির প্রতিবিম্বের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহমুদ। স্থির চাঁদের ঐ আলোক শিখা মাহমুদের মনকে টেনে নিয়ে গেল জর্দানের পাহাড় আর তার পাশ্বের উপত্যকা ভূমিতে। সেখানে তাঁবু আর কুঁড়ে ঘরে বাস করছে অগণিত মানুষ – মজলুম মানুষ। ঐ মজলুম মুসলমানদের জন্য আমরা এ পর্যন্ত কি করতে পেরেছি? সময় যতই গেছে ইসরাইল তার বিষাক্ত থাবাকে আরও সুদৃঢ়, আরও সুবিস্তৃত করেছে। এমিলিয়া এসে মাহমুদের পাশে দাঁড়াল। মাহমুদের দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, কি স্বপ্ন দেখছ?
মাহমুদ চমকে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই মুখে ফুটিয়ে তুলল মৃদু হাসির রেখা। বলল, ভাবছি এই সাগর আর এ তারকা খচিত নিকষ কালো আকাশের অসীমত্বের কথা। আমরা কত ক্ষুদ্র। এই সাগর ঐ অসীম আকাশ আর এই বিচিত্র পৃথিবীর মালিক স্রষ্টা না জানি কত মহাশক্তিশালী। শান্ত ও অনুচ্চস্বরে বলল স্রষ্টাকে তুমি মহাশক্তিশালী মনে কর দানিয়েল?
-আমার স্বীকার করা বা না করার সাথে এর সম্বন্ধ নেই এমিলিয়া। মহা সৃষ্টির মাইে যে তার মহাশক্তির সাক্ষ্য নিহিত। স্রষ্টাকে তুমি অস্বীকার করতে পারো এমিলিয়া?
-কিন্তু স্রষ্টাকে মানতে গেলে ধর্মকে মানতে হয়। আর ধর্মকে মানতে গেলে দেখ না কত ফ্যাসাদ।
-যেমন?
-কোন ধর্ম মানবো, ইহুদী না খৃষ্টান, না মোহামেডান? এত সংঘর্ষ আর বৈপরীত্য কেন?
-বৈপরীত্য নেই এমিলিয়া। মুসা, যিশু খৃষ্ট আর মোহাম্মদ এর মূল শিক্ষা একই। ব্যবহারিক ক্রিয়া কর্মের মধ্যে পার্থক্য আছে শুধু এই পার্থক্যকে শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন ও সংশোধনের সাথে তুলনা করা যায়।
-কিন্তু এটা স্বীকার করে নিলে যে ইসলামকে মানব সমাজের জন্য শেষ ও অনুসরণীয় একমাত্র জীবন বিধান বলে মেনে নিতে হয়?
-কিন্তু যা সত্য, তাকে আমরা অস্বীকার করব কেমন করে?
-এটা গুরুতর কথা দানিয়েল? এত সহজে এমন কথা তুমি বলতে পার না। যাক। আজ ধর্মের কি সত্যই কোন প্রয়োজন আছে বলে তুমি মনে কর?
-ধর্মের অর্থ জীবন পদ্ধতি। সুতরাং এ ভূমন্ডলে মানুষের জীবন যত দিন থাকবে ধর্মের প্রয়োজনও ততদিন থাকবে।
-জীবন পদ্ধতি আমরা নিজেরাই গড়ে নিতে পারি।
-তা পারি। এ ধরনের জীবন পদ্ধতি ফেরাউন, নমরুদ, সাদ্দাদ গড়ে তুলেছিল। প্লেটো, রুশো, ভল্টেয়ার মানুষের জন্য নতুন জীবন পদ্ধতির দিক নির্দেশ করেছিল। হেগেল, কার্ল মার্কস মানব সমাজের জন্য ঐতিহাসিক বস্ত্তবাদের আলোকে নতুন জীবনদর্শনের রূপরেখা এঁকে গেছে এবং সে মোতাবেক লেনিন, মাওসেতুং এর নেতৃত্বে রাশিয়া ও চীনে সর্বাত্মক বিপ্লবও সাধিত হয়েছে। গণতন্ত্রের উপর ভিত্তিশীল এক নয়া সমাজ পদ্ধতি (অবশ্য প্রকৃত পক্ষে এটা প্রাচীন গ্রীসিয় সমাজ সভ্যতার নবতর সংস্করণ) পশ্চিমা দেশগুলোতে চালু আছে কিন্তু এগুলোর কোন একটিও কি রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি জীবনে শান্তির সন্ধান দিতে পেরেছে? শ্রেণী স্বার্থের ধ্বজা তুলে সাম্যবাদের নামে সমাজবাদী দেশগুলো কি জনতাকে দাসে পরিণত করেনি? আর পুঁজিবাদী দেশগুলোতে ব্যক্তিস্বার্থ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে লুণ্ঠন শোষণের অবাধ সয়লাব কি বয়ে যাচ্ছে না? অশান্ত অস্থির মানুষকে ঘুমের বড়ি খেয়ে ঘুমোতে হয় কোন কারণে?
-কিন্তু স্রষ্টার নির্দেশিত জীবন পদ্ধতি সব সমস্যার সমাধান করবে, তার নিশ্চয়তা কি?
-আচ্ছা এমিলিয়া সাপের কোন জিনিসকে আমরা ভয় করি?
-বিষ দাঁতকে?
-আচ্ছা সাপের বিষ দাঁতকে যদি উপড়ে ফেলা হয়, তাহলে সে আর কোন ক্ষতি করতে পারে কি?
-না পারে না। এমিলিয়া হাসল। বলল, কিন্তু মানুষের বিষদাঁত তুমি পাবে কোথায়?
-মানুষের বিষদাঁত তার স্বেচ্ছাচারিতা ও স্বার্থপরতা। ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে সকল প্রকার বিপর্যয়, অশান্তি ও অনর্থের মূল কারণ মানুষের স্বার্থপরতা ও স্বেচ্ছাচারিতা। স্বার্থপরতা অন্যায়ের বাহন আর স্বেচ্ছাচারিতা তার অমোঘ অস্ত্র।
-কিন্তু এ বিষদাঁতকে তো ভাঙ্গা যায় না।
-ভাঙ্গা যায় না, কিন্তু এর বিলুপ্তি ঘটানো সম্ভব। মানুষ যখন এক স্রষ্টার সার্বভৌম ক্ষমতার কাছে সত্যিকার ভাবে মাথা নত করে তখন তার স্বেচ্চাচারিতা ও স্বার্থপরতার কোন সুযোগই আর থাকে না। সে সত্যিকারভাবে তখন স্রস্টার দেয়া বিধানবলীর প্রতিপালণকারী ও প্রয়োগকারী হয়ে দাঁড়ায়।
এমিলিয়া এক দৃষ্টিতে মাহমুদের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মুগ্ধ দৃষ্টি যেন আনন্দে নাচছে। সে বলল, আমার দেখা, আমার পরিচিত জনস্রোতের মাঝে তুমি সত্যই ব্যতিক্রম দানিয়েল। তুমি কখনো কঠিন বস্তুবাদী আবার কখনো কঠোর ভাববাদী। তুমি আসলে কি দানিয়েল?
-আমি একজন মানুষ। হাসল মাহমুদ।
এমিলিয়াও হাসল। কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমন সময় ক্ষুদ্রকার ডেকমাইক থেকে ঘোষিত হল, লেডিজ এন্ড জেন্টলম্যান আপনাদের স্ব স্ব আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।
সবাই গিয়ে আসন গ্রহণ করল। মাহমুদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত এগারটা বাজতে এক মিনিট বাকী।
রাত ১১ টা বেজে গেছে। আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ইসরাইলের বিজ্ঞান ও কারিগরি মন্ত্রী এ্যারোন কোপল্যান্ড তার আসন গ্রহণ করেছেন। ১১ টা বাজার সাথে সাথে ইসরাইলী অণুবিজ্ঞানী মিঃ মরিস কোহেন এবং মিঃ মোসে সারটক এসে আসন গ্রহণ করলেন।
১১ টা ১ মিনিট বাজল। মিঃ এ্যারোন কোপল্যান্ড উঠে দাঁড়ালেন উপস্থিত আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, উপস্থিত ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, আজ আমাদের জন্য এক পরম খুশীর দিন। আমাদের পিতৃভূমি ইসরাইল এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আমাদের সমরশক্তিতে পরমাণু বিজ্ঞানের আশির্বাদ লাভের জন্য আমরা এতদিন পরের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করেছি। আমাদের বিজ্ঞান ও আমাদের কারিগররা পারমাণবিক কৌশল আয়ত্ব করেছে অনেক আগে, কিন্তু নিজস্ব গবেষণাগার স্থাপনের কোন সুযোগ আমরা পাইনি। এতদিনে সে সুযোগ আমরা লাভ করতে যাচ্ছি। সুতরাং আজকের এদিন আমাদের বিজ্ঞানী, আমাদের জনসাধারণ, আমাদের সরকার এবং আমাদের বিদেশের শুভানুধ্যায়ীদের জন্য মহা আনন্দের সওগাত বয়ে এনেছে। আমরা এ নিশ্চয়তা আজ সবাইকে দিতে পারি সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন আমরা আমেরিকা ও রাশিয়ার মত ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালেষ্টিক মিসাইলের অধিকারী হবো।
শ্রোতমন্ডলি করতালি দিলেন। একটু থেমে মন্ত্রী মহোদয় আবার শুরু করলেন, পিতৃভূমির যে অংশটুকুর উপর আমরা অধিকার লাভ করেছি, তা নিয়ে আমরা কেউই সন্তুষ্ট নই, সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। হেজাযের ইয়াসরেব নগরী ( আল মদিনা ) থেকে তুরস্কের আলেকজান্দ্রিয়া প্রদেশ এবং ভূমধ্যসাগর ও নীল নদের সীমা থেকে ইউফ্রেটিস-তাইগ্রিস নদীর মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের পিতৃভূমির উপর আমরা যে কোন মূল্যেই হোক অধিকার কায়েম করবো। এজন্য চাই আরো শক্তি – আরো শক্তি ( আবার তুমূল করতালি কিন্তু মাহমুদের হাত দু’টিই শুধু নড়ল না )।
১১ টা ৭ মিঃ অনুষ্ঠানে শেষ হলো। খাবার প্রস্ত্ততি শুরু হল। সবাই নিজের কোলের উপর রুমাল বিছিয়ে নিচ্ছেন। মাহমুদের মন চঞ্চল হয়ে উঠল। আর তিন মিনিটের মধ্যেই প্রথম বিষ্ফোরণ ঘটার কথা। আল্লাহ কি দয়া করবেন? তার মিশন কি সফল হবে। বলদর্পী সাম্রাজ্যবাদী রক্ত পিপাসু ইহুদীদের আশার এ দীপশিখাকে কি সে নিভিয়ে দিতে পারবে? সকলের সামনে স্যুপ পরিবেশিত হয়েছে। চামচ দিয়ে স্যুপ নাড়ছে সবাই। চামচ দিয়ে ধীরে ধীরে মুখে তুলছে স্যুপ। সবার মত মাহমুদের মুখেও স্যুপ উঠছে। কিন্তু তার মন আশা নিরাশার তরঙ্গঘাতে অশান্ত চঞ্চল। ১১ টা ৯ মিঃ ৩০ সেকেন্ড। জাহাজ প্রচন্ডভাবে কেঁপে উঠল। প্রচণ্ড বিষ্ফোরণের শব্দ। সঙ্গে সঙ্গে এক বিরাট অগ্নিপিন্ড আকাশের দিকে উঠে গেল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল খাবার টেবিলে। স্যুপের পিয়ালা অনেকের কাত হয়ে পড়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সবাই উঠে দাড়িয়েছে। ভীত আতঙ্কগ্রস্থ সবাই। মাহমুদ তার কর্তব্য আগেই ঠিক করে রেখেছিল। এমিলিয়াকে বলল, এস আমার সাথে। বলে সে ছুটলো ডেক থেকে জেটিতে নামবার সিঁড়ির দিকে। জাহাজ কাঁপছে। প্রথম বিষ্ফারণের ফলে উৎক্ষিপ্ত অগ্নিপিন্ড নিচে নেমে জাহাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। সিঁড়ির মুখে গিয়ে মাহমুদ এমিলিয়াকে বলল, হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে আমার পিঠে উঠ।
এমিলিয়ার মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে কাঁপছে। মাহমুদের আদেশ পালন করল সে। অভ্যস্ত মাহমুদ দ্রুত কম্পমান সিঁড়ি দিয়ে জেটিতে নেমে এল। জেটিতে পা রাখার সাথে সাথে আর একটি বিষ্ফারণের শব্দ হল। মাহমুদ পিছনে ফিরে দেখল, জাহাজের বিজলি বাতি নিভে গেছে। কিন্তু বিষ্ফোরণের ফলে উৎক্ষিপ্ত আগুন জাহাজকে আলোকিত করে তুলছে। সেই আলোতে দেখা গেল জাহাজের একটা অংশ সম্পূর্ণ উড়ে গেছে। দ্বিতীয় বিষ্ফোরণের অগ্নিপিন্ড জাহাজে ছড়িয়ে পড়ায় জাহাজের স্থানে স্থানে আগুন জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। মাহমুদ এমিলিয়াকে নিয়ে জেটি থেকে আর একটু দূরে সরে এল। মাহমুদ দেখল আরো কয়েকজন মানুষ সিঁড়ি দিয়ে জেটিতে নেমে এল। আর একটি বিষ্ফোরণ ঘটল এ সময়। মনে হল জাহাজটি যেন একদিকে কাত হয়ে গেল। অপেক্ষকৃত ছোট আরও অনেকগুলি বিষ্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। জাহাজের অন্যান্য কয়েক স্থান থেকেও আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যেতে লাগল। দূরে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ীর ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল। মাহমুদ ও এমিলিয়া গাড়ীতে গিয়ে বসল। মাহমুদ গাড়ি ছেড়ে দিল। পোর্ট রোড ধরে গাড়ী তীব্র গতিতে পূর্বদিকে এগিয়ে চলছে। তেলআবিব অনেক দূরের পথ। লম্বা রাস্তা। মাহমুদের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পেরে তার মন তৃপ্ত। এ তৃপ্তির মাঝেও তার মনে একটি কাঁটা বিধছে। এবার এমিলিয়ার সাথে তার অভিনয়ের ইতি করতে হবে। কিন্তু শুধুই কি তা অভিনয় ছিল? মনের কোথায় যেন বেদানার সুর বাজছে তার। এমিলিয়া তার পরিচয় পেলে কি ভাববে তাকে? কালকেই গোয়েন্দা পুলিশ এসে এমিলিয়াকে ব্যস্ত করে তুলবে। বিনা অপরাধে বেচারী কষ্ট পাবে। এমিলিয়া একটু কাত হয়ে একটি হাত মাহমুদের পিছনে সোফার উপর প্রসারিত করে একটি হাত মাহমুদের কাঁধে রেখে মুখটি মাহমুদের কাঁধে গুঁজে রেখেছে। এক সময় ধীর কন্ঠে সে বলল, দানিয়েল, একবার তুমি আমাকে নৈতিক মৃত্যু থেকে বাঁচিয়েছ, আবার আজ তুমি আমাকে দৈহিক মৃত্যুর হাত তেকে বাঁচালে। জীবন দিয়েও এ ঋণ শোধ করতে পারব না আমি দানিয়েল। মাহমুদের গোটা দেহে একটি শিহরণ খেলে গেল। কিন্তু কোন উত্তর দিল না মাহমুদ। কি উত্তর দেবে সে? যে তার জীবনকে জাতির জন্য উৎসর্গ করেছে, সে কেমন করে একজন ইহুদী তরুণীর এ আত্ম নিবেদনকে গ্রহণ করবে? মাহমুদ ধীরে ধীরে বলল, কাল সকালে পুলিশ আসবে। আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করবে তারা। কি জবাব দিবে তুমি?
-কেন পুলিশ আসবে?
-আসবে।
-কেন আসবে?
-ধর যদি আসেই?
-আমি তোমার ঠিকানা বলে দেব, তোমার কাছে পাঠিয়ে দেব।
-পুলিশ আমাকে খুঁজে পাবে না।
-কেন? কোথাও চলে যাচ্ছ তুমি? বলে সোজা হয়ে বসল এমিলিয়া। মাহমুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর এমিলিয়ার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়েই বলল, পুলিশকে আমাদের পরিচয়ের আসল ঘটনাটির কথা জানাবে তাহলে আমাদের বন্ধুত্বের কারণ তারা বুঝবে এবং তোমার কোন দোষ হবে না।
-পুলিশ কেন তোমার সন্ধান করবে? কেন দোষ দিবে আমাকে তারা? এমিলিয়ার কন্ঠে উদ্বগ।
-ওসেয়ান কিং’ জাহাজ ধ্বংসের জন্য আমাকেই দায়ী করবে তারা।
-কেন তা করবে? তুমি ও কাজ করতে যাবে কোন কারণে? মাহমুদ মুহূর্তের জন্য এমিলিয়ার মুখের দিকে তাকাল। তার লাবণ্যভরা মুখটি উদ্বিগ উত্তেজনায় যেন কাঁপছে। ওর কোমল হৃদয়ে আঘাত দিতে কষ্ট লাগছে মাহমুদের। তবু সত্য ঘটনা তাকে বলতেই হবে মাহমুদ গম্ভীর কন্ঠে বলল, ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজের ফুয়েল ট্যাংকে আমি বিষ্ফোরণ ঘটিয়েছি এমিলিয়া।
-তুমি? এমিলিয়ার কণ্ঠ আর্ত চিৎকারের মত শোনাল। বিস্ময় উত্তেজনায় এমিলিয়ার মুখ হা হয়ে গেছে। সে বির্বাক দৃষ্টিতে আকিয়ে আছে মাহমুদের দিকে।
-মাহমুদ আবার এমিলিয়ার দিকে চাইল। তার মুখে ফুটে উঠল হাসির রেখা। কিন্তু তা যেন তাসি নয়, কান্না। বলল, জানি এমিলিয়া তুমি বিস্মিত হয়েছ। হয়তো ভাবছও আমি কেমন করে অমন খুনী হতে পারলাম। কিন্তু তুমি জান না, ‘ওসেয়ান কিং’ জাহাজে যে অগ্নিকুন্ড তুমি দেখেছ, তার চেয়েও অনেক বড় অগ্নিকুন্ড আমার হৃদয়ে জ্বলছে। শুধু আমার হৃদয়ে নয়, ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত আমার মত লক্ষ লক্ষ আরব মুসলমানের হৃদয়ে এ আগুন অমনি জ্বলছে।
-তুমি আরব? তুমি মুসলমান? এমিলিয়ার কণ্ঠ আর্তনাদ করে উঠল।
-হাঁ এমিলিয়া, আমি মুসলমান।
-বিস্ময় বিষ্ফারিত এমিলিয়ার চোখ। গভীর বেদনায় শক্ত নীল হয়ে উঠেছে এমিলিয়ার শুভ্র গন্ডদেশ। গোলাপের মত ঠোঁট দু’টি তার কাঁপছে। বিহ্ব্ল দৃষ্টিতে মুহূর্ত কাল মাহমুদের দিকে চেয়ে থাকল। তারপর ভেঙ্গে পড়ল কান্নায়। উপুড় হয়ে হাঁটুতে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। মাহমুদের দৃষ্টি সামনে প্রসারিত। জন বিরল প্রশস্ত রাস্তা। তীব্র গতিতে এগিয়ে চলেছে কার্ডিয়াক। মাহমুদ এবার এমিলিয়ার দিকে চাইল, কাঁদুক, কাঁদা উচিত। চোখের পানিতে ধুয়ে মুছে যাক মাহমুদে সব স্মৃতি।
খোলা প্রশস্ত গেট দিয়ে ডেভিড বেনগুরিয়ানের বারান্দায় প্রবেশ করল গাড়ী। মাহমুদ গাড়ী থেকে নেমে পাশ ঘুরে এসে গাড়ীর দরজা খুলে ধরে বলল, নেমে এস। এমিলিয়া মুখ তুলল। অশ্রু ধোয়া মুখ তার। দু’একটি অবিন্যস্ত চুল মুখে এসে পড়েছে। অশ্রুতে ভিজে গেছে সে গুলোও। কঠিন আঘাতে যে চোখে অশ্রু আসে না, মাহমুদের সে চোখ দু’টিও ভারী হয়ে উঠল। এমিলিয়া বেরিয়ে এসে মাহমুদের পাশে দাঁড়াল। নতমুখী এমিলিয়া। দু’জনই নির্বাক। প্রথমে কথা বলল মাহমুদ। বলল, পরিচয় গোপন করার জন্য এবং তোমাকে এমন করে আঘাত দেয়ার জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী এমিলিয়া। তুমি যদি আমাকে ভুল না বুঝ, তাহলে আমাকে ক্ষমা তুমি করতে পারবে।
এমিলিয়া নীরব। কোন কথা বলল না। মুখও তুলল না সে।
মাহমুদ আবার বলল, আর যদি প্রতিশোধ নিতে চাও তাহলে আমাকে পুলিশে ধরিয়ে দাও। আমি রাজী আছি।
এমিলিয়া যেন পাথর হয়ে গেছে। কোন উত্তর এল না তার কাছে থেকে। যেন অলক্ষ্যে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল মাহমুদের বুক থেকে চোখের কোণও বোধ হয় ভিজে এল তার বলল সে, তাহলে আসি এমিলিয়া, পারলে ক্ষমা করো।
দু’হাত মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে উঠল এমিলিয়া। মাহমুদ কয়েক পা এগিয়ে ছিল। ফিরে এল আবার। এমিলিয়ার মুখ তুলে ধরে ডাকল এমিলিয়া।
-দানিয়েল। বলে মাহমুদের হাত জড়িয়ে ধরে বাঁধ ভাঙ্গা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এমিলিয়া।
আর দানিয়েল নায় এমিলিয়া। আমার নাম মাহমুদ। ধীর স্বরে বলল মাহমুদ।
এমিলিয়া কেঁদেই চলল। মাহমুদের হাত এমিলিয়ার চোখের পানিতে ভিজে গেল।
মাহমুদ বলল, মুখ তোল কথা বল এমিলিয়া।
এমিলিয়া ধীরে ধীরে মুখ তুলল। অবিন্যস্ত চুল আর অশ্রু ধোয়া এমিলিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে, কি এক প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেছে এমিলিয়ার উপর দিয়ে। তার নীল শান্ত চোখে কি নিঃসীম মায়া বলল সে, আবার কবে দেখা হবে?
শক্ত একটি প্রশ্ন। মাহমুদ বলতে চাইল। স্রোতে ভাসা পানার মত নিরুদ্দিষ্ট আমাদের জীবন। কোন আবর্ত কোথায় কখন আমাদের নিয়ে যাবে তা আমরাও জানি না। কিন্তু কথা বাড়াতে চাইল না মাহমুদ। বলল, যদি কোথাও দূরে চলে না যাই তাহলে দেখা হবে।
-আর যদি দূরে চলে যাও? অবরুদ্ধ কান্নায় কাঁপতে লাগল এমিলিয়ার ঠোঁট দু’টি।
-একটি যাযাবর জীবনের জন্য তুমি অপেক্ষা করবে এমিলিয়া?
এমিলিয়ার দুই গন্ড বেয়ে আবার নেমে এল অশ্রুর দু’টি ধারা। বলল সে, কোন কথা নয় কথা দাও তুমি আসবে?
-কথা দিলাম আসব।
-বেশ। বলে এমিলিয়া মাহমুদের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল, এ সময় এ অঞ্চলে কোন ট্যাক্সি পাবে না, হেঁটে যাবে কেমন করে? চল আমি তোমাকে রেখে আসব। মাহমুদ ম্লান হাসল। বলল, এতক্ষণ তোমাদের গোয়েন্দারা হয়ত আমার সন্ধানে ছুটে আসছে। তোমাকে আর কোন বিপদে জড়াতে চাই না এমিলিয়া।
-কিন্তু তোমার বিপদের কথা তুমি ভাবছ না কেন?
-বিপদ আমাদের নিত্য খেলার সাথী। কোন চিন্তা করো না তুমি। আর আমাকে হেঁটে যেতে হচ্ছে না, তোমাদের গেটের বাইরে আমার জন্য গাড়ী অপেক্ষা করছে। বলে মাহমুদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, আসি এমিলিয়া। খোদা হাফেজ।
-আচ্ছা এস। কম্পিত কন্ঠে বলল এমিলিয়া।
মাহমুদ কয়েক কদম এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে চাইল। দেখল, এমিলিয়া একটি হাত গাড়ীর উপর ঠেস দিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গাড়ি বারান্দায় ম্লান আলো তার চোখের পানিতে প্রতিবিম্বত হয়ে চিক চিক করছে। হৃদয়ের কোথায় যেন মোচড় দিয়ে উঠল মাহমুদের। তার যাত্রা পথের দিকে চোখ দু’টি বুজে এল মাহমুদের। উচ্চারিত হল তার কন্ঠেঃ রাববানা আজআলনা মুসলিমাইনিলাকা (প্রভু আমার, তোমার কাছে আত্মসমর্পণকারী মুসলমানদের মধ্যে আমাদের সামিল কর)।
পরদিন সকালে অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠল এমিলিয়া। অনেক রাত্রে ঘুমিয়েছে সে। রাত্রেই এসেছিল নিরাপত্তা পুলিশরা। নাইট ক্লাবের মৌখিক পরিচয় ছাড়া মাহমুদ সম্বন্ধে আর কোন কিছু্ই জানে না বলেই জানিয়েছে এমিলিয়া তাঁদের। এমিলিয়ার বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই বলেই তার হয়ত কোন পীড়াপীড়ি করেনি আর।
শয্যায় উঠে বসেই সে দেখতে পেল পাশের টিপয়ে রাখা সেদিনের সংবাদপত্র। কাগজটি হাতে নিয়ে চোখ বুলোতেই সে দেখতে পেল, ওসেয়ান কিং জাহাজের খবরটি লিড ষ্টোরি হয়েছে। সে পড়ল, ওসেয়ান কিং জাহাজের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডঃ
অণূ বিজ্ঞানী মিঃ মরিস কোগেনসহ পাঁচজনের মৃত্যুঃ
২ জন নিখোঁজঃ ১০ জন আহতঃ সমুদয় কার্গো ভস্মিভূত। পরে ওসেয়ান কিং জাহাজে অগ্নিকান্ডের সময় ও পূর্ণ বিবরণ দিয়ে পরিশেষে লিখেছে ‘‘এই অগ্নিকান্ডে ইসরাইলের ৫০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের মহা মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও মালপত্র সম্পূর্ণ বিনষ্ট হয়েছে। সবচেয়ে ক্ষতি অণূ বিজ্ঞানী মিঃ মরিস কোহেনের মৃত্যু। তিনি ইসরাইল বিজ্ঞানাকাশের সূর্য এবং আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমূল্য রত্ন ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে পরমাণু বিজ্ঞানে আমাদের দেশ যে অনেক দূর পিছিয়ে গেল, তা বলাই বাহুল্য। এক বিশ্বস্ত সূত্রে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে ওসেয়ান কিং জাহাজে ৫০ মিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক গবেষণা সরঞ্জাম বোঝাই ছিল। এই মহামূল্যবান গবেষণা সরঞ্জামের বিনষ্টি আমাদের জাতীয় অগ্রগতির জন্য কত মর্মান্তিক, তা সহজেই অনুমেয়। ওসেয়ান কিং জাহাজের ঘটনায় নিহতদের মধ্যে আরো রয়েছেন, জাহাজের ক্যাপটেন জন টমসন এবং নিরুদ্দিষ্টদের মধ্যে আরো রয়েছে ইসরাইলী গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী প্রধান মিঃ হফম্যান। জানা গেছে, ভোজ অনুষ্ঠানের কিছু পূর্বে থেকেই তাঁকে জাহাজের ডেকে দেখা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে যে, দুষ্কৃতিকারীদের সাথে সংঘর্ষে তিনি নিহত হয়েছেন।
সাইমুদের নাশকতাকারীরা জাহাজের ফুয়েল ট্যাংকে বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে জাহাজে আগুন ধরিয়েছে বলে জানা গেছে, সংগৃহীত তথ্যের বরাত দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা পুলিশ বিভাগ জানাচ্ছেন, আমন্ত্রিত অতিথির ছদ্মবেশে সাইমুমের জনৈক নাশকাতাকারী জাহাজে প্রবেশ করেছিলো।’’
এমিলিয়া রুদ্ধ নিঃশ্বাসে খবর পড়া শেষ করল। বৈজ্ঞানিক মিঃ মরিস কোহেন এবং মি হফম্যানের মৃত্যু হয়েছে? এমিলিয়ার স্নায়ুতন্ত্রী দিয়ে এক হিম শীতল স্রোত বয়ে গেল। কি নিষ্ঠুরতা? কিন্তু পরক্ষনেই তার মানস দৃষ্টিতে ভেসে উঠল মাহমুদের মুখ আর তার কথাঃ ‘‘এমিলিয়া তুমি জান না, ওসেয়ান কিং জাহাজে যে অগ্নিকান্ড তুমি দেখেছ, তার চেয়েও অনেক বড় অগ্নিকুন্ড আমার হৃদয়ে জ্বলছে। শুধু আমার হৃদয়ে নয় ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত লক্ষ লক্ষ আরব মুসলমানদের হৃদয়ে এ আগুন এমনিভাবে জ্বলছে।’’ এমিলিয়ার মনে পড়ল, তাইতো আমরা ইহুদীরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসে ফিলিস্তিনী মুসলমানদের সহায় সম্পদ দখল করেছি, তাদেরকে তাদের পিতৃ পুরুষের ভিটা বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করেছি। আর যুগ যুগ ধরে মুক্ত আকাশের নীচে বৃষ্টি রোদের মধ্যে তাবুতে অমানুষিক জীবন যাপন করছে তারা। এমিলিয়ার আরো মনে পড়ল হত কালকের ভোজসভার বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রী মিঃ এ্যারোন কোপল্যাডের ভাষণঃ ‘হেযাজের ইয়সবরিব নগরী (মদিনা শরিফ) থেকে তুরস্কের আলেকজান্দ্রিয়া প্রদেশ এবং ভূমধ্যসাগর ও নীলনদের মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত আমাদের পিতৃভূমির উপর আমরা যে কোন মূল্যেই হোক অধিকার কায়েম করব।’’ ইসরাইলের এ ঘোষণা এ লক্ষ্যতো কোন আত্মরক্ষাকারী জাতি বা দেশের কথা নয়। এ যে সাম্রাজ্যবাদী দেশের আগ্রাসী নীতি। এ লক্ষ্য যদি অর্জিত হয়, তাহলে ঐ বিশাল ভূখন্ডের কোটি কোটি মুসলমানের ভাগ্যে কি ঘটবে? তারা কোথায় যাবে?
এতদিন এমিলিয়ার ধারণা, ছিল, ইসরাইলীরা আত্মরক্ষায় সচেষ্ট। কিন্তু আজ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল, ঘৃণ্য সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা নিয়ে তার দেশ শক্তি বৃদ্ধি করছে। আর ফিলিস্তিন ও আরব মুসলমানরাই যথাযথভাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা আর আত্মরক্ষার জন্য সংগ্রাম করেছে। ওসেয়ান কিং জাহাজের অগ্নিকান্ড যদি তাদের সেই সংগ্রামের অংশ হয়, তাহলে তাকে নিষ্ঠুর বলা যাবে কোন যুক্তিতে? মাহমুদকে নির্দোষ করতে পেরে গভীর প্রশান্তিতে বলে গেল এমিলিয়ার মন।
৭
এমিলিয়াদের গেট পেরিয়ে ফুটপাতে দাঁড়াতেই কালো রং এর একটি ‘মরিস করোনা’ এসে মাহমুদের সামনে দাঁড়াল। ভিতর থেকে মুখ বাড়াল আফজল পাশা। জাফা বন্দর থেকে সারাটা পথ আফজল পাশা মাহমুদের অনুসরণ করে এসেছে। এই নির্দেশই ছিল তার প্রতি। জাফা বন্দরের যে আস্তানায় আমরা ইতিপূর্বে মাহমুদ ও আফজলকে দেখেছি সেটা আপতত বন্ধ থাকবে।
মাহমুদ গাড়ীতে উঠে বসলে গাড়ী ছুটে চলল প্রশস্ত আলকেনান রোড ধরে দক্ষিণ দিকে। গাড়ীতে বসেই মাহমুদ পোশাক পাল্টে নিল। প্রথমেই কথা বলল মাহমুদ। বলল, শেখা জামালকে জানিয়েছ?
শেখ জামাল তেলআবিবের ৩ নং আস্তানার পরিচালক। এ আস্তানাটি দক্ষিণ তেলআবিবের বাজার সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত। এ আস্তানাতেই মাহমুদ এখন যাচ্ছে।
গাড়ী এবার ডেভিড পার্ক ঘুরে স্যামুয়েল রোড ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলল। তিন মিনিট চলার পর গাড়ী দক্ষিণ দিকে মোড় নিয়ে সেন্ট সলোমন রোড ধরে ছুটে চলল দক্ষিন দিকে। সেন্ট সলোমন রোড যেখানে এসে খাড়া পূর্ব দিকে মোড় নিয়েছে সেই মোড়ের উপর রাস্তার দক্ষিণ পাশে শেখ জামালের আস্তানা। দোতলা বাড়ী। নিচের তলায় ফলের দোকান। উপর তলায় থাকে জামাল। আরও দু’টি ঘর পশ্চিম দিকে রয়েছে। এর একটি দৃশ্যত রান্নাঘর আরটি ষ্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার হয়। কিন্তু রান্নাঘরটি ভ্রাম্যমান সাইমুম কর্মীদের একোমোডেশন এবং নিচের তলার ষ্টোর রুমটি অস্ত্রাগার ও ট্রেনিং কক্ষ। স্থানীয় সাইমুম ক্যাডেটদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করার পর অস্ত্রাগারটির অবশিষ্ট সবকিছু তেলআবিবের মূল ঘাঁটিতে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ইসরাইলে কর্মরত সাইমুম ইউনিট গুলোকে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার পর সর্বক্ষেত্রে একই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ এবং জরুরী মুহূর্তে নির্দেশ গ্রহণের জন্য যোগাযোগ রক্ষা করা ছাড়া আর আস্তানার সাথে স্বয়ং সম্পূণ সাইমুম ইউনিটগুলোর কোন রকমের সম্পর্ক নেই। ইসরাইলের বাসিন্দা আরব মুসলমানদের ৯৭ হাজার পুরুষ এবং ৮২ হাজার মহিলা সাইমুমের ‘জয় নয়, মৃত্যু’ মন্ত্রে দীক্ষিত। এদের নিয়েই গঠিত হয়েছে সাইমুমের হাজার হাজার ইউনিট। বিভিন্ন ঘাটি থেকে আস্তানাসমূহের মাধ্যমে এ ইউনিটগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়। ইসরাইলের এসব আরব বাসিন্দারা ইসরাইলীদের সাথে মিলে মিশে শান্তিপূর্ণ ও নিরীহ জীবন যাপন করছে আর সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের সেই দিনটির জন্য অতন্দ্র চোখে অপেক্ষা করছে। সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির পূর্বে কোন অপারেশনে ইসরাইলের আরব বাসিন্দাদের ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমন কি ইসরাইলে কর্মরত সাইমুমের ১০ হাজার কর্মীর প্রতি এ নির্দেশ রয়েছে যে, বিপদ মুহূর্তেও তারা কোন আরব মুসলমানের সাহায্য কিংবা আশ্রয় প্রার্থনা করবে না। সংরক্ষিত এবং গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ইসরাইলের আরব মুসলমানদেরকে সকল সন্দেহের উর্ধ্বে রাখাই সাইমুম প্রধান আহমদ মুসার লক্ষ্য।
সেন্ট সলোমন রোড চলে গেছে সরল রেখার মত দক্ষিণ দিকে। সামনেই মোড় দেখা যাচ্ছে। আস্তানার দু’তলা গৃহটিও চোখে পড়ছে। আস্তানার দ্বিতলের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল মাহমুদ। আফজল পাশাকে তৎক্ষণাৎ গাড়ী থামতে ইংগিত করল সে। আস্তানার দ্বিতলের ঘরটিতে নীকষ বেগুনি রং এর আলো জ্বলছে। সাইমুমের কোড অনুসারে এই আলো বিপদের সংকেত। শেখ জামালের কিছু হয়েছে, নয়তো সে অস্বাভাবিক কিছু সন্দেহ করেছে।
মাহমুদ গাড়ী থেকে নেমে পাশের গলিতে আফজলকে অপেক্ষা করতে বলে ডান পাশের ফুটপাত ধরে এগোল। গাছের ছায়ায় ঈষৎ আলো আঁধারের সৃষ্টি করেছে। মাহমুদের কাছে এটা আর্শিবাদ হয়ে দেখা দিল। সেন্ট সলোমন রোড যেখানে পূর্বদিকে মোড় নিয়েছে, সেখান থেকে আর একটি লেন পশ্চিম দিকে চলে গেছে। গলিটির মুখে এক ধারে প্রকান্ড একটি গাছ। নিচে বেশ অন্ধকার। পাতার ফাঁক দিয়ে কোথাও কোথাও চাঁদের আলো নেমে এসেছে অন্ধকারের বুক চিরে। তারই একটি আলোক রেখায় একটি গাড়ীর উইন্ড শিন্ড মাহমুদের চোখে পড়ল। সে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে গেল, অন্ধকারের মধ্যে একটি গাড়ী দাঁড় করানো রয়েছে মাহমুদ হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ীর দিকে এগুলো। পকেট থেকে পেন্সিল টর্চ বের করে নাম্বার প্লেটে দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল সে। এ যে ইসরাইলেল সিকুইরিটি ব্রাঞ্চ ‘সিনবেথ’ এর তেলআবিব শাখার প্রধান মিঃ চেচিনের গাড়ী। শিকারি বিড়ালের মতো ধীরে ধীরে মাহমুদ গাড়ীর সামনের দিকে এগুলো। গাড়ীতে কেউ নেই। ওরা কি তাহলে আস্তানার ভিতরে ঢুকেছে? পেন্সিলটর্চটি আর একবার জ্বেলে মাহমুদ গাড়ীটি পরীক্ষা করল। সামনের সীটের উপর সে নোট বুক পেল। তাড়াতাড়ি সে নোট বুকখানা পকেটে পুরে সরে এল গাড়ীর কাছ থেকে। তারপর কি মনে করে সে আবার ফিরে গেল গাড়ীর কাছে। তাড়াতাড়ি পকেট থেকে বের করল ডিম্বাকৃতি একটি বস্তু – টাইম বম। ধীরে ধীরে সেফটিপিন খুলে নিয়ে তা রেখে দিল সামনের সীটের নীচে। তারপর সরে এল সেখান থেকে।
মাহমুদ আফজলের কাছে ফিরে এল। বলল, সিনবেথ এর লোক এসেছে। তাদের সংখ্যা এক থেকে চার এর বেশী হবে না। গোপনে আস্তানা পরীক্ষা করা ওদের লক্ষ হতে পারে। তা যাই হোক শেখ জামালের চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি তারা। সে একাই যথেষ্ট হবে। শেখ জামালের কেশাগ্রও তারা স্পর্শ করতে পারবে না। সব চিহ্ন মুছে ফেলে সে একক্ষণে সরে পড়েছে।
উপর তলার ঘরে রাখা আলমারির মধ্যে দিয়ে নীচের তলায় ফলের দোকানে নামবার সিঁড়ি আছে। ফলের দোকানের বসবার বেদিটি একটি সুড়ঙ্গের মুখে রয়েছে। সে সুড়ঙ্গ দিয়ে আস্তানার গ্যারেজে পৌঁছা যায় এবং সেখান থেকে গাড়ী নিয়ে অথবা পিছনের দরজা দিয়ে যে কোন মুহূর্তে সরে পড়া সম্ভব। সুড়ঙ্গে নামবার পর বসবার বেদিটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। সুতরাং ‘সিনবেথ’ এর পক্ষে তা খুঁজে পাওয়া খুব সহজ হবে না।
গাড়ীতে উঠে বসতে বসতে মাহমুদ বলল, ‘সিনবেথ’ এর মিঃ চেচিন সাহেবের জন্য ফাঁদ পেতে রেখে গেলাম। খোদা করেন শিকার ধরা পড়বে। বলে আফজলের দিকে চেয়ে মাহমুদ বলল, এবার ঘরে ফিরে যাই চল। শেখ জামালকে হয়তো ওখানে পাব আমরা।
ইসরাইলের প্রতিটি শহরে ও উল্লেখযোগ্য স্থানে সাইমুমের একটি করে মূল ঘাঁটি রয়েছে। এখানে ‘ঘর’ বলতে মাহমুদ তেলআবিবের মূল ঘাঁটিকেই ইংগিত করেছে। ঘাঁটি ছাড়াও ঐ সমস্ত স্থানে রয়েছে কয়েকটি করে আস্তানা। এই আস্তানা গুলির ভূমিকা এ্যাকোমোডেশন ও তথ্য সরবরাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গাড়ী সেন্ট সলোমন রোড ধরে উত্তর দিকে এগিয়ে চলল। মাহমুদ গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত। ওসেয়ান কিং জাহাজের ঘটনা সিনবেথবে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত করে তুলেছে, কিন্তু মাহমুদ ভেবে পাচ্ছে না, সিনবেথ তাদের এ আস্তানার সন্ধান পেল কি করে?
তেলআবিবের শহরতলী এলাকা। তাই বলে ঘিঞ্জি বস্তি এলাকা নয়। অভিজাত আবাসিক এলাকা। পারিল্পনা করে সাজানো ইসরাইলের অনেক মাথাওয়ালা এবং বৈদেশিক মিশনের বাড়ীগুলি এ অঞ্চলেই। মাহমুদের গাড়ী এসে এক বিরাট অট্টালিকার সামনে দাঁড়াল। কাল পাথরে তৈরী বাড়ীর সামনে সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই করা। বাড়ীটির নাম ‘গ্রীণলজ’। বাড়ীটির সামনে বিরাট একটি সাইন বোর্ড ‘দানিয়েল এন্ড কোং’। বাড়ীটিকে ঘন ছায়াদার নানা গাছ যেন চারিদিক থেকে ঘিরে রেখেছে। মাহমুদ স্থানটি পার হতেই ভিতরে নীল আলো জ্বলে উঠল এবং সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা।
গ্রীণলজের একটি ইতিহাস আছে। ফিলিস্তিন বিভক্ত হবার পূর্বে অর্থাৎ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হবার আগে আহমদ শরিফ নামে একজন আরব মুসলমান এই গ্রীণলজের এবং সংলগ্ন বিস্কুট ফ্যাক্টরীর ছিল। ১৯৪৪ সালে উলম্যান নামে একজন ইহুদী তার অধীনে বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে চাকরি নেয়। বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতার গুণে সে আহমদ শরিফের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয় এবং ফ্যাক্টরীর সহকারী কর্মাধ্যক্ষ পদে উন্নীত হয়। তারপর এল ১৯৪৮ সালের ঝড়ো দিনগুলো। ইহুদীরা ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করল এবং আরব মুসলমানদেরকে উচ্ছেদের অবাধ অধিকার লাভ করল সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে। বৃদ্ধ আহমদ শরিফ নিহত হলেন। তাঁর ছয় ছেলে এবং আত্মীয় স্বজন রাতের অন্ধকারে জর্দান উপত্যকার দিকে পালিয়ে গেল। কিন্তু আহমদ শরিফের নয় বছরের ছেলে মাহমুদ ছিল সেদিন রোগশয্যায় মুমূর্ষ অবস্থায়। উলম্যান বহু কষ্টে আহমদ শরিফের এই ছেলেটিকে স্বজাতির হিংস্র গ্রাস থেকে রক্ষা করে। ১৯৪৮ সালের পর উলম্যান গ্রীণলজ এবং সন্নিহিত ফ্যাক্টরীর মালিক হয়ে যায়। কিন্তু উলম্যান তার মৃত প্রভুর প্রতি বিশ্বসঘাতকতা করতে পারেননি। সে মাহমুদের ইহুদী নাম দেয় ‘দানিয়েল’ এবং তার নামেই ফ্যাক্টরীর নামকরণ হয় এবং বাড়ীটির মালিকানা সত্ত্বও তার নামেই লিখিত হয়। মাহমুদ সবার কাছে উলম্যানের পুত্র বলে পরিচিত হলেও প্রকৃত ইতিহাস মাহমুদ জানত। তাঁর পিতার রক্তাক্ত জামা-কাপড় এখনও তার বাক্সে সযত্নে রক্ষিত। মৃত্যু পর্যন্ত উলম্যান কখনও মাহমুদকে প্রভাবিত কিংবা তার জীবনকে কোন দিক থেকে নিয়ন্ত্রিত করতে চায়নি। মাহমুদ ছোটবেলায় ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কর্মী তোফায়েল বিন আবদুল্লাহর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে। কৈশোরে সে মুসলিম যুব আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে। তারপর মজলুম মানুষের মুক্তি আন্দোলন সাইমুমে সে যোগদান করে। ‘দানিয়েল এন্ড কোং’ এর ভার এখন সে একজন ম্যানেজারের হাতে ছেড়ে দিয়ে সংগঠনের কাজে ঘুরে বেড়ায়। সবাই ধারণা করে, ধনী ইহুদীর একমাত্র সন্তান এমন একটু ছন্নছাড়া হতে পারে বৈকি। মাহমুদের বাড়ীই এখন তেলআবিবস্থ সাইমুমের মূল ঘাঁটি। এখানে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন রেডিও রিসিভার ও ট্রান্সমিটার রয়েছে। বাড়ীর পিছনে উঁচু দেয়াল ঘেরা বাগানে রয়েছে তেল, আবিব ও সন্নিহিত অঞ্চলের অস্ত্রাগার। অবিবাহিত মাহমুদের বাড়ীতে রয়েছে ৮ জন মানুষ। এর মধ্যে তিনজন রেডিও ইঞ্জিনিয়ার, চারজন প্রহরী। এদেরই একজন বাজার ও রান্না বান্নার কাজ করে থাকে। এরা সকলেই সাইমুমের অভিজ্ঞ কর্মী।
রাত ১ টা মাহমুদ শোবার জন্য শয্যায় উঠে বসেছে। হঠাৎ তার খেয়াল হল মিঃ চেচিনের গাড়ী থেকে পাওয়া ডাইরীর কথা। উঠে গিয়ে পকেট থেকে ডাইরিটা নিয়ে টেবিলে গিয়ে বসল। ডাইরীটা খুলতেই একটি ভাজ করা কাগজ বেরিয়ে এল। কাগজটি তুলে নিয়ে চোখের সামনে মেলে ধরল। ফটোষ্ট্যাট করা একটি চিঠিঃ
প্রেরকঃ – চেয়ারম্যান, সংযুক্ত ফিলিস্তিন জনফ্রন্ট ও ফিলিস্তিন গণতন্ত্রী জনফ্রন্ট, আম্মান, জর্দান।
প্রাপকঃ পরিচালক, মোসাদ জেরুজালেম, ইসরাইল।
নিম্ন স্বাক্ষরকারী আপনার অবগতি ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংযুক্ত ফিলিস্তিন জনফ্রন্ট ও ফিলিস্তিন গণতন্ত্রী একবিংশ কংগ্রেসের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের অনুলিপি আপনার সমীপে পাঠাইতেছে।
সিদ্ধান্ত
১। যেহেতু সংযুক্ত ফিলিস্তিন জনফ্রন্ট ও ফিলিস্তিন গণতন্ত্রী জনফ্রন্ট কার্ল মার্কস নির্দেশিত সমাজবাদে বিশ্বাসী, সেইহেতু এই ফ্রন্ট ইসরাইল রাষ্ট্রের সাথে ধর্ম সাম্প্রদায়ভিত্তিক শত্রুতামূলক সকল আচরণ পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছে।
২। এই সংযুক্ত ফ্রন্ট জর্দান, সিরিয়া, ইরাক, মিসর প্রভৃতি দেশের প্রতিক্রিয়াশীল জনগোষ্ঠী ও সরকারকে প্রধান শত্রু বলিয়া মনে করে এবং এদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকেই এই ফ্রন্ট আশু কর্তব্য বলিয়া মনে করিতেছে।
৩। এই ফ্রন্ট তাদের সংগ্রামে ইসারাইল রাষ্ট্রের সাহায্য কামনা করিতেছে বিনিময়ে এই ফ্রন্ট প্রতিশ্রুতি দান করিতেছে যে, এই ফ্রন্ট ইসরাইল বিরোধী সরকার ও সাইমুমের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সবরকম তথ্য পরিবেশন করিবে।
৪। ইসরাইল সরকারের সাথে যোগাযোগ রক্ষার জন্য এই ফ্রন্টের প্রধান জর্জ বাহাশকে ক্ষমতা প্রধান করিতেছে।
জর্জ বাহাশ
চেয়ারম্যান
সংযুক্ত ফিলিস্তিন জনফ্রন্ট
ও ফিলিস্তিন গণতন্ত্রী জনফ্রন্ট
রুদ্ধ নিঃশ্বাসে চিঠি পড়া শেষ করল মাহমুদ। তার দেহের প্রতি অণু পরমাণুতে যেন এক প্রচন্ড লাভাস্রোত বয়ে গেল। লৌহ হৃদয়ও তার কেঁপে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিল তার। কি নিদারুণ বিশ্বাসঘাতকতা! দেশ ও জাতির বুকে কি নিষ্ঠুর ছুরিকাঘাত। ও! ওরা ‘মার্কস এর অনুসারী অন্যজাত, ইহুদীদের পয়সার দালাল। চোখের কোণ ভিজে উঠতে চাইল মাহমুদের। জর্জ বাহাশদের সুপরিকল্পিত শয়তানীর কবলে পরে তাদেরই অসংখ্য ভাই তাহলে আত্মঘাতি পথে পা বাড়ালো?
সাইমুমের তেলআবিবস্থ ৩ নং আস্তানার পতন তাহলে ওদের এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণতি? ওরাই তাহলে মোসাদের মাধ্যমে সিনবেথদের লেলিয়ে দিয়েছে। কথাটা মনে হতেই বিদ্যুৎ স্পর্শের মত চমকে উঠল মাহমুদ। তাহলে তেলআবিবের মতই সাইমুমের ৫০০ টি আস্তনা তো বিপদের সম্মুখীন? বিভিন্ন শহরে অবস্থিত সাইমুমের মূল ঘাঁটিগুলোর সন্ধান জনফ্রন্ট জানে না বটে, কিন্তু প্রতিটি শহরের ১ টি করে আস্তানার ঠিকানা ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার মধ্যে সম্পাদিত পারস্পরিক চুক্তি মোতবেক জনফ্রন্টকে জানান আছে। মাহমুদ তাড়াতাড়ি ডাইরীটা বন্ধ করে চিঠি হাতে করে ছুটলো রেডিও রুমের দিকে।
ব্যস্ত সমস্ত হয়ে মাহমুদকে ট্রান্সমিশন রুমে ঢুকতে দেখে রেডিও অপারেটর ইবনে রায়হান বলল, জরুরী কোন কিছু জনাব?
-হ্যাঁ। সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে মাহমুদ বলল, সব ঠিক আছে তো?
-হ্যাঁ। উত্তর দিল রায়হান।
আর কোন কথা না বলে মাহমুদ নিজেই ট্রান্সমিশন যন্ত্রের পাশে বসে গেল। রায়হান পাশে সহযোগিতা করতে লাগল তার। ট্রান্সমিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে সুইচ টিপে জেরুজালেমের মূল ঘাঁটির সাথে সংযোগ করল মাহমুদ।
-০০১। মারুফ আল কামাল?
-হাঁ, বলছি।
-জরুরী – জরুরী- জরুরী ‘আমাদের সহযোগী জ, ফ, প্রতিষ্ঠান আমাদের প্রতিযোগী কোম্পানীর সাথে হাত মিলিয়েছে। জ, ফ, কোম্পানীর সাথে সম্পর্কিত আমাদের খুচরা বিক্রির দোকানটি বন্ধ করে দিয়ে মালপত্র গোডাউনে ফেরত আনো।
-আচ্ছা আর কিছু?
-না, বলে মাহমুদ কট করে লাইন বন্ধ করে দিয়ে বিভিন্ন এ্যাংগেলে ট্রান্সমিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে সুইচ টিপে ঐ একই ধরনের মেসেজে মাসাদা, খান ইউনুস, বীরশিন, হাইফা, আমাদোদ, ইম কাফে, শারম আল শেখ, ইলাত, গাজা, নাবলুস প্রভৃতি শহরের ঘাঁটিগুলোতে প্রেরন করল। তারপর পশ্চিম সিনাই এর রাফা, আল আরিস, কোয়ানতারা, মিতলা গিরিপথ, বীর লাহফান, ববেল লিবনি, আবু আখিলা পিতসানা, বীর গিফ গাফা প্রভৃতি মধ্য সিনাই এর খান জামিল, বীর আলনাফে, বীর আমন, বীর কাছেম, বীর সালেম প্রভৃতি, পূর্ব সিনাই ও সিনাই পর্বত মালার ওয়াদি গালাফা, আবু দোজানা, জেবেল উল ফজল, জেবেল কহর প্রভৃতি, জেরেুজালেম অঞ্চলের বীর আসির, তেলবায়ত, রামাত রাহেল, আলাতের উত্তর অঞ্চলীয় নেগিভের আউত, সিরটি, আলখারগা, আতসান জেজারিল ভ্যালির আল ফাসের, আর ওবেদি, হারার হুলেহ ভ্যালির আল-খাজাল, আল-আলামিন এবং গোলান হাইটের আল কুইনিত্রা ও আল বেনিয়াস ঘাঁটিতে সে মেসেজের প্রথম অংশ পাঠিয়ে দিল। জনবিরল এইসব অঞ্চলের ঘাঁটি কিংবা আস্তানার সন্ধান জনফ্রন্টকে জানানো হয় নাই, কারণ এসব অঞ্চলের কোন ঘাঁটি বা আস্তানার পতন ঘটলে নতুন করে তা প্রতিষ্ঠা করা এসব অঞ্চলে খুবই কঠিন।
ঘেমে উঠেছে মাহমুদ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে তার। রাত তখন সাড়ে তিনটা। ইসরাইলের সব ঘাঁটিতে সংবাদ পাঠান শেষ করে ট্রান্সমিটারের কাঁটা ঘুরিয়ে আম্মানস্থ হেড কোয়াটেরের সাথে সংযোগ করল মাহমুদ।
-১০০০?
-হাঁ কে আপনি?
-০১১, মাহমুদ! আপনি?
-আবদুল্লাহ আমিন।
মেসেজ রেকোর্ড করুন, বলে মাহমুদ মিঃ চেচিনের ডাইরীতে প্রাপ্ত সমস্ত চিঠিটা সাইমুমের বিশেষ কোডে পাঠিয়ে দিল।
কপালের ঘাম মুছে মাহমুদ উঠে দাঁড়াল। রায়হানের দিকে চেয়ে হেসে বলল মাহমুদ বিস্মিত হয়েছো রায়হান? ভুলে যাচ্ছে কেন, আবদুল্লাহ বিন ওবাই এর জন্মতো যুগে যুগে হবে। বলে মাহমুদ বের হয়ে এল ট্রান্সমিশন রুম থেকে।
তখন রাত ৩টা ৪৫ মিঃ। মাহমুদ তার ঘরে ফিরে গিয়ে টেবিলে বসল, মিঃ চেচিনের ডাইরীটা আবার মেলে ধরল চোখের সমনে। গভীর রাতের নিঝুম প্রহর। মাহমুদ হাত ঘড়ি থেকে ক্ষীণ কম্পন জাগছে বাতাসে -টিক, টিক, টিক -বয়ে চলেছে সময়।
৮
রাত তিনটা পয়ঁতাল্লিশ মিনিটা। তেলআবির থেকে মাহমুদের পাঠান মেসেজের প্রতি চোখ বুলিয়ে থেকে বিদ্যুৎ স্প্রিংএর মত উঠে দাঁড়াল আহমদ মুসা।
মনে হল কি এক তীব্র বেদনায় তার সারা মুখমন্ডল নীল হয়ে গেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে ভাব তার কেটে গেল আর চোখ দু’টি জ্বলে উঠল। মুখমন্ডল হয়ে উঠল শক্ত। কয়েকবার অস্থিরভাবে পায়চারি করল সে। তারপর দেয়ালে টাঙ্গানো জর্দানের মানচিত্রের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপর তার দৃষ্টি স্থির হয়ে দাঁড়াল। জেবেল আল শামছ -সংযুক্ত জনফ্রন্টের হেড কোয়ার্টার। ওরা আজ এক মিটিং এ এসেছে। ভালো হল পাওয়া যাবে এক সঙ্গে। কিন্তু জর্জ বাহাশ নেই। গেছে উত্তর ভিয়েতনাম সফরে। ওর জন্য দন্ড তোলা রইল।
আহমদ মুসা চেয়ারে গিয়ে বসল। বাম পাশের এক সুইচে মৃদু চাপ দিল। কিছুক্ষণ পরে পাশের কক্ষ থেকে আহমদ মুসার সেক্রেটারী আলি বিন সাকের এসে হাজির হল। আহমদ মুসা বলল, জাফর যুবায়ের ও ইউসুফকে তৈরী হতে বলো। জীপ রেডি আছে কিনা দেখো। এহসান সাবরিকে এখনি আমার কাছে আসতে সংবাদ দাও।
সাইমুমের এ্যাকসন স্কোয়াডের আম্মানস্থ অধিনায়ক এহসান সাবরি আহম্মদ মুসার কক্ষে প্রবেশ করল। আহম্মদ মুসা দাঁড়িয়ে ছিল। এহসান সাবরিকে বসতে বলে সেও চেয়ারে গিয়ে বসল। আহমদ মুসা এহসানকে জনফ্রন্টের ষড়যন্ত্রের কথা জানিয়ে বলল, আমি জেবেল আল শামছ এ যাচ্ছি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ১০০ জন মুজাহিদ নিয়ে তুমি এস। তুমি ৫০ জন মুজাহিদ নিয়ে বাব উল মাশরেক নিয়ে জেবেল যাবে এবং তালাবের নেতৃত্বে অন্য ৫০ জনকে বাব-উল-শেমাল দিয়ে প্রবেশ করতে বলবে। বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। এহসানও উঠল। এহসান সাবরি বের হয়ে যেতেই আলি বিন শাকের ঘরে ঢুকলো। বলল, সব রেডি জনাব।
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে আলির হাতে একটি চিঠি দিয়ে বলল, ‘মেসেজটি জেবেলে আমাদের হেড কোয়ার্টারে ইবনে সাদের কাছে এখনি পৌছে দিবে। বাদশাহ আবুল হিশামের (জর্দানের বাদশাহ) কাছে এ মেসেজ পাঠানো হয়েছে। অন্যান্য সকল আরব রাষ্ট্র প্রধানের কছে এ মেসেজ অবিলম্বে পৌঁছাতে হবে। ইবনে সাদ হেড কোয়ার্টারে প্রধান রেডিও বার্তা প্রেরক।
জাফর, যুবায়ের ও ইউসুফ অপেক্ষা করছিল। আহমদ মসা গাড়ীতে উঠতেই গাড়ী ছেড়ে দিল। সাইমুমের নাইট অপারেশনের কালো রংয়ের বিশেষ ইউনিফর্ম তাদের পরিধানে। দু’টি করে রিভলভার ছাড়া অন্যকোন অস্ত্র নেই তাদের কাছে।
আম্মান থেকে যে মহা সড়ক উত্তর দিকে গেছে,সেই সড়ক দিয়ে তীর বেগে ছুটে চলেছে আহমদ মুসার গাড়ী। রাতের নিস্তব্ধ প্রহর। জমাট অন্ধকার চারিদিকে। চাঁদ নেই তারার মেলা বসেছে আকাশে।
আহমদ মুসা ভাবছে, সাবধান হবার সুযোগ না দিয়েই ওদের কছে পৌছতে হবে। তাই যথা সম্ভব রক্তপাত ও সংঘর্ষ এড়াতে হবে। প্রহরীদেরকে নিঃশঙ্ক করার জন্যই মুসা নিরস্ত্র অবস্থায় এসেছে।
আম্মান থেকে ৭০ মাইল দূরে জেবেল আল শামছের পূর্ব দিকের প্রবেশ মুখ বাব -উল -মাশরেকের সন্নিকটবর্তী হল মুসার গাড়ী। গাড়ীর হেড লাইটের আলো বাব -উল -মাশরেকে গিয়ে পড়েছে। ষ্টেনগান উচিয়ে প্রহরীরা দাঁড়িয়ে আছে দেখা যাচ্ছে। দ্বিধাহীন গতিতে আহমদ মুসার গাড়ী গিয়ে ওদের সামনে থামল। গাড়ী থামাতেই ওরা দাঁড়াল চারিদিক থেকে। গাড়ী থেকে ওরা চারজনই নামল। আহমদ মুসাকে দেখে জনফ্রন্টের প্রহরীরা পিছিয়ে দাঁড়াল কয়েক পা। উচিয়ে ধরা ষ্টেনগান নেমে পড়ল তাদের। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা যেন বিহবল। আহমদ মুসা বলল, বাজাজ ডেকেছে, জরুরী কাজ আছে ।
আবদুর রহমান বাজাজ সংযুক্ত জনফ্রন্টের সেক্রেটারী জেনারেল। প্রহরীরা পরস্পর মুখ চাওয়া চাওয়ি করল, তারপর পথ ছেড়ে দুই পাশে সরে দাঁড়াল তারা। আহমদ মুসার গাড়ী এগিয়ে চলল। পথে আরও দু’জায়গায় দাঁড়াতে হল, কিন্তু কোন অসুবিধা হল না তাদের। প্রহরীরা কোনই সন্দেহ করতে পারেনি। আহমদ মুসা ভাবল জনফ্রন্টের ঊর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিদের ষড়যন্ত্রের বিষয় বোধ হয় এ বেচারাদের পুরোপুরি অবহিত করা হয়নি। হয়তো বা আদৌ জানান হয়নি। তাছাড়া কর্তা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিষয়টি সম্পূর্ণ বুঝে উঠা এ সরল মুসলিম যুবকদের পক্ষে খুব সহজনয়। সুতরাং বিষয়টির প্রয়োজনীয় গুরুত্ব সম্পর্কে তারা কিছুটা অবচেতন থাকবে – সেটাই স্বাভাবিক। সর্বোপরি মুক্তিফ্রন্টের সকল অঙ্গ দল, এমন কি আরব রাষ্ট্রগুলোর উপর সাইমুমের আহমদ মুসার প্রভাবের বিষয় তারা অবহিত আছে।
গাড়ী ছেড়ে দিয়ে অসমান গিরি পথ দিয়ে আহমদ মুসারা হেঁটে চলছিল।
জেবেল আল শামছের গুহার মুখে একটি চৌকোণ পাথুরে বাড়ী। সুদৃঢ় দেয়ালের মাঝখানে ভিতরে প্রবেশের একটি মাত্র পথ। গেটে দু’জন ষ্টেনগানধারী প্রহরী। আহমদ মুসা ও তার অনুচররা শান্ত ও প্রসন্নমুখে সেখানে এসে দাঁড়াল। দূরে থাকতেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রহরীদ্বয় তাদের পরীক্ষা করছিল। কি ভাবল তারা, নিজেদের স্থারে একটু নড়ে চড়ে দাঁড়াল। আহমদ মুসা স্বাভাবিক দ্রুত কন্ঠে বল মিটিং শেষ হয়নিত?
-জি না, একজন প্রহরী জবাব দিল।
-বাজাজ আমাদের ডেকেছেন।
একটু অপেক্ষা করতে হবে আপনাদের জনাব। বলে প্রহরীটি দরজার বাম পাশের দেয়ালে রক্ষিত সুইচ বোর্ডটি উপরে ঠেলে ধরল। সুইচ বোর্ডটি উপরে উঠে গেলে নিচে দেয়ালের সমান্তরাল করে বসিয়ে রাখা একটি কাল বেজের উপর ক্ষুদ্র একটি সাদা বোতাম দেখা গেল। বোতমে চাপ দিতেই ইস্পাতের ভারি দরজাটি নিঃশব্দে খুলে গেল।
একজন প্রহরী খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আহমদ মুসা ইউসুফকে একটি সংকেত দিয়ে, জাফর ও যুবায়েরকে নিয়ে খোলা দরজা পথে ভিতরে ঢুকে পড়ল। প্রহরীটি কয়েকপদ এগিয়ে ছিল মাত্র। পেছনে পদশব্দ শুনে ফিরে তাকাল। কিন্তু ততক্ষণে যুবায়েরের রিভলভার তার কপাল লক্ষ্যে উঠে এসেছে। ভয়ে মুখ তার বিবর্ণ হয়ে গেল। জাফর দ্রুত গিয়ে তার নাকে ক্লোরফর্মের রুমাল চেপে ধরল।
এদিকে ইউসুফ অপর প্রহরীটির কাছ থেকে ষ্টেনগানটি কেড়ে নিয়ে তাকে ঘুম পাড়িয়েছে জাফরের মত একই উপায়ে।
একটি ষ্টেনগান নিয়ে ইউসুফকে গেটে থাকতে এবং অপরটি নিয়ে যুবায়ের ও জাফরকে আসতে বলে আহমদ মুসা দ্রুত মিটিং রুমের দিকে চলল।
সংযুক্ত জনফ্রন্টের সেক্রেটারিয়েটে বসেছে মিটিং। প্রবেশের দরজাটি বন্ধ ছিল না, ভেজানো ছিল মাত্র। দরজাটি ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করল আহমদ মুসা।
একটি প্রকান্ড সেক্রেটারিয়েট টেবিল ঘিরে বসে আছে ১১ জন মানুষ। একটি রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে আবদুর রহমান বাজাজ। তার সামনে বিরাট একটি ফাইল। তার পাশের বড় রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে জনফ্রন্টের সহ সভাপতি আবদুল করিম হাসুনা। জর্জ বাহাশের অনুপস্থিতে সেই আজকের মিটিং এর সভাপতি। সেক্রেটারিয়েট টেবিলটির অন্য পাশে গোল হয়ে বসে আছে সংযুক্ত জনফ্রন্টের কার্যকরী কমিটির নয় জন সদস্য। দরজা খোলার শব্দে চোখ ফিরাল তারা দরজার দিকে। আহমদ মুসাকে দরজায় দাঁড়ানো দেখে বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়ল সবাই। তাদের বুদ্ধির উপর দিয়ে যেন হিম শীতল এক স্রোত বয়ে গেল। কিন্তু আবদুর রহমান বাজাজ ও আবদুল করিম দ্রুত সামলে নিল নিজেকে। তারা দু’জনেই পকেটে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা হেসে বলল, আব্দুর রহমান, আবদুল করিম পকেট থেকে আর হাত বের করো না। লাভ হবে না কোনও। বাইরে মোতায়েন তোমাদের সব লোক ধরা পড়েছে, সবদিক ঘিরে ফেলা হয়েছে তোমাদের এ ঘাঁটি।
আহমদ মুসার কথাগুলো শান্ত কিন্তু দৃঢ়। হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে তা যেন আঘাত করে। নিরস্ত্র আহমদ মুসার এ কথাগুলো যেন সম্মোহিত করল ওদের। আবদুর রহমান কিংবা আবদুল করিম কারুরই হাত পকেট থেকে বের হলো না। মনে হল, আহমদ মুসার কথা তারা অবিশ্বাস করেনি।
জাফর ও যুবায়ের এসে ঘরে ঢুকল। আহমদ মুসা বলল, জাফর ওদের সব অস্ত্র নিয়ে নাও। পাঁচমিনিটের মধ্যে ওদের সকলকে বাঁধা হয়ে গেল। আহমদ মুসা এগিয়ে গিয়ে বাজাজের ফাইলটি তুলে নিল। ফাইলের দিকে মুহূর্তকাল তাকিয়ে বলল, সাইমুমের অবস্থান সমূহের তথ্য যোগাড় করছ কার জন্য বাজাজ, তোমার প্রভু ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর জন্য? বলে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় বাজাজের দিকে। তারপর বলল, ইসরাইলকে যে সব তথ্য সরবরাহ করেছ, তার ফাইল কোথায়? বাজাজ কোন উত্তর দিল না। আহমদ মুসা বলল, সময় নষ্ট করো না বাজাজ। তুমি তো জান কথা কেমন করে বলাতে হয়, সে পদ্ধতি আমার জানা আছে।
এই সময় পূর্ব ও উত্তর দিক থেকে ভারী মেশিনগানের শব্দ শোনা গেল। মাত্র মিনিট দেড়েক। তারপর সব নীরব।
বাজাজ বলল, টেবিলের ড্রয়ারের তলায় বোতাম আছে। বোতামে চাপ দিলে টেবিলের নিচে মেঝের কিছু অংশ সরে যাবে, সেখানে পাবে একটি আয়রণ সেল্ফ, তাতে সব পাবে।
আহমদ মুসা জনফ্রন্টের সদস্য সাবির জামালের দিকে চেয়ে বলল, তুমি বোতামে চাপ দাও। সত্যই টেবিলের নিচে আয়রণ সেল্ফ পাওয়া গেল এবং তাতে পাওয়া গেল এক স্তুপ ফাইল। ফাইলগুলোর হেডিং একবার পরীক্ষা করল আহমদ মুসা। এহসান সাবরি এসময় ঘরে প্রবেশ করল।
-সংবাদ কি এহসান? আহমদ জিজ্ঞাসা করল।
-ওরা সকলে আত্ম-সমর্পন করেছে জনাব। বলল এহসান সাবরি।
-বেশ, তুমি রক্তক্ষয় এড়াতে পেরেছ। শয়তানরা তো আমাদের মধ্যে আত্মঘাতি সংঘর্ষ লাগিয়ে আমাদের দুর্বল করতে চায়।
কিছুক্ষন হাসল আহমদ মুসা। তারপর বলল, আমরা এদের নিয়ে চলে যাচ্ছি। তুমি গোটা ঘাঁটি সার্চ্চ করে ওদের নিয়ে এস।
১১ জন বন্দীকে নিয়ে, জাফর, যুবায়ের ও ইউসুফ আহমদ মুসার সাথে আম্মানের ঘাঁটিতে ফিরে এল। আহমদ মুসা তাঁর চেয়ারে এসে বসতেই আলি সাবের এসে জানাল বাদশাহ তাঁর খোঁজ করেছিলেন।
আহমদ মুসা তার পাশে সাদা রং এর টেলিফোনটি তুলে নিল।
-হ্যালো , আহমদ মুসা বলছি।
-আচ্ছালামু আলায়কুম, আবুল হিশাম বলছি।
-ওয়াআলায়কুম ছালাম। জনাব কি আমার খোঁজ করেছিলেন?
-জি, হাঁ। আপনার পাঠানো মেসেজ পেয়েছি। মারাত্মক সংবাদ। শাহ সউদ মিসরের আনোয়ার রশিদ
-জ্বি হাঁ। সব আরব রাষ্ট্র প্রধানের কাছে মেসেজটি পাঠানোর নির্দেশ আমি সংগে সংগে দিয়েছি।
-যাক, আমার ভার লাঘব করেছেন। আচ্ছা জনফ্রন্ট সম্বন্ধে কি চিন্তা করছেন?
-সংযুক্ত জনফ্রন্টের হেড কোয়াটার থেকে এইমাত্র এলাম। জর্জ বাহাশ ছাড়া জনফ্রন্টের কার্যকরী পরিষদের সবাইকে বন্দী করেছি। তাদের হেড কোয়ার্টারের অন্যান্য লোকজনও ধরা পড়েছে। যথসম্ভব দ্রুত জনফ্রন্টের লোকদের গ্রেপ্তার করার জন্য সাইমুমের সব ঘাঁটিতে নির্দেশ পাঠিয়েছে।
-আবদুর রহমান বাজাজ ও আবদুল করিম হাসুনার খবর কি? হাঁ, ওরা ধরা পড়েছে।
আলহামদুলিল্লাহ্ আল্লাহ আপনানের হাত কে আরো শক্তি শালী করুন।
-দোয়া করুন জনাব, ফিলিস্তিনের মুক্তি যেন আল্লাহ ত্বরান্বিত করেন এবং বিশ্বের মজলুম মানুষের মুক্তির যেন এটা হয় শুভ পদক্ষেপ।
-আল্লাহ সহায়। তিনি সর্বশক্তিমান।
-জনাব, সংযুক্ত আরব কমান্ড এবং নিখিল আরব নিরাপত্তা কাউন্সিলের শীর্ষ বৈঠকের কতদূর?
-সব ঠিকঠাক, তারিখ নির্দিষ্ট করার বাকী আছে।
-আসছে পবিত্র রবিউল আউয়ালের ১২ তারিখের মধ্যে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে ভালো হয়।
-দোয়া করুন। রাখি এখন।
-আচ্ছা, খোদা হাফেজ।
-খোদা হাফেজ। টেলিফোন রেখে রিভলভিং চেয়ারেটিতে গা এলিয়ে দিল আহমদ মুসা। ক্লান্তিতে গোটা শরীর ভেঙ্গে আসছে। পূর্বের জানালা দিয়ে আসা স্নিন্ধ বাতাস খু্ব ভালো লাগছে তার। ঘুমে জড়িয়ে আসতে চাইছে চোখ। হঠাৎ চারদিকের নীরবতা ভেঙ্গে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ শোনা গেল। আম্মানের শাহী মসজিদের উঁচু মিনার থেকে ভেসে আসছে আজান। আজানের মধুর ধ্বনি কেঁপে কেঁপে মিলিয়ে যাচ্ছে নিঃসীম নভোমন্ডলের ইথার কণায়। মোয়াজ্জিন ডাকল, হায়া আলাচ্ছালাহ। আহমদ মুসার মন মুহূর্ত ছুটে গেল জেরুজালেমের মুসলিম জনপদে। ওরা কি এই ধ্বনি এমনি করে শুনতে পাচ্ছে? মসজিদুল আকসার মিানার থেকে মোয়াজ্জিন কি এ আহবান জানাতে পারছে নিরুদ্বেগ চিত্তে? চোখের কোণ ভিজে উঠল আহমদ মুসার। ফিলিস্তিনী মজলুম ভাইদের মুক্তির সোনালী দিগন্ত আর কত দূরে? তেলআবিব, হাইফা, জেরুজালেম, ইলাত হেব্রন, গাজা প্রভৃতি শহরের মসজিদের মিনার শীর্ষ থেকে কবে মোয়াজ্জিনের এমনি স্বাধীন কণ্ঠ শোনা যাবে? সুবেহ সাদেরকের স্বর্গীয় স্পর্শে পূর্ব দিগন্ত শুভ্র হয়ে উঠেছে। আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল অজু করার জন্য।
৯
জেবেল আলনুর। সাইমুমের হেড কোয়ার্টারের বিচার কক্ষ। প্রধান কাজী শেখ আলী কুতুব কাজীর আসনে সমাসীন। জনফ্রন্টের সদস্যদের বিচার আজ। জনফ্রন্টের মোট পাঁচ হাজার সদস্য ধরা পড়েছে এবং নেতৃবৃন্দের মধ্যে জর্জ বাহাশ ছাড়া সকলেই বন্দী হয়েছে।
আবদুর রহমান বাজাজ এবং আবদুল করিম হাসুনাসহ ২৭ জন জনফ্রন্ট কর্মকর্তা আসামীর কাঠগড়ায় দন্ডায়মান। বাদী মুসলিম জনগণের পক্ষে সাইমুম প্রধান আহমদ মুসা। বাদীর পক্ষ থেকে আরজি পেশ করতে এলেন আহমদ খলিল। তিনি বললেন, আসামী জনফ্রন্টের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বাদী পক্ষের আরজ এই যে,
১। আসামীরা মুসলিম মিল্লাত থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে সম্পূর্ণ ভিন্ন মতাদর্শের দুশমনদের আনুগত্য স্বীকার করেছে;
২। আসামীরা তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও আরব রাষ্ট্র সমূহের সাথে সম্পাদিত চুক্তির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে ;
৩। আসামীরা মুসলিম জনগণের শত্রু ইসরাইলের সাথে আঁতাত করে নিম্নলিখিত বিশ্বাসঘাতকতার কাজ করেছে;
(ক) ফিলিস্তিনী জনগণের আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত সাইমুমের ইসরাইলস্থ গোপন আস্তানাগুলোর ঠিকানা ইসরাইলকে সরবরাহ করেছে ;
(খ) সাইমুম ইসরাইলের গোপন সামরিক তথ্যাদি সংগ্রহ করছে, এই খবর ইসরাইলকে জানিয়েছে;
(গ) মুসলিম নরনারীর ছদ্মবেশে যে সমস্ত ইহুদী মুসলিম পরিবারে জড়িত থেকে ইসরাইলের জন্য গোয়েন্দাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে, সাইমুম তাদের খুঁজে বের করছে, একথা ইসরাইলকে জানিয়েছে এবং নতুন করে গোয়েন্দা চক্র স্থাপনের জন্য সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
৪। আরবের মুসলিম জনগণ, আরব রাষ্ট্র এবং সাইমুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রমূলক কাজের সিদ্ধান্ত আসামীরা গ্রহণ করেছে। পরিশেষে আহমদ খলিল বলল বাদী পক্ষের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আপনার কাছে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ও নথিপত্র পেশ করা হয়েছে।
কাজীর পক্ষ থেকে আসামীদেরকে জিজ্ঞাসা করা হলো, বাদীর অভিযোগ তারা স্বীকার করে কিনা। আবদুর রহমান বাজাজ কাজীর প্রশ্নের জবাব না দিয়ে জানাল, আমাদের বিচার করবার কোন ক্ষমতা আপনাদের আইনের নেই।
-‘আপনাদের আইন’ বলতে আসামী মুসলিম আইন বুঝিয়েছেন কি? কাজী আলী কুতুব জিজ্ঞাসা করলেন।
কাজীর প্রশ্নটির কোন জবাব আবদুর রহমান বাজাজ দিল না।
আবদুর রহমান বাজাজের কথাই উপস্থিত সকল আসামীর কথা কিনা কাজী সাহেব জানতে চাইলেন। আসামীরা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
কাজী আলী কুতুব গভীর অভিনিবেশ সহকারে কিছুক্ষণ সম্মুখের নথিপত্র নাড়াচাড়া করলেন। তারপর কলম তুলে নিলেন হাতে।
তিনি ঘোষণা করলেনঃ আসামীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত এবং প্রমাণিত অভিযোগ অনুযায়ী আসামীগণ দুই ধরনের অপরাধে অপরাধী। প্রথমতঃ মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শত্রুদের সাথে যোগ দিয়েছে। অপরাধের প্রকৃতি হিসাবে প্রথম অপরাধটি প্রধান এবং দ্বিতীয় অপরাধ প্রথম অপরাধের অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া মাত্র। এই দিক দিয়ে আসামীদের একটিই মূল অপরাধ এবং তা হলো, ইসলামের আনুগত্যের অস্বীকৃতি এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারীদের বিরুদ্ধে কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, ইসলামের ইতিহাসে তার জলন্ত প্রমাণ রয়েছে। রসূলুল্লাহ (সঃ) এর মৃত্যুর পর আরবের কতিপয় সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তি ইসলামের আনুগত্য অস্বীকার এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা উত্তোলন করে। চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি স্বত্ত্বেও আমিরুল মোমিনিন হযরত আবুবকর (রাঃ) ইসলামের প্রশ্নে কোন আপোস কনসেশনের বিষয় নীতি বিরুদ্ধ ঘোষণা করে বিদ্রোহী মুরতাদদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ইসলামের আনুগত্যে পুনরায় ফিরে না এসেছ এমন প্রতিটি বিদ্রোহীকে হত্যা করা হয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যুদন্ডই হলো ইসলামের আনুগত্য অস্বীকারকারী বিদ্রোহীদের একমাত্র শাস্তি। ইসলামী সংবিধানের নির্দেশও তাই। আমাদের বর্তমান আসামী অর্থাৎ জনফ্রন্টের বিদ্রোহী আসামীদের বেলায়ও এই আইনই প্রযোজ্য। তারা অনুতপ্ত হয়ে যদি ইসলামের আনুগত্যে পুনরায় ফিরে আসে, তাহলে তাদের প্রথম অপরাধ ক্ষমার যোগ্য। এক্ষেত্রে তাদের দ্বিতীয় অপরাধের শাস্তি হিসেবে ফিলিস্তিনের সার্বিক মুক্তি না আসা পর্যন্ত তাদেরকে কারাগারে আটক থাকতে হবে। আর যদি ইসলামের আনুগত্যে ফিরে আসতে অস্বীকার করে তাহলে মৃত্যুই হবে তাদের শাস্তি। রায় ঘোষণা শেষ হতেই আসামীর কাঠগড়া থেকে সংযুক্ত জনফ্রন্টের ওয়ার্কিং কাউন্সিলের সদস্য আবদুল্লাহ ওয়াসিম এবং হাসান তালাত উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা আমাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। আমরা ইহুদীরের অর্থের প্রলোভনে পড়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা ও মজলুম ফিলিস্তিনীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকাতা করেছিলাম। আমারা মার্কসের সমাজ দর্শনকে ইসলামী জীবন ব্যবস্থার বিকল্প মনে করতে পারি না। আমরা আমাদের পদস্থলনের জন্য রাববুল আলামিন আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থী। তিনি দয়া করে আমাদের ক্ষমা করুন।
কাঠগড়ার অপর পঁচিশ জন আসামী মাথা নত করে দাঁড়িয়ে রইল। আসামীদেরকে কাঠ গড়া থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। পরে জনফ্রন্টের পাঁচ হাচার আসামী মুজাহিদের বিশজন প্রতিনিধিকে এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হলো। তাদের বিরুদ্ধেও ঐ একই অভিযোগ এবং কাজী আলী কুতুব ঐ একই রায় ঘোষণা করলেন। জনফ্রন্টের সদস্যরা শান্তচিত্তে ও নতমস্তকে অভিযোগ ও রায় শ্রবণ করলো। রায় ঘোষণা শেষ হলে, আসামী পক্ষ থেকে এক জন বলল, বাদী পক্ষ থেকে যে অভিযোগ সমূহ উত্থাপন করা হছেয়ে, আমরা বন্দী দশায় এসে তা জানতে পারলাম। এ সম্বন্ধে আমাদের বক্তব্য হলো, বিভিন্ন ভালো দিকের কথা আমাদের বলা হতো। কিন্তু আমাদের কর্তৃপক্ষ যে ইসলামের গন্ডী থেকে বেরিয়ে গিয়ে মার্কসের দর্শন গ্রহণ করেছেন, আমরা তা অবহিত নই। আমাদের নেতৃবৃন্দ যে আমাদের শত্রুদেশ ইসরাইলের সাথে আতাঁত করেছেন আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিষ্ঠান সাইমুম এবং আমাদের সাহায্যকারী আরব রাষ্ট্র সম্পর্কে বিভিন্ন গোপন তথ্য সরবরাহ করেছেন, আরব রাষ্ট্রসমূহ ও সাইমুমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রস্ততি নিচ্ছেন, আমরা সে সম্পর্কে ঘূনাক্ষরেও কিছু জানি না। এমন কি ইসরাইলস্থ জনফ্রন্টের ঘাঁটি সমূহের কর্মকর্তারাও সংস্থার নেতৃবৃন্দের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবহিত নয়। নেতৃবৃন্দ সরাসরি ইসরাইল রাষ্ট্রপ্রধানদের সাথে যোগাযোগ করেছেন। সাইমুমের আস্তানা সমূহের ঠিকানাও আমাদের নেতৃবৃন্দ সরাসরি ইসরাইল নেতৃবৃন্দকে জানিয়েছেন। আমরা সজ্ঞানে কোন অপরাধ করিনি। ষোল তারিখ রাতে এক জরুরী বার্তায় আমাদেরকে জানানো হয় যে, সাইমুমের সাথে আমাদের মতান্তর দেখা দিতে পারে, বিভিন্ন স্থানে ওদের অবস্থান, ওদের সংখ্যা ওদের কার্যকলাপ ও কার্যপদ্ধতির বিশদ বিবরণ হেড কোয়ার্টারে পৌঁছাও এবং কোন কাজে ওদের সহযোগিতা করো না। এ নির্দেশ ছাড়া ইসরাইলসস্থ আমাদের সহকর্মীদেরকে অতিরিক্ত আর একটি নির্দেশ দেওয়া হয় এবং তা হলো – ষোল তারিখ রাতেই তারা যেন সমস্ত পুরাতন ঘাঁটি ছেড়ে দেয়। এ নির্দেশ আমাদের প্রতিও ছিল, আমাদের জন্য পুরাতন ঘাঁটি ছেড়ে দেবার সময় নির্দিষ্টি ছিল ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় জেবেল আল-শামছের আমাদের হেড কোয়ার্টারও অন্যত্র স্থানান্তরিত হতো। কিন্তু এ পরিকল্পনার ১২ ঘন্টা আগেই সাইমুম তাদের সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে এগিয়ে যায়। আমাদের এই বক্তব্যের আলোকে মহামান্য আদালত সমীপে বন্দী ৫ হাজার মুজাহিদের তরফ থেকে আমাদের আরজ, আমরা নির্দোষ। আমরা জ্ঞানতঃ আমাদের রসূল (সঃ) এবং আমাদের ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করিনি এবং এ ধরনের কোন পরিকল্পনাও করিনি। আমরা আমাদের ভ্রাতৃ প্রতিষ্ঠান সাইমুম এবং কোন আরব রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জ্ঞানতঃ কোন ষড়যন্ত্রে যোগ দেইনি কিংবা এ ধরনের কোন ইচ্ছাও পোষণ করিনি।
জনফ্রন্টের ৫ হাজার মুজাহিদ বেকসুর খালাস হয়ে গেল। পরে তারা সাইমুমের সঙ্গে এক সাথে কাজ করার জন্য শপথ গ্রহণ করল। আহমদ মুসা তাদেরকে রাজনৈতিক শিক্ষা ও সামরিক ট্রেনিং গ্রহণের জন্য সউদী আরবের আল-আসির এলাকার একটি পাঠিয়ে দিল। সাইমুমের রাজনৈতিক শিক্ষার মধ্যে ইসলামী শিক্ষা, ইসলামী জীবন দর্শনের সার্বজনীনতা এবং জগতের অন্যান্য মতাদর্শের পরিচয় শামিল রয়েছে। সাইমুমের সদস্য হওয়ার জন্য এই জ্ঞানলাভ অপরিহার্য। এই কড়াকড়ি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলে আহমদ মুসা বলেন, এই জ্ঞানটুকু ছাড়া এক জন মুসলমান তার আত্ম পরিচয় লাভ করতে পারে না। আত্ম পরিচয়ই যে পেলো না, সে নিজের এবং দুনিয়ার অপর কারও কোন উপকার করতে পারে না।
১০
তেলআবিব সেক্রেটারীয়েট ভবনের প্রতিরক্ষা বিভাগ। বিরাট সিটিং রুম। কাল কার্পেটে মোড়া মেঝে। সোফা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো ঘর। মাঝখানের সোফাটিতে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক, তাঁর ডান পাশের সোফাটিতে রয়েছে ডেভিড বেঞ্জামিন এবং বাম পাশে আছেন এস্কোল। তারপর একে একে বসেছেন নিরাপত্তা ও কাউন্টার ইনটোলিজেন্স কার্যক্রমের জন্য দায়ীত্বশীল ‘সিনবেথ’ এর প্রধান জেনারেল শামিল এরফান,বিদেশে গোয়েন্দা কর্ম পরিচালসার প্রতিষ্ঠান ‘মোসাদ’ প্রধান মেজর জেনারেল লুইস কোহেন,মিলিটারী ইনটেলিজেন্স বিভাগ‘শোরুত মোদিন’এর প্রাধন জেনারেল মরদেশাই হড, রাজনৈতিক তথ্যাদির গোয়েন্দা কর্ম পরিচালনার প্রতিষ্ঠান ‘রিসুত’ এর প্রধান ইসাক রিজোক। ডেভিড বেঞ্জামিনের ডান পাশে বসেছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোশে হায়ান এবং ইসরাইল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ইসরাইল তাল। এ ছাড়া উপস্থিত আছেন ইসরাইল পার্লামেন্টের তিনজন প্রতিনিধি সদস্য।
ইসরাইলের সুপ্রীম সিকিউরিটি কাউন্সিলের এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করছেন প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক। তিনি ধীরে ধীরে বললেন, ‘‘ইসরাইলের সুসন্তান উপস্থিত ভদ্রমহোদয়গণ, বিগত কিছু দিনের ঘটনা প্রবাহ আমাদের জন্য বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে তেলআবিবের নিরাপত্তা প্রধান মিঃ চেচিনের মৃত্যু, ওসেয়ান কিং জাহাজের ভয়াবহ র্দুঘটনা এবং জেরুজালেম ও ইলাতের ক্ষেপনাস্ত্র ঘাঁটির সর্বাত্মক ক্ষতি সাধন শুধু সামরিক দিক দিয়ে উদ্বেগের নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিকে ও দুর্বল করে দিয়েছে। দেশের ভিতরে এবং বাইরে আমরা তীব্র সমালোচনা সম্মুখীন হয়েছি। ইসরাইলের সুমান ক্ষুণ্ণ হয়েছে অনেকখানি। এখানেই শেষ নয়, এক দুর্যোগের কালো মেঘ আমাদের পৃতিভূমিকে গ্রাস করতে আসছে। আমাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করবেন। মোশে হায়ান নড়ে চড়ে বসলেন। ফাইলটি নেড়ে চেড়ে সামনে ধরলেন। তাঁর গম্ভীর কন্ঠে ধ্বনিত হলো ‘‘ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের তথ্য সরবরাহকারী এজেন্সি সমূহ যে সব তথ্য সরবরাহ করছেন, যা আমার সামনে উপস্থিত আছে তার আলোকে বলতে হচ্ছে, সম্প্রতি পরিস্থিতির বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ মোড়া নিয়েছে। আপনারা জানেন, ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বহুপূর্ব থেকে একটি সুপরিকল্পিত ব্যবস্থার অধীনে ইহুদী তরুণ তরুণীরা আরব রাষ্ট্রসমূহে মুসলিম নামের ছদ্মবেশ নিয়ে মুসলমান হিসেবে বাস করছিল। আরব রাষ্ট্রসমূহের সামরিক ও বেসামরিক তথ্য সরবরাহের এরাই ছিল উৎস। এরা
নিজের জীবন বিপন্ন করে হলে ও দায়িত্বপালন থেকে পিছ পা হয়নি। ‘কামাল আমিন তাবিজ’ নামের ছদ্মবেশে এলিস কোহেন সিরীয় সেনা বাহিনীর যে তথ্যাদি সরবরাহ করেছিল, আপনারা তা জানেন। স্বীকার করতে হয়, তারই দেয়া তথ্যের উপর নির্ভর করে আমাদের সেনাবাহিনী ১৯৬৭ সালে গোলান হাইট দখল করতে পেরেছিল। এলিস কোহেনের মত হাজার হাজার ইসরাইল সন্তান পিতৃভূমির জন্য তথ্যাদি সরবরাহ করতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে। কিন্তু গভীর দুঃখ ও বেদাসান সাথে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে, মিসর থেকে জর্দান ও সিরীয়ার মধ্য দিয়ে লেবানন পর্যন্ত আমাদের যে স্পাই রিং ছিল, তা আজ ধবংসহয়ে গেছে। এই স্পাই রিং এ কার্য্যরত তিন হাজার ইহুদী যুবক, তিন হাজার পাঁচশত ছাব্বিশ জন ইহুদী নারী নিখোঁজ হয়েছে। এদের অনেকের লাশ পরে পাওয়া গেছে কিন্তু অধিকাংশের লাশ ও পাওয়া যায়নি। এছাড়া ‘মোসাদ’ এবং ‘শেরুত মোদিন’ এর ৫১ জন সুদক্ষ গোয়েন্দা কমী গত দু’বছরে প্রাণ দিয়েছে সীমান্তের ওপারে। সীমান্তের ওপারের এলাকা আমাদের জন্য অন্ধকার হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় আমরা WRF (World Red Forces) এর সহযোগিতায় ফিলিস্তিন সংযুক্ত জনফ্রন্ট ও গণতন্ত্রী জনফ্রন্টের বন্ধুত্ব অর্জন করতে পেরেছিলাম এবং তাদের সহযোগিতায় নতুন ‘স্পাই রিং প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু সে প্রচেষ্টা ও আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। সংযুক্ত জনফ্রন্টের চেয়ারম্যান জর্জ বাহাশ ছাড়া ফ্রন্টের সব নেতৃবৃন্দই ধরা পড়েছেন এবং তাদের ৫ হাজার মুজাহিদ বন্দী হয়েছে। আমরা সংবাদ পেয়েছি, নেতৃবৃন্দের দু’ জন ছাড়া সকলেরই মৃত্যুদন্ড হয়েছে এবং বন্দী মুজাহিদরা ক্ষমা লাভ করে সবাই সাইমুমে যোগ দিয়েছে।
আমরা জনফ্রন্ট সূত্রে জানতে পেরেছিলাম, সাইমুমের অসংখ্য কর্মী ইসরাইলের অভ্যন্তরে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে আছে। সাইমুমের কিছু আস্তানার সন্ধান আমরা পেয়েছিলাম, কিন্তু কোন ফল হয়নি। অদৃশ্য কোন সংকেতে ওরা
যেন হাওয়া হয়ে গেছে। এই পর্যন্ত বলে মোশে হায়ান চুপ করলেন। রুমাল দিয়ে কপালের ঘামটুকু মুছে নিলেন তিনি।
পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ রোজন বার্জ্জ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,‘‘আমাদের সুপরিকল্পিত গোয়েন্দা কার্যক্রমের এতবড় বিপর্যয় কেমন করে সম্ভব হলো? মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অলৌকিক কিছু বিশ্বাস করাতে চাইবেন নাতো?
মোশে হায়ান আবার বললেন,‘‘অলৌকিক কিছু ঘটে নাই বটে, কিন্তু অলৌকিক ভাবেই আমাদের ‘স্পাই রিং’ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, আর এটা সম্ভব হয়েছে ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থা সাইমুমের দ্বারা। এই প্রতিষ্ঠানই আমাদের বন্ধু প্রতিষ্ঠান জনফ্রন্টকে উৎখাত করেছে।
-এই সাইমুম কারা? ২৪ বছরে আরব রাষ্ট্রগুলো যার সন্ধান করতে পারেনি তারা তার ধবংস সাধন করলো কেমন করে? অপর একজন পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ সিমমন উত্তেজিতেভাবে প্রশ্নটি করলেন।
মোশে হায়ান বললেন,‘‘ইসরাইল থেকে বিতাড়িত মুসলিম মোহাজের নিয়ে এই সাইমুম গঠিত। চীনের সিংকিয়াং থেকে বিতাড়িত আহমদ মুসা এই সংগঠনের প্রধান। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের কর্মীরা এ সংগঠনের বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছে। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের স্বেচ্ছাসেবকরা এ সংগঠনের মূল শক্তি। ১৯৩৮ সালের যুদ্ধ অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে মিসরীয় বাহিনীর পাশে অত্যন্ত সক্রিয় যে শত্রু ভয়হীন স্বেচ্ছাসেবকদের দেখেছিলাম আমরা, এরা তাদেরই উত্তরসূরী।
মোশে হায়ান থামলে জেনারেল শামিল এরফান বললেন, ওরা অত্যন্ত বিপদজনকে। মনে পড়ছে আমার সেই যুদ্ধের কথা আমি তখন ইষ্টার্ণ কমান্ডের দায়িত্বে ছিলাম। খবর এল, জেরুজালেমের পার্শ্ববতী ‘সুর বাহির এ ঘাঁটি করে একদল মুসলিম সৈন্য সামনে এগুবার চেষ্টা করছে। ধূর্ত ও কুশলী সেনানায়ক লেঃ কর্ণেল এরিক স্যারনকে ‘আমি এক ব্রিগেড সৈন্য দিয়ে সেখানে পাঠালাম। স্যারন কিন্তু ‘সুর বাহির’ আক্রমণ না করে ৫০ মাইল দক্ষিণে মিসরীয়ে বাহিনীর ডিভিশন পোষ্ট ‘বির সুবীরে’র দিকে চলে গেল। পরে আমি তাকে কারণ জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিয়েছিলঃ
‘‘আমার সুর বাহির আক্রমণ করি নাই, কারণ সেখানে ইখওয়ানুল মুসলিমুনের এক বিরাট স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী মোতায়েন ছিল। ইখওয়ানুল মুসলিমুনের স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়মিত সৈন্যবাহিনী থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের সাধারণ সৈন্যের মত এরা যুদ্ধকে আদেশ সাপেক্ষ নিছক এক দায়িত্ব মনে করে না বরং এ যুদ্ধ এদের কাছে এক ধর্মীয় আবেগের ফল এবং হৃদয়ের একাগ্রতা তারা এ যুদ্ধে নিয়োজিত করে। এ দিক দিয়ে তারা ইসরাইলের জন্য সংগ্রামরত আমাদের সৈন্যবাহিনীর সাথে তুলনীয়। কিন্তু পার্থক্য এই যে, আমরা আমাদের আবাসভূমি জাতীয় রাষ্ট প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছি, আর ওদের কামনা হলো মৃত্যু। শুধু মৃত্যু ভয়হীন নয়, মৃত্যু কামনাকারী এসব মানুষকে আক্রমণ করা হিংস্র বন্যজন্তুর মিছিলে হামলা চালানোর শামিল। আমি এই ঝুঁকি এড়াতে চেয়েছিলাম। তাদের ধর্মীয় আবেগ উদ্দীপ্ত হবার সুযোগ দেয়াকে আমরা উচিত মনে করি নাই। তাদের সে আবেগ অন্যদের মধ্যেও সংক্রমিত হতে পারত যার ফলে ষোল আনা লাভ হতো তাদেরই আর সর্বনাশ হতো আমাদের।’’ জেনারেল একটু থামলেন। তারপর আবার শুরু করলেন, ‘‘আমি আমার এ উদাহরণের দ্বারা কিন্তু সাইমুমের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণকে নিরুৎসাহ করতে চাইনি বরং তারা যে কত বিপদজনক তাই বোঝাতে চেয়েছি। সম্মিলিত আরব কমান্ড আণবিক বোমা দিয়েও আমাদের যা না করতে পারবে, এদের ধর্মীয় আবেগ আমাদের সর্বনাশ করতে পারবে তার চেয়ে বেশী। আরব রাষ্ট্রগুলোর সরকারসমুহের এবং সেনাবাহিনীর উপর সাইমুমের প্রভাব আমাদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার। ওরা যদি ওদের ধর্মীয় আবেগ সকলের মধ্যে সংক্রামিত করতে পারে তা হলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা আমরা কেউ কল্পনাও করতে পারি না।’’ জেনারেল শামিল এরফান তার কথা শেষ করলেন।
জেনারেল মরদেশাই হড বললেন, ‘‘আরব সরকারসমূহ এবং তাদের সেনাবাহিনীর উপর সাইমুমের প্রভাবের সুস্পষ্ট প্রমাণ আমরা পেয়েছি। গত তিনমাসে লেবানন, সিরিয়া, জর্দান ও মিসর সরবার তাদের সেনাবাহিনীর মোট ৩০০ জন উচ্চ পদস্থ অফিসারকে বরখাস্ত ও অন্তরীণাবদ্ধ করেছে। এ ছাড়া ১৫০০ এর মতো ননকমিশনড অফিসার ও সাধারণ সৈন্যকে বরখাস্ত ও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই সমস্ত উচ্চ পদস্থ ও ননকমিশনড অফিসারদের শতকরা নব্বই জনের সাথে আমাদের ছদ্মবেশী গোয়েন্দাদের সম্পর্ক ছিল। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে, এটা কত নিখুঁত অনুসন্ধানের ফল। আমরা জানতে পেরেছি, সাইমুমের দেয়া তালিকা মোতাবেকই সেনাবাহিনীর ঐ সব অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা আরও জানতে পেরেছি মদ্যপান, নাইট ক্লাবে গমণ প্রভৃতিকে আরব সেনাবাহিনীর জওয়ান ও অফিসারদের জন্য অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য করা হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে আরব সেনাবাহিনীকে নতুন নৈতিক ভিত্তির উপর গড়ে তোলা হচ্ছে। ধর্মান্ধ সাইমুমের প্রভাবেরই যে ফল এটা, তা সহজেই অনুমেয়। আপনারা জানেন, নারী, নাইট ক্লাব আর মদ গোয়েন্দা কাজের প্রধান হাতিয়ার সাইমুমকে এ তিনটির কোন একটির আওতায় আনা যায় না বলে আমাদের গোয়েন্দা কার্যক্রম দুর্ভেদ্য বাধার সম্মুখীন হয়েছে। আমরা অনুভব করছি, আরবরা এতদিনে ব্যর্থতার তাদের প্রকৃত কারণ অনুধাবন করেছে। তারা সংশোধিত হচ্ছে ও পূর্ণগঠিত হচ্ছে। আর এ পূনর্গঠন ও সংশোধনের কাজে প্রধান ভূমিকা পালন করছে সাইমুম।’’ জেনারেল হড থামলেন।
সবাই মুখ নীচু করে চুপ বসে আছে। অখন্ড নীরবতা। দেয়ালের ঘড়িটি টিক্ টিক্ করে সময় নির্দেশ করে চলেছে। ধীরে মাথা তুললেন স্যামুয়েল শার্লটক। বললেন, IIt is now all clear, another war is coming near, কিন্তু পথ কি বলুন?’’
আবার নীরবতা। নীরবতা ভঙ্গ করে পার্লামেন্ট প্রতিনিধি মিঃ সিমসন বললেন, ‘‘আমরা ১৯৬৭ সালের পুনরাবৃত্তি করব।’’ মিঃ সিমসনের কথায় ইসরাইল সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল ইসরাইল তালের ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা খেলে গেল। কিন্তু কিছু বললেন না। তিনি জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রধান ডেভিড বেঞ্জামিন এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। এবার তিনি ধীরকন্ঠে বললেন,‘‘১৯৬৭ সালে আমাদের সেনাবাহিনীর সামনে ছিল সিনাই এবং জর্দান উপত্যকার অনুকুল যুদ্ধ পরিবেশ।
দ্বিতীয়তঃ আমাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় স্পাই রিং বিধ্বস্ত এবং তৃতীয়তঃ আরব সেনাবাহিনীর নৈতিক উন্নতি ও তাদের সচেতনতা। সুতরাং ১৯৬৭ সালকে আবার ফিরিয়ে আনতে পারব না।’’ তিনি একটু থামলেন। ধীরে ধীরে আবার শুরু করলেন, ‘‘আমাদের সামনে আজ তিনটি পথ খোলা আছে, এর যে কোন একটি আমাদের অনুসরণ করতে হবে।
১। অবিলম্বে আমাদের যুদ্ধে নামতে হবে এবং গঠনমুখী আরব বাহিনীকে ১৯৬৭ সালের মত বিধ্বস্ত করতে হবে। কিন্তু এটা যে যুক্তিসম্মত নয়, তা আমি আগেই বলেছি।
২। অধিকৃত সব আরব এলাকা ছেড়ে দিয়ে তাদের সাথে আপোষ করতে হবে। কিন্তু আমাদের জাতির কেউই এ সিদ্ধান্ত মেনে নিবে না বিধায় এ সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি না।
৩। যুদ্ধ এড়াতে হবে এবং সেই সুযোগে আরব এলাকায় আমাদের ‘স্পাই রিং, পূনর্গঠিত করে একদিকে তাদের সব তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে অপরদিকে ভিতর থেকে তাদের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করতে হবে। বাইরে থেকে নয় ভিতর থেকে আঘাত দিয়েই শুরু মুসলমানদেরকে পর্যুদস্ত করা সম্ভব। আপনারা জেনারেল শামিল এর ফানের বক্তব্য থেকে বুঝেছেন সাইমুমকে বাইরে থেকে আঘাত দিয়ে ওদের শক্তিকে শুধু বাড়িয়েই তোলা হবে, ক্ষতি কিছু করা যাবে না সুতরাং শক্তির পথ পরিহার করে কৌশলের আশ্রয় নিতে হবে। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার। কিন্তু যুদ্ধ এড়াতে না পারলে কিছুই সম্ভব নয়। যুদ্ধ এড়াতে হলে জাতিসংঘের মাধ্যম গ্রহণ করেত হবে। জাতিসংঘের মাধ্যমে আরবদের সামনে আশার আলো জালিয়ে কালক্ষেপণ করা যেতে হবে। আমাদের সরকার এবং রাশিয়া, বৃটেন, আমেরিকা ও জাতিসংঘ চত্তরের সুযোগ্য ইসরাইল সন্তানরা এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ আছেন।’’
সবাই করতালি দিয়ে ডেভিড বেঞ্জামিনের শেষোক্ত প্রস্তাবকে সমর্থন জানাল। পন্থাটির খুঁটিনাটি দিক নিয়ে আলোচনা চলল তাদের মধ্যে।
ঢং ঢং করে ঘড়িতে রাত ১১ টা বাজল। মিটিং সমাপ্ত করে সবাই উঠে দাঁড়াল। সবার মুখে হাসি কিন্তু জোর করে টেনে আনা রুটিন হাসি, তা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না মোটেই। যুদ্ধ এড়ানোর আশা সবাই করছে, কিন্তু চাইলেই কি যুদ্ধ এড়ানো যাবে? তাছাড়া আরবদের আসন্ন সংগ্রামের প্রকৃতি কেমন হবে, তাই বা কে জানে? প্রধানমন্ত্রীর কথা সকলের মনে নতুন করে জাগছে – ‘‘দুর্যোগের এক কালো মেঘ আমাদের পিতৃভূমিকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে।’’
১১
পরিষ্কার নীলাকাশ। উইলো গাছ আর জলপাইকুঞ্জে সকালের রোদ ঝিলমিল করছে। কোরআন শরীফ বন্ধ করে টিবিলে রেখে এসে মাহমুদ চেয়ারে বসল। সেদিনের দৈনিক কাগজ এসে গেছে, সে দেখতে পেল। কাগজটি উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল মাহমুদ। সিংগল কলাম হেডিং এর একটি ছোট্ট খবরে মাহমুদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। ‘‘বেনগুরিয়ান তনয়ার জন্ম বার্ষিকী।’’ খবরটিতে বেনগুরিয়ান তনয়া এমিলিয়ার একবিংশ জন্ম বার্ষিকী অনুষ্ঠান সূচীর কিছু পরিচয় দেয়া হয়েছে।
এমিলিয়ার নাম মনে পড়তেই মাহমুদের স্নায়ুতন্ত্রীতে এক উত্তপ্ত স্রোত বয়ে গেল। মায়াময় নীল দু’টি চোখ বেদনাপীড়িত মুখ শুভ্রগন্ডে অশ্রুর দু’টি ধারা – বিদায় মুহূর্তের এমিলিয়া মাহমুদের মানসচোখে ফুটে উঠল। মনে পড়ল তার সেই করুণ আকুতি আবার কবে দেখা হবে?’’ মাহমুদ তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি এ পর্যন্ত। অনেকবার মনে হয়েছে কিন্তু মাহমুদ চায়নি ফুলের মত সুন্দর ঐ জীবনটির উপর কোন সন্দেহের মেঘ নেমে আসুক – কোন অসুবিধায় পড়ুক সে। আজ ওর পরম খুশির দিন। মাহমুদ কি পারে না এই খুশির দিনে তার পাশে দাঁড়াতে। মাহমুদের ঠোঁটে ফুটে উঠল এক রহস্যময় হাসি। স্বগতঃ তার কন্ঠে উচ্চারিত হলো – পারি, কিন্তু আকাঙ্খার পরিতৃপ্তিকে জ্ঞান ও কর্তব্যের উর্ধ্বে স্থান দিতে পারি না আমি।
সা’দ আলি ঘরে ঢুকল। পায়ের শব্দে পিছনে ফিরে চাইতেই সা’দ বলল, ‘‘হেড কোয়ার্টারের মেসেজ জনাব।’’
মাহমুদ তাড়াতাড়ি হাত পেতে কাগজটি নিল। দ্রুত চোখ বুলাল কাগজটিতেঃ
World peace brigade এর অধিনায়ক মেজর জেনারেল ওয়ালটার কুট এর বিশেষ প্রতিনিধি হুগো গালার্ট গোপনে তেলআবিব আসছেন। তিনি ১১ তারিখ সন্ধ্যায় বৃটিশ রয়াল এয়ারফোর্সের বিশেষ বিমান যোগে রাত ৯ টা ২৫ মিনিটের সময় তেলআবিব নামছেন।
মাহমুদ স্মরণ করল, মেজর জেনারেল ওয়াল্টার মুটের ইহুদী নাম জেরম ইজাক রোমেন। সুইচ আর্মির প্রাক্তন অফিসার। ওয়াল্টার কুট নাম নিয়েছেন তিনি। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক গোপন ইহুদী আন্দোলনের ইনি একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। আর হুগো গালার্ট হচ্ছেন বার্লিনের দুর্দান্ত ইহুদী জ্যাকব গ্রিমব।
এগার তারিখ অর্থাৎ আজ রাত ৯-২৫ মিনিটে হুগো গালার্ট নামছেন তেলআবিবে। মনে মনে হিসাব করলো মাহমুদ।
গভীর চিন্তায় ডুবে গেল সে। হুগো গালার্ট কি মিশন নিয়ে আসছে? কোন মেসেজ বা কোন গোপন তথ্য? তাই হবে হয়তো। কিন্তু সে সব লিখিতভাবে না মৌখিক কানে কানে। হুগো গালার্ট যখন প্রতিনিধি মাত্র তখন তার মারফতে লিখিত মেসেজ বা তথ্য আসবে, সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু কোন পথে এগুনো যাবে? হুগো যদি পূর্বাহ্নে তার বিপদ আঁচ করতে পারে, তাহলে সব প্রয়োজনীয় রেকর্ড নষ্ট করে ফেলবে। এজন্য এমন স্বাভাবিক পথ অনুসরণ করতে হবে যা হুগোর মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক করবে না। চিন্তা করল মাহমুদ।
মাহমুদ হিসেব করল, বিমান বন্দর থেকে তেলআবিব ৯ মাইল। মিডিয়াম স্পিড যদি ধরা যায় তাহলে এই ৯ মাইল পথ অতিক্রম করতে ৭ থেকে ৯ মিনিট সময় লাগবে। এই সময়কেই কাজে লাগাতে হবে। বহনকারী তথ্যকে হস্তান্তরের সামান্য সুযোগও হুগোকে দেয়া চলবে না। অবশ্য বিমান বন্দরেই হুগো এটা করে ফেলেন কিনা তাও দেখতে হবে।
মনে মনে পরিকল্পনার এক ছক এঁকে নিল মাহমুদ। তারপর শেখ জামাল, আফজল ও হাসান কামালকে ডেকে তাদের সাথে পরামর্শ করে।
রাত ৮ টা ৪৫ মিনিট। মাহদুদ তার কার্ডিলাক নিয়ে বের হলো। বালফোর রোড গিয়ে পড়েছে এয়ার পোর্ট রোড ধরে ছুটে চলল। এয়ারপোর্টে মাহমুদ যখন পৌঁছল তখন ৮ টা ৫৬ মিনিট।
‘সিনবেথ’ এর নয়া তেলআবিব প্রধান মিঃ বেকম্যান ওয়েটিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে একটি ম্যাগাজিনের উপর চোখ বুলাচ্ছে। মাহমুদ তার সামনের সোফাটিতে বসে পড়ল। মনে মনে ভবল, ভালই হলো। যাত্রা শুভ।
৯ টা বিশ বাজল। মিঃ বেকম্যান উঠে দাঁড়াল। সে হলের দোর গোড়ায় দাঁড়াতেই একজন লোক এসে তার সামনে দাঁড়াল। মিঃ ব্যাকম্যান তাকে কি যেন বললো, তারপর ফিরে এলো আবার। সোফা থেকে চশমা আর ম্যাগাজিনটি তুলে নিয়ে ঢুকে গেলো ভিতরে। মাহমুদ বুঝলো, রানওয়েতে হুগোকে অভ্যর্থনা জানানোর বন্দোবস্ত এটা। বেকম্যান উঠে যাবার পর মাহমুদও উঠে গিয়ে এদিক ওদিক পায়চারী করল। মাহমুদ দেখতে পেল, আফজল বিশেষ অতিথিদের দরজাটির আশেপাশেই রয়েছে। যদিও মাহমুদ স্থির নিশ্চিত যে সাধারণ যাত্রী নির্গমনের পথ দিয়ে ওরা বেরোবে না, সময় বাঁচানোর জন্য ওরা ভি আই পি’র পথই বেছে নিবে। তবু মাহমুদ অতিরিক্ত এ ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ঠিক ৯-২৬ মিনিটে রায়াল এয়ারফোর্সের একটি বিমান রানওয়েতে ল্যান্ড করল। সিনবেথের গাড়ী দাঁড় করানো ছিল ওয়েটিং রুমের পূর্ব পার্শ্বের দরজার বামপাশে। আর মাহমুদ তার গাড়ী দাঁড় করিয়েছিল হলের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের দরজার সামনে। ৯ – ৪০ মিনিটে একটি বোয়িং তেলআবিব থেকে যাত্রা করছে, সেজন্য যাত্রী ও তাদের বন্ধু বান্ধবদের আনাগোনায় বেশ ভীড় জমে উঠেছে।
মিঃ বেকম্যান একজন লোকের সাথে সহাস্যে কথা বলতে বলতে কর্মচারী আগমণ নির্গমনের বিশেষ দরজা দিয়ে বের হয়ে এল। লোকটির পরিধানে কালো রংএর স্যুট, হাতে সুদৃশ্য একটি এটাচী। মাথায় হ্যাট কপাল পর্যন্ত নামানো নাকের নীচে হিটলারী কায়দার গোঁফ। গল্প করতে করতে ওরা দরজার দিকে এগোলো। মাহমুদ দেখতে পেল, ওদের কয়েক গজ পিছনে আফজল এসে দাঁড়িয়েছে। আফজল ওদের পিছনে গিয়ে দরজায় মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে ফিরে এল। আফজল ফেরার সাথে সাথে মাহমুদ নিজের গাড়ীর দিকে চলল। মাহমুদ গাড়ীতে উঠতে উঠতে দেখতে পেল আফজল টেলিফোন বুথের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। মাহমুদের মুখে ফুটে উঠল প্রশান্তির হাসি। পেছনের সিটে শুয়ে হাসান কামাল ঘুমের কসরত করছিল। মাহমুদকে গাড়ীতে উঠতে দেখে নড়ে চড়ে ঠিক হয়ে বসল সে।
মাহমুদের গাড়ী এয়ারপোর্ট চত্বরের দ্বিতীয় গেট দিয়ে বেরিয়ে এয়ারপোর্ট রোডে পড়ল। প্রায় ৩০০ গজ সামনে আর একটি কালো রং এর গাড়ী এয়ারপোর্ট রোড ধরে এগিয়ে চলছে। রেয়ার লাইটের আলোকে গাড়ীর নাম্বার প্লেটটি দেখে মাহমুদের ঠোঁটের কোণে হাসি খেলে গেল। তার মুখে স্বগতঃ উচ্চারিত হলো, ইন্না ছালাতি ওয়া নুসুকি ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামতি লিল্লাহে রাবিবল আলামিন (নিশ্চয় আমার উপাসনা প্রার্থনা আমার সাধনা, আমার জীবন, আমার মরণ সমস্তই বিশ্ব নিয়ন্তা রাব্বুল আলামিন আল্লাহর নামে নিবেদিত)। মাহমুদ গাড়ীর স্পিড একটু কমিয়ে দিল, কিন্তু গাড়ীটিকে চোখের আড় হতে দিল না। পিছনে সংকেত থেকে সে বুঝে নিল, ওটা আফজলের গাড়ী।
চার মাইল পথ এসেছে তারা। সামনেই রাস্তাটি বামদিকে বাঁক নিয়েছে। মাহমুদ অধীর আগ্রহে সামনে তাকিয়েছিল। অবশেষে দেখতে পেল, একটি উজ্জ্বল হেড লাইট/ সঙ্গে সঙ্গে মাহমুদ তার নিজের হেড লাইট থেকে কয়েকবার সংকেত দিল। সংকেতের উত্তর পেল সামনের তীব্রবেগে এগিয়ে আসা হেড লাইট থেকে। স্বস্তি লাভ করল মাহমুদ -শেখ জামাল ঠিক সময়ে পৌছেছে। কিছু দূরেই মোড়। শেখ জামালের গাড়ীর হেড লাইট থেকে বুঝা যাচ্ছে প্রায় মোড়ের সন্নিকটে পৌছে গিয়েছে সে। ওদিকে এগিয়ে চলা মিঃ বেকম্যানের গাড়িটিও মোড়ের সন্নি্কটে পৌছে গেছে। মিঃ জামালের গাড়ীর হেড লাইটের আলোতে মিঃ বেকম্যানের গাড়ী এবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। মাত্র মুহূর্তকয়েকের ব্যবধান। সামনে থেকে তীক্ষ্ণ এক ধাতব সংঘর্ষের শব্দ শোনা গেল। মাহমুদ চঞ্চল হয়ে উঠল। দ্রুত এগিয়ে গেল তার গাড়ী। পাশ দিয়ে প্রচন্ড বেগে শেখ জামালের পাঁচ টনি ট্রাক বেরিয়ে গেল।
মোড়ে এসে দ্রুত গাড়ী থেকে নেমে মাহমুদ দেখল, মিঃ বেকম্যানের গাড়ীটি একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেছে। গাড়ীর ডানপাশের অংশ দুমড়ে গেছে। ড্রাইভার তার সিটের একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে। ধীরে ধীরে উঠবার চেষ্টা করছে সে। মিঃ বেকম্যানের কপালে আঘাতে লেগেছে, রক্ত বেরুচ্ছে। সে নিঃসাড়ভাবে পড়ে আছে। বোঝা গেল না জ্ঞান হারিয়েছে কিনা। মিঃ হুগো মিঃ বেকম্যানের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন, এটাচী কেসটি কিন্তু তার হাতছাড়া হয়নি। মাহমুদ গাড়ীর কাছে পৌছতেই সে উঠে বসতে চেষ্টা করল। মাহমুদ হুগোকে বলল, ‘‘বেরিয়ে আসুন।’’ বলে মাহমুদ তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেল। বের করে এনে তাকে নিজের গাড়ীর কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘‘বসুন ভিতরে গিয়ে।’’
মিঃ হুগো কেমন যেন চঞ্চল হয়ে উঠলেন। কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তার হাত থেকে এটাচী কেসটি কেড়ে নিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসতে বসতে বলল মাহমুদ, ‘‘হাসান কামাল, মিঃ হুগোকে এবার ঘুমিয়ে দাও।
মাহমুদ বলার আগেই হাসান কামাল তার কাজে লেগে গিয়েছিল। কয়েকবার ঝটপট করলেন মিঃ হুগো, কিন্তু তারপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল তার দেহ।
গাড়ী ছেড়ে দিল মাহমুদ। সব কাজ সম্পন্ন করতে তার আধ মিনিটের মত সময় লাগল। আফজলের গাড়ী যখন মোড়ে পৌছল, মাহমুদের গাড়ী তখন চলে গেছে কয়েকশ গজ সামনে। আফজলের পর আরো কয়েকটি গাড়ী এসে পৌছল। একটি হৈ চৈ পড়ে গেল চারদিকে।
এই সময় মিঃ বেকম্যানের জ্ঞান ফিরে এল। চারিদিকে চেয়ে প্রথমেই সে বলল, ‘‘মিঃ হুগো ………….।’’ একটু থেমে ঢোক গিলে পুনরায় সে বলল, ‘‘গাড়ীতে আর এক জন লোক ছিল, সে কোথায়? ’’
উপস্থিত কেউ এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারল না। ড্রাইভার তখনও সীটের উপর পড়েছিল। তার মাথার ও বুকে আঘাত লেগেছে। সে ধীরে ধীরে বলল, ‘‘দুর্ঘটনার পরেই একটি গাড়ী তাকে তুলে নিয়ে গেছে।’’
-তুলে নিয়ে গেছে। সে কি গুরুতর আহত ছিল? তার কণ্ঠ যেন কেঁপে উঠল।
– আমি জানি না, তবে বুঝতে পেরেছিলাম তার জ্ঞান ছিল।
আর কোন প্রশ্ন করল না বেকম্যান। চোখ বুজে মুহুর্তকয় চিন্তা করে উঠে দাঁড়াল। আঘাতের কথা সে যেন ভুলে গেছে। বলল সে, ‘‘এখনি পৌঁছতে হবে হেড কোয়ার্টারে।’’
অনেকেই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। মিঃ বেকম্যানকে গাড়ী এগিয়ে চলল ‘সিনবেথ’ এর হেড কোয়ার্টার এর দিকে। মিঃ বেকম্যানের লক্ষ্য বুঝতে পারল আফজল। মাহমুদের পশ্চাৎদিকের নিরাপত্তায় মোতায়েন আফজল এবার নিশ্চিন্ত হয়ে তার গাড়ী ছেড়ে দিল।
ওয়াইজম্যান রোডের একটি প্রকান্ড বাড়ী। বাইরে থেকে দেখতে একটি সাদমাটা ত্রিতল। কিন্তু ভিতরে গেলে বুঝা যায় বাড়ীর বিরাটত্ব। প্রকান্ড গাড়ী বারান্দা। পাঁচ ছয়টি গাড়ী খুব সহজভাবেই এখানে স্থান পেতে পারে। সব মিলে খান তিরিশেক ঘর। মেঝের তল দিয়ে বিলম্বিত এক সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে সবগুলো ঘরকে ইন্টারকানেক্টেড করা হয়েছে। পরিশেষে এই সুড়ঙ্গ পথ ওয়াইজম্যান রোডের দক্ষিন পার্শ্ব দিয়ে সমান্তরালভাবে চলে যাওয়া মরদেশাই রোডের একটি ফলের দোকানে গিয়ে শেষ হয়েছে। তেলআবিবে সাইমুমের এটা চতুর্থ আস্তানা।
মাহমুদ মিঃ হুগো গালার্টকে এই আস্তানাতে এনে তুলল। বাইরের কোন লোককে সাইমুম কখনও তাদের মূল ঘাঁটিতে নিয়ে যায় না। এমন কি দলীয় সদস্যদেরও যোগাযোগ কেন্দ্র এই আস্তানাগুলো। মূল ঘাঁটির অধিকতর নিরাপত্তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
হুগো গালার্টকে সার্চ করা হলো। তার বৃহদাকার এটাচী থেকে পাওয়া গেল হুগোর প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়। আর পাওয়া গেল একটা ডাইরী এবং কিছু পাউন্ড মুদ্রা। ডাইরীতে হুগোর নিজস্ব খরচ পত্রের খুঁটিনাটি এবং তার কিছু ট্যুর রেকর্ড। ডইরীর মধ্যে পাওয়া গেল World peace Brigade এর অধিনায়ক মিঃ ওয়াল্টার কুটের নিজস্ব প্যাডের একটি চার ভাঁজ করা সাদা পাতা।
হুগোর জুতার তলা এবং তার পায়ের পাতা থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত সব কিছুই তন্ন তন্ন করে সার্চ করা হলো। তার পোশাকের সন্দেহজনক কোন অংশই বাদ দেয়া হলো না। অবশেষে হুগোর এটাচী কেস ফেঁড়ে ফেলা হলো, তার অতিরিক্ত কাপড় চোপড় গুলো ও পরীক্ষা করা হলো। কিন্তু কিছুই মিলল না।
কপালের ঘাম মুছে শেখ জামাল এসে চেয়ারে ধপ করে বসল। মাহমুদ চেয়ে চেয়ে দেখছিল/ শেখ জামাল বসতেই মাহমুদ মিঃ হুগোর দিকে চেয়ে বলল, ‘‘মিঃ হুগো আপনি কি হাওয়া খাওয়ার জন্য গোপন সফরে তেলআবিব এসেছেন?’’
মিঃ হুগো শুধু মিট মিট করে চাইলেন। কোন উত্তর এল না তার কাছ থেকে। মাহমুদ জানে, হুগো ওরফে জ্যাকব গ্রিমবের মুখ খোলার জন্য মুখের কথা যথেষ্ট নয়। মাহমুদ হুগোকে আর কিছু বলল না। গভীর চিন্তায় আবার ডুব দিল সে।
হঠাৎ সোজা হয়ে বসল মাহমুদ। মুখ তার খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার মনে পড়ে গেল, লেনিন যখন জেলে ছিলেন তখন তাঁর স্ত্রী তার কাছে পড়ার জন্য ম্যাগাজিন পাঠাতো। লেনিন ম্যাগাজিনের সাদা অংশগুলোতে দুধ দিয়ে তাঁর মেসেজ লিখতেন কর্মীদের উদ্দেশ্যে। দুধের এ লেখাগুলো এমনিতে দেখা যেত না, কিন্তু পানিতে ডোবালেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠত। লেনিনের স্ত্রী তার স্বামীর কাছ থেকে ম্যাগাজিন ফেরত নিয়ে গিয়ে মেসেজগুলো উদ্ধার করে পৌঁছাতেন কর্মীদের নিকট।
কথাটা মনে হতেই মাহমুদ শেখ জামালকে নির্দেশ দিলেন এক গামলা পানি আনতে।
পানি এলে মিঃ হুগোর ডাইরী থেকে ওয়াল্টার কুটের প্যাডের চার ভাঁজ পাতাটি এনে ভাঁজ খুলে পানিতে ডুবিয়ে দিল।
সাফ্যলের আনন্দ খেলে গেল মাহমুদের মুখে। কাগজের বুকে সাদা সাঁদা অক্ষর ফুটে উঠেছে। মাহমুদ শেখ জামালকে বলল, ‘‘তাড়াতাড়ি কাগজ কলম আনো। কাগজ বেশীক্ষণ পানিতে রাখা যাবে না।
শেখ জামাল মাহমুদের অনুসরণ করে লিখ যেতে লাগলঃ
‘‘প্রেরক ওয়াল্টার কুট, অধিনায়ক বিশ্ব শান্তি সেনা।
-প্রাপক স্যামুয়েল শার্লটক, প্রধানমন্ত্রী, ইসরাইল।
আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, যুদ্ধ বিরতি সীমারেখার ওপারে যুদ্ধবিরতি তদারককারীদের মধ্যে আমরা কিছু ইসরাইল সন্তানকে সন্নিবিষ্ট করতে পেরেছি। ‘ইরগুন জাই লিউমি’র মাধ্যমে তারা তথ্য সরবরাহ করবে। কিন্তু জরুরী পরিস্থিতিতে যোগাযোগের জন্য আমরা তাদের রেডিও মিটার পাঠালাম। বিশেষভাবে বলা হচ্ছে, কোন পরিস্থিতিতেই তাদের নাম জানার চেষ্টা করা চলবে না।
- 44 11. GH . 43. 07 GH . 45 33 GV . 32 . 13, JZ 54; 05, GR. 47, 55. GR 44, 77, GR, 39, 17, SZ 40, 99, SZ. 38. 66, SZ. 51 . 02. SZ . 47. 21, SZ 48,81,”
ইরগুন জাই লিউমি’হচ্ছে গুপ্ত বিশ্ব ইহুদী গোয়েন্দা চক্রগুলোর একটি। মেসেজ পরিস্কার। ইসরাইলের বিধ্বস্ত স্পাই রিং এর আংশিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা তাতে করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল ডবল ভূমিকায় অভিনয়কারী জাতিসংঘের প্রতিনিধির মুখোশ পরা প্রতিনিধিবর্গ কারা বোঝা যাচ্ছে, GH অর্থাৎ গোলান হাইট, GV অর্থাৎ হুলেহ ভ্যালি, JZ অর্থাৎ জেজরিস ভ্যালি, GR অর্থাৎ জর্দান রিভার, SZ অর্থাৎ সুয়েজ খাল অঞ্চলে ওরা মোতায়েন আছে। মাহমুদ ভেবে দেখল শুধু রেডিও মিটার দিয়ে ওদের চিহ্নিত করা যাবে না। সুতরাং যে কোন মূল্যেই ওদের নাম জানতে হবে।
মাহমুদ উঠে গিয়ে মিঃ হুগোর একেবারে মুখোমুখি দাঁড়াল। মিঃ হুগোর চোখের মনি দু’টোতে স্থির চক্ষু নিবদ্ধ করে সে বলল, মিঃ হুগো যুদ্ধ বিরতি রেখার ওধারে যারা ইসরাইলের হয়ে কাজ করছে, তাদের নাম বলতে হবে। মিঃ হুগো নীরব। মাহমুদ বলল, অধিবেশনে না বসলে বুঝি কথা বলবেন না।
মিঃ হুগোর চোখ দু’টি চঞ্চল হয়ে উঠল। আশংকার একটি বিষাদ রেখা তার মুখের উপর দিয়ে খেলে গেলে।
মাহমুদ শেখ জামাল কে বলল, পর্দাটা সরিয়ে দাও জামাল। মি হুগো অধিবেশনের ব্যবস্থাটা একটু দেখে নিক।
ঘরে উত্তর দিকে টাঙ্গানো পর্দা সরিয়ে ফেলল জামাল। কাঠের একটি সুদৃঢ় পাটাতন, তাতে চামড়ার ফিতা লাগান। পাটাতনে শায়িত মানুষকে মজবুত করে বাঁধার কাজে তা ব্যবহৃত হয়। পাটাতনের পাশে সুইচবোর্ড। একটি ইলেকট্রিক মেগনেটো পড়ে আছে পাটাতনের উপর, তার উপর সাদা বোতাম জ্বলজ্বল করছে।
মাহমুদ ঐ দিকে অঙ্গুলি সংকেত করে বলল, ঐ তড়িৎ অধিবেশনের সাথে তোমরা তো খুব পরিচিত। আমাদের কথা বলার অভিযানের ওটা প্রথম অস্ত্র। এরপর একে একে আসবে অন্যগুলো।
মিঃ হুগো একবার চকিত দৃষ্টিতে ওদিকে চেয়ে বলল অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে কি করবে তোমরা, আমি কিছুই জানি না। কণ্ঠ তার কাঁপছে।
ওয়ার্ল্ড পিস ব্রিগ্রেডের লিঁয়াজো অফিসার মিঃ হুগো, জান কি জান না আমরা দেখব। বলে একটু থামল মাহমুদ, তারপর বলল, অমানুষিক নির্যাতন কিন্তু তোমরাই আমাদের শিখিয়েছ। এই সেদিন আলজেরিয়াতে সুসভ্য ইউরোপের তোমাদের জাত ভাইয়েরা কি করল? আলজিয়ার্সের আলবিয়ায় কোয়ার্টার আর ‘সেন্টার দ্য ত্রি’র নির্যাতন কক্ষগুলোতে তোমাদের ভাইয়েরা স্বধীনতাকামী আমাদের ভাইদের উপর কি অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে তা মনে পড়ে নাকি তোমাদের? থামল মাহমুদ। আবার বলল, পাঁচ মিনিট সময় দিলাম তোমাকে, এরমধ্যে যদি নামগুলো বলো তাহলে মুক্তির আশা করতে পারো। এখন তুমি ভেবে দেখ একদিকে মুক্তি অন্য দিকে ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে গমণ – কোনটি তুমি বেছে নেবে।
মাহমুদ বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
মি হুগো গালার্টের স্মৃতিতে নাজি কনসেনট্রেসন ক্যাম্পের ভয়াবহ ঘনাগুলোর কথা জাগরুক রয়েছে। মাহমুদের উল্লেখকৃত আলজিয়ার্সের ‘আলবিয়ার’ ও ‘সেন্টা দ্য ত্রি’র ভয়াবহ নির্যাতন কাহিনীর সাথেও সে পরিচিত। ইলেকট্রিক সিটিং ‘পাটাতন ও ১৫ মেগনেটো’ ‘নকল ডোবনো প্রক্রিয়া, প্রভৃতির কথা স্মরণ হতেই আৎকে উঠল মিঃ হুগো গালার্ট। প্রবল ইচ্ছা শক্তি তার ধ্বসে পড়ে গেল মুহূর্তে।
পাঁচ মিনিট পরে ফিরে এল মাহমুদ। ইলেকট্রিক সিটিংএর আর প্রয়োজন হলো না। তার কাছ থেকে জানা গেল ১৪ টি নাম। লিখে নিল মাহমুদ। তারপর পরখ করে সে দেখল ওপারের যুদ্ধ বিরতি সীমা রেখা তদারককারীদের মধ্যে এসব নাম আছে কিনা।
উঠে দাঁড়িয়ে মাহমুদ বলল, তোমাকে আমরা পাঠিয়ে দেব আমাদের হেড কোয়ার্টারে, ওখান থেকেই তোমার সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তবে মুক্তি যে এক সময় তুমি পাবে, সে নিশ্চয়তা আমরা তোমাকে দিচ্ছি।
সংগৃহীত নাম ও মেসেজটি হেড কোয়ার্টারে পাঠাবার জন্য মাহমুদ দ্রুত তার মূল ঘাঁটিতে ফিরে এল।
পরদিন বিকেলে লন্ডনের ‘ইভিনিং পোষ্টে’র দু’কলাম হেডিংএর একটি সংবাদ দৃষ্টি আকৃষ্ট করলো মাহমুদের। সিরিয়া, জর্দান ও মিসর সরকার যুদ্ধ বিরতি সীমারেখা তদারককারীদের মধ্যে থেকে গোলান হাইট এলাকার মিকাইল বোরডিন, ক্লারেন্স ডিলোন, বাউন্সকভ, হুলেহ ভ্যালির রলফ বোম্যান, জেজারিল ভ্যালির ফ্রাঙ্ক কার্লসন, জর্দান নদী এলাকার মরিস চাইল্ডস, আর্নল্ড ফোষ্টার, পিটার গাবর এবং সুয়েজ খার এলাকার মিকাইল গার্ডিন, গিল বার্ট গ্রিণ ভিক্টর গ্রুজ, মার্ক গায়েন ও বিল মার্ডোর ২৪ ঘন্টার মধ্যে বহিস্কার দাবী করেছেন। আরব রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থবিরোধী কর্ম তৎপরতার অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের প্রতি। প্রশান্ত হাসি ফুটে উঠল মাহমুদের মুখে।
উপরোক্ত খবরের পাশে আর একটি খবরও মাহমুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ইসরাইলের সুপ্রিম নিরাপত্তা কাউন্সিলের মেম্বার ইসরাইল পার্লামেন্টের সদস্য মিঃ সিমসন স্যামুয়েল শালটক সরকারের বিরুদ্ধে আযোগ্যতার অভিযোগ এনেছেন। তিনি বলেছেন, স্যামুয়েল শার্লটক সরকারের অধীনে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে এবং জাতির নিরাপত্তা বিধানকারী সংস্থাগুলো যাচ্ছে রসাতলে। খবরটি পড়ে হাসল মাহমুদ। পতন যখন ঘনিয়ে আসে, তখন সবাই পরস্পর কাদা ছোঁড়াছুড়ি করে নিজেদের দোষ ও অযোগ্যতার কথা ঢেকে রাখতে চায় এবং এইভাবে তারা নিজেদের সংশোধন ও যোগ্যতা বৃদ্ধির পথ বন্ধ করে প্রতিপক্ষের শক্তিবৃদ্ধি ও বিজয়ে সহায়তা করে।
১২
ডেভিড বেনগুরিয়ানের বাড়ী। এমিলিয়ার কক্ষ। একটি ড্রইং রুম, একটি বাথরুম ও একটি বেড রুম নিয়ে এমিলিয়ার নিজস্ব জগত। গ্রীসিও মেয়ে ভোনাস এই জগতে এমিলিয়ার একমাত্র সঙ্গী ও পরিচারিকা। পিতা ও মাতা এখানে আসেন, কিন্তু সেটা কতকটা রুটিন সফরেরর মত। তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এমিলিয়াকে তারা অবাধ বিচরণের সুযোগ দিয়েছেন।
রাত ৯ -৩০ মিনিট। বেশ গরম বাইরে। কিন্তু সেন্ট্রালি ইয়ার কন্ডিশন্ড এ বাড়ীতে গরমের কোন চিহ্ন নেই। এমিলিয়া পড়ার টেবিলে বসে। কিন্তু মন বসাতে পারল না বইতে। মন এলামেলো, বিশৃঙ্খল। শয্যায় গিয়ে সে শুয়ে পড়ল। চোখ বুঝে সে মনকে ভাবনাহীন করতে চাইল। কিন্তু পারছে না সে। খোঁচার মত বিঁধছে শুধু।
এমিলিয়ার মা ঘরে ঢুকলেন। মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে তিনি একবার পড়ার টেবিল ও একবার শায়িতা এমিলিয়ার দিকে চাইলেন। তারপর গিয়ে বসলেন এমিলিয়ার পাশে। তারপর ধীরে ধীরে তিনি এমিলিয়ার কপালে হাত রেখে বললেন অসুখ করেনি তো মা? চমকে উঠল এমিলিয়া। নিজেকে সামলে নিল সে। নিজের কপালে রাখা মায়ের হাতটি তুলে নিয়ে সে বলল, না মা অসুখ করেনি।
-এমন অসময়ে শুয়ে কেন তুমি? মায়ের কথায় তখন আশংকার সুর।
-ভালো লাগছে না কিছু, তাই শুয়ে আছি মা।
-এই ভাল না লাগাটাই তো অসুখ মা। তাছাড়া বেশ কিছুদিন থেকে দেখছি তুমি বাইরে কোথাও তেমন বের হওনা ঘরেই শুয়ে থাক। কিছুক্ষণ থামল এমিলিয়ার মা। বলল, না হয় গিয়ে একবার ইউরোপ ঘুরে এসো, এখন তো তেমন পড়াশুনার চাপ নেই।
-না মা তোমরা কিছু ভেব না। আমি ভাল আছি। ঘরে বসে পড়ি? বেড়াতে তেমন ভালো লাগছে না। হাসিতে মুখ রাঙ্গিয়ে বলল এমিলিয়া।
-তাই ভালো মা। দিনকাল ভাল যাচ্ছে না। ঘরে বাইরে শত্রু আজ। শ্বাসরোধ করতে চাইছে আমাদের।
-আচ্ছা মা শান্তি কি্সবে না? আমরা শক্রকে বন্ধু বানাতে পারবো না?
-কেমন করে? শক্ররা যদি শক্রতা না ছাড়তে চায়?
-কিন্তু আমরা তো শক্রতা ছাড়ছি না?
-কেমন করে?
-যে সব আরব মুসলমানকে আমরা তাদের ঘরবাড়ী থেকে তাড়িয়েছি, তাদেরকে ফিরিয়ে এনে যথাযোগ্য অধিকার তাদের আমরা কেন দিচ্ছি না?
-যথাযোগ্য কি অধিকার মা?
-দেশের শাসন ও আইন প্রণয়নের অধিকার।
এমিলিয়ার মা হাসল। বলল, পাগল মেয়ে, ওদেরকে দেশের শাসন ও আইন প্রণয়নের অধিকার দিলে ইসরাইললের সন্তানরা দাঁড়াবে কোথায়?
-কেন, আমরা যেহেতু সংখ্যালঘিষ্ট, তাই সংখ্যালঘিষ্টের অধিকারই প্রাপ্য।
-কিন্তু জার্মানিতে সংখ্যালঘিষ্ট ইহুদীদের অবস্থার কথা তুমি কি জান না?
-জানি। কিন্তু তাই বলে আরব মুসলমানদেরকে হিটলারের আসনে বসাবার কি কোন যুক্তি আছে মা?
-নিশ্চয়। তুমি নিশ্চয় জান, মুসলমানদের পয়গম্বর মোহাম্মদ কেমন করে ইহুদীদেরকে প্রথমে মদীনা, তারপর খায়বর, সর্বশেষ তাদের আরব থেকে বিতাড়িত করেছিল।
-কিন্তু মা, নবী মোহাম্মদ কি বিনা কারণে ইহুদীদের বহিস্কার করেছিলেন? ইসলামের নবীর সাথে তাদের সম্পাদিত চুক্তি তিনবার ইহুদীরা ভংগ করেছে এবং বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এর পর তারা মদীনা থেকে বহিস্কৃত হয় এবং খায়বরে আশ্রয় পায় কিন্তু খায়বরকে ঘাঁটি করে আবার তারা ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার পথ অনুসরণ করল, এরপর তাদের আরব থেকে বিতাড়িত করা ছাড়া উপায় ছিল কি?
-এমিলিয়ার মা আবার মুখ টিপে হাসল। বলল যে কারণে নবী মোহাম্মদ ইহুদীদেরকে বিতাড়িত করেছিল, সে কারণে আমরা ও আরব মুসলমানদের বিতাড়িত করেছি।
-কিন্তু মা উভয় স্থলে তো একরকম কার্যকারণ নেই।
নবী মোহাম্মদ পৌত্তলিকদের ধর্মান্তরিত করে স্বাভাবিক ভাবেই মদীনা ও আরবের মালিক হয়েছিলেন, মালিকানা তিনি ইহুদীদের কাছ থেকে কেড়ে নেননি। অন্যপক্ষ আমরা আরব মুসলমানদের বিতাড়িত করে তাদের দেশ ফিলিস্তীনকে আমরা ইসরাইল রাষ্ট্র বানিয়েছি।
-তোমার কথা ঠিক এমি। কিন্তু আমাদের জাতির স্বার্থে এর প্রয়োজন ছিল এবং ভবিষ্যতে থাকবে।
-এক জাতির প্রয়োজনে অপর জাতির ধ্বংস সাধন কেমন সুবিচার মা?
-রূঢ় বাস্তবতার সাথে তোমাদের পরিচয় নেই মা, অবিচার সব সময় অবিচার নয়।
-কিন্তু মা, অন্যায় করে যাদের অধিকার হরণ করা হল, তারা কি অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে না। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সা্যমুয়েল শার্লটক রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করে আমেরিকায় প্রতিপালিত হয়ে হঠাৎ উড়ে এসে ইসরাইলের নিয়ামক হয়ে বসার অধিকার যদি পায়, তাহলে বংশ পরস্পরায় বসবাসকারী আরব মুসলমানরা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে তো এগিয়ে আসবেই।
-হাঁ, এটা তারা করছে।
-সুতরাং আমরা শান্তির আশা কেমন করে করতে পারি?
এমিলিয়ার মা কোন উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ গম্ভীর ভাবে থেকে পরে ধীরে ধীরে বলল সে, শান্তির সম্ভাবনা যে নেই প্রতিটি ইসরাইলীই তা জানে, কৌশল আর শক্তির বলেই তারা এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, শক্তি ও কৌশলের আশ্রয় নিয়েই তাদেরকে টিকে থাকতে হবে। শুধু টিকে থাকাই নয়, তাদের থাবাকে আরও মজবুত ও বিস্তৃত করতে হবে। মায়ের দিকে এমিলিয়া পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়েছিল। তার মায়ের কথা সেদিন ওসেয়ান কিং জাহাজে শোনা ইসরাইলী মন্ত্রীর বক্তব্যের সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে। তাহলে প্রতিটি ইসরাইলীই কি আরব ভূমিতে তাদের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর। আত্মরক্ষাকারী জাতি বলে পরিচয় দানকারী ইসরাইলীদের একি বিভৎস সাম্রাজ্যবাদী রূপ। শিউরে উঠল এমিলিয়া।
এমিলিয়ার গম্ভীর আত্মস্থ ভাবের দিকে চেয়ে এমিলিয়ার মা হেসে বলল, ভালো যুক্তি শিখেছো এমি, তোমার আব্বা খুব খুশী হতেন শুনলে। কিন্তু সেন্টিমেন্ট দিয়ে সবকিছু বিচার করলে ভুল করবে। জাতির বৃহত্তর প্রয়োজন ও মঙ্গলের জন্য এমন অনেক কিছু করতে হয় যা নীতিশাস্ত্র অনুযায়ী অবিচার আর অন্যায়ের পর্যায়ে পড়ে।
এমিলিয়া বলল, এটাই যদি জাতীয় নীতি হয় মা, তাহলে হিটলারকে দোষ দেয়া যায় কেমন করে? নুরেনবার্গ বিচারের প্রহসনই বা তাহলে করা হলো কেন? জার্মান জাতির পরম সুহৃদ নাজিদেরকে অমানুষিক নির্যাতন আর শাস্তিরই বা শিকার হতে হল কেন?
-জাতীয় দায়িত্ব যখন কাঁধে আসবে, তখনই সব বুঝতে পাবে মা। বলে উঠে দাঁড়াল এমিলিয়ার মা। বলল, তাড়াতাড়ি খেতে এস।
এমিলিয়ার মা চলে গেল।
রাত ১১ টা। নাইটগাউন পরার জন্য এমিলিয়া ডেসিং রুমে ঢুকেছে। হঠাৎ ঘরের মেঝেয় কিছু পতনের শব্দ শুনতে পেল সে।
পার্টিশন ডোরে মুখ বাড়াল এমিলিয়া, মেঝেয় দাঁড়িয়ে আছে মাহমুদ। চোখাচোখি হয়ে গেল। মাহমুদের মুখে এক টুকরো হাসি।
এমিলিয়া প্রথমে বিস্ময়বিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। বিমূঢ় ভাব কেটে যেতেই তার মুখ রাঙ্গা হয়ে উঠল। সে চোখ নামিয়ে নিল।
মাহমুদ ধীরে ধীরে এগুলো এমিলিয়ার দিকে। একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ালো এসে। বললো, কেমন আছ এমি?
কোন উত্তর দিল না এমিলিয়া। চলবার ও কথা বলবার শক্তি যেন সে হারিয়ে ফেলেছে।
কথা বলল মাহমুদ, রাগ করেছ বুঝি তুমি?
মুখ তুলল এবার এমিলিয়া। দুফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল দু’গন্ড বেয়ে তার।
-তুমি কাঁদছ এমি? নীরব অশ্রুর ঢল নেমেছে তখন তার দু’চোখে।
-তুমি কোথায় ছিলে? চকিতে মুখ তুলে প্রশ্ন করল এমিলিয়া।
-তেলআবিবেই ছিলাম।
-এখানেই ছিলে? একটু থামল এমিলিয়া। ঢোক গিলে বলল সে, আমি মনে করেছিলাম, অন্তত আমার জন্মদিনে তুমি আসবেই।
-তুমি পথ চাইবে আমি জানতাম। কিন্তু আসিনি আমি।
-আসনি কেন?
-তোমাদের গোয়েন্দারা সেদিন সারারাত আমার জন্য অপেক্ষা করেছে তোমাদের বাড়ীর চারদিকে।
চমকে উঠে মুখ তুলল এমিলিয়া। তার চোখে বিস্ময়। মাহমুদ বলল, বিস্মিত হবার কিছু নেই। সেই রাতের ঘটনার পর থেকে ‘সিনবেথ’ গোয়েন্দারা তোমার উপর চোখ রেখেছে আমাকে ধরার জন্য। তারা নিশ্চিত ছিল, জন্মদিনে আমি আসছিই।
-ওরা তাহলে সন্দেহ করছে আমাকে?
-সন্দেহ নাও হতে পারে। হতে পারে ওরা নিশ্চিত হতে চেয়েছিল। তোমার জন্মদিনের পর ওরা কিন্তু আর তোমাদের বাড়ীতে পাহারায় আসছে না।
-তুমি এসে ফিরে গিয়েছিলে।
-না এমি, পা বাড়ালে আমি আসতামই। তোমাদের গোয়ান্দারা আমার পথ রোধ করতে পারত না। কিন্তু আমি চাইনি অপ্রীতিকর কিছু ঘটুক চেয়েছি, কোন সন্দেহই যাতে তোমাকে স্পর্শ না করে।
-কোন পথ না পেয়ে শেষে আমাদের বাড়ীতেই পাহারা বসাতে হল। এমন অসহায় যে ইসরাইল গোয়েন্দা বাহিনী আমি ধারণা করিনি কোনদিন। বলে এমিলিয়া মৃদু হেসে বলল, তোমাকে বসতে বলিনি পর্যন্ত। বসবে চল।
মাহমুদ সোফায় গিয়ে বসল। সোফার উপর কনুই দু’টি ঠেস দিয়ে সোফার পিছনে দাঁড়াল এমিলিয়া। মাহমুদের মাথা এমিলিয়ার গায়ে অনেকটা যেন ঠেস দিল। মাহমুদ মাথাটা একটু সরিয়ে নিল।
-জানো, একটা সুখবর দিতে পারি। বলল এমিলিয়া।
-কি সুখবর? বলল মাহমুদ।
-বলব না। আগে বল বিনিময় কি হবে?
মাহমুদ বলল, কেমন সুখবর না শুনলে কেমন পুরস্কারের যোগ্য হবে কি করে বুঝব?
-কেন বলতে পার না, যা চাইবে তাই।
-বেশ যা চইবে, তাই।
এমিলিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার দু’হাতের আঙ্গুলগুলো তখন মাহমুদের জামার কলার নিয়ে খেলা করছিল। সে ধীরে ধীরে বলল, জানো, সেদিন আমি গাজায় গিয়েছিলাম। ওখানকার মোহামেহডান বুক ষ্টোর থেকেঃ Towards understanding Islam, Rights of non Muslim in Islamic State, Islam in Theory and Practice – বই তিনটি কিনে এনেছি। এর মধ্যে Towards understanding islam বইটি শেষ করে ফেলেছি। Islam in Theory and Practice বইটি পড়তে শুরু করেছি। মাহমুদের প্রতি ধমনিতে, প্রতিটি রক্ত কণিকায় আনন্দের স্রোত বয়ে গেল। আল্লাহ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। মাহমুদ বলল, Towards understanding Islam ইসলামকে জানার জন্য প্রাথমিক স্তরের একখানা অতি উৎকৃষ্ট বই, কেমন লাগল এমি?
-বারে! ভুলে যাচ্ছ কেন? আগে আমার পুরস্কার পরে তোমার প্রশ্নের উত্তর।
-কি চাও বল। মাহমুদ বলল হেসে।
-চাইব না, তুমিই বল, কি দেবে তুমি।
-তোমার ঐ খবর আমাকে যতখানি খুশী করেছে, তার কোন তুলনা আমার জীবনে নেই এমি। তোমার একটি প্রাপ্যের কথাই আমার মনে পড়ছে। কিন্তু এ বই সামান্য।
এমিলিয়ার শুভ্র গন্ডে এক ঝকল রক্তিম স্রোত বয়ে গেল। বলল সে বলই না শুনি? মাহমুদ এমিলিয়ার দু’টি হাত তুলে নিল হাতে। ধীর গম্ভীর স্বরে বলল, ইসরাইল রাষ্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ইসরাইলের এককালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বিশ্ব ইহুদীবাদের নেতৃস্থানীয় মস্তিস্ক ডেভিড বেনগুরিয়ানের একমাত্র নাতনি এমিলিয়া তুমি। তুমি কি সব ত্যাগ করে গোঁড়া মুসলিম মাহমুদকে নিয়ে সুখী হতে পারবে।
এমিলিয়া কোন উত্তর দিল না। দু’ হাতে মুখ ঢেকে কপালটা এলিয়ে দিয়েছে সোফার উপর।
মাহমুদ একটু ঘাড় ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল কই, উত্তর দিলে না? তার ঠোঁটের কোণায় হাসি।
-ইস আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে। দিবার কথা তুমি দিয়েছ। যে নিয়েছে সে রাখুক বা ফেলে দিক তোমার কি।
-আমার কিছু নয়, কিন্তু acknowledgementবলতে একটি জিনিস আছে? হাসল মাহমুদ।
-না, তুমি নিষ্ঠুরের মত ডুব মেরে থাক, কিছু পাবে না তুমি। বলে সরে যচ্ছিল এমিলিয়া। একটি হাত ধরে তাকে আটকিয়ে তার দিকে পরিপূর্ণ দু’টি চোখ তুলে ধরে মাহমুদ বলল, একটি কঠিন জীবন তুমি বেছে নিলে এমিলিয়া। লেহিহান অগ্নিশিখার উপর দিয়ে আমাদের চলার পথ। পথের শেষ কোথায় আমরা জানি না। এমিলিয়া মাহমুদের কাছে একটু সরে আসল। কয়েক মুহূর্তের জন্য তার চোখ দুটি বন্ধ হয়ে এল। তারপর চোখ খুলে সে বলল, আজ থেকে এমিলিয়াকে তোমাদের একজন বলে মনে করো মাহমুদ। সুখে দুঃখে তাকে তোমরা তোমাদের পাশেই পাবে।
মাহমুদ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, এটাই তোমার কছে এই মুহূর্তে চাইছিলাম এমিলিয়া। বলে একটু থামল মাহমুদ। তারপর বলল, ফেরাউনী আর শাদ্দাদী শাসনের কবলে পড়ে গোটা পৃথিবী আজ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। এই অবস্থায় প্রতিটি মুসলামানের উপর এসেছে দুর্বহ দায়িত্ব। আমি দোয়া করি মুসলিম মিল্লাতের একজন হিসাবে আল্লাহ তোমাকে তোমার দায়িত্ব পালনের তওফিক দিন।
-জানো, আজ মার সাথে অনেক তর্ক হলো।
-কি নিয়ে?
-ইসরাইল আরব সমস্যা নিয়ে।
-তুমি বুঝি আরব মুসলমানদের পক্ষ নিয়েছিলে?
-আমি ন্যায়ের পক্ষ নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, স্যামুয়েল শার্লটক রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করে এবং আমেরিকায় প্রতিপালিত হয়ে যদি ইসাইলের নিয়ামক হতে পারেন, তাহলে আরব মুসলমানরা ইসরাইলের শাসন ও আইন প্রণয়নের অধিকার পাবে না কেন?
-সুন্দর তোমার যুক্তি। তোমার মা কি বলেছিলেন?
-তিনি বলছিলেন, জাতির প্রয়োজনে অবিচার জুলুম সব সময় অন্যায় নয়। আমি বলেছিলাম, তাহলে হিটলার আর নাজিদেরকে আমরা দোষ দিতে পারব কোন দিক দিয়ে।
মাহমুদ এমিলিয়ার চোখে চোখ রেখেছিল। তার চোখ বিস্ময় -আনন্দে নাচছে।
এমিলিয়ার মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। সে বলল, অমন করে চেয়ে থাকলে কিছু বলব না আমি।
মাহমুদ হেসে এমিলিয়ার গালে টোকা দিয়ে বলল, তুমি শুধু সুন্দরই নও এমি, তোমার যুক্তিগুলো আরও সুন্দর। ফিলিস্তিনীদের পক্ষ থেকে এমন করে এ সত্য কথাগুলো ইসরাইলীদের কানে কেউ কখনও তুলে দিতে পারেনি।
-যাও, আর কোন কথা বলব না। বলে এমিলিয়া ছুটে পালাল তার শোবার ঘরে। কিছুক্ষণ পরে এমিলিয়া প্লেটে করে মিষ্টি ও ফল অন্য হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে ফিরে এল। মাহমুদ বলল, রাত দুপুরে একি করছ এমি?
-কি করব সময়ে যে তোমাকে পাই না?
-সে আমার দোষ বটে।
-দোষ তোমার নয়, আমার ভাগ্যের।
-তা বটে, তানা হলে একজন নিশাচর মানুষ ভাগ্যে জুটবে কেন?
-অতএব কোন আপত্তি তো আর চলে না। হাসল এমিলিয়া।
টেবিলে প্লেট সাজিয়ে মাহমুদের সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও আর দেরি নয়।
মাহমুদ বলল, জানি আপত্তি চলবে না। কিন্তু তোমাকেও বসতে হবে এমি। খাবার প্লেট শেষ করল দু’জনে। খাবার প্লেট সরিয়ে রেখে মাহমুদের পাশে বসল এমিলিয়া। বলল, আচ্ছা মাহমুদ, আমি পড়েছি, বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা ইসলামের চূড়ান্ত লক্ষ্য; সুতরাং ইসলাম চরিত্রগত ভাবে সম্প্রসারণ মুখী। ইসলামের এই বৈশিষ্ট্যের সাথে সাম্রাজ্যবাদের পার্থক্য কোনখানে?
মাহমুদ বলল, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিলই সাম্রাজ্যবাদের মূল লক্ষ্য। বিজিত জাতির উপর বিজয়ী জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠাই সাম্রাজ্যবাদের একমাত্র কাম্য বিষয়। অন্য পক্ষে ইসলাম এক মতাদর্শের নাম। যেহেতু বিশ্বের মানুষের জন্য বিশ্বস্রষ্ঠার এটা মনোনীত জীবন বিধান, তাই বিশ্বের মানুষের সার্বিক কল্যাণ এর মধ্যেই নিহিত। সুতরাং বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা এর চূড়ান্ত লক্ষ্য। বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সে সানুষের কল্যাণ করতে চায় এক জাতির স্বার্থোদ্ধার বা অন্য জাতির ক্ষতি সাধন করা তার লক্ষ্য নয়। মুসলমান কখনও তার ব্যক্তিগত শাসন প্রতিষ্ঠা কিংবা মানুষকে নিজের গোলামে পরিণত করা এবং তাদের কঠোর শ্রমলব্ধ অর্থ অবৈধভাবে কেড়ে নিয়ে দুনিয়ার বুকে নিজের স্বর্গ সুখ রচনার জন্য যুদ্ধ করেনা আর মুসলমান হিসেবে এ সবের জন্যে সে সংগ্রাম ও করতে পারেনা। দুনিয়ার কোন প্রান্তের কোন দেশের বা কোন জাতির কে এসে শাসন ক্ষমতায় বসলো, তা নিয়েও কোন মাথা ব্যাথা ইসলামের নেই। ইসলাম শুধু দেখে, সে মংগলের ধর্ম ইসলামের অনুসারী কি না। বিজয়ী ও বিজেতা বলে মানুষের মধ্যে কোন বিভেদের দেয়াল তুলে দেয় না ইসলাম। মুসলমানরা যখন তাদের সংগ্রামে জয় লাভ করে, রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক হয়, তখন মুসলিম শাসদের উপর এক বিরাট দায়িত্ব এসে চেপে বসে। এর ফলে ঐ বেচারাদের রাতের ঘুম ও দিনের আরাম পর্যন্ত হারাম হয়ে যায়। ইসলামী রাষ্ট্রের শাসকের চাইতে বাজারের একজন নগণ্য দোকানদারের অবস্থা অনেক ভালো হয়ে থাকে। সে দিনের বেলা খলীফা বা শাসকের চাইতে বেশী উপর্জন করে এবং রাতের বেলা নিশ্চিন্তে আরামে ঘুমাতে পারে। কিন্তু খলীফা বেচারা না তার সমান উপার্জন করার সুযোগ পায় আর না পায় রাতের বেলায় নিশ্চিন্তে ঘুমানোর অবসর। দৃশ্যতঃ সাম্রাজ্যবাদও দেশ জয় করে, কিন্তু উভয়ের প্রকৃতিতে আসমান জমিন পার্থক্য বিদ্যমান।
মাহমুদের কথাগুলো যেন এমিলিয়া গোগ্রাসে গিলছিল। বলল সে, কিন্তু এমন কল্যাণ রাষ্ট্রের নমুনা আজ কোথায় মাহমুদ?
এর হুবহু নমুনা কোথাও হয়েতো খুঁজে পাবে না এমি। মুসলমানদের আদর্শ বিচ্যুতিই এর কারণ। এই আদর্শ বিচ্যুতির ফলে শুধু কল্যাণ রাষ্ট্রের বিলুপ্তি ঘটেছে তাই নয়, নির্যাতন আর গোলামীর শৃংখল নেমে এসেছে মুসলমানদের মাথায়। কয়েক লক্ষ ইসরাইলীর হাতে আমরা মার খাচ্ছি। তুর্কিস্তান ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে আমরা গোলামী করছি অন্য জাতির। আবিসিনিয়া ও স্পেন থেকে আমাদের অস্তিত্ব মুছে গেছে। আল্লাহ যে মুসলমানদেরকে বিশ্বের মানুষকে পথ দোখানোর দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন, সেই মুসলমানরা আজ চোখ বন্ধ করে অন্যের দেখানো পথে চলছে। আবেগ উত্তেজনায় মাহমুদের কণ্ঠ যেন বুজে আসল। থামল সে। আবার বলল, আমরা এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি এমি। সাইমুমের হাজার হাজার মুসলিম তরুণ এ পথে জীবন দিতে প্রস্তুত। আমরা শুধু ফিলিস্তিনের মুক্তি নয়, মুসলমানদেরকে পুনগঠিত পুনর্জাগরিত করে তাদের উপর থেকে নির্যাতন আর গোলামীর অবসান ঘটাতে চাই ¬- প্রতিষ্ঠিত করতে চাই কল্যাণ রাষ্ট্র। থামল মাহমুদ।
এমিলিয়াও নীরব। সেও ভাবছে। কিছুক্ষণ পরে সে বলল, মতাদর্শ হিসাবে কম্যুনিজমও আন্তর্জাতিক চরিত্রের। সুতরাং ইসলামের সাথে তো সংঘর্ষ তার অবশ্যম্ভাবী?
মাহমুদ হেসে বলল, দৃশ্যত তা বোঝায় কিন্তু কম্যুনিজমের উপর দিয়ে স্বাভাবিক নিয়মে যে পরিবর্তনের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, তাতে কম্যুনিজম রূপ নিতে যাচ্ছে পুঁজিবাদে। হেগেল থেকে মার্কস, মার্কস থেকে লেনিন, লেনিন থেকে ষ্টালিন, তারপর বর্তমান রাশিয়ার ঘটনা পরস্পরের বিচার করলেই তা বুঝতে পাবে। চীনও এ পথই ধরেছে। সুতরাং আপাতত কিছু সংঘর্ষ হলেও কম্যুনিজম ইসলামের সাথে প্রতিযোগিতার যোগ্য নয় মোটেই।
-কিন্তু পরিবর্তন তো ইসলামেরও এসেছে। বলল এমিলিয়া।
-না এমি, পরিবর্তন ইসলামের নয়, পরিবর্তন এসেছে মুসলমানদের আচার আচরণে। কম্যুনিজমের নির্মাতা মানুষ, মানুষ তার পরিবর্তন করতে পারে। কিন্তু ইসলাম মানুষের উদ্ভাবিত নয়, সুতরাং কোন মানুষ তার পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। আরও পড়াশুনা কর এমি, বুঝতে পারবে সব। মাহমুদ থামল।
মাথা নত করে চুপ করে বসে ছিল এমিলিয়া। মাথা তুলল সে। মাথা তুলতেই মাহমুদের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল। আবার চোখ নামিয়ে নিল এমিলিয়া। মুখ তার রাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বিজলী বাতির আলো রাঙ্গা মুখকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। মাহমুদ বলল, তোমার সুন্দর ঐ মুখ মনকে স্বপনের জাগতে নিয়ে যায়, কিন্তু তোমার মনের সত্যানুসন্ধিৎসা আবার ফিরিয়ে আনে মনকে বাস্তব জগতে। স্বপ্ন আর বাস্তবের সমাহারে তুমি অপরূপ এমি।
এমিলিয়া দু’হাতে মুখ ঢেকে বলল, যাও, মানুষকে খুব লজ্জা দিতে পার। মাহমুদ হেসে বলল, যাবার সময় হল এমি। এবার সত্যিই উঠতে হবে। এমিলিয়া বলল, বারে। তোমাকে বুঝি আমি যেতে বললাম?
-না বললেও যেতে হবে।
-কিন্তু এত তাড়াতাড়ি?
-রাত এখন বারটা। ওরা খুব ভাববে।
-ওরা কারা?
-আমার সহকর্মীরা।
-তুমি এখনে এসেছ ওরা জানে?
-হাঁ জানে। আমরা কিছু গোপন করতে পারি না এমি? প্রথম দিনই আমি এ বিষয়টি আমাদের হেড কোয়ার্টারে আমাদের অধিনায়ক আহমদ মুসাকে জানিয়েছি।
-তিনি কি বলেছেন। অধীর কন্ঠে বলল এমি।
-তিনি বলেছেন, তুমি মুসলমান – একথা স্মরণ রেখে পথ চললে কোন কাজেই তোমার ভুল হবে না। থামল মাহমুদ। আবার বলল, ইসলামের প্রতি তোমার অনুরক্তির কথা শুনালে তিনি খুব খুশী হবেন।
-এ কথাও জানাবে বুঝি?
-নিশ্চয়।
-আচ্ছা তোমার সংগঠন যদি তোমাকে আমার থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিত?
-সংগঠন দ্বিমত পোষণ করতে পারে বা জাতির কোন ক্ষতি হতে পারে, এমন কোন সিদ্ধান্ত আমি নিতে পারি না, একথা আমি যেমন জানি, আমার সংগঠনও তেমনি জানে।
-আচ্ছা ধর, এমন সিদ্ধান্ত যদি নিতো।
-আমি সংগঠনের সিদ্ধান্ত মেনে নিতাম।
-এমন নিষ্ঠুর হতে পারতে? কষ্ট হত না?
-হয়তো হতো, কিন্তু জ্ঞান ও কর্তব্যের নির্দেশ সবচেয়ে বড়।
এমিলিয়া হাসল। বলল, ভাগ্যবতী আমি তাই না?
মাহমুদ বলল, তুমি ভাগ্যবতী কিনা জানি না। কিন্তু আমার যাযাবর জীবনে তোমাকে পেয়েছি এক স্নিগ্ধ আলোর মতো। যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ি, যখন দেহমন শান্তির সন্ধানে উন্মুখ হয়, তখন তোমার স্মরণ আমাকে শান্তি দেয় এমি। দেহ মনকে সজীব করে নতুন শক্তিতে।
এমিলিয়া একটুক্ষণ চুপ করে থেকে ধীরে ধীরে বলল, আমি তোমার ঠিকানা জানতে চাই না, জিজ্ঞাসাও করব না তোমাকে কোথায় পাব। কিন্তু কথা দাও, তুমি মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে যাবে। জানি তুমি ব্যস্ত। কাজ তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ, তবু আমার অনুরোধ, উদ্বেগ যাতনায় জর্জরিত একটি হৃদয়ের শান্তনার জন্য তুমি আসবে।
-সময় পেলেই আমি আসব এমি। বলে থামল, তারপর বলল, আমার এবার যে উঠতে হয়।
-এমিলিয়া বলল, আর একটি কথা। ক্লাবে রেস্তোরায় আর যাই না। ইউনিভার্সিটির পড়াতেও মন বসাতে পারেছি না। শত চেষ্টা করেও মনকে ফিরিয়ে রাখতে পারি না তোমার চিন্তা থেকে। তুমি আমাকে কোন কাজ দাও, তোমার দেওয়া কাজ করে হয়তো হৃদয়ে শান্তি পাব।
মাহমুদ চিন্তা করল। বলল তারপর, তোমার সাহায্য পেলে আমরা সুখী হব এমি। কিন্তু হেড কোয়ার্টারের সাথে পরামর্শ না করে কোন কাজ আমি তোমাকে দিতে পারি না। থামল একটু তারপর আবার বলল মাহমুদ, তুমি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছ এমি?
-কি মনে কর তুমি?
-ক্লাবে রেস্তেরায় যাওয়ার মত নির্লজ্জতাও যখন ছেড়ে দিয়েছ, তখন মদ তুমি খেতে পার না।
-হাঁ, তোমার সাথে বল নাচের সেই রাত থেকেই মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি মাহমুদ।
মাহমুদের মুগ্ধ ও আনন্দোজ্জ্বল চোখ দু’টি পলকহীন দৃষ্টিতে এমিলিয়ার মুখের দিকে চেয়েছিল। ধীরে ধীরে সে এমিলিয়ার একটি হাত তুলে নিতে গেল।
মাহমুদের সেই দৃষ্টির সামনে গোটা দেহ যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল এমিলিয়ার। একটা অপরাধী স্পর্শ যেন তার গোটা দেহ অবশ করে দিচ্ছে। চোখ দু’টি বুজে এল তার। কাঁপছে যেন সে।
কিন্তু মাহমুদ সচেতন হল। মন তার স্বীকার করল, সীমা লংঘন করেছে সে। এমিলিয়ার হাত স্পর্শ না করে হাত টেনে নিয়ে বলল, না এমি, আমরা সীমা লংঘন করছি, আসি আজ।
চমকে উঠল এমিলিয়া। চোখ খুলল সে। মুক তার আরক্ত হয়ে উঠল, বলল, সত্যি বলেছ মাহমুদ। সাবধান হব আমরা ভবিষ্যতে। জানালার কাছে এসে দাঁড়াল মাহমুদ। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। জানালা দিয়ে নীচে তাকিয়ে আঁতকে উঠল এমিলিয়া। এই অন্ধকারে নামবে কেমন করে? তার কন্ঠে উৎকণ্ঠা।
মাহমুদ হাসল। বলল, ভেব না এমি। আমার অভ্যেস আছে্ দোয়া করো। আসি। খোদা হাফেজ।
-এসো, খোদা হাফেজ। হাসতে চেষ্টা করল, ঠোঁট কাপল শুধু। জানালা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল মাহমুদ। অন্ধকারে মাহমুদকে আর দেখা গেল না। এমিলিয়া দাঁড়িয়ে রইল ঐ খানে তেমনি ভাবে। চারিদিক নীরব। গোটা তেলআবিব যেন ঘুমাচ্ছে। বড় একা বোধ করল এমিলিয়া। জানালা থেকে সরে এল সে। মাহমুদের উপস্থিতির উষ্ণতা এমিলিয়া সব জায়গায় অনুভব করছে। এমিলিয়া সোফায় গিয়ে গা এলিয়ে দিল। হঠাৎ টি পয়ের উপর মাহমুদের একটি রুমাল চোখে পড়ল এমিলিয়ার। রুমালটি তুলে নিয়ে মুখে চেপে ধরল এমিলিয়া। দু’টি চোখ বুঁজে এল তার।
অপারেশন তেলআবিব-২
কায়রো। হোটেল নাইল। হোটেলের কফিখানা। কফিখানায় প্রবেশ করল আবদুল্লাহ জাবের। সাইমুমের কায়রো অপারেশন স্কোয়াডের প্রধান ইনি।
তখন সন্ধ্যা সাতটা। কফিখানা ভর্তি। সামনের একটি টেবিলে একটি সিট খালি দেখতে পেল জাবের। টেবিলের ওপাশে আর একজন লোক বসা। পরণে নীল স্যুট। শ্যাওলা রং-এর টাই। আরবীয় ধরনের লম্বাটে রোদপোড়া মুখ। কিন্ত তার ঘোলাটে লাল চোখ আর চেপ্টা নাক খুব স্বাভাবিক নয়। জাবের গিয়ে বলল, “বসতে পারি আপনার টেবিলে?”
লোকটির হাতে ছিল সেদিনকার আ-আহরাম কাগজ। কাগজটির পাতায় ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কলমের আঁচড়। কোনটি অনর্থক আঁচড়, কোনটি আরবী ও ইংরেজী বর্ণমালার কোন অক্ষর। কোনটি আবার কোন শব্দও হয়েছে। এমন ধরনের লোক আছে যাদের হাতে কলম যদি থাকে, কাগজ যদি পায়, আর অবসর সময়ও যদি থাকে তাহলে আর কোন কথা নেই- নিরুদ্দেশভাবে কলম তাদের চলবে। জাবের ভাবল লোকটি সেই প্রকৃতির। তার হাতে তখনও কলম ছিল। ইতস্তত কলম চালাচ্ছিল সে। কয়েকটি হিব্রু অক্ষর জাবেরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। মনোযোগ দিয়ে পড়ে চমকে উঠল জাবের। হুগো গ্যালার্ট? নামটি তার পরিচিত মনে হচ্ছে। এই সময় লোকটি মুখ তুলে জাবেরের প্রশ্নের জবাবে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। কথা বলল না।
জাবের বসল। এক কাপ কফির অর্ডার দিল সে। কিন্তু চিন্তা তার ঘুরপাক খাচ্ছে হুগো গ্যালার্ট নাম নিয়ে। হঠাৎ তার মনে পড়ল, গোপন বিশ্ব ইহুদী গোয়েন্দাচক্র ‘ইরগুণ জাই লিউমি’র একজন স্পাই হুগো গ্যালার্ট। ইসরাইলদের তথ্য সরবরাহ করতে গিয়ে সেদিন তেলআবিবে ধরা পড়েছে সাইমুমের হাতে।
কথাটা মনে হবার সাথে সাথে জাবেরের সমগ্র চেতনা সক্রিয় হয়ে উঠল। এই লোক হুগো গ্যালার্টের নাম জানল কি করে? হুগো গ্যলার্টের নাম জানে সাইমুম, ইসরাইল গোয়েন্দা এবং ইরগুণ জাই লিউমি। লোকটি সাইমুমের নয় মোটেই, তাহলে কি শেষোক্ত দল দু’টির কোন একটির? আবার মনে হলো জাবেরের, হুগো গ্যালার্ট নাম হয়ত আরো থাকতে পারে। এমনকি লোকটির নাম হুগো গ্যালার্ট-এমনও হতে পারে। কিন্তু জাবেরের মনে প্রশ্ন জাগল লোকটি হিব্রু জানল কি করে? ভাষাটা ইহুদীদের নিজস্ব এবং ওরাই ভাষাটিকে পুর্নজীবিত করে তুলছে। সুতরাং নামের ব্যপারটিকে কো-ইনসিডেন্স ধরলেও লোকটির হিব্রু জ্ঞান স্বাভাবিক নয়।
জাবের কফির কাপ থেকে মুখ তুলল। চাইল লোকটির দিকে। টেবিলের পাশে রাখা হ্যাট তুলে মাথায় পরছে সে। কপাল ও চোখের একাংশ অস্পষ্ট হয়ে গেছে। ক্লিন-সেভড মুখ। নিচের ঠোঁট ও থুতনির মাঝামাঝি জায়গায় একটি ছোট কাটা দাগ। লোকটি কাগজ মুড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
জাবের মুহূর্তে সিদ্ধান্ত ঠিক করে নিল। লোকটি কফিখানা থেকে বেরিয়ে যেতেই জাবেরও উঠে দাঁড়াল। কফিখানা থেকে বেরিয়ে এসে জাবের দেখল, লোকটি রিসেপশন রুমের পাশ দিয়ে লিফটরুমে গিয়ে ঢুকল। লোকটি কি তাহলে হোটেলের বাসিন্দা? ভাবল জাবের। লিফটে অনুসরণ করা সমীচীন মনে করল না সে। সন্দেহের কোন অবকাশ দিতে চায় না জাবের। সে রিসেপশন কাউন্টারের সামনে সোফায় গিয়ে বসল।
মাত্র ন’মিনিট। লোকটি ফিরে এল। লিফট-রুম থেকে বেরিয়ে কাউন্টারে এসে সে রিসেশনিস্টকে তার ঘরের চাবি দিয়ে দিল। জাবের দেখল, ৩০১ চিহ্নিত প্লাকে চাবিটি আটকিয়ে রাখল রিসেপশনিস্ট। ৩০১ সংখ্যাটি জাবের কয়েকবার উচ্চারণ করল মনে মনে।
হোটেলের দরজায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াল লোকটি। একবার সময় দেখলো। তারপর বেরিয়ে গেল হোটেল থেকে।
আবদুল্লাহ জাবের যখন তার গাড়ীতে উঠে বসল, তখন লোকটির ভাড়া করা ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়েছে গাড়ীর রিয়ার লাইটে গাড়ীর নম্বর স্পষ্ট হয়ে উঠল। সাইমুম কর্মী তৌফিকের গাড়ী ওটা। ঘটনার অভাবনীয় আনুকূল্যের জন্য জাবের আল্লাহকে অশেষ শুকরিয়া জ্ঞাপন করল।
নাসের এভিনিউ ধরে গাড়ী এগিয়ে চলেছে। সন্ধ্যার রাজপথ। প্রচন্ড ভীড় গাড়ীর। নাসের এভিনিউ পার হয়ে গাড়ী ফারুক এভিনিউতে পড়ল। জাবের সাইমুমের সাউন্ড-কোর্ড-এ তৌফিকের উদ্দেশ্যে সংকেত পাঠালো। কয়েক সেকেন্ড পর সামনের গাড়ী থেকে পরিচিত সংকেত এল গাড়ীর হর্ণ থেকে।
গাড়ী আতাবা-আল-খাদরায় প্রবেশ করল। কায়রো শহরের পুরাতন আর নতুন অংশের এটা সংগমস্থল। এখান থেকে ডজন খানেকেরও বেশী বড় ও ছোট রাস্তা শহরের বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। আতাবা আল খাদরা থেকে তৌফিকের গাড়ী ইবনুল আরাবী রোড ধরে পূর্ব দিকে এগিয়ে চলল। নীল নদের তীর ঘেঁষে গওহর রোড। ইবনুল আরাবী রোড এই গওহর রোডে গিয়ে মিশেছে। তৌফিকের গাড়ী এসে গওহর রোডের উপর নীল নদের তীর ঘেঁষে নির্মিত গওহর মসজিদের পাশে দাঁড়াল। ফাতেমী বংশের খলিফা আল-মুইজের সেনাপতি গওহর এই মসজিদের নির্মাতা। তিনি কায়রো শহরেরও প্রতিষ্ঠাতা। শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৬৯ খৃষ্টাব্দে।
লোকটি গাড়ী থেকে নেমে তৌফিককে তার ভাড়া মিটিয়ে দিল। পকেট থেকে টাকা বের করার সময় এক টুকরো কাগজ লোকটির পকেট থেকে পড়ে গেল। তৌফিককে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ তোলায় সে এটা লক্ষ্য করতে পারলো না।
ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সে নদীর ধারে বেঁধে রাখা ‘দাহাবিয়া’র দিকে এগিয়ে গেল। ‘দাহাবিয়া’ বজরা নৌকা বিশেষ। নীল নদীতে ভ্রমণ, নদী পারাপার ইত্যাদি কাজের জন্য এগুলো ব্যবহৃত হয়। নদীতে ভ্রমণের জন্য বৈকালে লোকের প্রচুর ভীড় জমে। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে তবু অনেক লোকজন দেখা যাচ্ছে। লোকটি একটি দাহারিয়ায় গিয়ে উঠল।
জাবের তৌফিকের পাশে এসে দাঁড়াতেই তৌফিক লোকটির পকেট থেকে পড়ে যাওয়া কাগজটি তার হাতে দিল। সেই হিব্রু লিখা। জাবের পড়ল,
“আজ রাত ৮-১৫ ৯নং জাজিরা-৩”
নীল নদের মধ্যে ছোট সুন্দর দ্বীপ রয়েছে। এই দ্বীপগুলোকে বলে জাজিরা। এই জাজিরাগুলোতে সুন্দর সুন্দর বাড়ী তৈরী করে বাস করছে কায়রোর ধনী অভিজাত আর বড় বড় সরকারী কর্মচারীরা। জাজিরার বাড়ীগুলো দেখতে খুব সুন্দর। প্রায় প্রতিটি বাড়ীর সামনে বাগান। বিখ্যাত বিদেশী গাছে ঘেরা বাড়ীগুলো। রাজতন্ত্রের যুগে জাজিরাগুলো আমির-ওমরাহদের বাসস্থান হিসেবে প্রায় নির্দিষ্ট ছিল। মিসরের অনেক উত্থান-পতন এবং অগণিত অঘটন সংঘটনের ইতিহাসের সাথে এই জাজিরাগুলোর নাম জড়িত। জাবের লিখাটির অর্থ করল, আজ রাত দশটায় তিন নম্বর জাজিরার নয় নম্বর বাড়ীতে একটা কিছু হচ্ছে। লোকটি জাজিরার সেই বাড়ীতেই তাহলে যাচ্ছে।
৩নং জাজিরার নয় নম্বর বাড়ী-মনে মনে সন্ধান করল জাবের। মরহুম ফিন্ড মার্শল আবদুল হাকিম আমরের বাড়ী এই জাজিরাতে। এই জাজিরাতেই মেজর জেনারেল আবুদল হাফিজ রশিদ এবং কায়রো গ্যারিসনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ব্রিগেডিয়ার ফখরুদ্দীন আলীর গ্রীষ্মাবাস। এছাড়াও সরকারী ও বেসরকারী আরও কয়েকজন অভিজাত পরিবার বাস করেন এই জাজিরাতে। কিন্তু জাবের ঠিক করতে পারলো না কোন বাড়ীটির নম্বর ‘নয়’।
-ফিন্ড মার্শল আবদুল হাকিম আমরের বাড়ীর নম্বর কত তুমি জান তৌফিক? তৌফিকের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল জাবের।
তৌফিক তাড়াতাড়ি তার ড্রাইভিং সিটের তলা থেকে একটি ক্ষুদ্র নোটবই বের করল। নোটবই দেখে তৌফিক বলল, পাঁচ নম্বর।
-আর নয় নম্বর বাড়ী? পুনরায় জিজ্ঞেস করল জাবের।
-নয় নম্বর বাড়ী হ’ল ফখরুদ্দীন আলী সাহেবের। কিন্তু তিনি গ্যারিসনের স্টাফ কোয়ার্টারেই বাস করেন। মাস খানেক হলো বোধ হয় তিনি বাড়ীটি ভাড়া দিয়েছেন। সাইপ্রাসের ইসহাক এমিল নামের একজন ধনী ব্যবসায়ী এই বাড়ীটিতে বাস করছেন এখন।
-লোকটিকে তুমি দেখেছ?
-একবার দেখেছি। বয়স ৪৫ থেকে ৫০। মাথায় টাক। গ্রীকদের মত আরবী উচ্চারণ। মুসলমান বলে মনে হয়নি আমার কাছে।
-কেন?
-লোকটি হিব্রু জানে, অথচ তুর্কি জানে না। সাইপ্রাসে টারকিশ সাইপ্রিয়টদের সংস্পর্শে বাস করে তুর্কি জানে না-এটা অবিশ্বাস্য।
-ঠিক বলেছ তৌফিক। কিন্তু লোকটি হিব্রু জানে কেমন করে বুঝলে তুমি?
-আমি একদিন তাকে লিফট দিয়েছিলাম। ভাড়া নেবার সময় তার তর্জ্জনীর সোনার আংটিতে একটি হিব্রু অক্ষর দেখেছি।
জাবের কিছুক্ষণ চিন্তা করল। তারপর কিছুটা স্বগত স্বরেই বলল, তুমি আজ যাকে লিফট দিলে, সেও হিব্রু জানে এবং সে যেখানে যাচ্ছে সেখানেও হিব্রু জানা লোক, এর অর্থ কি তৌফিক।
-অর্থ পরিষ্কার, Another jews Conspiracy (আর একটি ইহুদী ষড়যন্ত্র)।
-কিন্তু একেবারে তা ব্রিগেডিয়ার ফখরুদ্দিন আলীর বাড়ীতে বসে?
-জি, এটা বিস্ময়কর বটে।
নীল নদের একটি ক্ষুদ্র জাজিরা। ব্রিগেডিয়ার ফখরুদ্দিন আলীর বাসভবন। বাড়ীর চারদিকে ঘেরা বাগান। বাগানের বহিঃপ্রান্ত দিয়ে কাঁটা তারের বেড়া। বাড়ীর সামনে বিরাট লোহার ফটক। সেখান থেকে বাগানের মধ্যে দিয়ে একটি লাল শুড়কীর রাস্তা গাড়ী বারান্দায় গিয়ে ঠেকেছে। বাড়ীর দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে বিভিন্ন প্রকার বিদেশী গাছ লাল রং এর বাড়ীটি ঘিরে সবুজের মেলা বসিয়েছে। বাড়ীর এই অংশ অনেকটা অন্ধকার। বাড়ীর প্রধান অংশ উত্তর ও পূর্বদিকে। দক্ষিণ দিকে প্রচীর দিয়ে ঘেরা। পশ্চিম দিকে রান্না ও ভাড়ার ঘর। দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে কোন আলো দেখা যাচ্ছে না। গাছের ছায়ায় এ অংশে অন্ধকার আরো ঘনিভূত হয়ে উঠেছে।
দ্বিতলের একটি হলঘর উজ্জ্বল আলোতে ঝলমল করছে। ঘরটির দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিকে একটি করে কাঁচের জানালা। জানালাগুলো বন্ধ। সেগুলো আবার কালো পুরু কাপড় দিয়ে ঢাকা। এর ফলে ঘরের অভ্যন্তরের কথা ও দৃশ্য-দুটোরই বর্হিগমন রুদ্ধ হয়েছে। দক্ষিণের জানালার সামনে একটি বড় সোফা। এতে বসেছেন ব্রিগেডিয়ার ফখরুদ্দিন আলী এবং এসহাক এমিল। এ সোফার পূর্ব পাশে আর একটি সোফা। এটাতে বসেছে হোটেল নাইল থেকে আগত সেই লোকটি। সোফার সামনে টি পয় দু’টির উপর কফির খালি পেয়ালা পড়েছিল। বেয়ারা এসে কুড়িয়ে নিয়ে গেল। সে বেরিয়ে যাবার সময় ভালো করে দরজা এটে দিল। বেয়ারা বেরিয়ে যাবার পর ইসহাক এমিল নড়েচড়ে বসল। বলল, এবার বলুন মিঃ আলী।
ব্রিগেডিয়ার আলী বললেন, আমার প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। আলেকজান্দ্রিয়া নৌঘাঁটির ভাইস এডমিরাল আলী আশরাফ, ইসমাইলিয়া ও পোর্ট সৈয়দের সহকারী সেনাধ্যক্ষ কর্ণেল শরিফ ও আহসানের সমর্থন আমি পেয়েছি। এছাড়া কায়রো বিমান ঘাটির এয়ার কমোডর ফারুকী এবং স্কোয়ার্ডন লিডার সেলিম ও কামালও যোগ দিয়েছে আমার সাথে। আপনাদের সহযোগিতা পেলে আমি সফল হবো আশা করি।
ইসহাক এমিল পাশের সোফায় বসা হোটেল নাইল থেকে আগত লোকটির দিকে ইশারা করে বলল, এ সম্পর্কে বিস্তারিত প্রোগ্রাম নিয়ে এসেছেন মিঃ স্যামুয়েল আলফ্রেড। সবকিছু তিনিই জানাবেন।
স্যামুয়েল আলফ্রেড বিশ্ব ইহুদী আন্দোলনের গোপন প্রতিষ্ঠান ‘ইরগুণ জাই লিউমি’র একজন বিশিষ্ট সদস্য। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার আলীর কাছে তার পরিচয় বিশ্বশান্তি পরিষদের (ওয়ার্ল্ড পিস ব্রিগেড)-এর একজন মুখপাত্র হিসেবে। ইসহাক এমিলেরও এই পরিচয় তার কাছে। ব্রিগেডিয়ার আলীকে বোঝান হয়েছে, বিশ্ব শান্তির জন্য মিসরের বর্তমান সরকারের পরিবর্তন বিশ্বের শান্তিকামীদের কাম্য। বর্তমান আনোয়ার রশিদ সরকারের পরিবর্তনে মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান সম্ভব হবে বলে তাঁকে জানানো হয়েছে এবং ওয়ার্ল্ড পিস ব্রিগেড এবং বিশ্বের শান্তিকামীদের তরফ থেকে ব্রিগেডিয়ার আলীকে আশ্বাস দেয়া হয়েছে যে, রশিদ সরকারের পরিবর্তে তাকে মিসরের ক্ষমতায় আসীন করতে সব সহযোগিতা দান করা হবে। স্যামুয়েল আলফ্রেড এসেছেন ওয়ার্ল্ড পিস ব্রিগেড তথা বিশ্বশান্তি পরিষদের তরফ থেকে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য নিয়ে।
ইসহাক এমিল থামলে স্যামুয়েল আলফ্রেড বলল, মিঃ আলী আমাকে শুধু ওয়ার্ল্ড পিস ব্রিগেডের মুখপাত্র বলেই আপনি মনে করবেন না, শান্তিকামী রাশিয়া, বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারী বক্তব্যও আমিই বহন করে এনেছি। বলে স্যামুয়েল আলফ্রেড তার পকেট থেকে তিনটি চিঠি বের করে ব্রিগেডিয়ার আলীর হাতে দিলেন। চিঠিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা দপ্তরের এবং সেগুলোতে এসব দেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর সহি ও সীলমোহর রয়েছে।
স্যামুয়েল আলফ্রেড আবার শুরু করলেন, ১১ই রবিউল আউয়াল সন্ধ্যায় প্রধান সেনাপতি জেনারেল আবু তারিক আল জামাল এক গোপন সফরে দেশের বাইরে যাচ্ছেন, আমরা চাই তারা যেন আর কোন দিন দেশে ফিরে আসতে না পারেন।
স্যামুয়েল আলফ্রেডের কথা শেষ না হতেই ব্রিগেডিয়ার আলী প্রশ্ন করলো, তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন ঐ দিন।
স্যামুয়েল একটু হাসল। বলল তারপর, বিশ্ব শান্তির শত্রু সাইমুম আহূত সম্মেলনে যোগ দিতে সৌদী আরবে। স্যামুয়েল থামল একটু। তারপর বলল আবার, ১১ তারিখ দিনগত রাত ও ১২ তারিখের দিনের মধ্যেই সব কাজ সম্পন্ন করতে হবে। সম্ভব হলে এর আগেও অভ্যুত্থান চলতে পারে, কিন্তু কোন ক্রমেই তা ১২ই রবিউল আউয়াল থেকে পিছিয়ে দেয়া চলবে না। ১২ই রবিউল আইয়াল চুড়ান্ত।
ব্রিগেডিয়ার আলী বলল, রশিদ সরকারের অনুগত সামরিক অফিসারদের বিস্তৃত লিষ্ট তৈরী সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম আঘাতেই আমরা ওদের সরিয়ে ফেলবো, তারপরের কাজ খুব কঠিন হবে না আমাদের জন্য। কিন্তু ভাবছি আমি রশিদ সরকারের বন্ধু এবং সাইমুমের প্রভাবাধীন পার্শ্ববতী আরব রাষ্ট্রগুলোর কথা। যদি ওদের সাহায্য পেয়ে ডিফেন্স তৈরী হয় আমাদের বিরুদ্ধে?
স্যামুয়েল আলফ্রেড বলল, এ চিন্তা আমরাও করেছি, কিন্তু এতে উদ্বেগের কিছুই নেই। কায়রো বেতার থেকে আপনাদের অভ্যুত্থান ও নতুন সরকার গঠনের কথা ঘোষিত হবার পর মুহূর্তেই রাশিয়া, বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল প্রভৃতি রাষ্ট্র আপনার নতুন সরকারকে স্বীকৃতি ও সমর্থন দিবে। যদি পার্শ্ববর্তী বা বাইরের কোন দেশ সামান্য হস্তক্ষেপেরও চেষ্টা করে মিসরের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে, তাহলে নতুন সরকারের নিরাপত্তার জন্য ঐ রাষ্ট্রসমূহ এগিয়ে আসবে এবং এজন্য তারা যে কোন ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। এমন কি আপনার সরকার যদি অভ্যন্তর থেকেও কোন মারাত্মক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়, তাহলে যে কোন সাহায্যের জন্য ইসরাইলী সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তুত থাকবে। গত ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে পাওয়া মিসরীয় বিমান বাহিনীর প্রতীক সম্বলিত কিছু বিমান ও মিসরীয় বাহিনীর বহু ট্যাংক ইসরাইলের কাছে রয়েছে, প্রয়োজনবোধে ইসরাইল এসব আপনার সরকারের সাহায্যের জন্য নিরাপদে ব্যবহার করতে পারবে।
ব্রিগ্রেডিয়ার আলী বলল, আমি কৃতজ্ঞ থাকব আপনাদের সাহায্যের জন্য।
স্যামুয়েল আলফ্রেড বলল, সব সাহায্যের বিনিময়ে আমরা কয়েকটি শর্তের প্রতি আপনার স্বীকৃতি দাবী করছি –
(১) সাইমুমের সাথে আপনার সরকার কোন সম্বন্ধ রাখতে পারবে না এবং যাদের সাথে বা যে সরকারের সাথে সাইমুমের সম্পর্ক আছে, তাদের সাথে আপনার সরকার কোন সম্পর্ক রাখতে পারবে না।
(২) ইসরাইলের সাথে মিসর প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যোগ দেবে।
(৩) মিসর ‘ওয়ার্ল্ড পিস ব্রিগেড’-এর সদস্য হবে।
কথা শেষ করে থামল স্যামুয়েল আলফ্রেড।
ব্রিগেডিয়ার আলী কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল, শর্তগুলোর কোনটিই কঠিন নয় এবং ঐগুলোর সাথে আমি একমত। কিন্তু দ্বিতীয় শর্তটি জনমনের সাথে সম্পর্কিত ও সেন্টিমেন্টাল। এর বাস্তবায়ন কিছুটা সময় সাপেক্ষ হতে পারে, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও বৃটেনের সাহায্য সহযোগিতা পেলে তা কঠিন হবে না মোটেই।
স্যামুয়েল আলফ্রেড বলল, শুনে খুশী হলাম। আমরা সকলে সেই শুভ দিনটির অপেক্ষা করব।
ইসহাক এমিল তার সামনের টি পয়ের একটি সুইচে চাপ দিল। কিছুক্ষণ পরে একটি ট্রেতে করে ফরাসী লেবেল দেয়া মদের দু’টি বোতল আর কয়েকটি গ্লাস নিয়ে প্রবেশ করল বেয়ারা।
ফরাসী হুইস্কি নিয়ে যখন ওরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল তখন দেখা গেল দক্ষিণের জানালায় একটি ছায়ামূর্তি অতি সন্তর্পণে একটি হাই সেন্সেটিভ রেডিও রিসিভার তার সমেত গুটিয়ে নিয়ে পকেটে রাখল। কাঁচের জানালার ১ বর্গফুট পরিমিত স্থান থেকে কাঁচ কেটে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেই পথ দিয়ে একটি হাই সেন্সেটিভ রেডিও রিসিভার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। রেডিও রিসিভারের বাইরের প্রান্তে একটি রেকর্ডার সংযুক্ত ছিল।
ছায়ামূর্তিটি আর কেউ নন আবদুল্লাহ জাবের। ঘরের ভেতরের সবগুলো কথাই জাবের শুনেছে। বিস্ময় ও উত্তেজনায় সে ঘেমে উঠেছে। কি জঘন্য তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জাবের নিশ্চিত ইসহাক এমিল এবং স্যামুয়েল আলফ্রেড দু’জনেই গোপন বিশ্বইহুদী গোয়েন্দাচক্র ‘ইরগুণ জাই লিউমি’র লোক। জাবের বুঝতে পারছে,
ইহুদীদের এটা মরণ কামড়। সাইমুমের কাজ এবং পরিকল্পনাকে কোন পথে বানচাল করতে না পেরে, অবশেষে মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে শেষ রক্ষা করতে চাচ্ছে তারা। রশিদ সরকারের পরিবর্তন ঘটিয়ে পুতুল সরকারের পত্তন করে ইহুদীরা একদিকে সাইমুম আহূত আসন্ন আরব-সম্মেলনকে বানচাল করতে চাচ্ছে, অপরদিকে ফিলিস্তিনের মুক্তি পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিতে চাচ্ছে। সাইমুমের হেড কোয়ার্টারে অবিলম্বে খবর পৌঁছানো দরকার। জাবের চঞ্চল হয়ে উঠল। প্রতিটি মুহূর্ত তার কাছে মনে হচ্ছে একযুগ।
কার্নিস বেয়ে পা টিপে টিপে জাবের পানির পাইপের দিকে এগুলো। পানির পাইপ ওখান থেকে মাত্র তিনগজ দূরে। এই তিনগজ স্থান পার হতে জাবেরের সময় লাগল পুরো সাত মিনিট।
জাবের যখন তার ঘাটিতে ফিরে এল, তখন রাত দশটা। পৌঁছেই সে বাড়ীর চিলে কোঠায় উঠে গেল। এখানে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রেডিও ট্রান্সমিটার রয়েছে। জাবের রেডিও ট্রান্সমিটারের পাশে বসা ইঞ্জিনিয়ার আকরম ফারুকের পাশে বসে মেসেজ তৈরী করল এবং তা আকরম ফারুকের হাতে দিয়ে দিল। মেসেজটি আম্মানে সাইমুমের হেড কোয়ার্টারে পাঠাতে ৭ মিনিট সময় লাগল।
মেসেজটি পাঠানোর পরও জাবের সেই রেডিও রুমেই রইল। তার চঞ্চল চোখ বার বার রেডিও রিসিভারের উপর দিয়ে ঘুরে আসছে। তার কান দু’টি উৎকর্ণ হয়ে আছে রেডিও রিসিভার থেকে ‘ঝিৎস’ শব্দ শোনার জন্য। জাবের নিশ্চিত, জরুরী কোন নির্দেশ হেড কোয়ার্টার থেকে আসছে। এক মিনিট দু’মিনিট করে গত হ’ল ১ ঘন্টা ১৫ মিনিট। হঠাৎ রেডিও রিসিভারে একটি লাল আলো জ্বলে উঠল এবং সাথে সাথে ভেসে এল মিষ্টি সিগন্যাল। আরও পাঁচ মিনিট গত হ’ল। রেডিও ইঞ্জিনিয়ার আকরম ফারুক একটি মেসেজ এনে জাবেরের হাতে দিল।
জাবের দ্রুত চোখ বুলাল তাতেঃ
“জাবের, প্রেসিডেন্ট আনোয়ার রশিদের সাথে কথা হল। তিনি
তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি হেড কোয়ার্টারে। তুমি এখনই
যাও। খোদা সহায়, তোমাদের মিলিত প্রচেষ্টা বিশ্ব-ইহুদী আর তার
মুরুব্বীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দিতে পারবে। আহমদ মুসা।”
মেসেজটি পড়া শেষ করে জাবের উঠে দাঁড়াল। দ্রুত নেমে গেল নীচে।
রাত সাড়ে এগারটা। জনবিরল রাজপথ। ঘন্টায় ৮০ মাইল বেগে উর্ধ্বশ্বাসে এগিয়ে চলেছে জাবেরের কাডিলাক।
কায়রো আর্মি হেড কোয়ার্টারের প্রশস্ত গেট। উচিয়ে ধরা সঙ্গীনের সামনে এসে জাবেরের গাড়ী ক্যাচ করে এক শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ল। জাবের গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে বলল, আমি আব্দুল্লাহ জাবের। সঙ্গে সঙ্গে উচিয়ে ধরা সঙ্গীনের মাথা নেমে গেল। আর পর মুহূর্তেই খুলে গেল ফটক। জাবেরের গাড়ী এগিয়ে চলল। আঁকা-বাঁকা অনেক পথ পার হয়ে হেড কোয়ার্টারের বারান্দায় এসে দাঁড়াল তার গাড়ী। গাড়ী থেকে নামতেই দেখা হল সহকারী সেনাধ্যক্ষ লেঃ জেঃ আহসান আল-জামিলের সাথে। তার চোখ মুখে উত্তেজনার ছাপ। বলল, আসুন আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন।
তারা একটি হল ঘরে প্রবেশ করল। লোকারণ্য হল ঘরটি। বিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিল। মাঝখানের চেয়ারটিতে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার রশিদ বসে আছেন। তার ডান পাশে প্রধান সেনাপতি আবু তারিক আল-জামাল। প্রধান সেনাপতির ডান পাশে বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর অধিনায়কদ্বয় বসেছেন। এছাড়া মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ এবং সেনাবাহিনীর কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ অফিসার রয়েছেন। আনোয়ার রশিদের সামনে একটি চেয়ার খালি ছিল। সেখানে গিয়ে বসল আবদুল্লাহ জাবের।
আনোয়ার রশিদ প্রশান্ত দৃষ্টিতে চাইলেন জাবেরের দিকে। বললেন, আহমদ মুসার কাছে কিছু ইংগিত পেয়েছি মাত্র। আপনার কাছ থেকে বিস্তারিত জানার জন্য আমরা উদগ্রীবভাবে অপেক্ষা করছি।
কোন ভূমিকা না করে জাবের বলল, একজন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে অনুসরণ করে জাজিরার একটি বাড়ীতে গিয়েছিলাম। বাড়ীটি ব্রিগেডিয়ার ফখরুদ্দীন আলীর। আমি সেখানে ‘ইরগুণ জাই লিউমি’র দু’জন লোকের সাথে ব্রিগেডিয়ার আলীকে এক পরামর্শ সভায় মিলিত হতে দেখেছি। তাদের আলোচনার রেকর্ড আমার কাছে রয়েছে। রেকর্ডই আপনাদের সব বলবে। বলে জাবের পকেট থেকে ক্ষুদ্র রেকর্ডার বের করল। রেকর্ডারটির সাথে তখনও রেডিও রিসিভার সংযুক্ত ছিল। রেডিও রিসিভারটি খুলে নিয়ে জাবের রেকর্ডারটি টেবিলের উপর রাখল।
জাবের লাউড স্পিকারের সাথে জুড়ে দিলেন রেকর্ডারটি। সমগ্র হলঘরে অখন্ড নিরবতা। রেকর্ডারটি বেজে চলেছে। দু’টি কণ্ঠস্বর অপরিচিত। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার আলীর কণ্ঠস্বরটি চিনতে পারছে ঘরে উপস্থিত সবাই। প্রেসিডেন্ট রশিদের মুখ নত। চোখের নিষ্পলক দৃষ্টি টেবিলে নিবদ্ধ। তার মুখে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। প্রধান সেনাপতি, বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর অধিনায়কদের ভীষণ উত্তেজিত দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রীদের মুখমন্ডল বিবর্ণ। রেকর্ড শেষ হয়ে এল। জাবের সুইচ টিপে বন্ধ করে দিলো রেকর্ড।
কিছুক্ষণ নিরব সবাই। প্রথম কথা বলল, প্রধান সেনাপতি আবু তারিক, এবার তাহলে সবকয়টা বৃহৎ শক্তিই ইহুদীদের পেছনে এসে দাঁড়ালো।
জাবের বলল, দাঁড়াল নয় জনাব, দাঁড়িয়েছিল শুরু থেকেই। ইসরাইলকে তো ওরাই সৃষ্টি করেছে তাই ওরা ইসরাইলকে লালন করবে তা বিচিত্র নয়।
বিমান বাহিনীর তরুণ অধিনায়ক মার্শাল আব্দুল্লাহ সোহায়েল বলল, এ ষড়যন্ত্র রশিদ সরকারের বিরুদ্ধে নয়, এ ষড়যন্ত্র কোটি কোটি নিপীড়িত জনতার স্বার্থের বিরুদ্ধে। সুতরাং মিসর সরকারের সামরিক অফিসার হিসেবে শুধু নয়, একজন মুসলমান হিসেবে দায়িত্ব এসেছে আমাদের উপর এ ষড়যন্ত্র ধ্বংস করে দেবার। আমরা নির্দেশ চাই। তার কণ্ঠস্বর আবেগে রুদ্ধ হয়ে এল শেষের দিকে।
প্রধান সেনাপতি আবু তারিক প্রেসিডেন্ট রশিদের মুখের দিকে তাকালেন। তিনিও মুখ তুলেছেন। গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল তাঁর। প্রধান সেনাপতিকে তিনি বললেন, রাত্রি ভোর হবার আগে ষড়যন্ত্রকারীদের সবাইকে এখানে হাজির করো আবু তারিক। তারপর জাবেরের দিকে চেয়ে তিনি বললেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে লজ্জা দিব না আপনাদের। জাতির সেবায় আমাদের চেয়ে অনেক উর্ধ্বে আপনারা। আমি আশা করি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সাথে আজ আপনাদেরকেও আমরা পাব।
জাবের বলল, আমাদের সমস্ত শক্তি আপনাদের সাথে থাকবে। কিন্তু একটি অনুরোধ, ‘ইরগুন জাই লিউমি’র লোকদের আমাদের হাতে দিতে হবে। ওদের বিচার আমরাই করবো।
প্রেসিডেন্ট রশিদ বললেন, আপনার ইচ্ছা পূর্ণ হবে। প্রেসিডেন্ট রশিদ উঠে দাঁড়ালেন। উঠে দাঁড়ালেন সবাই।
পরদিন আল আহরাম পত্রিকায় খবর বেরুল,
“মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টা
বিগ্রেডিয়ার ফখরুদ্দীন আলীসহ আরো পঁচিশজন
সামরিক অফিসার ধৃত”
খবরে সামরিক সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, কায়রো গ্যারিসনের জি, ও, সি, ব্রিগেডিয়ার ফখরুদ্দীন আলী মোবারকের নেতৃত্বে রশিদ সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল। এ ষড়যন্ত্রের সাথে কোন কোন বিদেশী শক্তির গোপন হাত ছিল বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, রশিদ সরকারকে উৎখাত করে মিসরে একটি প্রো-ইসরাইলী সরকার গঠন ষড়যন্ত্রকারীদের উদ্দেশ্য ছিল।
উপরোক্ত খবরের পাশে আর একটি খবর। খবরটিতে রশিদ সরকারের বিপদ-উত্তরণে খোশ আমদেদ জানিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র প্রধানদের কাছ থেকে বার্তা এসেছে। এদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে রাশিয়া, বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম।
কায়রোর পথে ঘাটে, রেস্তোরাঁয় যখন ব্যর্থ অভ্যুত্থানের বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে, তখন আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশের তিনতলা বাড়ীটির ভুগর্ভস্থ একটি কক্ষের তড়িৎ আসনে শায়িত ‘ইরগুণ জাই লিউমি’র কায়রো প্রধান ইসহাক এমিল তার স্পাই নেট ওয়ার্কের বিবরণ বলে যাচ্ছে। লিখে নিচ্ছে আবদুল্লাহ জাবের।
জাবের বলছে, কায়রো, ইসমাইলিয়া ও পোর্ট সৈয়দে তোমাদের লোকদের পরিচয় দিলে, আলেকজান্দ্রিয়ায় তোমাদের লোকদের পরিচয় এখনও দাওনি।
এমিল বলল, বিশ্বাস করুন, ওখানে আমাদের কোন লোক নেই।
জাবের বলল, আমি জানি ওখানে তোমাদের গুরুত্বপূর্ণ লোক রয়েছে। তোমাকে বলতে হবে, ভাই এ্যাডমিরাল আলী আশরাফের সাথে তোমাদের কোন লোক যোগাযোগ করেছিল?
এমিল নীরব। ইলেকট্রিক মেগনেটো আবার হাতে তুলে নিলো জাবের। বিবর্ণ হয়ে গেল ইসহাক এমিলের মুখ। বলল সে, বলব-বলছি আমি।
জাবের ফিরে এসে তার সামনে বসল। বলে চলল এমিল, আলেকজান্দ্রিয়ার হোটেল প্রিন্স-এর পরিচারিকা মিস জামিলা ও মিস রায়হানা আমাদের লোক। ওদের প্রকৃত ইহুদী নাম ইলিহ এবং ইশতার ফ্রেডম্যান। গত দু’মাস ধরে তারা চাকুরি করছে ওখানে মুসলিম মহিলার ছদ্মবেশে। ‘আলি ব্রাদারস এন্ড কোং’ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের সেলসম্যান ফারুকী এবং মিস সেলিনা আমাদের পক্ষে কাজ করছে। ওদের প্রকৃত ইহুদী নাম জোসেফ পাপ এবং সিদি মার্কস। থামল এমিল।
জাবের চিন্তা করল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, ভাইস এডমিরাল আলী আশরাফের সাথে তোমাদের যোগাযোগ হয়েছিল কিভাবে? আর তোমাদের লোকেরা ‘হোটেল প্রিন্স’ ও ‘আলী এন্ড ব্রাদার্স’-এ চাকুরিই বা পেল কেমন করে?
এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কোন দ্বিধা করল না এমিল। সে বলল, আজ থেকে ছয় মাস আগে ‘ইরগুণ জাই লিউমি’ আমাদেরকে মিসরে প্রেরণ করে। ‘ইরগুন জাই লিউমি’র পক্ষ থেকে ইসরাইলের জন্য মিসরের গোপন সামরিক তথ্যাদি সংগ্রহ করা ছিল আমাদের দায়িত্ব। আমরা জানতাম, মিসরের উর্দ্ধতন সামরিক অফিসারদের সংস্পর্শে না আসতে পারলে, এ ধরনের খবর সংগ্রহ সম্ভব নয়। আমরা এই প্রচেষ্টাই শুরু করলাম। সুন্দরী নারী এবং অর্থই ছিল আমাদের প্রধান হাতিয়ার। মিসরের অফিসারদের পেছনে আমরা যেসব সুন্দরী ইহুদী তরুণী লেলিয়ে দিয়েছিলাম মিস ইলিহ্ ও মিস ইশতার ফ্রেডম্যান ছিল তাদের অন্যতম। মিস ইলিহ্ ও মিস ইশতার ফেডম্যান মাত্র ১৫ দিনের চেষ্টায় ভাইস এডমিরাল আলী আশরাফকে শয্যা সঙ্গী করতে সমর্থ হয় এবং পরবর্তীকালে সে আমাদের মুঠায় এসে যায়। তারই সাহায্যে মিস ইলিহ্ ও মিস ইশতার জোসেফ পাপ ও সিদি মার্কস চাকরি লাভ করে।
-ব্রিগেডিয়ার ফখরুদ্দিন আলী এবং অন্যান্য সামরিক অফিসারদের ক্ষেত্রেও কি তোমাদের এই একই পন্থা কাজ করেছে? -বলল জাবের।
মিঃ ইসহাক এমিল সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
পাশে দাঁড়ানো বিন আতীর দিকে চেয়ে জাবের বলল, এখানকার কাজ আপাতত শেষ। একে নিয়ে সেলে রাখ। খেতে দাও। হেড কোয়ার্টার থেকে নির্দেশ পেলে এর ব্যবস্থা করা যাবে। কথা শেষ করে জাবের দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে এল। প্রবেশ করল ওয়ারলেস রুমে। প্রেরক যন্ত্রের কাটা ঘুরিয়ে সে যোগাযোগ করল আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে।
-হ্যালো। ৩২১ ইউ, এন, এ?
-হ্যাঁ। ওপার থেকে উত্তর এল।
-কে?
-ইবনে জাবীর।
-শোন, হোটেল প্রিন্স-এর মিস জামিলা ও মিস রায়হানা এবং ‘আলী এন্ড ব্রাদারস কোং
-এর মিঃ ফারুকী ও মিস সেলিনাকে অবিলম্বে গ্রেফতার কর। বিমান বন্দর ও সি-পোর্ট বন্ধ। নিশ্চয় ওরা কোথাও পালাতে পারেনি। আমি বলে দিচ্ছি, গ্যারিসন কমান্ডার তোমার সহযোগিতা করবে।
অনুরূপভাবে জাবের মিসরের কয়েকটি জায়গায় সংবাদ পাঠিয়ে অবশেষে যোগাযোগ করল হেড কোয়ার্টারে আহমদ মুসার সঙ্গে। জাবেরের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। পরিশ্রম আর উত্তেজনার স্বাক্ষর ওগুলো।
২
জেবেল আল-নুর। আহমদ মুসার অফিস কক্ষ। পায়চারি করছিল আহমদ মুসা। সুন্দর, প্রশস্ত কপাল তাঁর কুঞ্চিত। তীক্ষ্ণ চোখ দু’টি তাঁর মনের গভীরে আত্মস্থ। মনে তাঁর চিন্তার ঝড়। প্রায় তিন সপ্তাহ হয় ইসরাইলের পরিচিত কোড মেসেজ বন্ধ হয়ে গেছে। তার জায়গায় শোনা যাচ্ছে অপরিচিত ও দুর্বোধ্য সংকেত। ঐ দুর্বোধ্য সংকেতের পাঠোদ্ধার করা যায়নি। সাইমুমের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, সংকেতগুলো ইসরাইলের নতুন কোড মেসেজ। ওরা তাদের পুরাতন কোড মেসেজের পরিবর্তন করেছে। আরব বিশ্বে নতুন করে স্পাই রিং গড়ে তোলারই এটা হয়ত পূর্ব প্রস্তুতি। ইসরাইলের এই নতুন উদ্যোগ বান্চাল করে দেবার জন্য ওদের নতুন কোড মেসেজের পাঠোদ্বার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব? চিন্তা করে চলে আহমদ মুসা। একটি সহজ পথ আছে ঐ দূর্বোধ্য সংকেতগুলো পাঠোদ্ধার করার এবং তা হল ইসরাইলী কোড মেসেজের ডিসইফার যোগাড় করা। আহমদ মুসার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো এবং তার চোখে মুখে ফুটে উঠলো স্পষ্ট সিদ্ধান্তের ছাপ। সে গিয়ে চেয়ারে বসে পড়ল। তার কন্ঠে স্বগত উচ্চারিত হল, হ্যা, যেমন করেই হোক ইসরাইলের কবল থেকে তাদের ডিসাইফার যোগাড় করতে হবে। টেবিলে রক্ষিত লাল টেলিফোনটি তুলে নিয়ে আহমদ মুসা রেডিও রুমে কামালকে ডেকে বললো, তেলআবিবে লাইন নিয়ে মাহমুদকে ডাক। আমি আসছি।
কথা শেষ করে টেলিফোনের রিসিভার যথাস্থানে রেখে দিয়ে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল। দ্রুত পদক্ষেপে এগিয়ে চলল সে রেডিও রুমের দিকে। রেডিও রুমে ঢুকতেই কামাল আহমদ মুসাকে সালাম জানিয়ে বলল, মাহমুদ ভাই আসছে জনাব। আহমদ মুসা ওয়ারলেস সেটের সামনে গিয়ে বসলো। মুহূর্ত কয়েকের মধ্যেই ওপার থেকে মাহমুদের কথা শুনতে পাওয়া গেল। সালাম ও কুশলাদির পর আহমদ মুসা বললো, ইসরাইলিরা কোড বদলিয়েছে লক্ষ্য করেছ?
-জি হাঁ। ওপার থেকে বলল, মাহমুদ।
-কি ভাবছ এ সম্পর্কে?
-আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় আছি।
-হ্যাঁ শোন, ওদের নয়া কোডের পাঠোদ্ধার করার সকল প্রচেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। ওদের ডিসাইফার ছাড়া এর পাঠোদ্ধার সম্ভব নয়। সুতরাং ওটা তোমাকে যোগাড় করতেই হবে।
-বুঝেছি জনাব।
-যে কোন মুল্যের বিনিময়ে ডিসাইফার আমাদের চাই মাহমুদ। বর্তমান মুহূর্তে এটাই আমাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
-দোয়া করুন জনাব। আমি এখনি কাজ শুরু করছি।
-আল্লাহ তোমাদের সফল করুন। খোদা হাফেজ।
– খোদা হাফেজ।
আহমদ মুসা ধীরে ধীরে ওয়ারলেস রুম থেকে বেরিয়ে এলো। সামনের গলিপথটি পেরিয়ে একটি উন্মুক্ত স্থানে এসে দাঁড়াল। কাছেই পাহাড়ের একটি ছোট টিলা। আহমদ মুসা টিলায় উঠে একেবারে মাথায় গিয়ে বসলো। চারিদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের উন্নত চুড়াগুলো। চারদিক নিস্তব্দ-নিঝুম। দক্ষিণ-পূর্বদিকের আকাশের এক জায়গায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। আহমদ মুসা বুঝল, ওটা আম্মানের আকাশ। আকাশের দিকে মুখ তুল আহমদ মুসা। জোৎস্নাহীন আকাশের তারাগুলো বেশ ভালো লাগছে দেখতে। এক সময় আদম সুরতের পায়ের নীচে লুব্ধকে এসে আটকে যায় তার চোখ। ওর আলোতে যেন সূর্যের দীপ্তী। সূর্যের মত চোখ বিদ্ধকারী তীক্ষ্ণতা ওতে নেই, আছে স্নিগ্ধতা, আছে প্রশান্তি। পলকহীনভাবে আহমদ মুসা চেয়ে থাকে ওর দিকে। লুব্ধক যেন নেমে আসে তার কাছে, একেবারে কাছে। লুব্ধকের দেশে পৌঁছে যায় আহমদ মুসা। লুব্ধকের দেশ থেকে সে উর্ধ্বে চেয়ে দেখল মিট মিটে তারার আলো ভেসে আসছে উপরের উর্ধলোক থেকেও। আহমদ মুসার মনে প্রশ্ন জাগে, ঐ তারার জগতের ওপারে আবার কি আছে? উত্তর এসে তার কানে বাজল, শূন্য, শূন্য, আদি অন্তহীন মহাশূন্য। সম্মুখে পশ্চাতে, ডানে বামে, উপরে নীচে সব দিকেই অন্তহীন মহাশূন্য। এই মহাশুন্যের নিকট অন্ধকারে তারকা সূর্যগুলো দীপ শিখা জ্বালিয়ে রেখেছে। মহাশুন্যের অন্তহীন ব্যাপকতার মাঝে আহমদ মুসা ভয়ে বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে। তার মনে প্রশ্ন জাগে, এই মহা সৃষ্টির স্রষ্টা আল্লাহর শক্তি তাহলে কত বিরাট, কত বড় বিজ্ঞানী তিনি? আহমদ মুসার হৃদয় ও মন নুয়ে পড়ে স্রষ্টার উদ্দেশ্যে। আহমদ মুসা লুব্ধকের জগৎ থেকে দৃষ্টিপাত করে নীচে-বহু নীচে দেখা যায় সূর্যকে। মহাশুন্যের নিকষ কালো বুকে সূর্যকে অতি ক্ষুদ্র এক আলোকবিন্দুর মত মনে হচ্ছে। পৃথিবীর কোন অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষ? মহাশুন্যের বিশাল ব্যাপকতার মাঝে মানুষের অস্তিত্ব সত্যই কিছু আছে কি প্রশ্ন জাগে আহমদ মুসার মনে। অথচ এই মানুষই আল্লাহর বড় প্রিয় এবং আশরাফুল মুখলুকাত-সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। আল্লাহর এ কোন কুদরত। আবেগে উত্তেজনায় দু’ চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে আহমদ মুসার। হযরত দাউদ (আঃ)-এর মত তার বিস্ময় বিক্ষুব্ধ চিত্ত থেকে স্বগত উচ্চারিত হয়- হে বিশ্ব নিয়ন্তা প্রভু, মনুষ্য কে যে তুমি তার বিষয় চিন্তা কর? এবং মনুষ্য সন্তানই বা কি যে তুমি তার প্রতি মনোযোগী হও?
আহমদ মুসার সেক্রেটারী আলী বেন শাকের এসে আহমদ মুসার পেছনে দাঁড়াল। অতি ধীর কন্ঠে বলল, অনেক রাত হয়েছে জনাব। খুব শীত পড়ছে। আপনার বিশ্রাম প্রয়োজন।
ধীরে ধীরে মুখ ফিরাল আহমদ মুসা। এই সময় বিরাট এক নক্ষত্র পতন হল। আহমদ মুসার দু’দন্ড বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রু চিক চিক করে উঠল। শাকেরের দৃষ্টি এড়াল না তা। সে বিস্মিত কন্ঠে বলল, আপনি কাঁদছেন জনাব?
আহমদ মুসার মুখে ফুটে উঠলো এক টুকরো প্রশান্ত হাসি। সে বলল, এ হারানোর কান্না নয় শাকের, পাওয়ার কান্না। আমার আল্লাহকে আমি এমন নিবিড়ভাবে কোনদিন পাইনি। আকাশের দিকে চেয়ে দেখ, তারায় তারায় শুধু তাঁরই হাতছানি। নিঃসীম মহকাশের আলো আঁধারীর মাঝে তাঁরই শুধুই লুকোচুরি খেলা। বলতে বলতে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
শাকের মন দিয়ে আহমদ মুসার কথা গুলো শুনলো। কিছুই বলল না মুখে। কথা বাড়ানো উচিত নয়। তাদের প্রিয় নেতার বিশ্রাম এ সময় অত্যন্ত জরুরী। আগে আগে চলল আহমদ মুসা, পিছনে শাকের। আহমদ মুসাকে শয়ন কক্ষে পৌঁছে দিয়ে শাকের তার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
তেলআবিব। মাহমুদ চিন্তান্বিত মুখে ওয়ারলেস রুম থেকে বেরিয়ে এল। মাথায় তার একরাশ চিন্তার জট। ধীরে ধীরে এসে ড্রইং রুমের সোফায় বসল। ইসরাইলীদের হাত থেকে ডিসাইফার উদ্ধার করা চাটটিখানি কথা নয়। মাহমুদ সমস্ত ব্যাপারটা একবার চিন্তা করে দেখল। ডিসাইফার হাতে পেতে হলে অনেকটা পথ তাকে পাড়ি দিতে হবে। প্রথমে তাকে খুঁজে দেখতে হবে, ডিসাইফারের খোঁজ কোন কোন ব্যক্তির কাছে পাওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়তঃ ঐ সব ব্যক্তির মধ্যে কার কাছ থেকে ডিসাইফারের খবর বের করে নেয়া সহজ হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। তৃতীয়তঃ ডিসাইফার উদ্ধারের ব্যবস্থা করা। মাহমুদ গোটা পরিকল্পনাটিকে আর একবার আগাগোড়া ভেবে দেখল। তারপর প্রথম বিষয়টির প্রতি মনোনিবেশ করল সে। সে চিন্তা করে দেখল, ডিসাইফার কোন গোপন স্থানে রক্ষিত আছে, তা কাদের পক্ষে জানা সম্ভব তাদের মধ্যে প্রধান হলেন-এক, মন্ত্রি; দুই, দেশরক্ষা সেক্রেটারী; তিন, মোসাদ প্রধান এবং চার, সিনবেথ প্রধান ইত্যাদি। এদের মধ্যে দেশরক্ষা মন্ত্রীকে হিসেবের বাইরে রাখা উচিত। এখন অবশিষ্টদের মধ্যে কার নিকট থেকে তথ্য বের করা সহজ হবে? মাহমুদ ভাবল, এটা সুক্ষ্ণ বিচার-বিবেচনার প্রশ্ন। ডসিয়ার আলোচনা ছাড়া এ প্রশ্নের সমাধান অসম্ভব। সোফা ছেড়ে মাহমুদ উঠে দাঁড়াল।
গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে একটি গোপন সিঁড়িপথ বেয়ে সে প্রবেশ করল ভূ-গর্ভস্থ একটি কক্ষে। রেকর্ড রুম। মাহমুদ ডসিয়ার সেকশনে গিয়ে বসল। টেনে নিল ‘সিনবেথ’ প্রধানের ডসিয়ার ফাইল। গভীর মনোযাগ নিবিষ্ট করে সে ফাইলটিতে। ফাইল শেষ করে হাতে তুলে নিল মোসাদ প্রধানের ডসিয়ার। শেষ করে ওটাও রেখে দিল সে ফাইল কেবিনে। দেশ রক্ষা সেক্রেটারী এরহান শার্লটকের কোন ডসিয়ার সাইমুমের এ স্থানীয় রেকর্ড রুমে নেই। এরহান শার্লটক স্বরাষ্ট্র বিভাগ থেকে সদ্য আগত এবং স্বরাষ্ট্র বিভাগেও তার চাকুরির মেয়াদ বেশী দিনের নয়। হয়তো এ কারণেই অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় তার ডসিয়ারই তৈরি হয়নি। সিনবেথ প্রধানের ডসিয়ার থেকে তার যে চরিত্র পরিচয় পাওয়া গেল তা হল তিনি ঠান্ডা মাথা, নির্লিপ্ত মেজাজ, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি কর্তব্যপরায়ণ ও বিশ্বাসী। মাহমুদ ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল, এ বড় শক্ত চীজ। এ ভাঙ্গবে কিন্তু মচকাবে না। মোসাদ প্রধানও মোটামুটি একই চরিত্রের। তবে সিনবেথ প্রধান অপেক্ষা অধিকতর কূটবুদ্ধি ও হিংস্র। তাঁর চরিত্রের বড় একটি দুর্বল দিক হলো, নারীর প্রতি মাত্রাতিরিক্ত মোহ। ঘৃণায় মাহমুদের মুখ কুঞ্চিত হলো। সাইমুম এ ধরনের অস্ত্র প্রয়োগকে ঘৃণা করে। উঠে দাঁড়াল মাহমুদ। বেরিয়ে এল রেকর্ড রুম থেকে। সমস্যার সমাধান হল না। এরহান শার্লটক সম্পর্কে জানা দরকার। এমিলয়ার কাছ থেকে জানা যাবে? হঠাৎ একটি নাম তার স্মৃতির আকাশে ঝিলিক দিয়ে গেল, ‘এমিলিয়া’! নামটি স্মরণ হওয়ার সাথে সাথে মাহমুদের গোটা দেহের অণুতে-পরমাণুতে বিদ্যুৎ শিহরণ খেলে গেল। আনন্দের শিহরণ খেলে গেল দেহের প্রতিটি শিরা উপশিরায়। মাহমদ অবাক হল এমিলিয়া তার দেহের অণুতে-পরমাণুতে এমনিভাবে মিশে গেছে?
হাঁ, এমিলিয়ার কাছে এরহান শার্লটক সম্পর্কে জানা যেতে পারে, কিংবা জানার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্যও সে করতে পারে। মাহমুদ সোফায় এসে বসল। হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল, রাত ১টা। এমিলিয়া ঘুমিয়ে আছে। বেচারীকে এ রাতে ঘুম থেকে জাগানো কি ঠিক হবে? কিন্তু এছাড়া উপায় কি? ডিসাইফারের ব্যাপারে কালকের মধ্যে একটা সুরাহা করা তার চাই। মাহমুদ উঠে দাঁড়াল। পা বাড়াল ড্রেসিং রুমের দিকে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে মাহমুদ বেরিয়ে এল। পরনে কাল ট্রাউজারের উপর লম্বা কাল ওভারকোট। মাথায় ফেলট হ্যাট। একটু দুর থেকে দেখলে মনে হবে রাত্রিকালের টহলদারি ইসরাইলী পুলিশ।
রাত দুপুরের তেলআবিব। জনবিরল রাস্তা। দু’একটি গাড়ীর আনা গোনা চলছে। মাহমুদের গাড়ী এসে একটি পাবলিক টেলিফোন বুথের সামনে দাঁড়াল। টেলিফোন বুথে প্রবেশ করে একটি নম্বরে সে ডায়াল করল। মুখে এক টুকরো হাসি। ও প্রান্তে টেলিফোন বেজে চলেছে। কিন্তু নো রিপ্লাই। মাহমুদ নাছোড় বান্দা। বেজেই চলছে টেলিফোন। কিছুক্ষণ পর ও প্রান্ত থেকে রিসিভার ওঠানোর শব্দ শোনা গেল। তারপর ভেসে এল একটি শব্দ হ্যালো—। নিদ্রাজড়িত কণ্ঠ। বলছে এমিলিয়া। নিশ্চিত হয়ে মাহমুদ রিসিভার রেখে দিল কোন উত্তর না দিয়েই। রাগে বিরক্তিতে এমিলিয়ার সুন্দর মুখটি এখন কেমন হয়েছে, মানস চক্ষেই আঁচ করত পারল মাহমুদ। কিন্তু বেচারীকে এভাবে না জাগিয়ে উপায় ছিল না।
এমিলিয়ার বাড়ী থেকে একটু দুরে একটি অন্ধকার গলিতে গাড়ী পার্ক করে রেখে এমিলিয়াদের বাড়ীর পেছন এসে দাঁড়াল মাহমুদ। তারপর পাচিল টপকে ভিতরে বাগানে গিয়ে পড়ল সে। একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে চারিদিকটা একবার দেখে নিয়ে মাহমুদ সামনে পা বাড়াল। গিয়ে দাঁড়াল এমিলিয়া যে ঘরে থাকত, ঠিক তার নীচে। উপরে চেয়ে দেখল, এমিলিয়ার দু’টি জানালাই বন্ধ। মাহমুদ মত পরিবর্তন করল, না আজ জানালা দিয়ে নয় দরজা দিয়ে সে প্রবেশ করবে। গভীর রাত। কেউ জেগে নেই। পকেট থেকে সিল্কের কর্ড বের করে ছুড়ে মারল সে ছাদে। অভ্রান্ত লক্ষ্য। কর্ডের মাথার হুকটি বেঁধে গেল ছাদের সাইড ওয়ালে। মাহমুদ কর্ড বেয়ে উঠে গেল ছাদে। মাহমুদ খুশি হল, ছাদ থেকে নীচে নামবার সিঁড়ির দরজা খোলা আছে। সে অতি সন্তর্পণে সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। চারতলার বারান্দা। চারতলার অংশে মোট তিনটি ঘর। একটি এমিলিয়ার বেডরুম, অন্যটি ড্রয়িংরুম এবং তৃতীয়টিতে থাকে এমিলিয়ার খাস পরিচারিকা সোনি। সর্বদক্ষিণের ঘরটি এমিলিয়ার শয়নকক্ষ। শয়নকক্ষের দরজায় গিয়ে মাহমুদ দাঁড়াল। হাঁটুর নীচ পর্যন্ত নামানো মাহমুদের ওভারকোট। ফেল্ট হ্যাট মুখের অর্ধাংশ ঢেকে রেখেছে। মাহমুদ ধীরে ধীরে ‘নক’ করল দরজায়। একবার-দুইবার-তিনবার। তুতীয়বারের পর এমিলিয়ার কণ্ঠ শোনা গেল। ‘কে?’ সোনি? মাহমুদ আবার সামান্য বিরতিতে টোকা দিল। আবার এমিলিয়ার কণ্ঠঃ কে? এবার তার কন্ঠে যেন উদ্বেগ। মাত্র কয়েক মুহুর্ত, তারপর ধীরে ধীরে দরজা খুলে গেল। ভিতরে হালকা নিল আলো। উদ্যত রিভলভার হাতে দাঁড়িয়ে আছে এমিলিয়া। রিভলভারের চকচকে নল মাহমুদের বুক লক্ষ্য করে সাপের জিহ্বার মত যেন লকলক করছে। ট্রিগারে রাখা এমিলিয়ার তর্জনিটি উত্তেজনায় কাঁপছে, যে কোন মুহুর্তে ট্রিগারে চাপ দিয়ে বসবে। চিৎকার করে এমিলিয়া কিছু বলতে যাচ্ছিল। মাহমুদ তর্জনিটি ঠোটে ঠেকিয়ে চুপ করার ইংগিত করল এবং পর মুহূর্তেই মাথা থেকে ফেল্ট হ্যাট ছুড়ে ফেলে দিল মাহমুদ। মাহমুদকে চিনতে পেরেই এমিলিয়া রিভলভার ছুড়ে ফেলে দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল। মাহমুদ একটু এগিয়ে এমিলিয়াকে বলল, ভয় পেয়েছ? এমিলিয়া মুখ তুলল। তার মুখে আনন্দ ও বিষ্ময় দুটোই। বলল, যদি গুলী করতাম।
মাহমুদ ঘরে প্রবেশ করে বলল, কি হত আর, এভাবে মৃত্যু থাকলে মরে যেতাম।।
এমিলিয়া দরজাটি বন্ধ করে দিয়ে এসে মাহমুদের ওভারকোট-এর বোতাম খুলতে খুলতে বলল, ইস! তাহলে কি হত?
-হত আর কি, ডেভিট বেন গুরিয়ানের নাতনী তুমি। ভাবতে, এক দুস্বপ্ন দেখছিলে।
-না, আমি শুধু ডেভিড বেনগুরিয়ানের নাতনী নই। আমি আমি………। কথা শেষ না করেই থামল, এমিলিয়া। মুখ তার আরক্ত হয়ে উঠেছে। বলল, ঐ রিভলভারের একটি গুলি আমার বুকেও ঢুকত।
-কিন্তু নিয়ম তো এ নয় এমি!
-কেন?
-তোমার জীবনের মালিক তুমি নও, তোমার স্রষ্টা আল্লাহ। সুতরাং ইচ্ছা করলেই তুমি তোমার জীবনের উপর স্বেচ্ছাচার চালাতে পার না। -এ অধিকার তোমার নেই।
-কিন্তু ঐ দুর্বহ বেদনার ভার বহন করা……।
-তবু তাই করতে হয়। শত দুঃখ বেদনার পারাবার পাড়ি দিয়ে আল্লাহর বান্দা হিসেবে তুমি তোমার জীবনকে সার্থক করে তুলবে-এটাই জীবনের স্বাভাবিক দাবী।
-বড় কঠিন এটা।
-কঠিন, কিন্তু স্বাভাবিক।
মাহমুদের গা থেকে ওভারকোট খুলে নিয়ে রেখে দিয়ে এমিলিয়া বলল, একটু বিশ্রাম নাও। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বলে সে মাহমুদকে ইজি চেয়ার এগিয়ে দিল।
মাহমুদ বলল, তুমিও বস।
-বসছি। বলল এমি। কিন্তু সে বসল না। ইজি চেয়ারের পিছনে দাড়াল এমিলিয়া। তার হাতের আঙ্গুলগুলো মাহমুদের জামার কলার নিয়ে খেলা করতে লাগল। ফিস্ ফিস্ করে এক সময় বলল, রাতে ক’ঘন্টা ঘুমাও।
-কোনদিন সারারাত, কোনদিন এক ঘন্টাও না।
-এমন করলে শরীর ভাল থাকে বুঝি?
-না থাকুক। অসুখ করলে শুয়ে থাকা যায়, পরিচর্যা পাওয়া যায়।
-কে পরিচর্যা করে?
-অসুখ করেনি কোনদিন। সামান্য যা করেছে আপন পরিচর্যায় তা সেরে গেছে। তাই বলতে পারিনে।
-যদি হয়?
-আমার সহকর্মীরা আছে।
-কেন, আমাকে ডাকবে না?
-ডাকলে তুমি যাবে?
-তোমার কি মনে হয়?
মাহমুদ কোন জবাব দিল না। পরে ধীরে ধীরে বলল, তোমাকে ডাকবার দিন এখনো আসেনি এমি। যেদিন ফিলিস্তিনী মজলুম মুসলিম ভাই বোনেরা তাদের স্বদেশ ভূমি ও তাদের বাড়ীঘর ফিরে পাবে, যেদিন তারা হারোনোর বেদনা ভুলে গিয়ে পাওয়ার আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠবে, সেইদিন আমার সংসারের রাণী সেজে যাবে আমার ঘরে। জ্বলবে আমার আঁধার ঘরে আলো। হাসি আনন্দে মুখর করে তুলবে আমার বোবা গৃহাঙ্গন। মাহমুদের কণ্ঠ ভারি হয়ে উঠল যেন ক্রমে।
-সেদিন কতদুরে মাহমুদ?
-আমি জানি না এমি।
অনেক্ষণ ধরে কেউ কোন কথা বলল না। প্রথমে নিরবতা ভাঙ্গল এমিলিয়া। বলল, এতরাতে তোমাকে কি খাওয়াই বলত?
-না, তোমাকে ওসব পাগলামি করতে দেব না। এটা সময় নয় খাওয়ার।
-ফল মিষ্টি খেতে দোষ নেই। মাত্র দু’মিনিট। আমি আসছি। একটু পর রেফ্রিজারেটর থেকে আঙ্গুর, কেক প্রভৃতি কয়েক ধরনের খাবার এনে এমিলিয়া হাযির করল। মাহমুদ এমিলিয়াকেও বসাল। খেতে খেতে মাহমুদ বলল, খুব ভয় পেয়েছিলে, না?
মুখে পুরে দেয়া কেকের টুকরা ভাল করে গিলে নিয়ে এমিলিয়া বলল, ঐ টেলিফোনটাও তাহলে তুমিই করেছিলে না?
মাহমুদ হাসতে লাগল।
এমিলিয়া বলল-ঐ ভূতুড়ে টেলিফোন পাওয়ার পরই রাত দুপুরে যদি দরজায় টোকা শোনা যায় এবং জিজ্ঞেস করেও তার কাছ থেকে যদি জবাব না পাওয়া যায়, আর দরজা খুলে যদি দেখা যায় ফেল্ট হ্যাটে মুখ ঢাকা কাল আলখেল্লা মোড়া এক মনুষ্যমুর্তি, তাহলে ভয় করবে না বুঝি? একটু থেমে সে আবার বলল, টেলিফোন ছেড়ে দিয়েছিলে কেন? বলে আসলেই পারতে।
-হ্যাঁ তোমাকে টেলিফোনে বলে-কয়ে আসি, আর তোমাদের টিকটিকি মহাশয়রা আমার অভ্যর্থনায় তোমাদের বাড়ীর গেটে দাঁড়িয়ে থাকুক।
-তা’হলে টেলিফোন করলে কেন?
-তোমার ঘুম ভাঙ্গানোর জন্য, এখানে এসে তো ডাকতে পারতাম না।
-উহ! তোমার এত বুদ্ধি।
-তোমার সাবধানতা দেখে আমি খুশী হয়েছি এমি, ভবিষ্যতেও তুমি এমনি সাবধান থেকো।
খাওয়া শেষ হয়ে গেল। মাহমুদ ঘড়ি দেখল, রাত প্রায় দু’টা। প্লেটগুলো নিয়ে উঠে দাঁড়াল এমি। মাহমুদ বলল, তোমার সাথে জরুরী কিছু কথা আছে।
এমি বলল-আসছি।
এমি প্লেটগুলো রেখে এসে সামনের চেয়ারটিতে বসে বলল-বল।
মাহমুদ তার ইজি চেয়ারটি টেনে নিয়ে এমিলিয়ার আরও কাছে গিয়ে বসল। এমিলিয়ার চোখে চোখ রেখে অতি নীচু গলায় বলল-তোমার কিছু সহযোগিতা চাই এমি।
এমিলিয়ার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বলল, বল, আমি রাজি।
-দেশরক্ষা সেক্রেটারী এরহান শার্লটককে তুমি চেন?
-চিনি।
-কেমন চেন?
-ভালভাবে চিনি। ওর মেয়ে, আমার ক্লাশমেট। ওদের বাসায় মাঝে মাঝে যাই। এরহান চাচাজী আমাকে খুব স্নেহ করেন।
এরহান শার্লটকের মেজাজ ও চরিত্র সম্পর্কে কিছু বলতে পার?
-সৎ, সচ্চরিত্র, কর্তব্যপরায়ণ ও বিশ্বাসী কর্মচারী বলে উনার খুব সুনাম আছে। আর মেজাজ-মেজাজ একটু খিট খিটে ধরনের বলেই আমার মনে হয়।
-কেন?
-সামান্য কারণেও ওঁকে মাঝে মাঝে আমি খুব বেশী রেগে যেতে দেখিছি।
-যেমন?
-কারও কোথাও থেকে আসতে একটু দেরী হওয়া, ইত্যাদি।
মাহমুদ আর কিছু বলল না। পাওয়া সুত্রগুলো নিয়ে চিন্তার অতলে ডুব দিল সে। চোখ দু’টি তার বুজে গেল। যা সে জানতে চেয়েছিল, তা সে পেয়েছে। শার্লটকের এ খিটখিটে মেজাজের অর্থ তাঁর প্রতিরোধ শক্তি কম। এ ধরনের লোকের কাছ থেকে ভয় দেখিয়ে কিংবা চাপ দিয়ে কথা আদায় করা যায়। ডিসাইফারের খবর শার্লটকের কাছ থেকেই যোগাড় করতে হবে। মাহমুদ চোখ খুলল। দেখল এমিলিয়া পলকহীন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বলল মাহমুদ ভাবছিলাম এমি।
-কি ভাবছিলে?
-তোমার শার্লটক চাচাজির মুখ থেকে আমাদের একটা কথা বের করে নিতে হবে, তা সম্ভব কি না তাই চিন্তা করছিলাম।
-কি কথা জানতে পারি কি? মাফ করো, আমি নিছক জানার আগ্রহ নিয়ে এ কথা বলছি না, যদি কোন সাহায্য করতে পারি সেই উদ্দেশ্যে।
-আমি তা বুঝতে পেরেছি এমি। একটু থামল মাহমুদ।
তারপর আবার বলল, ডিসাইফার চিন?
-কোড এক্সপ্লানেশন যাতে লেখা সেই বই কিংবা কোড মেসেজের ব্যাখ্যাকারী বই তো?
-হ্যাঁ, ঠিক চিনেছ। দিন পনের হয় ইসরাইল তাদের পুরনো কোডের পরিবর্তন করে নতুন কোডের প্রবর্তন করেছে। এই নতুন কোডের যে ডিসাইফার বুক ইসরাইলের আছে সেটা আমাদের প্রয়োজন। এই ডিসাইফার কোথায় রাখা হয়েছে, সেটাই আমরা জানতে চাই তোমার চাচাজানের কাছ থেকে।
-তিনি কি বলবেন?
-সহজে কি বলবেন? বলতে বাধ্য হবেন।
-ডিসাইফারের কিছু সন্ধান বোধ হয় আমি জানি।
-জান তুমি? মাহমুদের কন্ঠে ঝরে পড়ল একরাশ বিস্ময়।
-হাঁ, আমি জানি।
মাহমুদের বিস্ময় তখনও কাটেনি। মুহূর্ত কয়েক পর সে ধীর কন্ঠে বলল, কি জান, কতটুকু জান এমি?
-না বলব না। মুখ টিপে হাসল এমিলিয়া।
-তা হলে তোমাকেই হাইজাক করতে হয় দেখছি। মাহমুদও হাসল।
-আমি রাজি। অন্তত ……
-অন্তত আমার আস্তানাটা দেখতে পারবে, তাইতো? হেসে বলল মাহমুদ।
দূরের কোন পেটা ঘড়িতে রাত দু’টো বেজে গেল। মাহমুদ সচকিতভাবে ঘড়ির দিকে চাইল। বলল-না এমি আর অপেক্ষা করতে পারি না, তোমার কষ্ট হচ্ছে।
-কষ্ট? আমার হচ্ছে? একটু থামল এমিলিয়া। বেদনার্ত হয়ে উঠল তার দু’টি চোখ। বলল সে, যার অপেক্ষায় হৃদয়-মন ব্যাকুল হয়ে থাকে, তাকে পাশে পাওয়ার সৌভাগ্য কষ্টকরই বটে।
-তা নয়, আমি বলছিলাম…….
মাহমুদের কথা কেড়ে নিয়ে এমিলিয়া বলল, না আর কোন কথা নয়। তোমার সময় নষ্ট হচ্ছে। বলে সে মাহমুদের সামনে উঠে এসে তার পিছনে দাঁড়াল। দু’টি কনুই মাহমুদের ইজি চেয়ারে ঠেস দিল। এমিলিয়ার তপ্ত নিঃশ্বাস মাহমুদ স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিল তার কানে-গন্ডে।
মাহমুদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। এমিলিয়া তাকে বাধা দিয়ে বলল, শুন, দেশরক্ষা সেক্রেটারী শার্লটক চাচাজানের মেয়ে মারিয়া স্মার্থা আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ও “মোসাদ”-এ ট্রেনিং নিচ্ছে। ওর কাছেই আমি ডিসাইফারের একটি কপি গত পরশু দেখেছি। বইটি আমাকে দেখিয়ে সে বলেছে, অতি গোপনীয় বইটি বিশেষ নির্দেশক্রমে সে মাত্র কয়েকদিনের জন্য আনতে পেরেছে। থামল এমিলিয়া।
মাহমুদ এমিলিয়ার একটি হাত ধরে টেনে নিয়ে পাশে বসাল। বলল, বইটি আমার চাই এমি এবং কালই।
-আমাকে চুরি করতে বলছ বইটি? হাসল এমিলিয়া। মাহমুদ বলল, না তোমার বান্ধবীকে আমরা বিপদে ফেলতে চাই না। তাছাড়া চুরি করলে ওরা জানতে পারবে, তাতে আমাদের খুব বেশী লাভ হবে না।
-তা হলে ……?
-বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা কত হতে পারে?
-দেড়শ’র বেশী হবে না।
-আচ্ছা, তুমি যদি ওখানে গিয়ে বইটি দেখ বা পড়, তাহলে তোমার বান্ধবী আপত্তি করবে?
-না।
মাহমুদ মুহূর্ত কয়েক ভাবল। তারপর পকেট থেকে ক্ষুদ্র সিগারেট লাইটার বের করে এমিলিয়ার হাতে দিল।
এমিলিয়া বলল, এ সিগারেট লাইটার দিয়ে কি হবে?
-সিগারেট লাইটার নয়। এটা একটা ক্যামেরা। ঐ যে মাথায় ক্ষুদ্র সাদা সুইচ দেখছ, ওটাতে যতবার চাপ দিবে, উঠবে একটি করে ফটো।
-বুঝেছি, বই-এর প্রতিটি পাতার ফটো নিব আমি। হাসল এমিলিয়া।
-ঠিক, তোমার বান্ধবীর অলক্ষ্যে করতে হবে এ কাজ। পারবে না?
-তোমার নির্দেশ হলে, এর চেয়েও কঠিন কাজ আমি করব। শান্ত ও দৃঢ় কণ্ঠ এমিলিয়ার।
-নির্দেশ নয় এমি, এটা আমার অনুরোধ। সকলের তরফ থেকে আমার এ অনুরোধ। আর জান, এটা অন্যায়ও নয় এমি। ফিলিস্তিনের প্রকৃত ইহুদি বাসিন্দাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোন ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই। বাস্তুহারা মুসলিম ফিলিস্তিনিরা তাদের হারানো রাষ্ট্র ফিরে পেতে চায়, যেখানে নাগরিক হিসেবে ইহুদিদেরও থাকবে সমান অধিকার।
-আমি জানি মাহমুদ। বল আমাকে কি করতে হবে।
-বলছি শুন, এই একটি লাইটার ক্যামেরায় যা রীল আছে, তাতে ৫০টি ফটো উঠবে। এ ধরনের আরও দু’টি ক্যামেরা আমরা তোমাকে পৌঁছাব। এখন বল তোমার পরিকল্পনা-কিভাবে এগুবে।
-তুমি যেমন বলবে।
-আমি তোমার মূল কর্তব্য বলে দিয়েছি। এখন তোমার নিজের বুদ্ধির উপর নির্ভর করে কাজ করতে হবে। কোন অবস্তাতেই তোমাকে ধরা পড়া চলবে না। একান্তই যদি কোন প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে লাইটার ক্যামেরার নীচের তলায় একটি লাল সুইচ আছে, ওটাতে চাপ দিয়ে গোটা ক্যামেরাটাই জ্বালিয়ে দিবে।
-বুঝেছি।
-তুমি যে ক্যামেরাটি পেলে ওটা ১নম্বর। ২ এবং ৩ নম্বর কাল পাবে। ক্রমিক হিসেবে ব্যবহার করবে। আচ্ছা, কাল কখন যেতে পারবে স্মার্থাদের ওখান?
-সকাল ন’টায় যাব।
-সকাল ঠিক আটটায় তোমাদের বাড়ীর গেটে ফুল-বিক্রেতা আসবে। তার কাছে থাকবে সুন্দর সুন্দর ফুলের তোড়া। তুমি দু’টি তোড়া কিনে নিবে। তারপর-তারপর কি করবে বলত? হেসে বলল মাহমুদ।
-ফুলের তোড়া ভেঙ্গে ক্যামেরা দু’টো বের করে নেবো। কিন্তু ফুলের তোড়া কি ভাঙ্গতে ইচ্ছে করবে? এমিলিয়া হাসল।
-ভাঙ্গতে হবে না। মাঝখানের মাত্র একটি ফুল তুললেই ক্যামেরা পেয়ে যাবে। থামল মাহমুদ। তারপর বলল, আবার তুমি কখন ফিরতে পারবে সেখান থেকে?
-ঠিক করে তো বলা কঠিন।
-বিকেলের আগে তো নিশ্চয়ই।
-তাহবে।
-কালকেই কিন্তু আমাদের ক্যামেরা ফিরে চাই।
-তুমি আসবে নিতে?
-আসতে বল?
-বলতে কি তা পারব? ব্যক্তিগত ভালো লাগা-না লাগার মূল্য কি কিছু আছে? এমিলিয়ার কণ্ঠ ভারী শোনাল।
মাহমুদ এমিলিয়ার চোখে চোখ রাখল। এমিলিয়া চোখ নামিয়ে নিলে। মৃদু হাসল মাহমুদ। তারপর বলল, জাতীয় কর্তব্য যেখানে মুখ্য হয়ে ওঠে, ব্যক্তি সত্ত্বা সেখানে অবশ্যই গৌণ হয়ে পড়ে। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে তা যে মুছে যায় না- একথা আজ আমি মর্মে মর্মে অনুভব করছি। জাতীয় দায়িত্বের শত কাজের ভীড়েও আমি তোমার কথা ভাবি, ভাবতে ভাল লাগে। যখন তোমার কাছে আসার প্রশ্ন ওঠে, তখন মন নেচে ওঠে আনন্দে। আমার এ ব্যক্তিগত ভালো লাগাকে মূল্য না দিয়ে পারছি কই এমি?
-ব্যক্তিসত্ত্বার এ দাবী কি অন্যায়?
-ব্যক্তি ও জাতীয় সত্ত্বা উভয়েরই সমান মর্যাদা। একটির স্বার্থে অপরটিকে অস্বীকার করা যায় না। আমার বিশ্বাস, ব্যক্তি সত্ত্বার দাবী যতক্ষণ জাতীয় নীতি-নিয়মের সীমা লংঘন না করছে, ততক্ষণ সে দাবী অন্যায় নয়। থামল মাহমুদ।
এমিলিয়া নিরব। মাহমুদ বলল, কথা বলছ না যে।
-খুব ভয় করে আমার, হয়ত কত অন্যায় করে যাচ্ছি। দেখ ছোট বেলা থেকে নিজের ব্যক্তিগত ভালো লাগা না লাগাকে বড় করে দেখার শিক্ষা পেয়েছি। তাই ভুল-ভ্রান্তিকে ক্ষমা করো।
-তুমি ইতিমধ্যে অনেক পরিবর্তন এনেছ। তুমি শুধু আমাকে নয়, আমাদের সবাইকেই বিস্মিত করেছ। থামল মাহমুদ। বলল আবার, আগামী সন্ধ্যা ৭ টায় অক্সফোর্ড বুক ফাউন্ডেশন থেকে কিছু বই নিয়ে একজন লোক এসে তোমাদের গেটে দাঁড়াবে এবং তুমি কিছু বই চেয়েছ বলে তোমাকে সংবাদ দিতে বলবে। তুমি তাকে ডেকে নেবে। ক্যামেরা তিনটি একটি থ্রিক্যাসল সিগারেট প্যাকেটে পুরে রাখবে। বুক ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি এসে বসার পর সেও একটি থ্রিক্যাসল সিগারেটের প্যাকেট টেবিলে রাখবে। সিগারেট-প্যাকেটের এক কোণে আমার হস্তাক্ষর থাকবে-CM. থ্রিক্যাসল সিগারেট প্যাকেটে যদি আমার হস্তাক্ষর দেখতে পাও, তাহলে লোকটিকে খাঁটি জানবে এবং বইপত্র দেখার ফাঁকে ঐ প্যাকেটটি তুলে নিয়ে তোমারটি রেখে দিবে।
-তোমার হস্তাক্ষর CM-এর অর্থ কি?
-কর্ণেল মাহমুদ।
-আর ইউ কর্ণেল। বিস্ময়ে এমিলিয়া চোখ দু’টি বড় বড় করল।
-কেন বিশ্বাস হয় না?
-তুমি রীতিমত তা’হলে সেনাবাহিনীর লোক? কিন্তু ….
-কিন্তু কোন্ সেনাবাহিনীর এই তো? হাসল মাহমুদ। একটু থেমে আবার বলল, থাক ওসব কথা আজ। এবার উঠি এমি। বলে উঠে দাঁড়াল মাহমুদ।
-যাচ্ছ?
-হাঁ, যাই।
-আবার কবে দেখা হবে?
-আল্লাহ জানেন।
মাহমুদ ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদে উঠে এল। সাথে সাথে উঠে এল। এমিলিয়াও ছাদের কার্ণিশ থেকে সিল্কের কর্ড ঝুলছে। মাহমুদ গিয়ে দাঁড়াল সেখানে।
এমিলিয়া এসে দাঁড়াল মাহমুদের পাশে একান্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে। বলল, একটা কথা বলব?
-অন্তত তোমার টেলিফোন নম্বরটুকু পেতে পারি না?
মাহমুদ মুহূর্ত কয়েক চিন্তা করে বলল, আমার অপারগতার কথা তো তুমি জান এমি।
-আমি কথা দিচ্ছি, আমি কখনও টেলিফোন করব না। শুধু আমি নিশ্চিন্ত থাকতে চাই যে, প্রয়োজন হলে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারব।
-তোমার অনুরোধ রক্ষা করতে না পারা আমার জন্য বড় কষ্টের এমি। কিন্তু আমি অপারগ। তুমি সব জান। আমাকে ক্ষমা করো তুমি।
এমিলিয়া মুখ নীচু করে দাঁড়িয়েছিল। কোন কথা বলল না। তেমনি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
মাহমুদ ফিরে এমিলিয়ার মুখোমুখি দাঁড়াল। ওর চোখে অশ্রু। বোধ হয় অশ্রু গোপন করার জন্য এমিলিয়া দু’হাতে মুখ ঢাকল।
ভাব্ছিল মাহমুদ। ভাবছিল এমিলিয়াকে টেলিফোন নম্বর দেয়া যায় কি না। কিন্তু ভেবে দেখল, এমিলিয়াকে সকল সন্দেহের উর্ধে হলেও এ ধরনের কাজ হবে সম্পূর্ণ নীতি-বিরুদ্ধে। প্রিয়তমার চোখের পানিতে সে তার নীতি ও দায়িত্ববোধ বিসর্জ্জন দিতে পারে না। মাহমুদ বলল, বড্ড খারাপ লাগছে এমি। বিদায় বেলায় আজ তোমার চোখে অশ্রু দেখে গেলাম।
এমিলিয়া একটু হেঁট হয়ে রুমালে দু’টি চোখ মুছে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। কোন কথা বলল না।
মাহমুদ বলল, আসি এমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, এরপর বাইরের কোন টেলিফোন থেকে মাঝে মাঝে তোমার সাথে কথা বলব। বলে মাহমুদ দোলায়মান কর্ডের দিকে এগুলো।
এমিলিয়া মাহমুদের একটি হাত চেপে ধরে বলল, কষ্ট নিও না, আমার দুর্বলতাকে ক্ষমা করো।
মাহমুদ ফিরে দাঁড়াল। এমিলিয়ার আনত মুখটিকে তুলে ধরে বলল, তাহলে হাসতে হবে। বলে হাসতে লাগল।
-জোর করে বুঝি হাসাবে তুমি। হেসে ফেলল এমিলিয়াও।
-কাঁদাবে যে হাসাবে তো সেই। আসি। খোদা করুন আগামীকালের অপারেশনে তুমি সফল হও। খোদা হাফেজ।
-খোদা হাফেজ। বলল এমিলিয়া।
মাহমুদ সিল্কের কর্ড ধরে ঝুলে পড়ল।
৩
সৌদি আরবের দুর্গম মরুদ্যান আল-আসির। রাত দশটা। চারিদিকের দিগন্ত প্রসারিত বালির সমুদ্রে একটি ক্ষুদ্র তিলকের মত ঘুমিয়ে আছে আল-আসির। খেজুর কুঞ্জ আচ্ছাদিত আল-আসিরের ঘুটঘুটে অন্ধকারের বুক চিরে একটি লাল আলো স্থিরভাবে জ্বলছে। ভয় করে আলোর দিকে চাইলে। যেন কাল রাত্রির বিশাল দেহ রক্তচক্ষু তুলে কাউকে শাসাচ্ছে। আল আসিরের পশ্চিম আকাশে হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। শব্দ নিকটতর হলো-বোঝা গেল হেলিকপ্টার লাল আলোর উপরে এসে সার্চ লাইটের আলো একবার নীচে নিক্ষেপ করল। সার্চ লাইটের আলোয় একটি দীর্ঘ রানওয়ে স্পট হয়ে উঠল। নিভে গেল সার্চ লাইট। ল্যান্ড করল হেলিকপ্টারটি। মাত্র ২৫ মিনিটের মধ্যে আরও তিনটি হেলিকপ্টার ল্যান্ড করল আল-আসিরে।
আল-আসিরের মাঝখানে খেজুর কুঞ্জে ঢাকা একটি কাল পাথরের বাড়ী। বায়তুল-আমিন-শাহ সউদের একটি অবকাশ নীড়। পারস্য উপসাগরের হিমেল বাতাস সিক্ত এই নীরব-নিঝুম মরুদ্যানে শাহ সউদ মাঝে মাঝে অবকাশ যাপন করতে আসেন। শাহ ইবনে সউদের অবকাশ নীড় এই বায়তুল আমিনেই আজ সংযুক্ত আরব কমান্ড ও আরব সুপ্রীম সিকিউরিটি কাউন্সিলের বৈঠক বসেছে। ফিলিস্তিন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্বান্ত নেয়া হবে আজ এখানে। অতি গোপন এ বৈঠক। আমেরিকা, রাশিয়া ও বৃটেনের শ্যেনদৃষ্টিকে ফাঁকি দিয়ে আজ এখানে একত্রিত হয়েছেন বাদশাহ সউদ, মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার রশিদ, জর্দানের বাদশাহ আবুল হিশাম, লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট শিবলি সোহায়েল, মরক্কোর বাদশাহ হাসান শরীফ, সুদানের প্রেসিডেন্ট ফারুক আল নিমেরী, আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আবু জাফর আবেদীন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-সাল্লাল এবং সংযুক্ত আরব কমান্ডের অধিনায়ক আবুল আমর আবদুল্লাহ। আর এসেছে সাইমুমের নেতা আহমদ মুসা।
কাল পাথুরে বাড়ীটির অভ্যন্তরে একটি সুসজ্জিত হলঘর। একটি গোল টেবিলের চারদিকে বসেছেন আরব নেতাগণ। সভাপতির আসনে বসেছেন শাহ সউদ। শাহ সউদের ডানপাশে বসেছেন সাইমুম প্রধান আহমদ মুসা, আর বামপাশে আনোয়ার রশিদ। শাহ সউদের সামনে একগাদা কাগজ। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করে কথা বললেন, শাহ সউদ। গম্ভীর কন্ঠ ধ্বনিত হলো তার, ‘সম্মানিত ভ্রাতৃবৃন্দ, আমরা এক অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্বান্ত নেবার জন্য এখানে সমবেত হয়েছি। বায়তুল মোকাদ্দাস এবং ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য আমরা কোন পথ ধরব? সে পথ কি আমাদের সম্মিলিত শক্তি প্রয়োগের পথ? কিংবা বৃহৎ শক্তিবর্গের উপর চাপ সৃষ্টির পথ? অথবা কৌশলে ফিলিস্তিনে স্বয়ংক্রিয় কোন বিপ্লব সংঘটনের পথ? আশা করি এ ব্যাপারে আপনারা আপনাদের সূচিন্তিত বক্তব্য রাখবেন।’ শাহ সউদ চুপ করলেন। নেমে এল নীরবতা।
এবার কথা বললেন আনোয়ার রশিদ। তিনি বললেন, ফিলিস্তিনের মুক্তির জন্য আপনি যে পথ তিনটির কথা উল্লেখ করেছেন, তারই কোন একটি পথ ধরে আমাদের এগুতে হবে। এ পথগুলোর সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কে আমাদের সকলের যে ধারণা, তা একরূপই হবে বলে আমার বিশ্বাস। আমার অনুরোধ, আপনিই এ ব্যাপারে প্রথম বক্তব্য রাখবেন।
প্রেসিডেন্ট আবেদীন, বাদশাহ হাসান শরিফ, প্রেসিডেন্ট শিবলি সোহায়েল প্রমুখ উপস্থিত সকলেই আনোয়ার রশিদের প্রস্তাবকে সহাস্যে সমর্থন জানালেন।
শাহ সউদ ধীরে ধীরে মুখ তুললেন। মনে হলো একটু ভাবলেন তিনি। কাগজপত্র একটু নাড়াচাড়া করলেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, আমরা সকলেই জানি সোভিয়েত, বৃটেন ও আমেরিকা ইহুদী শক্তির পিছনে না থাকলে ফিলিস্তিনে ইহুদী আমদানি সম্ভব হতো না, জাতিসংঘে ফিলিস্তিন বিভক্তির প্রস্তাব উঠত না, পাশও হতো না এবং ইসরাইল রাষ্ট্রও জন্মলাভ করত না। বাইরে থেকে আমরা শক্তি প্রয়োগ করে ফিলিস্তিন মুক্ত করতে পারব না। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন ও আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করার মত শক্তি আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি। ইসরাইলের সাথে আমাদের কয়েকটি যুদ্ধ থেকে পরিষ্কার হয়ে গেছে ও পথ আমাদের সাফল্যের পথ নয়। চাপ প্রয়োগের কথা আমরা ভাবতে পারি। তৈল-অস্ত্রের সাহায্যে আমরা সে চাপ দিয়ে আসছি। কিন্তু এ চাপেরও একটা সীমা আছে, সে সীমা আমরা অতিক্রম করতে পারি না। তৈল অস্ত্র প্রয়েগে কিছু ফল আমরা পেয়েছি, আরও কিছু ফল পেতে পারি। কিন্তু ফিলিস্তিনের মুক্তি এর দ্বারা আসতে পারে না। আর একটি পথ বাকি থাকে। সেটা হলো ফিলিস্তিনের অভ্যন্তর থেকে স্বয়ংক্রিয় বিপ্লবের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের মুক্তি। আমার মতে ফিলিস্তিনের মুক্তির এই পথই একমাত্র সঠিক পথ। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের এই পথেই আমাদের এগুতে হবে। আমি আনন্দিত যে, সাইমুম জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের সে পথ রচনা করেছে। শাহ সউদ চুপ করলেন।
মুহূর্ত কয়েক নীরবতা। তারপর কথা বললেন আলজিরিয়ার প্রেসিডেন্ট। তিনি বললেন, আন্তর্জাতিক দিক থেকে এ পথটি নিরাপদ। কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত জটিল ও সময় সাপেক্ষ।
আনোয়ার রশিদ বললেন, বিষয়টি জটিল ও সময় সাপেক্ষ অবশ্যই, কিন্ত অসম্ভব নয়। সাইমুম যে পথ ধরে এগুচ্ছে, তা একে অনেক সহজ করে দেবে।
বাদশাহ হাসান শরিফ ও প্রেসিডেন্ট শিবলি সোহায়েল নীচু স্বরে কিছূ কথা বললেন। পরে প্রেসিডেন্ট শিবলি সোহায়েল বললেন, আমরা যে পথে এগুতে যাচ্ছি, তার সাফল্যের অধিকাংশ নির্ভর করছে সাইমুমের কর্মতৎপরতার উপর। আমাদের মোহতারাম ভাই আহমদ মুসা উপস্থিত আছেন, তার বক্তব্য আমরা শুনতে পেলে আমাদের আলোচনা সহজ হতো।
শাহ সউদ মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক। স্মিত হেসে আহমদ মুসার দিকে চাইলেন।
আহমদ মুসা বললেন, মোহতারাম শাহ সাহেব যে মত প্রকাশ করেছেন আমার বক্তব্যও সেটাই। আমি আনন্দিত যে, আমরা সবাই একই লাইনে চিন্তা করছি। আর সাইমুমের গোটা সংগঠন গড়ে উঠেছে এই দর্শনের উপর ভিত্তি করেই। আপনারা যে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতা দিয়ে আসছেন, তা অব্যাহত থাকলে আমি নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। আপনারা শুনে সুখী হবেন যে, ইসরাইলের ‘ড্রজি’ সম্প্রদায়ের সাথে আমাদের চুক্তি হয়েছে। ইসরাইলের স্থল, বিমান ও নৌবাহিনীতে ওদের ১৪ হাজারের মত লোক রয়েছে। ওদের সর্বাত্মক সাহায্য আমরা পাব। এতদিন ইসরাইলী আর্মির অভ্যন্তরে প্রবেশ ছিল অসম্ভব। আল্লাহর অনুগ্রহে এখন সে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ইসরাইলীদের ইহুদীকরণ প্রচেষ্টায় অসন্তুষ্ট ক্ষুব্ধ ‘ড্রজিরা’ আমাদের সব রকম সাহায্য দেবে। আহমদ মুসা চুপ করল। নেমে এল নীরবতা।
নীরবতা ভাঙ্গলেন শাহ সউদ নিজে। “ফিলিস্তিনে কোন স্বয়ংক্রিয় বিপ্লব বা গণ-অভুত্থানের মাধ্যমে যদি আমরা ইসরাইল রাষ্ট্রের উৎখাত করতে চাই, তাহলে ফিলিস্তিনী মুসলিম জনসাধারণের প্রতিনিধি ও মুখপাত্র হিসেবে সাইমুমের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করতে হবে। আর তার আগে আমাদের তরফ থেকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আমরা মুসলিম দেশগুলো যদি জাতিসংঘে প্রস্তাব আনি এবং আমাদের প্রভাব কাজে লাগাই, তাহলে সাইমুম জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করবে। ভবিষ্যতে এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুবই কাজে আসবে।”
মরক্কোর বাদশা শরিফ বললেন, ‘শাহ সাহেব উপযুক্ত পরামর্শ দিয়েছেন। ফিলিস্তিনে অন্তর্বিপ্লবের পরিকল্পনা যদি আমাদের সফল হয়, তাহলে ঐ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুবই উপকারে আসবে। অবশ্য সে বিপ্লব যদি নিছক সরকার পরিবর্তন ধরনের হয়, তাহলে ঐ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি খুব গুরুত্ববহ হবে’।
বাদশাহ আবুল হিশাম বললেন, আমরা কি আজই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিব?
প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল-সাল্লাল বললেন, সিদ্ধান্ত আমরা আজই নিচ্ছি। কিন্তু তা আমরা ঘোষণা করব আমাদের আসন্ন রাবাত শীর্ষ সম্মেলনে এবং তারপর থেকেই সাইমুমের জন্য আমরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের প্রচেষ্টা চালাব।
শাহ সউদ বললেন, হাফিজ সাহেব ঠিক বলেছেন। রাবাত সম্মেলনেই আমরা আমাদের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করব। শাহ সউদ একটু চুপ করলেন। তারপর আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বললেন, লক্ষ লক্ষ নিরাশ্রয় ও দুঃখী মানুষের পক্ষ থেকে এ গুরু দায়িত আপনার উপর বর্তেছে। আমরা গর্বিত যে, সাইমুম এ দায়িত্ব পালনে সমর্থ। আমরা এখন জানতে পারলে উপকৃত হবো যে, অন্তর্বিপ্লবের পরিকল্পনা আপনার কি হবে এবং সে ক্ষেত্রে আমাদের কি করণীয় থাকবে?
আহমদ মুসা একটু নড়ে-চড়ে বসলেন। কপালে তাঁর চিন্তার বলিরেখা স্পষ্ট। মুখটি তাঁর প্রশান্ত। চোখ দু’টি তাঁর ভাবনার কোন অতল গভীরে। ধীরে ধীরে মুখ খুললো আহমদ মুসা। বল সে, আন্তর্বিপ্লবের পথ অত্যন্ত জঠিল ও ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা শুধু শক্তি দিয়ে ৩০ লাখ ইহুদীর কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নিতে পারব না আমাদেরকে কৌশলের পথ ধরতে হবে। ইসরাইলী নেতাদের পারস্পরিক বিরোধের সুযোগ আমাদের নিতে হবে। উচ্চাভিলাষী মোশেহায়ান ক্যাবিনেট থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। ইসরাইলী আর্মির সাবেক সর্বাধিনায়াক জেনারেল রবিন রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছেন আমরা জানি। ইসরাইল আর্মির এক বিরাট অংশের উপর এই দুইজনের প্রভাব রয়েছে। ইসরাইলের বন্ধু দেশগুলোও তাদের রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ সম্পর্কে জ্ঞাত আছে। আমরা তাদের দু’জনকে কাজে লাগিয়ে ইসরাইলী জনগণ ও সেনাবাহিনী এবং ইসরাইলের বন্ধুরাষ্ট্রদের বিভ্রান্ত করবো। বিভ্রান্তি কাটিয়ে প্রকৃত বিষয় তারা বুঝে ওঠার পূর্বেই আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারব বলে আশা করছি। আহমদ মুসা একটু থামলেন। আবার শুরু করলেন, এর উপর আমরা যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাই, তাহলে ভবিষ্যতে তা আমাদের খুব উপকারে আসবে। আমরা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের পর ইসরাইল সরকারের সাথে আপোষমূলক মনোভাব আপনাদের দেখাতে হবে। আমি যতদূর জানি, ইসরাইল স্বীকৃতির আশ্বাস পেলে তার অধিকৃত সব এলাকা সে ছেড়ে দিবে। ইসরাইলের সাথে এ ধরনের সমঝোতার পথ আপনাদের করতে হবে। আর এ সমঝোতা চেষ্টা পাবলিসিটি ওর্য়াক বেশী করতে হবে। ইসরাইল আর্মি এবং সেখানকার জনসাধারণের এক বিরাট অংশ এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে। সুতরাং ইসরাইল সরকারের এই আপোষমূলক মনোভাবের বিরুদ্ধে তারা বিক্ষুব্ধ হবে। আর আমরা এরই সুযোগ গ্রহণ করব। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন ও আমেরিকা আন্তরিকভাবে চায় না যে, ইসরাইল ও আরবরা পূর্ণ সমঝোতায় পৌঁছুক। সুতরাং আমাদের সাথে আপোষমুখী ইসরাইল সরকারের বিরুদ্ধে কোন আভ্যন্তরীণ অভ্যুত্থনকে তারা কোনরূপ সন্দেহের চোখে দেখবে না। আহমদ মুসা থামলো।
প্রেসিডেন্ট শিবলি সোহায়েল কথা বললেন। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আহমদ মুসার ডান হাতটি হাতে নিয়ে একটি ঝাঁকুনী দিয়ে বললেন, খায়ের! খায়ের!! চমৎকার বুদ্ধি, চমৎকার পরিকল্পনা। মোবারকবাদ আপনাকে।
শাহ সউদের চোখ বুজে গিয়েছিল। ধীরে ধীরে তিনি চোখ খুললেন। হাঁ, পরিকল্পনা ও প্রস্তাবগুলো খুব সমীচীন, সূচিন্তিত। কিন্তু সমস্যা দেখা দেবে বিপ্লবের প্রকৃতি প্রকাশ হয়ে পড়ার পর। আমেরিকা মরিয়া হয়ে কিছু করে না বসে। অবশ্য আফ্রো-এশিয়াসহ চীন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশগুলো যদি আমাদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে আমেরিকা সে সাহস পাবে না। তাছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিরপেক্ষ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে আমাদের।
আনোয়ার রশিদ ও হাফিজ আল-সাল্লাল প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠলেন, আমরা তা পারব। আমরা যদি তাকে তার প্রভাব বলয়ের অক্ষুন্নতার নিশ্চয়তা দান করি, তাহলেই এটা করতে পারব।
বাদশাহ আবুল হিশাম, ফারুক আল-নিমেরী, হাফিজ আল-সাল্লাল, শিবলি সোহায়েল প্রমুখদের মধ্যে টুকিটাকি আলোচনা চলতে লাগল। শাহ সউদ তাঁর টেবিলের সাদা বোতামে মৃদু চাপ দিলেন। তারপর বললেন, আমরা এখন নাস্তা করব। আমাদের এতক্ষণের আলোচনায় যে সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, তা হলোঃ
(১) অন্তর্বিপ্লবের মাধ্যমে ফিলিস্তিন মুক্ত করতে হবে।
(২) সাইমুমকে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা স্বীকৃতি দেব এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করবো।
(৩) ইসরাইল সরকারকে আমরা এমন ধরনের মৈত্রীতে আবদ্ধ করতে চেষ্টা করব, যাতে সেখানকার জনগণ ও সেনাবাহিনী বিক্ষুব্ধ হয়।
(৪) অর্থবল, লোকবল, অস্ত্রবল-যে সাহায্যই সাইমুমের প্রয়োজন পড়বে তা আমরা দিব।
শাহ সউদ থামলেন। তিনি চুপ করতেই সাউন্ড প্রুফ ঘরটির দেয়াল ফেটে একটি দরজা বেরুল। দরজা দিয়ে নাস্তার ট্রে ঠেলে প্রবেশ করল শাহ সউদের খাস বেয়ারা শরিফ ইবনে আলী আকরাম।
রাবাতের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। কঠোর প্রহরা চারিদিকে। দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও সীমিত সংখ্যক সাংবাদিক ছাড়া বেসামরিক কোন লোকের চিহৃ কোথাও নেই। আর মিনিট সাতেকের মধ্যেই শাহ সউদের বিশেষ বিমানটি ল্যান্ড করবে। মরক্কোর বাদশা হাসান শরিফ এবং মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাঁর। উর্ধতন সামরিক অফিসার ও বিমান কর্মচারীদের ইতস্তত বিচরণ করতে দেখা যাচ্ছে। ‘গার্ড অব অনার’ দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট প্রস্তুত রয়েছে। সালাম গ্রহণ মঞ্চের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে বুলেট-প্রুফ সুদৃশ্য গাড়ী, ওদেরই একটি বহন করবে শাহ সউদ ও বাদশাহ হাসান শরিফকে।
আহমদ মুসা ভি, আই, পি, রুম থেকে বেরিয়ে বিমান চত্বরে একটি চক্কর দিয়ে টয়লেটের দিকে চললো। সাধারণ আরবী পোশাক তাঁর দেহে। টয়লেটে ঢুকতে গিয়ে একটি মুখের দিকে নজর পড়তেই তার চিন্তা যেন হোঁচট খেল। কাঁধে ক্যামেরা ঝোলানো একজন লোক বেরিয়ে আসছিল টয়লেট থেকে। সোডিয়াম লাইটের ধবধবে আলো লোকটির মুখের প্রতিটি রেখা যেন আহমদ মুসার কাছে স্পষ্ট করে তুলল। জোড়া ভ্রু, নাকের ডানপাশে কাটা দাগ, ঝুলে পড়া ঠোঁট, কোথায় যেন এ মুখ তিনি দেখেছেন। লোকটির পিছনে আর একজন লোক বেরিয়ে এল। এই লোকটিকে আহমদ মুসা চেনে-বাদশা শরিফের খাস ড্রাইভারদের প্রধান।
আহমদ মুসা টয়লেটে ঢুকলো। কিন্তু উড়োজাহাজের প্রফেলারের মত চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল-‘তাস’-এর এ সাংবাদিক ভদ্রলোকটি কে? হঠাৎ তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল ডসিয়ার এলবামের একটি মুখ, সেই জোড়া ভ্রু, নাকের ডানপাশে কাটা দাগ, ঝুলে পড়া ঠোঁট। নাম ইসাক এলিস। ইরগুণ জাই লিউমির দুর্ধর্ষ ইহুদী স্পাই। কথাটা মনে হওয়ার সাথে সাথে গোটা শরীর রোমাঞ্চ দিয়ে উঠল আহমদ মুসার। ‘ইরগুণ জাই লিউমি’র অপারেশন স্কোয়ার্ডের মধ্যমণি ইসাক এলিস এখানে? ‘তাস’ করেসপন্ডেন্ট সে কবে থেকে? বিজলির চমকের মত আর একটি প্রশ্ন ছুটে এল তাঁর মনে-খাস ড্রাইভার প্রধান শরীফ আলম ইসাক এলিসের পিছনে বেরিয়ে গেল কেন? শাহ ফয়সালের শাহাদতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে যাচ্ছে না তো? কেঁপে উঠল মুসার লৌহ হৃদয়ও। আকাশে জেট ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে, ল্যান্ড করছে শাহ সউদের বিমান। টয়লেট থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলো আহমদ মুসা। ঐ তো রানওয়ে দিয়ে ছুটে আসছে শাহ সউদের বিশেষ বিমানটি। বাদশাহ হাসান শরিফ ও উর্ধতন নেতৃবৃন্দ বিমান চত্বরে এসে দাঁড়িয়েছেন মহান অতিথিকে সম্বর্ধনার জন্য। দ্রুত কাজ করছিল আহমদ মুসার মন। বিন্দু বিন্দু ঘাম তাঁর কপালে। চোখে তাঁর দৃঢ় সিদ্ধান্তের ছাপ।
টয়লেট থেকে বেরিয়ে সে সোজা গেলো সালাম গ্রহণ মঞ্চের পিছনে দাঁড়ানো আবুল আসের কাছে। আবুল আস সাইমুমের রাবাত ইউনিটের প্রধান। খুব নীচু গলায় আহমদ মুসা বলেলো, ‘তাস’ করেসপন্ডেন্টের দিকে নজর রেখো, ওকে আমাদের চাই-ই। ড্রাইভার শরিফ আলমকেও সন্দেহ করছি। বলেই আহমদ মুসা দ্রুত ফিরে এলো বিমানের দিকে। বিমানের খোলা দরজায় সিঁড়ি লাগানো হয়ে গেছে। পরক্ষণেই দেখা গেল, শাহ সউদ নেমে আসছেন সিঁড়ি দিয়ে। সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে বাদশাহ হাসান শরিফ। আহমদ মুসা গিয়ে দাঁড়ালেন বাদশাহর পাশে। মন তাঁর ছটফট করছিল। অবিলম্বে কয়েকটি কথা বলা দরকার বাদশাহকে। কিন্তু ফুরসৎ কই? এখান থেকে সোজা ওঁরা যাবেন সালাম গ্রহণ মঞ্চে, তারপর সেখান থেকে গাড়ীতে। কিন্তু বলতেই হবে তাঁকে কথা।
সুযোগ জুটে গেল। বিমান চত্বর থেকে ফেরার পথে শাহ সাহেব ও প্রধানমন্ত্রী হাস্যালাপ করছিলেন। সেই সুযোগে আহমদ মুসা বাদশাহকে বলল, এই মুহূর্তেই আপনাকে দু’টি আদেশ দিতে হবে, অত্যন্ত জরুরী।
বাদশাহ কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে বললেন, বলুন।
পূর্ব নির্দিষ্ট গাড়ী বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীর গাড়ী কিংবা অন্য কোন গাড়ীতে আপনাদের যাবার ব্যবস্থা করতে বলুন, ড্রাইভার শরিফ আলমকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে বলুন, আর ‘তাস’ করেসপন্ডেন্টকে আমরা গ্রেপ্তার করতে চাই।
-কিছু হয়েছে, কিছু ঘটেছে? এবার স্পষ্ট উদ্বেগ ঝরে পড়ল বাদশাহর কন্ঠে। তিনি প্রায় দাঁড়িয়ে পড়লেন।
-পরে সব জানতে পারবেন, আপনার রায় বলুন।
-আমি আবু আমরকে এখনই নির্দেশ দিচ্ছি। আবু আমর মরক্কোর সিকিউরিটি প্রধান।
গার্ড অব অনার শেষে সাংবাদিকদের সাথে সংক্ষিপ্ত দু’চারটি কথা বলার পর বাদশাহ হাসান শরিফ ও শাহ সউদ যখন সেনাবাহিনীর একটি গাড়ীর দিকে এগুচ্ছিলেন, ঠিক সেই সময় পূর্ব নির্দিষ্ট গাড়ীর পাশে এ্যাটেনশনভাবে দাঁড়ানো ড্রাইভার শরিফ আলমকে দু’জন নিরাপত্তা পুলিশ ধরে নিয়ে গেল।
বাদশাহর গাড়ী চলে যাবার পর বিমান বন্দরের বহিরাঙ্গন থেকে সাংবাদিকদের জন্য নির্দিষ্ট খোলা জিপটিও যাত্রা করল। দেখা গেল ‘তাস’ করেসপন্ডেন্ট আঁদ্রে শুখানভ ওরফে ইসাক এলিসও উঠে বসলেন ড্রাইভারের পাশের সিটে। সাংবাদিকদের জীপের পিছনে আর একটি ল্যান্ড রোভার ষ্টার্ট নিল। গাড়ীর পিছনের সিটে দু’জন মুকোশধারী, ড্রাইভিং সিটে আবুল আস নিজে। তাঁদের গাড়ী যখন বিমান বন্দরের গেট পার হলো, সেই সময় পিছন থেকে প্রচন্ড বিষ্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। সালাম গ্রহণ মঞ্চের পার্শ্বে দাঁড়ানো ড্রাইভার শরীফ আলমের গাড়ীর ছাদ প্রচন্ড বিষ্ফোরণে উড়ে গেছে-জ্বলছে লিমোজিনটি। আবুল আস দেখতে পেল-সামনের সাংবাদিক জিপটি থেমে গেছে। জীপ থেকে লাফিয়ে পড়লেন রয়টার এবং এ, এফ, পি’র করেসপন্ডেন্ট। ছুটছেন তাঁরা বিমান বন্দরের দিকে দুর্ঘটনা দেখার জন্য। একটু পরে আঁদ্রে শুখানভ ওরফে ইসাক এলিসও নামলেন। আবুল আসের গাড়ীটিও সাংবাদিক জীপের পিছনে এসে থেমে গিয়েছিল। আর একটি নীল রংয়ের ভক্সওয়াগন এসে আবুল আসের গাড়ীর পিছনে থেমে গেল। আবুল আস মুখোশধারীদের একজনকে বললো, ‘তুমি আমার সাথে এসো।’ বলে আবুল আস গাড়ী থেকে নেমেই দেখলো, এলিস পিছনের গাড়ীটার পাশে প্রায় পৌঁছতেই দরজাটি হঠাৎ খুলে গেল, আর ঝুপ করে সে ঢুকে গেল গাড়ীর ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠলো গাড়ী। ব্যাপারটি বুঝে ফেলল আবুল আস। গুলী করল সে গাড়ীর টায়ার লক্ষ্য করে। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সে গুলী। গাড়ীটির জানালা দিয়ে ডিম্বাকৃতি একটি বস্তু ছুটে এসে সশব্দে ফেটে গেল। মুহূর্তের মধ্যে গাঢ় কাল ধোয়ায় ছেয়ে গেল স্থানটি। আবুল আস তার নিজের গাড়ীও ঠাহর করতে পারলো না ধোঁয়ার সেই গাঢ় আবরণে। মুহূর্তকয় পর ধোঁয়া যখন সরে গেল, তখন পিছনের গাড়ীটির কোন অস্তিত্ব কোথাও নেই।
ইসাক এলিসকে নিয়ে এয়ারপোর্ট রোড ধরে তীব্র বেগে ছুটে চলছিল সেই নীল রংয়ের ভক্সওয়াগন। এলিসসহ মোট তিনজন আরোহী। এলিস পিছনের অন্ধকার ঢাকা পথের দিকে চেয়ে আশ্বস্ত হলো -না কেউপিছু নেয়নি। পরে পাশের লোকটির দিকে চেয়ে বলল, ‘শরিফ ধরা পড়েছে রবিন।’ রবিন নামক লোকটি বলল, শাহ ও বাদশাহকে অন্য গাড়ীতে দেখেই আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম।
টাইম বোম্ব সে যথাসময়েই গাড়ীতে সেট করতে পেরেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে সব পন্ড হলো কি করে আমি তাই ভাবছি। বলল এলিস।
-আপনার পিছু নিয়েছিল ওরা কারা?
-যারাই হোক, সরকারের লোক নয়, এরাই ধরিয়ে দিয়েছে শরিফ আলমকে।
-আমার ধারণা, ওরা সাইমুমের লোক। আপনার পরিচয় শুধু ওদের পক্ষেই জানা সম্ভব।
এলিসের গাড়ীর পিছনে নিঃশব্দে ঝড়ের গতিতে ছুটে আসছিল আর একটি গাড়ী। কালো রং-এর ল্যান্ড রোভার। হেড লাইট নিভানো, তাই আগের গাড়ীর আরোহীদের কাছে গাড়ীটি অজ্ঞাতই রয়ে গেছে। গাড়ীতে একজন মাত্র আরোহী। আরবীয় পোশাক পরিধানে। কানের পাশ দিয়ে নেমে আসা রুমাল মুখের অধিকাংশ ঢেকে রেখেছে। তার পাশে পড়ে রয়েছে একটি সাব-মেশিনগান।
এলিসের গাড়ী এয়ারপোর্ট রোড ছেড়ে জনবিরল এরাবিয়ান হাইওয়েতে গিয়ে পড়ল। এই সময় সামনে থেকে আর একটি গাড়ী এসে পড়ল। তার হেড লাইটের আলোতে এলিসদের গাড়ীসহ পিছনের গাড়ীটি আলোকিত হয়ে উঠল। দৃর্ভাগ্যই বলতে হবে পিছনের গাড়ীর আরোহীর। তার অস্তিত্ব সামনের গাড়ীর আরোহীর কাছে পরিস্কার হয়ে গেল। প্রমাদ গুণল পিছনের গাড়ীর আরোহী।
এলিসদের গাড়ীর গতিবেগ বেড়ে গেল। গতিবেগ বাড়ালো পিছনের গাড়ীটিও। পিছনের গাড়ীর আরোহীর চোখ দু’টি সামনের গাড়ীর প্রতি স্থিরভাবে নিবদ্ধ। মুখে তার দৃঢ় সংকল্পের ছাপ। স্পিডোমিটারের কাঁটা কাঁপছে। ৮০ পেরিয়ে কাঁটা ৯০ ছুঁই ছুঁই করছে। সামনের গাড়ীর স্পিডোমিটারের কাঁটা তখন ৮০’তে, পারছে না প্রতিযোগিতায়। পিছনের গাড়ীটি মিনিট দেড়েকের মধ্যেই ধরে ফেলল সামনের গাড়ীটিকে। আগের গাড়ীর নিকটে আসতেই এক ঝাঁক গুলী এসে পিছনের গাড়ীর গায়ে লাগল। তবু বেপরোয়া আরোহীটি তার গাড়ী এনে সামনের গাড়ীর পথ রোধ করে দাঁড়াল। থেমে গেছে এলিসদের গাড়ীও, আলো নিভে গেছে তার। গাড়ীটি থামিয়েই আরবী পোশাকের আরোহীটি সাবমেশিনগানটি নিয়ে গড়িয়ে নেমে পড়েছে নীচে। চোখ তার ইনফ্রারেড গগলস। অন্ধকার স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে তার চোখে। ঐ গাড়ী থেকে গুলীবৃষ্টি হচ্ছে। পিছনের গাড়ীর আরবীয় পোশাকের আরোহিটি কোন প্রত্যুত্তর না দিয়ে সাপের মত এগিয়ে চলেছে এলিসদের গাড়ীর দিকে। রাস্তার উত্তর পাশের ঢাল বেয়ে নিঃশব্দে এগুচ্ছিল সে। কোন প্রত্যুত্তর না পেয়ে ওপারের গুলীও বন্ধ হয়ে গেল। আরবীয় পোশাকের আরোহী দেখতে পেল, এলিসের গাড়ীর এপাশে লম্বালম্বি শুয়ে আছে একজন, হাতে তার উদ্যত স্টেনগান। মাথা ঈষৎ উঁচু করে সে চারিদিকটা একবার ভাল করে দেখার চেষ্টা করছে। পিছনের আরবী আরোহীটি গুলী করার লোভ সম্বরণ করল। বোঝা গেল গাড়ীর তিনজন আরোহীর কে কোথায়, তা সে প্রথমে জানতে চায়। গাড়ীর পিছন বরাবর গিয়ে সে থামল। অপর দু’জনকে সে গাড়ীর পিছনে দেখতে পেল। তাদের একজন শুয়ে, হাতে তার স্টেনগান, অপরজন হাঁটু গেড়ে বসে, হাতে তার রিভলভার। হাঁটু গেড়ে বসা লোকটিই ইসাক এলিস, তা বুঝতে পারল আরবী পোশাকের আরোহী। এলিসদের সকলের দৃষ্টি সামনের আড়াআড়ি করে রাখা আরবী লোকটির ঐ গাড়ীর দিকে। গাড়ীর উত্তর পার্শ্বে গাড়ীর লম্বালম্বি শুয়ে থাকা লোকটিকে এই সময়ে গুটি গুটি গাড়ীর পিছন দিকে আসতে দেখা গেল। আরবীয় পোশাকের আরোহীটি বোধ হয় এভাবে তিনজনকে এক সঙ্গেই চাচ্ছিল। প্রশস্ত মাইল পোস্টের আড়ালে শুয়ে স্টেনগানটি বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে রিভলভার থেকে ধীরে সুস্থে প্রথম গুলীটি ছুঁড়ল সে। আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল গুটি গুটি করে আসা লোকটি। বিদ্যুৎ গতিতে ফিরে দাঁড়িয়েছিল এলিস। একটু মাথা তুলে ফিরবার চেষ্টা করেছিল গাড়ীর পিছনে শুয়ে থাকা লোকটিও। কিন্তু আরবীয় পোশাকের আরোহীটির দ্বিতীয় গুলী তার কানের পাশ দিয়ে ঢুকে গেল একদম মাথার ভিতরে, এলিয়ে পড়ল তার মাথা আবার মাটিতে। এলিসও গুলী ছুঁড়েছিল, কিন্তু লক্ষ্যহীন সে সব। এলিস এবার সঙ্গীর স্টেনগানটি তুলে নিয়ে দৌড়ে দক্ষিণ পার্শ্বে চলে গেল। বোঝা গেল, আরবীয় পোশাকের আরোহীটি ইচ্ছা করেই তৃতীয় গুলীটি ছুঁড়ল না। বরং সে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ঢাল বেয়ে দৌড়ে এলিসের গাড়ীটির ওপাশে গিয়ে উঠল। দেখতে পেল সে, এলিস রাস্তার ওপাশের ঢালে নেমে যাচ্ছে। কয়েক পা সামনে গিয়ে চিৎকার করে উঠল আরবীয় পোশাকের আরোহী স্টেনগান ফেলে দাও এলি কথা শেষ হলো না তার। ঝট করে এলিস পিছনে ফিরে দাঁড়াল, কিন্তু বেপরোয়া এলিসের স্টেনগান থেকে গুলী বেরুবার আগেই আরবীয় পোশাকের আরোহীর তৃতীয় বুলেটটি এলিসের বাম কাঁধে ঢুকে গেল। স্টেনগান পড়ে গেল হাত থেকে, বসে পড়ল সে।
এলিস, এলিসের দুই সহকর্মী ও এলিসের গাড়ীটি সার্চ করে এলিসকে বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে গাড়ী ছেড়ে দিল এবার আরোহীটি। শহরের অকট্রয় পোস্টে আসতেই গাড়ীটি আটকে দিল সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট। বুলেটের ঝাকে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া গাড়ীটি তারা ঘিরে দাঁড়াল। কিন্তু তাদের অফিসার গাড়ীর সমনে এসে আরোহীকে দেখেই চমকে উঠে স্যালুট করে সরে দাঁড়াল। ঘিরে দাঁড়ানো সৈনিকরাও সরে দাঁড়াল সঙ্গে সঙ্গে। গাড়ীটি চলে যাওয়ার পর অফিসারটি উৎসুক সৈনিকদের জানাল, আহমদ মুসা।
নামটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে সৈনিকদের বিস্ময়াবিষ্ট চোখ অপসৃয়মান গাড়ীটির দিকে ছুটে গেল আর একবার।
আরবীয় পোশাকের আরোহীটি আহমদ মুসা। এলিসের প্রতি দৃষ্টি রাখবার নির্দেশ আবুল আসকে দিয়েও নিশ্চিন্ত হতে পারেনি। তাই নিজেও পিছু নিয়েছিল তার।
এলিসকে নিয়ে আহমদ মুসা সোজা সাইমুমের রাবাত ঘাঁটিতে এসে হাযির হলো। আহমদ মুসাকে গাড়ী থেকে নামতে দেখে উদ্বেগাকুল আবুল আস ছুটে এল। কিছু বলতে যাচ্ছিল আবুল আস, কিন্তু গাড়ীর ভিতর থেকে হাত-পা বাঁধা এলিসকে পিট পিট করে চাইতে দেখে চমকে উঠে থেমে গেল সে। পরে আহমদ মুসাকে এক পাশে ডেকে বলল, শাহ এবং বাদশাহ দু’বার খোঁজ করেছেন আপনাকে। উদ্বিগ্ন তাঁরা। স্টেট গেস্ট হাউসে তাঁরা অপেক্ষা করছেন।
এলিসকে আবুল আসের হাতে সোপর্দ করে আহমদ মুসা তখনই চলল স্টেট গেস্ট হাউসের উদ্দেশ্যে।
গেস্ট হাউসের গেটে আহমদ মুসার গাড়ী পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব পালনরত অফিসার টেলিফোনে খবরটি ভিতরে পৌঁছিয়ে বাইরে এসে আহমদ মুসাকে স্যালুট করে দাঁড়াল। মুহূর্তে খুলে গেল গেট। ভিতরে প্রবেশ করল আহমদ মুসার গাড়ী। শাহ সউদ এবং বাদশাহ হাসান শরিফ দু’জনেই গাড়ী বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আহমদ মুসা গাড়ী থেকে নামতেই জড়িয়ে ধরলেন প্রথমে বাদশাহ এবং পরে শাহ সউদ।
বাদশাহ বললেন, আল্লাহ এক ভয়ানক দুর্ঘটনা থেকে আমাদের বাঁচিয়েছেন আপনার সাহায্যে।
শাহ বললেন, শুধু আমরা নই, শীর্ষ সম্মেলনটিও রক্ষা পেয়েছে।
-সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর। স্মিত হেসে জবাব দিল আহমদ মুসা।
গাড়ীর দিকে চেয়ে ভ্রুকুঁচকে শাহ সউদ বললেন, মনে হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরলেন।
বাদশাহও গাড়ীর দিকে চেয়ে বললেন, “তাই তো!” তারপর তিনি বললেন “চলুন ভিতরে গিয়ে শোনা যাবে সব।”
স্টেট গেস্ট হাউসের সুদৃশ্য ড্রইং রুমে এসে বসলেন তাঁরা।
বাদশাহ প্রথম কথা বললেন, প্রথম চোটেই ড্রাইভার শরিফ আলম সব স্বীকার করেছে। অত্যাধুনিক টাইম বোম্বটি সাপ্লাই দিয়েছে আঁদ্রে শুখানভ।”
-আঁদ্রে শুখানভ নয়, ওর আসল নাম ‘ইসাক এলিস’ ইরগুণ জাই লিউমির দুর্ধর্ষ স্পাই।
-ইসাক এলিস! চমকে উঠলেন যেন শাহ ও বাদশাহ দু’জনেই। কিছুক্ষণ নির্বাক সকলেই।
প্রথম মুখ খুললেন বাদশাহ। বললেন, দুঃখ হচ্ছে, হাতের মুঠোয় পেয়েও আমরা তাকে ধরতে পারলাম না, আবুল আস কিন্তু চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি।
-আপনি খুশী হবেন, এলিস ধরা পড়েছে। তার দু’জন সাথী নিহত, সেও আহত। এইমাত্র তাকে আমি আবুল আসের হাতে তুলে দিয়ে এলাম।
-আলহামদুলিল্লাহ! ধরা পড়েছে এলিস! সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন বাদশাহ আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা পূর্বাপর সব ঘটনা তাদের জানালেন। সব শুনে বাদশাহ যেন অভিভূত হয়ে পড়লেন। শাহ সউদ বললেন, আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘজীবি করুন। মজলুম মানবতার খেদমতের জন্য আল্লাহ আপনাকে বাঁচিয়ে রাখুন।
আহমদ মুসা বললেন, ইসাক এলিসের গ্রেপ্তারের খবর গোপন রাখতে হবে। আগামীকাল শুধু এইটুকু খবর থাকবে কাগজে, ‘বিষ্ফোরণের পর থেকে আঁদ্রে শুখানভের অন্তর্ধান ঘটেছে। অবশ্য কোন সাংবাদিকই এর বেশী কিছু বলতে পারবে না।
শরবত এল এ সময়। শরবত পান করার পর প্রসঙ্গান্তর ঘটল।
শাহ সউদ বললেন, এখন থেকে পনর মিনিটের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এখানে আসছেন।
-হঠাৎ তাঁর এ আগমন। বিস্ময় প্রকাশ করল আহমদ মুসা।
-আমার ধারণা, অনুরোধ ও হুমকি দুই-ই নিয়ে আসছেন তিনি।
-কি রকম? পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল আহমদ মুসা শাহ-এর দিকে।
-ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা যেন আগামীকালের শীর্ষসম্মেলনে সাইমুমকে স্বীকৃতি না দেই, এ অনুরোধ তিনি জানাবেন। আর ইউরোপ ও আমেরিকার প্রাণস্বরূপ তেল নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি করলে আরবদেরকে প্রলয়ংকারী এক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে হবে, এ হুমকি তিনি দেবেন। থামলেন শাহ সউদ।
-‘আর এ হুমকি ও অনুরোধের মূল লহ্ম্য হলো ইসরাইল রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা।’ শাহ সউদের কথার সঙ্গে যোগ করল আহমদ মুসা।
-ঠিক বলেছেন আপনি। বললেন বাদশাহ।
-জবাব তো নিশ্চয় আপনারা ঠিক করে ফেলেছেন? বলল আহমদ মুসা।
-কেন, আল-আসির বৈঠকে জবাবতো আমাদের তৈরী হয়েই আছে। বললেন শাহ সউদ।
একটু থেমে শাহ সউদ আবার বললেন, তবে উপস্থাপনাটা হবে একটু আলাদা ধরনের।
-যেমন? শাহ সউদের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইল আহমদ মুসা।
-আমরা পরিষ্কার বলে দেব, ফিলিস্তিন নিয়ে আরবরা তিনবার যুদ্ধে নেমেছে, চতুর্থ যুদ্ধে তারা আর নামতে চায় না। এজন্য ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি হিসেবে সাইমুমকে স্বীকার করে নিয়ে ফিলিস্তিন সম্পর্কিত সমস্ত দায়-দায়িত্ব তার কাঁধে ছেড়ে দিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনের ব্যাপারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়া থেকে অব্যাহতি পেতে চায়। আর তেল অবরোধের সাথে ফিলিস্তিন সমস্যা ও অধিকতর আরব এলাকা প্রত্যার্পণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। সাইমুমকে স্বীকৃতি দেয়ার পর এবং ইসরাইলের নিকট থেকে অধিকৃত সব এলাকা ফিরিয়ে পাওয়ার পর ফিলিস্তিন প্রশ্ন আরবদের কাছে গৌণ হয়ে পড়বে, তৈল অবরোধের কোন প্রশ্নও তখন আর উঠবে না। আর এ কথাও আমরা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেব, ইসরাইল অধিকৃত এলাকা ফিরিয়ে দিলে ইসরাইলের সঙ্গে তাদের শান্তিচুক্তিও হতে পারে। থামলেন শাহ সউদ।
হাসি খেলে গেল আহমদ মুসার মুখে। বলল সে, আমি আশা করছি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় খুশীই হবেন।
-আবার একে new startegy মনে করতে পারেন তিনি। শাহ সউদ হেসে বললেন।
-তা অবশ্য পারেন। করবেনও হয়ত তিনি। কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো যে ইসরাইলের ব্যাপারে কিছুটা soft লাইন নিয়েছে, এই বোধ তাকে আশ্বস্ত করবে। এর ফলে তারা পারস্পরিক আলোচনার সুফল সম্পর্কে আশাবাদী হবে।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই বাদশাহ হাসান শরিফের লাল টেলিফোনটি বেজে উঠল। এয়ারপোর্ট থেকে টেলিফোন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ হেনরী স্ট্রাফোর্ডকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসমাইল আবু বকর বিমান বন্দরে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা আসছেন।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে এবার যেতে হয়। ওদিকে কিছু কাজও পড়ে আছে। এযাযত দিন।
-কাজ থাকবেই, কিন্তু এই মুহূর্তে বিশ্রাম আপনার খুব প্রয়োজন।
শাহ এবং বাদশাহ আহমদ মুসাকে গাড়ী বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তাঁদের সালাম দিয়ে গাড়ীতে বসল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার গাড়ী যখন পার্ক এভিনিউ অতিক্রম করছিল, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে একটি গাড়ীর মিছিল তখন স্টেট গেস্ট হাউসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।
৪
কোড ডিসাইফার খুলে ভ্রু কুচকে উঠল সিনবেথ প্রধান ডেভিড ডোবিনের। কোড বুকটা ভালো করে নেড়ে চেড়ে দেখল পাতাগুলো কেমন আলগা আলগা। প্রতিটি পাতায় চাপ দিয়ে ফ্ল্যাট করার লক্ষণ স্পষ্ট। ডোবিন বিস্ময়ের সাথে লহ্ম্য করল, চাপের ফলে মাঝখানের কয়েকটা পাতার পেস্টিং আঠা পর্যন্ত আলগা হয়ে গেছে। স্পষ্টই বুঝা যায়, বইটি জোর করে মেলে রাখতে গিয়েই এমনটা ঘটেছে।
কপালটাও কুঞ্চিত হলো ডোবিনের।
পাশ থেকে আরও একটি বই টেনে নিল ডোবিন। বহুল পঠিত বই। কিন্তু পাতাগুলো অসম হয়নি। বিস্ময়টা ধীরে ধীরে সন্দেহের এক কুয়াশায় রূপ নিল।
ডোবিন ভূ-গর্ভস্থ সিকুরিটি রুম থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে নিজের কক্ষে চলে এল। বিশাল টেবিলের পাশে বিশাল চেয়ারটায় বসে ডোবিন ইন্টারকমে সহকারী আইজাককে বলল, তুমি একটু এস এখানে। এক মিনিটের মধ্যেই আইজাক এসে প্রবেশ করল ডোবিনের রুমে।
আইজাককে বসার জন্যে ইঙ্গিত করে ডোবিন বলল, এ কোড ডিসাইফারটা কে নিয়েছিল?
-স্মার্থা, দেশরক্ষা সচিব এরহান শালর্টকের মেয়ে।
-ও মনে পড়েছে। কয়দিন রেখেছিল বইটা?
-৭ দিন।
-স্মার্থা মেয়েটাতো ভালো।
বলে চোখ বুজল ডোবিন। মুহূর্তকয় পরে চোখ খুলল। ডিসাইফার আইজাকের হাতে দিয়ে বলল, ডিসাইফারের পাতায় যে ফিংগার প্রিন্টগুলো আছে তা নিয়ে আস এখুনি।
বইটি নিয়ে আচ্ছা বলে আইজাক বেরিয়ে গেল।
মিনিট পনর পরে আইজাক ডোবিনের ঘরে ফিরে এল ফিংগার প্রিন্ট নিয়ে।
ঘরে প্রবেশ করতেই ডোবিন বলল, কি পেলে আইজাক?
-স্যার ডসিয়ারের সবগুলো ফিংগার প্রিন্ট পরিচিত শুধু একটি ছাড়া।
-অপরিচিত ফিংগার প্রিন্ট কত জায়গায় পেয়েছ?
-যতগুলো পাতা দেখেছি, সবগুলোতেই আছে। আর …….
-আর কি?
ডোবিনের চোখে নতুন কৌতুহল।
-কয়েকটা পাতার আমি Ray একজমিনও করেছি।
-করেছ, কি পেয়েছ তাতে?
চেয়ারে সোজা হয়ে বসল ডোবিন। তার ধারাল চোখ আইজাকের চোখে।
-সাধারণ আলো থেকে একশ গুণ বেশী শক্তিশালী এক ধরনের Ray প্রতিফলন চিহ্ন পাওয়া গেছে ডসিয়ারের পাতায়।
একপোচ কালি যেন ছড়িয়ে পড়ল ডোবিনের গোটা মুখে। এক লহমায় তার বয়সটা ১০ বছর বেড়ে গেল। চোখের ধারাল দৃষ্টি যেন নিস্তেজ হয়ে গেল। কপালের ভাজগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল।
সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে লাগল। পায়চারি করতে করতে আইজাকের কাছে এসে অপরিচিত সেই ফিংগার প্রিন্টটি তার কাছ থেকে নিয়ে চোখের সামনে ধরল। দেখে স্বগতঃই উচ্চারণ করল, মহিলার ফিংগার প্রিন্ট। আইজাকের হাতে ফেরত দিয়ে ডোবিন বলল, স্মার্থা ছাড়া আর কারো হাতে গেছে এই ডসিয়ার?
‘না’ সূচক মাথা নাড়াল আইজাক।
-তাহলে অন্য কিছু চিন্তা করার আগে স্মার্থাকেই একবার জিজ্ঞেস করতে হয় আর কারো হাতে এই ডসিয়ার পড়েছিল কি না?
একটু থামল ডোবিন। তারপর বলল, আইজাক, যাও, ড্রাইভারকে গাড়ীতে উঠতে বল। আমি দেশরক্ষা সচিবের বাসায় যাব। টেলিফোনে ওর কাছ থেকে অনুমতি নিচ্ছি।
আইজাক বেরিয়ে গেল।
ডোবিন লাল টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নিল হাতে।
কোড ডিসাইফারটা এমিলিয়ার হাতেও গেছে এ কথা জেনে নিয়ে ডোবিন ছুটল এমিলিয়ার বাড়ীতে।
ডেভিড বেনগুরিয়ানের ছেলে ডেভিড সালেম সলোমন যুদ্ধে একটা পা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ার করেছেন অনেক আগে। ডাকসাইটে একজন অফিসার ছিলেন তিনি সেনাবাহিনীর। এখন একজন শিল্পিপতি ব্যবসায়ী হিসেবে সকলের সম্মানের পাত্র তিনি। তাছাড়া ডেভিড বেনগুরিয়ানের ছেলে হিসেবেও তার একটা বিশেষ মর্যাদা আছে সবার কাছে।
ডোবিন সেনাবাহিনীতে ডেভিড সালেমের অনেক জুনিয়র ছিল। সালেমের ড্রয়িং রুমে বসে তার অপেক্ষা করছিল ডোবিন।
ডেভিড সালেম এসে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দিল ডোবিন। বলল, স্যার অসময়ে এসেছি, এমিলিয়ার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
ডোবিনের মুখের দিকে তাকিয়ে সালেম বলল, বস ডোবিন। তোমাকে খুব উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে।
-জি স্যার।
-ব্যাপার কি, কিছু ঘটেছে?
-আমাদের নতুন কোড ডিসাইফারটাও আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
-হাতের বাইরে মানে শত্রুর হাতে? কপাল কুঞ্চিত হয়ে উঠল। ডেভিড সালেমের।
-শত্রুর হাতে গেছে কি না এটা এখনও স্পষ্ট নয়। এজন্যেই এমিলিয়ার সাথে এ ব্যাপারে কয়টা কথা বলতে চাই।
-এমিলিয়ার সাথে, এ ব্যাপারে?
বিস্ময় ঝরে পড়ল ডেভিড সালেমের কণ্ঠ থেকে।
-জি স্যার, কোড ডিসাইফারটা এমিলিয়ার হাতেও গিয়েছিল।
-ব্যাপারটা খুলে বলতো ডোবিন।
এবার কিছুটা উদ্বেগ ডেভিড সালেমের কন্ঠে।
সোফায় একটু নড়ে চড়ে বসে ডোবিন বলল, দেশরক্ষা সচিব এরহান শার্লটকের মেয়ে স্মার্থা মোসাদে ট্রেনিং নিচ্ছে। দেশরক্ষা সচিবের কথায় তাকে ৭ দিনের জন্যে কোড ডিসাইফারটা দিয়েছিলাম। ডিসাইফারটা ফেরত পাওয়ার পর আমরা চেক করতে গিয়ে দেখেছি, ডিসাইফারটার ফটো কপি করা হয়েছে। কার দ্বারা হয়েছে আমরা জানি না। যেহেতু কোড বইটা স্মার্থার কাছ থেকে এমিলিয়াও নিয়েছিল, তাই আমরা তাকেও কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই।
উদ্বেগ ফুটে উঠল ডেভিড সালেমের চোখেও। তিনি সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিটেও দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি জানেন, ছোট্র ঐ কোড বইটার কত মূল্য। জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নই শুধু নয়, জাতির গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের জীবন ঐ কোড বইটা। ডেভিট সালেম বলল, তুমি সাংঘাতিক খবর শোনালে ডোবিন, শত্রুরা আমাদের কোডের কপি পেয়ে গেলে সর্বনাশ। এমিলিয়াকে আমি ডেকে দিচ্ছি।
বলে ডেভিড সালেম বেয়ারাকে নির্দেশ দিল এমিলিয়াকে ডেকে আনারজন্যে।
অল্পক্ষণ পরেই এমিলিয়া এসে ড্রইং রুমে প্রবেশ করল। লাল লম্বা স্কার্ট পরা, মাথায় রুমাল।
ডেভিড সালেম বলল, এস মা।
ডোবিন এমিলিয়ার দিকে মুখ তুলে হেসে বলল, বস মা, কেমন আছ?
-ভাল। আপনি কেমন আছেন, চাচাজান?
-আছি একরকম, খুব ভাল কি থাকতে পারছি।
এমিলিয়া সোফায় তার পিতার পাশে বসল।
মুহুর্ত কয়েক সবাই চুপচাপ।
নীরবতা ভাঙ্গল প্রথমে এমিলিয়ার পিতাই। বলল, তোমার চাচা ডোবিন তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবে এমি।
বলে ডোবিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কথা শুরু কর ডোবিন।
এমিলিয়া চকিতে একবার পিতার দিকে তাকাল। একটা সন্দেহ, বিশেষ করে ডোবিনকে এভাবে দেখে, তার মনে ঝিলিক দিয়ে গেল। সেই সাথে একটা শংকাও দেখা দিল তার মনে। বোধ হয় চোখে মুখে তার একটা অস্বস্থির ছাপও ফুঠে উঠল।
কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যই। ঘটনার কথা স্মরণ করতে গিয়ে তার হৃদয়ে ভেসে উঠল মাহমুদের মুখ। প্রশান্তিতে ভরে উঠল এমিলিয়ার বুকটা। ওঁর কাজে লাগতে পেরেছে এমিলিয়া এর চেয়ে বড় তৃপ্তি তার কাছে আর কিছু নেই।
ডেভিড সালেমের কথায় ডোবিন একটু নড়ে-চড়ে বসল। একটু সামনে ঝুকে বসে জিজ্ঞেস করল, মা এমিলিয়া তুমি তো স্মার্থার কাছ থেকে কোড ডিসাইফার নিয়েছিলে তাই না? এমিলিয়া শান্তভাবে জবাব দিল, জি, নিয়েছিলাম।
-এনে ক’দিন রেখেছিলে?
-বাসায় আনিনি?
-তাহলে?
-স্মার্থার বাসায়ই আমি ওটা দেখেছি। এমিলিয়ার জবাবে ডেভিড সালেমের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ডেভিড আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কি গোটা বইটা পড়েছিলে?
-হাঁ গোটা বইটাই আমি দেখেছি।
ডোবিন একটু চুপ করে থাকল। তারপর মুখ তুলে তাকাল এমিলিয়ার দিকে। বলল, তুমি কি বইটার ফটো নিয়েছিলে? ডেভিড সালেমেরও স্থির দৃষ্টি এমিলিয়ার দিকে। তার চোখে কিঞ্চিত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার ছাপ।
প্রশ্ন শুনে এমিলিয়ার মুখ একটু নীচু হলো। একটা বিমর্ষতার ছাপ ফুটে উঠল তার চোখে মুখে। বাইরে শান্ত দেখালেও বুকটা তার তোলপাড় করছিল। কি উত্তর দেবে সে? পিতা, দাদার মর্যাদার কথা সে জানে। নিজের জন্য তার কিছু ভয় নেই, কিন্তু তার এ স্বীকৃতিতে পিতার এবং দাদার মান মর্যাদা ধূলায় লুটিয়ে পড়বে, এই কথা তার কাছে খুব বড় হয়ে উঠল। তাহলে সে কি করবে? মিথ্যা কথা বলবে? জ্বলজ্যান্ত মিথ্যা কথা সে বলবে কেমন করে? তার প্রিয়তম মাহমুদের কথা তার মনে পড়ল। এ অবস্থায় সে কি করত? নিশ্চয়ই তার মত নীতি-নিষ্ঠ মানুষের মিথ্যা বলার প্রশ্নই উঠে না। যদি তাই হয় তাহলে তার এমিলিয়া জীবনের ভয়ে, বংশ মর্যাদার ভয়ে মিথ্যা কথা বলবে কি করে? এমিলিয়া মন শক্ত করল, সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। মুখ না তুলেই ধীর কন্ঠে সে বলল, হাঁ আমি ফটো নিয়েছি?
-ফটো নিয়েছো?
ডেভিড সালেম এবং ডোবিন দু’জনের কণ্ঠই আঁৎকে উঠল।
ডেভিড সালেমের চোখে-মুখে একটা কালোছায়া নেমে এসেছে। সে বিস্ময়-বিষ্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে এমিলিয়ার দিকে। যেন তার বিশ্বাস হতে চাইছে না, এমন কন্ঠে সে দ্রুত জিজ্ঞেস করল, সত্যিই বলছ, তুমি ফটো নিয়েছ?
মুখ না তুলেই এমিলিয়া বলল, জি, আব্বা।
ডেভিড সালেম আর কোন কথা জিজ্ঞেস করতে পারল না। যেন ব্যাপারটা বুঝতে এবং আত্মস্থ হতে তার সময় লাগছে।
এই ফাঁকে ডোবিন জিজ্ঞেস করল ফটোগুলো তোমার কাছে এখন আছে?
-না, নেই।
মুহূর্তে উত্তেজনায় মুখটি লাল হয়ে উঠল ডোবিনের। চঞ্চল হয়ে উঠল সালেমের চোখ-মুখও। এমিলিয়া কিন্তু মুখ তোলেনি। যেভাবে সে মুখ নীচু করে বসেছিল, সেভাবেই বসে থাকল।
ডোবিন আবার জিজ্ঞেস করল কোথায় ফটোগুলো? এবার মুখ তুলে স্পষ্ট কন্ঠে এমিলিয়া বলল, মাহমুদ নামের একজন ওগুলো নিয়ে গেছে?
-মাহমুদ! কে সে, কোথায় থাকে? প্রায় চিৎকার করে উঠল ডোবিনের কণ্ঠ।
আমি তার নাম জানি, কোথায় থাকে জানি না।
এবার ডেভিড সালেম জিজ্ঞাসা করল, কেমন করে, কোথায় তোমার সাথে পরিচয়?
উদ্বেগে যেন ভেঙ্গে পড়তে চাইল ডেভিড সালেমের কণ্ঠস্বর।
এমিলিয়া ধীরকন্ঠে জবাব দিল, একটা দুর্ঘটনার সময় উনি আমাকে রক্ষা করেছিলেন। সেই থেকে পরিচয়। কোথায় থাকেন তার কিছুই আমি জানি না।
ডোবিন ডেভিড সালেমের দিকে একটু চেয়ে এমিলিয়ার দিকে ফিরে আবার জিজ্ঞেস করল, মা এমিলিয়া, তুমি বুদ্ধিমতি, তুমি জান ঐ কোড ডিসাইফারটি শত্রুর হাতে পড়লে ইসরাইল রাষ্ট্রের কি সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমরা চাই তার হাত থেকে এই মুহূর্তে ওটা উদ্ধার করি। তুমি তার ঠিকানা দিয়ে আমাদের সাহায্য কর।
চোখে-মুখে এমিলিয়ার একটা অসহায়ত্বের ভাব ফুটে উঠল। বলল, চাচাজান, আমি মিথ্যা কথা বলি না। বলছি, আমি তার ঠিকানা জানিনা।
ভাবছিল ডোবিন মুখ নীচু করে। কিছুপর মাথা তুলে বলল, তার সাথে যোগাযোগ হতো কোথায়, সেটা বলো।
-তার সাথে কোন যোগাযোগ আমি কখনও করিনি। স্পষ্ট কন্ঠে জবাব দিল এমিলিয়া।
মাথা নীচু করে ভাবছিল ডোবিন। কিছুক্ষণ পরে মুখ তুলে ডেভিড সালেমের দিকে চেয়ে বলল, স্যার আপনার সাথে একা কথা বলতে চাই।
ডেভিড সালেমের গোটা মুখমন্ডলটা বিধ্বস্ত, বিমূঢ় ও অসহায়ভাব সেখানে। সে এমিলিয়াকে বলল, মা তুমি একটু ভিতরে যাও।
এমিলিয়া চলে গেলে ডোবিন বলল, বলুন স্যার, এখন কি করণীয়?
-আমিও ভাবছি ডোবিন। কেমন করে এ সর্বনাশ হলো বুঝতে পারছিনা।
-আমার মনে হয় স্যার, এমিলিয়া শত্রু পক্ষের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের জালে জড়িয়ে পড়েছে।
চমকে উঠল ডেভিড সালেম। বলল, তুমি কি এ রকমটাই মনে করছ?
-আমার কাছে এখনও কিছু স্পষ্ট নয় স্যার।
ডোবিন একটু থামল, একটু দ্বিধা করল। তারপর বলল, পরিস্থিতি যতদূর গড়িয়েছে তাতে এমিলিয়াকে একবার আমাদের অফিসে যাওয়া দরকার। সকলে যাতে মূতমাইন হতে পারে এ জন্যে সকলের সামনেই তার জিজ্ঞাসাবাদ হওয়া উচিত।
মনে মনে কেঁপে উঠল ডেভিড সালেম। তার অতি আদরের একমাত্র কন্যাকে যেতে হবে সিনবেথ অফিসে। এ যাওয়ার অর্থ সে বুঝে। বুকটা তার মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু সেই সাথে মনে পড়ল রাষ্ট্রের কথা, ইসরাইলী জনগণের কথা, ইহুদী স্বার্থের কথা। আরো মনে হল, অন্যের ক্ষেত্রে হলে এ পরিস্থিতিতে সে কি করত! বড় অসহায় বোধ করল ডেভিড সালেম। পিতৃমন তার কোন যুক্তিই মানতে চায় না। কিন্তু তার পিতৃস্নেহের কি মূল্য! কে এর মূল্য দিবে! সে কি ডোবিনকে বাধা দিতে পারবে? তার পিতৃত্বের অধিকার দিয়ে রাষ্ট্রের অধিকারকে সে কেমন করে ঠেকিয়ে রাখবে! ডেভিড সালেম ডোবিনের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে বলল, এখনি নিয়ে যেতে চাও?
ডোবিনও ডেভিড সালেমের এই অবস্থার সামনে খুবই বিব্রত বোধ করছিল। বলল, তার আগে স্যার আপনারা এমিলিয়াকে একটু বুঝিয়ে দেখুন। মাহমুদের ঠিকানা জানালে ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়।
আবার কেপেঁ উঠল ডেভিড সালেমের মন। ডোবিনরা এ কঠিন পয়েন্টই ধরবে সে জানে। বলল, ঠিক আছে ডোবিন, তুমি আরেকটু বস।
বলে ডেভিড সালেম ভেতরে চলে গেল।
সালেম চলে গেলে ডোবিন টেলিফোন করল অফিসে। টেলিফোনের ওপার থেকে আইজ্যাক কথা বলে উঠল। ডোবিন বলল, আইজাক খবর খারাপ। পাখি আমাদের হাতছাড়া বলে মনে হচ্ছে। ঘটনার মূল এখন এমিলিয়া। তাকে নিয়ে আসছি।
বিস্মিত আইজাক ওপার থেকে কিছু বলতে চাইল। ডোবিন তাকে বাধা দিয়ে বলল, এখন আর কোন কথা নয়। আসি তারপর।
ডোবিন মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল গাড়ীর পাশে। এমিলিয়া শান্ত ও স্বাভাবিকভাবে হেটে গিয়ে গাড়ীতে উঠল। তার ইচ্ছা হচ্ছিল পিছন ফিরে একবার মাকে দেখে। কিন্তু সাহস পাচ্ছিল না। মায়ের মুখ সে সহ্য করতে পারবে না। হয়ত সে ভেঙ্গে পড়বে শেষ মুহূর্তে, আর লোকে বলবে আমি ভয়ে কেঁদেছি। তার মনে পড়ল পিতা-মাতার কান্নাজড়িত অনুরোধের কথা। আমি যেন মাহমুদের ঠিকানা বলে দিই, বলে দিয়ে নিজেকে রক্ষা করি, পিতা-মাতার মুখ রক্ষা করি। কিন্তু এ অনুরোধ এমিলিয়া রাখবে কি করে? সে তো আসলেই মাহমুদের ঠিকানা জানে না। এখানেই সবচেয়ে বেশী কষ্ট লাগছে এমিলিয়ার। পিতা-মাতা নিশ্চয়ই মনে করছেন আমি সব জানি, কিন্তু বলছি না। কিন্তু কেমন করে সে তাদের বুঝাবে যে, তাদের এমিলিয়া তাদের সাথে মিথ্যা কথা বলেনি।
ডোবিনের গাড়ী এমিলিয়াকে নিয়ে চলে গেল। এমিলিয়ার মা আইরিনা টলতে টলতে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করল। চলে গেল শোবার ঘরে।
ওখানে এমিলিয়ার পিতা ডেভিড সালেম চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। কাঁচের জানালা দিয়ে তার দু’টি চোখ কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল কে জানে।
আইরিনা তার গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। তুমি কোন কিছু বললে না, কেন যেতে দিলে আমার এমিলিয়াকে? কেন কেন, কেন!
ডেভিড সালেম কিছুই বলল না। যেমন বসেছিল তেমনি বসে রইল। ঠিক বোবা মানুষের মত।
আইরিনা ডেভিড সালেমের গা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
ডেভিড সালেম উঠে আইরিনাকে তুলে বলল, ধৈর্য ধর আইরিনা, ইহুদীরা আমরা ইসরাইলের স্বার্থকেই সবার ওপর স্থান দিয়েছি।
-মানি না এ কথা।
-মানতে হবে আইরিনা, ব্যক্তির জন্যে দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেব কেমন করে?
-দেশের স্বার্থ বিকিয়ে দেবার প্রশ্ন কেন, আমার এমিলিয়া নির্দোষ।
-তুমি বললেই তো সবাই একথা বলবে না আইরিনা!
-আমার এমিলিয়া যা জানে সত্য সত্যই সব বলেছে!
-সত্য বলেই তো আরো জড়িয়ে পড়েছে!
আইরিনা আবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠল, না, আমি এসব কিছু বুঝি না। প্রধানমন্ত্রী তোমার পিতার লোক, তাকে তুমি বল, আমার এমিলিয়াকে ফিরিয়ে আন।
ডেভিড সালেম আইরিনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, আমাকে এ অনুরোধ করো না, আমি এ কথা তাকে বলতে পারবো না।
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল আইরিনা। চিৎকার করে বলল, তুমি এত নিষ্ঠুর। তুমি পিতা না? তুমি কি জান না, সিনবেথ কোন নরপশুদের আড্ডা?
বলে কান্না চাপতে চাপতে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল আইরিনা।
চেয়ারে ফিরে এল সালেম। আইরিনার শেষ কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল তার অন্তরে, তুমি পিতা না? তুমি জান না, সিনবেথ কোন নরপশুদের আড্ডা?
অন্তরটা তারও হাহাকার করে উঠল। এমিলিয়ার অসহায় মুখটি ভেসে উঠল তার চোখে। দু’চোখ ফেটে তার নেমে এল অশ্রু, মাথাটা নুয়ে পড়ল টেবিলে। অবরুদ্ধ কান্নার বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাসে কেঁপে উঠতে লাগল তার শরীর।
৫
ইসরাইলের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সার্ভিস ‘সিনবেথ’ -এর নির্যাতন সেল। অন্ধকূপের মত সেলটি। দুই হাতের বেশী প্রশস্ত নয়। পাথুরে দেয়াল। একটি মাত্র লোহার দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। কোন জানালা নেই। বহু উঁচুতে দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে একখণ্ড আলো এসে বিপরীত দিকের দেয়ালে পড়েছে। সেলের ঘুটঘুটে অন্ধকারের বুকে ঐ গোলাকার আলোক খণ্ডকে মনে হচ্ছে যেন কারও দৈত্যাকার রক্ত চক্ষু।
জ্ঞান ফিরে পেয়েছে এমিলিয়া অনেকক্ষণ। সারা গায়ে অসহ্য বেদনা। হাত ও পায়ের আঙ্গুল তীব্র যন্ত্রণায় খসে যাচ্ছে যেন। হাত ও পায়ের আঙ্গুলে সুচ ফুটানোর দুঃসহ স্মৃতি তার সামনে এল। শিউরে উঠল সে। উঃ ! কি সে বর্বরতা !!
কিন্তু সব বেদনা, সব যন্ত্রণা ছাপিয়ে উঠেছে তার তৃষ্ণা গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। তৃষ্ণায় ফেটে যাচ্ছে বুক। যেন এক সাগর পানি হলেও এ তৃষ্ণা মিটবে না। দিন কি রাত বোঝা যাচ্ছে না। কোথা থেকে যেন একটা খট্ খট্ শব্দ কানে এল। ভারী বুট পায়ে কে যেন হেটে যাচ্ছে। তৃষ্ণা অসহ্য হয়ে উঠলো তার। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে। তার মুখ ফেটে চিৎকার বেরুলোঃ পানি, পানি, পানি……।
এই সময় খট্ করে খুলে গেল সেলের লৌহ দরজা। প্রবেশ করল ‘সিনবেথ’-এর আই, ও (Indoor Operation) বিভাগের প্রধান জন স্যামুয়েল। তার সাথে আর একজন লোক। নাম সলোমন। হাতে তার একটি জগ ও একটি গ্লাস।
পানি দেখে উন্মুখ হয়ে উঠল এমিলিয়া। তার চোখের কোণে আশার আলো চিক চিক করে উঠল। এই মুহূর্তে তার কাছে পানির চেয়ে বড় কিছু পৃথিবীতে নেই।
মিঃ স্যামুয়েল দাঁড়িয়েই বললেন, ‘মিস পলিন ফ্রেডম্যান, আপনি কি মনস্থির করতে পেরেছেন?
প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে এমিলিয়া বলল, আমাকে পানি দিন।
-আমি দুঃখিত মিস পলিন, আপনি আমাদের সাহায্য না করলে আমরা কেমন করে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? নির্বিকার কন্ঠে বলল স্যামুয়েল।
-কি সাহায্য আমি করতে পারি? আমি তো বলেছি, সাইমুমের কারও পরিচয় আমি জানি না। কোন ঠিকানা তাদের আমার জানা নেই।
-আপনি তাদের কোন খবর রাখেন না? হাসালেন মিস পলিন।
-বিশ্বাস করুন আমাকে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এমিলিয়া।
-আপনি আমাদের সকলের শ্রদ্ধার পাত্র জাতির অনতম প্রতিষ্ঠাতা মৃত ডেভিড বেনগুরিয়ানের নাতনি। আপনার প্রতি বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা আছে বলেই আপনার কাছ থেকে কথা বের করতে আমাদের এত দেরী হচেছ। কিন্তু আর দেরী আমরা করতে পারি না, আপনি আমাদের বিশ্বাস ও শ্রদ্ধার মর্যাদা রাখেননি।
এমিলিয়া মাথা নীচু করেছিল। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে অবিরাম ধারায় নামছে পানি। সে ধীরে ধীরে চোখ মুছে ফেলল। ভাবল, এদের কাছে অনুগ্রহ ভিক্ষা করে কোন লাভ নেই, কোন কথাই এরা বিশ্বাস করবে না। যত কষ্টই হোক, মৃত্যুর সীমা পেরিয়ে তো আর কিছু ঘটবে না।
মিঃ স্যামুয়েল কিছুহ্মণ থেমে আবার বলল, আপনাকে ভাববার জন্য ১০ মিনিট সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে আপনি আমাদের সহযোগিতা করতে রাজী না হলে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন আপনাকে হতে হবে। তড়িৎ আসনের নাম শুনেছেন নিশ্চয়?
তড়িৎ আসনের কথা শুনতেই আতংকে শিউরে উঠল এমিলিয়ার গোটা দেহ। কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। বলল, ১০ মিনিট কেন ১০ দিন সময় দিলেও আমার ঐ একই কথা মিঃ স্যামুয়েল। আমি যা জানি না তা বলতে পারব না।
কোন কথা না বলে মিঃ জন স্যামুয়েল বের হয়ে গেল। তার সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে গেল পানিওয়ালা সলোমন। এমিলিয়ার চোখে পড়ল, পানিওয়ালা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে মেঝের উপর খানিকটা পানি জমে আছে -ফোঁটা ফোটাঁ করে পড়েছিল জগ থেকে। এমিলিয়া এগিয়ে গেল পানির দিকে এক সমুদ্র তৃষ্ণা নিয়ে। দরজা এই সময় বন্ধ হয়ে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল ঘর। এমিলিয়া হুমড়ি খেয়ে পড়ল পানির উপর। মাটিতে ঠোঁট ঠেকিয়ে শুষে নিল পানিটুকু। গলা জিহ্বা এতে ভিজল বটে কিন্তু আরো তীব্র হয়ে উঠল তৃষ্ণার জ্বালা। মেঝে থেকে পানির শেষ চিহ্নটুকু জিহবা দিয়ে শুষে নিয়ে কান্নায় লুটিয়ে পড়ল এমিলিয়া। অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল সে। মনে পড়ল মাহমুদের কথা। সে কি জানতে পেরেছে তার এই অবস্থা। সে কি আর কোন দিন বেরুতে পারবে এই মৃত্যুপুরী থেকে? দেখতে পাবে কি আর মাহমুদকে?
বাইরে ভারি বুটের শব্দ হল। তালা খোলার শব্দ শোনা গেল। তারপর খট্ করে খুলে গেল দরজা। প্রবেশ করল সেই মিঃ জন স্যামুয়েল। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকল আরও দু’জন। মিঃ স্যামুয়েল একই ধরনের প্রশ্ন পুনরায় আওড়ালো। আপনি কি মন স্থির করতে পেরেছেন মিস পলিন?
এমিলিয়া এই নিরর্থক প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। মিঃ জন স্যামুয়েল পুনরায় বলল, চরম পথ বেছে নিতে আমাদেরকে আপনিই বাধ্য করলেন মিস পলিন।
-যে পথই আপনারা গ্রহণ করুন, যা জানা নেই, তা আপনারা বের করতে পারবেন না। বলল এমিলিয়া।
-এ রকম কথা আমরা বহু শুনেছি, বহু জনের কাছে। কিন্তু শেষে বলতে তারা বাধ্য হয়েছে। বলে একটু থেমে দরজায় দাঁড়ানো দু’জনকে বলল, একে নিয়ে চল অপারেশন রুমে। বলে সে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
লোক দু’টি ঘরে ঢুকতেই এমিলিয়া অতি কষ্টে স্বেচ্ছায় উঠে দাঁড়ালো। দরজার সামনে রাখা স্ট্রেচারে শুয়ে পড়ল সে। লোক দু’জন ধরাধরি করে নিয়ে চলল স্ট্রেচার।
বাইরের খোলা বাতাস বুক ভরে গ্রহণ করল এমিলিয়া। কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তা সে জানে। এক মহা আতংক এসে তার বুকে চেপে বসতে চাইছে। মনকে হালকা করতে চাইল সে। তাকে লম্বা বারান্দা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বারান্দার পাশ দিয়ে এক ফালি নীল আকাশ দেখা যাচ্ছে। নীশ আকাশের বুকে একখন্ড সাদা মেঘ কোন অজানার পথে পাড়ি জমিয়েছে। বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠল এমিলিয়ার বুক। হায়রে মুক্ত জীবন।
হঠাৎ নীল আকাশ কোথায় হারিয়ে গেল। তাকে প্রবেশ করানো হলো একটি ঘরে, সে ঘর থেকে আর একটি ঘর। এ ঘর থেকে একটি সংকীর্ণ সিঁড়ি নেমে গেছে ভূগর্ভে। ভূগর্ভের সিঁড়ি দিয়ে এমিলিয়াকে নিয়ে পৌঁছানো হলো একটি প্রশস্ত কক্ষে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিতি ছিল মিঃ জন স্যামুয়েল এবং আরও দু’জন লোক। স্ট্রেচার সমেত এমিলিয়াকে রেখে বাহকরা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঘরটি। আসবাব বাহুল্য নেই। চারদিকে পাথরের দেয়াল। উত্তর দিকের দেয়ালে লোহার গরাদে ঢাকা একটি স্থান। মনে হলো জানালা। ঘরের ঠিক মাঝখানে কয়েক ইঞ্চি উঁচু একটি বেদীর উপর লম্বা ও সুদৃঢ় একটি কাঠের পাটাতন। পাটাতনের দু’পাশ থেকে দু’টি করে চামড়ার মোটা বেল্ট বের হয়ে এসেছে। পাটাতনের উপর পড়ে আছে একটি ইলেকট্রিক ম্যাগনেটো। জ্বলজ্বল করছে তার উপর সাদা দু’টি বোতাম। পাশেই সুইচ বোর্ড। ওদিকে একবার চেয়েই বুঝতে পালো-সেটা কি। এমিলিয়ার প্রতিটি স্নায়ুতন্ত্রী, প্রতিটি রক্ত কণিকায় যন্ত্রণার উষ্ণ স্রোত বয়ে গেল। সে মন শক্ত করতে চেষ্টা করল, মৃত্যুর পরপারে তো আর এ যন্ত্রণা পৌঁছবে না।
এই সময় মিঃ স্যামুয়েল এমিলিয়ার দিকে চেয়ে বলল, ‘সময় আছে এখনও মিস পলিন। আপনি সচেতন, আপনি শিক্ষিতা। আপনার সামনে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক কষ্টের মধ্যে দিয়ে তিলে তিলে মৃত্যু, আর ক্ষমা এবং সুখ স্বাচ্ছন্দপূর্ণ জীবন। আপনি কোনটি করবেন, আপনিই ভেবে দেখুন।
এমিলিয়া মিঃ স্যামুয়েলের দিকে চেয়ে স্পষ্ট কন্ঠে বলল, সাইমুমের লোকজনদের পরিচয় ঠিকানা জানলেও আমি বলতাম কি না জানি না, তবে আমি আগেও বলেছি আবার বলছি তাদের কারও পরিচয়, ঠিকানা আমি জানি না।
সাপের মত ঠান্ডা এক হাসি টেনে নিরুত্তাপ স্বরে বলল মিঃ স্যামুয়েল, ‘আমি তা জানি মিস পলিন। আমাদের আগেই বোঝা উচিত ছিল, আজকাল মেয়ে স্পাইরাই সবচেয়ে কঠিন হয়ে থাকে গত দু’দিনের অভিজ্ঞতায় আপনাকে দিয়েই এ বোধটা আমাদের মনে নতুন করে জাগল।’ বলে সে উঠে দাঁড়ালো।
উঠে গরাদ-ঢাকা সেই স্থানটিতে গিয়ে দাঁড়াল। একটি ছোট্ট হাতল ঘুরিয়ে গরাদ খুলে ফেলল। উন্মুক্ত হল একটি জানালা পথ। সে এমিলিয়ার দিকে চেয়ে বলল, আসুন মিস পলিন, দেখুন।
যন্ত্র-চালিতের মত উঠে গিয়ে স্যামুয়েলের পাশে দাঁড়াল এমিলিয়া। স্যামুয়েল জানালার পাশে একটা বোতামে চাপ দিল। অমনি জানালার বাইরের অন্ধকার সরে গেল। জানালার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া সুগভীর পয়ঃপ্রণালী স্পষ্ট হয়ে উঠল। পয়ঃপ্রণালীর দু’পাশ দিয়ে প্রশস্ত করিডোর। মিঃ স্যামুয়েল সামনের করিডোরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘চেয়ে দেখুন।’
এমিলিয়া তাঁর ইঙ্গিত অনুসরণ করে চেয়ে দেখল, নরমুন্ডের বিরাট স্তুপ।
স্যামুয়েল বলল, আমরা এই কক্ষে সহজে কাউকে আনি না। কেউ আসলে সে আর ফিরে যায় না। ঐ নরমুন্ডের স্তুপই তার প্রমান। তড়িৎ আসন ব্যর্থ হলে ঐ নরমুন্ডের মিছিলে তার স্থান।
এমন দৃশ্যের সম্মুখীন হলে আগে সে হয়ত ভয়ে ভিমরি খেয়ে যেতো, কিন্তু আজ তার সে অবস্থা নেই। অনুভূতি তার যেন ভোঁতা হয়ে গেছে। কোন উত্তর দিল না সে মিঃ স্যামুয়েলের কথার।
মিঃ স্যামুয়েল জানালা বন্ধ করে দিল। তারপর যন্ত্রের মত দাঁড়ানো লোক দু’জন একজনকে সম্বোধন করে বলল, ‘আইজাক, অধিবেশনের কাজ শুরু কর’ বলে সে ঘরের চেয়ারটিতে গিয়ে বসল।
এমিলিয়ার দিকে এগিয়ে এল আইজাক। কেঁপে উঠল এমিলিয়ার বুক। আইজাকের ইঙ্গিতে যন্ত্রচালিতের মত শুয়ে পড়ল এমিলিয়া পাটাতনের উপর। থর থর করে কাঁপছে গোটা শরীর। গলা-জিহ্বা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। প্রকট হয়ে উঠল বুক-ফাটা তৃষ্ণা। এমিলিয়া স্থির করেছিল, কোন অনুরোধ কাউকে করবে না সে। কিন্তু পারল না। মুখ থেকে আপনিই বেরিয়ে গেল পানি, পানি দাও।
দু’পাশ থেকে চামড়ার বেল্ট শক্ত করে বেঁধে ফেলেছিল এমিলিয়াকে। শরীরটা পাটাতনের সাথে এক হয়ে গেছে, নড়বার শক্তি ছিল না এতটুকুও। চেয়ারে বসেই কথা ছুঁড়ে মারল স্যামুয়েল, সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত মিস পলিন।
এমিলিয়ার দু’চোখ থেকে কানের দু’পাশ দিয়ে নেমে এল অশ্রুর দু’টি ধারা। তার শুকনো জিহ্বা আর শুকনো ঠোঁট থেকে অষ্ফুটে বেরুলো, আল্লাহ, তুমি সর্বশক্তিমান সবার উপর ক্ষমতাশালী তুমি।
এমিলিয়ার মুখে গুঁজে দেয়া হলো বড় একটি কাপড়। তার কিছু অংশ পোটলা হয়ে মুখের ভিতরে থাকলো, কিছু অংশ থাকলো বাইরে।
সকল প্রস্তুতি শেষ করে ইলেকট্রিক ম্যাগনেটোর সাথে কানেকশন নেয়া হলো সুইচ বোর্ডের। অন করল সুইচ। আইজাক ছোট্ট করে চাপ দিল ম্যাগনেটোর একটি বোতামে। গোটা দেহ হঠাৎ খিচুনী দিয়ে উঠলো এমিলিয়ার। অষ্ফুট গোঙ্গানী বেরুলো মুখ থেকে। চোখ দু’টি তার বিষ্ফোরিত হলো। বোতাম থেকে হাত উঠিয়ে নিল আইজাক।
দেহের খিচুনী থেমে গেল। কিন্তু গোঙ্গানী থামল না। হাঁপাচ্ছে এমিলিয়া। তার ঠোঁট কাঁপছে, চোখের পাতা কাঁপছে, থর থর করে কাঁপছে তার গোটা দেহ।
এবার বোতামে চাপ দিল আইজাক। আবার শুরু হলো সেই খিচুনী, ফুলে ফুলে উঠছে গোটা শরীর। চোখ দু’টি বিষ্ফোরিত হয়ে বের হয়ে আসছে যেন। চামড়ার বেল্ট কেটে বসে যাচ্ছে শরীরে।
এমিলিয়ার শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে যন্ত্রণার এক ভয়াবহ আগুন। প্রতিটি মাংসপেশীর প্রতিটি কণিকাকে যেন কেটে কেটে পৃথক করে দিচ্ছে, আর সেই কণিকাগুলোকে ঝাঝরা করে দিচ্ছে আগুনের অসংখ্য সূঁচ।
চোখের প্রতিটি মাংস কণিকা যেন খন্ড খন্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। সর্বশক্তি দিয়ে কামড়ে ধরেছে মুখে গুঁজে দেয়া কাপড়। দাঁতগুলো কেটে বসে গেছে কাপড়ে। অসহ্য যন্ত্রণা চেতনার প্রান্তসীমায় নিয়ে গেল এমিলিয়াকে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলল সে।
সিনবেথ হেড কোয়ার্টারের বেয়ারা সলোমন। আজ পচিঁশ বছর হলো আছে সে এই চাকুরীতে। বয়স তার এখন পঞ্চাশ। জীবনের পঁচিশ বছর সে কাটিয়েছে বীরশিবায়। বীরশিবা তার জন্মস্থান।
তৃষ্ণার্ত এমিলিয়াকে পেছনে রেখে যখন সে সেল থেকে বের হয়ে আসছিল তখন তার মন গিয়ে পড়েছিল বীরশিবায়। তার চোখে ভেসে উঠেছিল এমনি একটি দৃশ্য। প্রায় পঁচিশ ছাব্বিশ বছর আগের কথা। বীরশিবা তখন একটি সমৃদ্ধ মুসলিম জনপদ। মুসলিম মহল্লারই একপ্রান্তে ছিল সলোমনদের বাড়ী। তারই ছিল বীরশিবার একমাত্র ইহুদী পরিবার। সুখে দুঃখে একাত্ম হয়েছিল তারা মুসলমানদের সাথে। হঠাৎ ওলট-পালট হয়ে গেল সব। দলে দলে এল ইহুদী। কেউ রাশিয়ার, কেউ জার্মানীর, কেউ আমেরিকার। উচ্ছেদ করা হলো মুসলমানদের। সে কি নির্মম দৃশ্য। মুমূর্ষ মানুষের কত করুণ আকুতি সে দেখেছে। মনে পড়ে সলোমনের এমনি একজন প্রতিবেশী মুমূর্ষ মানুষের মুখে পানি তুলে দিতে গিয়ে নবাগত মারমুখো ইহুদীদের হাতে সে কেমনভাবে লাঞ্চিত হয়েছিল। তার চোখের সামনেই বুক ভরা পিপাসা নিয়ে তার মুমূর্ষ প্রতিবেশী চিরতরে চোখ মুদেছিল। আজ পিপাসাকাতর এমিলিয়ার মুখ দেখবার পর তারই কথা মনে হচ্ছিল সলোমনের। সলোমন রাজনীতি করে না, রাজনীতি বোঝে না। সকল নির্যাতনের বিরোধী সে। সাধ্য থাকলে ওই ফুলের মত মেয়েটিকে সে এদের হাত থেকে বাঁচাতো। সে জানে মেঝেতে ফেলা ঐ কয়েক ফোঁটা পানি এমিলিয়ার তৃষ্ণা মেটাতে পারবে না, তবু মনকে প্রবোধ দেয়ার জন্যই সে তা করেছিল।
বারটায় ডিউটি শেষে যখন সে অফিস থেকে বেরুচ্ছিল, তখন এমিলিয়ার চিন্তা তার সারা মন জুড়ে ছিল। ডেভিড বেনগুরিয়ানের মত লোকের নাতনি কি-ই বা এমন অপরাধ করেছে। অপারেশন রুমে মেয়েটি নির্ঘাত নরপশুদের অত্যাচারে মারা পড়বে।
মরদেশাই রোডের এক বাড়ীতে বাস করে সলোমন। তার বাড়ীর পাশেই একটি ফলের দোকান। দোকানের মালিক বৃদ্ধ খলিল শেখ। সলোমনের বন্ধু। বৃদ্ধ খলিলের বাড়ী ছিল জেরুজালেমের নিকট বিরসুবিরে। তার শশুর বাড়ী ছিল বীরশিবায়। সে যেত মাঝে মাঝে সেখানে। সেই থেকেই তার সাথে সলোমনের পরিচয়। সলোমন তার অবসর সময়ের অধিকাংশই খলিলের দোকানে আড্ডা দিয়ে কাটায়। সলোমন ফিলিস্তিনে বহিরাগত ইহুদীদের বাড়াবাড়ি কোন দিনই পছন্দ করতে পারেনি। এ বিষয়ে দু’জনের মধ্যে পূর্ণ ঐক্যমত রয়েছে। এ নিয়ে কত আলোচনা আর কত অভিজ্ঞতা বিনিময় হয় দু’জনার মধ্যে। বহিরাগত ইহুদীদের বিরুদ্ধে সলোমনের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো, “ওরা বাইরে থেকে উড়ে এসে দেশের সমস্ত বড় বড় চাকুরী ও সম্পদ-সম্পত্তিতে জুড়ে বসেছে, আর মুষ্টিমেয় স্থানীয় ইহুদীরা চাপরাশী, কেরানী ও মুটে-মজুরের জীবন যাপন করছে।”
এ দিনও সলোমন অফিস থেকে ফিরে খাওয়া সেরে খলিলের ফলের দোকানে গিয়ে দেখা দিল। সলোমনকে দেখেই খলিল আগ বাড়িয়ে বলল, এস, এস, কেমন আছ?
-আর থাকা! মন বড় ভাল লাগছে না।
-কেন, কিছু হয়েছে বাড়ীতে? উদ্বিগ্ন খলিল।
-বাড়ীতে আর কি হবে, ঐ অফিসের কথাই বলছি!
-অফিসে আবার তোমার কি হলো?
-আমার আবার কি হবে? রোজ রোজ কি ঐসব দেখা যায়। আজ আবার বেনগুরিয়ানের নাতনিটিকে ধরে নিয়ে গেছে। এতটুকু এক মেয়ের উপর উঃ! কি অত্যাচার !! দু’দিন থেকে মেয়েটাকে পানিও খেতে দেয়নি।
সলোমনের কথা শুনে চমকে উঠলো খলিল। কিন্তু সামলে নিল নিজেকে। স্বাভাবিক কন্ঠে বলল, খুব মায়া হচ্ছে না?
-মায়া! সাধ্য থাকলে মেয়েটাকে নরপশুদের হাত থেকে ছিনিয়ে আনতাম।
-মানুষের অসাধ্য কিছু আছে নাকি? হেসে বলল খলিল।
-অসাধ্য কিছু নেই। আমিও তা জানি। আমিও পারি, বাঁচাতে পারি মেয়েটাকে। কিন্তু কি লাভ হবে তাতে? সিনবেথের হাত থেকে পরে সেও বাঁচবে না, আমিও বাঁচব না।
মনে মনে অধীর হয়ে উঠেছে, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে খলিল। তবু শান্ত কন্ঠে সে বলল, তা ঠিক বলেছ। অর্থহীন ঝুঁকি নিয়ে কি লাভ?
এইভাবে খলিল ও সলোমনের মধ্যে গল্পের যে শুরু হলো, তা প্রতিদিনের রীতিমত নিরবচ্ছিন্নভাবে চল্লই কিন্তু প্রতিদিনের মত খলিল গল্পে মন বসাতে পারছিল না। এক সময় সে বলল, সলোমন তুমি বস, খবরের কাগজগুলো দেখ। আমি মিনিট পনের পর আসছি।
সলোমন বলল, আমিও উঠি খলিল, একটু স্টেডিয়ামের দিকে যাব। বেশ ভাল খেলা আছে আজ। বলত, তোমার টিকিটও কেটে রাখব।
খলিল বলল, আজ বোধ হয় সময় পাব না সলোমন।
সলোমন উঠে যেতেই খলিল ভিতরে ঢুকে গেল। পার্শ্বের ঘরে বসার একটি বেদী উল্টিয়ে একটি গোপন সিঁড়ি পথ ধরে নীচে নেমে গেল সে। খলিল সাইমুমের তেলআবিবস্থ ৪নং ঘটির একজন দায়িত্বশীল ব্যাক্তি। ওয়াজম্যান রোডের ৪নং ঘাটির সাথে একটি গোপন সুড়ঙ্গ দ্বারা সংযুক্ত। মরদেশাই রোডের এই ফলের দোকানের পরিচালনার ভার তারই হাতে রয়েছে।
গ্রীণ লজ। তার একটি কক্ষে পা এলিয়ে বসে ছিল মাহমুদ। সামনে জানালা দিয়ে জলপাই গাছের মাথার ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে একখন্ড নীল আকাশ। ঘন সবুজ জলপাই গাছের মাথায় যেন নীলের প্রলেপ।
কিন্তু কিছুতেই মন নেই মাহমুদের। কাল রাত থেকে সে ভাবছে। ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে সে এক অসহ্য যন্ত্রণায়। কিন্তু এ যন্ত্রণা কাউকে জানানোর নয়। এমিলিয়াকে সে ভালবাসে। এ ভালবাসাই তাকে দুর্বল করে দিচ্ছে, শুষে নিচ্ছে শক্তি ও উদ্যম। ইসরাইলী বর্বরতার হাত থেকে ওকে বের করে আনতে হলে ঝুঁকি নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু তার এমিলিয়ার জন্য সহকর্মীদের মূল্যবান জীবনকে সে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে কেন?
তেলআবিবের সকল সাইমুম-সদস্যদের মধ্যেও এসেছে ভাবান্তর। এমিলিয়ার ঘটনা সকলের মনকেই পীড়া দিচ্ছে। তারা সকলেই অপেক্ষা করছে নির্দেশের, কিন্তু পাথরের মত নীরব-নিস্পন্দ মাহমুদের কাছ থেকে কোন সাড়া তারা পায়নি।
চিন্তার অথৈ স্রোতে ডুবে গিয়েছিল মাহমুদ। পায়ের শব্দে চমকে দরজার দিকে চোখ ফিরালো সে। দেখল, রায়হান ঘরে ঢুকছে। রায়হানকে দেখে সোজা হয়ে বসে মাহমুদ বলল, কোন মেসেজ রায়হান?
-হেড কোয়ার্টার থেকে আপনার কল, মুসা ভাই কথা বলবেন।
লাফ দিয়ে উঠল মাহমুদ। খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে আহমদ মুসা লাইনে আসে না, মেসেজ পাঠায়। মাহমুদ দ্রুত রেডিও রুমে চলল।
সালাম বিনিময়ের পর প্রথমেই জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা, এমিলিয়ার খবর কি?
-পরবর্তী কোন খবর আর পাইনি।
-কোথায় রেখেছে তাকে?
-বোধ হয় কারাগারে।
-বোধ হয় কেন? এ খবরটুকুও নেওনি?
মাহমুদ নীরব। কি জবাব দেবে সে? কি বোঝাবে, কেমন করে সে বোঝাবে আহমদ মুসাকে। আহমদ মুসা বোধ হয় আঁচ করতে পারল মাহমুদের অবস্থা। সেও আনমনা হয়ে পড়ল। অনেক আগে ফেলে আসা এক অতীতে হারিয়ে গেল সে। হিমালয়ের এক অন্ধকার গুহায় ফেলে আসা ফারজানার মুখটি অনেকদিন পর আজ তার চোখে ভেসে উঠল। আহমদ মুসা ধীর স্বরে ডাকল, মাহমুদ!
-জি! উত্তর দিল মাহমুদ।
-তোমার দুর্বলতা ঢাকতে গিয়ে, একটি জীবনকে তুমি এক অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবে, তা তো আমি ধারণা করতে পারিনি। তুমি কি জান না, ইসরাইলের Indoor Operation-এর শয়তানরা কত নরপশু।
কেঁপে উঠলো মাহমুদ। তার গোটা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল অসহ্য এক যন্ত্রণা। কোন জবাব দিতে পারল না সে।
আহমদ মুসা আবার বলল, শোন আমার নির্দেশ, যে কোন মূল্যে এমিলিয়াকে বাঁচাতে হবে। সে আমাদেরই একজন। তার প্রতি আমাদের দায়িত্ব আছে। আমাদের জন্য সে যা করেছে, তা আমরা কেউই ভুলতে পারিনা।
আপনার আদেশ আমরা পালন করব জনাব। ধীর কন্ঠে বলল মাহমুদ। তার চোখে মুখে দৃঢ় সংকল্পের ছাপ।
-আর শোন, আগামী ২৫শে ফেব্রুয়ারী মিসর, সিরিয়া, জর্দান ও লেবাননের সঙ্গে ইসরাইলের শান্তি-চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে। আর ২৭ শে ফেব্রুয়ারী ইসরাইলের ‘সাবাত দিবস’। আজ থেকে ঠিক ১ মাস ১ দিন পর। ইনশাআল্লাহ ঐ দিনটিই হবে ইসরাইল রাষ্ট্রের শেষ আনন্দের দিন। আমি ১১ ই ফেব্রুয়ারী ইসরাইলের শেষ কৃত্যের জন্য তেলআবিব আসছি।
মাহমুদ রেডিও রুম থেকে বেরিয়ে ঘরে প্রবেশ করে দেখে শেখ জামাল বসে আছে।
-কি সংবাদ জামাল? মাহমুদ বলল।
-এইমাত্র কিছু খবর খলিলের কাছ থেকে পাওয়া গেল।
-কি খবর?
-মিস্ এমিলিয়াকে আজ সকালে সিনবেথের অপারেশন চেম্বারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত দু’দিন তাঁর উপর নির্মম অত্যাচার চলেছে, পানিও খেতে দেয়া হয়নি।
-হুঁ! দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে একটি ছোট্ট জবাব দিল মাহমুদ। এক ঘন্টা সময় আছে, যাও প্রস্তুত হও। শেখ জামাল বেরিয়ে গেল।
৬
মাহমুদ তেলআবিব শহরের মিউনিসিপ্যাল মানচিত্র সামনে নিয়ে গভীরভাবে ভাবছিল।
সুরক্ষিত সিনবেথের অফিস। দক্ষিণ-উত্তর বিলম্বিত হারজেল এভিনিউ থেকে একটা সরু রাস্তা এগিয়ে গেছে পশ্চিমে। এ পথ ধরে শ’ দুয়েক গজ এগুলেই নাম-সাইনবোর্ডহীন সিনবেথ অফিসের কারাগার সদৃশ্য প্রধান ফটকে পৌঁছা যায়। সরু রাস্তাটির দু’ধারের বিল্ডিংগুলো নিয়ে আধা সামরিক সিকুউরিটি মিলিশিয়াদের গেরিলা ইউনিটের অফিস। এছাড়া সিনবেথ অফিসের চার দিক ঘিরে মিনিষ্ট্রি অব হোমের নানা বিভাগের অফিস যাকে ডবল প্রটেকটেড এলাকা হিসেবে গণ্য করা হয়।
মাহমুদের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিয়েছিল। ভেবে পাচ্ছিল না সে এমিলিয়াকে উদ্ধারের পথ কি! রীতিমত যুদ্ধ ছাড়া সিনবেথ অফিসে ঢোকা এবং বের হওয়া অসম্ভব।
অন্য কোন পথ? অন্য পথ আর কি, হেলিকপ্টার নিয়ে সিনবেথ অফিসে গিয়ে হাজির হওয়া।
মাটির তলের কথা মনে হতেই বহুদিন আগে পড়া একটা নিইজের কথা তার মনে পড়ল। চাঞ্চল্যকর খবরটি ছিল দু’টি লাশ নিয়ে। বর্ষাকালে হারজেল এভিনিই-এর ড্রেন পরিষ্কার করার সময় দু’টি লাশ পাওয়া যায়। লাশ দু’টির ফটো বেরোয় পত্রিকায়। অকথ্য শারিরীক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল তাদের শরীরে। খবরের কাগজের অনুসন্ধান রিপোর্টে বলা হয়েছিল, দু’সপ্তাহ আগে সিনবেথ লোক দু’টিকে গ্রেপ্তার করে। সিনবেথের নির্যাতনেই তারা মারা যায়। মারা যাবার পর তাদের লাশ ড্রেনে ফেলে দেয়। খবরে উল্লেখ করা হয়, এভাবে লোক হত্যা করে সিনবেথের ভুগর্ভস্থ টর্চার চেম্বার সংলগ্ন ড্রেনে লাশ ফেলে দেয়া সিনবেথের একটা পুরোনো অভ্যাস।
খবরটি মনে পড়ার সাথে সাথে মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল মাহমুদের। মিউনিসিপ্যাল মানচিত্রের উপর আবার সে ঝুঁকে পড়ল।
মানচিত্রে হেড ড্রেনগুলোকে কালো এবং শাখা ও প্রশাখা ড্রেনগুলোকে নীল ও সবুজ লাইন দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে লক্ষ্য করল, একটি গভীর কালো রেখা হারজেল রোডের পশ্চিম পাশ দিয়ে সমান্তরালভাবে এগিয়ে গেছে। সে মেপে দেখল, হেড ড্রেনটি সিনবেথ অফিস ক্রস করে এগিয়ে গেছে। তার চোখ দু’টি আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সিনবেথের ভূগর্ভস্থ টর্চার চেম্বারের সাথে তাহলে এই ড্রেনেরই একটা সংযোগ রয়েছে।
মাহমুদ নতুন এই ব্যাপারটা নিয়ে একটু চিন্তা করল। ভাবল, এই ড্রেনের পথ ধরে সিনবেথের টর্চার চেম্বারে পৌঁছা যায় কি না। গভীর চিন্তায় কপালটা তার কুঞ্চিত হলো, চোখ দু’টিও বন্ধ হয়ে এল।
একটু পরে উঠে গিয়ে লাইব্রেরী থেকে তেলআবিব শহরের ‘ওয়াটার এন্ড সুয়ারেজ’ ডায়াগ্রাম নিয়ে এল সে। ‘সুয়ারেজ ডায়াগ্রামটা’ বিস্তারিত। এতে ড্রেনগুলোর আয়তন এবং ম্যানহোলগুলোর অবয়বই সুন্দরভাবে চিহ্নিত আছে। মাহমুদ দেখল, সিনবেথ অফিসের কাছাকাছি সবচেয়ে সুবিধাজনক হল ডেভিড পার্কের ম্যানহোলটা। পার্কের বহির্দেয়ালের প্রায় গজ পাচেক ভেতরে বিরাট জলপাই গাছের তলে এই ম্যানহোল। আশে-পাশে আরও ঝাও গাছ আছে, ফুল গাছ আছে। একেবারে নির্জন জায়গা। পার্কের প্রহরীদের উপর নজর রাখতে পারলে এ ম্যানহোল নিরাপদেই ব্যবহার করা যায়।
এরপর মাহমুদ ‘ডেভেলপমেন্ট অব সুয়ারেজ সিস্টেম’ বইটা এনে তার উপর চোখ বুলাল। তেলআবিব লন্ডন নগরীর সুয়ারেজ সিস্টেমকেই অনুসরণ করেছে। এ সিস্টেম অনুসারে প্রশাখা ড্রেনগুলো ছাড়া হেড ও শাখা ড্রেনগুলোতে ড্রেন-বলয়ের দু’পাশে করিডোর থাকে। দু’করিডোরের মাঝখানে নালা দিয়ে বয়ে যায় ময়লার প্রবাহ। ড্রেনগুলোর সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কার সুবিধার জন্যেই এই ব্যবস্থা। হেড ড্রেনগুলোর করিডোর দিয়ে খুব স্বচ্ছন্দেই মানুষ হেটে বেড়াতে পারে।
ওয়াটার সুয়ারেজ ডায়াগ্রাম হাতে নিয়েই মাহমুদ লাইব্রেরী রুম থেকে বেরিয়ে অফিসে এসে বসল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সন্ধ্যা ৬ টা।
টেলিফোন তুলে মাহমুদ আসলামকে বলল, শেখ জামালকে তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও।
মুহূর্ত কয়েক পরে শেখ জামাল এসে ঘরে ঢুকল। মাহমুদ তাকে বসতে ইঙ্গিত করে বলল, হারজেল এভিনিউ-এর সমান্তরালে বয়ে চলা ২নং হেড ড্রেন সিনবেথ অফিসকে ক্রস করেছে। আমরা এই ড্রেনের পথেই সিনবেথ হেড কোয়ার্টার প্রবেশ করব।
থামল মাহমুদ। চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল শেখ জামালের।
মাহমুদই আবার কথা বলল। বলল যে, আমরা যদি ডেভিড পার্কের নির্জন কোণের ম্যানহোলটি ব্যবহার করি, তাহলে আধা মাইল গিয়েই আমরা পাব ‘সিনবেথ হেড কোয়ার্টার।
একটু থামল মাহমুদ। তারপর বলল, সব কিছু ঠিক ঠাক করগে। আমরা রাত ৯ টায় প্রবেশ করব ২ নং হেড ড্রেনে। আসলাম ও যায়েদ রিয়ার গার্ড হিসেবে ডেভিড পার্কের ঐ ম্যানহোল পাহারায় থাকবে। আর জন দশ বারো জন লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখবে পার্কের আশে-পাশে। রাত দশটায় আমাদের পরিবহন ইউনিটের সালেম ও সুলাইমান দু’টো গাড়ী নিয়ে ডেভিড পার্কে যাবে।
মাহমুদ চুপ করল।
শেখ জামাল সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
শেখ জামাল বেরিয়ে গেলে মাহমুদ আবার সেই সুয়ারেজ ডায়াগ্রাম নিয়ে বসল। সিনবেথ হেড কোয়ার্টারের অবস্থান থেকে ডেভিড পার্কের ম্যানহোল পর্যন্ত দুরত্ব সে কম্পাস দিয়ে মাপল। মোট দুরত্ব হল এগার শ’ চল্লিশ গজ। মাহমুদ টেলিফোনে আসলামকে জিজ্ঞেস করল, সর্বোচ্চ কত বড় টেপ আমাদের আছে আসলাম? আসলাম বলল, ১৭৬০ গজ।
মাহমুদের মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠল। বলল, ঠিক আছে।
বিভিন্ন সরঞ্জাম ভর্তি ব্যাগ গলায় ঝুলিয়ে গ্যাসমাস্ক পরে দড়ির মই বেয়ে ম্যানহোল দিয়ে প্রথম নামল মাহমুদ। অনেক ভেবে চিন্তে মাহমুদ বাম অর্থাৎ ড্রেনের পূর্বধারের করিডোরে নামারই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হারজেল এভিনিউ থেকে সিনবেথ অফিস এবং ড্রেনের দুরত্বের হিসেবে সিনবেথ অফিস ড্রেনের পূর্বধারেই পড়বে।
টর্চ জ্বেলে পূর্বপাশের করিডোরটা দেখে দড়ির মই থেকে করিডোরে পা রাখল মাহমুদ। টর্চের আলোতে কয়েকটা বড় ধরনের ইদুর ও মাকড়সা ছুটে পালাল। মাকড়সাগুলোর বিপুল বপু দেখে আঁৎকে উঠল সে। রক্তপায়ী মাকড়সার কথা মহমুদ পড়েছে, কিন্তু তারাতো ফিলিস্তিনে থাকে না।
মাহমুদ নামার পর শেখ জামালও নেমে এল দড়ির মই বেয়ে।
শেখ জামাল নেমে আসার পর দড়ির মই-এর সাথে টেপের এক মাথাকে বেধে দিল মাহমুদ। ১৭৬০ গজ দীর্ঘ টেপ থেকে সে ১১শ’ ৪০ গজ কেটে নিয়ে এসেছে যাতে করে ড্রেনে নেমে সিনবেথ অফিসের লোকেশন নিয়ে মাথা ঘামাতে না হয়। টেপ যেখানে গিয়ে শেষ হবে সেটাই হবে মোটামুটিভাবে সিনবেথ অফিসের লোকেশন।
টর্চ জ্বেলে তারা দক্ষিণ দিকে চলতে শুরু করল। হাতঘড়ির সাথে ফিট করা দিক নির্দেশক কম্পাসের দিকে চেয়ে দেখল তারা ঠিক দক্ষিণ দিকেই চলছে।
মাহমুদ আগে চলছে। শেখ জামাল তার পিছনে। টর্চের আলো এবং সেই সাথে মানুষের পদশব্দে নানা ধরনের পোকা মাকড় ছুটে পালিয়ে তাদের পথ করে দিচ্ছে। করিডোরের অল্প নীচ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে নর্দমা।
‘সাপ সাপ’ বলে চিৎকার করে উঠে শেখ জামাল প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাহমুদের গায়ের উপর। টর্চ পিছনে ফিরিয়ে মাহমুদ দেখল, প্রায় ৫ গজ একটি উদ্যতফণা সাপ ছুটে আসতে আসতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল।
মাহমুদ সাইলেন্সার লাগানো রিভলভারটা তুলে ধীরে সুস্থে একটা গুলী করল। সাপটি ঝপ করে পড়ে গেল নর্দমায়।
মাহমুদ শেখ জামালকে বলল, তুমি টর্চ জ্বালিয়ে পিছনে ফিরে ধীরে ধীরে এস। তুমি পিছনটা দেখবে, আমি সামনে।
ধীরে ধীরে চলছিল তারা। হঠাৎ টেপে টান পড়ায় থামল থমকে দাড়াল মাহমুদ। বুকে ঝুলানো ব্যাগে হাত দিয়ে দেখল টেপ শেষ। তাহলে কি তারা সিনবেথের লোকেশনে পৌঁছে গেছে? ঘড়ির দিকে তাকাল মাহমুদ। দেখল ৯টা ৪০ মিনিট। ৪০ মিনিট লেগেছে তাদের ১১শ’ গজ আসতে।
মাহমুদ বলল, শেখ জামাল আমরা এসে গেছি।
তারপর মাহমুদ ড্রেনের দেয়ালের দিকে ঘুরে দাড়াল। রবারের গ্লাভস খুলে হাত রাখল ড্রেনের দেয়ালে। কংক্রিটের শক্ত দেয়াল। টর্চের আলো ফেলে দেখল সিমেন্ট ঢালাই করে তৈরী, একদম সলিড। কোথাও অস্বাভাবিক কোন চিহ্ন নেই।
টেপের মাথা শেখ জামালের হাতে দিয়ে মাহমুদ বলল, তুমি এখানে দাড়াও, আমি সামনে খুঁজে দেখি। কংক্রিট কিংবা ইস্পাতের কোন দরজা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
মাহমুদ টর্চ জ্বেলে ড্রেনের দেয়াল পরীক্ষা করতে করতে সমানে এগুলো। প্লাষ্টিকের বাটওয়ালা লোহার হাতুড়ি দিয়ে প্রায় ১ ফুট অন্তর অন্তর ড্রেনের দেয়ালে ঘা দিচ্ছিল মাহমুদ, ফাঁপা বা ব্যতিক্রমধর্মী কোন শব্দ কানে আসে কি না তা দেখার জন্যে। এভাবে প্রায় সে চল্লিশ গজ সামনে এগুলো, না কোন চিহ্ন কোথাও সে পেল না। আবার ফিরে এল মাহমুদ ঐভাবে পরীক্ষা করতে করতেই।
শেখ জামালের কাছ ফিরে আসার পর মাহমুদ সামনের মত পিছনের দিকটাও পরীক্ষা করতে এগিয়ে গেল। হতে পারে সিনবেথের অফিস তারা পিছনে ফেলে এসেছে। মাহমুদ যেমন সামনের দিকটা দেখেছে তেমনি পিছনের ৪০ গজ পরিমাণ দেয়ালও সে ঐভাবে পরীক্ষা করল। না, ইস্পাতের সলিড দেয়ালে কোথাও সামান্য পরিমাণ অস্বাভাবিকতারও চিহ্ন নেই।
ফিরে এল মাহমুদ আবার শেখ জামালের কাছে। তারা গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল, কিন্তু তারা ছেয়েও উদ্বিগ্ন তার মনটা। তাহলে তারা কি ব্যর্থ হবে? মাপ অনুসারে তারা তো সিনবেথের অবস্থানেই পৌছেছে। না সিনবেথের দরজাটা ওপার করিডোরে? মনের এ চিন্তাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হল মাহমুদের কাছে। শেখ জামালকে সে বলল, তুমি এখানে দাঁড়াও আমি ওপারের দেয়ালটা পরীহ্মা করে আসি।
জামাল বলল, জনাব অনুমতি দিলে আমি দেখে আসি।
মাহমুদ হেসে বলল, না জামাল আমাকেই যেতে হবে।
বলে মাহমুদ বুকের ব্যাগ থেকে রবারের ডুবুরী পোশাক বের করে নিল। তারপর ওটা পরে নিয়ে নেমে গেল সে নর্দমায়। সাঁতরে ওপারে পার হয়ে গেল মাহমুদ।
ওপারের করিডোরে উঠে ডুবুরীর পোশাক পরেই সেই দেয়াল পরীক্ষার পালা সে শুরু করল। শেখ জামালের অবস্থানকে মাঝখানে রেখে, সামনে চল্লিশ গজ সে পরীক্ষা করল। না, সে একই দৃশ্য, সলিড কংক্রিটের দেয়াল, কোথাও কোন অস্বাভাবিকতার চিহ্নই নেই।
হতাশা এবং ক্লান্তিতে মাহমুদ ড্রেনের করিডোরে বসে পড়ে। তাহলে তারা কি দিক ভুল করেছে? না দিক ভুল হয়নি। চলার সময় ২ নং মূল হেড ড্রেন থেকে এর অন্য কোন শাখায় তো তারা ঢুকে পড়েনি? না সে ভুল তারা করেনি। তারা মোট দশটি শাখা ড্রেন পাশ কাটিয়ে মূল হেড ড্রেন ধরেই এগিয়ে এসেছে।
হঠাৎ তার মনে হল, টেপতো তাদের মিস গাইড করছে না? টেপের মাপ এবং ডেভিড পার্ক থেকে সিনবেথ হেড কোয়ার্টার পর্যন্ত যে মাপ সে সুয়ারেজ ডায়াগ্রাম থেকে নিয়েছে তা কি নিখুঁত? ডায়াগ্রামে ড্রেনের জিগ -জ্যাগকে তার কাছে তো তখন বড় বলে মনে হয়নি, কিন্তু বাস্তবে তো এই জিগ-জ্যাগ দুরত্বের ক্ষেত্রে অনেক পার্থক্য সৃষ্টি করে! মেপে দেখার সময় মাহমুদের এ কথাটা মোটেই মনে হয়নি। এই ভুলের জন্যে নিজের চুল নিজেই ছিড়তে ইচ্ছা করল মাহমুদের। কিন্তু পরক্ষণেই সচেতন হল, এ সময় অধৈর্য হলে চলবে না, সাহস হারালে চলবে না।
মাহমুদ চিন্তা করে দেখল, তার হিসেব ভুল হবার অর্থ হলো ড্রেনে প্রকৃত দৈর্ঘের চেয়ে টেপের মাপ কম হওয়া। অর্থাৎ তাদের আরও সামনে এগুতে হবে।
মাহমুদ নর্দমা পার হয়ে শেখ জামালের কাছে ফিরে এল। বলল, শেখ জামাল আমাদের আরও সামনে এগুতে হবে। শেখ জামাল বলল, চলুন জনাব, ইনশাআল্লাহ আমাদের লক্ষ্য আমরা খুঁজে পাবই।
-ইনশায়াল্লাহ’ বলে মাহমুদ সামনে পা বাড়াল।
মাহমুদ এবার পাশের দেয়ালসহ চারিদিকটা ভালভাবে পরীক্ষা করেই ধীরে ধীরে সামনে এগুতে লাগল। টেপের সাথে দু’শ গজের একটা প্লাষ্টিক কর্ড বেধে তারা সামনে এগুতে লাগল।
করিডোর এবং দেয়ালের উপর টর্চের আলো ফেলে এবং হাতুড়ি দিয়ে কংক্রিটের দেয়াল ঠুকে ঠুকে সে সামনে এগুচ্ছিল। হঠাৎ এক জায়গায় করিডোরের উপর কয়েক খন্ড ইলেকট্রিকের লালরঙা তার টর্চের আলোর চিক চিক করে উঠল। মাহমুদের চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝুকে পড়ে তার তুলতে গিয়ে সিগারেটের একটা খন্ডও তার চোখে পড়ল। সিগারেটের খন্ডটাও সে তুলে নিল। সিগারেটের ফিল্টার দেখেই বুঝল, অত্যন্ত দামী সিগারেট। ইলেকট্রিকের তার এবং সিগারেটের খন্ডের উপর জমে ওঠা ময়লার পরিমাণ থেকে মাহমুদ বুঝল, এ দুটো জিনিষই খুব আগের নয়।
মাহমুদ বলল, শেখ জামাল আল্লাহ বোধ হয় আমাদের দয়া করেছেন। আমরা বোধ হয় মনজিলে পৌঁছে গেছি।
হঠাৎ মাথা বরাবর দেয়ালের গায়ে বর্গাকৃতি কাল একটি বর্ডার তার নজরে পড়ল। হাত দিতে গিয়েও চমকে টেনে নিল সে হাত। বুকে ঝুলানো ব্যাগ থেকে ডেটোনেটর বের করে কালো বর্ডারের মাঝখানের দেয়াল স্পর্শ করে বুঝল, ওটা সিমেন্ট রং-এর ইলেকট্রিফায়েড ইস্পাত। চারধারটা কালো রাবারের বর্ডার।
ফিস্ ফিস্ করে মাহমুদ বলল, শেখ জামাল, এটাই সেই দরজা। দু’জনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।
কিভাবে এগুবে একটু চিন্তা করল মাহমুদ। যেহেতু বিদ্যুৎ সুইচটা ভেতরে তাই বিদ্যুতায়িত এই দরজা থেকে বিদ্যুৎ ডিসকানেক্ট করার কোন উপায় নেই। এখন একটিই পথ এবং তা হলো গোটা দরজা কেটে নামিয়ে আনা। কিন্তু ঘরের ভেতরটা নিরাপদ না করে দরজা কেটে নামানোর অর্থ শত্রুকে স্বাগত জানানো।
চিন্তা করছিল মাহমুদ। একটা রবারের নল ঢুকানো যাবে, এমন ফুটা কিভাবে ইস্পাতের এই দরজায় করা যায়? ল্যাসার বিম দিয়ে মুহূর্তে এটা করা সম্ভব। কিন্তু বিদ্যুতায়িত ইস্পাতে ল্যাসার প্রয়োগ করলে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এটা হলে তার আসল কাজ নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
আরো ভাবল মাহমুদ। অবশেষে অনেক চিন্তা করে খুব সন্তর্পণে রবারের বর্ডার এবং কংক্রিটের দেয়ালের সংযোগ স্থলে ল্যাসার রস্মি প্রয়োগ করে আধা ইঞ্চি ব্যাসের একটা ফুটো করল। ফুটো দিয়ে একটা রাবারের নল ঢুকিয়ে দিল। বিনা বাধায় নলটি ফুটখানেক প্রবেশ করায় সে বুঝল নলটি নিশ্চয় ঘরে প্রবেশ করেছে। এরপর মাহমুদ সেই রাবারের নলের প্রান্ত ফ্লাইং ক্লোরোফরমের কনটেইনারের সাথে জুড়ে দিয়ে সুইচ অন করে দিল। এক মিনিট অন করে রাখার পর সুইচ অফ করে দিল মাহমুদ।
পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করার পর মাহমুদ রাবারের বর্ডার বরাবর ইস্পাতের দরজার চারদিকে ল্যাসার বিম চালিয়ে দরজাটা কেটে ফেলল। সশব্দে ভারি দরজাটা পড়ে গেল করিডোরের ওপর। দরজার নীচের প্রান্তের সাথে একটা ইলেকট্রিকের তার যুক্ত ছিল, দরজার ভারে তার ছিড়ে গেল। বিদ্যুতায়নের উৎস ছিল ঐ তারটি। মাহমুদ তারটির মুখ টেপ দিয়ে মুড়ে দিল।
মাহমুদ মনে করেছিল ইস্পাতের দরজাটা খুললেই সিনবেথের ভূগর্ভস্থ কক্ষে প্রবেশ করা যাবে, কিন্তু তা হলো না। এ দরজার পরে চার পাচঁ গজ লম্বা একটা সুড়ঙ্গ, তারপর আরেকটা দরজা। সেটাও ইস্পাতের।
মাহমুদ শেখ জামালকে ড্রেনের করিডোরে অপেক্ষা করতে বলে সেই সুড়ঙ্গে উঠে গেল। ডেটোনেটর দিয়ে দেখল দ্বিতীয় এ দরজা বিদ্যুতায়িত নয়। তার সন্দেহ হলো, তার আগের ক্লোরোফরম এ দরজা ডিঙ্গিয়ে সরে যেতে পেরেছে কি না!
কোন সন্দেহের অবকাশ না রাখার জন্যে মাহমুদ দরজার গোড়ায় লেসার বিম দিয়ে ছোট্ট একটা ফুটো করে রাবারের নল দিয়ে ফ্লাইং ক্লোরোফরম আবার চালান করে দিল ঘরের ভেতরে। ঘরে যদি কেউ থাকে গন্ধহীন এ ক্লোরোফরম নিমিষে তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেবে।
ক্লোরোফরম চালান দেবার পর দু’তিন মিনিট অপেক্ষা করল মাহমুদ। তারপর ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার এক পাশে বড় ধরনের ফুটো করল। চোখ লাগাল সে ফুটোয়, দেখল উজ্জ্বল আলোয় ঘরটি ভরে আছে। ঘরে কেউ নেই। মনটা মাহমুদের ছ্যাঁৎ করে উঠল। তাহলে তার সব চেষ্টা বৃথা যবে।
হঠাৎ তার চোখ পড়ল ঘরের একপাশে মেঝের ওপর। ভালো করে দেখা যায় না। মনে হল, মেঝের ওপর একটা তক্তপোষ। সে তক্তপোষের ওপর মানুষের মত কিছু শুয়ে আছে, কাপড় দেখে বুঝা যায়। ওকি এমিলিয়া! দেহের রক্ত তার চঞ্চল হয়ে উঠল। বুকটা তোলপাড় করে উঠল তার।
মাহমুদ তাড়াতাড়ি ল্যাসার বিম দিয়ে দরজার দুপাশটা কেটে ফেলল। তারপর দরজা একপাশে সরিয়ে রেখে ছুটে গেল ঘরে তক্তপোষের কাছে। এক পলক এমিলিয়াকে দেখে পরীক্ষা করে ছুটে গেল সে বাইরের দরজায়। দরজাটা বন্ধই ছিল, লক করে দিল মাহমুদ। তারপর দৌড়ে গিয়ে সে বিদ্যুতায়নের সেই তারটা নিয়ে এল। প্লাকটি খুলে রেখে তারের মুখ থেকে টেপ খুলে নিয়ে সেটা সে জুড়ে দিল বাইরের দরজার সাথে। তারপর প্লাকটি আবার লাগিয়ে দিল। ডেটোনেটর দিয়ে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হল যে, দরজাটি বিদ্যুতায়িত হয়েছে। খুশী হল মাহমুদ।
এবার সে ছুটে এল এমিলিয়ার কাছে। আবার নাকে হাত দিয়ে দেখল সব ঠিক আছে।
তাড়াতাড়ি সে তার বাধনগুলো কেটে তাকে গ্যাসমাষ্ক পরিয়ে কাঁধে তুলে নিল।
তারপর সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে নেমে এল ড্রেনের করিডোরে।
ফিরতি যাত্রা শুরু হলো তাদের।
এক হাতে কাঁধে এমিলিয়াকে ধরে, অন্য হাতে টর্চ জ্বালিয়ে আগে আগে হাটছিল মাহমুদ। তার পিছনে শেখ জামাল, সেই আগের মত করে।
এমিলিয়কে নিয়ে এসে তেলআবিব শহরের পূর্বাঞ্চলে পার্ক ষ্ট্রীটের একটি বাড়ীতে এনে তোলা হল। বাড়ীটির সামনে সাইন বোর্ড ‘দানিয়েল এ্যান্ড কোং’।
পূর্ব তেলআবিবে দানিয়েল এ্যান্ড কোম্পানীর প্রধান সেল্স ডিপো। বাড়ীটি জনৈক ইহুদীর নিকট থেকে অতি সম্প্রতি ক্রয় করেছে মাহমুদ। বাড়ীর বাইরের অংশে ক্রয়-বিক্রয়ের কাজ চলে আর ভিতরের অংশ ব্যবহৃত হয় সাইমুমের হাসপাতাল হিসেবে। একজন মহিলা ডাক্তার ও একজন নার্স এমিলিয়ার দেখা শোনার ভার নিল।
জ্ঞান ফিরে পেয়েই চোখ মেলল এমিলিয়া। সুন্দর খাটে নরম ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছে সে। লাল কার্পেট মোড়া মেঝে। সাদা রং-এর দেয়াল। খাটের পাশে সাদা টেবিলে ঔষধের শিশি ও গ্লাস। কোথায় অপারেশন চেম্বারের শক্ত মেঝে, আর কোথায় জাকজমকপূর্ণ গৃহের নরম শয্যা। স্বপ্ন দেখছে না তো সে। গায়ে চিমটি কেটে দেখল-না স্বপ্ন নয়।
এমন সময় ঘরে ঢুকল নার্স। গায়ে সাদা আরবী পোশাক। মাথায় সাদা রুমাল। এমিলিয়াকে চাইতে দেখে সে দ্রুত তার পাশে এসে নরম গলায় বলল, কেমন লাগছে?
জবাব না দিয়ে এমিলিয়া বলল, আমি কোথায়? আপনি কে?
-আপনি নিরাপদ স্থানে আছেন। বলল নার্স।
কিছু বলার জন্য মুখ হা করেছিল এমিলিয়া। হঠাৎ ঘরে প্রবেশ করল মাহমুদ।
কথা বলতে পারল না এমিলিয়া। মুখ তার হা হয়েই রইলো অভিভূতের মত চেয়ে রইল সে মাহমুদের দিকে। ঠোঁট কাঁপতে লাগল তার। অবরুদ্ধ এক উচ্ছাসে কাঁপছে সে। উচ্ছাস ছাপিয়ে নেমে এল দু’গন্ড বেয়ে অশ্রুর ধারা। মুখ কাত হয়ে পড়ল বালিশে। বালিশে মুখ গুজে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল এমিলিয়া।
নার্স অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছিল।
মাহমুদ ধীরে ধীরে গিয়ে এমিলিয়ার পাশে বসল। বলল, কেদোঁ না এমি, ভয়ংকর সে দুঃস্বপ্নের ইতি হয়েছে।
কান্না বেড়ে গেল এমিলিয়ার। কান্নার বেগে কাঁপছে তার দেহ।
এমিলিয়ার রেশমের মত নরম চুলে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে ইচ্ছ হচ্ছিল মাহমুদের। কিন্তু পারছিল না। বিবেকের কঠোর শাসানি তার সামনে। নতুন পরিবেশে, নতুন পরিচয়ে এমিলিয়া আজ এক মহিমাময়ী নারী। কাছে পেয়েও তাকে মনে হচ্ছে দুরে। সামান্য স্বোচ্ছাচারিতার অবকাশও তাদের মধ্যে নেই যেন আজ।
অবসাদে যেন ভেঙে পড়ছে এমিলিয়া। কান্না তার থেমে গেছে। কিন্তু মুখ তুলছে না সে।
নার্স গরম দুধ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। মাহমুদ পাশের একটি চেয়ারে গিয়ে বসেছিল। এমিলিয়াকে দুধ খাইয়ে চলে গেল নার্স। মাহমুদ বলল, এখন উঠি এমি, সকালে আসব।
-কোথায় যাবে, আমি কোথায়? অষ্ফুট প্রায় একটি প্রশ্ন।
-কেন নিজের বাড়ীতে। মাহমুদের ঠোঁটে হাসি।
এমিলিয়া কোন জবাব দিল না। চোখ দু’টি নামিয়ে নিল সে। মাহমুদ বলল, কেন বিশ্বাস হচ্ছে না?
-বিদ্রুপ করছ তুমি আমাকে মাহমুদ? এমিলিয়ার কণ্ঠ ভারি শোনাল।
-বিদ্রুপ নয়, সত্যি বলছি, আমি এ বাড়ীতে থাকি না বটে, তবে এটা আমারই বাড়ী।
এমিলিয়া কোন কথা বলল না। নীরব দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইল শুধু। দৃষ্টিতে তার সে কি বিশ্বাস আর নির্ভরতা।
মাহমুদই কথা বলল আবার, তোমার নিরাপত্তার ব্যবস্থা আমরা করেছি কোন ভয় নেই। একটু থেমে মাহমুদ আবার বলল, আমি তোমাকে একেবারে আমার ওখানেই তুলতে পারতাম, কিন্তু তা করিনি। তুমি তো জান, আমার শূন্য ঘরে তোমার পদধুলি পড়বে, সে সৌভাগ্যের দিন আমার এখনো আসেনি। বলেই মাহমুদ উঠে দাঁড়াল। বলল এখানে যারা আছে যাদের তুমি দেখবে, সকলকেই নিজের লোক মনে করো। যে কোন অসুবিধার কথা তাদের জানিও।
মাহমুদ বেরিয়ে এল ঘর থেকে।
এমিলিয়া অপসৃয়মান মাহমুদের দিকে চেয়েছিল। তার চোখ দু’টি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বালিশ দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মুখ লাগালো সে বালিশে।
সেদিন এমিলিয়ার মা আইরিনা তার ঘরে এমিলিয়ার ফটো সামনে নিয়ে বসেছিল। মায়ের কয়েক ফোটা অশ্রু গিয়ে পড়েছে এমিলিয়ার বাধানো ফটোর আয়নায়। এমিলিয়া চলে যাবার পর থেকে এভাবেই কাঁদছে আইরিনা। আইরিনা সেই যে সিনবেথ অফিসে গেছে, তারপর আর কোন খোঁজ নেই তার। এতটুকুই শুধু জানা গেছে যে, তার জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ জিজ্ঞাসাবাদ কেমন তা ভাবতেও শিউরে উঠে আইরিনা। সেই থেকে এমিলিয়ার বাবাও বোবা হয়ে গেছে। কোন কথাই সে বলে না। আইরিনার অনেক কাদাকাটার পর গতকাল শুধু একটা কথাই বলেছিল, মেয়েটা আমার সসম্মানে মৃত্যুবরণ করতে পারুক, এর চেয়ে বেশী আর কিছু চেয়ো না আইরিনা। কিন্তু ওরা তো মারবে না, কষ্ট দেবে। এ কষ্ট দেবার টেকনিক আমরা হিটলারের কাছে শিখে এসেছি।’ স্বামীর এ কথাগুলো মনে পড়ায় আবার নতুন করে কেঁপে উঠল আইরিনা, অশ্রুর ঢল নামল দু’চোখ বেয়ে।
এ সময় একটা খবরের কাগজ হাতে ঘরে প্রবেশ করল ডেভিড সালেম। কাগজের একটা খবর স্ত্রীর কাছে মেলে ধরে বলল, পড়।
চোখ মেলে স্বামীর দিকে চেয়ে খবরের ওপর চোখ নিবদ্ধ করল আইরিনা। খবরটির শিরোনাম এরূপ,
“সিনবেথের দুর্ভেদ্য অপারেশন কক্ষ
থেকে আসামীর পলায়ন”
আর খবরে বলা হয়েছে, গতকাল রাতে সিনবেথের ভূগর্ভস্থ অপারেশন কক্ষ থেকে অতি গোপনীয় রাষ্ট্রীয় দলিল পাচারের দায়ে ধৃত আসামী জনৈকা এমিলিয়া পলায়ন করেছে। জানা গেছে, কে বা কারা ভূগর্ভস্থ ড্রেনের পথে দৃঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে সিনবেথের অপারেশন কক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করে নিরাপদে পালিয়ে গেছে।…..
খবরটা পড়া শেষ না করেই আইরিনা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ঈশ্বর আমাদের দেখেছেন, আমাদের মেয়েকে বাঁচিয়েছেন।’
ডেভিড সালেমের চোখেও তখন অশ্রু।
এ সময় দরজায় নক হলো।
আইরিনা স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ইসাকের মা এস।
পরিচারিকা ইসাকের মা ঘরে প্রবেশ করে একটা চিঠি ডেভিড সালেমের হাতে দিল।
সাদা দামী ইনভেলাপ। এ ধরনের ইনভেলাপের ব্যবহার ইসরাইলে নেই। ইনভেলাপের ওপর কারও নাম লেখা নেই। বিষ্মিত ডেভিড সালেম ইনভেলাপ ছিঁড়ে একটা চিঠি বের করল। চিঠির কাগজটিও অত্যন্ত দামী। চিঠিটি পড়ল ডেভিড সালেম,
সম্মানিত ডেভিড সালেম,
আপনাদের মেয়ে এমিলিয়া ভাল আছেন, সুস্থ আছেন। নিরাপদ মনে করলে আপনাদের কাছেই পাঠাতাম। কিন্তু তা পারছি না।
-মাহমুদ
চিঠিটি পড়ে ডেভিড সালেম বলল, কোথায় পেলে ইসাকের মা এই চিঠি?
ইসাকের মা বলল, একজন ফুলওয়ালা এই চিঠি দিয়ে গেছে। ইসাকের মা বেরিয়ে গেল।
আইরিনা চিঠিটি পড়ে মেঝেতেই সেজদায় পড়ে গেল মুসার খোদার উদ্দেশ্য।
সেজদা থেকে উঠে আবেগ জড়িত কন্ঠে বলল, বলতে পার এই মাহমুদ কে?
ডেভিড সালেম বলল, কে আমি জানি না, অনুমান করতে পারি, সাইমুমরা ছাড়া এ দেশে এত শক্তিশালী আর কেউ নেই।
একটু থেমে সে বলল, মাহমুদ যদি সাইমুমের হয় তাহলে আমাদের মেয়ে সম্পর্কে আমরা নিরাপদ থাকতে পারি।
এ সময় টেলিফোন বেজে উঠল।
ডেভিড সালেম টেলিফোন ধরলে ওপার থেকে সিনবেথ প্রধান ডোবিন বলল, স্যার আমরা আপনার সহযোগিতা চাই। এমিলিয়ার কোনও তথ্য যদি পান…..
ডেভিড সালেম ডোবিনকে কথা শেষ করতে না দিয়েই বলল তোমার কথা আমি বুঝেছি ডোবিন। আমার অবস্থা তুমি জান, পরে কথা বলব তোমার সাথে।
বলে টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে এসে আইরিনার হাত থেকে চিঠিটি নিয়ে ছিড়ে ফেলল। চিঠি ছিড়তে ছিড়তে সে বলল, বুঝলে আইরিনা ডোবিন আমার কাছ থেকে এমিলিয়ার খোঁজ চায়। ওরা ভুল করছে। আমি ইহুদী বটে’ কিন্তু আমি একজন পিতাও ঐ অমানুষরা তা ভুললো কি করে।
৭
ইসরাইলের প্রতিটি লোকালয়-পল্লী-নগরীতে সপ্তবার্ষিক ‘সাবাত’ দিবসের মহা আনন্দের বারতা নিয়ে উদিত হল ২৭ শে ফেব্রুয়ারীর সূর্য। প্রতি সাত বছর পর পালিত হয় এই উৎসব। ধর্মীয় বিধান অনুসারে এই দিন অর্থকরী সকল প্রকার কাজকর্মে ব্যাপৃত হওয়া সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। কোন কাজে ব্যাপৃত হওয়া মহাপাপের কাজ তাদের জন্য। ইসরাইলের এটা সাধারণ ছুটির দিন। খেত-খামার, কল-কারখানা, অফিস-আদালত, ব্যবসায়-বাণিজ্য, দোকান-পাট সবকিছুর দরজা এদিন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। মহা আনন্দের বন্যায় প্লাবিত হয়ে যায় এদিন প্রতিটি ইহুদী জনপদ। এ ২৭ শে ফেব্রুয়ারীর সূর্যও সেই মহা আনন্দের বারতা নিয়ে এল ইসরাইলে।
তবে এবারের ‘সাবাত’ দিবস ইসরাইলের কাছে আরও তাৎপর্যময়। দু’দিন আগে ইসরাইলের সাথে আরব রাষ্ট্রসমূহের শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেই সাথে ইসরাইল তাদের স্বীকৃতি লাভ করেছে। অবশ্য এজন্য তাকে অধিকৃত এলাকা ছাড়াও আরো অনেকখানি ইসরাইলী এলাকা ছেড়ে দিতে হয়েছে। জেরুজালেম থেকেও তাদের হাত গুটিয়ে নিতে হয়েছে-সরে যেতে হয়েছে তাদেরকে ১৯৪৮ সালের পাটিশন সময়ের মূল এলাকার মধ্যে। তবু বহু বছর পর আজ শান্তি ও স্বস্তি লাভ করেছে ইসরাইলিরা। তাদের মাথার উপর যে উদ্যত খাঁড়া ঝুলছিল তার ভীতি থেকে তারা আজ মুক্ত হয়েছে। তাই আজকের ‘সাবাত’ দিবস ইসরাইলিদের কাছে সৌভাগ্যের সূচনাকারী হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। তাই সারা ইসরাইলে আজ বাধনহারা আনন্দের বন্যা। সেনাবাহিনীর ব্যারাক হতে শুরু করে কুলি-মজুরের অঙ্গন পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে এই আনন্দ।
সারাদিন ধরে চলেছে আনন্দ। ইসরাইল জন-জীবনে আজ কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, কোন আইনের বাধন যেন নেই কোথাও। সন্ধ্যার আগমনে আনন্দ উৎসব আরও জমে উঠল। তেল-আবিবের ৪১টি সিনেমা হল, ২৭টি নাট্য মঞ্চ, ১৭টি পাবলিক হলে আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে। সৈনিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, অফিসার প্রভৃতি সকলেই আজ এসে জমা হয়েছে এসব আনন্দানুষ্ঠানে। এছাড়াও বিভিন্ন মহল্লায় শামিয়ানা টাঙ্গিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সেনাবাহিনীর গ্যারিসনসমূহে তাদের নিজস্ব মিলনায়তনেও আয়োজন হয়েছে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের। ইসরাইলের সকল শহরে আজ একটিই দৃশ্য। ইহুদী-পল্লী-জনপদেও এরূপ আনন্দানুষ্ঠানের ব্যবস্থা হয়েছে। দেশের এই আনন্দানুষ্ঠানে মিলিত হয়নি শুধু মুসলিম ও ডোজি সম্প্রদায়। ইহুদীদের ধর্মানুষ্ঠানের সাথে তাদের কোন যোগ নেই।
রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ইসরাইলে আজ যে শীর্ষ আনন্দানুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছে, তার স্থান হয়েছে ষ্ট্রেট এ্যাসেম্বলি হল। এখানে রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রিসভা ও পার্লামেন্ট সদস্য, উর্ধতন সরকারী কর্মচারী এবং সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় অফিসারবৃন্দ সমবেত হয়েছেন।
গ্রীন লজের ওয়্যারলেস রুম। ওয়্যারলেসের সামনে বসেছিল আহমদ মুসা এবং মাহমুদ।
সন্ধ্যা ৭ টা পেরিয়ে গেছে। ইসরাইলের বিভিন্ন শহর ও সাইমুমের অন্যান্য আঞ্চলিক ঘাঁটি থেকে রিপোর্ট আসছে, তারা সে রিপোর্ট পরীক্ষা করছে এবং সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিচ্ছে। সিনাই অঞ্চল, জর্দান উপত্যকা ও গোলান হাইট এলাকা থেকে সকল সাইমুম ইউনিটকে ইসরাইলের অভ্যন্তরে সরিয়ে আনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সংগঠনের সকল কর্মীকেও এনে সমবেত করা হয়েছে ইসরাইলে। ইসরাইলের বিভিন্ন ঘাঁটিতে তারা ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় নেতৃত্বকে তারা পরামর্শ ও সহযোগিতা দান করছে। তাদের কাছ থেকে রিপোর্ট আসছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে আহমদ মুসা ও মাহমুদের কপালে।
ইসরাইলের সমস্ত ঘাঁটিতে সাইমুমের সকল ইউনিট প্রস্তুত। সকলের মধ্যে হালকা অস্ত্র বিতরণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। চূড়ান্ত মুহূতটির জন্য অপেক্ষা করছে সকলেই। রাত্রি দশটা এক মিনিটে মাইমুমের অপারেশন স্কোয়াড তার কাজ শুরু করবে। এর অর্ধ ঘন্টা পরে পাবলিসিটি স্কোয়াডের কাজ শুরু হবে। রাত্রি ১২ টায় রেডিও ঘোষণা করবে অভূত্থানের কথা। সেই সঙ্গে শুরু হবে ডিপ্লোম্যাটিক এবং এডমিনিষ্ট্রেসন স্কোয়াডের তৎপরতা।
সকল ঘাঁটির সাথে যোগাযোগ সম্পন্ন করে ওয়্যারলেস রুম থেকে বেরিয়ে এল আহমদ মুসা। কিন্তু মাহমুদ বসে রইল ওয়ারলেস সেটের সামনে। সমস্ত মনোযোগ তার ওয়্যারলেস সেটের দিকে নিবদ্ধ।
ওয়্যারলেস রুম থেকে বেরিয়ে এসে আহমদ মুসা মিটিং রুমে প্রবেশ করল। একটি গোল টেবিল ঘিরে বসেছিল সাইমুমের রাজনৈতিক বিভাগের প্রধান আমিন আল আজহারি, সামরিক পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান আবদুল্লা আমর। জেনারেল মোশে হায়ান ও জেনারেল রবিনকে চেয়ারের সাথে শক্ত করে বেঁধে রাখা অবস্থায় দেখা গেল। তাদের চোখ বাঁধা।
আহমদ মুসা এসে চেয়ারে বসতেই আমিন আল-আজহারি তার দিকে একটি বিবৃতির খসড়া এগিয়ে দিল। গভীর মনোযোগের সাথে তাতে চোখ বুলাল আহমদ মুসা। এখানে-সেখানে কয়েকটা সংশোধন আনল। এ নিয়ে সে নিম্নস্বরে আবদুল্লাহ আমরের সাথে পরামর্শ করল। তারপর সে আমিন আল-আজহারিকে বললো, একটি ফ্রেস কপি তৈরি করুন।
আহমদ মুসা উঠে গিয়ে জেনারেল হায়ান ও জেনারেল রবিনের চোখের বাঁধন খুলে দিল। চোখের বাঁধন খুলে যেতেই ওরা পিট পিট করে সবার দিকে চোখ তুলল, দেখে নিল ঘরটাকেও একবার। আহমদ মুসা চেয়ারে এসে বসল। ততক্ষণে ফ্রেস কপি তৈরী হয়ে গেছে।
আহমদ মুসা কাগজটি হায়ানের সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, পাঠ করুন কাগজটি। কাগজটি জেনারেল রবিনকে দিয়েও পাঠ করানো হল। পাঠ করে তারা চমকে উঠল। পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখল তারা সবাইকে। মোশে হায়ান বলল, এর অর্থ কি, কে আপনারা?
আহমদ মুসা বলল, পরিচয় পর্ব পরেও হতে পারবে, কিন্ত তাড়াতাড়ি মেসেজটি আমাদের রেকর্ড করানো দরকার, ওটাই আগে হোক। বলে সে ড্রয়ার থেকে একটি ছোট্ট মাউথ পিস বের করে তার সামনে তুলে ধরল। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে মেসেজটি একবার পাঠ করুন মিঃ হায়ান।
হায়ান বলল, আমি পাঠ করতে পারি না, আমাদের ব্লাক মেইলিং করা হচ্ছে।
আহমদ মুসা কঠিন কন্ঠে বলল, আমরা খেলা করতে বসিনি মিঃ হায়ান, সময় নষ্ট করবেন না। পাঠ করুন, অথবা মৃত্যুর জন্য তৈরী হোন। বলে আহমদ মুসা রিভলভার বের করে ডান হাতে রেখে বামহাতে মাউথ পিসটি তুলে ধরল হায়ানের সামনে। লৌহ মানব বলে কথিত এক চক্ষু বিশিষ্ট হায়ানেরও মুখ পাংশু হয়ে গেল। সে মুসার স্থির অচঞ্চল চোখে কি যেন পাঠ করল, তারপর পাঠ করে গেল মেসেজটি। জেনারেল রবিনও অনুসরণ করল হায়ানকে।
রাত্রি নয়টা তিরিশ মিনিট। উৎসব মুখর তেলআবিব নগরী। সাইমুমের ট্রাফিক ইউনিট সাধারণ পথচারীর ছদ্মবেশে শহরের রোডে মোতায়েন হয়ে গেছে। হ্যান্ড গ্রেনেড ও ষ্টেনগান সজ্জিত তারা। সেই চরম মুহূর্তটিতে যানবাহন ও পথ চলাচল সম্পূর্ণ অচল করে দেয়াই হবে তাদের কাজ। কারফিউ নিয়ন্ত্রণও করবে তারা। নির্দিষ্ট সময়ে টেলি-যোগাযোগ বিকল করে দেয়াও তাদের দায়িত্ব। ৯-৪৫ মিনিটে সাইমুম অপারেশন স্কোয়াডের কর্মীরা গণ জমায়েতের স্থানগুলোতে পজিশন নিয়ে নিল। বিশেষ করে টেষ্ট এ্যাসেম্বলী হল ও গুরুত্বপূর্ণ গভর্ণর-দফতর গুলোতে তারা অলক্ষ্য অবরোধের সৃষ্টি করে দাঁড়াল। টেলিফোন-টেলিগ্রাফ, টেলিভিশন ও বেতার কেন্দ্র এবং সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করা হল সবচেয়ে বেশী।
ঢং ঢং করে তেলআবিবের ঘড়িতে রাত্রি দশটা বেজে গেল। পেটা ঘড়ির শেষ ঘন্টাটি বাতাসে মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে ইসরাইল আর্মির প্রতীক আকাঁ দু’খানা জীপ সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারের বিশাল গেটে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের দু’পাশে গার্ড রুম থেকে দুইজন মিলিটারি পুলিশ এগিয়ে এল জীপের দিকে। দুই জীপে মোট দশজন লোক ইসরাইল আর্মির পোশাক পরা। প্রত্যেকের সোলডার ব্যান্ডে অফিসারের ইনসিগনিয়া। মিলিটারী পুলিশ এক নজর তাকিয়েই ষ্ট্রেনগান নামিয়ে ফিরে চলল। তারা ফিরে দাঁড়াতেই জীপ থেকে দু’টি রিভলভার একই সঙ্গে অগ্নিউদগীরণ করল। সাইলেন্সার লাগানো রিভলভার। কোন শব্দ হলো না। লোক দু’টিও নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ল গেটের গোড়ায়। জীপ দু’টি তীরবেগে ঢুকে গেল ভিতরে। ঢুকে একটি সোজা রাস্তা ধরে চলে গেল জেনারেলের অফিসের দিকে। আর একটি চলে গেল ইসরাইল আর্মির ‘আরসেনাল’ ফিল্ডের দিকে।
জেনারেলের অফিসমুখী জীপের নেতৃত্ব দিচ্ছিল মাহমুদ স্বয়ং। ঝড়ের গতিতে এগিয়ে চলছিল জীপ। আর মাত্র পঁয়ত্রিশ সেকেন্ড বাকি। এ সময়ে মধ্যে তাকে জেনারেলের অফিসে পৌঁছতে হবে। ঐতো দেখা যাচ্ছে জেনারেলের অফিস, তাঁর সুদৃশ্য গেট। গ্রাউন্ড ফ্লোরেই বসেন জেনারেল। কিন্তু গ্রাউন্ড ফ্লোরটি গ্রাউন্ড লেবেল থেকে প্রায় বিশ ফুট উঁচু। জেনারেলের অফিসের তলদেশে ইসরাইল আর্মির হেড অয়্যারলেস কনট্রোল কেবিন।
জেনারেলের উন্মুক্ত গেটে দেখা যাচ্ছে দু’জন মিলিটারী পুলিশ। জীপ দেখে তাদের হাতের ষ্টেনগান উঁচু হয়ে উঠল। গুলীর রেঞ্জে ওরা আসতেই মাহমুদ নির্দেশ দিল, ফায়ার। দু’টি রিভলভার একই সঙ্গে আবার অগ্নি-উদগীরণ করল। নিঃশব্দ সে গুলী। কোন চিৎকারও উঠল না নিঃশব্দে লুটিয়ে পড়ল লোক দু’টি। গেটে গিয়ে গাড়ী দাঁড়াতেই মাহমুদ লাফ দিয়ে নেমে গেট পেরিয়ে ক্ষীপ্ত পদে সিঁড়ির দিকে ছুটল। তার পিছনে আরও দু’জন। অন্য দু’জন মেশিনগান নিয়ে দাঁড়াল গেটে।
মাহমুদ সিঁড়ি ভেঙে উঠে একটি করিডোর পেরিয়ে জেনারেলের অফিসের বদ্ধ দরজার সামনে দাঁড়াল। দরজার পাশে ডান দিকে জেনারেলের সেক্রটারীর অফিস। সে মাহমুদদের দেখে হকচকিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। তার সোলডার ব্যান্ডে কর্ণেলের ইনসিগনিয়া। মাহমুদের রিভলভার নিঃশব্দে অগ্নি বৃষ্টি করল। কানের পাশ দিয়ে ঢুকে গেল সে গুলী। টেবিলের উপরই লুটিয়ে পড়ল সে। শব্দ হল পতনের।
মাহমুদ দ্রুত দরজা ঠেলে প্রবেশ করল ভিতরে, সঙ্গী দু’জনের মধ্যে একজন দরজায় পাহারায় থাকল, আর একজন মাহমুদের সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করল।
ঘরে ঢুকে মাহমুদ দেখল, ইসরাইল সশস্ত্র বাহিনীর সহকারী অধিনায়ক জেনারেল আব্রাহাম উঠে দাঁড়িয়েছে। তার চোখে উৎকণ্ঠিত দৃষ্টি, হাতে রিভলভার। কিন্তু তার রিভলভার উঠানোর সময় হলো না। মাহমুদের রিভলভার আর একবার অগ্নি উদগীরণ করল। জেনারেল আব্রাহামের কব্জি ভেদ করে তা বেরিয়ে গেল। জেনারেল আব্রাহামের বাম হাত টেবিলের নীচে নেমে যাচ্ছিল। মাহমুদের রিভলভারের আর একটি গুলী জেনারেল আব্রাহামের বাম বাহু ভেদ করল। চেয়ারে বসে পড়ল জেনারেল। মাহমুদ গর্জে উঠল, ‘যেমন আছেন ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে থাকুন। জানি এবার লেগ বক্সের বোতাম টিপে কনট্রোল রুমে নেমে যেতে চেষ্টা করবেন। পা নড়াবার চেষ্টা করলে তৃতীয় গুলীটি এবার আপনার বক্ষ ভেদ করবে।
জেনারেল আব্রাহামকে সামনে রেখে তার পিছু পিছু মাহমুদ কনট্রোল রুমে প্রবেশ করলো। মাহমুদের পিছনে প্রবেশ করল ওয়্যারলেস ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লা আমিন।
আবদুল্লা আমিন মিটার ইনডেক্স অনুসরণ করে ইসরাইলের বিভিন্ন গ্যারিসনের সাথে সংযোগ-চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করল। তারপর সে চ্যানেলগুলোকে হেড ট্রান্সমিটারের সাথে যুক্ত করল।
ওদিকে মাহমুদ প্রাক্তন দেশরক্ষা মন্ত্রী জেনারেল মোশে হায়ান ও প্রাক্তন সর্বাধিনায়ক জেনারেল রবিনের স্বাক্ষরকৃত বিবৃতি জেনারেল আব্রাহামকে দেখাল। তারপর আর একটি লিখিত বিবৃতি জেনারেল আব্রাহামের চোখের সামনে তুলে ধরে বলল, ‘এবার পাঠ করুন তো জেনারেল।’ বলে সে রেকর্ডার যন্ত্রের সুইচ অন করল। তারপর রিভলভারের নলটি জেনারেলের কপাল বরাবর তুলে ধরে বলল, এক আদেশ কিন্তু দু’বার করার মত সময় আমাদের নেই।
জেনারেল আব্রাহামের আহত হাত থেকে রক্ত ঝরছিল, কাঁপছিল সে। বোধ হয়ে বুঝল সে, সামনের ঐ লোকটি দু’বার আদেশ করার লোক নয়। বিবৃতিটি সে পাঠ করে গেল,
দেশের জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী পুতুল সরকারের পতন ঘটেছে। দেশপ্রেমিক শক্তি দেশের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছে। আমার রাজনীতি-নিরপেক্ষ সেনাবাহিনীকে সাময়িকভাবে অস্ত্র ত্যাগ করতে এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে আদেশ করছি।
মেসেজটি আবদুল্লা আমিন ট্রান্সমিট করল। রাত্রি তখন দশটা এগার মিনিটি।
মেসেজ ট্রান্সমিট করার ১ম ও ২য় মিনিটে জাফা ও হাইফা নৌ-ঘাঁটি থেকে খবর এল। একই ধরনের খবর, “প্রায় সকলেই বিভিন্ন আনন্দানুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে, ঘাঁটিগুলো প্রায় শূন্য। অজ্ঞাত পরিচয় একদল লোক ঘাঁটি দখল করেছে। ওরা কনট্রোল রুমে ঢুকতে চেষ্টা করছিল। এখন খুলে দিচ্ছি কনট্রোল রুম।” ৩য় মিনিটে তেলআবিব, লুদ, মাসাদা ও বিরশিবা বিমান ঘাঁটি থেকে খবর এল। তেলআবিব ও লুদ জানাল, “আমরা কিছু বুঝতে পারছি না। বাইরে গুলীর শব্দ শুনতে পাচ্ছি। শব্দ নিকটতর হচ্ছে ক্রমে। পাইলট ও অফিসার্স ব্যারাক শূন্য, ঘাঁটিতে রুটিন পেট্রোল শুধু কাজ করছিল।” মাসাদ ও বিরশিবা বিমান ঘাঁটি জানাল, রুটিন পেট্রোলের সাথে ছিটেফোটা সংঘর্ষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সমগ্র বিমানক্ষেত্র অজ্ঞাতনামা ব্যাক্তিদের দখলে। আমরা কনট্রোল রুম ছেড়ে যাচ্ছি।’
মাহমুদ তার নিজস্ব অয়্যারলেসে এখানকার খবর এবং প্রাপ্ত অন্যান্য খবর জানিয়ে দিল গ্রীণ লজের হেডকোয়ার্টারে আহমদ মুসাকে।
মাহমুদ যখন জেনারেল অফিসের দখল নিচ্ছিল, তখন এহসান সাবরির নেতৃত্বে আর একটি দল বিদ্যুৎগতিতে আঘাত হেনে প্রহরায় নিযুক্ত এক প্লাটুন সৈন্যের প্রতিরোধ চূর্ণ করে হেড কোয়ার্টারের আরসেনাল ফিল্ড দখল করে নিয়েছিল। আরসেনাল ফিল্ড অধিকারে ‘ডজি’ সম্প্রদায়ের সৈন্যদের মূল্যবান সহযোগিতা পেয়েছিল এহসান সাবরি।
অপরদিকে আবদুল্লা জাবেরের নেতৃত্বে সাইমুমের এক হাজার সদস্যের একটি দল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে সেনাবাহিনীর ব্যারাকসমূহ দখল করে নিয়েছিল। অধিকাংশ ব্যারাক প্রায় শূন্য ছিল। আর্মি, পুলিশ, পেট্রোল ও উপস্থিত অন্যান্য সশস্ত্র সৈন্য কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধের সৃষ্টি করলেও সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ কোথাও হয়নি। ব্যারাকে তিন হাজার ‘ডজি’ সম্প্রদায়ের সৈনিক কোন প্রতিরোধ করেনি। রাত্রি দশটা ত্রিশ মিনিটের মধ্যে সমগ্র ব্যারাক এলাকা সাইমুমের কর্মীসেনারা দখল করে নিয়েছিল। গ্যারিসনের এ্যাসেম্বলি হল ও ব্যারাক এলাকা থেকে রাত্রি সাড়ে দশটার মধ্যে তিন হাজার ইসরাইলি সৈন্য ধৃত হয়েছিল। শহরের ৪১ টি সিনেমা হল, ২৭টি নাট্যমঞ্চ, ১৭টি পাবলিক হল ও অন্যান্য অনুষ্ঠান এলাকা থেকে ১৭ হাজার সমরিক বাহিনীর লোকসহ মোট ৫০ হাজার ইসরাইলি যুবক গ্রেপ্তার হল। সাইমুমের ট্রাফিক ইউনিট ও লোকাল ইউনিটের হাতে গ্রেপ্তার হল আরও ১১ হাজার লোক।
রাত্রি ১০-৩০ মিনিটে তেলআবিব আর্মি গ্যারিসন থেকে সাইমুমের সাঁজোয়া বাহিনী বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত হয়ে তেলআবিবের রাস্তায় টহল দিতে শুরু করল। পাবলিসিটি স্কোয়াডের কাজও তখন শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় ঘোষণা করা হচ্ছে, ‘দেশের জনগণের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতাকারী পুতুল সরকারের পতন ঘটেছে। জনগণকে শান্তভাবে গৃহে অবস্থান করতে অনুরোধ করা হচ্ছে।’
ষ্ট্রেট এ্যাসেম্বলী হলে রাষ্ট্রপ্রধান থেকে শুরু করে পার্লামেন্ট ও মন্ত্রী সভার সদস্য, উর্ধ্বতন সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের সকলেই গ্রেপ্তার হয়েছে। তেলআবিবের পেটা ঘড়িগুলোতে আর রাত্রি ১২টা বাজার ঘন্টাধ্বনি শোনা গেল না। রাত্রি ১২টা বাজার আগেই গোটা তেলআবিব সাইমুমের হাতের মুঠোয় এসে গেল। সাইমুমের ১০ হাজার কর্মীসেনা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তেলআবিবে টহল দিয়ে ফিরছে।
রাত্রি এগারটা পঞ্চাশ মিনিটে আহমদ মুসা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে গ্রীনলজের অয়্যারলেস রুম থেকে বেরিয়ে এল।
অয়্যারলেস রুম থেকে বেরিয়ে সে প্রবেশ করল মিটিং রুমে। ওখানে বসেছিল সাইমুমের উপদেষ্টা পরিষদ। আহমদ মুসা তাদের সামনে সানন্দে ঘোষণা করল, ‘ভ্রাতৃবৃন্দ, আল্লাহর হাজার শোকর, ফিলিস্তিনের প্রতিটি শহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সাইমুম তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। সকল আর্মি গ্যারিসন, হাইফা ও ওজাফা নৌ-ঘাঁটির কামানশ্রেণী এখন আমাদের দখলে। সাবমেরিন ও যুদ্ধ জাহাজগুলোকে এখন নিয়ন্ত্রণ করছে সইমুমের নৌ-ইউনিট।’ দাঁড়িয়ে কথা বলছিল আহমদ মুসা।
বাইরে ষ্টার্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ী। আহমদ মুসা, আমিন আল আজহারি ও সাইমুমের ডিপ্লোম্যটিক করপসের প্রধান সোহায়েল আবদুল্লা গাড়ীতে আরোহন করলে বেতার-কেন্দ্র অভিমুখে তা যাত্রা শুরু করল।
রাত্রি ১২টা ১ মিনিট। ইসরাইল রেডিও থেকে ঘোষকের গম্ভীর কণ্ঠ ধ্বনিত হলো, ‘অন্যায়, অবিচার আর জুলুমের প্রতীক ইসরাইল সরকারের পতন ঘটেছে। ‘দানিয়েল এ্যারোন’-এর নেতৃত্বে নুতন জাতীয় সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে।’ উল্লেখ্য যে, ইহুদী সমাজে মাহমুদ ‘দানিয়েল এ্যারোন’ নামে পরিচিত।
এই ঘোষণার পরই জেনারেল হায়ান ও জেনারেল রবিনের বিবৃতি প্রচার করা হলো। বিবৃতিতে বলা হল,
“দেশের প্রকৃত মালিক জনসাধারণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাকারী সরকারকে উৎখাত করে এ দেশের যে নয়া সরকার, নয়া প্রশাসন ও নয়া ব্যবস্থার জন্ম হল, তার সাথে দেশের সশস্ত্র বাহিনী, দেশের জনসাধারণ এবং বিদেশে আমাদের শুভানুধ্যায়ী সকলের একাত্মতা রয়েছে। এই পরিবর্তন এই দেশ ও এই অঞ্চলের মানুষের জীবনে নিয়ে আসবে স্থায়ী শান্তি।’
বিবৃতি প্রচারের পর দানিয়েল এ্যারোন সরকারের পক্ষ থেকে কতিপয় নির্দেশ ও ঘোষণা প্রচার করা হল,
(১) পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বলবত থাকবে।
(২) পরবর্তী আদেশ ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত দেশের সকল অফিস-আদালত ও কল-কারখানা বন্ধ থাকবে।
(৩) দেশের সকল নৌ ও বিমান বন্দর অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
(৪) আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে সকল বিদেশীকে দেশত্যাগ করতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর নিজস্ব বিমানে তাদেরকে নিকটতম কোন রাজধানীতে পৌঁছে দেয়া হবে।
(৫) বৈদেশিক মিশনের সকলকে তাদের নিজস্ব এলাকায় অবস্থান করতে বলা হচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহ তারা নিয়মিত পাবে।
(৬) দেশের বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক নীতিসমূহ অপরিবর্তিত থাকবে। এ সম্পর্কীত র্পূববর্তী সকল চুক্তি ও প্রতিশ্রুতিসমূহের মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখা হবে।
রেডিও থেকে মাঝে মাঝে উপরোক্ত বিবৃতি ও ঘোষণা প্রচার হতে থাকল। এরই মাঝে উদিত হল ২৮শে ফেব্রুয়ারীর সূর্য। এই সূর্য লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনবাসীর জীবনে নিয়ে এল নতুন দিন নতুন ভবিষ্যত।
৮
৭ ই মার্চ। সাইমুমের অভ্যূত্থানের পর ১১ দিন পার হয়ে গেছে। এই ১১ দিনে ওলট পালট হয়ে গেছে ইসরাইলের চেহারা। দু’যুগেরও বেশী আগে যে সব ফিলিস্তিনি দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল, তারা সকলেই ফিরে এসেছে দেশে। সাইমুমের এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন স্কোয়াড নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে। অফিস-আদালত ও কল-কারখানায় এবং কৃষিক্ষেত্রে ফিলিস্তিনের আদি ইহুদী বাসিন্দাদের অধিকারে কোন হস্তক্ষেপ করা হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যেসব ইহুদী ফিলিস্তিনে এসেছে, তাদেরকে অফিস-আদালত ও কল-কারখানা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। ফিলিস্তিনে অবাঞ্ছিত বহিরাগত হিসেবে তাদের গণ্য করা হয়েছে। ইলাতের নিকটবর্তী দুর্গম পার্বত্য এলাকার আশ্রয় শিবিরে ইসরাইলের পাঁচ লক্ষ সামরিক, আধাসামরিক ও উগ্র যুবশক্তিকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। সাইমুম এদের কে জিম্মি হিসেবে রেখেছে। ফিলিস্তিনের জাতীয় সরকারের ওপর বাইরের ইহুদী মুরব্বীদের প্ররোচনায় বাইরে থেকে কোন আঘাত এলে এদের ওপর আঘাত হানা হবে। বিদেশী ইহুদী মুরুব্বীদের ষড়যন্ত্রের পাল্টা উত্তর হিসেবে এদের কে ব্যবহার করবে সাইমুম।
এই ১১ দিনে সাইমুম ফিলিস্তিন জাতীয় সরকারের সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছে। সাইমুমের কর্মীসেনাসহ ফিলিস্তিনের পাঁচ লক্ষ মুসলিম যুবককে নিয়ে এ সেনাবাহিনী গঠিত হয়েছে। ফিলিস্তিনকে একটি অস্ত্রাগারে পরিণত করেছিল ইসরাইলিরা। সুতরাং অস্ত্রের অভাব হয়নি। সউদি আরব, জর্দান ও লিবিয়ার বিমান বাহিনী ও নৌ-বাহিনীর অফিসার ও ক্রুদের সঙ্গোপনে ফিলিস্তিনে আনা হয়েছে। তারা ফিলিস্তিন জাতীয় সরকারের বিমান ও নৌ-বাহিনীকে র্পূণ কর্মক্ষম করে তুলেছে। মিসর, পাকিস্তান ও ইরান থেকে আণবিক বিশেষজ্ঞদের আণবিক গবেষণা ও পরীক্ষা কেন্দ্র নেগিও মরুভূমির ডেমনায় আনা হলো।
আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর অফিস-আদালত ও কল-কারখানার কাজ শুরু করা হলো।
এরও ৭ দিন পর ডেমনার ১১টি আণবিক বোমাকে ব্যবহারোপযোগী করে তোলা হল এবং মূহূর্তের নোটিশে তা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারবে এমন প্রস্তুতি সম্পন্ন হবার পর বিমান ও নৌ-বন্দর খুলে দেয়া হলো। কিন্তু অনুসৃত আভ্যন্তরীণ নীতি সম্পর্কে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হলো। প্রচার নয়, দ্রুত কাজ-এই নীতি গ্রহণ করল সাইমুম নিয়ন্ত্রিত নতুন জাতীয় সরকার। ঘটনা প্রবাহের স্বাভাবিক বিকাশের ফলে যেটুকু প্রকাশ পায়, তার বেশী কিছু প্রকাশ করতে চায় না সরকার।
অভ্যুত্থানের দিন সাতেক পর চীন ও ফ্রান্সসহ অধিকাংশ আফ্রিকা, এশিয়া ও পশ্চিম ইউরোপীয় দেশের স্বীকৃতি পাওয়া গেল। তবে মুসলিম দেশগুলো বোধগম্য কারণেই ফিলিস্তিনে জাতীয় সরকার সম্পর্কে কঠোর নীরবতা পালন করছে। তাদের এই নীরবতার ফলে ফিলিস্তিন বিপ্লবের সঠিক প্রকৃতি সম্পর্কে মুসলমানদের চিহ্নিত শত্রুরা কিছু আঁচ করতে সমর্থ হলো না।
জাতিসংঘ মিশন ও বিদেশী সাংবাদিকদের রিপোর্ট থেকে ফিলিস্তিনের নতুন সরকার সম্পর্কে বাইরে যে ধারণা দাঁড়াল তা হল, ইসরাইলের নতুন সরকার একটি আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদী সরকার। ইহুদী, খৃস্টান ও মুসলমান সকলেই সেখানে সমান অধিকার লাভ করবে। ফিলিস্তিনের লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা মুসলমান তাদের পূর্বের বাস্তু-ভিটা ফিরে পাচ্ছে। অপরদিকে লক্ষ লক্ষ বহিরাগত ইহুদী তাদের নাগরিক অধিকার হারিয়ে উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হলো বিশ্বের রাজধানীগুলোতে। একমাত্র দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়া আফ্রিকা ও এশিয়ার প্রত্যেকটি দেশ ফিলিস্তিন জাতীয় সরকারের নীতি সমর্থন করল। অভিনন্দিত হলো সরকার। এই সময় মুসলিম দেশগুলো প্রায় এক সাথে ফিলিস্তিন সরকারকে আনুষ্ঠনিকভাবে স্বীকৃতি জ্ঞাপন করল।
বৃটেন নতুন সরকারের সমালোচনা করল এবং নতুন ইহুদী উদ্বাস্তু সমস্যার দিকে জাতিসংঘের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। সোভিয়েত ইউনিয়ন নীরবতা অবলম্বন করল। বোঝা গেল, কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছে সোভিয়েত সরকার। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ঘটল আমেরিকায়। ভীষণ হৈ চৈ শুরু হলো সেখানকার ইহুদী সার্কেলে। কিন্তু ফিলিস্তিনের নতুন সরকার প্রশ্নে মার্কিন সিনেট ও কংগ্রেস ও সিনেটের একটি শক্তিশালী গ্রুপ মার্কিন ইহুদীদের ইসরাইল নীতির তীব্র সমালোচনা করল। তারা পরিষ্কার ভাবে জানাল, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে আর তারা ইহুদীদের হাতের পুতুল সাজতে দিবে না। ইহুদী স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আর তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহৃত হতে দিবে না।” মার্কিন ইহুদীদের তারা আরও পরামর্শ দিল, হৈ চৈ করে ইহুদী উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান করা যাবে না। যেমন করে বিশ্ব ইহুদী মুরুব্বীরা ফিলিস্তিনে ইহুদী রপ্তানী করেছিল, ঠিক তেমনি ভাবেই উদ্বাস্তু ইহুদীদের সেখান থেকে ফিরিয়ে আনা উচিত। অথবা ফিলিস্তিনি আরব মুসলমানদের সেই আবাসভূমিতে বিশ্বস্ত পড়শী সেজে বসবাস করার মানসিকতা ইহুদীদের সৃষ্টি করতে হবে।
[২০০৯ সালে ইরা পাবলিকেশন্স এর আন্ডারে প্রকাশিত হয় সাইমুম সমগ্র-১। সেখানে প্রথম তিনটি বই দেয়া হয়। তার সাথে ফিলিস্তিনের উপর লেখা নতুন একটি কাহিনী আবার তেলআবিবে শিরোনামে অপারেশন তেলআবিব–২ এর পর যোগ করা হয়।
সেই আবার তেলআবিবে অংশটি এখানে দেয়া হল।]
৯
মিটিং কক্ষটি পূর্ণ। ওভাল টেবিলটির ১১টি চেয়ারের কোনটাই খালি নেই। এক্সিট দরজাগুলোর সবগুলোই বন্ধ।
ইসরাইল থেকে পালিয়ে আসা ইসরাইল সরকারের আপাতকালীন প্রবাসী মন্ত্রীসভার বৈঠক। দেয়ালে টাঙানো ইসরাইল রাষ্ট্রের মানচিত্রের নিচে বিশেষ চেয়ারটায় বসেছেন প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটন। তার ডান পাশে বসেছেন নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রজার রবিন আর বাম পাশে সিকিউরিটি ও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের (সিনবেথ) চীফ জেনারেল শামিল এরফান। এ ছাড়াও অন্যান্যের মধ্যে রয়েছেন বিদেশে গোয়েন্দা কর্মের (মোসাদ) প্রধান মেজর জেনারেল লুইস কোহেন, মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সের (শেরুত মোদিন) নতুন প্রধান জেনারেল দানিয়েল দোরিন এবং সশস্ত্র বাহিনীর নতুন প্রধান আইজ্যাক এ্যারন।
বৈঠক শুরু হয়ে গেছে।
বৈঠকের শুরুতে নতুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রজার রবীন বৈঠক সম্পর্কে ব্রীফ করে বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্ত্রীসভাকে ব্রীফ করবেন। ঘোষণা দেয়া হলো, মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ, এখন ব্রীফ করছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী:
আষাঢ়ের পানি ভরা মেঘের মত ভারী প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটকের মুখ। সে আগেই নড়েচড়ে বসেছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর কণ্ঠ থামতেই মুখ খুলে গেল প্রধানমন্ত্রীর।
কথা শুরু করল ইসরাইল থেকে পালিয়ে আসা আপাতকালীন মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক, ‘মন্ত্রীসভার সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, প্রিয় বন্ধুগণ, আপনারা ইসরাইল দখলকারী ফিলিস্তিন সরকারের ঘোষণা শুনেছেন। আমাদের ইসরাইল সরকারের অধীনে বিদেশ থেকে এসে ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করা লাখ লাখ ইহুদি রাতারাতি তাদের বাড়ি-ঘর, সহায়-সম্পত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুর অধিকার হারিয়েছে। তারা যে দেশ থেকে এসেছে সে দেশে চলে যাওয়া তাদের দায়িত্ব বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এতবড় অন্যায়ের কেউ প্রতিবাদ করল না। শুধু বৃটেন উদ্বাস্তুদের জন্যে তার উদ্বেগের কথা জাতিসংঘকে জানিয়েছে। সোভিয়েট ইউনিয়ন একটি কথাও উচ্চারণ করেনি, যদিও সেখান থেকেই বেশি ইহুদি এসেছে ফিলিস্তিনে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা। সেখানে সরকারের কেউ কেউ ইসরাইলের পক্ষ নিলেও কংগ্রেস ও সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মার্কিন সরকার ইসরাইলের পক্ষ নেয়ার ঘোরতর বিরোধীতা করেছে। এমনকি লাখ লাখ ইহুদি উদ্বাস্তু হওয়া এবং তাদেরকে তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানোর ভয়ংকর সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করতে তারা নারাজ। আমি সিনেট ও কংগ্রেসের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু নেতাদের সাথে কথা বলেছি, অনুরোধ করেছি। কিন্তু তারা যেন রাতারাতিই পাল্টে গেছে। তারা বলেছে, ইসাইল রাষ্ট্র ও এক শ্রেণীর ইহুদির বাড়াবাড়ির কারণে আজ যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমরা কিছু করতে অপারগ। এখানে প্রায় সব দেশপ্রেমিক আমেরিকানের মত হলো, একশ্রেণীর ইহুদিরা লাখ লাখ ফিলিস্তিনবাসিকেই শুধু অর্ধ সহস্র বছরের বেশি সময় ধরে উদ্বাস্তু করে রাখেনি, আমেরিকানদের ওপরও ছড়ি ঘুরাচ্ছে। আইনানুগ আমেরিকানরা এটা মেনে নিয়েছে আইনের প্রতি শ্রদ্ধার কারণে, কিন্তু ইসরাইলকে সহায়তা করতে তারা রাজি নয়। তাদের এই চূড়ান্ত কথা শোনার পর তাদেরকে বলার আর কিছু অবশিষ্ট নেই। আমি যোগাযোগ করেছিলাম আমেরিকায় ইহুদিদের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান ‘কাউন্সিল অব জুইস এসোসিয়েশন অব আমেরিকা’র নেতৃবৃন্দসহ ইহুদি ধর্মীয় সমিতিগুলোর নেতাদের সাথেও। কাউন্সিলের নেতৃবৃন্দ আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু আমেরিকানদের যে সেন্টিমেন্ট, তাতে এই সময় কিছু করা সম্ভব নয় বলে তারা জানিয়েছে। তারা বলছে এই সময় কিছু করতে গেলে কাউন্সিল ও এসোসিয়েশনগুলো বিপদে পড়তে পারে। কিছু করা গেলেও তার জন্যে সময় চাই বলে তারা জানিয়ে দিয়েছে। ধর্মীয় সমিতির ধর্ম নেতাদের সাথে আলাপ করেছি। তারা আমেরিকানদের চেয়ে আমাদের প্রতি বেশি বিক্ষুব্ধ ও আক্রমণাত্মক। তারা নির্লজ্জের মত একথা স্পষ্ট করেই বলেছে যে, ইসরাইল ও জায়নবাদীদের রাজনৈতিক অভিলাষের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মভীরু ও নিরপরাধ ইহুদিরাও আজ বিপদের মুখে পড়েছে। ইসরাইলের পক্ষ নিয়ে তারা আর বিপদ বাড়াতে চায় না। এই হলো আমাদের স্বজাতিদেরও কথা। অর্থাৎ এখন আমাদের কোন বন্ধু নেই। সামরিক সাহায্য দূরের কথা অর্থনৈতিক সাহায্যও কারও কাছ থেকে পাওয়ার আশা নেই। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রসহ জাতিসংঘও একথা মনে করতে চাচ্ছে যে, ইসরাইলে যা ঘটেছে সেটা ক্ষমতার ইন্টারন্যাল পরিবর্তন। ইসরাইলে ক্ষমতা দখলকারী ফিলিস্তিন সরকার ফিলিস্তিন স্থানীয় ইহুদী ও খৃষ্টানদের সমর্থন যোগাড় করে এই ইমেজই দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিতে চাইছে। এই চালাকির প্রতি সমর্থন দিয়েই আমাদের বন্ধুরাও বলছে, ইসরাইলে ফিলিস্তিনিদের অভ্যুত্থানে বিদেশী সাহায্য বা বিদেশী সৈন্যের কোন অংশগ্রহণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তারা আরও বলছে, এই ঘটনায় আরব রাষ্ট্রগুলোও খুব উৎসাহ দেখায়নি, এমনকি তাদের কেউ স্বীকৃতিও দেয়নি ইসরাইলের ফিলিস্তিন সরকারের প্রতি। এসব যুক্তি তুলেই আমাদের বন্ধু দেশগুলো আমাদের এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে। এই অবস্থায় যা করতে হবে আমাদেরকেই করতে হবে।
বলে থামলো আপাতকালীন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক। থেমেই আবার বলে উঠলেন, কি করতে হবে এ সম্পর্কে আপনাদের চিন্তা আপনারা বলুন।
সবার মধ্যে একটা নড়াচড়ার ভাব পরিলক্ষিত হলো। নড়েচড়ে বসল সবাই।
কিন্তু সবাই চুপ-চাপ।
মুখ খুলল প্রথমে মন্ত্রীসভার জুনিয়র সদস্য পুনর্বাসন-পুনর্গঠন মন্ত্রী ইসরাইল আবা ইবান। বলল সে, আমরা যে যুদ্ধে জেতার কথা, সে যুদ্ধে জিতিনি, দেশকে আমরা রক্ষা করতে পারিনি। এখন দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। তারা আকারে ছোট শক্তি ছিল বলে অ্যাসেট্রিক ওয়ার (হিট এন্ড রান, গোপন তৎপরতা, ইত্যাদি) এর মাধ্যমে ওরা আমাদের পরাজিত করেছে। এখন আমরা ছোট শক্তি হয়ে পড়েছি, আর ওরা বড়। আমাদেরকে এখন ‘অ্যাসিমেট্রিক ওয়ার’-এর পথ গ্রহণ করতে হবে।
থামল তরুণ মন্ত্রী আবা ইবান।
প্রধানমন্ত্রী শার্লটক অন্যদের দিকে তাকাল। সকলেই ইসরাইল আবা ইবানের যুক্তি ও মত সমর্থন করল।
সবশেষে কথা বলার পালা দেশরক্ষামন্ত্রী রজার রবিনের। তিনি কোন মত প্রকাশ না করে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, এবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলবেন।
বলতে শুরু করল প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক, ‘ইশ্বরকে ধন্যবাদ যে, ‘আমরা সকলে এক ভাবেই ভাবছি। আপনারা শুনে খুশি হবেন, যে যুদ্ধের কথা আপনারা বলেছেন, সেই যুদ্ধ আমরা শুরু করেছি। প্রথম আক্রমণ হিসেবে ইসরাইল দখলকারী ফিলিস্তিন প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ ও তার স্ত্রীকে কিডন্যাপ করার সব ব্যবস্থা আমরা সম্পন্ন করেছি। আজ জেরুসালেমে ওদের মসজিদুল আকসায় শোকরানা দিবসের সমাবেশ। সেখানে ওদের প্রধান মাহমুদ সস্ত্রীক আসবে। তাকে সস্ত্রীক কিডন্যাপ করা হবে। আমাদের গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের একটা অংশ অক্ষত আছে। তারাই এগিয়ে এসেছে বড় এই দায়িত্ব পালনে। সাফল্য সম্পর্কে আমি আশাবাদী।
থামলো স্যামুয়েল শার্লটক।
ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর মুখ তুলে বলল, অনুষ্ঠান ঘণ্টা দুই আগে শেষ হওয়ার কথা। তার মানে আমাদের মিশন বাস্তবায়নের কাজ কমপক্ষে দু’ঘণ্টা আগে শুরু হয়েছে। কোন একটা খবর খুব শীঘ্রই আমরা পাব।
‘আমিন। জিহবা আমাদের সাহায্য করুন।’ প্রধানমন্ত্রীর কথার মধ্যেই সবাই এক বাক্যে এই প্রার্থনা বাক্য উচ্চারণ করল।
থেমে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক।
সবার প্রার্থনার কণ্ঠ থেমে যেতেই সেই তরুণ মন্ত্রী ইসরাইল আবা ইবান বলল, কিন্তু মাত্র কিডন্যাপই সাফল্য নয়, এই কিডন্যাপ দিয়ে আমরা কি করতে চাচ্ছি, এ নিয়ে আমরা নিশ্চয় কিছু ভেবেছি।
থ্যাংক ইউ ইয়ংম্যান, উপযুক্ত জিজ্ঞাসাই তোমার মনে জেগেছে।
একটু থামল প্রধানমন্ত্রী। পরমূহুর্তেই বলতে শুরু করল আবার, প্রধানমন্ত্রী দম্পতিকে জিম্মি বানিয়ে আমরা দাবি করবো: এক. ফিলিস্তিন সরকারকে ইসরাইল ত্যাগ করে জর্দান নদীর পশ্চিম তীর ও গাজা এলাকায় সরে যেতে হবে, দুই. সকল ইহুদি উদ্বাস্তুকে অবিলম্বে ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রসের হাতে ছেড়ে দিয়ে ইসরাইলে তাদের স্ব স্ব বাড়ি ও সম্পত্তিতে ফিরে যাবার সুযোগ দিয়ে তাদের পুনর্বাসন করতে হবে এবং তিন. অবৈধ দখলদার সরকারকে স্বীকৃতি না দিয়ে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে।
থামল প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু এই ধরনের কিডন্যাপের ঘটনা ও এইসব শক্ত দাবি-দাওয়া করে আমরা আমাদের টিকিয়ে রাখব কেমন করে? ছোট্ট তোয়া দ্বীপ তখন সবার চোখে পড়ে যাবে। এই কিডন্যাপকে দুনিয়ার কেউ সমর্থন করবে না, আমাদের বন্ধুরাও নয়। এই অবস্থায় আমরা দাবি-দাওয়া করে আমরা আমাদের টিকিয়ে রাখব কেমন করে? ছোট্ট তোয়া দ্বীপ তখন সবার চোখে পড়ে যাবে। এই কিডন্যাপকে দুনিয়ার কেউ সমর্থন করবে না, আমাদের বন্ধুরাও নয়। এই অবস্থায় আমাদের দাবি-দাওয়া আদায় তো দূরের কথা, আমাদের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে। স্যার নিশ্চয় এটা চিন্তা করেছেন। তাই আমি কিছু বুঝতে পারছি না স্যার। বলল অর্থ বিভাগের জন্যে দায়িত্বশীল মন্ত্রী তরুণ অর্থনীতিবিদ শিমন সুলেমান।
শিমন সুলেমান থামতেই প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক বলল, শিমন, তুমি যে পরিণতির বিষয় সামনে এনেছ, তা অবশ্যই ভাবনার বিষয় যদি কিডন্যাপের ঘটনা তোয়া থেকে আমরা ঘটাই। কিন্তু কিডন্যাপ তো আমরা করছি না। তোয়া এবং আমরা এই কিডন্যাপের সাথে জড়িত নই। কিডন্যাপের পরপরই ইসরাইলের এক ঠিকানা থেকে মিডিয়াকে জানানো হবে, ‘ইসরাইল পিপল আর্মি’ (আইপিএ) এই কিডন্যাপের ঘটনা ঘটাতে বাধ্য হয়েছে তিনটি ন্যায্য দাবি আদায়ের লক্ষ্যে। সুতরাং কিডন্যাপের দায় ইসরাইল পিপল আর্মির ঘাড়ে গিয়ে বর্তাবে। অতএব তোয়া কিংবা আমাদের কোন পরিণতি নিয়ে ভাববার কিছু নেই।
কথা বলার জন্যে হাত তুলেছিল ইসরাইলের তরুণ মন্ত্রী আবা-ইবান।
কিন্তু দেশরক্ষা মন্ত্রীর সামনে রাখা ওয়ারলেসটা ‘বিপ’ ‘বিপ’ সংকেত দিতে শুরু করল।
‘এক্সকিউজ মি অল’ বলে দেশরক্ষা মন্ত্রী রজার রবীন ওয়ারলেসটা তুলে নিয়ে ঘরের এক পাশে সরে গেল। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা।
ওয়ারলেসে কোন কথা বলল না। নীরবে ওপারের কথা শুনে ‘থ্যাংকস’ দিয়ে ওয়ারলেস বন্ধ করে দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর কাছে এল।
সবার দৃষ্টি দেশরক্ষা মন্ত্রীর ওপর নিবদ্ধ।
দেশরক্ষা মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে কানে কানে কিছু বলে ফিরে এসে বসল তার চেয়ারে।
প্রধানমন্ত্রীর মুখটা প্রথমে কিছুটা ম্লান হয়ে গেলেও পরে স্বাভাবিক হয়ে এল।
উদ্বেগ দেখা দিল উদগ্রীবভাবে অপেক্ষমান মন্ত্রীদের মনে। মিশন কি তাহলে ব্যর্থ হয়েছে।
মন্ত্রীদের সবার চোখ এবার প্রধানমন্ত্রীর মুখের উপর নিবদ্ধ।
প্রধানমন্ত্রী একটু নড়েচড়ে বসল।
মুখ তুলল। বলতে শুরু করল, ‘প্রিয় সহকর্মীবৃন্দ, আপনাদের উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। উদ্বেগের কিছু নেই। আমরা হানড্রেড পারসেন্ট চাই বটে, কিন্তু সবক্ষেত্রে হানড্রেড পারসেন্ট পূরণ হয় না। কিডন্যাপ মিশন আমাদের সফল হয়েছে। তবে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রীকে আমরা পাইনি। সেদিন সে প্রার্থনা সভায় প্রধানমন্ত্রী হাজির থাকতে পারেননি। তবে প্রধানমন্ত্রী মাহমুদকে না পেলেও তাঁর স্ত্রী এমিলিয়া এবং বায়তুল আকসা মসজিদের খতিব ও ফিলিস্তিন আন্দোলনের সাইমুমের আধ্যাত্মিক নেতা শেখুল ইসলাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান দির ইয়াসিনি এই দু’জনকে কিডন্যাপ করা হয়েছে এবং এতক্ষণে তাদের ইসরাইলের বাইরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে বলে আশা করা হচ্ছে।
লং লিভ ইসরাইল। মিশন সাকসেসফুল। প্রধানমন্ত্রী মাহমুদের দরকার নেই। তাঁর স্ত্রী এমিলিয়া কিংবা শেখুল ইসলাম আব্দুল্লাহকে হাতে পাওয়াই যথেষ্ট ছিল। জিহবাকে ধন্যবাদ যে, দু’জনকেই পাওয়া গেছে। এটা সোনায় সোহাগা। বলল কয়েকজন তরুণ মন্ত্রী সমস্বরে।
যে উদ্দেশ্যে কিডন্যাপ করা সেই চাপ যাতে কার্যকরী হয়, সেটাই এখন নিশ্চিত করতে হবে। ইউরোপ ও আমেরিকার প্রেসের সাহায্য আমরা পাব আশা করছি। কিডন্যাপের সমালোচনা হবে, কিন্তু সেই সাথে বিশ্বের দৃষ্টি ও মনোযোগের ফোকাস আমাদের ওপর কেন্দ্রীভূত হবে। এটাই আমরা চাই। বিশ্বের মনোযোগ আমরা আমাদের দিকে আকৃষ্ট করতে চাই। তার সাথে আমরা সমবেদনাও কিছু পাব। বলল প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক।
ভালো ফল নির্ভর করছে দীর্ঘদিন তাদের ধরে রাখতে পারার উপর। আমরা সেটা পারছি কিনা এটাই বড় কথা। বন্দীদের কোথায় রাখা হবে, আমরা জানতে চাইবো না। কিন্তু আমরা জানতে চাচ্ছি, যেখানেই আমরা তাদের রাখি, তারা যেন পালাতে না পারে বা উদ্ধার হতে না পারে, আবার তাদের কোন বড় ক্ষতিও না হয় সবই আমরা নিশ্চিত করতে পারছি কিনা। বলল তৃতীয় একজন তরুণ মন্ত্রী।
এসব বিষয় আমরা আগেই ভেবেছি। সব ভেবেই আমরা স্থান বাছাই করেছি যার চেয়ে কোন নিরাপদ স্থান এখন আমাদের হাতে নেই।
প্রধানমন্ত্রী থামলো।
কোন সিনিয়র মন্ত্রী কথা বলছেন না। সবাই গম্ভীর। দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তারা জানেন এমন পরিস্থিতিতে কি করতে হয়, কি হচ্ছে। তারা ভালোভাবেই অবহিত যে, তারা কি বিপদ, কি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং তাদের সামনে সমস্যা কি, সম্ভাবনাই বা কি। এজন্যে তাদের মনে প্রশ্নের চাইতে ভাবনার ভাবটাই বেশি।
প্রধানমন্ত্রীর কথা শেষ হতেই চতুর্থ একজন তরুণ মন্ত্রী বলল, এক্সকিউজ মি স্যার, আমি জানতে চাচ্ছি কিডন্যাপের ঘটনা প্রকাশ হওয়ার পর বাইরের দুনিয়ার চাপ থেকে আমাদের ‘তোয়া’ এবং আমরা কতটা নিরাপদ থাকব? ইসরাইল সরকার যে তার অন্তবর্তীকালীন রাজধানী তোয়া দ্বীপে স্থাপন করেছে, এটা অন্তত পাশ্চাত্যের সবাই ইতিমধ্যে জেনে গেছে। কিডন্যাপের দায় বাইরের দুনিয়া আমাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা করবে কিনা?’
জরুরি একটা বিষয় বলেছ ইয়ংম্যান, বলতে শুরু করল প্রধানমন্ত্রী, তবে এ ব্যাপারে আমাদের ভূমিকা আমরা ঠিক করেই রেখেছি। কিডন্যাপের ঘটনা প্রচার হওয়ার সাথে সাথে আমরা এ ঘটনার সাথে আমাদের সম্পর্ক থাকার কথা অস্বীকার করব। আমরা বলব, এ্যাফেকটেড হয়েছে এমন অনেক গ্রুপ আছে, তাদেরই হট হেডেড কেউ এই কাজ করেছে। কিডন্যাপাররা যে দাবি করেছে, সেসব দাবি ইসরাইল সরকার আগেই ঘোষণা করেছে। এসব দাবি অবিলম্বে পূরণ হোক, এসব দাবি পূরণে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মহল আমাদের সাহায্য করুন আমরা এটা চাই, কিন্তু কিডন্যাপারদের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই। আর একটা কথা, ইউরোপ ও আমেরিকার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এই বিপদে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি ঠিক, কিন্তু আমাদের আশ্রয়স্থল, বর্তমান রাজ্য ও রাজধানী তোয়া দ্বীপ রক্ষায় তারা আমাদের সাহায্য করবে। তারা এ প্রতিশ্রুতি আমাদের দিয়েছে। এমনকি তোয়ার তিন পাশে আরও কয়েকটি দ্বীপ আছে, যার সর্বমোট আয়তন দুই হাজার বর্গমাইল, এ দ্বীপেও আমাদের অধিকারের তারা গ্যারান্টি দিয়েছে। এসব দ্বীপের কোনটির ওপর সাইপ্রাস, কোনটির ওপর বৃটিশ মালিকানার দাবি ছিল। তারা সে দাবি ছেড়ে দিয়েছে। তারা এও নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, প্রায় তিন হাজার বর্গমাইলের দ্বীপ এলাকা নিয়ে আমরা একটা প্রবাসী ইসরাইল রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারি। সুতরাং আমাদের পায়ের তলায় মাটি আছে, আপনারা নিশ্চিত থাকুন।
থামল প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু স্যার যে দুই হাজার বর্গমাইলের দ্বীপমালার কথা বললেন, সেখানে তো সাইপ্রিয়ট ও বৃটিশ জনবসতি আছে, তাদের কি হবে? বলল শিমন সুলেমান।
এটা সমস্যা ছিল, কিন্তু তারও সমাধান হয়ে যাচ্ছে। সাইপ্রাস ও বৃটেন উভয়েই তাদের লোক সরিয়ে নিচ্ছে বিকল্প জায়গায়। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই দ্বীপগুলো আমাদের দখলে আসবে। প্রধানমন্ত্রী বলল।
ধন্যবাদ স্যার দুঃখের মধ্যেও বড় একটা শুভ সংবাদের জন্যে। আরেকটা বিষয় স্যার, আমাদের এই তোয়া দ্বীপে কয়েকটা আইন-শৃঙ্খলা বিরোধী গ্রুপ আছে যারা ইহুদি বংশোদ্ভুত হলেও জাত ক্রিমিনাল। এরা ইতিমধ্যেই কয়েকটা ঘটনা ঘটিয়েছে, যাদের দ্বারা আমাদের সরকারি লোকরা পর্যন্ত আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দরকার। বলল পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন মন্ত্রী ইসরাইল আবা ইবান।
ধন্যবাদ ইবান বিষয়টা উত্থাপন করার জন্যে। ঘটনাগুলো এবং তাদের বিষয়টা জেনারেল শামিল এরফান ইতিমধ্যেই আমার নজরে এনেছেন। আমি নির্দেশ দিয়েছি তাদের ওপর চোখ রাখা এবং তাদের ব্যাপারে সব তথ্য সংগ্রহ করতে। এ্যাকশনে যাওয়ার আগে যদি তাদের সব ব্যাপার জানা যায় তবে তাদের সমূলে উপড়ে ফেলা যায়। তবে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নিয়ে আমাদের সকলকে ধৈর্যের সাথে এগোতে হবে। এখনই এই সময়ে ভাল-মন্দ সবার সহযোগিতা আমাদের দরকার।
এবার দেশরক্ষা মন্ত্রী রজার রবীনের ওয়ারলেস সংকেত দিয়ে উঠল।
‘এক্সকিউজ মি অল’ বলে ওয়ারলেস নিয়ে ঘরের এক পাশে সরে গেল।
এবারও সে ওপারের কথা শুনে কোন কথা না বলে ধন্যবাদ দিয়ে ওয়ারলেস বন্ধ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরে এল। বলল কানে কানে কিছু কথা। তারপর ফিরে এসে বসল সে তার চেয়ারে।
প্রধানমন্ত্রীর চোখে আনন্দের উজ্জ্বলতা ফুটে উঠেছে।
সবার দৃষ্টি প্রধানমন্ত্রীর দিকে।
প্রধানমন্ত্রী মুখ খুলল। বলল, প্রিয় সহকর্মী বন্ধুগণ, আমাদের মিশন সব ঝুঁকি পেরিয়ে নিরাপদ অবস্থার মধ্যে এসে গেছে। মিশন এখন জিম্মিদের নিয়ে তাদের যেখানে রাখা হবে, সেদিকে এগোচ্ছে। সবাই প্রার্থনা করুন মিশনের বাকি অংশটুকুও যেন নিরাপদ হয়।
একটু থামল প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক। তার পরেই বলে উঠল, মন্ত্রীসভার সম্মানিত সদস্যবৃন্দ মন্ত্রীসভার আজকের বৈঠকের এখন মুলতবি হচ্ছে। সবাইকে ধন্যবাদ।
উঠে দাঁড়াল প্রধানমন্ত্রী স্যামুয়েল শার্লটক।
তার সাথে উঠে দাঁড়াল সবাই।
গাজায় সাইমুমের একটা আঞ্চলিক সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন আহমদ মুসা।
বক্তৃতার তখন পিক আওয়ার।
হলভর্তি সাইমুমের শ্রোতা। পিনপতন নীরবতা।
পকেটের মোবাইল আবারো বেজে ওঠল আহমদ মুসার বেসুরো আওয়াজে। আরো কয়েকবার বেজেছে এর আগে। তখন এ্যাভয়েড করেছে।
এবার আর কল রিজেক্ট করল না আহমদ মুসা।
বক্তৃতা অব্যাহত রেখেই আহমদ মুসা এক হাত দিয়ে মোবাইল বের করে স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে দেখল ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মাহমুদের পিএস-এর টেলিফোন। কোন জরুরি খবর বা মেসেজ না থাকলে আহমদ মুসাকে তার টেলিফোন করার কথা নয়।
কল রিসিভিং বাটনে চাপ দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে আহমদ মুসা মোবাইল কানের কাছে তুলে নিল।
‘হ্যালো’ বলে আহমদ মুসা সাঁড়া দিতেই ওপার থেকে মাহমুদের পিএস ড. আব্দুল্লাহ আকরামের কম্পিত, ভাঙা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। সালাম দিয়ে বলল, স্যার, ম্যাডাম এমিলিয়া কিডন্যাপড হয়েছে, তার সাথে কিডন্যাপড হয়েছে বায়তুল আকসার মহামান্য খতিব শেখুল ইসলাম শেখ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান দির ইয়াসিনি।
বলছ কি তুমি! কখন ঘটল? কি করে ঘটল? কোথায় ঘটল? মাহমুদ কোথায়? ঝড়ের মত প্রশ্নগুলো উচ্চারিত হলো আহমদ মুসার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে।
‘স্যার, আপনি জানেন জেরুসালেমে মসজিদুল আকসায় আজ শোকরানা দিবস উপলক্ষে দোয়ার অনুষ্ঠান ছিল। দোয়ার অনুষ্ঠান শেষে মানুষ যখন ফেরার মুখে ছিল, ম্যাডামসহ খতিব সাহেবানরা যখন গাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন, তখন অনেকগুলো বোমার বিস্ফোরণ হয়, গুলী-গোলাও হয়। এরই মধ্যে তারা কিডন্যাপড হন। বলল ড. আব্দুল্লাহ আকরাম।
মাহমুদের কি খবর, অনুষ্ঠানে তো তারও যাওয়ার কথা ছিল। আহমদ মুসা বলল।
স্যার, শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী স্যারকে প্রোগ্রাম চেঞ্জ করে জরুরি প্রয়োজনে তেলআবিবে আসতে হয়। ম্যাডাম যান ওখানে।
‘ইন্নালিল্লাহে……….., মাহমুদ এখন কোথায়? আহমদ মুসা বলল।
স্যার, উনি খবর পেয়েই হেলিকপ্টারে দ্রুত জেরুসালেমে চলে গেলেন। আপনাকে কয়েকবার চেষ্টা করে পাননি। আপনাকে সব জানানোর দায়িত্ব দিয়ে উনি চলে গেলেন। ড. আব্দুল্লাহ বলল।
ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ, আমি এখনি জেরুসালেম রওয়ানা হচ্ছি। বলে কল অফ করে পকেটে মোবাইল রাখতে রাখতে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলল, প্রিয় ভাইয়েরা, আপনাদের প্রিয় স্বাধীনতা, আপনার প্রিয় রাষ্ট্রের ওপর শত্রুরা আঘাত হেনেছে, প্রথম আঘাত, কাপুরুষের মত আঘাত। তারা প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী ম্যাডাম এমিলিয়া এবং মসজিদুল আকসার খতিব আমাদের সকলের উস্তাদ, নেতা শেখ আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমানকে কিডন্যাপ করে জেরুসালেমের অনুষ্ঠান থেকে……..।
সম্মিলিত কণ্ঠে ইন্নালিল্লাহ উচ্চারিত হলো এবং ইহুদিবাদ বিরোধী গগণবিদারী শ্লোগান ওঠল হল থেকে আহমদ মুসার কথার মধ্যেই। আহমদ মুসা হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সবাই ধৈর্য ধরুন, আল্লাহর ওপর ভরসা করুন। আমি আমার কথা এখানেই শেষ করছি। আসসালামু আলায়কুম ওয়া রাহমাতুল্লা।
কথা শেষ করে আহমদ মুসা মঞ্চের দিকে চেয়ে বলল, আমাকে এখনি রওয়ানা হতে হচ্ছে জেরুসালেমে।
মঞ্চে নেতৃবৃন্দের সবার মুখই উদ্বেগে আশংকায় থমথমে। সাইমুমের গাজা এলাকার চীফ এবং গাজার গভর্নর উঠে দাঁড়ালো। গভর্নরই কথা বলল, অবশ্যই আপনাকে যেতে হবে স্যার। তবে হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা একটু বিলম্ব হবে স্যার। একটাই হেলিকপ্টার গাজায়, ওটা সকালে হ্যাংগারে গেছে, এতক্ষণ ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার কথা।
আহমদ মুসা বলল গভর্নরকে, হেলিকপ্টারের জন্যে দেরি করা যাবে না। আমার গাড়ি রেডি আছে। আমি গাড়িতেই যাচ্ছি।
গভর্নর সাইমুম চীফ যুবায়েরের দিকে চেয়ে বলল, তুমি কয়েকজনকে নিয়ে জেরুসালেমে পৌছা পর্যন্ত স্যারের সাথে থাকবে।
পেছনে বসা গাজার পুলিশ প্রধানের দিকে চেয়ে বলল, দু’জন অফিসারের নেতৃত্বে দুই গাড়ি পুলিশ দাও, তারা স্যারের গাড়ির আগে ও পেছনে থাকবে।
যুবায়ের ও গাজার পুলিশ প্রধান আব্দুল্লাহ আকিল সংগে সংগেই বেরিয়ে গেল।
‘মি. গভর্নর, আমার আগে পিছে পাহারা বসিয়ে আমাকে দেখছি দুর্বল করে ফেলতে চাচ্ছেন। এত আয়োজনের মধ্যে ভিআইপি হিসেবে আমি তো ওদের চোখে পড়ে যাব। হাসতে হাসতে বলল আহমদ মুসা।
স্যার আপনার নিরাপত্তা আমাদের টপ প্রয়োরিটি। যা করছি খুবই কম। এটুকু মিনিমাম ব্যবস্থা না করে আপনাকে আমরা ছাড়তে পারি না। জেরুসালেমের সাংঘাতিক ঘটনা ঘটার এটাই শিক্ষা। বলতে বলতে কান্নায় রুদ্ধ হয়ে গেল গভর্নরের কণ্ঠ।
আহমদ মুসা গভর্নরের পিঠে হাত রেখে সান্তনার স্বরে বলল, সব ঠিক হয়ে যাবে গভর্নর। ওদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হবে। আল্লাহ আমাদের সহায়।
আল্লাহু আকবার। নিশ্চয় সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাদের সহায়। আপনাকে আল্লাহই পাঠিয়েছেন। আমাদের সবার আস্থার কেন্দ্র আপনি। তবু দুর্বল মন আমাদের, উদ্বেগ দূর করতে পারি না। ভারী কণ্ঠ গভর্নরের। চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলল সে।
আহমদ মুসা গর্ভনরের পিঠ চাপড়ে বলল, চলুন আমরা বের হই। দেখি, ওরা প্রস্তুত হলো কিনা।
চলুন স্যার। বলল গভর্নর।
দু’জনেই পা বাড়াল বাইরের দিকে।
১০
আহমদ মুসা জেরুসালেমে পৌছে প্রধানমন্ত্রীর প্রশাসনিক ভবনের সামনে গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে দোতলার বারান্দায় উঠে গেল।
সামনেই প্রধানমন্ত্রী মাহমুদের অফিস কক্ষ। দরজা খোলা।
আহমদ মুসা দ্রুত প্রবেশ করল অফিস কক্ষে।
প্রধানমন্ত্রীর অফিস কক্ষের সোফায় বসে ছিল আব্দুল্লাহ জাবের, আব্দুল্লাহ আমিন, এহসান সাবরী, জাফর জামিল, যুবায়ের আওয়াস, তালাত বে সবাই। সবাই এরা ফিলিস্তিন বিপ্লবের এক একটি করে স্তম্ভ, সংগ্রামের মনি-মানিক্য।
সবারই উদ্বেগ-আশংকায় মুষড়ে পড়া চেহারা।
আহমদ মুসাকে দেখেই সবাই উঠে দাঁড়াল।
আহমদ মুসা সালাম দিয়েছিল।
ওরা সালাম গ্রহণ করল।
প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ তার টেবিলে ছিল না।
মাহমুদ কোথায়? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
কারও কাছ থেকে উত্তর এল না। সবার মুষড়ে পড়া চেহারায় ফেনিয়ে উঠেছে যেন বাধ ভাঙা আবেগ। বিপদগ্রস্ত অসহায় কোন মানুষ হঠাৎ স্বজনকে কাছে পেয়ে যেমন বাকরুদ্ধ কান্নায় ভেঙে পড়তে পারে। এদের অবস্থা তাই। এদের দু’চোখ থেকে দর দর করে নামছে অশ্রু।
এ সময় পাশের রুম থেকে মাহমুদ এসে তার অফিস কক্ষে প্রবেশ করল। আহমদ মুসাকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। সে আরও শিশুর মত কেঁদে ফেলল আহমদ মুসাকে পেয়ে।
আহমদ মুসা পিঠে হাত বুলিয়ে সান্তনার স্বরে বলল, মাহমুদ তুমিও এভাবে ভেঙে পড়েছে। তুমি না প্রধানমন্ত্রী!
মুসা ভাই, এই প্রথম কাঁদলাম। আল্লাহর পরে আপনার কাছে ছাড়া আমার তো কাঁদার জায়গা নেই। এটুকু না কাঁদলে আমি মরে যাব। মুসা ভাই সিনবেথের টর্চার সেল থেকে একদিন আমি তাকে উদ্ধার করে এনেছিলাম। দ্বিতীয়বার সে সেই টর্চার সেলে বন্দী হয়েছে আরও অনেক বেশি অপরাধ নিয়ে। আমি যে ভাবতেও পারছি না মুসা ভাই। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল মাহমুদ।
আহমদ মুসা কোন কথা না বলে তাকে ধরে নিয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসাল। চোখ মুছে দিয়ে বলল, তুমি যা বলার বলেছ, এসব নিয়ে দ্বিতীয়বার কথা বলো না। ভুলে যেয়ো না আল্লাহ আছেন এবং তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতাশালী, তোমার সিনবেথের ওপরও।
বলে মাহমুদের সামনে চেয়ারে এসে বসল।
মাহমুদ রুমাল দিয়ে মুখটা ভালো করে মুছল। আহমদ মুসার শেষ কথাগুলো তার চোখে-মুখে ঔজ্জল্যের এক তড়িৎ প্রবাহ নিয়ে এসেছে। বলল, এক্সকিউজ মি মুসা ভাই। আল্লাহ সবার ওপর ক্ষমতাশালী।
‘ধন্যবাদ মাহমুদ’ বলে তাকাল আহমদ মুসা সোফায় বসা আব্দুল্লাহ জাবের, এহসান সাবরীদের দিকে। বলল, তোমরাও সফল বিপ্লবের একজন করে সিপাহসালার। তোমরাও কি ভুলে গিয়েছিলে আল্লাহ আছেন তোমাদের অভিভাবক হিসেবে?
স্যরি আহমদ মুসা ভাই, অবস্থা আমাদের জ্ঞান শূন্য করে দিয়েছে। পুলিশ ও আমরা স্পটের প্রাথমিক তদন্ত সম্পূর্ণ করেছি। কোন ক্লুই পাওয়া যায়নি। অবস্থা আমাদের দিশেহারা করে দিয়েছে মুসা ভাই। বলল আব্দুল্লাহ জাবের।
আহমদ মুসা ঘুরে বসল মাহমুদের দিকে। বলল, তোমার পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ কি বলছে? কিডন্যাপাররা কতজন ছিল, কি তাদের চেহারা, কোন পথে কিভাবে এল, কিভাবে গেল, এসব ব্যাপারে বলেছে কিছু?
তাদের ধারণা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তারা এসেছে। কয়েক গ্রুপ বোমা ফেলেছে। একাধিক গ্রুপ কিডন্যাপের কাজ করেছে। যা বোঝা যাচ্ছে, তাতে তারা ভাড়া করা ট্যাক্সিতে এসেছে, কিন্তু যাওয়ার সময় এ্যাম্বুলেন্সে করে পালিয়েছে। এ্যাম্বুলেন্সও তাদের লোকরাই এনে রেখেছিল। বোমা- বিস্ফোরণের পর তাদের এ্যাম্বুলেন্স নিয়ে সরে পড়া সহজ হয়েছে। পুলিশ এ্যাম্বুলেন্সকে শহরের উত্তর দক্ষিণ প্রান্তে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। বলল মাহমুদ।
গুলি-গোলা শুধু ওরাই চালিয়েছে, না পুলিশও? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
কিডন্যাপের সময় ওরা গুলী চালিয়েছে। আমাদের পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকরাও গুলী চালিয়েছে, কিন্তু সেগুলো ফাঁকা গুলী ছিল, না পয়েন্টেড বলা মুষ্কিল। বলল মাহমুদ।
ওদের কেউ মারা গেছে? জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
মৃতের মধ্যে পুলিশ আছে, স্বেচ্ছাসেবক আছে এবং সাধারণ লোক। বিশেষ পোশাকের সন্দেহজনক কাউকে পাওয়া যায়নি। মাহমুদ বলল।
কিডন্যাপাররা বিশেষ পোশাকে ছিল বলে কোন প্রমাণ পাওয়া গেছে? বলল আহমদ মুসা।
না এরকম কেউ বলেনি। মাহমুদ বলল।
তার মানে কিডন্যাপাররা সাধারণ মানুষের পরিচিত পোশাকেই ছিল। আহমদ মুসা অনেকটা স্বগতোক্তি করল।
পরক্ষণেই আবার বলল, আমি স্পট দেখতে চাই, লাশগুলো কোথায়? জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
স্পটটা ‘এ্যাজ ইট ইজ’ আছে। লাশগুলোও সেভাবেই আছে। আপনার দেখার জন্যেই এভাবে রাখা হয়েছে। বলল মাহমুদ।
আহমদ মুসা আব্দুল্লাহ জাবেরদের দিকে চেয়ে বলল, চল তাহলে যাই।
বলেই মাহমুদের দিকে ফিরে বলল, পুলিশরা তো ওখানে আছে, না?
আছে। আমিও আপনার সাথে যাব আহমদ মুসা ভাই। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধের সুর।
‘চল তোমরা নাকি আবার প্রটোকল লাগবে দেরি হবে না তো? বলল আহমদ মুসা।
ঘটনার পর প্রটোকল অনেকের জন্যেই হয়েছে, আপনার জন্যেও। ইচ্ছা করলেই আর আপনি যখন-তখন যেখানে সেখানে যেতে পারবেন না। তবে চলুন, এখন আমার এক প্রটোকলেই সবার হয়ে যাবে।
বায়তুল আকসা মসজিদের চত্বরে পৌছল সবাই।
বিভৎস দৃশ্য।
চারটি এলাকাকে কেন্দ্র করে বোমা ফাটানো হয়েছে। এমিলিয়া ও খতিবকে যে দিক দিয়ে গাড়িতে নিয়ে আসা হচ্ছিল তার দু’পাশে এবং পেছনের মূল ভেনুতে গাড়ি ও এ্যাম্বুলেন্স ছিল সেখানে।
মোট পঞ্চাশটির মত লাশ পড়ে আছে। আহতরা পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে।
গোটা স্পটের দিকে তাকিয়ে আহমদ মুসা বলল, ঠিক বলেছে তোমার পুলিশ, ওরা অনেকগুলো গ্রুপে বিভক্ত ছিল। যারা বোমা ছুঁড়েছে, গুলী-গোলা চালিয়েছে তারা কিন্তু কিডন্যাপ করেনি। বোমা ছুঁড়ে মানুষকে প্যানিকি সরিয়ে দিয়েছে। তারপর যারা ম্যাডাম এমিলিয়া ও খতিব মহোদয়ের নিরাপত্তা দিচ্ছিল, তাদের উদ্দেশ্যে গুলী ছুঁড়ে হত্যা করে কিডন্যাপ নির্বিঘ্ন করা হয়েছে।
গুলীতে নিহত পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের লাশ যেখানে পড়েছিল, সেখানে গেল আহমদ মুসা। নিহত তিনজন পুলিশ ও চারজন সাইমুম স্বেচ্ছাসেবকের লাশ সেখানে ছিল। আহমদ মুসা বলল, বোমা ফাটার পর এরাই সম্ভবত ম্যাডাম ও খতিবকে আগলে রেখে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। এদেরকে হত্যা করেই তাদের কিডন্যাপ করা হয়েছে।
কিন্তু চারদিকে ঘিরে রাখা এদেরকে গুলী করতে গিয়ে ওরা ম্যাডামদেরও ক্ষতি করেনি তো! বলল এহসান সাবরী।
না এহসান, ওরা ব্রাশ ফায়ার করেনি, এলোপাথারিও গুলী ছোঁড়েনি। রিভলবার দিয়ে ওরা পয়েন্টেড গুরী করেছে। দেখ না সবারই বুক কিংবা মাথা গুলীবিদ্ধ হয়েছে। ওরা ছিল একদমই ঠান্ডা মাথার প্রফেশনাল।
বলতে বলতে আহমদ মুসা হাঁটছিল গাড়ি যেখানে ছিল সেদিকে। পথে আহমদ মুসা দুই জায়গায় দলা পাকানো তুলা কুড়িয়ে পেয়ে থমকে দাঁড়াল। তুলাগুলো নাকের কাছে নিল। যা সন্দেহ করেছিল তাই। তুলাগুলোতে ক্লোরোফর্মের গন্ধ। আহমদ মুসা দুই দলা তুলা মাহমুদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ওদেরকে সংজ্ঞাহীন করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খুব চালাক ওরা। সংজ্ঞাহীন দু’জনকে ওরা যখন ধরাধরি করে এ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন কেউ দেখলেও তাদের সন্দেহ হয়নি। ভেবেছে বোমায় আহতদের এ্যাম্বুলেন্সে নেয়া হচ্ছে। আর কিডন্যাপকারী যারা ওদের ধরাধরি করে নিয়ে গেছে তারা সাধারণ ফিলিস্তিনিদের পোশাকে ছিল অথবা পুলিশের পোশাকেও থাকতে পারে। যাই হোক ওদের পরিকল্পনা নিখুঁত ছিল।
আহমদ মুসা ঘুরে ঘুরে সব লাশই দেখল।
মঞ্চের কিছু দূর সামনে যেখানে অনেকগুলো লাশ পড়ে আছে, তাদের থেকে কিছুটা দূরে পড়ে থাকা একটা লাশ দেখছিল আহমদ মুসা। মাথায় গুলীবিদ্ধ হয়ে সে মারা গেছে। মুখের চেহারাটা প্রায় রক্তে ঢেকে গেছে। গায়ে আরবী আলখেল্লা। চিৎ হয়ে পড়ে আছে। আলখেল্লার বোতামগুলো খোলা। খোলা জায়গা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ভেতরের কলারবিহীন টি-সার্টের একটা অংশ। টি-সার্টের বুকের ওপরের সেই অংশে একটা মনোগ্রাম ষ্টিকারের ওপর তার চোখ আটকে গেল। ঝুঁকে পড়ল আহমদ মুসা। একটা ছবির ওপর রোমান হরফে ক্যালিওগ্রাফি ঢংয়ে সাইপ্রাস লেখা। আর প্রথম দৃষ্টিতে মুখ তোলা ক্যাংগারুর মত যাকে ছবি মনে হয়েছিল ওটা ছবি নয়, সাইপ্রাসের মানচিত্র। বসে পড়ল আহমদ মুসা। তার চোখে বিস্ময়, সাইপ্রাসের টি-সার্ট ফিলিস্তিনে! কোন সময়ই তো দেখা যায়নি। কিন্তু বসার পর সাইপ্রাসের নীল মানচিত্রের নিচটা ঘেঁষে ছোট হরফের লেখা চার শব্দের একটা লাইন চোখে পড়ল আহমদ মুসার। হিব্রু হরফ লেখা দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠল আহমদ মুসা। হিব্রু হরফের লেখাটা হলো, ‘নিউ তোয়া ইন্টারপ্রাইজ, তোয়া।’ ‘তোয়া দ্বীপ’টা আহমদ মুসার চোখের সামনে ভেসে উঠল। তোয়া দ্বীপের বসতির প্রায় গোটাটাই ইহুদি। আর গোয়েন্দা রিপোর্ট হলো, এই তোয়াতেই গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে ইসরাইল সরকারের অবশিষ্ট অংশ। তার মানে এই অভিযানের গোড়া তোয়ায়। তাহলে এমিলিয়াদেরকে ‘তোয়া’তেই নেয়া হয়েছে! এসব চিন্তায় বুঁদ হয়ে গিয়েছিল আহমদ মুসা। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল মাহমুদ ও আব্দুল্লাহ জাবেররা। তারা নিশ্চিত আহমদ মুসা টি-সার্টটায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু পেয়েছে।
মুসা ভাই, গুরুত্বপূর্ণ কিছু? একটু ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল মাহমুদ।
শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, মহাগুরুত্বপূর্ণ। বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালো আহমদ মুসা।
চারদিকে একবার তাকাল। জাবের, মাহমুদরা ছাড়া আশেপাশে কেউ নেই। পুলিশরা স্পটের চারদিকে ঘিরে দাঁড়ানো। মাহমুদের নিরাপত্তা প্রহরীরাও কিছু দূরে দাঁড়িয়ে।
সবার দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
আহমদ মুসা নিচু কণ্ঠে বলল, এই যুবক ইহুদি। সে বন্দুকবাজদের একজন। দেখ তার আশেপাশে রিভলবার পাওয়ার কথা। বলে আহমদ মুসা চারদিকে তাকাল। বলল আব্দুল্লাহ জাবেরের দিকে তাকিয়ে, তোমরা লাশটাকে এখান থেকে সরাও দেখি।
লাশটা কয়েক হাত সরিয়ে নিল।
লাশের তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল তার রিভলবার।
কিছু বলতে যাচ্ছিল এহসান সাবরী। আহমদ মুসা তাকে বাধা দিয়ে বলল, আমার কথা শেষ হয়নি এহসান।
‘স্যরি’ বলে চুপ করল এহসান সাবরী।
বন্দুকবাজ যারা ম্যাডাম এমিলিয়া ও খতিব মহোদয়কে নিরাপত্তা দানকারী আমাদের পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের হত্যা করেছে, এ যুবক তাদের একজন। তবে এর রিভলবার বের করাটা একটু আগেই হয়ে গিয়েছিল এবং পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবকরা তাকে দেখতে পায়। ফলে পুলিশ বা স্বেচ্ছাসেবকদের গুলীতে সে নিহত হয। সে নিহত হওয়ার সময় অন্যেরা বোধ হয় একটু সময় নিয়ে একযোগে ব্যস্ত ছিল। একটু থামল আহমদ মুসা।
থেমেই আবার বলে উঠল, আমার মনে হয়, আমাদের যা জানার তা জেনে গেছি। এই যুবক ‘তোয়া দ্বীপ’ থেকে এসেছে। আর তোমরা জান ‘তোয়া দ্বীপ’ এখন কি। আমি নিশ্চিত ম্যাডাম এমিলিয়া ও খতিব মহোদয়কে কিডন্যাপ করে তোয়ায় নেয়া হয়েছে।
মাহমুদসহ সবার চোখে-মুখে আকস্মিকতার এক বিস্ময়।
যুবকটি কি তোয়া দ্বীপের? বলল মাহমুদ। তার কণ্ঠে বিস্ময় ও উদ্বেগ।
যুবকটির টি-সার্টটি সাইপ্রাসে তৈরি। সাইপ্রাস থেকে ‘তোয়া’ দ্বীপের একটা প্রতিষ্ঠান টি-সার্ট ইমপোর্ট করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সিল আছে টি-সার্টটির মনোগ্রামের নিচে। আর টি-সার্টটি একেবারে নতুন। বলল আহমদ মুসা।
মাহমুদ, জাবেররা এগিয়ে গিয়ে যুবকটির টি-সার্টের মনোগ্রাম দেখল।
উঠে দাঁড়াল ওরা। বলল মাহমুদ, আহমদ মুসা ভাই ঠিক বলেছেন, যুবকটি ‘তোয়া’ থেকে এসেছে সেটা নিশ্চিতই বলা যায়। কিন্তু একটা প্রমাণ থেকেই কি আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌছাতে পারি?
এস আরও বিকল্প তালাশ করি। যদি না পাওয়া যায়, তাহলে যা পাওয়া গেছে তাকেই টার্গেট করতে হবে। আহমদ মুসা বলল।
মাহমুদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার ওয়ারলেসটি ‘বিপ’ ‘বিপ’ সংকেত দিয়ে ওঠল।
সে পকেট থেকে ওয়াললেসটি তুলে নিল। সালাম দিয়ে ‘ইয়েস মাহমুদ’ বলে কথা শুনতে লাগল ওপারের।
মাঝে মধ্যে দু’একটা প্রশ্ন ছাড়া মাহমুদ শুনেই চলল। মুখ তার অনেকখানি সহজ হয়ে এসেছে।
ওপারের কথা শুনতে শুনতেই মাহমুদ তাকাল আহমদ মুসার দিকে।
ওপারের কথা শেষ হতেই মাহমুদ আহমদ মুসার উদ্দেশ্যে দ্রুতকণ্ঠে বলল, মুসা ভাই, কথা বললাম আমাদের গোয়েন্দা প্রধানের সাথে। উনি সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য দিয়েছে, যা আপনার তত্বকেই সমর্থন করছে। এমিলিয়াদের ওরা মনে হচ্ছে ‘তোয়া’তেই নিয়েছে।
কি তথ্য দিয়েছেন তিনি। জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য থেকে তারা জেনেছেন, জেরুসালেমের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে যেখানে এ্যাম্বুলেন্স পাওয়া গেছে, সেখানকার একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, এ্যাম্বুলেন্স থেকে বেরিয়ে কয়েকজন লোক দু’জন মানুষকে ধরাধরি করে রাস্তার পাশে দাঁড়ানো এক বড় প্রাদো জীপে তুলেছে। তারপর দ্রুত উত্তর দিকে চলে গেছে। কিডন্যাপ ঘটনার এক ঘণ্টার মধ্যে প্রাদো জীপটাকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে সামারিয়া পর্যন্ত পৌছে। যেহেতু জীপটা সামারিয়াতে পাওয়া গেছে, তাই ধারণা করা হচ্ছে উত্তর দিকেই তারা গেছে। আমাদের গোয়েন্দা বিভাগ লেবানন গোয়েন্দা বিভাগকে অনুরোধ করেছিল তাৎক্ষণিকভাবে দেখার জন্যে যে, দক্ষিণ লেবাননে ফিলিস্তিনের কোন গাড়ি বা এ্যাম্বুলেন্স অথবা সন্দেহভাজন কোন গাড়ি বা এ্যাম্বুলেন্স তারা দেখতে পায় কিনা। সেখান থেকে দু’টি খবর পাওয়া গেছে। আমাদের সর্ব উত্তর-পূর্বের শহর ক্বিরাত শামোনা থেকে ১০ মাইল উত্তরে আমাদের বর্ডার ও লেবাননের লিতানি নদীর কাছাকাছি রাস্তার পাশে আমাদের একটি মিলিটারি ট্রাক পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় খবর হলো, লেবাননের টায়ার বন্দরের পাশে একটা ট্রলার জেটির বাইরে একটা এ্যাম্বুলেন্স পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এদিকে ঘটনার দুই ঘণ্টা পরের একটা তথ্য পাওয়া গেছে আমাদের সর্ব উত্তর-পূর্বের বাইরে ঐ ক্বিরাত শামোনা থেকে। পুলিশ জানিয়েছে, একটা মিলিটারি ট্রাককে তারা দ্রুত গতিতে উত্তরে সীমান্তের দিকে যেতে দেখেছে। এসব তথ্য থেকে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগেরও ধারণা কিডন্যাপাররা এই রুটে এবং এই গাড়িগুলেই ব্যবহার করেছে এবং সাগর পথেই কোথাও তারা গেছে। থামল মাহমুদ।
আহমদ মুসা গম্ভীর। বলল, তোমাদের গোয়েন্দা বিভাগকে ধন্যবাদ কিডন্যাপারদের তথ্য যোগাড়ের ক্ষেত্রে যা সাধ্যে কুলায় তার সবটুকুই তারা করেছে। আমরা এখন নিশ্চিত ধরে নিতে পারি, তারা ট্রলার নিয়ে লেবাননের কোনো শহরে অবশ্যই যায়নি, তুরষ্কে প্রবেশেরও প্রশ্ন ওঠে না, তারা অবশ্যই হয় সাইপ্রাস, না হয় সোজা ‘তোয়া’ দ্বীপে চলে গেছে। হতে পারে গভীর সাগরে কোন জাহাজ তাদের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ট্রলার থেকে তারা সে জাহাজে উঠেছে।
একটু থামল আহমদ মুসা। ভাবল একটু। তারপর বলল, তাদের এই কিডন্যাপ অভিযান ছিল অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং অনেক প্রস্তুতির ফল। তবে তাদের দুর্ভাগ্য তারা আসল লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
মাহমুদ এবং সবার চোখে বিস্ময়। মাহমুদেরই প্রশ্ন, একথা বলছেন কেন মুসা ভাই? এমিলিয়া এবং মহামান্য খতিব ও আমাদের নেতা শেখ আব্দুল্লাহকে তারা হাতে পেয়েছে।
মাহমুদ, মহামান্য খতিবকে তারা বিকল্প হিসেবে নিয়ে গেছে। আসল টার্গেট ওদের ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী ও তার স্ত্রীকে একই সাথে কিডন্যাপ করা। মাহমুদ তুমি তেলআবিব চলে যাওয়ায় বেঁচে গেছ। তোমাকে না পেয়ে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তারা বায়তুল আকসার খতিবকে নিয়ে গেছে। অবশ্য এ শিকারও তাদের জন্যে খুব বড়, এ কথা নিশ্চয় তারা এখন ভাবছে। বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই জাবের, এহসান সাবরীরা সমস্বরে বলল, ঠিক বলেছেন মুসা ভাই।
তারপর আব্দুল্লাহ জাবের বলে উঠল, নিশ্চিতভাবে এটাই তাদের ষড়যন্ত্র ছিল। তাদের অসম্ভব আয়োজন থেকেও এটা বুঝা যায়। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী কিডন্যাপড! রাষ্ট্রের মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত! প্রমাণ হতো, দেশে আইন-শৃঙ্খলা বলতে কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রীকে কিডন্যাপ করতে পারলে তাদের বোধ হয় আরো কোন পরিকল্পনা ছিল।
হ্যাঁ, আব্দুল্লাহ জাবের, তারা দেশে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টির সুযোগ নিত। এ প্রস্তুতিও হয়তো তাদের ছিল।
আহমদ মুসা একটু থামল। থেমেই আবার বলল, বিপ্লব করা যত কঠিন, বিপ্লব রক্ষা করা তার চেয়েও কঠিন। শত্রুর এই আঘাত তোমাদের এলার্ট করে দিয়ে গেল মাহমুদ।
মাহমুদের চোখে-মুখে উদ্বেগ। বলল, সব কথাই ঠিক। শত্রুরা বসে নেই, কিন্তু আমরা সাফল্যের আবেশে বসে গিয়েছিলাম। আল্লাহ তারই শাস্তি দিয়েছেন হয়তো! আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।
একটু থেমে আবার শুরু করল, বুঝতে পারছি, আমাদের অভ্যন্তরীণ আইন-শৃঙ্খলা এবং বাইরের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আরও সাবধান, আরও সক্রিয় হতে হবে। অন্যদিকে কিডন্যাপারদের কবল থেকে ওঁদের মুক্ত করার জন্যে আশু পদক্ষেপ প্রয়োজন। বলুন মুসা ভাই এখন আমাদের কি কি করণীয়?
বলেই অস্থিরভাবে পায়চারি করতে লাগল মাহমুদ।
মাহমুদ তোমাকে অস্থির হলে চলবে না। শান্ত হতে হবে তোমাকে। সব ঠিক আছে, সবই ঠিক হয়ে যাবে। তুমি জান, তোমার সহকর্মীরা অভ্যন্তরীন আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপারে কি করতে হবে। বৈদেশিকভাবে তেমন ভয়ের কোন ক্ষেত্র নেই তুমি সেটা জান। আর কিডন্যাপারদের ডিল করার ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দাও, তুমি প্রধানমন্ত্রী নাহলে মাহমুদ, এ দায়িত্ব তোমাকেই দিতাম।
হঠাৎ সজল হয়ে ওঠা মাহমুদের দু’চোখ জড়িয়ে ধরল এসে আহমদ মুসাকে। দরদর করে তার দু’চোখে নেমে এল অশ্রু। এ অশ্রু আহমদ মুসার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতার, না ব্যর্থতা, বেদনায় ভেঙে পড়ার? দু’য়েরই হতে পারে।
আহমদ মুসা মাহমুদের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, বলেছি তো সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। দেখবে, আল্লাহর ইচ্ছায় তোমার এমিলিয়া এবং আমাদের বোন এমিলিয়া ও আমাদের খতিবকে সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় নিয়ে আমি শীঘ্রই ফিরে আসছি। আমার জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করো বৈরুত যাওয়ার।
মাহমুদ আহমদ মুসাকে ছেড়ে দিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, এখনই যাবেন?
হ্যাঁ মাহমুদ। বলল আহমদ মুসা।
ভাইয়া আপনি বৈরুত যাবেন কেন? তোয়াই যদি টার্গেট হয়, তাহলে সরাসরি তো যেতে পারেন সমুদ্র পথে। আর মনে হচ্ছে, আপনি একা যাবেন। কিন্তু আমরা কেউ আপনার সঙ্গি হতে চাই। বলল আব্দুল্লাহ যাবের।
‘তোয়া’র চারদিকের সমুদ্রেই ওরা চোখ রাখবে। বিশেষ করে এদিক থেকে যাওয়া সব জাহাজ-জলযানকেই তারা সন্দেহ করবে। কিন্তু তোয়ায় পৌছতে হবে আমাদের সবার অলক্ষ্যে। আর এ ধরনের অভিযান দল বেঁধে হয় না, সুতরাং কাউকেই আমি সাথে নিচ্ছি না। আহমদ মুসা বলল।
‘বৈরুত যাওয়ার জন্যে আমি হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। এতে তাড়াতাড়িও যাওয়া যাবে।’ বলল মাহমুদ।
মানে আমাকে ভিআইপি সাজিয়ে প্রচার করে দিতে চাও যে আমি বৈরুত গেছি! তা হবে না। আমি গাড়িতে যাব। নীরবে উঠব গিয়ে বৈরুতে। তোমাদের দূতাবাসেও যাব না। শুধু তুমি তোমাদের বৈরুত দূতাবাসে সাইমুমের যে ছেলেটা, আবু আমর, গোয়েন্দাকর্মী হিসেবে আছে, তাকে বলবে রাতে যেন সে বৈরুতের ‘সি ভিউ’ হোটেলে গিয়ে রেজিষ্ট্রার দেখে ‘হাবিব গনজালেস’ এর কক্ষে সে যায়। আমার এই মিশনে ‘হাবিব গনজালেস’ নামের পাসপোর্ট ব্যবহার করব। চল, তোমার অফিসে গিয়ে আমি ফ্রেস হবো। ইতোমধ্যে আমার জন্যে একটা ভিন্নগাড়ি ঠিক-ঠাক করো। অবশিষ্ট কথা পরে বলব, চল।
বলে আহমদ মুসা চলতে শুরু করল গাড়ির দিকে।
সবাই তার পেছনে পেছনে চলল।
সাইপ্রাসের দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার ফিশিং ট্রলার বোটটি।
আহমদ মুসা যাত্রা করেছে দক্ষিণ সাইপ্রাসের পাফোস বন্দর থেকে। বন্দরটি মূলত ফিশিং বন্দর। আহমদ মুসা আগের দিন সাইপ্রাসে এসে থেমেছিল লিমাসোল বন্দরে একজন ট্যুরিষ্টের পরিচয়ে। বৈরুত থেকে সে সাইপ্রাসের ভিসা নিয়েছিল আবু আমরকে দিয়ে দালালের মাধ্যমে। পাসপোর্টে তার হবি লেখা আছে ফিশিং ও ফরেষ্ট ট্যুরে। আহমদ মুসা লিমসোল থেকে কিছু খোঁজ-খবর নিয়ে গতকালই সড়ক পথে এসেছিল দক্ষিণ সাইপ্রাসের সর্বদক্ষিণ বন্দর শহর পাফোসে। এখানে এসে আরও খোঁজ খবর নিয়ে জেনেছিল, তোয়া উপকূল মাছ শিকারের জন্যে বিখ্যাত। সাইপ্রাস থেকেও জেলেরা মাছ শিকারে মাঝে মাঝে সেখানে যায়। অনুমতি নিয়ে ও রয়্যালটি দিয়ে সেখানে মাছ শিকার করা যায়। তবে কয়েকদিন হলো সেখানে মাছ শিকার ভীষণ কড়াকড়ির মধ্যে পড়েছে। সবাইকে মাছ শিকারের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। কথা বলে খুশি হলে তবেই এই অনুমতি মেলে। দ্বীপে ট্যুরিষ্টদের যাতায়াত নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। আইনসংগত ও অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যবসায় ও চাকরির প্রয়োজন ছাড়া সাইপ্রাসবাসিরাও সেখানে যেতে পারে না।
আহমদ মুসা ভালো করে খোঁজ-খবর নিয়ে একটা ফিশিং ট্রলার কোম্পানীতে যায়। নিজের পরিচয় দিয়ে বলে যে, সে একজন পর্যটক, ফিশিং তার হবি। তোয়া উপকূলে মাছ শিকার তার বহুদিনের ইচ্ছা। তাকে ভালো ট্রলার ও সহযোগিতার জন্যে জেলে দিয়ে সাহায্য করলে এর জন্যে উপযুক্ত অর্থ দিতে সে রাজি আছে। কোম্পানির মালিক বলে, এর জন্যে তো লাগবে অনেক অর্থ। অত্যাধুনিক ট্রলার যদি নিতে হয়, তাহলে প্রথম ফেরত যোগ্য সিকিউরিটি ডিপোজিট ৫ হাজার মার্কিন ডলার। আর প্রতি ঘণ্টায় ট্রলারের ভাড়া ১০০ ডলার করে। কমপক্ষে ৫ জন জেলে সাথে যাবে। তাদের প্রতিজনের প্রতি ছয় ঘণ্টার কর্মদিনের জন্যে লাগবে ১০০ ডলার করে। ফিশিং সরঞ্জামের ভাড়া লাগবে না। সেটা বোটের ভাড়ার মধ্যে শামিল।
খরচের হিসেব শুনে আহমদ মুসা মনে মনে বলেছিল, এর দ্বিগুণ, কিংবা কয়েকগুণ বেশি দাবি করলেও তোমরা পেতে। কিন্তু মুখে বলেছিল, ট্রলার ভাড়া ও জেলেদের পারিশ্রমিক যা আশা করেছিলাম, তার চেয়ে অনেক বেশি।
কোম্পানীর কর্তা বলেছিল, তাহলে স্যার ফিশিং আইডিয়া ছেড়ে দিন, সেটাই ভাল।
এটাই যদি আপনার শেষ কথা হয়, তাহলে আমাকে রাজি হতেই হবে। অনেক আশা করে আমি এসেছি। বলেছিল আহমদ মুসা।
ধন্যবাদ। সাংঘাতিক ফিশিং হবি তো আপনার! কিন্তু আরেকটি ব্যাপারে আপনাকে রাজি হতে হবে। সেটা হলো, তোয়া উপকূল এলাকায় বর্তমানে খুব কড়াকড়ি চলছে। আপনি যদি ফিশিং অনুমতি না পান কিংবা আপনার কোন বিপদ হয় তার জন্যে আমরা দায়ী থাকব না এবং আমরা ক্ষতিও স্বীকার করব না। দ্বিতীয়ত এক কর্মদিন অর্থাৎ ছয় ঘণ্টার ভাড়া ও পারিশ্রমিক আপনাকে সিকিউরিটি মানির সাথে অগ্রিম জমা দিতে হবে। বলেছিল কোম্পানীর কর্মকর্তা।
আপনাদের এ শর্তও আমি মেনে নিচ্ছি। তবে আমার যদি কোন বিপদ হয়, তবে সেটা আমার আত্মীয়-স্বজনকে আপনাদের জানাতে হবে। আমি নিকোশিয়ার একটা পোষ্ট বক্স নাম্বার দিয়ে যাবো। সেখানে জানালেই আমার আত্মীয়-স্বজনরা তা পেয়ে যাবে। কৃত্রিম বিনীত কণ্ঠে বলেছিল আহমদ মুসা।
এভাবে একটা আধুনিক ফিশিং ট্রলার বোট এবং ৫ জন জেলে নিয়ে যাত্রা করেছে আহমদ মুসা।
বিকেল চারটায় বোট নিয়ে পাফোস থেকে যাত্রা করেছে আহমদ মুসা। আহমদ মুসা বলেছে শেষ রাত এবং সকালেই সে মাছ ধরতে ভালবাসে। সে সন্ধ্যার মধ্যে তোয়া উপকূলে পৌছতে চায়।
পূর্ণ শক্তিতে এগিয়ে চলেছে আহমদ মুসার বোট উপকূলের দিকে।
বোটের পেছন দিকে বোটের চার ভাগের এক ভাগ জায়গায় আধুনিক কেবিন। কেবিনের মাথার উপর ফ্ল্যাগ ষ্ট্যান্ডে উড়ছে ফিশিং পতাকা।
আহমদ মুসা হাতঘড়ির দিকে তাকাল। সাড়ে ৫টা বাজে। নব্বই-একশ মাইলের মত এসেছে। আরও পঞ্চাশ-ষাট মাইল বাঁকি। তার মানে আরও এক ঘণ্টা লাগবে তোয়া উপকূলে পৌছতে। সন্ধ্যায় পৌছবে তারা তোয়া উপকূলে। এ রকম একটা সময়ই আহমদ মুসা চায়।
আহমদ মুসার পরিকল্পনা হলো, সাংঘাতিক অসুস্থ হওয়ার কথা বলে সে উপকূলে নেমে সকালে ফিরে আসার কথা বলবে। আর যদি সকালে ফিরতে না পারে, তাহলে ট্রলার যেন চলে যায়। একটা বেয়ারার চেক দিয়ে যাবে, যা ভাঙালে তাদের পাওনা পরিশোধ হয়ে যাবে।
আরও এক ঘণ্টা পার হলো।
তোয়া উপকূলে তারা এসে পৌছেছে। তোয়া দ্বীপের উত্তর উপকূলটা কালো দেয়ালের মত তাদের সামনে। তোয়া দ্বীপ থেকে কোন আলো তারা দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু উপকূলের পানিতে আলোর ছুটোছুটি দেখা যাচ্ছে। পাঁচজন জেলের যে সর্দার সে বলল, স্যার ছুটন্ত যে আলোগুলো দেখছেন, সেগুলো উপকূল গার্ডদের বোটের আলো। আমাদের বোটের আলো দেখলেই দেখবেন তারা ছুটে আসবে।
আমাদের বোটের আলো দেখে তারা বুঝবে কি করে যে, আমাদের এটা উপকূল গার্ডের বোট নয়। অন্ধকারে তো তারা আমাদের বোট দেখতে পাবে না। জিজ্ঞেস করল আহমদ মুসা।
স্যার, দেখুন ওদের ও আমাদের বোটের আলোর রংয়ে পার্থক্য আছে। দেখুন আমাদের বোটের আলোর রং সম্মোহনকারী হালকা নীলাভ। রাতে মাছ শিকারের জন্যে এই রং খুব কার্যকরী। সব বোটের আলোই এই রংয়ের। কিন্তু ওদের বোটের আলো দেখুন স্বচ্ছ সাদা। বলল জেলেদের সর্দার।
আহমদ মুসাদের বোট তখন ‘তোয়া’ উপকূলের আরও কাছে চলে এসেছে।
এই সময় জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন দ্রুতকণ্ঠে বলল, স্যার দেখুন, দু’টি বোট আমাদের দিকে ছুটে আসছে। তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
আহমদ মুসাও দেখল দু’টি আলো তীর বেগে তাদের দিকে ছুটে আসছে। আহমদ মুসা বলল, আমি সাইপ্রাসের লোক নই দেখলে তারা আমাকে কি করবে বলে মনে কর?
স্যার, তারা কথা বলে ছেড়েও দিতে পারে, জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে উর্ধ্বতন অফিসারদের কাছে নিয়েও যেতে পারে। উর্ধ্বতন অফিসাররা ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু স্যার, সন্দেহ হলে তারা নির্ঘাত মেরে ফেলবে। স্যার, এখনকার ওরা মানুষের বাচ্চা নয়। গত সপ্তাহ দুই ধরে এই অবস্থা হয়েছে।’ বলল জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন।
আমাকে নিয়ে গেলে তোমরা কি করবে? আহমদ মুসার জিজ্ঞাসা।
নিয়ে যাবে তারা? আমরা বুঝতে পারছি না স্যার, আপনাকে নিয়ে গেলে আমরা কি করব। আপনিই বলুন।
আমি ভয় করছি না। আমাকে নিয়ে গেলেও তারা ছেড়ে দেবে। সন্দেহের কিছু পাবে না। নিয়ে যদি যায় তাহলে তোমরা অপেক্ষা না করে চলে যেও। আমি যাবার সময় একটা চেক দিয়ে যাব, সেটা পাফোসের ব্যাংকে ভাঙিয়ে পাওনা নিয়ে নিতে পারবে। বলল আহমদ মুসা।
আপনার কথা শুনে আমারই ভয় করছে স্যার। কিন্তু আপনাকে ভীত দেখছি না? বলল জেলেদের সর্দার।
‘ভয় পাব কেন? আমার কোনই অপরাধ নেই। মানুষ মানুষকে ভয় পাবে কেন?’ আহমদ মুসা বলল।
আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। কিন্তু ওরা তো মানুষ নয়। সামান্য সন্দেহ হলেও ওরা পাখির মত গুলী করে মানুষ মারে। ভয়টা আমার এ জন্যেই। আপনি খুব ভাল মানুষ…….।
কথা শেষ না করেই বলল, স্যার ওরা এসে গেছে।
ঠিক আছে, আসতে দাও। বলল আহমদ মুসা।
এর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই দু’দিক থেকে দুই পেট্রল বোট এসে আহমদ মুসাদের বোটের দু’পাশে অবস্থান নিল। দু’পাশের দু’বোট থেকে দু’হুক দিয়ে আহমদ মুসাদের বোটকে ওদের বোটের সাথে আটকে দেয়া হলো।
দু’বোট থেকে দু’অফিসার আহমদ মুসাদের বোটে উঠে এল। তাদের সাথে উঠে এল আরও দু’জন প্রহরী। তাদের হাতে উদ্যত সাব-মেশিনগান, তা তাক করা বোটের লোকদের দিকে।
বোটে উঠেই একজন অফিসার বোটের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, পরিচয়ের কাগজপত্র নিয়ে সার বেধে দাঁড়াও।
জেলেরাসহ আহমদ মুসা সার বেঁধে দাঁড়াল। জেলেদের সবার কাগজপত্র দেখে ওকে করে দিল। কিন্তু অফিসারটি আহমদ মুসার ফিসিং কন্ট্রাক্টের কাগজপত্র ও পাসপোর্ট দেখে বিস্ময়ের সাথে আহমদ মুসার দিকে তাকাল। বলল, জানেন না, ‘তোয়া উপকূলে পর্যটকদের আসা নিষিদ্ধ হয়েছে?
আমি পর্যটক হিসেবে আসিনি, আমি এসেছি এখানে ফিশিং-এর জন্যে। বলল আহমদ মুসা।
কিন্তু নিশ্চয় আপনি জেনেছেন, সাইপ্রাসের নাগরিক ছাড়া অন্য সবার জন্যে ফিশিং এখানে নিষিদ্ধ?
আমি সাইপ্রাসের নই বটে, কিন্তু যাদের নিয়ে আমি ফিশিং এ এসেছি, সবাই সাইপ্রাসের। বোট, ফিশিং সরঞ্জাম, জেলে সবাই সাইপ্রাসের। আহমদ মুসা বলল।
কিন্তু আপনি সাইপ্রাসের নন। অন্যদের ব্যাপারে প্রশ্ন নেই।
কথা শেষ করেই অফিসারটির দিকে চেয়ে বলল, এঁকে আমাদের বেজ ক্যাম্পে নিয়ে যাও। তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখুক।
অফিসারটির কথা শেষ হতেই জেলেদের সর্দার নিকোলাস নেলসন বলল, স্যার, ওঁকে নিয়ে যাবেন না। আমরা ফিশিং করব না, আমরা ফিরে যাচ্ছি সাইপ্রাসে।
ওঁকে ছাড়ার ক্ষমতা আমাদের নেই। অবাঞ্জিত কেউ আমাদের জলসীমা ও উপকূলে ধরা পড়লে, তাকে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সামনে নিয়ে যেতে হবে। তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন, তাঁদের কাছে নামের তালিকা ও ফটোর এ্যালবাম আছে, সে সবের সাথে মিলিয়ে যা ইচ্ছে তারাই করবেন। থামল অফিসার।
থেমেই সে পুলিশ অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বলল, ইলাম, এঁকে সার্চ করে তোমার বোটে তুলে নাও।
ইলাম নামের অফিসার এগিয়ে এল।
আহমদ মুসা নিজের থেকেই হাত তুলে দাঁড়াল।
অফিসারটি এসে আহমদ মুসার জ্যাকেট ও প্যান্টের সবগুলো পকেট সার্চ করল। কমর সার্চ করার সময় চামড়ার খাপে একটা ছুরি পেল সে।
ছুরিটি খুলে নিয়ে অন্য অফিসারটির উদ্দেশ্যে বলল, পকেটে মানিব্যাগ ছাড়া আর কিছু নেই স্যার।
ঠিক আছে তাকে বোটে তুলে নাও। বলল অফিসারটি।
আহমদ মুসা সার্চকারী অফিসারটিকে বলল, একটু সময় দিন।
বলে আহমদ মুসা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা চেক বের করে জেলেদের সর্দারের হাতে দিয়ে বলল, ব্যাংকে এটা ভাঙিয়ে আপনাদের ও মালিকের পাওনা নিয়ে নেবেন।
কথা শেষ করেই অফিসারটির সাথে যাবার জন্যে ঘুরে দাঁড়াতে যাচ্ছিল। জেলেদের সর্দার নেলসন বলল, স্যার আমরা কি অপেক্ষা করব না?
না অপেক্ষা করবে না। বলল আহমদ মুসা।
আপনি ফিরবেন কি করে? জিজ্ঞাসা নেলসনের।
যারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদেরই দায়িত্ব হবে আমাকে আমার জায়গায় ফেরত পাঠানো। আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসা বোটে উঠলে তারপর অফিসারটি বোটে উঠে এল।
সংগে সংগেই বোট ষ্টার্ট নিল।
বোটে অফিসারসহ ওরা পাঁচজন।
আহমদ মুসাকে বোটের সামনে রেখে বোটের মাঝখানে অফিসারসহ চারজন বসল। বোটের পেছনে একজন। বোটকে সেই ড্রাইভ করছে।
বোটের মাঝখানে অফিসার ছাড়া তিনজনের হাতেই ষ্টেনগান। নির্দেশ বা প্রয়োজন হলেই ষ্টেনগানগুলোর নল উঠে আসবে এবং গুলীর বৃষ্টি সৃষ্টি করবে।
বোট দ্রুত চলছে উপকূলের দিকে।
অফিসারটি এক সময় আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, তোমাকে খুব সাহসী ও বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। কিন্তু তুমি এভাবে ফাঁদে পড়লে কেন?
ফাঁদে কোথায়? জিজ্ঞাসাবাদ তো তোমরা করতেই পার। আহমদ মুসা বলল।
হাসল অফিসারটি। বলল, ফাঁদ নয় ফাঁসি কাষ্টের দিকে তুমি যাচ্ছ। দুঃখের সাথে বলছি, তোমার মত অবাঞ্চিত, অপরিচিত যারা তোয়া দ্বীপে পা রাখে, তারা আর ফিরে যায় না।
আহমদ মুসা ওদের চ্যালেঞ্জ করারই একটা পথ খুঁজছিল। সে সুযোগ পেয়ে বলল, কিন্তু তোমরা আমাকে বলেছ, তোমরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে আমাকে নিয়ে যাচ্ছ। এখন বলছ তোমাদের মতলব অন্যরকম। তাহলে তো আমি যাব না।
হেসে উঠল অফিসারটি। বলল, মনে হচ্ছে যাওয়া না যাওয়া তোমার হাতে?
দেখ, আমি এখনও তোমাদের বেজ ক্যাম্পে যাইনি। আমি এখনও মুক্ত।
তোমার সামনে তিনটি ষ্টেনগান আছে দেখতে পাচছ না? নির্দেশ দিলেই হা করে উঠবে তোমার দিকে, তোমাকে ঝাঁঝরা করে দেবে গুলীর বৃষ্টি।
আহমদ মুসা পা মুড়ে বসে ছিল। মুড়ানো তার ডান পা তার ডান ‘হিপ’-এর বাইরে বেরিয়ে ছিল। আহমদ মুসার ডান হাতটা তার ডান পায়ের টাকনুর উপর রাখা ছিল। আর তার পায়ের মোজার ভেতর গুজে রাখা এম-১৬ এর সর্বাধুনিক মিনি সংস্করণ ‘লিটল ক্যানল’ রিভলবারটির বাট আহমদ মুসার ডান হাত স্পর্শ করে আছে। আহমদ মুসার ঠোঁটে ফুটে উঠেছে এক টুকরো হাসি।
সে দুটো আঙুল দিয়ে নাইলনের মোজা ইতিমধ্যেই নামিয়ে দিয়েছে। এবার ‘লিটল ক্যানন’-এর বাঁটে হাত রেখে বলল, তোমরা কি করবে, আমাকে মেরে ফেলবে?
কেন, ক্ষতি কি? যে কাজটা ওরা একটু পরে করবে, সে কাজ আমরা এখন করলে ক্ষতি কি? বরং তারা খুশি হবে এই ভেবে যে, আমরা শেয়ানা হয়েছি।
কিন্তু মি. এ্যারন, শুধু গন্ডাখানেক ষ্টেনগান থাকলেই মানুষকে আটকানো যায় না।’
বলেই আহমদ মুসা রিভলবার সমেত ডান হাত বিদ্যুত বেগে সামনে এনে চারজনকে তাক করল। বলল, তোমরা ষ্টেনগান তোলার চেষ্টা করলে আর মি. এ্যারন তুমি পকেটে হাত দেয়ার চেষ্টা করলে এই ‘লিটল ক্যানন’ ব্রাশ ফায়ার করবে। তোমার হাতের ষ্টেনগান, হাতের রিভলবার বোটে রেখে পানিতে নেমে যাও, আমি তোমাদের মারতে চাই না।
একথা বলার সময় পেছনে ড্রাইভিং-এ বসা লোকটি তার পাশে রাখা ষ্টেনগান তুলতে যাচ্ছিল।
আহমদ মুসা এদের সাথে কথা বললেও তার চোখ পেছনের লোকটিকেও কভার করছিল।
কথা বলার মধ্যেই আহমদ মুসার ‘লিটল ক্যানন’ রিভলবারটির ট্রিগার সেকেন্ডের জন্যে চেপে বসল আর সামনে বসা চারজনের মধ্যে দু’জনের ফাঁক দিয়ে কয়েকটা বুলেট ছুটে গিয়ে নিখুঁতভাবে তার মাথায় আঘাত করল।
লোকটির দেহ উল্টে ঝপ করে পানিতে পড়ে গেল।
এরা চারজনই পলকের জন্যে পেছনে তাকিয়ে মরিয়া হয়ে তিনজন তাদের ষ্টেনগানের নল উপরে তুলেছিল। আর অফিসারটিও হাত দিয়েছিল পকেটে।
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আহমদ মুসার তর্জনি ট্রিগারের উপরেই ছিল। তা আবার চেপে বসল ট্রিগারে। আর আ