আমাদের সাহিত্যের প্রাচীন উপাদান
মানুষের জীবন-জীবিকা স্থান-কাল নিরপেক্ষ নয়। তাই মানুষের চলনে, বলনে ও আচরণে স্থানি। ও কালিক প্রভাব থাকে অনেকখানি। এজন্যেই স্থান ও কালভেদে মানুষের ভাব-ভাবনায় এবং জীবন-জীবিকায় দেখা যায় বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য, এই বিচিত্রতা ও বিশিষ্টতাই এক এক স্থানিক গোত্রের বা জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। টুকরো টুকরো তুলো দিয়ে যেমন তৈরি হয় অবিচ্ছিন্ন সূতো, তেমনি ব্যষ্টির খণ্ড-ক্ষুদ্র-চিন্তা ও কৃতির সমবায়ে গড়ে উঠে জাতীয় ঐতিহ্য। Politics পুরোনো হলে হয় ইতিহাস আর পুরোনো সংস্কৃতির নাম ঐতিহ্য। এরই সর্বাত্মক সাধারণ অভিধা সভ্যতা।
ঐতিহ্য জাতীয় জীবনে প্রেরণার উৎস ও সংস্কৃতির নবনব বিকাশের ভিত্তি। শিকড় দিয়ে মাটির রস, আর পাতা দিয়ে আলো বাতাসের উপাদান গ্রহণ করে যেমন বেড়ে ওঠে গাছ, জাতিও তেমনি ঐতিহ্য থেকে প্রাণরস এবং সমকালীন পরিবেশ থেকে মানস- সম্পদ আহরণ করে প্রয়াসী হয় আত্মবিকাশে, নতুন পাতার উদ্গমে ঝরে পড়ে পুরোনো পাতা, নতুন চিন্তার উন্মেষে অবহেলিত হয় পুরোনো চিন্তা। পুরোনো অকেজো হল বটে, কিন্তু তাই বলে অসার্থক নয়, কেননা তা নতুনে উত্তরণের সোপান। তার কালে সেও ছিল আজকের সংস্কৃতির মতো জীবন-প্রচেষ্টার সম্বল ও বাহন। বহতা নদীর স্রোত যেমন নিজে এগিয়ে যায় আর টেনে আনে পেছনের পানি, ঐতিহ্যও তেমনি নিজের কোলে জন্ম দেয় নতুনের। পাকানো রশিতে কিংবা বহতা নদীতে আর ঐতিহ্য- পরস্পরায় তফাৎ নেই কিছুই।
চলমান জীবনে আর উত্তরাধিকারের মতো সাহিত্যের উত্তরাধিকারও বিশেষ মূল্যবান সম্পদ। ঐতিহ্যের স্বরূপ স্পষ্টভাবে বিধৃত থাকে সাহিত্যে। তাই জাতীয় জীবনে সাহিত্যিক ঐতিহ্যের প্রভাব অসামান্য। গ্রীকদের উপর হোমারের ইলিয়াড-ওডেসির প্রভাব, ইরানিদের জীবনে শাহনামার গুরুত্ব আর পাক-ভারতের হিন্দুর আচারিক ও মনো-জীবনে রামায়ণ-মহাভারতের প্রেরণা অপরিমেয়।
হোমারের রচনা অবলম্বন করে য়ুরোপে, শাহনামা সম্বল করে মুসলিম জগতে এবং রামায়ণ মহাভারত ভিত্তি করে হিন্দু-ভারতে বিচিত্র রস ও রূপে গড়ে উঠেছে বিপুল আধুনিক সাহিত্য।
পুরোনো কিস্সায় নতুন আঙ্গিক ও অভিধা আরোপিত হলে সে কিস্সার জলুস কত বাড়ে এবং কেমন রসস্ফূর্তি ঘটে তার দৃষ্টান্ত মিলবে মিল্টনের Paradise Lost-এ, টেনিসনের Ulysses-এ, শেলীর Prometheus Unbound-এ আর ম্যাথু আরনডের Sohrab and Rostum-এ। আমাদের দেশে পৌরাণিক উপাখ্যান নিয়ে রচিত কালিদাসের শকুন্তলা নাটক, কুমারসম্ভব কাব্য, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীরামদাসের মহাভারত, মধুসূদনের মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনা, হেমচন্দ্রের বৃত্রসংহার, নবীন সেনের ত্রয়ী, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, গান্ধারীর আবেদন, কর্ণ-কুন্তীসংবাদ, বিদায় অভিশাপ প্রভৃতি বহু রচনা এর প্রমাণ। সাধারণভাবে বলতে গেলে উনিশ শতকের হিন্দু রচিত আধুনিক বাঙলা কাব্যের বারো আনা উপাদানই রামায়ণ মহাভারত থেকে নেয়া। আর বাঙলা সাহিত্যের উপমাদি অলঙ্কারের চৌদ্দ-আনা মহাভারতের কাহিনী থেকে পাওয়া।
এদেশে মুসলমানেরাও নিষ্ক্রিয় ছিলেন না এ ব্যাপারে। তারাও আমাদের মধ্যযুগীয়-সাহিত্যের উপাদান সগ্রহ করেছেন পুরোনো সাহিত্য থেকেই। ফারসি ও হিন্দুস্তানী প্রণয়োপখ্যানগুলো কায়িক, ছায়িক ও ভাবিক অনুসরণ যেমন করেছেন, তেমনি রচনা করেছেন ইসলামের উন্মেষ যুগের হযরত আলী, আমির হামজা, হানিফা প্রভৃতির বীরত্বের উপকথা নিয়ে জঙ্গনামাগুলো। আলেফলায়লা ও শাহনামার নানা কাহিনীও হয়েছে আমাদের পুথি-সাহিত্যের অবলম্বন। এসব উপাদানে গড়ে উঠেছিল আমাদের বিপুল সাহিত্য।
এ যুগেও আরবি-ইরানি-উর্দু সাহিত্য এবং আমাদের পুথি অবলম্বনে আধুনিক ভাব-চিন্তার অনুগ সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন ও করছেন কোনো কোনো কবি। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু, কায়কোবাদের মহরম শরীফ, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মহাশিক্ষা কাব্য, হামিদ আলীর কাসেমবধ ও জয়নাল উদ্ধার প্রভৃতি কারবালা যুদ্ধভিত্তিক রচনা। সৈয়দ আলী আহসানের অসম্পূর্ণ চাহার দরবেশ, ফররুখ আহমদের নৌফল ও হাতেম, শাহরিয়ার, হাতেমতায়ী, আব্দুর রশিদ ওয়াসেকপুরীর আমীর সওদাগর, আজিমুদ্দিনের মহুয়া প্রভৃতি পুরোনো সাহিত্যেরই আধুনিক রূপায়ণ।
এ কয়জনের গুটিকতক রচনাতেই উজার হয়ে যায়নি সে বিপুল ভাণ্ডার। বলতে গেলে আজো অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে এর উৎকৃষ্ট সম্পদ। এ কাজে যে শ্রদ্ধা, শ্রম ও সংবেদনশীল মনের প্রয়োজন, তা আমাদের মধ্যে আজো বিরল। অথচ পুরোনো সাহিত্যিক-ঐতিহ্যের সুপ্রয়োগেই সমৃদ্ধ হয় নতুন সাহিত্য ও সুপ্রকট হয় মনন। এজন্যে পুরোনো সাহিত্যের উপাদানই হয়েছে চিরকাল উৎকৃষ্ট কাব্যের অবলম্বন। ঐতিহ্য সচেতনতার ও পুরোনো সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব আমদের আজকের সাহিত্যের অপূর্ণতা ও দীনতার অন্যতম কারণ। আমাদের মধ্যযুগীয় সাহিত্যের পঠন-পাঠন শিক্ষিত সাধারণ্যে নিতান্ত কম। অথচ এর বহুল চর্চা না হলে একে বুনিয়াদ করে সাহিত্যসৃষ্টির চর্যাগ্রহণ করা সম্ভব নয় কিছুতেই। আমাদের পুথি-সাহিত্যের আধুনিক রূপায়ণের সম্ভাব্যতার একটু আভাস দিয়েই আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই। এর সম্ভাবনা যেমন বিপুল, যারা এ পথে এগিয়ে আসবেন তাদের কৃতির ভবিষ্যৎও তেমনি উজ্জ্বল।
সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ একটি বিরাট কাব্য। হযরত আদম থেকে হযরত মুহম্মদ (দ.) অবধি সব জ্ঞাত নবীর কাহিনীই রয়েছে এতে। হযরত আয়ুব-রহিমা, ইব্রাহিম ও আল্লার অভিজ্ঞান, ইব্রাহিম-সারা-হাজেরা, মুসা-কারুন, নূহ-কেনান, সোলায়মান-জাদু আঙটি প্রভৃতি চমৎকার অবলম্বন হতে পারে আধুনিক জীবন-জিজ্ঞাসার তত্ত্ব-ভাবনার। হযরত আদমের পারিবারিক দ্বন্দ্ব সংঘাতের কাহিনীও আধুনিক পরিবারের দ্বান্দ্বিক জীবনের প্রতীক হতে পারে। এ যুগের রোমান্টিক কবি-কল্পনার সবচেয়ে সুন্দর অবলম্বন হতে পারে আদমের জীবন-স্বপ্ন। বেহেস্তে সদ্য-তৈরি আদম একাকিত্বের অস্পষ্ট বেদনার উন্মন। নতুন-দেখা প্রকৃতি যেন বাড়িয়ে দিচ্ছে সে বেদনা। ক্লান্তমনে ঘুমিয়ে পড়েছেন আদম, ঘুমের ঘোরে অনুভব করছেন তিনিঃ তার বাম পাশের রগ থেকে কী যেন গড়ে উঠছে, কী যেন জেগে উঠল, দাঁড়িয়ে গেল। তাকে যেন ইশারায় ঐ নতুন সত্তা ডাকছে। তিনি চোখ খুললেন, দেখলেন এক অপরূপ রূপসী তার অপেক্ষায় পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর স্বপ্নের, তার অবচেতন কামনার ধন পেয়ে ধন্য হলেন তিনি। এই-যে আদি মানবের প্রথম জীবনস্বপ্ন, একে প্রেম বলুন, মৈথুন তত্ত্ব বলুন–একেই কেন্দ্র করে বিকশিত হচ্ছে জীবন। জীবনবৃক্ষে ফুল ফোঁটানো, ফল ধরানো আর রঙ চড়ানো–সবকিছুর মূলে রয়েছে এ স্বপ্নের দান। আমাদের পসন্দ-সই আবহ সৃষ্টি করতে পারেননি মধ্যযুগের কবি। কিন্তু বীজ বুনে গেছেন, তা আজকের শক্তিমান কবির হাতে প্রকটিত হতে পারে অসামান্য রসে-রূপে। কাসাসুল আম্বিয়া প্রভৃতির নানা কাহিনী অবলম্বন করেও অভিব্যক্তি পেতে পারে আমাদের আজকের জীবনতত্ত্ব।
ইউসুফ-জোলেখা আমাদের প্রণয়–জিজ্ঞাসার চিরন্তন প্রতীক-প্রণয়ের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও আদর্শের আকর। আমাদের শাহ মুহম্মদ সগীরের কিংবা আবদুল হাকিমের ইউসুফ-জোলেখা কাব্যে ইউসুফের অলোকসামান্য সংযম ও চরিত্র-মাহাত্ম্য, জোলেখার প্রণয়াবেগ ও কৃচ্ছ্বসাধনা যে মহিমান্বিত রূপ পেয়েছে এমনটি আধুনিক বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসেও দুর্লভ। একদিকে Passions ও emotions-এর দুর্বার বেগ, অপরদিকে সংযম, সততা ও আদর্শানুগত্যের প্রমূর্ত রূপ যে কোনো কালের উৎকৃষ্ট সাহিত্যের অবলম্বন হবার স্পর্ধা রাখে।
মালিকার সওয়াল মুসার সওয়াল বলে আমাদের সাহিত্যে যে একপ্রকার তত্ত্বগ্রন্থ আছে, তাকেও এ-যুগের জীবন-দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে দেয়া যায় চমৎকার আধুনিক রূপ, যোগ্য হাতে পড়লে রূপে-রসে মসনবীর মতো হতে পারে এগুলো।
হামজা-হানিফা-রুস্তম-সোহ্রাব প্রভৃতি যে শুধু আমাদের আধুনিক কিশোর-সাহিত্যে নায়ক হতে পারেন তা নয়, তাদের দিগ্বিজয় কাহিনীর মধ্যে এমন উপাদান রয়েছে, যা রোমান্টিক কাহিনীর কিংবা উৎকৃষ্ট গীতিকবিতার হতে পারে বিষয়বস্তু!
এমনি আরো কত বিষয় রয়েছে ছড়িয়ে। আমরা অনধিকারী, তা আমাদের চোখে পড়বার কথা নয়। কোথায় কোনো সৃষ্টির বীজ লুকিয়ে আছে, কোথায় কোনো সাহিত্য-রত্নের টুকরো রয়েছে পড়ে তা সহজে নজরে পড়তে পারে সৃষ্টিশীল লিখিয়েদেরই। আমাদের অনুভূতিহীন স্থূলদৃষ্টিতে যা তুচ্ছ, তা-ই যোগ্য লোকের মহৎ সৃষ্টির উপাদান হতে পারে হয়তো। আমাদের কেবল বলবার কথা এই যে ঐতিহ্যানুগত্য ছাড়া জাতি যেমন অবাধে বড় হয় না, তেমনি সাহিত্য ঐতিহ্য অবহেলা করলে সহজে তৈরি হতে পারে না মহৎ সৃষ্টির ক্ষেত্র। উৎকৃষ্ট সাহিত্যের অনুবাদ যেমন তৈরি করে দেয় নতুন ভাষা ও সাহিত্যের বুনিয়াদ, তেমনি সাহিত্যের বিকাশ ও মননের প্রসার দ্রুততর হয় পুরোনো সাহিত্যের নব রূপায়ণে। টি. এস. এলিয়ট পুরোনো উপমাদি পর্যন্ত নতুন ব্যঞ্জনায় প্রয়োগ করে অর্জন করেছেন অসামান্য সাফল্য এবং এ বিষয়ে নয়া ব্রতীদের দিয়েছেন দিশা।
সাহিত্যক্ষেত্রে আগেও নিঃস্ব ছিলাম না আমরা। গর্ব ও গৌরব করবার মতো সাহিত্যিক ঐতিহ্য আমাদের ছিল বরাবরই। কিন্তু প্রয়োজনমতো কাজে লাগাইনি তা। তাই আধুনিক সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের দীনতা যতটুকু ঘুচতে পারত তা-ও ঘোচেনি। আমাদের অক্ষমতা নয়, উদাসীনতাই এর জন্যে অনেকখানি দায়ী। আশার কথা, আমাদের অনেক লিখিয়েই সচেতন হয়েছে এ ব্যাপারে এবং পুথির উপাদান নিয়ে লিখতে হয়েছেন উদ্যোগী। তবে মনে রাখতে হবে, আমরা পুরাতনের উদ্বর্তন চাইনে, পুরাতন সামগ্রী নিয়ে নয়া ইমারত তৈরি করে নতুনের আবাহন ও প্রতিষ্ঠাই কামনা করি তাতে। কিন্তু জীবন যে মুখ্যত মৃত্তিকা-আশ্রয়ী তা ভুললে চলবে না। স্বদেশের আবহাওয়ায় গড়ে ওঠে জীবন। প্রাণ-রস পায় মানুষ দেশের ঐতিহ্য থেকেই। কেননা, এ ঐতিহ্য হচ্ছে তারই পূর্বপুরুষের অর্জিত বা সৃষ্ট কিংবা কৃতির ফসল। ধর্মীয় জীবন হচ্ছে বাইরের থেকে পাওয়া আদর্শের কৃত্রিম রূপায়ণ। তাই দেশী ঐতিহ্যকে অবহেলা করে কেবল ধর্মীয় কিংবা ধর্মীয় ঐক্যসূত্রে পাওয়া বিদেশী ঐতিহ্যের প্রয়োগে সাহিত্য সৃষ্টি করলে তা হবে তাসের ঘরের মতো অকেজো ও অসার্থক। তা কখনো হবে না প্রেরণার কিংবা অনুভবের উৎস।
কথাসাহিত্যে সমস্যা ও এর বিষয়বস্তু
০১.
সভ্যতার আদিম স্তরে এমন একদিন ছিল যখন স্কুল ক্ষুন্নিবৃত্তি ও যৌনবোধ ছাড়া মানুষের আর কিছুই ছিল না। জনসংখ্যা কম ছিল, বিস্তৃত ভুবন পড়েছিল তাদের পায়ের তলায়। কাজেই জীবন জীবিকার সমস্যা ছিল না মোটেই। তাই সেকালের অজ্ঞ মানুষ চারদিককার নিসর্গ ও প্রকৃতির প্রতি সবিস্ময়ে তাকাবার অবসর পেয়েছে প্রচুর। যেখানে অজ্ঞতা, সেখানেই বিস্ময় ও কল্পনার প্রশ্রয়। সেদিনকার বিস্ময়-ব্যাকুল মানুষ তাই মনোময় রূপকথা সৃষ্টি করে জগৎ ও জীবনের কল্প-নির্ভর ব্যাখ্যা দিয়ে স্ব স্ব কৌতূহল নিবৃত্ত করেছে। এরূপে ভূত, প্রেত, রাক্ষস, দৈত্য, পরী, যক্ষ ও দেবতা মানুষের মনোরাজ্যে বিচরণ করতে থাকে।
দ্বিতীয়স্তরে মানুষের জীবনবোধ প্রসারিত হল। উচ্চবিত্তের লোকমনে আত্ম-প্রসারের প্রেরণা জাগল। কিন্তু কল্পলোকের পূর্বতন অধিবাসীরাও ঠাই ছাড়ল না। তারাও রইল। উচ্চবিত্তের মধ্যে এ আত্মপ্রসার প্রবৃত্তি দেখা দিল জরু ও জমির অধিকার লিপ্সারূপে। তারা রাজ্য ও রাজকন্যার সন্ধানে ছুটল দিকে দিকে। সৃষ্ট হল রোমান্স। এবারকার অভিযানে নায়ক রাজকুমার, মন্ত্রীপুত্র, কোটাল আর বিত্তশালী সওদাগর। সেদিনও বেনে-বুদ্ধি রাজশক্তির সঙ্গে জোট মিলিয়ে পাল্লা দিয়ে চলত!
কিন্তু গণমানব-মনে এতবড় দুরাকাঙ্ক্ষা তখনও জাগেনি। একে তারা তাদের পক্ষে অশোভন ঔদ্ধত্য বলে মেনে নিল। তাই তারা পড়ে রইল একান্তে। কিন্তু ব্যবহৃত হল উচ্চবিত্তের জীবন লীলার হাতিয়াররূপে। এভাবে শুরু হল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পটভূমিকায় অজ্ঞ মানুষের কল্পবিহারী মনোজীবনের লীলা। কথা সৃষ্টি হল–রূপকথা ও উপকথা। এ কথার তথা সাহিত্যের নায়ক হচ্ছে উচ্চাভিলাষী উচ্চবিত্তের মানুষ।
সভ্যতার তৃতীয়স্তরে যদিও মানুষের জীবন-জিজ্ঞাসা বাড়ল–মানুষ অধিকতর জীবনমুখী হল, তথাপি তা গণজীবনেতর রইল। কল্পবিহারী মন মর্ত-প্রবাস শুরু করল বটে, তবে কল্পলোকের প্রতিবেশীকে ত্যাগ করল না। এতটুকু যে করল, তাও গরজে পড়ে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল। নিম্নবিত্তের ও কতক লোকের উচ্চাভিলাষ জাগল, জীবনে ভোগেচ্ছা বাড়ল, জীবিকা-প্রয়াস হল তীব্রতর। এরূপে জীবনবোধের প্রসার হল। সৃষ্টি হল রোমান্স।
এ স্তরে বাস্তব ও স্বপ্ন, কল্পনা ও প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও বোধি, জগৎ ও জীবন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ল। সৃষ্টি হল অভিজাতদের গরজে ও স্বার্থে জাতীয় মহাকাব্য।
একেই আমরা বলছি আদি মধ্যযুগ। মানব-সভ্যতার ইতিহাসে এ স্তর দীর্ঘস্থায়ী হয়েছ। এ যুগের মুখ্য নীতি হচ্ছে জোর যার মূলক তার। অর্থাৎ যোগ্যতরের উধ্বর্তন। এ যুগের ক্রম পরিণতিতে মানুষের হৃদয়বৃত্তির বিকাশ হয়েছে। বহু মহত্ত্বলি, নানা আপ্তবাক্য আমরা শুনলাম। বিচিত্রগামী বুদ্ধিবৃত্তির আভা পরিব্যাপ্ত হল সর্বত্র। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জীবন ও জীবিকা সম্মুখীন হল কঠিনতর সমস্যার। জনসংখ্যা পেল বৃদ্ধি। স্থায়ী বসবাস হল। জীবন-বোধ প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ল জীবনের চাহিদাও। অথচ প্রয়োজনের ওজনমতো ভোগ্যবস্তু বাড়েনি, ফলত দেখা দিল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। লেগে গেল কাড়াকাড়ি, মারামারি ও হানাহানি। মানুষের এ আত্মধ্বংসী সংগ্রামে, এ দুর্যোগকালে এগিয়ে এলেন অভিজাত প্রজ্ঞাসম্পন্ন বুদ্ধিমানগণ। প্রচারিত হল ধর্মের নামে নীতিশাস্ত্র। এরূপে শুরু হল নিয়তি, অদৃষ্টবাদ, ইহ-পরকাল, স্বর্গ-মর্ত্য, জন্মান্তর, পাপ-পুণ্য, রিজিকের মালিক রাজ্জাক, সুখ-দুঃখ, প্রেম-প্রীতি, ন্যায়-নীতি প্রভৃতি হাজারো কথার মারপ্যাঁচে মানুষকে দ্বন্দ্বে নিরস্ত করবার অশেষবিধ প্রয়াস। এভাবে মানুষকে ত্রিবিধ নিয়মনীতির নিগড়ে বেঁধে রাখবার চেষ্টা চলল। ধর্মের বিধি, সমাজের নীতি ও রাজার শাসন-ই সেই নিগড়। চিরকালই দেখা গেছে Law maker-রা সাধারণত Law abider হয় না, কাজেই এসব তৈরি হয়েছে দুর্বলকে দ্বন্দ্বে সংগ্রামে নিরস্ত রাখবার জন্যেই। তাদের সে উদ্দেশ্য বহুল পরিমাণে সফল হয়েছিল, তবু যুগ ও জন-প্রয়োজনে পাল্টাতে হল নিয়ম ও আদর্শের ধরন ও ধারণ। এরূপে কত ধর্মের জন্ম মৃত্যু হল
.
তারপর এল শেষ মধ্যযুগ। মানুষ আরো বাড়ল। জীবনবোধ তীক্ষ্ণতর হল। বৃদ্ধি পেল ভোগলিপ্সা। ফলে জীবনোপভোগের পরিধি হল প্রসারিত। ভোগ্যসামগ্রীর চাহিদাও বাড়ল। অধিকাংশ লোকের মনে জাগল উচ্চাভিলাষ। জীবন-ধারণ পদ্ধতি ও জীবিকা-উপায় উদ্ভাবনে। অতৃপ্ত মানুষ ব্যাকুল হয়ে উঠল। দেখা দিল ভাববিপ্লব, আদর্শ বিভ্রাট, জীবনজিজ্ঞাসা, বুদ্ধিবৃত্তির বিচিত্রলীলা। বিজ্ঞান-দর্শনের কচকচি আর ঠোকাঠুকি। আস্তিক্য, নাস্তিক্য, ভাব, যুক্তি ও বিবর্তনবাদের সুরাসুরিক দ্বন্দ্বে নতুন ভাব-চিন্তা ও যুক্তির আবির্ভাব ঘটল। এ দ্বন্দ্বের ঝুঁকি নিল য়ুরোপ। যুগার্জিত বিশ্বাস-সংস্কার এবং জগৎ ও জীবনের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি হল পরিবর্তিত। সমাজের অভ্যস্ত জীবন বিপর্যস্ত হল ভিতরে বাইরে। এ কারো কাছে অমৃত, কারো কাছে গরল।
বৈজ্ঞানিক আবিক্রিয়া বিশাল দুনিয়াকে করে দিল সংহত ও ঘোট, এ ভাব বিপ্লব ও তদানুষঙ্গিক যন্ত্রদানব অল্পকালের মধ্যে পৃথিবীকে পুরে ফেলল আপন মুঠির মধ্যে। এ ভালোই হল। কেননা, কোনো নতুন মানুষের অমঙ্গলের জন্যে আসে না, অন্তত এ পর্যন্ত তার পষ্ট প্রমাণ মেলেনি। নতুনকে বরণ ও ধারণ করেই মানুষ ও মনুষ্য-সভ্যতা এগিয়ে এসেছে।
নতুন যান্ত্রিক পরিবেশে জীবিকার্জন পদ্ধতিতে বিপর্যয় ঘটল। ধনবণ্টন সমস্যার অর্থনৈতিক আবর্তে জীর্ণ হয়ে পড়ল পুরোনো সমাজকাঠামো। বিত্তশালীদের জীবনে জীবনোল্লাস যেমন বাড়ল, তেমনি বিত্তহীনদের চিত্তে জাগল চরম বিক্ষোভ-সে বিক্ষোভ হতবাঞ্ছর। এর ফলে চিরকালের একটা মানসিক ব্যবধান ঘুচল। আগে আর্থিক সমতার কথা, জন্মসূত্রে নয় কর্মসূত্রে জীবন নিয়ন্ত্রণ ও উপভোগের বিষয়, পরলোকে বিশ্বাসী নিয়তিনির্ভর অজ্ঞ মানুষ ভাবতে সাহস পায়নি। এবার তাদের চোখ খুলে গেল, মনের সংকোচ গেল টুটে। উঠল জগতে ও জীবন জন্মসূত্রে সমাধিকারবাদ ও সুযোগবাদের ধ্বনি। ফলে মানুষ অবিশেষের মনে জাগল অপরিমেয় ভোগেচ্ছা এবং তজ্জাত লোভ ও ঈর্ষা। আর তা থেকে শুরু হল দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। বিঘোষিত হল গণতন্ত্রের জয়।
এভাবে আধুনিক যুগ হল শুরু। বিজ্ঞানই এ যুগের উদ্বোধক। ভাবের রাজ্যেও পৌরোহিত্য তারই। এ-যুগ অধিকারবাদের যুগ। সে-অধিকার আদায়ে সংগ্রামী মানুষ আমরা। এ যুগে আকাশ ও প্রকৃতি থেকে মানুষের দৃষ্টি নেমে এল জীবনের উপর–মাটির দিকে। ভোগেচ্ছার পরিপূর্তিই আমাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। আমরা বস্তুতান্ত্রিক, আমরা নাস্তিক। কোনো বৃহৎ ও, মহৎ বুলি আমাদের বিভ্রান্ত করতে পারছে না। মুগ্ধ করে না স্বর্গ-সুখ। বিভীষিকা সৃষ্টি করে না দোজখের যন্ত্রণা। আমরা বলি–মানবের তরে মাটির পৃথিবী।
চিরকাল দুর্বলের প্রতিরোধ ব্যবস্থা চলে সঙ্ঘবদ্ধতায়। তাই আজ নিঃস্ব লোকেরা জোট বেঁধেছে। দোহাই কাড়ছে মানবতার। দুর্বল যখন বাহুবলে অন্যায়-নিপীড়নের প্রতিকারে অক্ষম হয়, তখন তাঁর মুখে ফোটে ন্যায়-নীতির আবেদন। সে চেষ্টা করে সমশ্রেণীর ও সমভাবে নিপীড়িত জনের সহানুভূতি ও সহায়তা লাভের। যখন নিপীড়ন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, তখন মরিয়া হয়ে আত্মস্বার্থে লোক জুটে যায়। শুরু হয় সংগ্রাম। আমাদেরও এ মানবতা-মন্ত্রের পশ্চাতে রয়েছে বঞ্চিত বুকের বেদনার বিক্ষোভ। আসলে এটাও আমাদের ভোগেচ্ছা ও ঈর্ষার শোভন বহিঃপ্রকাশ মাত্র। বক্তব্যটি এই জনসংখ্যা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে ও যাচ্ছে, সে পরিমাণে যখন ভোগ্যসামগ্রী বাড়ছে না, তখন টানাটানি অপরিহার্য। এহেন দুর্দিনে যখন কারো কারো গাছতলাও জুটছে না তখন, তোমাদের সৌধে বাস শোভা পায় না। এ হৃদয়হীন অসামাজিক মনোভাব। তোমাদের অট্টালিকা, প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রাপ্তি ও প্রাচুর্য দেখে আমাদের আশ্রয় ও অশনহীনতার দাহ বেড়ে যায়। অতএব, তোমরাও কিছুটা নেমে এসো, আমরাও কিছুটা উঠে আসি। তোমারও প্রাসাদের পাট চুল, আমারও কুটিরের অভাব ঘুচল। এবার তোমার আমার অভাব সমান হল। আমার মনের ঈর্ষাজাত লোভ-ক্ষোভের জ্বালা জুড়োল। তুমি আমি হলাম বন্ধু, আত্মীয় এবং অখণ্ড মানব জাতি। তবে অভাব রয়ে গেল। তা আর কী করা যাবে! এসো, দেখা যাক, নতুন যন্ত্র প্রয়োগে নতুন উপায়ে ও নতুনতর কৌশলে বুড়ি ধরণীর রস আরও কিছুটা নিঙড়ানো যায় কী না। এতে আরো প্রবল নৈতিক যুক্তি রয়েছে। আমরাই যখন আয়োজনাতিরিক্ত আমন্ত্রণ করি না, তখন স্রষ্টা খাওয়া-পরার ব্যবস্থাতিরিক্ত জন সৃষ্টি করেছেন–এ কথা ভাবব কেন? Terminus-এ প্রথম উঠেছে বলেই কী রেলগাড়ির গোটা Compartment-এ-কোনো লোকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? এ-ই হচ্ছে আজকের মানুষের মনের কথা, মুখের বুলি ও সংগ্রামের কারণ। এর সমাধান ছাড়া এড়ানোর উপায় নেই।
কাজের কথা বলতে গিয়ে এতক্ষণ ধরে রূপকথা শোনালাম, এর প্রয়োজন ছিল। পটভূমিকা ছাড়া বক্তব্য অর্থহীন হত।
সাহিত্য মনুষ্য-মনেরই সন্তান। তার যখনকার যে মনোভঙ্গি, তা-ই তখন প্রতিফলিত হয় তার সৃষ্ট সাহিত্যে। এজন্যেই সাহিত্যকে জীবনের প্রতিচ্ছবি বলা হয়। বলা হয় ব্যক্তিক ও জাতীয় জীবনের মুকুর। বাহ্য সমস্যার সঙ্গে মানুষের এ মনোবিবর্তনের সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে মানুষের অতীত সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্প। মানুষের অজ্ঞতার ক্রমবিদূরণ, জীবনবোধের প্রসার, প্রজ্ঞা, বুদ্ধি ও বোধির ক্রমবিকাশ, হৃদয়বৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তির অভিজ্ঞতালব্ধ ক্রমোন্নতি প্রভৃতি প্রতিবিম্বিত হয়েছে এসব সাহিত্যে। বিস্ময়াবিষ্ট অজ্ঞ মানুষের সাহিত্য ছিল ভূত-প্রেত-দেও-পরী-রাক্ষসের লীলা, তারপরের যুগে পেলাম রাজা বাদশাহর জীবন-বিলাস চিত্র। তারপরে পেয়েছি ন্যায়নীতি আদর্শবাদ-পুষ্ট ইহ-পারলৌকিক জীবনের মোহনীয় ও বিভীষিকাময়ী কাহিনী। মানুষের জীবন জীবকার সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে মনোভঙ্গি যেমন বদলেছে, জগৎ ও জীবন জিজ্ঞাসা-পদ্ধতি যেমন বিবর্তিত হয়েছে, সাহিত্যেরও তেমনি সমভাবে রূপান্তর ঘটেছে আদর্শে, রূপকল্পে ও রকল্পে। বিবর্তিত হয়েছে ভাষা, পালটে গেছে ভঙ্গি, পরিবর্তিত হয়েছে রস-রুচিবোধ। বিষয়বস্তুও হয়েছে বহুবিচিত্র। আজকের সাহিত্যকে তাই পুরনো নিয়ম-নীতির নিরিখে যাচাই করা চলবে না। আজকের সাহিত্যের সাধারণ নাম রস সাহিত্য নয়–গণসাহিত্য। আজকের সাহিত্য-শিল্প কুশলতা মাত্র নয়, গণমানবের আত্মিক উন্নতির জন্যেই সাহিত্য। সমাজের জন্যে নয়, রাষ্ট্রের জন্যেও নয়–একান্তভাবে ব্যক্তিসত্তায় আস্থাবান মানুষের জন্যেই হবে এ সাহিত্য। মানুষ অবিশেষের মর্যাদা ও অধিকার-বোধ জাগানো ও প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই রচিত হবে সাহিত্য। প্রতি মানুষের জীবনের মর্যাদা ও মূল্যমান যথার্থভাবে বুঝিয়ে দিয়ে মানুষকে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তুলবার সাধনার অবলম্বন ও বাহন হচ্ছে এ সাহিত্য। তাই আজকের সাহিত্য অবসরবিলাসীর চিত্তবিনোদনের জন্যে নয়, কেজো মানুষকে প্রেরণা ও প্রতিষ্ঠা দানের জন্যেই। হালকাভাবে বললেও স্বীকার করতে হবে যে : যার খায় তার গুণ গাইতে হয়। এককালের লেখকেরা ধনীর আশ্রয়-নির্ভর ছিলেন, তাই সাহিত্যে স্তুতি গেয়েছেন ধনীমানবের। আজ গণমানবই তাদের খোরপোশ যোগায়। কাজেই আজ সাহিত্য সৃষ্টি হবে গণমানুষের স্বার্থে ও কল্যাণে। সেকালের ধনীদের স্তুতিকার হবেন একালের গণমানবের চাটুকার।
আজদের দিনের বিশ্বসাহিত্যে সার্থক স্রষ্টাগণ মানুষকে নিবিড়ভাবে জানবার ও জানাবার এই মহান ব্রতই গ্রহণ করেছেন। আজকের দিনে লেখকের সাহিত্য কথা-শিল্প নয়–জীবন-শিল্প। একনিষ্ঠভাবে সাধনা চলেছে জীবনের অর্থ খুঁজবারও। মার্ক টোয়েন, সমর্সেট মম, পার্লক, হেমিংওয়ে, জোলা, রোলা, আনাতোলা ফ্রাঁ, টুর্গেনিত, গোর্কী, ডস্টয়ভী, টলস্টয়, শেখভ, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি আমাদের এ পথেরই সন্ধান দিয়েছেন। কল্লোল কালিকলমের যুগ থেকে পশ্চিমবঙ্গেও এ সাধনাই লঘু-গুরুভাবে চলে আসছে।
.
০২.
আমরাও ব্রত গ্রহণ আর সাধনার দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই। কিন্তু সিদ্ধি আজো যেন নাগালের বাইরে। এর যেসব কারণ আমরা অনুমান করেছি, সেগুলোই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব।
আজকের সাহিত্যান্দোলনের উদ্গাতা য়ুরোপ। আজকের সাহিত্য মানুষের জীবনভিত্তিক। সে জীবন বাহ্যত সামাজিক, অর্থনীতিক ও রাষ্ট্রিক হলেও তাদের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়াজ যে-মনোজীবন, তার স্বরূপ উদ্ঘাটনই শিল্পীর মূল লক্ষ্য। কাজেই সেকেলে-ধারায় একেলে সাহিত্য সৃষ্ট হতে পারে না।
সাহিত্যের আধুনিক রূপকল্প হচ্ছে য়ুরোপের সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ফল। তাই তাদের কাছে যা স্বতঃস্ফূর্ত, আমাদের কাছে তা অনুকৃতি মাত্র। আর অনুকৃতি মাত্রেই কৃত্রিম। বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়ার শক্তি যেমন আমাদের জন্মায়নি, অথচ আমরা পূর্ণ যান্ত্রিক সেবা ও সুবিধে গ্রহণ করছি; ওদের তৈরি যন্ত্রের অনুকরণে আমরাও অনুরূপ যন্ত্র তৈরি করে নিচ্ছি, কিন্তু নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে পারছিনে। সাহিত্য শিল্পে আর আদর্শেও তেমনি আমাদের অনুরূপ অক্ষমতা ও অনুকৃতি প্রকাশ পেয়েছে। প্রতীচ্য সংস্কৃতি বরণে ও ধারণে আমরা ভুঁইফোড় বলেই আমাদের স্বীকরণ ক্ষমতা জন্মায়নি। এসব গুণ আহরণ করা চলে না, অন্তর্নিহিত শক্তিবলে অর্জন করতে হয়, পেলব্ধ হওয়া চাই। ফলে অশিক্ষিত লোক স্যুট পরলে যেমন তা তার দেহে খাপ খায় না, আমাদের মনের সঙ্গে য়ুরোপীয় ভাবধারাও তেমনি মিশে যেতে পারছে না। তাই আমাদের আত্মবোধ যত প্রবল, গণবোধ তত সাবলীল নয়। এজন্যেই শিক্ষা-প্রবুদ্ধ ও সংস্কৃতিপরায়ণ য়ুরোপে যা সহজেই সম্ভব হয়েছে, নতুন শিক্ষিত আমাদের কাছে তা-ই উঠেছে সমস্যা হয়ে।
আমরা কী লিখব আর কেমন করে লিখব তার সৃষ্টি-সম্ভব ধারণা আমাদের মনে গড়ে ওঠেনি। অথচ সাহিত্য-শিল্প হচ্ছে কী ভাবছি তা নয়, ভাব কীভাবে প্রকাশ করছি তা-ই। কাজেই আমাদের কথা-শিল্পে, রূপকল্প ও রসকল্পএই উভয় দিক দিয়েই সমস্যা রয়ে গেছে।
মহৎ সৃষ্টির জন্যে জগৎ ও জীবনকে একান্তভাবে অনুভব করতে হয়। তার জন্যে দরকার দৃষ্টি ও সংবেদনশীল মন। সৃষ্টির আগে দৃষ্টি নিখুঁত ও সামগ্রিক হওয়া চাই। এজন্যে আমাদের দুটো প্রাথমিক সাধ্যবস্তু রয়েছে। একটা হচ্ছে, জৈব-জীবনের বৃত্তি-প্রবৃত্তি তথা মানব-মনের গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে সচেতনতা এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে মানব- চরিত্রে ও আচরণে প্রতিবেশিক প্রভাব সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জন। শিল্পীরা হচ্ছেন স্রষ্টা। আর ভাব-ভাষার জাদুস্পর্শে সজীব, সচল ও ক্রিয়াশীল মানুষ সৃষ্টি করা কী সহজ কথা! কোনো বস্তু বা ব্যক্তির সামগ্রিক স্বরূপ দৃষ্টিতে বা মনে ধরা না দিলে তার চলচ্চিত্র দেওয়া অসম্ভব। যেমন ঢাকা শহরের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমি জবাব খুঁজে পাইনে, কেননা এর সামগ্রিক রূপ আমার কাছে পষ্ট নয়। না জানার চেয়ে কম জানাতেই ভুল হয় বেশি।
মানব-প্রবৃত্তি সম্বন্ধে যথার্থ জ্ঞান না থাকলে সৃষ্ট চরিত্র অস্পষ্ট ও অস্বাভাবিক হতে বাধ্য। আর সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস-সংস্কার, অদৃষ্টবাদ, নিয়তিনির্ভরতা, আর্থিক ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাব যে মানুষের আচরণকে বিচিত্রভাবে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করে, তা না জানলে, সজীব ও স্বাভাবিক মানুষ সৃষ্টি হবে কী করে?
এক কথায়, মানুষের প্রতিমুহূর্তের বাহ্যাচরণ ও জীবন-প্রচেষ্টার মধ্যে মনুষ্যজীবনের বৃত্তি প্রবৃত্তির যে অদৃশ্য প্রভাব রয়েছে, তার যথার্থ স্বরূপ না জানলে বা কারণ-ক্রিয়া জ্ঞান না জন্মালে কোনো রচনাই শিল্পায়ত্ত হবে না।
আমাদের মনে হয়, এ দুটো অভিজ্ঞতার অভাবেই মুখ্যত আমাদের ছোট গল্প সার্থক হচ্ছে না, আর লেখকেরা উপন্যাস রচনায় সাহস পাচ্ছেন না। যারা সাহস করে এগিয়ে আসছেন, তারাও প্রায়ই ব্যর্থ হচ্ছেন। এ কারণেই বহু প্রশংসিত সূর্য দীঘল বাড়িতে দৃষ্টি আছে, সৃষ্টি নেই। অর্থাৎ দৃষ্টির পরিচয় আছে, কিন্তু সৃষ্টির স্বাক্ষর তেমন নেই।
এদিকে আমাদের যা ছিল তা-ও হারাতে বসেছি। পারিবারিক ও সামাজিক যে নিবিড় আত্মীয়তাবোধ ছিল, শিক্ষা-প্রবুদ্ধ জনগণ তাও হেলায় ত্যাগ করেছে। আমরা যতই বৃহত্তর মানবতাবোধ তথা মনুষ্যপ্রীতির দোহাই কাড়ছি, আমাদের আত্মীয়তাবোধ যেন ততই ম্লান হয়ে আসছে। অপ্রেম ও অসামাজিকতা যেন বেড়ে চলেছে। এর জন্যে দায়ী আমাদের নতুন-গড়া মধ্যবিত্ত মনোভাব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি প্রয়োজনে আমাদের শিক্ষিত সাধারণের হাতে যোগ্যতাতিরিক্ত টাকা আসে, তাঁরা এখন উচ্চবিত্তের লোক। তাদের জীবনের ব্রত ধন-আহরণ আর লক্ষ্য একখানা গাড়ি ও ধানমণ্ডিতে একখানা বাড়ি। এসব ভুঁইফোড় ধনী আভিজাত্য-লোভে ও ঐশ্বর্যগর্বে নিজেদেরকে বিরাট গণসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছেন। অথচ এঁরাই হচ্ছেন সমাজ-সংস্কৃতির শক্তির উৎস। এর সঙ্গে একটি মারাত্মক সরকারি নীতিও হয়েছে যুক্ত। সরকার কর্মচারীদের মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছেন, এতে চাকুরিজীরিদের অভাব অনেক পরিমাণে লাঘব হয়েছে। যদিও তারা সংখ্যায় নগণ্য, তবু প্রভাব-প্রতিপত্তিতে তারাই হচ্ছেন সমাজের দিশারী। পাঁচ কোটি লোকের দেশে কয়েক লক্ষ লোকের আর্থিক দৈন্য ঘুচলেই দেশ কিছু উন্নত হয় না। পক্ষান্তরে শিক্ষিত লোকদের এভাবে গণসমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সরকার ভেদনীতির প্রয়োগে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করছেন মাত্র। এতে নেতৃত্বাভাবে অজ্ঞ অসহায় পাঁচ কোটি লোকের। অভাব-নিপীড়ন বাড়লই। যদি নতুন-গড়া শিক্ষিত শ্রেণীরও যথার্থ চিত্তবিক্ষোভ ও হতবাচ্ছা থাকত, তবে তাদের প্রভাবে দেশের গণমন সহজে জাগত। আত্মরক্ষার গরজেই সমবেত প্রয়াস চলত দেশের উন্নতির জন্যে।
আমাদের এ-কথা ভুললে চলবে না যে শ্ৰমিক-নেতা যেমন শ্রমিক নন, কৃষক-নেতা যেমন চাষী নন, জননেতা যেমন জনগণের নাগালের বাইরে, তেমনি লেখকগণও সাধারণত অনভিজাত নন। কাজেই যে-সমাজ থেকে লেখকের আবির্ভাব সে-সমাজই এখন ধ্যান করছে গাড়ি-বাড়ির। কাজেই গণ-সমাজের প্রতি তাদের সে-নজর কোথায়–যে দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করলে দুদবোধ ও সহানুভূতির ছোঁয়ায় গণহৃদয়-মন ও আশা-আরজু লেখকের নিজ হৃদয়-মনে মুকুরের মতো প্রতিফলিত হয়? উনিশ শতকের কোলকাতার মধ্যবিত্তদের মতোই আত্মসর্বস্ব হয়ে উঠেছে এই বিত্তশালীরা।
আমাদের সামাজিক জীবনের আর এক মস্ত বিড়ম্বনা–মিথ্যা আত্মসম্মান-বোধ ও আভিজাত্যচেতনা। যে-কেউ একটু লেখাপড়া করে, সেই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বলে আত্মপরিচয় দেয়। আসলে আমাদের সমাজে সাম্প্ৰত-পূর্ব যুগে শ্ৰেণী হিসেবে কোনো মধ্যবিত্ত ছিল না। আসলে সবাই বিত্তহীন। চাকুরি না করে যে খেতে-পরতে পারে না, সে বিত্তবান হয় কী করে! একজন দিনমজুর বা রিকশাওয়ালা ও আমাদের তথাকথিত মধ্যবিত্তের মধ্যে বিত্তের দিক দিয়ে তফাৎ কোথায়! কাজ না পেলে ওরও ভাত জুটে না, এরও আহার মেলে না। এ আত্মপ্রবঞ্চনা-আর্তনাদকে আস্ফালন দিয়ে ঢাকবার এ চেষ্টা আমাদের নিজেদেরও স্বরূপ উপলব্ধির পথে প্রবল বাধা। তাই আজো আমরা অকপটে আত্মকথাও শিল্পায়ত করতে পারিনি। মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত এই বিত্তহীন বা স্বল্পবিত্ত শ্রেণীর মতো অসহায় দুঃখী মানুষ এদেশে সত্যিই আর নেই। এদের বিত্তের সঙ্গে বৃত্তি বেসাত যুক্ত না হলে দুবেলা দুমুঠো অন্ন জোটানো মুস্কিল, বৃত্তি যা জোটে তা সামান্য কেরানিগিরি, নয় মাস্টারি। আজকের দুর্মূল্যের দুর্দিনে যে জীবন-যুদ্ধ শুরু হয়েছে, তাতে দাঁড়াবার ঠাই পাচ্ছে না, এরা কুলি-মজুরের চাইতেও অসহায়। কেননা এরা দুঃখের কথা কইতেও পারে না, সইতেও পারে; ভিক্ষাবুলিও নেয়া চলে না, গাছতলায় বাস করতে পারে না। এবং এদের জীবনবোধ অশিক্ষিতদের চেয়েও বেশি বলে বেদনাও তীব্রতর।
আবার বিক্ষুব্ধচিত্তেও সার্থক সৃষ্টি সম্ভব নয়। তাতে চিত্ত বিক্ষোভজাত উচ্ছ্বাস শিল্পীর সংযমবোধ ও রসদৃষ্টি ব্যাহত করে। এ ধরনের সৃষ্টি সাধারণত হয় গীতাত্মক বা বিবৃতিমূলক। সার্থক সৃষ্টির জন্যে শান্ত, সমাহিত অথচ সহানুভূতি ও সংবেদনশীল মনোভঙ্গির প্রয়োজন, পরিমিত দূর থেকে বা উপর থেকে দেখলে যে-কোনো বস্তু বা ঘটনার সামগ্রিক স্বরূপ যেভাবে দৃষ্টিগোচর হয়, ভেতর থেকে তা কখনো সম্ভব নয়, সে-অবস্থায় শুধু বিচ্ছিন্ন ও খণ্ডিত রূপই চোখে পড়ে। তা ই চিত্রিত করতে গেলে খাপছাড়া হয়ে ওঠে।
আর একটি ক্রটি প্রায়ই চোখে পড়ে। আমাদের অনেক গল্প-লেখক মনে করেন, গীতিকবিতার সঙ্গে ছোটগল্পের বিশেষ পার্থক্য নেই। অনুভূতি ও ভাবের দিক দিয়ে হয়তো এ ধারণা আংশিক সত্য, কিন্তু আঙ্গিকের দিক দিয়ে এদের আসমান-জমিন তফাৎ। কিন্তু তাঁরা তাঁদের অনুভূত তত্ত্বটি সংলাপের ও বিবৃতির মাধ্যমে কোনোরকমে প্রকাশ করেই ছুটি নিতে চান। ফলে অনেক গল্পই রূপে ও রসে তথা আঙ্গিকে ও চিত্রণে গল্প হয়ে ওঠে না। সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাতে চাইলে যেমন শুধু দিগন্তে একটা সূর্য এঁকে দিলেই হয় না; আকাশ, নদী, গাছপালা, কুটির প্রভৃতির উপর অস্তায়মান সূর্যের রশ্মি ছড়িয়ে সূর্যাস্তকালীন দৃশ্য পরিস্ফুট করতে হয়, তেমনি গল্পের বক্তব্যের অনুকূল প্রতিবেশ বা পটভূমিকা সৃষ্টি করে বক্তব্যকে শিল্পায়ত করতে হয়। এ-না হলে গল্প অচল।
আর একটা বিষয় যথাযযাগ্য গুরুত্ব সহকারে আমাদের বুঝে দিতে হবে। যন্ত্র- বিজ্ঞানের প্রভাবের ফলে এ যুগে জনজীবনে বিপর্যয় এসেছে। সে-বিপর্যয় আর্থিক ও মানসিক। আমাদের আনন্দের পিপাসা আছে, অথচ আনন্দ নেই। আনন্দের সামগ্রী যতই বাড়ছে ততই আনন্দ যেন আলেয়ার মতো ফাঁকি দিচ্ছে, মরীচিৎকার মতো শুধু মানসিক পীড়নই বাড়াচ্ছে। য়ুরোপ তাই বিক্ষুব্ধ, চঞ্চল আর ব্যাকুল শান্তি ও আনন্দের সন্ধানে কেমন যেন ছটফট করছে। আমাদের দেশেও সে অবস্থা এল বলে!
আগের দিনে আনন্দ-উৎসব ছিল পার্বণিক ব্যাপার, নিত্য ঘটত না। তাই যাত্রা, পাঁচালি, খেলা প্রভৃতির আয়োজনের উত্তেজনায় ও স্বপ্নে কাটত কয়দিন, আর স্মৃতিতে মাধুর্যে কাটত বহুদিন। এভাবে কেটে যেত স্বপ্ন ও স্মৃতিঘেরা বছর। অবরুদ্ধ বধূ বাপের বাড়ি নাইরে যাবার স্বপ্নে, নাইহরের সুখ-উত্তেজনায় আর নাইহর অন্তে তার মধুর স্মৃতি মন্থন করে সহজেই বছর ফুরিয়ে দিতে পারত। আর আজ সিনেমা, খেলাধূলা, ভ্রমণ, কিছুই যেন চোখে নতুন ঠেকে না, মনে লাগায় দোলা। শহুরে মেয়েরা নাইরে প্রিয়-পরিজনের সান্নিধ্যের মাধুর্য আর কল্পনাও করতে পারে, অবাধে চলাফেরার সুবিধে সেই সুখ-স্বপ্ন ও উল্লাস থেকে বঞ্চিত করেছে তাদের। তার উপর পৃথিবী একখানি ছোট মানচিত্রের মতো ঝুলে রয়েছে চোখের সামনে। বিদ্যার প্রসারে, আর বইপত্রের বদৌলত আগ্রহ ও কৌতূহল জাগাবার কোনো অজানা-অচেনা বস্তুই রইল না, সবকিছু পড়া-পাঠেরে মতো মনে হয় পুরোনো, নীরস ও একঘেয়ে। তাই আজকের দিনে উচ্চবিত্তের মানুষের মনেও স্বপ্ন বা স্মৃতি কোনোটাই ঠাই পায় না। মানবের মনোজীবনের এই শ্রান্তিও মনুষ্যজাতির একটা বড় সঙ্কট। এই বিড়ম্বনাও আজকের রাষ্ট্রিক ও অর্থনীতিক দ্বন্দ্ব-হানাহানির জন্যে কতকটা দায়ী। তৃপ্তি নেই, আনন্দ নেই। তাই স্বস্তি আর শান্তিও দুর্লভ। এতে একটা নৈরাশ্যবাদ আমাদের পেয়ে বসেছে, আশাবাদ জাগাতে হবে আমাদের মনে।
আমাদের মনে রাখতে হবে সাহিত্য শুধু জনচিত্তের বিশ্লেষণ করবে না, প্রচলিত সমাজ-চিত্র দেবে না, সমাজকে নিয়ন্ত্রিতও করবে, দিশাও দেবে পরোক্ষভাবে, প্রভাবিত করবে অতি সন্তর্পণে। কিন্তু তাই বলে উগ্র ও প্রত্যক্ষ আদর্শবাদ থাকবে না। এটুকু আদর্শবাদ ও রোমান্টিকতা প্রচ্ছন্ন না থাকলে, সাহিত্যের উদ্দেশ্যই যাবে ব্যর্থ হয়ে। কেননা শুধু বাস্তব দিয়ে চিত্র হতে পারে, শিল্প হবে না। রচনায় শিল্পীর মনের রঙ-রস ও চিন্তা মেশাতেই হবে। কিন্তু কোনো আদর্শবাদই জৈবধর্ম বা প্রাণধর্ম বা পরিবেশের প্রতিকূল হলে চলবে না। তথাপি এ-যুগে লেখকদের হতে হবে জীবন শিল্পী। আদর্শবাদ থাকবে প্রচ্ছন্ন। মহৎ সৃষ্টির এ-ই লক্ষণ।
এ যুগের গল্প-উপন্যাসের পটভূমি বিশাল–গোটা দুনিয়া। জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা, স্বাদেশিকতা ও বিশ্বমানবতা এ যুগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কেননা, যদিও স্বাজাত্যবোধ হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিজীবনে বল-ভরসার আকর, আত্মকল্যাণই এর লক্ষ্য; কিন্তু তবু কল্যাণ আপেক্ষিক শব্দ। অপরের অকল্যাণ করে নিজের হিতসাধন হয় না। ব্যক্তিস্বার্থ নিৰ্দ্ধন্দু ও নির্বিঘ্ন করতে হলে, পরিবার-পরিজনেরও বৃহত্তর স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। তেমনি পরিবারের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যেই সামাজিক স্বার্থ সম্বন্ধে সচেতন থাকা চাই। সামাজিক কল্যাণ সাধনের খাতিরেই স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক মঙ্গলের দিকে সতর্কদৃষ্টি রাখা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। আর স্বাজাতিক কল্যাণের গরজে আন্তর্জাতিক শুভেচ্ছার কামনা জেগে ওঠে। অতএব, স্বাতন্ত্র-বোধ অসম্ভব!
কথাসাহিত্য রূপ ও রসের দিক দিয়ে চার ভাগে বিভক্ত হতে পারে : ক, চিত্রধর্মী, খ. মনোসমীক্ষাধর্মী, গ. বিশ্লেষণধর্মী ও ঘ. রোমান্টিক।
কথাসাহিত্য ও নাটকের সংলাপের ভাষা নিয়েও কথা উঠেছে। এ ব্যাপারে একটি বিষয় গুরুত্ব সহকারে স্মরণীয় ও বিবেচ্য। সাধুভাষার কাছাকাছি না হলে কোনো কথ্যভাষাই দেশের সর্বাঞ্চলের লোকের বোধগম্য ও প্রয়োগ-যোগ্য হবে না। এটা বুঝেছিলেন বলেই পূর্ববঙ্গঘেঁষা উত্তরবঙ্গের লোক প্রমথ চৌধুরী গ্রহণ করেছিলেন ভাগীরথী তীরাঞ্চলের ভাষা। নতুন কথ্যভাষা গ্রহণ করবার গরজ আমাদের থাকলে, কুষ্টিয়া যশোহর বা খুলনা অঞ্চলের কথ্যরূপ গ্রহণ করাই শ্রেয়। বিশেষত সাহিত্যের ভাষা চিরকালই কিছুটা কৃত্রিম। প্রমথ চৌধুরী প্রবর্তিত কথ্যভাষাও অকৃত্রিম নয়। ও ভাষার অবিকল প্রতিরূপ কথায় ব্যবহৃত হয় না কোথাও।
আমরা অনেক সমস্যা তুলে ধরলাম। তাতে উদ্বিগ্ন হবার কিছুই নেই। শক্তিমানের সামনে কোনো সমস্যাই টিকতে পারে না। এগিয়ে চলার পথ করে নিতে পারে সে। আমরা জানি, আমরা নব-শিক্ষিত ও নতুন সংস্কৃতিসেবী, আমাদের জাতীয় জীবনও আধুনিক অর্থে গড়ার মুখে। তবু আমাদের কথা-সাহিত্যক্ষেত্রে দু-চারজন যথার্থ শিল্পীকে ইতিমধ্যে পেয়েছি। বেশ কয়েকটা ভালো সৃষ্টিও হয়েছে। অবশ্য আরো কিছুকাল হয়তো প্রতিভার আবির্ভাবের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে আমাদের। এতে হতাশ হবার কিছুই নেই। কোনো দেশেই প্রতিভা গণ্ডায় গণ্ডায় জন্মায় না।
.
০৩.
আধুনিক যুগে ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার ও নিপীড়নে জর্জরিত হয়ে মানুষ নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপনের ফলে আর্থিক বৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে গ্লানি, মনন-জীবন করেছে পঙ্গু। তাই অধিকারবাদের লড়াই শুরু হয়েছে দুনিয়াময়। ব্যবহারিক জীবনের যে-মনোজীবন রয়েছে, তা দুঃখ-দৈন্য ও অভাব উৎপীড়নের প্রতিক্রিয়ার ফলে আজ লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত।
আমাদের দেশের সমস্যা যেমনি জটিল, তেমনি মারাত্মক। কিন্তু এদেশে যারা মার খায়, তারা সহ্য করতে অভ্যস্ত। আর যারা মার দেয়, তারাও একে অন্যায় বলে উপলব্ধি করতে অক্ষম। ফলে যে-চেতনা যে-মর্যাদাজ্ঞান, যে-অধিকার আদায়-প্রয়াস বিপ্লব আনে, তা আমাদের দেশে আজো স্বপ্ন। ১৩৫০ সালের মন্বন্তরে লক্ষ লক্ষ মানুষের নির্বাক-নির্বিদ্রোহ আত্মাহুতিই এর প্রমাণ।
তাই য়ুরোপের অনুকরণে আমাদের দেশে গণতন্ত্র, সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে-শৌখিন আন্দোলন শুরু হল, তাতে জনগণের আন্তরিক যোগ ছিল না। অনুভূতি- বিহীন মনীষালব্ধ বাণীর বাহক ও প্রচারক আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের প্রচেষ্টা তাই ব্রত না হয়ে বিলাসরূপে প্রকাশ পেল। যে জিজ্ঞাসা, সমাজবোধ, সমস্যা-সচেতনতা, সামাজিক জীবনচেতনা ও বাস্তবানুভূতি, মানুষের প্রকৃতি ও প্রবৃদ্ধি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা এবং রুচি-আদর্শ সজাগতা সার্থক সৃষ্টির পক্ষে অপরিহার্য, তা আমাদের আদর্শপ্রিয় য়ুরোপমুখী কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিরল। এইজন্যে তাদের রচনায় মনন-বৈচিত্র্য নেই। তাদের রচনা যে বিচিত্রধারায় ও মননে সার্থক হয়ে উঠছে না, তার কারণ বাস্তব ও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতির অভাব। শুধু আদর্শের প্রতি আনুগত্য, কল্পনা, শ্রুতিস্মৃতি ও অনুকরণ দ্বারা সার্থক সৃষ্টি সম্ভব নয়। মানুষের মন ভাঙাগড়া আর সমাজ ভাঙাগড়ার মতো সৃষ্টি কী অল্প-সাধনায় সাধ্য!
একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারি, ইসলামের মূলবাণী হচ্ছে Live and let live. মানে নিজে বেঁচে থাকো এবং অপরকে বাঁচতে সাহায্য কর। ইসলাম বলে–এমন কিছু তুমি তোমার ভাই-এর জন্যে কামনা করো না, যা তুমি নিজের জন্যে পছন্দ করতে পার না; অর্থাৎ যে-দুঃখ, যে-বেদনা, যে-আঘাত তুমি এড়িয়ে চলতে চাও; সে-দুঃখ, সে-বেদনা, সে-আঘাত তুমি অপরকে দিও না। আজকের হিংসা-কোন্দল-হরণ-শোষণ-জর্জরিত মানুষের কাছে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট বাণী কী আছে, যা এই হানাহানি আর কাড়াকাড়ির দুনিয়াতে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষকে নিঃশঙ্ক শান্তি দান করতে পারে? জীবনের সমস্যা, তথা ব্যক্তি ও সমাজের সমস্যা এই আদর্শের আলোকে প্রত্যক্ষ করে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের দেশের জনসাধারণ আধিদৈবিক, আধিভৌতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সর্বপ্রকার দুর্যোগ-দুর্ভোগকে মনুষ্যসাধ্য-বহির্ভূত তকদিরের মামলা বলে আত্মপ্রবোধের ছলে আত্মপ্রবঞ্চনা করতে অভ্যস্ত। এই অদৃষ্টবাদ মানুষের পুরুষ্কারকে যুগ যুগ ধরে অপমানিত ও নিরুদ্যম করে আসছে। এখানেই ঘটেছে আমাদের প্রাণধর্মের, মনুষ্যত্বের ও আত্মশক্তির অপমৃত্যু। একূল ভাঙে ওকূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা–এই হচ্ছে আমাদের স্বীকৃত জীবন-দর্শন। এ মারাত্মক সর্বনাশা সংস্কার থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে। কর্মবিমুখ, সাধনাভীরু, আকাভ ক্ষাবিহীন জনসাধারণ আলস্যকে উদাসীনতা, অক্ষমতাকে নিস্পৃহতা, কাপুরুষতাকে সহনশীলতা, আত্মবিশ্বাসকে অহঙ্কার, পরাজয়কে অদৃশ্যশক্তির ইচ্ছা, অভাব-অনটনকে আত্মিক শোধনের উপায় ও পার্থিব জীবনের দুঃখ-বেদনাকে পারলৌকিক জীবনে সুখের আভাস ঠাওরিয়ে, পৌরুষহীন নিষ্ক্রিয় জীবনকে শ্রেয় মনে করে নিয়েছে। আজকের দিনে খলতা, কপটতা, প্রতারণা, মিথ্যা, অন্যায়, দুর্নীতি পরিণত হয়েছে মানুষের জীবন-বেদে। এ অবস্থা অশুভ এবং পরিণাম ভয়াবহ। ন্যায়নীতি ও সত্য আজ নির্বাসিতা। ন্যায়নীতিবোধ জাতির মেরুদণ্ড স্বরূপ। ন্যায়নীতি, সত্যপ্রীতি হারালে জাতি দাঁড়াবে কিসের জোরে? মিথ্যায় সুবিধা আছে, কিন্তু শক্তি নেই, তাই পতন অনিবার্য। এ কথার কথা নয়, ইতিহাসের বাণী। এজন্যে আমাদের সাহিত্যে প্রতারণা, মিথ্যা, অন্যায় ও দুর্নীতির বিভীষিকাময় পরিণতির চিত্র অঙ্কিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। ন্যায়-নীতি-সত্য যে আত্মমর্যাদা ও মনুষ্যত্বের পরিপোষক, মনোবল ও আত্মশক্তির বিকাশক, এ ধারণাও জন্মিয়ে দিতে হবে ইতিহাসের নজির দিয়ে। মিথ্যা, প্রতারণা ও দুর্নীতির পঙ্ককুণ্ড থেকে জাতিকে উদ্ধার করার ব্রতও গ্রহণ করতে হবে আমাদের সাহিত্য-স্রষ্টাদের।
শহরগুলোর বস্তিবাসীরা অশিক্ষা-অজ্ঞতা-অক্ষমতার দরুণ জীবনযুদ্ধে ঘায়েল হয়ে হয়ে ক্রমে উচ্ছন্ন যাচ্ছে। খাওয়া-পরার সংগ্রাম তীব্র ও দুর্বিষহ হচ্ছে আর মাথা গুঁজবার ঠাই ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে। অপঘাতে অপমৃত্যুর হাত থেকে এদের বাঁচবার ইস বাতলে দিতে হবে সাহিত্যের মাধ্যমে। অন্তত শহর ছেড়ে শহরতলীতেও যেন বাঁচবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তারা, তেমন-পথের সন্ধান দিতে হবে তাদেরকে।
এদেশের অধিকাংশ লোক অশিক্ষিত কৃষিজীবী ও মজুর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং কলকারখানা হওয়ার সাথে সাথে জীবন ধারণের জন্যে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অভাবে যে-অনটন-সমস্যা এ যুগে দেখা দিয়েছে, তার সমাধানের চাবিকাঠি এদের হাতে নেই। অদৃষ্টবাদের জাদুমন্ত্রের প্রভাবে ওরা স্রষ্টা বা সমাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ-অনুযোগ করতেও ভুলে গেছে, দুঃখের দিনে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেও ভয় পায়–পাছে খোদা আরও রুষ্ট হন। শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা ওদের পক্ষ হয়ে ধনবৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছে। কিন্তু ওরা নিজেরা অদৃষ্টবাদী ও জড়ধর্মী। তাদেরকে আত্মসচেতন করে তুলতে হলে শিক্ষার মাধ্যমে তাদের প্রাণে প্রেরণা যোগাতে হবে আত্মমর্যাদার ও অধিকারবোধের। আজ তাদের জীবনে প্রেম পলাতক না হলেও স্বস্তি পলাতক। বুভুক্ষু, নিরন্ন, রোগগ্রস্ত লক্ষ লক্ষ আশাহীন, ভাষাহীন পল্লীবাসীকে বাঁচানোর ও সমাজ-কর্মীদের প্রাণে সহানুভূতি ও সাড়া জাগানোর দায়িত্ব সমাজেরই। এরূপে আমাদের দরদী শিক্ষিত জনসাধারণ রাষ্ট্রের মারফত ওদের দুঃখমোচনে সক্ষম হবে। শিক্ষার আলোকে, আত্মমর্যাদাবোধের তীব্রতায় ওরা তখন নিজেরাই বুঝে নেবে নিজেদের দাবী-দাওয়া। বহুকালের অনভ্যাসের ফলে আমাদের দেশের কিশোর ও তরুণেরা বন্দুক-ভীরু হয়ে পড়েছে। বীরত্ব ও দুঃসাহসিকতার ঐতিহাসিক বা কাল্পনিক চিত্র অঙ্কিত করে উদ্বুদ্ধ করতে হবে আমাদের কিশোর-তরুণদের। তাদের সাহস, চিত্তের দৃঢ়তা ও বুকের পাটা দেখে যেন ভয়ও ভয় পায়, ভেতো বাঙালির বদনাম ঘুচুক! পদ্মার দু-তীরে দুঃসাহসী পল্লীবাসী বর্ষাকালীন সর্বগ্রাসিনী পদ্মার প্রলয়-নাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যে টিকে রয়েছে যুগ যুগান্তর ধরে, তাদের বিচিত্র জীবন-কাহিনী আমাদের সাহিত্যের মূল্যবান উপাদান হতে পারে।
চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের সনাতন জীবনযাত্রা প্রণালী ও মনের গতি-প্রকৃতি আমাদের সাহিত্যে পরিবেশন করতে পারে বিচিত্ররস।
পাটচাষীদের পাটের বাজারদর সম্পর্কিত আশা-নিরাশার চিত্রও সাহিত্য-বস্তু। এ বছ। পাটের দরে না-জানি কেমন করে, ঘরে ঘরে হল ভাবনা। লক্ষ লক্ষ লোকের মরণ-বাঁচন যে পাটের বাজারমূল্যের উপর নির্ভরশীল, পাটচাষীর সে-সমস্যা ও আশা-নৈরাশ্য সাহিত্যে অধিক পরিমাণে রূপায়ণ বাঞ্ছনীয় বৈকী! মেঘনা, পদ্মা আর বঙ্গোপসাগরের জেলেদের ক্ষুদ্রতরী যোগে ঝড়ের রাতের দুঃসাহসিক অভিযানও মনোজ্ঞ সাহিত্যের উপাদান।
চট্টগ্রাম, সিলেট ও নোয়াখালীর নাবিকদের সমুদ্রযাত্রা, প্রবাস, দূরের পিপাসা, বর্মাপ্রবাসী চট্টগ্রামীদের বিচিত্র জীবন-কাহিনী রহস্য-মধুর রোমান্টিক সাহিত্যের উপাদান হতে পারে।
এছাড়া কলকারখানার মজুর, রিকশাওয়ালা, গাড়িওয়ালা, বিড়িওয়ালার জীবন তো রয়েছেই। তাদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণও সাহিত্যিকদের ব্রত হওয়া উচিত। নারীর শিক্ষা, অবাধ চলাফেরা ও চাকুরি গ্রহণ ব্যাপারে-বাহ্যত না হোক-যুগসঞ্চিত ধর্মীয়, সামাজিক ও নৈতিক সংস্কারবশত আমাদের, বিশেষ করে প্রবীণদের মনে একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। দেখাদেখি যুগরীতির কাছে ঘরে ঘরে সবাই আত্মসমর্পণ করছে সত্য, কিন্তু সমর্থন করে না অনেকেই; প্রতিরোেধ নেই বলে সমর্থন আছে মনে করবার কারণ নেই। এর সামাজিক ও নৈতিক ঝুঁকি এবং মানসিক দ্বন্দ্বেরও সুন্দর চিত্রাঙ্কন চলতে পারে।
মধ্যবিত্ত নামে পরিচিত হতভাগ্যদের কথা আগেই বলা হয়েছে।
মানুষের জীবনে সাহিত্যের উপাদানের অভাব কোনোদিনই হবে না। মানুষ যেমন আকৃতিতে বিচিত্র, তেমনি প্রকৃতি-প্রবৃত্তিতেও। মানুষের এই বিচিত্র জীবনলীলার কাহিনী কোনোদিন বলে শেষ করা যাবে না। তার উপর সৃষ্টি-স্রষ্টা, জগৎ-জীবন, প্রকৃতি, মানুষ, সমাজ, ধর্ম, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির বিচিত্র সম্পর্ক সংযোগ তো আছেই–এসব রহস্য চির-নতুন সাহিত্যের চিরকালীন উপাদান।
আমরা ইট-সুরকির কথা আলোচনা করলাম, কিন্তু সৃষ্টির ব্যাপারে এদের গুরুত্ব বেশি নয়; স্ব স্ব রুচি ও সাধ্যানুসারে শিল্পীরা সাহিত্যসৌধ গড়ে তুলবেন; আকারে-প্রকারে, রূপে-রসে সে সব সৌধ হবে বহুধা ও বহু বিচিত্র। সৃষ্টির ব্যাপারে নির্দেশ চলে না। লেখকের মন-মানসের ধ্যানই স্রষ্টা। বাস্তব অভিজ্ঞতা, দেখবার চোখ, বুঝবার বুদ্ধি, অনুভব করবার হৃদয়, জিজ্ঞাসা, কৌতূহল, মানব-মনের রুচি, গতি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান, সামগ্রিক জীবনবোধ–সর্বোপরি রূপায়ণশক্তি সার্থক সাহিত্য সৃষ্টির জন্যে অপরিহার্য। এজন্যে সাধনা আবশ্যক।
কবিতার কথা
০১.
আজকে বলে নয়, নতুন আঙ্গিক ও মননের কবিতা নিয়ে দেশে দেশে সমকালীন পাঠক মহলে বিরূপতা দেখা দিয়েছে যুগে যুগে। এর প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা সেকালেও ছিল না, আজকেও নেই। শুধু কাব্যক্ষেত্রে নয়, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায়ও নতুন ভাব, চিন্তা ও আঙ্গিকের শত্রু চিরকালই সংখ্যাগরিষ্ঠ।
বিদেশের কথা বলে কাজ নেই। দেশেই রয়েছে এর বহু নজির। গত একশ বছরের মধ্যে আমাদের সাহিত্যে লেখক-পাঠকে যে-কয়বার দ্বন্দ্ব ঘটে গেছে, তাদের উল্লেখ মাত্রই এক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে।
মধুসূদন বড় ভরসায় বড় মুখ করে বলেছিলেন a real graduate তার মেঘনাদবধের টীকা লিখছেন। সে real graduate হেমচন্দ্রও অমিত্রাক্ষর ছন্দের গোড়ার কথাই বুঝতে পারেননি। মেঘনাদবধ বা অমিত্রাক্ষর ছন্দের কোনো কদরই হয়নি উনিশ শতকে। মধুসূদনের প্রতিভা ও সৃষ্টি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধাও অর্জন করেনি কোনোদিন। মধুসূদনের ঠাই হল না। হেমচন্দ্র হলেন জাতীয় কবি, শ্রেষ্ঠ কবি, মহাকবি।
বঙ্কিমচন্দ্রের অশুদ্ধ ভাষা ও অশ্লীল উপাখ্যান সে-যুগে কী অবজ্ঞাই না লাভ করেছে! গুরুজনের নামে স্বরচিত উপন্যাস উৎসর্গ করে নীতবাগীশদের নিন্দা শুনতে হয়েছে তাকে।
সে যুগের আমেরিকা-ফেরৎ, বি-এ পাশ, ডেপুটি, কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের কবিতার মাথা-মুণ্ড বুঝতে না পেরে বলেছেন অর্থহীন। প্রেমের অশ্লীল কবিতা লিখে রবীন্দ্রনাথ দেশের লোকের চরিত্র নাশ করছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন তিনি। কালীপ্রসন্ন ঘোষ প্রভৃতি যদি তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য বলে থাকেন তবে বিস্মিত হবার কিছু থাকে না।
এমন যে বিহারীলাল, তিনিও জীবকালে পাত্তা পাননি। আর কার কথা বলব? শরৎচন্দ্র নজরুলের উপর এককালে যে ঝড়ঝাপ্টা গেছে, তা অনেকেরই স্মরণে আছে। কল্লোল যুগের বহুনিন্দিত গল্প-লিখিয়েরা চোখের সামনেই ভক্ত-হৃদয়ের পূজো পাচ্ছেন।
নতুন সৃষ্টি বা উদ্ভাবন মাত্রেই প্রতিভার দান। ইচ্ছে করলেই কেউ নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। দুনিয়াতে স্তরে স্তরে কোটি কোটি মানুষ এসেছে, গেছে। নতুন সৃষ্টি বা উদ্ভাবন করতে পেরেছে কয়জনে? ব্যবহারিক জীবনের প্রাত্যহিক প্রয়োজনের দ্রব্য-সামগ্রীই হোক, রান্নাবান্নার কলাকৌশলই হোক, সমাজে-ধর্মে-রাষ্ট্রে বা আচার-আচরণেই হোক, নতুন উদ্ভাবন সহজ কথা নয়। এতে বোঝা যায়, সাধারণ মানুষ সৃষ্টিশীল নয়, সৃষ্টি-পরিকল্পনা তাদের মধ্যে নেই। অবচেতন মনে সৃজনের কোনো প্রেরণা সুপ্ত যদিও বা থাকে, তা অনুকরণ স্পৃহাতেই রূপ নেয় এবং সার্থকতা খোঁজে।
মানুষের পুরোনোর প্রতি যত প্রীতি আছে, নতুনের প্রতি তত শ্রদ্ধা নেই। তাই সাধারণ মানুষ ঐতিহ্যপ্রিয়, প্রাচীনপন্থী ও রক্ষণশীল। তাদের পুরোনোর প্রতি যেমন মমতা ও শ্রদ্ধা থাকে, নতুনের প্রতি তেমনি থাকে ভীতি, বিরূপতা আর অবজ্ঞা। মানুষ যতটা পশ্চাত্মখী, সে পরিমাণে সম্মুখদৃষ্টিসম্পন্ন নয়। তাই ইতিহাসের সাক্ষ্য সত্ত্বেও মানুষ চিরকাল নতুনকে অভিনন্দিত না করে পুরাতনকে বন্দনা করেছে। ইতিহাস আমাদের বলেছে–কোনো নতুনই মানুষের অকল্যাণের জন্যে আসে না। অন্তত তা যে মানুষেরই অগ্রগতির নিশ্চিত ফল এবং ফেলে আসা দিনের চেয়ে যে না আসা দিনগুলোতে মানুষের বোধবুদ্ধির বেশি বিকাশ হবে–কেননা সামগ্রিকভাবে মানুষ প্রতিমুহূর্তেই উন্নত হচ্ছে, এগিয়ে যাচ্ছে, রুচি-বুদ্ধি-বোধির বিকাশ হচ্ছে–তা ইতিহাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তবু আমাদের চৈতন্য হয় না। আমরা চিরকাল এ ব্যাপারে অর্থাৎ নতুন পুরাতনের দ্বন্দ্বে নির্বিচারে পুরাতনের পক্ষই সমর্থন করেছি। তবু কোনোদিন রোধ করা যায়নি নতুনের প্রতিষ্ঠা।
এতে দুটো তত্ত্ব পাওয়া যাচ্ছে। এক. বোঝা যাচ্ছে নতুনের উদ্ভাবক সাধারণ মানুষের তুলনায় কত অসাধারণ। আর এজন্যেই সাধারণের পক্ষে সমকালীন প্রতিভার মূল্যায়ন ও মর্যাদা দান সম্ভব হয় না। তাদের চোখে সে বিদ্রোহী। দুই. মানুষের পশ্চাৎমুখিতা ও নতুনের প্রতি অশ্রদ্ধা এতই প্রবল যে এ ব্যাপারে তাদের বিচারশক্তি লোপ পায়, চোখ থেকেও তারা দৃষ্টিহীন। একটা অন্ধ সংস্কার-নির্ভর আবেগই তাদের একমাত্র অবলম্বন–যুক্তি-বুদ্ধি নয়।
শুধু সাহিত্য ব্যাপারেই নয়, ধর্ম ও রাষ্ট্র বিষয়েও তাই। রাজনীতিতে নেতৃত্ব মানার বা সামাজিক কাজে কর্তৃত্ব স্বীকার করার ব্যাপারে তাই অনেক সময়–যুক্তি নয়–অভিমানই দেয় বাধা। এ ব্যাপারে বয়োজ্যেষ্ঠের অভিমান আর মর্যাদাবোধও অনেকাংশে দায়ী।
.
০২.
যেখানে অজ্ঞতা, সেখানেই কল্পনার প্রশ্রয়। বিস্ময়ের উৎস এবং আশ্রয়ও তা-ই! আর যেখানে কল্পনা ও বিস্ময় সেখানেই উচ্ছ্বাস। বলা যায়, উচ্ছ্বাস ও কল্পনা বিস্ময়-বোধেরই সন্তান। অতিভাষণ উচ্ছ্বাসের নিত্যকালের সঙ্গী। এবার ভারতচন্দ্রের উক্তি স্মরণ করুন : সে কহে বিস্তর মিছা যে কহে বিস্তর। ফল দাঁড়াল এই–লোকে দৈত্য, রাক্ষস, যক্ষ, ড্রাগন, পঙ্খিরাজঘোড়া, দেবলোক, জীন, পরী, গন্ধর্ব প্রভৃতি যেমন মনোরাজ্যে সৃষ্টি করেছে, তেমনি করেছে চন্দ্রে-সূর্যে-মেঘে-সমুদ্রে ব্যক্তিত্ব আরোপ। আমাদের রূপকথায়, উপকথায়, ইতিবৃত্তে, মহাকাব্যে, ধর্মশাস্ত্রে ও রোমান্সে তাই আদি মধ্যযুগে এর ছড়াছড়ি দেখতে পাচ্ছি। মধ্যযুগ আমরা বিশেষ অর্থে প্রয়োগ করছি, কেননা মধ্যযুগ সবদেশে ও সবজাতে সমকালীন নয়–এর শুরু ও শেষ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক মানের উপর নির্ভরশীল।
মানুষের অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিকাশ হল মানুষের বুদ্ধি ও বোধের। এর ফলে মানুষের মনে যুক্তিবাদের জন্ম হল। জন্ম হল বললে ভুল বলা হয়; বরং বলা যেতে পারে সুপ্তি থেকে জেগে উঠে বিশ্বাস-সংস্কারের সঙ্গে দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হল, কেননা যুক্তিবাদই মনুষ্যত্ব। যুক্তিবিজ্ঞানের ভাষায় মানুষের differentia হল যুক্তি-বুদ্ধি। বহুকাল চলল কেহ কারে নাহি। জিনে সমানে সমান অবস্থায়। অবশেষে বিজ্ঞান এসে সব তত্ত্ব ও কল্পনার, বিশ্বাস ও সংস্কারের গোড়ার কথা বেফাঁস করে দিল। আমরা দেখলাম সূর্য বামুন হয়ে মর্ত্যে নামতে পারে না; চাঁদ সুন্দরও নয়, প্রণয়ীও নয়। রাক্ষস, ড্রাগন, যক্ষ, দৈত্য দুনিয়ায় কোনোকালে ছিল না। সূর্য অস্তও যায় না, আবিরও ছড়ায় না। অরুণে-কমলে সখ্য নেই। চাঁদে-চকোরে প্রেম নেই, মেঘ বাম্পপুঞ্জ মাত্র ইন্দ্র-ঐরাবতের সঙ্গে তার সম্পর্কমাত্র নেই, বজ্র শয়তানও তাড়ায় না, দৈত্যও খেদায় না, বৃত্রকেও মারে না! এভাবে আমাদের কল্পনার তাসের ঘর ভেঙে পড়ল, স্বপ্নসৌধ জাদু-সৃষ্ট বস্তুর মতো হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। আমরা–অজ্ঞরা অবাক হয়ে ভাবলাম–এসবের বিরুদ্ধে হাজারো বছর কাটিয়া গিয়াছে কেহ তো কহেনি কথা! আজ একি কথা শুনি–নেই! নেই, সত্যি কিছুই নেই–এ কারণে নাস্তিকের উল্লাসে, বন্ধন-মুক্তির স্বস্তিতে, মুক্তির আশ্বাসে, ভবিষ্যৎ নিশ্চিন্ততার আনন্দে, প্রসারিত জীবনের মুখরতায় মানুষ স্বচ্ছন্দ ও উচ্ছল হয়ে উঠল।
রূপকথা অচল হল, উপকথা উবে গেল, পুরাণ তলিয়ে গেল; কারণ তাদের কাঠামো যে উপাদানে তৈরি, ভোজবাজির মতো মন থেকে মুছে গেল সে-সব। তাই আজকের দিনে আর রূপকথা তৈরি হয় না, উপকথা বলবার লোক নেই, পুরাণ শুনবার ধৈর্য নেই। মানুষের যুগযুগান্তর লালিত বিশ্বাস ও সংস্কার ভেঙে চুরমার হল। আদি বা মধ্যযুগের সে-জগৎ নেই, তাই সে-জীবনও, নেই, তাতেই সে-সাহিত্য-শিল্প আর ধর্মবোধও নেই।
নতুন বিশ্বাসের অবলম্বন খুঁজে পেল, তাই নিয়ে সে নতুন করে গড়ছে স্বপ্নসৌধ, সাধের জগৎ, শখের ইমারত আর গরজের বুরুজ।
.
০৩.
স্থানিক, কালিক আর পাত্রিক বিবর্তনে সাহিত্যের রসকল্পে নয় শুধু, রূপকল্পেও পরিবর্তন আসতে বাধ্য। বলেছি, মানুষের জীবনের তথা সাহিত্যের আদি ও মধ্য স্তর ছিল অজ্ঞতার যুগ; তাই কল্পনা, বিস্ময় এবং উচ্ছ্বাসই ছিল সাহিত্য-দেহের হাড় ও প্রাণ। কল্পনায় ভাটা পড়লে কল্প-সৃষ্ট বস্তুর মূল্য কমে যাবেই, বিস্ময় উবে গেলে বিস্ময়ের অবলম্বনও বাজে হয়ে যায়, আর কল্পনা-রূপ আধার না থাকলে আধেয় বিস্ময়ও পায় লোপ, কাজেই বিস্ময়জাত উচ্ছ্বাসের জন্মউৎসই যায় শুকিয়ে। আর এসবকিছুর উৎস ছিল হৃদয়বৃত্তি এবং তজ্জাত বোধি। মুক্তবুদ্ধি পাত্তা পায়নি সে যুগে।
বলেছি, উচ্ছ্বাসের সঙ্গে অতিভাষণের যোগ নিত্যকালের। আগে ছন্দের পরিপ্রেক্ষিতে এ উক্তি যাচাই করা যাক। সমিল ছন্দের খাতিরে আমাদের সবসময় ভাব প্রকাশের পক্ষে অপ্রয়োজনীয়, এমনকি অবান্তর কথা যোগ করে দিতে হয়। মনে করা যাক, একটি চরণে একটি ভাব প্রায় অভিব্যক্তি লাভ করেছে, শুধু একটিমাত্র শব্দ বাকি। কিন্তু যেহেতু চরণে আর জায়গা নেই, সেজন্যে একটি শব্দ প্রয়োগের গরজে আমাকে একটি পুরো চরণ তৈরি করতে হয়। ফলে কতগুলো অপ্রয়োজনীয় শব্দ শুধু ধ্বনি ও ছন্দ রক্ষার খাতিরে জুড়ে দিতে হয়। উচ্ছ্বাসের ভাষা যেমন :
১. হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ূরের মতো
নাচেরে হৃদয় নাচেরে
২. আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান।
৩. এই লভিনু সঙ্গ তব, সুন্দর হে সুন্দর।
পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর
সুন্দর হে সুন্দর। ….
এই তোমার পরশ-রাগে চিত্ত হল রঞ্জিত,
এই তোমারি মিলন-সুধা রইল প্রাণে সঞ্চিত।
৪. আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি
আমার যত বিত্ত প্রভু, আমার যত বাণী–
আমার চোখের চেয়ে দেখা আমার কানের শোনা,
আমার হাতের নিপুণ সেবা, আমার আনাগোনা।
৫. আজি কী তোমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রভাতে
হে মাতঃ বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে।
মাঝখানে তুমি দাঁড়ায়ে জননী শরৎকালের প্রভাতে
ডাকিছে দোয়েল গাহিছে কোয়েল তোমার কানন সভাতে।
৬. তোমার ছুটি নীল আকাশে, তোমার ছুটি মাঠে,
তোমার ছুটি থইহারা ওই দিঘির ঘাটে ঘাটে।
তোমার ছুটি তেঁতুল তলায়, গোলাবাড়ির কোণে,
তোমার ছুটি ঝোপে ঝাপে পারুল ডাঙার বনে।
মানুষের জ্ঞান-প্রজ্ঞা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষ হৃদয়বৃত্তির আশ্রয় ত্যাগ করে বুদ্ধিবৃত্তির নিশ্চিত স্মরণ নিয়েছে। আজকের মানুষের বুদ্ধিনির্ভর। হৃদয়-ধর্ম জল-শোধন যন্ত্রের মতো বুদ্ধিকে আশ্রয় করে, বলা যায়-বুদ্ধির দ্বারা শোধিত হয়ে প্রকাশিত হয়। এভাবে মিতালি ঘটেছে মন মস্তিষ্কের। আবেগও তাই উদ্বেগ বলে ভ্রম জন্মায়। মানবসভ্যতার তথা সাহিত্য-শিল্পের ক্রমবিবর্তনের ধারা এভাবে লক্ষ্য করেছিলেন বলেই লর্ড মেকলে সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে পুরানো রীতির কবিতার অপকর্ষ ঘটবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী উচ্চারণ করেছিলেন।
বুদ্ধিবৃত্তিতে উচ্ছ্বাসের ঠাঁই নেই। কাজেই আমাদের কাব্যকলার ছন্দে ও বাক-পদ্ধতিতে পরিবর্তন না এসে পারে নি। বুদ্ধি লব্ধ তথ্য, বুদ্ধি-নির্ভর ভাষণ চটুল হতে পারে, সরস হতে পারে, বিদ্রুপাত্মক হতে পারে; দীপ্ত হতেও বাধা নেই, কিন্তু ললিত-মধুর, আবেগ-বিভোল হতে পারে না। নূপুরের দিন নেই, কাজেই শিঞ্জন শোনার আশা বিড়ম্বিত হবেই।
তাই আজকের কবিতা তথাকথিত ছন্দ বিহীন।
.
০৪.
শারীর প্রেমের উপর আগের যুগে মানুষ Divinity বা দিব্যতা আরোপ করে একপ্রকার আত্মবঞ্চনামূলক আত্মপ্রসাদ লাভ করত। যদিও মনে জানত–এ ফাঁকি, তবু মহত্ত্ব ও দিব্যতা আরোপ করে, একে নির্বিশেষ ভাবলোকে স্থাপিত করে, এর মহিমা ঘোষণা করে নিজেদের মহিমান্বিত করে তুলত। এতে সুখ ছিল কিনা জানিনে, তবে মুখরক্ষা হত! এ-যুগের বিজ্ঞান সব রহস্য বেফাঁস করে দিয়ে বলল, প্রেম আকাশের নয়, নিতান্ত পঙ্কজ। খগজ প্রেম শুধু ভুইয়ে লুটিয়ে পড়ল, তা নয়; বিজ্ঞান জানাল–এটা হচ্ছে জীবনের প্রবলতম প্রবৃত্তি, বিশেষ বয়সের ধর্ম, এবং সৃষ্টি প্রক্রিয়ারই অঙ্গ, একান্তই প্রাকৃতিক নিয়মের ফল। বিশেষ বয়সের পূর্বে বা পরে–অপর জীবের তো নয়-ই,–স্বাভাবিক মানুষেরও তা থাকে না। প্রেম-মহিমা তাই আর কথার সাগর মন্থন করে শব্দ চয়ন করে যোচ্ছাসে গাওয়া চলে না। তেমনি ভূতে যার বিশ্বাস নেই, তাকে ভূতের ভয় দেখাননা যায় না।
পুরোনো বিশ্বাস-সংস্কার যখন মিথ্যে হয়ে গেল, তখন পুরোনো রূপপ্রতীক কী সত্য থাকতে পারে? চাঁদ-সূর্যের গোপন তত্ত্ব জানার পরে তাদের সেবাকালীন স্বরূপে রূপপ্রতীক সৃষ্টি করা কী চলে? চকোর দেখিইনি, কাজেই চাঁদ-চকোরের উপমা দিতে আমার যুক্তি-বুদ্ধি বাধা দেবেই। ক্ষীণ মাঝার সঙ্গে কেশরী বা চুলের উপমা শুধু সেকালেই চলতে পারত; যেকালে বিশাল নথও নাকে শোভা পেত, পুরুষের কানে কুণ্ডল আর হাতে বালা মানাত ও পাজব-চন্দ্রহারে নারী লোম লাবণ্যে ললনা হয়ে উঠত!
আমাদের রুচির বিকাশ হয়েছে, সৌন্দর্যবোধ সূক্ষ্ম হয়েছে। তাই আদ্যিকালীন কাব্যে নারীর রূপ-বর্ণনায় রূপ প্রত্যক্ষ করা দূরে থাক, মানবীকেই পাওয়া যায় না। অদৃষ্ট খঞ্জনের মতো আঁখি, বাজের চক্ষুসদৃশ নাসা, হেমকুম্ভ স্তন, মৃণাল ভুজ, রামরম্ভাতরুর মতো উরু, কামধনুর মতো জ্ব, তীরের মতো পক্ষ্ম, ঘটের মতো নিতম্ব, পদ্মের মতো পা, শকুনির ন্যায় গ্রীবা, পদ্মকোরকের ন্যায় নাভি, মেঘবর্ণ চুল, কুঁচবর্ণ রঙ, দ্বিতীয়ার চাঁদের ন্যায় কপাল, বিম্বফলের ন্যায় অধরোষ্ঠ, প্রভৃতি এমন কী সুপ্রযুক্ত উপমা যে স্মরণ মাত্র সুন্দরীর রূপ-লাবণ্য অন্তরে শেলসম বিদ্ধ হয়ে থাকবে? স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের রূপবর্ণন পদ্ধতি কী একালে টিকল? সুন্দরীর রূপ-মহিমা একালীন ভাষায় একবার দেখলে পিছন ফিরে আবার দেখতে হয় বা একবার তাকালে চোখ ফিরানো যায় না বা বারবার তাকাবার মতো রূপ বললে কী বর্ণনার আর কিছু বাকি থাকে! কিম্বা, খঞ্জন-হরিণ-পদ্মের উল্লেখ না করে পটল-চেরা কী টানা টানা চোখ বললে কী কিছু কম বলা হয়! রুক্ষ চুলের সঙ্গে মেঘের তুলনা চলে, কিন্তু কালো চুল নিশ্চয়ই মেঘের বর্ণ নয়, তার চাইতে ভ্রমরকৃষ্ণ, চুল তার কবেকার বিদিশার নিশা কিম্বা আলকাতরার, টেলিফোনের রিসিভারের, মোটরগাড়ির নয়া কালো টায়ারের বা প্লাস্টিকের কালো পাতের তুলনা আপাতত vulgar মনে হলেও অনেক বেশি সুপ্রযুক্ত। কাক পোষা পাখি নয় যে কাকচক্ষু বললেই বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
অবশ্য পুরোনো রূপপ্রতীক মাত্রেই পুরোনো নয়, বেণীর সঙ্গে সাপের উপমা চিরনতুনই বটে! তেমনি চিরকালই উপমার অবলম্বন হয়ে থাকবে রাত্রির তমসা।
তাই বলে নতুন ভাব-চিন্তা-জ্ঞান-বস্তু পেলাম, অথচ নতুন অলঙ্কার তৈরি হবে না, এমন কথাই হতে পারে না। আগের কালে যেমন মানুষ নিজের জানা-ভুবন থেকে রূপ-প্রতীক সংগ্রহ করেছে, আজও তা-ই শুধু করা হচ্ছে। আগের মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জগৎ আজকের চেয়ে অনেক ছোট ছিল, তাই তার ভাষণে থাকত পরিমিত ও স্বল্প-পরিচিত এমনকি কল্পজাত রূপ প্রতীক। আজকের মানুষের পায়ের নিচে বিশাল ভুবন, মাথার উপরে বিস্তৃত জগৎ। আজ এদের সঙ্গে তার পরিচয় কত ঘনিষ্ঠ, কত স্পষ্ট! সে মুখ খুললেই কত কথা, কত চিত্র, কত রূপপ্রতীক এসে ভিড় জমায় স্মৃতির সরণিতে–জিহ্বার ডগায়, এদের সে অস্বীকার করে কীভাবে! কাকে ছেড়ে কাকে নেবে তা-ই দাঁড়ায় সমস্যা হয়ে! শুধু কী তাই, নতুন সূর্যের উদয়ে নতুন ভাব-চিন্তা আসবেই, তাকে রোধ করবে–সাধ্য কার! রবীন্দ্রনাথও পয়ার-ত্রিপদীতে অনেক কবিতা রচনা করেছেন, ছন্দ একই হওয়া সত্ত্বেও ভাবে, ভাষায়, অর্থব্যঞ্জনায় ও ধ্বনি-মাধুর্যে পূর্বেকার পয়ার ত্রিপদীর সঙ্গে কী এদের তুলনা চলে? ভাবের ও চিন্তার বৈচিত্র্যে যে বাকভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটে, এর চেয়ে আর উৎকৃষ্ট নজির আর কী দেওয়া যায়! আবার ভাব-চিন্তার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শুধু নবীনেরাই নন, রবীন্দ্রনাথও পয়ার-ত্রিপদী ছেড়েছিলেন। কাজেই প্রয়োজনমতো প্রতিষ্ঠিত আঙ্গিকও বদলায়।
লঙ্ঘিয়ে সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে
ওগো কার তরী ধায় নির্ভীক চিত্তে।
চলন্ত নৌকার কী চমৎকার বর্ণনা! কিন্তু কোনো অরসিক যদি বলে বসে কাঠের তৈরি নৌকায় চিত্ত কোথায়! তবে তো সকলি গরল ভেল। তেমনি চোখ হাসে মোর, বুক হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে–তখন আমদের কানে-মনে খটকা লাগে না। প্রশ্ন জাগে না যে খুন নাচতে পারে, হাসে কী করে? আকাশ আচ্ছন্ন করে মেঘ উঠলে তাকে নারীর এলোচুল বলতে আপত্তি থাকে না।-কে এসেছে কেশ এলায়ে কবরী এলায়ে? কিন্তু জীবনানন্দ দাস যখন লেখেন– রৌদ্র মাথা রেখে ধানক্ষেতে শুইয়ে আছ তখন আমাদের অবজ্ঞার অন্ত থাকে না। কিন্তু ভেবে দেখি না যে, আমাদের অতিপরিচিত একটি পুরোনো ভালো ইংরেজি কবিতায় অর্থাৎ Keats-এর Ode to Autumn-এধরনের প্রতীকই ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন–The (Autumn) sitting careless on a granary floor on a half reaped furrow. sound asleep Steady they laden head across a brook by a ciderpress, with patient look thou watchest the last oozings hours by hours to
আবার পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে উপমার এখন দেখছি আদর-কদর বেড়েই চলেছে। তাজমহল যখন কালের কপোলতলে একবিন্দু নয়নের জল কিংবা মেঘদূত কাব্যে মেঘ দূতরূপে বর্ণিত হয়, কিংবা অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অনুভূত হয়, তখন আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে না। কিন্তু উনিশ শতকে হলে জাগত!
আসল কথা, নতুন কিছু কানে-মনে খাপ খাওয়ানো সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রায় অসাধ্য। তাই কেউ সমকালীন সমাজে নতুন কিছু করে স্বীকৃতি পায় না। কিন্তু উত্তর-পুরুষ ঐ আওতায় লালিত হয় বলে তার কাছে এককালের বেয়াড়া নতুনও গা-সহা এবং কান-সহা হয়ে ওঠে শুধু নয়, রস কল্পনার সহায়কও হয়ে উঠে।
আজকের দিনে ঝলসানো রুটিস্বরূপ চাঁদ, বোমা, টর্পেডো, শুটনিক (এমনকি লাইকাও), কুইসলিং প্রভৃতি আমাদের রচনার রূপপ্রতীকরূপে ব্যবহৃত না হয়ে যেমন পারে না; তেমনি আমাদের নতুনতর ভাব, চিন্তা ও দৃষ্টির প্রভাবে বাকভঙ্গিও বদলাবে, তার সঙ্গে বদলাবে আটপৌরে ব্যবহারের শব্দের ব্যঞ্জনাও। বিবেকে বৃশ্চিক দংশন বা বিছার কামড় যদি সম্ভব হয়, তাহলে হৃদয় আমার ছেঁড়া কাঁথা আর তুমি তার মাঝে ছারপোকা–আজ যতই vulgar মনে হোক, আমাদের উত্তরপুরুষদের কাছে তা কদর পাবে। আগেকার যুগের রূপপ্রতীকগুলো বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে, বহু অদ্ভুত প্রতীক আমাদের চিত্তবিনোদনের সহায়ক হয়েছে,–চাঁদপানা মুখ যখন বলি তখন আমরা চাঁদের প্রভাটাই নিই, চাঁদের থালা-আকৃতি বাদ দিই। যোগ-বিয়োগ এত সহজ-সাধ্য নয়, অভ্যাসবশে যত সহজভাবে আমরা উপলব্ধি করি। রবীন্দ্রনাথের কৃপণ কবিতার রথী রাজভিখারিটি কোনো বাস্তব চিত্রের সঙ্গে মেলে না, কাজেই বাস্তব প্রতীক হতে পারে না, তবু ভালো কবিতা বলে এটি কদর পেয়ে আসছে।
জন্ম-মৃত্যুর মাধ্যমে মানুষ যেমন বদলাচ্ছে, অর্থাৎ নতুন মানুষকে ঠাই ছেড়ে দিয়ে পুরোনো মানুষ বিদায় নিচ্ছে,;তেমনি মানুষের ভাষা, সাহিত্য, শিল্প আর ভঙ্গিও বহতা নদীর মতো চিরকাল গড়িয়ে চলেছে, চলেছে এগিয়ে। কাজেই তাদের কোনো স্থায়ী নিগড়ে বেঁধে স্থির রাখা যাবে না। এ সহজ সত্যটি মনে মেনে নিলে আর কোনো দ্বিধা থাকে না। কেননা পৃথিবীটা পুরোনো বটে, কিন্তু তার জনপ্রবাহ নতুন। তাই তার অধিবাসীদের চোখে এ ভুবন চিরনতুন। জীবনযাত্রায় তারা নতুনভাবে আবিষ্কার করে জগৎকে, অনুভব করে জীবনকে, রচনা করে ভবন, বিকশিত হয় জীবন। এ চলার পথের উল্লাস কিংবা যন্ত্রণা, জিজ্ঞাসা কিংবা অভিজ্ঞতা অভিব্যক্তি পায় তাদের কাজে, কথায় অথবা লেখায়।
অতএব মানুষের মনটি তাজা আর অনুভূতি মাত্রই চিরনতুন। এই পুরোনো বিলাসী জগতের প্রতিবেশ প্রাণে প্রাণে যে-সাড়া জাগায়, চোখে-চোখে সুন্দরের যে-অঞ্জন মেখে দেয় তাতে হৃদয়-মন মুখর হয়ে ওঠে। সে-ই উচ্ছল আবেগই প্রকাশ পায় কবিতায়–নতুন মানুষের নতুন অনুভবের আনন্দ-বেদনা নবতর ভাষায়, ছন্দে ও রূপকল্পে প্রকাশিত হবে–এ-ই তো বাঞ্ছনীয় এবং স্বাভাবিক। নতুন অনুভবে যদি তিলে তিলে নতুন হয়ে নতুন তাৎপর্যে ও লাবণ্যে জগৎ ও জীবনকে উপলব্ধি ও উপভোগ করা না গেল, তা হলে চকিত ও চমকৃত করার অসামর্থ্যে পুরোনো পৃথিবী মানুষের বাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে।
কেজো ও অকেজো সাহিত্য
জার্নাল কাব্য হয় কি-না কিংবা কাব্য জার্নাল হতে পারে কি-না এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে। কিং নিরর্থক। কেননা, পরিণামে স্বীকার করতেই হবে যে জার্নালও সাহিত্য হয়, আর সাহিত্যও জার্নাল হতে পারে। এ-কথা এমন নিঃসংশয়ে বলতে পারছি, রবীন্দ্রনাথের শেষের দশ-বারো বছরের রচনার নজির সামনে রয়েছে বলেই।
এ যদি সত্য হয়, তাহলে জটিল কথার জাল না-পেতেই বলা যায় সাহিত্যের দুই তত্ত্ব দুইরূপ, একটি তার ব্যবহারিক ও প্রাত্যহিক দিক, অপরটি তার আত্মিক ও চিরন্তন রূপ। এমনকি শক্তিমানের হাতে পড়লে একাধারেই দুইরূপ–দুইতত্ত্ব পাওয়া যেতে পারে; শেক্সপীয়র-ভিক্টর হুগো-গ্যেটে-টলস্টয় ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে তার দৃষ্টান্ত রয়েছে। এবং বড়-ছোট সব লেখকেরই সার্থক রচনায় এর প্রমাণ কিছু কিছু মিলবে।
যেহেতু মানুষের কোনো আচরণই স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক প্রভাব-নিরপেক্ষ নয়, সেহেতু প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে পারিবেশিক প্রভাব রচনায় না-থেকেই পারে না। সাধারণভাবে বলতে গেলে, চিন্তার উৎপত্তি ঘটে পরিবেশ থেকেই। Thought-provoke করাবার কারণ সবসময়ই আবেষ্টনীর মধ্যে ব্যাপ্ত থাকে। সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে কোনো ভাবই নিরূপ-নিরপেক্ষ হতে পারে না, যেমন আগুন হতে পারে না নিরবলম্ব। কাজেই চিন্তার জাগরণ যখন আপেক্ষিক এবং তা পরিবেষ্টনী-উদ্ভূত–তথা সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র-সংস্কারপ্রসূত অন্তত সে-সংস্কার সংপৃক্ত, তাহলে। মানবিক আচরণে নির্জলা নিরূপ-নিরপেক্ষ কিছু আরোপ করা অসম্ভব। এদিক দিয়ে যাচাই করলে আমরা দেখতে পাব যে মানুষের ভাব-চিন্তা-অনুভূতি বাহ্য প্রয়োজন, প্রেরণা বা উত্তেজনা জাত–তা স্কুলও হতে পারে, আবার এমন সূক্ষ্মও হয়, যা সচেতনভাবে ঠিক উপলব্ধি করা যায় না। কিন্তু অবচেতনার প্রভাবে অভিভূতি আনে। যা স্কুল তা বাহ্য প্রয়োজন মিটায়। যা সূক্ষ্ম ও পরোক্ষ তা দিয়ে ব্যবহারিক জীবনের কোনো কাজই হয় না হয়তো। যেমন কেজো কিছু হয় না ফুল বা পাতাবাহারের গাছ দিয়ে। কাজেই দেখা যাচ্ছে সাহিত্যও দুই প্রকার-কেজো আর অকেজো। অপ্রয়োজনের প্রয়োজন বোঝানো সহজ নয়, তেমনি অকেজো সাহিত্যের কার্যকরতা দেখানো কঠিন। তবে বলা যায়, জীবনে সুন্দরের যে-স্থান, মনে অকেজো সাহিত্যেরও সে-চাহিদা। আজ স্বার্থবুদ্ধির ফেরে পড়ে দুনিয়ার লোক কেজো সাহিত্যের অনুরাগী হয়ে উঠেছে। অকেজো সাহিত্যের নামে তারা চরম অবজ্ঞায় নাক সিটকায়। তাদের বক্তব্য অনেকটা এরকম : অন্নের কাঙাল চাষীর ধান-পাটের চাষই জীবনের ব্রত। কেননা ক্ষুধার অন্ন যোগাড় করাই তার লক্ষ্য। সে যদি ধান-পাট ক্ষেতে ফুলের বাগান করার শখ করে, তাহলে তা হবে তার পক্ষে আত্মহত্যার সামিল। তাকে আমরা বলব মূর্খ, বিকৃতবুদ্ধি কিংবা নির্বোধ। সে ঘৃণ্য। আজকের দিনে সমস্যা-বিমূঢ় কাঙাল মানুষ তাই কেজো সাহিত্যের পক্ষপাতী। তাদের মতে সাহিত্য-বিলাসের পরিবেশ পৃথিবীতে আজ দুর্লভ। তাই রসকৈবল্যাদর্শের প্রতি তারা মারমুখো। তারা সংখ্যাগুরু। কাজেই সবাই তাদের দাপটে কাবু-খামোশ হয়ে আছে।
তাই বলে অকেজো সাহিত্য আজও অনর্থক নয় এবং কোনোকালেই একেবারে নিরর্থক মনে হবে না। কেননা তেমনি নির্বুদ্ধিতা হবে রমনার্থীনে ধানচাষ করবার আয়োজন করলে। ধান-পাটের প্রয়োজন যতই গুরুতর হোক, ফুল-বাগানের সাথে তার তুলনা হতে পারে না যেমন তুলনা হয় না লোহায়-সোনায় ফুল-বাগানের বিরোধিতা যদি করতে হয়, তা হলে তা অসামর্থ্যের অজুহাতেই করব, অপ্রয়োজনের বলে নয়। ধান-পাটে জৈব-প্রয়োজন মিটে, ওটি চাষীরও জীবনের লক্ষ্য নয়–means to an end মাত্র। আমরা উপায়কেই লক্ষ্য ঠাওরেছি, আমাদের জীবনের বিড়ম্বনা এখানেই। ধান-পাট উপলক্ষ মাত্র–লক্ষ্য তো নিশ্চিত মানসানন্দ উপভোগ। বাগান সে চাহিদা। মিটায়। কাজেই যেখানে জৈব-প্রয়োজনের শেষ, মানস-আয়োজনের সেখানেই শুরু। অতএব, অকেজো সাহিত্য কেবল উঁচুস্তরের নয়, যথার্থ কাজেরও; কেবল উপভোগের. নয়, পরম উপকারেরও।
সমস্যাবিমূঢ় কাঙাল মানুষের অসামর্থ্যকে ঢাকবার জন্যে, আঙুর ফল টক শ্রেণীর যুক্তি দিয়ে মহৎ প্রয়োজনের আয়োজনকে তাচ্ছিল্য দেখাবার আস্ফালনেই কেবল আমাদের আপত্তি।
যে-অর্থে আমাদের ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রয়োজনের; সে-অর্থে সাহিত্য কোনো কালে প্রয়োজন ছিল না–হতে পারে না। সাহিত্য করে কয়জন, আর পড়ে কয়জন? সাহিত্যই জীবনের অপরিহার্য সামগ্রী যে নয়, তার প্রমাণ (অশিক্ষিতের তো কথাই নেই) শিক্ষিত লোকদের গুটিকয়জনই সাহিত্য পড়ে। এবং তাও সারাজীবনে পড়ে কয়খানা? যারা পড়ে না, তারা জীবনে উপভোগ উপলব্ধির অসম্পূর্ণতাও অনুভব করে না। কাজেই সাহিত্যাদি কলা এমনিতেই কেজো জীবনের বাইরে। তাহলে যা আদপেই কেজো নয়, তাকেই কাজে লাগানোর এত আয়োজন কেন? কথাটা বিশ্লেষণ করে বোঝার চেষ্টা করা যাক।
জনমনে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রচেতনা দানের জন্যে কিংবা স্বদেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, কল্যাণবুদ্ধি জাগানোর জন্যে, অথবা ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সমস্যা তুলে ধরে সমাধানের ইঙ্গিত কিংবা প্রেরণা যোগাবার জন্যেই যে সাহিত্য হওয়া উচিত, সে সম্বন্ধে আজকাল জীবন-সচেতন মানুষ মাত্রই একমত। এ যে-রচনায় নেই তা ব্যর্থ। এ-ই তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত। আমরা তো স্বীকার করেছি যে কেজো সাহিত্যও আছে। আমাদের আপত্তি হচ্ছে প্রথমত কেজো সাহিত্যই একমাত্র সাহিত্য নয়, দ্বিতীয়ত কেজো সাহিত্য নিতান্ত কেজো বলেই মহৎ নয়, তৃতীয়ত কেজো সাহিত্য সৃষ্টি করাই কারো ব্রত হওয়া উচিত নয়। কেন, এবার তা-ই বলছি। শোনা যায় এবং ঘটা করে সারা দুনিয়ার নানা সাহিত্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে শোনানোও হয় যে সমাজ সংস্কারে, ধর্ম-প্রচারে, পীড়ন-অপসারণে, আযাদী অর্জনে, রাষ্ট্রগঠনে, মতবাদ গড়নে,বিপ্লব-বিদ্রোহ সৃজনে, সংস্কৃতির উন্নয়নে, জাগরণ আনয়নে কিংবা সামগ্রিকভাবে জাতীয় চেতনা দানে কেজো সাহিত্যের মতো এমন অব্যর্থ অস্ত্র আর নেই। ঘরে বসে কলম পেষো, কাগজে ছেপে দাও, ব্যস, জাদুর মতো অভীষ্ট ফল ফলে গেছে!
কিন্তু প্রচার-সাহিত্য ছাড়া এসব ব্যাপারে সাফল্যের আর কোনো উপায় নেই, কিংবা সাহিত্যের মাধ্যমে প্রচারই একমাত্র পন্থা তা মানা যাবে না, কেননা আমরা চোখের সামনেই দেখছি, এক জায়গার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খবরই অন্যত্র দাঙ্গা বাধানোর পক্ষে যথেষ্ট। অশিক্ষিতের দেশ কঙ্গোও যখন স্বাধীন হয়, খবরের কাগজে পরিবেশিত লুমুম্বা-হত্যার কেবল সংবাদই যদি উত্তেজনা সৃষ্টির প্রচুর কারণ হয়ে ওঠে কিংবা সম্পাদকীয় মন্তব্যই উত্তেজনা ও প্রেরণাদান তথা বিদ্রোহ-বিপ্লব ঘটানোর পক্ষে যথেষ্ট প্রমাণিত হয়, তাহলে চেতনা দানের সাহিত্য অপরিহার্য বলে মানি কী করে? যেখানে স্বার্থ, গরজ ও পীড়ন সেখানে মনটি এমনিতেই Time-bomb-এর মতো তৈরি হয়েই থাকে, সামান্য উত্তেজনা কিংবা যোগ্য নেতৃত্বে গণশক্তি ফেটে পড়েই। এ আমাদের দেখা-জানা কথা। কাজেই কেজো সাহিত্য যে খুব কাজের তা ধ্রুব নয়। এক্ষেত্রে বরং রাজনীতিকের বক্তৃতাই বিশেষ কার্যকর। ভালো বক্তার ভালো লিখিয়ে হওয়া সম্ভব, কিন্তু বড় বক্তা বড় লিখিয়ে নন।
এবার অকেজো সাহিত্যের কথায় আসা যাক। ধর্মে, সমাজে ও রাষ্ট্রে আদর্শানুগত্য ও মতবাদনিষ্ঠা কেবল ভালো নয়, অতি প্রয়োজনীয়ও বটে। তাতে করে নিয়ম-নীতির বেষ্টনীর মধ্যে জীবন নির্বিঘ্নে উপভোগ করা সম্ভব ও সহজ হয়, তাতে মানুষের হাতে মানুষের লাঞ্ছনা-পীড়নের আশঙ্কা কমে। এতে করে সজ্জন, সচ্চরিত্র ও সুনাগরিকের সংখ্যা বাড়ে। এককথায় ব্যবহারিক জীবনের বাস্তব material ও লাভের ব্যাপারে একরকম নিশ্চিন্তই হওয়া যায়। কেজো জীবনের বাইরেও যে একটা মনোজগৎ রয়েছে! উপভোগ-উপলব্ধির নিবিড়তম যে-কেন্দ্র, তাতে কেজো কথার দাম নেই। সে হল অকাজের কাজী, অপ্রয়োজনের প্রয়োজন নিয়ে তার কারবার। সে স্কুল কিছু গ্রহণ করে না। হয়তো বা সহ্যও করে না। তার কাজ নির্যাস নেয়া, সেটি অবিমিশ্রতায় নিরূপ না হলেও স্বরূপে তাকে ধরা মুশকিল। ফুল গাছেই জন্মায়, তবু ফুল আর গাছ এক নয়; তেমনি বাহ্যঘটনা, পরিবেশ ও আচরণই সে-উপলব্ধি ও বয়সের ভিত্তি বা প্রসূতি, তবু মা-মেয়ের আদর্শে মিল খুঁজে পাওয়া ভার। কতটা স্বপ্নের মতোই। এ অবচেতন মনের লীলা। মনস্তাত্ত্বিক না হলে এ মনোরসের বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। যে-কারণে ফটো চিত্রকলা নয়, নক্সা সাহিত্য নয়, সে-কারণেই। কেজো সাহিত্য বিশুদ্ধ সাহিত্য নয়। কেজো সাহিত্যের বড় দোষ তার স্থূলতা ও বাস্তবানুরক্তি। আমরা এ-কথা হয়তো সবাই মানি যে প্রত্যক্ষকে পরোক্ষ করে তোলা এবং খণ্ড, ক্ষুদ্র ও তুচ্ছকে সমগ্রতার মর্যাদা ও গুরুত্ব দানই সাহিত্যের কাজ। কাজেই জীবনের রোজনামচা যেমন জীবনী নয়, সত্যকথার পদ্যরূপ যেমন সাহিত্য নয়, তেমনি কোনো ব্যবহারিক প্রয়োজন-মিটানো স্থূলতা এবং সাময়িকতাও অকেজো সাহিত্যের অবলম্বন হতে পারে না। কেননা অকেজো সাহিত্য যে-মনের খোরাক, তার সম্পর্ক পরিবেষ্টনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ নয়–পরোক্ষ। কথাটা ব্যাখ্যা করে বলি, সমাজ ধর্ম-রাষ্ট্র ও ধন-জন-মান প্রভৃতি আমাদের জৈবিক প্রয়োজনেরই অবলম্বন। এ জীবনে দেশ আছে, ধর্ম আছে, আইন আছে, সংস্কার আছে এবং আছে আরো কত কি। আমরা এসব নীতিশাসনের হাজারো গিঁঠাতে বাঁধা। আমাদের একটি মনোজীবনও আছে, যেখানে দেশ-কাল-সমাজ-ধর্ম শাসন-নিয়ম কোনোটারই বন্ধন স্বীকার করিনে, বলা যায় এসবের অস্তিত্বই অনুভব করিনে। কাজেই সেখানে কোনো আদর্শবাদ কিংবা কিছুতে ঐকান্তিক নিষ্ঠার প্রশ্নই ওঠে না। সেখানে প্রাকৃতিক ঋতুবৈচিত্র্য নেই, স্থান-কালের তফাৎ নেই। এখানে যে-বোধ আছে তাকে বলা যায় মানবিক-বোধ। তা সচেতন নয়–সুপ্ত। একে বলা যায় Radical Humanism বা মৌল মানবিকতা। একে সযত্নে লালন করলে, সচেতনভাবে এর পোষকতা করলে পাই Rational Humanism বা বোধিসম্পন্ন মনুষ্যত্ব। এ মনুষ্যত্বের কাছে কালিক, ভৌগোলিক কিংবা সামাজিক বাছ-বিচার নেই। মৌল মানবিকতা বীজ হলে মনুষ্যত্ব হবে ফল। দেশ, কাল ও জাতিচেতনার ঊর্ধ্বে সর্বমানবিক, রসনিষ্যন্দী সাহিত্য এ বোধেরই সন্তান। যাতে মানুষ আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি। কারণ বিপুলা পৃথিবীর নিরবধি কালের মানস-সঞ্চয় নিয়ে এর কারবার। এ হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রাণের সাথে মিলায় প্রাণ। আবহমান কালের বুকে ধ্রুব হয়ে দাঁড়াবার কেরামতি থাকে এর। এক অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্র দিয়ে এ খণ্ড-ক্ষুদ্র ও তুচ্ছকে সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে করে এক অদ্বয় চেতনার আবেশে মানুষ আনন্দলোকের অধিকার পায়, যেখানে দাঁড়িয়ে সে বলতে পারে এবং বলেও–এ জীবন মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধুলি, এখানে যা দেখেছি যা পেয়েছি তুলনা তার নাই। তখন সব সুন্দর এবং সুন্দর সর্বব্যাপী। তখন লোভে সুন্দর, ক্ষোভে সুন্দর, স্নেহে সুন্দর, প্রেমে সুন্দর, আনন্দে সুন্দর, বেদনায় সুন্দর। তখন দুবৃত্ত সুন্দর, নিপীড়িত সুন্দর, খল সুর, ছলও সুন্দর। তখন কেড়ে খাওয়া আর সেধে দেওয়া–দুই-ই সমান, দুই-ই অপরূপ। এমনি বোধের অধিকারী হলেই মানুষ হয় জীবনরসিক। তখন সে দৃশ্যজগতের সবকিছু থেকেই। কেবল আনন্দের উপাদানই পায়–সে-আনন্দে দৈবিক, মানবিক কিংবা আসুরিক বলে কোনো পরিমাণ বা স্তরভেদ থাকে না। একালের এক স্বীকৃত মহৎ লিখিয়ের মুখে তাই শুনি–আমি চোখ মেলে যা দেখলুম, চোখ আমার তাতে কখনো ক্লান্ত হলো না। বিস্ময়ের অন্ত পাইনি। চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহত বাণী অনন্ত কালের অভিমুখে ধ্বনিত, তাতে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে; মনে হয়েছে, যুগে যুগে এ বিশ্ববাণী শুনে এলুম। আমি ভালোবেসেছি এ জগৎকে, আমি প্রমাণ করেছি এ মহৎকে। আমি কামনা করেছি মুক্তিকে।
ইনি আরো বলেন–
এ কথা যখন জানি
মানবচিত্তের সাধনায়
গূঢ় আছে যে সত্যের রূপ
সেই সত্য সুখ দুখ সবের অতীত।
তখন বুঝিতে পারি
আপন আত্মায় যারা
ফলবান করে তারে
তারাই চরম লক্ষ্য মানব সৃষ্টির।
এসবকিছুর মূলে রয়েছে সামগ্রিক ভালোবাসা, নির্বিচার প্রেম–এই হচ্ছে জীবনরস, একে যে নিতে শিখেছে তাকেই বলি জীবনরসিক। তার চিত্তকে একটিমাত্র বোধই আচ্ছন্ন করে রাখে, সে জানে–
এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি
এ ভালোবাসাই সত্য,–এ জন্মের দান।
বিদায় নেবার কালে
এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুরে করিবে অস্বীকার।
শাদামাটা কথায় বলা যায়, মনের এ স্তর হচ্ছে জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে সূক্ষ্ম অনুভূতি ও উপলব্ধির স্তর, To know all is to Pardon all কথাটি যে-বোধের পরিচয় দেয়, আমরা সে-বোধের স্বরূপটিকেই Rational Humanism বা বোধিসম্পন্ন মনুষ্যত্ব বলছি। পূর্ণাঙ্গ জীবনালেখ্য দেয়া কিংবা নিখুঁত জগৎ উদ্ঘাটন করা, এমনি মনুষ্যত্বেই সম্ভব।
আমি কবি, তর্ক নাহি জানি। এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে। মহৎ সাহিত্যিকের লক্ষ্য, সাধ্য ও ব্রত এ-ই। অতএব এক্ষেত্রে আদর্শানুগত্য, জাতি ও সমাজ-চেতনা প্রভৃতি অবাঞ্ছিত কথা। আদর্শানুগত্য মহৎ সৃষ্টির তো বটেই, ভালো সৃষ্টিরও পরিপন্থী। মন যার মুক্ত নয়, চিন্তা তাঁর। স্বাধীন হতে পারে না। আর স্বাধীন চিন্তা যেখানে অসম্ভব, সেখানে অনুভূতি খণ্ড আর উপলব্ধি পঙ্গু হবেই। কাজেই তাকে সত্য, সমগ্র ও সুন্দর ধরা দেয় না। তেমন লেখক, জাতীয় কবি হতে পারেন, সমাজ-দরদী ঔপন্যাসিক হতে পারেন, জনপ্রিয় মনীষীও হতে বাধা নেই, কিন্তু মানুষের : আত্মিক মিলন-ময়দানে তাঁর স্বীকৃতি নেই–সেখানে তিনি অচেনা–অবাঞ্ছিতও। পারিবারিক জীবনে ব্যক্তিক স্বার্থচেতনা যেমন পরিবারের অশান্তি ও বিপর্যয় ঘটায়, তেমনি স্বাজাত্য ও স্বারাষ্ট্রবোধ দেশে দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত জিইয়ে রাখে। আজকের দুনিয়ার বারো আনা দুঃখের উৎস এটিই। আজ যখন পৃথিবীর ভৌগোলিক বাধা মুছে গেছে, রাজার রাজ্য উঠে গেছে, মানুষ রাষ্ট্রিক সীমাও অপসারণের স্বপ্ন দেখছে, তখন গোত্র, সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র-সীমা-চেতনাপ্রসূত আদর্শবাদ কিংবা মতবাদ-প্রবণতা মনুষ্য মনন ও প্রগতির বাধা বৈকী! জাতীয় নয়–আন্তর্জাতিকতাই এ যুগের সাধ্য হওয়া উচিত–তাহলেই আশু মঙ্গল। বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা নিয়েও যেমন পৃথিবী অখণ্ড, তেমনি দুনিয়ার মানুষের মনন ও আচার বৈচিত্র্য স্বীকার করেই মানুষ একজাত অর্থাৎ United in diversity–শতবছর পরে হলেও নিশ্চয়ই কোনো একপ্রকারের বিশ্বরাষ্ট্র গড়ে উঠবে। কাজেই দূরদৃষ্টি যার আছে, সে কেন বৃথা সাধনায় জীবন নষ্ট করবে!
বলেছি, আদর্শানুগত্য জীবনের আর আর ক্ষেত্রে বিশেষ ফলপ্রসূ, কিন্তু মানসসৃষ্টির ক্ষেত্রে অভিশাপ। স্রষ্টা নিজেকে কোথাও বিকোতে পারে না, তার স্বাধীনতা কারও কাছে বন্ধক রাখা যায় না। তাহলে প্রতিমুহূর্তে তাকে আত্মপ্রতারণা করতে হয়। কারণ আদর্শ বিচ্যুতির ভয়ে সে তার উপলব্ধির সত্যকে প্রকাশ করতে পারে না। অকৃত্রিম কাঞ্চন ফেলে, সে গিটিকে সোনা করবার বিড়ম্বনায় আত্মনিয়োগ করে। এতে হয়তো কেজো সাহিত্য সৃষ্টি হয়–কাজেও লাগে, কিন্তু অকেজো সাহিত্য হতেই পারে না। কেজো সাহিত্য হচ্ছে বেগুন-ক্ষেত আর অকেজো সাহিত্য ফুলবাগান। যার যা রুচি ও প্রয়োজন, সে তা-ই করবে।
গণসাহিত্য
গণসাহিত্য বা সাম্প্ৰত-সাহিত্য ও সাহিত্যাদর্শ সম্বন্ধে আজো অনেকেই বিরূপ ধারণা পোষণ করেন। এমন লোকও আছেন, যাঁরা একে রসসাহিত্য বলতে কিছুতেই রাজি নন। এক কথায়, তারা সাহিত্যের অত্যাধুনিক আদর্শে আস্থাবান নন।
দোষ তাঁদের নয়। নতুনকে দ্বিধাহীনচিত্তে গ্রহণ করা কোনোকালেই তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। নবীন ও প্রবীণে দ্বন্দ্ব নতুন নয়। প্রবীণের মনে প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার গর্ব থাকে, তাতেই প্রবীণরা রক্ষণশীল। যাকে প্রবীণেরা প্রজ্ঞা মনে করেন, তা আসলে সংস্কার; আর যাকে অভিজ্ঞতার কষ্টিপাথরে পরীক্ষিত ভাবেন, তা মূলত অভ্যস্ত সংস্কারের প্রতি অন্ধ মমতা। এজন্যেই প্রবীণমাত্রেই বিজ্ঞতার দাবী করেন। নবীনরা চলে প্রাণধর্মের প্রেরণায়। বয়োধর্মের গুণে সংস্কারবিমুক্ত একটি স্বচ্ছ অথচ উচ্ছ্বাসময় দৃষ্টি এদের স্বভাবজ। সে-দৃষ্টিতে জগৎ, জীবন, ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক খুঁত–বহু ত্রুটি ধরা পড়ে যায়। তারুণ্যের আর একটি লক্ষণ হচ্ছে বিসদৃশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, আর শক্তির প্রয়োগ। আশ্চর্য এই যে, এককালে যারা নবীন-নতুনের দিশারী ও পূজারী, তারাই বয়োধর্মের বিধানে প্রবীণ–বিজ্ঞতাভিমানী, নতুনের বিদ্বেষী, রক্ষণশীল; তারা এমন গোঁড়া। রক্ষণশীল যে, নতুন তুলিতে আর বুলিতে ভীত ও ত্রস্ত হয়ে উঠেন। সবল হলে সশস্ত্র রুখে দাঁড়ান, দুর্বল হলে কান্না জুড়ে বসেন। ধর্মে-দর্শনে-সমাজে-সাহিত্যে-রাষ্ট্রে চিরদিন এই দ্বন্দ্বই চলে আসছে।
অতএব, আমাদের আজকের দিনের সাহিত্যাদর্শও যদি পূর্বযুগের মনন-পুষ্ট কারো পছন্দসই না হয়, তবে দুঃখ করবার কিছুই নেই। তাদের কাছে স্বীকৃতি না পেলে ক্ষুব্ধ হওয়াও উচিত নয়।
তবে প্রথা আছে, প্রচারণা চালিয়ে স্বমতের প্রতিষ্ঠা করা–আর অবিশ্বাসীর মনে বিশ্বাস আনয়ন করা। আমরাই বা নিয়মের ব্যতিক্রম করব কেন! তাই দু-চারটা কথা বলতে চাই।
সাম্প্ৰত-সাহিত্য সম্বন্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে–এ সাহিত্য হৃদয় ও কল্পনাধর্মী নয়, নিছক ব্যবহারিক জীবনের অভাব-অভিযোগ নিয়ে একপ্রকার মানসিক ব্যায়াম অথবা অশিক্ষিত মনের অসংযত উত্তেজনা। অর্থাৎ তাদের মতে, আজকের সাহিত্য রসসাহিত্য নয়–অভিযোগ অভিযানের বাণীবাহক প্রচারপত্র বিশেষ। তারা বলেন–সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, অভাব-অভিযোগ, অত্যাচার-নিপীড়ন চিরদিন মনুষ্য-জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে। ব্যবহারিক জীবনে এসবের প্রতিষ্ঠা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্যে সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় স্তম্ভটি তো রয়েছেই, এগুলো নিয়ে আবার সাহিত্য করা কেন? আর এগুলোতে সাহিত্যের উপাদানই বা কোথায়? সাহিত্য হবে। ব্যবহারিক জীবনের এক কল্পজগতের দিশারী, সে-জগৎ হবে সব পাওয়ার দেশ। জীবনে যা পাইনি, যা পারিনি–সেখানে থাকবে তারই সমাবেশ। সেখানে রাজা আর ভিখারি সমভাবে—‘আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি’।–এ মতের সমর্থক একজন কবি বলেছেন :
জীবন যাহার অতি দুর্বহ দীন দুর্বল সবি–
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ–সে-জন বটে কবি। (মোহিত মজুমদার)
অপর একজন বলেছেন :
জীবনে যে-সাধ হয়েছে বিফল
সে-সাধ ফুটিছে গানে। (রবীন্দ্রনাথ)।
সুতরাং তাদের সুদৃঢ় অভিমত হচ্ছে—আধুনিক সাহিত্য-প্রচেষ্টা কোনোমতেই কবিকৃতি বা শিল্পীর সৃষ্টি নয়। কারণ সাম্প্ৰত-সাহিত্যের আদর্শ বা বিষয়বস্তু কোনোটারই রচনাকে রসায়ত্ত করবার যোগ্যতা নেই। কেননা–এ আদর্শে ও বিষয়বস্তুতে মানব-মনের ও হৃদয়ের চিরন্তন অনুভূতি ও প্রেরণা নিহিত নেই।
বিরুদ্ধবাদীদের অভিযোগ শোনা গেল, এখন আমাদের বক্তব্য পেশ করতে হয়।
প্রথমত, দেশ-কাল-পাত্র-নিরপেক্ষ সাহিত্য নেই–তা সেই সাহিত্যের আদর্শ art for arts sake ই হোক, আর সমাজ-রাষ্ট্র বা ব্যক্তিজীবন-বোধই হোক। হোমারের ইলিয়ড ওডেসিতে যে-ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যেসব চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে, যে-নীতির তারিফ করা হয়েছে, তা এদেশের নয়, এ যুগের নয়, এ জাতিরও নয়। তবে তা আজো বিশ্বমানবের সম্পত্তি হয়ে রইল কী করে? ইরানের সেই বীর-বাদশা নেই, সে-কালও নেই, কিন্তু শাহনামা আজো আছে। জাঁ ভাজার দিনের সেই ফ্রান্স আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। আজকের ফরাসি-জাতিতে ও ফরাসি দেশে সে-ফ্রান্সের সমাজের, রাষ্ট্রের, মানুষের চিহ্নমাত্র নেই; তবে ল্য মিজারেবল আজো টিকে রইল কী করে? একদিন যা ছিল একান্তভাবে একটি বিশেষ দেশের, কালের ও মানুষের নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার, তা-ই আজ দেশ-কাল-পাত্র-নিরপেক্ষ বিশ্বমানবের সর্বজনীন হৃদয়ের ধন হয়ে উঠল কিরূপে? জানি, বিরুদ্ধবাদীরা বলবেন–এতে মানব-মনের ও হৃদয়ের চিরন্তন অভিব্যক্তি ছিল– যা সর্বকালের, সর্বদেশের ও সর্বমানবের। ল্য মিজারেবল-এর মতো আরো দুটো পরিচিত গ্রন্থের নাম করব–একটা হচ্ছে Uncle Toms Cabin অপরটা নীলদর্পণ। এ দুটোও প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে দুটো দেশে বিপ্লব ঘটিয়েছিল। নীলদর্পণের আবেদন নীল-চাষ উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। এটি স্বদেশেও কালজয়ী হতে পারেনি। Uncle Toms Cabin-এর আবেদনও কী আজ আছে? কিন্তু ল্য মিজারেবল-এর গৌরব আজো অম্লান। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাহিত্যের বিষয়বস্তু কোনোকালেই চিরন্তন নয়, আদর্শও অনেক সময় নিতান্ত সাময়িক সমস্যা নির্ভর। তবু রসসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আসনে এদের অনধিকার নেই।
অতএব একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছা গেল–তা হচ্ছে রসসাহিত্য বা চিরন্তন আবেদনের সাহিত্য সৃষ্টিতে বিষয়বস্তু বা আদর্শ বড়কিছু নয়, লেখকের শক্তিই আসল। ল মিজারেবল-এ যে-সার্জেন্ট টার চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে, তা কোনো ব্যক্তিবিশেষের চরিত্র নয়–সে হচ্ছে আইনের মূর্তিমান প্রতীক (personification of the spirit of law)। জঁ ভাজাও নির্যাতিত মানবতার প্রতিমূর্তি একটি বিদ্রোহী আত্মাবিশেষ (a personified soul of the suffering humanity and its revolt against mankind)। ল্য মিজারেবল-এর তাই এত কদর এবং অমর-সৃষ্টি বলে গোটা দুনিয়ায় অভিনন্দিত। অথচ একটা দেশের একটা বিশেষ যুগের আর্থিক বিপর্যয় ও রাষ্ট্রীয় কুশাসনের চিত্র বই এ আর কিছু নয়।
ওথেলো নাটকের কথাই ধরা যাক্। বিষয়বস্তু হচ্ছে–এক তরুণ স্বামী তার স্ত্রীর চরিত্রে সন্দিহান হয়ে স্ত্রীকে হত্যা করে। এমন ঘটনা হয়তো আজো দৈনন্দিন ঘটছে। নিতান্ত ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঘটনা। কিন্তু শুধু কী তাই! ওথেলো ও ডেসডিমোেনায় কী প্রেমের দুটো দিক মূর্তি পরিগ্রহ করেনি, ইয়াগো কী সর্বধ্বংসী মন্দশক্তির প্রতীক হয়ে ওঠেনি? এখানেও প্রেম, প্রতিহিংসা ও ঘৃণা মূর্তি ধারণ করেছে (The sprit of love, malice and hatred is manifested)। এজন্যেই ওথেলোর কাহিনী ব্যক্তির হয়েও সমষ্টির হয়ে উঠতে পেরেছে। এখানেই কবিকৃতি–শিল্পীর গৌরব এবং সৃষ্টির স্থায়িত্বও নির্ভর করে সম্পূর্ণ শিল্পকৌশলের উপর বিষয়বস্তু বা আদর্শের উপর নয়।
দ্বিতীয়ত, আমরা আজকের দিনে যে-জীবন-সমস্যার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, এমন সমস্যা দুনিয়ায় কোনোদিন ছিল না। ব্যক্তিসত্তাবোধ ও. তীব্র গণচেতনা এ-যুগের পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। শিক্ষা-সভ্যতার প্রসারে আধুনিক যুগের মানুষ জগৎ, জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র ও ব্যক্তি সম্পর্ক নতুনভাবে যাচাই করে নিতে বদ্ধপরিকর। কেননা শিক্ষা ও সুরুচি মানুষকে দিয়েছে তীব্র মর্যাদাবোধ ও আত্মবিশ্বাস। এদিকে পরিবেশও হয়ে উঠেছে প্রতিকূল। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গোটা দুনিয়ায় জীবন-ধারণযোগ্য দ্রব্য-সামগ্রীর অভাব ঘটেছে একান্ত। ফলে লোভ আর কাড়াকাড়ি ও হানাহানি তীব্রতর হয়ে উঠেছে সর্বত্র। বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, তাই দুর্বল জনসাধারণ ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার, পীড়ন ও অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। এইরূপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপিত হওয়ার ফলে ধন-বৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে ক্ষোভ আর গ্লানি, মনন জীবন করেছে পঙ্গু। অধিকাংশ লোকের ডাল ভাতের সংস্থান না-থাকায় তারা বুনিয়াদি শিল্প-কলা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির উপর ক্ষোভে উত্তেজনায় মারমুখী হয়ে উঠেছে। বস্তুত বেঁচে থাকাই যখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে, তখন মনুষ্যত্ব বিকাশক সুন্দর, বৃহৎ ও মহতের সাধনায় আত্মনিয়োগ করা সম্ভব নয়। তাই অধিকারবাদের সগ্রাম শুরু হয়েছে দুনিয়াময়। সে-সগ্রাম দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে আর শ্রেণীতে শ্রেণীতে অবিরাম চলছে।
ব্যক্তিসত্তায় সংগ্রামী বীজ অনুপ্রবিষ্ট হয়ে গণচিত্ত করেছে বিক্ষুব্ধ, বিস্রস্ত; তাই আজকের দিনে বুনিয়াদি শিল্পকলায় ও রুচি-সৌন্দর্যে অনুরাগ প্রদর্শন করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। আজকের সাহিত্য প্রচেষ্টায় তাই বস্তু-ভাব-ভাষা-ছন্দ ও আদর্শ একান্তই নিরাবরণ ও নিরাভরণ। কিন্তু তাই বলে কী আজকের দিনের সাহিত্য আগামী দিনের জনগণ-মনে রস পরিবেশনে অক্ষম হবে?
আমাদের এই সংঘাত-মুখর গ্লানিময় জীবনের, এ ক্লিন্ন দিনের কাহিনী কী তাদের মনে রেখাপাত করবে না? তারা কী বুঝবে না–সমাজ ও রাষ্ট্রের অব্যবস্থায় যে-আর্থিক বিপর্যয় আসে, তাতে বুভুক্ষাপীড়িত নিরন্ন রুগ্ণ-ক্লিষ্ট-পিষ্ট কোটি কোটি হতভাগ্য মানবসন্তান অপঘাত অপমৃত্যু থেকে বাঁচবার জন্যে আনচান করেছিল? তারা কী উপলব্ধি করবে না ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই হতভাগ্যেরা বৃহৎ ও মহতের সাধনায়, সুন্দরের সাধনায় আত্মনিয়োগ করবার সুযোগ-অবসর পায়নি? এ কলঙ্কিত যুগের মানুষের ও মনুষ্যত্বের অপমৃত্যুর ইতিহাস কী তাদের জানবার দরকার হবে
আমাদের ব্যবহারিক জীবনের বেদনার কাহিনী, আমাদের সংগ্রামের বাণী যদি তাদের কাছে কদর না পায়, তবে তা বিষয়বস্তু ও আদর্শের অযোগ্যতার দরুণ নয়, বরং তা আমাদের বাচনভঙ্গির ত্রুটি ও চিত্রণশক্তির অপটুতার জন্যেই উপেক্ষিত হবে।
আগেই বলেছি, রচনাকে রসায়ত্ত শিল্পরূপে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে শক্তি ও শিল্পকুশলতা প্রয়োজন। অন্যথায় রচনা রচনাই থেকে যায়, সাহিত্য হয় না।
একটা দৃষ্টান্ত নেয়া যাক্। আমরা স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম বলেই নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও পলাশীর কাহিনী আমাদের উত্তেজিত করত, প্রেরণা দিত। আজ আজাদী পেয়েছি। পলাশী যুদ্ধ বা নবাব সিরাজদ্দৌলার কাহিনী আমাদের মনে আর সাড়া জাগাবে না; ইতিহাসের অসংখ্য যুদ্ধ, বিশ্বাসঘাতকতা ও হত্যা-কাহিনীর মতো এও একটি কাহিনী হয়েই থাকবে। তার বিশেষ আবেদন, বিশেষ ব্যঞ্জনা ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ যদি জুলিয়াস সিজারের মতো নাটক রচনা করে এ কাহিনীকে ভিত্তি করে, তবে তার আবেদন থাকবে চিরস্থায়ী হয়ে। ফলে, পলাশীর যুদ্ধ ও নবাব সিরাজদ্দৌলার ঐতিহাসিক মূল্য শুধু ইতিহাসের ছাত্রের কাছেই থাকল, কিন্তু পলাশীযুদ্ধ বা সিরাজদ্দৌলা নাটকের আবেদন সর্বদেশের, সর্বকালের ও সর্বমানবের কাছে সমভাবে পৌঁছবে। একেই বলে শিল্প, এতেই হয় সাহিত্য।
সুতরাং আধুনিক গণসাহিত্যকে প্রচারপত্রিকা বলে উপহাস করবার কারণ নেই। এ আদর্শে রচিত কোনো রচনা যদি পাঠক-হৃদয়ে সাড়া না জাগাতে পারে, তবে বুঝতে হবে, লেখক অক্ষম প্রতিভাহীন। আদর্শ ছোট নয়–বিষয়বস্তুও সাহিত্যের উপাদান হবার অযোগ্য নয়।
আধুনিক সাহিত্যের বিরুদ্ধে আর একটা নালিশ এই যে–এতে প্রাচীন বিশ্বাস, সংস্কার, রীতিনীতি প্রভৃতিকে অস্বীকার ও উপহাস করা হচ্ছে। নরনারীর সম্পর্ক, প্রেম-স্নেহ-মমতা প্রভৃতির আধুনিক-মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রাচীন সংস্কার ও বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছে, ফলে যা একসময় আত্মিক ও আধ্যাত্মিক আবরণে বরণীয় ও সহনীয়রূপে পরম পবিত্র বলে বিবেচিত হত, তাকেই একান্ত জৈব-ব্যবহারিক প্রয়োজনের সামগ্রী বলে মাহাত্ম্যহীন করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, এর সাথে বিপর্যস্ত করা হচ্ছে মানুষের আস্তিক্য বুদ্ধিকেও। শ্রদ্ধা, ভক্তি প্রভৃতির মতো পবিত্র বৃত্তি ব্যঞ্জনাগুলোকেও যেন করা হচ্ছে উপহাস। সমাজ-রাষ্ট্র ও ব্যক্তিসত্তার চিরন্তন সংস্কারকেও দলিত করে সমাজের ভিত জীর্ণ করে দিচ্ছে। এর ফলে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সামঞ্জস্য সৌষ্ঠব-শান্তি নষ্ট হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে যে-সংসার–সে-সংসারে প্রয়োজনের ব্যবহারিক বন্ধনের উপর ধর্মীয়, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক মর্যাদা আরোপ করে পারস্পরিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতার মধ্যে যে একটা পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের সংস্কার জাগিয়ে রাখা হয়েছিল, তা যদি নষ্ট হয়ে যায়; তবে সংসার, পারিবারিক বন্ধন টিকবে কোনো আদর্শের জোরে?–এ-ই হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসা।
অবশ্য এ-কথা সত্যি যে, আমরা যে-পরিমাণে কার্লমার্কস্ ও ফ্রয়েডের অনুরাগী হচ্ছি, ঠিক তার দ্বিগুণ পরিমাণে প্রাচীন বিশ্বাস ও সংস্কার থেকে দূরে সরে আসছি, ফলে প্রাচীনরাও ঠিক সেই পরিমাণে মানুষ ও মনুষ্য-সমাজের পরিণাম চিন্তায় ভীত-ত্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু প্রাচীনদের ভুলে চলবে না যে, কালস্রোত নদীর স্রোতের চেয়ে কম বেগবান নয়। কিছু ধরে রাখতে চাইলেই রাখা যায় না; নতুন সূর্যের উদয়ে, নতুন মানুষের আবির্ভাবে নতুন দিন নতুন চিন্তা না এসে পারে না। প্রকৃতির রাজ্যে অহরহ পরিবর্তন চলছে-বীজে মূল, মূলে কাণ্ড, কাণ্ডে শাখা, শাখায় পাতা-কলি ফুল-ফল, ফলে আবার বীজ। স্রষ্টার কল চলছে অনবরত–সৃষ্টি আর ধ্বংস, ধ্বংস আর সৃষ্টি, এই তার কাজ। যা যাচ্ছে তা আর ফিরে আসে না এবং Old order changeth yeilding place to new.
কিন্তু তবু নতুন যা আসছে, তার সাথে পুরাতনের অনৈক্য নেই, যদিও নতুন ও পুরাতন দুটোর আলাদা রূপ। তেমনি মনুষ্য-সমাজেও নতুন ও পুরাতনে রূপগত, পথগত অনৈক্য থাকলেও মৌলিক ঐক্য সর্বত্র বিদ্যমান, উদ্দেশ্যগত বিরোধ নেই কোথাও। প্রাচীন বিধি-ব্যবস্থা, শিক্ষা সংস্কারের উদ্দেশ্য যেমন সুশৃঙ্খল; জীবন ও সমাজবোধ, আজকের বিচার-বিশ্লেষণ, গ্রহণ-বর্জন, বিশ্বাস-শ্রদ্ধা, উপহাস-উপেক্ষাও ঠিক একই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সুতরাং প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কার পালটাতে পারে, কিন্তু মানুষ চিরদিন সামাজিক জীবই থাকবে–তাতে সন্দেহ নেই। অতএব বলা যেতে পারে, এ পথে মানুষের পরিণাম ভয়াবহ হবে না বরং সামাজিক ও পারিবারিক জীবন আরও সুন্দর, আরো সার্থক, আরো মধুর হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়। সুতরাং প্রাচীনদের আশঙ্কা করার কিছুই নেই, বরং ভরসা করার রয়েছে অনেক কারণ। কেননা শিক্ষা-সভ্যতার প্রসারের ফলে মানুষের উৎকৃষ্ট বৃত্তিগুলো অধিকতর বিকাশ লাভ করছে, বেহেস্ত-দোজখের শান্তি-শাস্তি নিরপেক্ষ সহজ মনুষ্যত্বের প্রেরণায় মানুষের মানবতাবোধ ও সুরুচি মানুষকে বিবেচক ও ন্যায়ানুরাগী করে তুলতে বাধ্য, যা আগের যুগে আধ্যাত্মিক-আধিদৈবিক শক্তির দোহাই কেড়েও সম্ভব হয়নি।
জাতীয় জীবনে লোকসাহিত্যের মূল্য
সুর মানুষের আদিম সৃষ্টি। যা কিছু মহৎ, সুন্দর, শোভন ও কাম্য–তাকেই মানুষ সুরের বন্ধনে সুন্দর করেছে। বিলাপে, ভ্যাংচিতে, গানে, কথায়–এক কথায় সর্বপ্রকার হৃদয়ানুভূতির অভিব্যক্তিতে মানুষ তাই সুরের আশ্রয় নেয়।
ফলে আবহমান কাল থেকে মানুষের সুখ-হর্ষ, ভয়-ভাবনা, সখ-শঙ্কা প্রভৃতি আবেগময় সবকিছুই সুরে বিধৃত।
কিন্তু চিরকাল মানুষের মন আদর্শপ্রবণ ও আদর্শানুগ। নীতি ও আদর্শের প্রতি মানুষের একটা স্বাভাবিক শ্রদ্ধা ও আকর্ষণ রয়েছে। সেকালে ধর্মই ছিল লোকজীবন ও সমাজের ভিত্তি আর দিশারী। যে-যুগে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক মত ও আদর্শ গড়ে উঠত ধর্ম ভিত্তি করে। তাই ধর্মকথা বা নীতিবার্তাই ছিল সাহিত্যের প্রাণস্বরূপ। এ না হলে রচনার সামাজিক মূল্য থাকত না।
এ-যুগে এ ব্যাপারে ধর্মবিশ্বাস কার্যকর নয় বটে, তবে এ-যুগেও নীতি আর আদর্শ ছাড়া কোনো মত গড়ে ওঠে না। সমাজে, সাহিত্যে বা রাজনীতিতে মতাদর্শ লোক-যাত্রার অবলম্বন,–তা সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনীতিক বা মানবতার আদর্শের যে-কোনোটিই হোক না কেন।
সে-যুগের ধর্মের স্থান দখল করেছে এ-যুগে মতবাদ। সে-যুগে জীবন ছিল ধর্মকেন্দ্রী ও সংস্কার-প্রবণ। এ-যুগে জীবন মত-ভিত্তিক। অতএব নামান্তরে বা কেন্দ্রান্তরে আমাদের অদৃশ্য নিয়ন্তা রয়েইছে।
বলছিলাম, সে-যুগে জীবন ধর্মকেন্দ্রিক ছিল। ফলে যা ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষের সহায়ক নয়, তা ছিল একান্তই অবহেলিত। এ কারণেই সে-যুগের ধর্ম ও নীতি-নিরপেক্ষ রচনা বর্ণে-বিধৃত হয়ে কালজয়ী রূপে এ-যুগে আমাদের হাতে পৌঁছায়নি। এখানে আমাদের উপাখ্যান-সাহিত্যের প্রশ্ন উঠতে পারে। এর উত্তরে বলা যায়, প্রথমত, রোমান্স বিদেশী সাহিত্যের অনুকরণ ও অনুবাদ। দ্বিতীয়ত, এগুলো পনেরো-ষোলো শতকের পূর্বের নয়। তৃতীয়ত, এগুলো অপেক্ষাকৃত সংস্কারমুক্ত মুসলিম-মনেরই অভিব্যক্তি। তবু রোমান্স-সাহিত্যে ধর্ম না থাকলেও ধর্মবোধ ছিল; ছিল আদর্শানুগত্য। তাই ওগুলো টিকে রয়েছ।
সে-যুগে মানুষ ছিল, অথচ মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ রস-চেতনা ছিল না–এমন হতেই পারে না। তার প্রমাণও পাচ্ছি ছড়ায়, রূপকথায়, গানে-গাথায়, প্রবাদে-প্রবচনে, হেঁয়ালিতে। যে-যুগে লাখে একজন শিক্ষিত ছিল না, সে-যুগে প্রাকৃতজন-সৃষ্ট এসবই মানুষের রস-পিপাসা চরিতার্থ করেছে শত শত বছর ধরে। শিক্ষার প্রসারের ফলে, আজ এদের রস-মূল্য কমে গেছে। সাহিত্যমূল্যও হয়তো নেই। তাই এসব লোক-সৃষ্ট সাহিত্য লোকস্মৃতি থেকে মুছে যাচ্ছে। তবু লোকশ্রুতিতে কতকটা বেঁচে আছে। কিন্তু এ-যুগে এসব আর বুঝি টিকে থাকতে পারছে না। লোকমুখের আশ্রয় হারিয়ে ওগুলো নদীর চরের মতো আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসে ঠাই করে নিচ্ছে। যদি সবগুলো সযত্নে সংগৃহীত হয়, তাহলে আমাদের ক্ষোভের কারণ থাকে না।
শিক্ষা-সভ্যতার বিকাশ ও প্রসারের ফলে আজ আমাদের কাছে এসব অবহেলিত রচনার মূল্য অপরিমেয়। কেননা, এর থেকেই আমরা আমাদের সর্বপ্রকার ঐতিহ্যের সন্ধান পাব–পাব সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনীতিক এমনকি নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের উপাদান। আরো একদিক দিয়ে এসবের মূল্য অপরিসীম, কেননা সে-যুগে বিদ্বান লোকেরা দরবারি ভাষা সংস্কৃতের (মুসলমান আমলে ফারসিও) চর্চা করতেন। প্রাকৃত ভাষার প্রতি তাদের অবজ্ঞার অন্ত ছিল না। কাজেই আমাদের ছড়া, প্রবাদ প্রবচন, গান, গাথা ও রূপকথা নিশ্চিতই প্রাকৃতজনের সৃষ্টি। তাই আমাদের অতীত জীবনধারার স্বরূপ উপলব্ধি ও উঘাটনের পক্ষে এগুলো আরো মূল্যবান, কারণ এতে আর যা-ই থাক, সাহিত্যিক বা নৈতিক কৃত্রিমতা নেই।
ভাষার ভিত্তি শব্দ। কাজেই জাতির পরিচয়ে শব্দের মুল্য কম নয়। এর থেকেই জাতির আচার-আচরণের বাহ্যরূপ চিত্রিত হতে পারে। এ শব্দ দিয়েও জাতির ইতিহাসের কাঠামো খাড়া করা যায়। যেমন ধরুন স্বতন্ত্র শব্দটি। এ প্রাচীন শব্দটিই বলে দেয়–এককালে এদেশে কাপড় বুনবার জন্যে আলাদা সম্প্রদায় ছিল না, প্রত্যেক পরিবারেই কাপড় বোনা হত। যাদের নিজস্ব তত থাকত, তারাই সমাজে ধনী ও মানী বলে মর্যাদা পেত। প্রতিপত্তি ছিল তাদেরই। যেমন ধরুন, প্রাচীনকালের কথা বলতেই আমরা যতই গদগদ কণ্ঠে, গোলায় গোলায় ধান আর গলায় গলায় গানের বর্ণনা দিই না কেন, দুর্ভিক্ষ শব্দটিই বলে দিচ্ছে–আমরা যেমন কল্পনা করছি, অবস্থাটা নিতান্ত তেমনি ছিল না। সে-সোনার যুগেও ভিক্ষা দিতে হত, কাঙালি-বিদায় পার্বণও ছিল, ছিল ডাল-ভাতের চোরও।
তারপর আমাদের বাগ্বিধির বিচার করলে দেখা যাবে তাতেও বিচিত্রভাবে ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের সংস্কৃতির উপাদান। যেমন পান দান। এটা সম্মতি, খাতির, মিত্রতা ও প্রীতির স্বীকৃতি সূচক।
যেমন কলকে পাওয়া–গাঁজা, চরশ তামাক প্রভৃতির দেশে সমাজে মর্যাদা বা খাতির পাওয়ার কথা এর থেকে উৎকৃষ্ট ভাবে বলা যায় না। আর একটি উদাহরণ নিন তেলা মাথায় তেল-এককালে যে আমাদের দেশে তেলাভিষিক্ত করে অভিনন্দিত বা বরণ করা হত–এ তারই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। উৎসবাদিতে তেলোয়াই দেয়ার প্রথা আজো উঠে যায়নি।
ছড়াতেও রয়েছে আমাদের সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাস। আপাত দৃষ্টিতে এগুলো যতই অস্পষ্ট ও অসংলগ্ন বলে মনে হোক না কেন, এগুলোতেও রয়েছে আমাদের নানা আচার-আচরণের ছিটেফোঁটা, মন-মননের নানা ইঙ্গিত। যেমন–
আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে।
ঝাঁঝর কাঁসর মৃদঙ্গ বাজে ॥
আগডুম-অগ্রগামী ডোম, বাগডুম–পার্শ্বগামী ডোম আর অশ্বারোহী ডোম সেনার কথা বলা হয়েছে এখানে। রাঢ় অঞ্চলে একসময় রাজা ও জমিদারদের ডোম-সৈন্য থাকত। ডোম-সেনার চতুরঙ্গ বাহিনীর রূপটিই এ প্রাচীন ছড়ায় বিধৃত হয়েছে।
হেঁয়ালির মধ্যে আমাদের মনোভঙ্গি ধরা দিয়েছে বিচিত্ররূপে। বুদ্ধির দীপ্তি, সৌন্দর্যবোধ, রসচেতনা ও রসিকতা, মননশীলতা, প্রতীকপ্রিয়তা, তত্ত্বপ্রবণতা প্রভৃতিই হেঁয়ালি বা ধাঁধার মৌলিক লক্ষণ। এ ধাঁধা যে কেবল ছেলে-হাসানো বা ইয়ার-ঠকানো রচনা, তা নয়–বঙ্গ-ভারতীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মরমীয়া বাণী বা অধ্যাত্মতত্ত্বও এর মারফতে পরিব্যক্ত। যেমন চর্যাপদে আছে :
দুলি দুহি পিঠা ধরণ ণ জাই।
রুক্ষের তেলি কুম্ভীরে খাই।
তেমনি বাউল-মারফতি গানে রয়েছে :
সোল হত্যা বাঁশের ঘর না কুলাইল জনম ভর।
পাঁচপো হত্যা পিজরা কলে থাকবি কিরে মরণ পর ॥
অথবা–
দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।
অথবা–
খাঁচার মাঝে অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মনোবেড়ী দিতাম পাখির পায়।
সাধারণ ধাঁধা—
তরু নয় বনে রয় নাহি ধরে ফুল
ডাল পল্লব তার অতি সে বিপুল।
পবনে করিয়া ভর করয়ে ভ্রমণ।
বনেতে থাকিয়া করে বনের পীড়ন।
প্রবাদ আর প্রবচনে ধরা পড়েছে আমাদের চিরকালীন বিশ্বাস, সংস্কার, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, চিন্তা ও মনন-লব্ধ তথ্য ও তত্ত্ব। প্রবাদ ও প্রবচনে একটু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। প্রবাদে মনুষ্য চরিত্রের বৈচিত্র্য, মানুষের বাহ্যাচরণের সঙ্গে মনের সংযোগের স্বরূপ; ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সম্বন্ধীয় ভূয়োদর্শনজাত অভিজ্ঞতার অভিব্যক্তি–এক কথায় জগৎ, জীবন, লোক-চরিত্র ও সমাজমনের তথ্য ও তত্ত্ব প্রবাদে বিধৃত থাকে। আর প্রবচনে থাকে নীতি, আদর্শ, কৃষি, জ্যোতিষ, সামাজিক সংস্কার, আচার, অনুষ্ঠান ও আচরণীয় বিষয় সম্বন্ধে উপদেশমূলক হিতকথা। আর একটি স্থূল পার্থক্য আছে। প্রবাদ সংক্ষিপ্ত, প্রায়ই বাক্যে বা পদে সমাপ্ত। প্রবচন ছন্দোবদ্ধ ছড়া-জাতীয় রচনা প্রায়শ একাধিক পদে সমন্বিত।
প্রবাদ যেমন,
পিরীত আর গীত–জোরের কাজ নয়
বা, নারীর বল, চোখের জল।
বা, অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী।
এবার প্রবচন দেখুন : কানে কচু চোখে তেল।
তার বাড়ি না বৈদ্য গেল ॥
অথবা, খায় না খায় সকালে নায়,
হয় না হয় তিনবার যায়।
তার কড়ি কী বৈদ্যে খায়?
অথবা। তাল, তেঁতুল, কুল–তিনে বাস্তু নির্মূল।
এসব প্রবচনে প্রাচীন স্বাস্থ্যতত্ত্ব ও চিকিৎসা বিদ্যার কথা বিধৃত। আমাদের মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাকের বুলিগুলোতেও রয়েছে আমাদের সংস্কারপুষ্ট মন ও অজ্ঞতাদুষ্ট মননের পরিচয়। এছাড়া প্রণয়গীতি, ভাটিয়ালি প্রভৃতি লোকগীতি; বাউল-মুর্শিদী-মারফতি প্রভৃতি অধ্যাত্মসঙ্গীত; ঝুমুর, সামা, কীর্তন প্রভৃতি নৃত্যসঙ্গীত এবং গাথা, রূপকথা, উপকথা, ইতিকথা প্রভৃতির সাহিত্যিক মূল্য আজো নেহাত কম নয়।
আধুনিক অর্থে আমরা জাতি হিসেবে আজো গড়ে ওঠার মুখে। এজন্যেই আমাদের কাছে এসব লোকশ্রুতি ও লোকসাহিত্যের মূল্য অপরিমেয়। এর থেকেই জাগবে আমাদের ঐতিহ্যবোধ। এখানেই দেখতে পাব আমরা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্যের স্বরূপ। আমাদের জাতীয় মন-মননের গতি-প্রকৃতির ও ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ও নিশ্চিত পরিচয় ঘটবে এসবেরই মাধ্যমে। জাতীয় সাহিত্য যদি জাতীয় জাগরণের অবলম্বন হয়, সাহিত্যকে যদি জাতির প্রাণরসের উৎস বলে মনে করি, তবে এগুলোর মূল্য অবশ্যস্বীকার্য।
ছড়ায়-প্রবাদে-প্রবচনে যেমন; তেমনি এসব গান, গাথা, রূপকথা, উপকথা ও ইতিকথায় আমাদের জগৎ-জীবন, ঘর-ঘাট, মাঠ-বাট, মন-মনন, আচার-আচরণ প্রভৃতির স্বরূপ কোথাও চিত্রে, কোথাও ইঙ্গিতে বিধৃত আছে। আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাষ্ট্রিক ও অর্থনীতিক ইতিহাস লিখিত হবে এসব উপাদান সম্বল করেই। আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি হিন্দু বৌদ্ধ যুগের বিরাট ইতিহাস রচিত হয়েছে এভাবে। ডা. নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙালির ইতিহাস নামক বিরাট গ্রন্থটি এরূপ আপাত নগণ্য উপাদান ভিত্তিক।
অতএব আমাদের জাতীয় গরজে এসব লোকসাহিত্যের সন্ধান, সংগ্রহ, সরক্ষণ ও গবেষণাকার্য অবিলম্বে শুরু হওয়া প্রয়োজন। নতুবা আজো যা-কিছু পল্লী-মানুষের মুখে ও স্মৃতিতে টিকে আছে, তাও আমরা হারাব। সাময়িক পত্র-পত্রিকায় যৎসামান্য বিধৃত হয়েছে, কিন্তু প্রাচুর্য ও প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্ত নগণ্য। এদিক দিয়ে ডক্টর সুশীল কুমার দের প্রবাদ সংগ্রহ ও ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্যের লোকসাহিত্যর বিশেষ অবদান।
জীবন-শিল্পী
০১.
আগুনের যেমন নিরবলম্ব কোনো অস্তিত্ব নেই, শিল্পও তেমনি জীবন-নিরপেক্ষ হতে পারে না। জীবন-চেতনাকে অবলম্বন করেই সৃজনশীলতার প্রকাশ-শিল্পের উদ্ভব।
জীবনকে যিনি ভালোবাসেন, জীবনের কোনো মুহূর্তই যার কাছে তুচ্ছ নয়, প্রতিক্ষণেই যিনি জীবনকে গভীর তাৎপর্য দিয়ে অনুভব করতে প্রয়াসী, জীবনের তুচ্ছতম কিংবা মহত্তম ক্ষণকে যিনি সমান গুরুত্বে গ্রহণ করতে সমর্থ, শিল্পী হওয়া তাঁর পক্ষেই সম্ভব। জীবন-চেতনা যার ক্ষীণ, বিচরণক্ষেত্র যার সংকীর্ণ, অভিজ্ঞতা যার সীমিত, সংবেদনশীলতা যাতে অনুপস্থিত, জীবন-শিল্পীর গৌরব তাঁর ভাগ্যে নেই।
এ যে বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞানে লভ্য নয়, তা বলে দেয়ায় অপেক্ষা রাখে না। সদাসচেতন ইন্দ্রিয়, সমীক্ষুমন, দরদভরা হৃদয় আর গুছিয়ে ও পিজিয়ে বলার কায়দা যার আয়ত্তে, শিল্পী হওয়া তাঁরই সাজে।
এসব গুণের সমন্বিত শক্তিই সৃজনশীলতা। না বললেও চলে যে নক্শা আর সাহিত্য এক বস্তু নয়। নিরবয়বকে অবয়ব দানই সাহিত্য-শিল্পের লক্ষ্য। কেননা সাহিত্য জীবনালেখ্য নয়– জীবনচেতনার উদ্ভাস মাত্র। বাহ্য আচরণ, ঘটনা কিংবা দৃশ্যের বর্ণনা মাত্রই সাহিত্য হয় না, তার সঙ্গে যুক্ত থাকবে নিরীক্ষণশীল মন, বিশ্লেষণী মনীষা, সংশ্লেষণী দৃষ্টি আর জীবনরসের রসিকচিত্ত। এতেই বর্ণিত বিষয় রূপে, লাবণ্যে, রসে ও তাৎপর্যে অপরূপ হয়ে ওঠে। শিল্পীরা আমাদেরই জীবন নিয়ে লেখেন। আমরা ভোলা চোখে বিচ্ছিন্ন আচরণ, ঘটনা ও দৃশ্য দেখি। কিন্তু পরিবেষ্টনীর গুরুত্ববোধ, কার্যকারণ সম্পর্ক-চেতনা কিংবা সামগ্রিক চেতনার অভাবে আমরা কোনো যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারিনে। তাই আমাদের চেতনায় খণ্ড কখনো অখণ্ড অবয়বে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না, পাইনে কোনো তাৎপর্য। ফলে আমাদের অবোধ চেতনার খণ্ড সবসময়েই স্বয়ংসম্পূর্ণ, আর তুচ্ছ চিরকালই অবহেলিত। কিন্তু শিল্পীর চোখে ক্ষুদ্র-বৃহৎ তুচ্ছ-উচ্চ সব এক অখণ্ড জীবনপ্রবাহের বিচিত্র প্রকাশরূপে ধরা দেয়। জীবনের সামগ্রিক রূপ প্রত্যক্ষ করা, জীবনকে বিশ্লেষণ করা, জীবনের বিচিত্র বিকাশ কিংবা প্রকাশের তাৎপর্য আবিষ্কার করা তাই শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব। যেমন একটা খাটের বিভিন্ন অংশ যদি বিভিন্ন কক্ষে রক্ষিত হয়, সেসব-যে একখানা খাটেরই অংশ তা শিশুর পক্ষে ধারণা করা শক্ত হলেও বয়স্ক লোকের পক্ষে সহজ। শিল্পী ও সাধারণ লোকের পার্থক্য এখানেই। শিল্পীর রয়েছে অখণ্ড দৃষ্টি আর অশিল্পীর আছে খণ্ড চেতনা। তাই আমাদের ঘরের কথা ও কালের খবর সাহিত্য পড়েই জানতে পাই আমরা। সুন্দর, সুস্থ ও স্বস্থ জীবনের অনুধ্যানই শিল্পীর ব্রত। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সন্ধান এবং উপলব্ধিই শিল্পীর লক্ষ্য।
ঔপন্যাসিক হচ্ছেন জীবনশিল্পী। জীবনরূপ মহাকাব্যের মহাকবি। জীবননাট্যের নাট্যকার। তাঁর দায়িত্ব অনেক। সে-দায়িত্ব পালনের যোগ্যতা থাকা চাই তার। মানুষের জীবনে বিচরণক্ষেত্র সীমিত, কিন্তু মনের সঞ্চরণ-পথ ঋজু নয়। সেই বিচিত্রগামী সদাচঞ্চল তুরঙ্গ-গতি মনের দিশা পাওয়া সাধনা-সাধ্য বিষয়। একে অনুসরণ করার নৈপুণ্য অর্জন করতে হলে বিচিত্র প্রতিবেশে, বিভিন্ন অবস্থায় নানা মানুষের আচরণের, নানা ঘটনার ও অনেক ঘনিষ্ঠ হৃদয়ের উষ্ণ স্পর্শের অভিজ্ঞতা আবশ্যক। আমাদের দেশেও তেমনি শিল্পী একেবারে দুর্লভ নয়। যদিও বেদনার সঙ্গেই বলতে হয় সাধারণভাবে আমাদের উপন্যাসশাখা দুর্বল। এর দৈন্য গুহায়িত নয়। আমাদের অনেক ঔপন্যাসিকের শিল্পীসুলভ দৃষ্টি আছে কিন্তু তাঁদের প্রায় সৃষ্টিই অসম্পূর্ণ। উপন্যাসে পাঠক বিস্তৃত পরিসরে বিচিত্র পরিবেশে, সংঘাতময় জটিল জীবনালেখ্য আশা করে। সর্পিল জীবনধারায় সমাজ প্রতিবেশে জীবনের বৃত্তি-প্রবৃত্তির প্রকাশ, বিকাশ, বিবর্তন ও রূপান্তর প্রত্যক্ষ করার আগ্রহ রাখে পাঠক, আর চায় লোভ-ক্ষোভ, প্রেম-ঈর্ষা, বিরোধ-মিলন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, সুখ-শান্তি, আনন্দ-আরাম, দুঃখ-শোক আর হার-জিৎ আকীর্ণ বন্ধুর জীবনে বিচিত্রগামী মন-মানসের অঋজু পরিক্রমণ-চিত্র। কেননা মানুষ একাও নয়, স্বাধীনও নয়। তার আছে দেশ, কাল, সমাজ, ধর্ম, আইন-কানুন, বিশ্বাস সংস্কার, ভয়-শঙ্কা, আশা-নৈরাশ্য, আদর্শ ও লক্ষ্য। তার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে এসবের হাজারো বাঁধন। ভোলা চোখে জীবনের খণ্ডরূপই দৃশ্যমান। তাই তা নিতান্ত সরল, তার রূপ এক। এজন্যেই সে জীবনের বর্ণালি অথচ অখণ্ড আলেখ্য দেখতে চায় শিল্পীর তুলিতে। আমাদের নামকরা ভালো উপন্যাসেও এ গুণ দুর্লক্ষ্য। এমনকি দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, আমাদের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোও আঙ্গিকে আর বহরে বড় গল্পের ঊর্ধ্বে ওঠেনি। মানুষের আচরণ, ঘটনা কিংবা দৃশ্য দেখা যায়, কিন্তু তার অন্তনিহিত কার্যকারণ ধরে দেয়াই শিল্পীর কাজ।
এজন্যে প্রয়োজন গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও মনোবিশ্লেষণে দক্ষতা। ব্যক্তিক আচরণ কিংবা বাহ্যঘটনা মনুষ্য হৃদয়ে কী ক্রিয়া-প্রক্রিয়া সৃষ্টি করে বৃত্তি-প্রবৃত্তিকে কীভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করে তার স্বরূপ জানার আগ্রহ নিয়েই পাঠক বই খোলে। পাঠকের এ সাধ যে-উপন্যাস মেটাতে অসমর্থ, ব্যর্থ রচনা বলেই মানতে হবে তাকে।
পূর্ব পাকিস্তানে সার্থক উপন্যাস প্রায় নেই–এমন অনুযোগ আমাদের অজানা নয়। কিন্তু লেখকের পক্ষেও বক্তব্য রয়েছে। এ যুগে প্রতীচ্য প্রভাবে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য চেতনা বেড়েছে, কিন্তু সে অনুপাতে আর্থিক সাচ্ছল্য আসেনি। গার্হস্থ্যজীবনে নানা অভাবের টানাপড়েন-সমস্যায় মধ্যবিত্ত বা বিত্তহীনের জীবন বিপর্যস্ত। বলা বাহুল্য, লেখকরা এ শ্ৰেণীরই লোক। তাদের কেউ কেউ লেখাকেই পেশা হিসেবে বরণ করেছেন, আবার কেউ কেউ চাকুরিজীবী হলেও বেতন বেশি নয়। তাই এসব ছা-পোষা লেখক প্রাণের প্রেরণা না পেয়েও প্রকাশকের আহবানে সাড়া দিতে বাধ্য হন। ফলে সিনেমার কাগজের এবং পুস্তক প্রকাশকের ফরমায়েশি তাড়নায় রচিত উপন্যাস পড়ে পাঠক-মন তৃপ্তি পায় না। আর ফরমায়েশি হয়েও মহৎ-সাহিত্য হবে সৃষ্টির তেমন দুর্লভক্ষণ সবসময় মেলে না। এ যুগে পাঠক অসংখ্য, প্রকাশকও অনেক। সে তুলনায় লেখক কম। তাই লেখকরা আজকাল রোজগারের সুযোগ পাচ্ছেন, দরিদ্রের পক্ষে সে সুযোগ ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে প্রকাশকের কাছে লেখকদের কদর বাড়ছে, গ্রন্থের সংখ্যাও বাড়ছে। প্রচ্ছদ-শিল্পের উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু লেখার মান যাচ্ছে নেমে, পাঠকের ক্ষোভও হচ্ছে তীব্র। লেখক ও পাঠকের এ দুর্ভাগ্যের কথা নাহয় না-ই বললাম, কিন্তু দেশ ও সাহিত্যের এ ক্ষতি গুরুতর।
মুদ্রাস্ফীতির কুফল কবলিত আজকের দিনে লেখকদের শিল্প-সাধনায় অনন্য-নিষ্ঠ রাখতে হলে তাদেরকে প্রতুল না হোক–প্রচুর সম্পদের অধিকার দিতে হবে।
.
০২.
জীবনে যখন জাগরণ আসে, তখন মানুষ উন্মুক্ত হয়ে উঠে আত্মপ্রসারে। তখন তাজা প্রাণ ঘিরে থাকে সৃষ্টিসুখের উল্লাস। তখন সে হয় সৃজনশীল, চারদিকে কেবল নিজেকে রচনা করাই তার কাজ। সুন্দর করে বয়ন, শোভন করে রচন, আর কল্যাণমুখী সৃজন তার লক্ষ্য।
তাই প্রগতি কিংবা অগ্রগতি আসলে মনেরই চিন্তা-ভাবনার ফসল। আকাঙ্ক্ষা-প্রবল সুস্থ ও স্বস্থ মনের স্বভাবধর্মই হচ্ছে এগিয়ে যাওয়া। অগ্রগতির জন্যে চাই মনের ঘাহিকা শক্তি ও উচ্চাভিলাষ। সেক্ষেত্রে জ্ঞান তার সহায় আর আত্মবিশ্বাস তার অবলম্বন। এতেই মেলে সৃজনশীলতা। নতুনের অনুভবে, সুন্দরের অনুধ্যানে এবং মনোজীবনে আর ব্যবহারিক জীবনের ক্ষেত্রে বিচিত্র উদ্ভাবনায় মেলে তার পরিচয়। স্বাধীনতা লাভের পর আমরা দেখতে পাচ্ছি অন্তজীবনের বিকাশ এবং ব্যবহারিক জীবনের উন্নয়ন। শিল্পে-বাণিজ্যে, শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে, সাহিত্যে-স্থাপত্যে সর্বত্রই অনুভব করছি নতুন জীবনের বিকাশোনুখ প্রাণের সাড়া। দেহ-মন আত্মার মুক্তি না ঘটলে এমনি এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ আসে না।
সাহিত্যই হচ্ছে জাতীয় জীবনের অগ্রগতির শ্রেষ্ঠ পরিমাপক। কেননা, সাহিত্যেই ঘটে মন মানসের অন্তরঙ্গ ও সুন্দরতম প্রকাশ। ব্যক্তি ও জাতিকে চেনা যায় তার সাহিত্য পড়েই। এ অর্থেই সাহিত্য জাতীয় জীবনের মুকুর ও প্রতিভূ।
আমাদের জাতীয় সাহিত্যে অগ্রগতির পরিচয় নিলে বোঝা যাবে আমাদের কতখানি ঘটেছে মনের মুক্তি, কতখানি সুস্থ ও সুস্থ আমাদের চিত্তলোক আর কীভাবে এবং কোনো পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা-বিশেষ করে তরুণের দৃষ্টিতে তার সামগ্রিক রূপটি কীভাবে ধরা পড়ছে মিলবে তারও আভাস।
দোভাষী পুথির ভাষা
০১.
ছাপাখানা প্রবর্তিত হবার পূর্বেকার হস্তলিখিত পুস্তকমাত্রেই পুথি নামে পরিচিত ছিল। পুথি শব্দ সংস্কৃত পুস্তিকা শব্দজাত। কাজেই পুথি বলতে প্রাচীন অমুদ্রিত গ্রন্থাবলীকেই বোঝানো উচিত। কিন্তু অধুনা কেউ কেউ আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা-হিন্দুস্তানী মিশ্রিত ভাষায় রচিত দোভাষী (দ্বিভাষী) কাব্যগুলোকেই বিশেষ অর্থে পুথি নামে অভিহিত করেন। সেজন্যে আমরাও পুথি সাহিত্য অর্থে দোভাষী পুথিই বুঝব।
দোভাষী পুথির ভাষা সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে একটু ভূমিকা প্রয়োজন। আর্য-পূর্ব যুগে বাঙলা দেশে বিভিন্ন গোত্রের যে-সব লোক বাস করত, তাদের স্ব স্ব ভাষা ছিল বা সর্বজনীন একটি মিশ্রভাষায় (অস্টিক-দ্রাবিড়-মোঙ্গল ও অন্যান্য অনার্য ভাষার মিশ্রণজাত) তারা কথা বলত–এটা আমরা অনুমান করতে পারি। কারণ খ্রীস্টীয় আট শতকে রচিত আমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প নামক সংস্কৃত গ্রন্থে উল্লেখ আছে, অসুরানাং ভবেৎ বাঁচা গৌড় পুড্রোদভবা সদা।–অসুরেরা গৌড় ও পুণ্ড্রবর্ধন জাত ভাষা ব্যবহার করে।
বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম নিয়ে যখন ধর্মপ্রচারক ও শাসক হিসেবে মুখ্যত আর্য সংস্কৃতিবাহী ও আর্যভাষা (প্রাকৃত)-ভাষী একদল লোক বাঙলা দেশে তাদের প্রভাব বিস্তার করলেন, তখন এদেশীয় প্রাচীন অধিবাসীরা অপেক্ষাকৃত উন্নত আর্যধর্ম, দর্শন, ভাষা ও সংস্কৃতি বিনাদ্বিধায় গ্রহণ করে নিল, এও আমরা অনুমান করতে পারি। কারণ, সবল ও উন্নত শাসকজাতির কাছে দুর্বল, বিজিত ও শাসিত জাতির সংস্কৃতির পরাজয় ও বশ্যতা চিরকালীন ঐতিহাসিক সত্য ব্যাপার।
বাঙলা দেশে যে-আর্যভাষা প্রথম প্রবেশ করেছিল তা বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষা নয়–বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বাণীবাহক পালি বা প্রাকৃত। ভারতের নানাস্থানে যূরোপীয়দের হাতে দীক্ষিত ভারতীয়গণ যেমন ইংরেজিকে তাদের নিজেদের ভাষারূপে গ্রহণ করে; বাঙালিরাও তেমনি পালি প্রাকৃতকে মাতৃভাষারূপে বরণ করে। কারণ, তাদের নিজেদের কোনো লিখিত ভাষা ও সাহিত্য ছিল বলে কোনো প্রমাণ মেলে না। এখনো কোল, মুণ্ডা, কুকী ও নাগাদের কোনো বর্ণমালা বা লিখিত ভাষা নেই। কাজেই বাঙালিরা পালি-প্রাকৃতকেই গ্রহণ করে বলে বিশ্বাস করা চলে। সংস্কৃতের সঙ্গে তাদের পরিচয় হতে পারেনি।
উক্ত পালি-প্রাকৃত ভাষায় তাদের নিজেদের ভাষার যেসব শব্দের প্রতিশব্দ পাওয়া যায়নি, অথবা পালি-প্রাকৃতের যেসব শব্দ তাদের কাছে শ্রুতিসুখকর বা প্রয়োজনীয় ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ বলে মনে হয়নি, সেসব ক্ষেত্রে তারা নিজেদের শব্দসম্পদ বর্জন করেনি। ফলে আজো বাঙলা ভাষায় আমরা বহু দেশী তথা অপ্রাকৃত শব্দ পাচ্ছি। কালক্রমে যে আরো বহু শব্দ লুপ্ত হয়ে গেছে, তাতে সন্দেহ নেই।
তারপর বিদেশী মৌর্য ও গুপ্ত শাসনকালে এবং পাল রাজাদের আমলে কিছু কিছু সংস্কৃত শব্দ আমদানি হয়ে বাঙালির ভাষায় স্থায়ীভাবে ঠাই পেল। এরপর ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন রাজাদের আমলে এদেশে ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চার ধুম পড়ে গেল। সে সময় সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বাঙালির উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বাঙালির ভাষা সংস্কৃত শব্দসম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে উঠে।
এরপর আসেন মুসলমান ধর্মপ্রচারক ও শাসকগণ। এসময় অনিবার্য কারণে বহু ফারসি, তুর্কী ও আরবি শব্দ ভাষায় স্থায়ী আসন লাভ করে।
এ পর্যন্ত সাহিত্য সৃষ্টির কাজ চলেছে পদ্যে। পদ্য আর গদ্য ভাষায় পার্থক্য বিস্তর। পদ্যে অল্পকথায় স্বল্প শব্দে ও অস্পষ্ট অন্বয়ে কাজ চলে, কিন্তু গদ্যের বাঁধন শ্লথ হলে চলে না। এজন্যে আমরা মুসলমান আমলের দলিল-দস্তাবিজে, চিঠিপত্রে আরবি-ফারসি শব্দমিশ্রিত বাঙলাগদ্যের সাক্ষাৎ পাই। কারণ তখনো গদ্যে সাহিত্যসৃষ্টির প্রচেষ্টা চালু না হওয়ায়, বাঙলা ভাষায় গদ্য সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস কেউ করেনি। আর এ-কথা কে না স্বীকার করবে যে, সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াস ছাড়া কোনো ভাষাই মার্জিত ও শালীন হয়ে উঠতে পারে না। কেননা মুখের বুলি চিরকাল অপূর্ণ ও ত্রুটিবহুল, তাকে লিপিবদ্ধ করতে হলে অনেককিছু যোগ করতে হয়–অনেক পরিশোধনের প্রয়োজন। কারণ শিক্ষিত ও ভাবুক লোকের ভাব-চিন্তা প্রকাশের জন্যে অনেক বেশি শব্দের প্রয়োজন যা মননহীন অশিক্ষিত লোকের ঘরোয়া বা ব্যবহারিক জীবনে কাজে আসে না। এজন্যেই ভাবুক, পণ্ডিত আর মূর্খ-লোকের ভাষায় পার্থক্য থাকে–একটা ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ, অপরটা বাক্যার্থ সর্বস্ব। এ কারণেই চর্যাচর্যবিনিশ্চয়ের পরেও আমরা প্রয়োজনের তাগিদে বহু সংস্কৃত শব্দ অবচেতনভাবে বাঙলা-ভাষায় ব্যবহার করেছি। চর্যাপদের পর থেকে ভারতচন্দ্র বা তৎপরবর্তীকাল পর্যন্ত মধ্যযুগীয় ধারার বাঙলাসাহিত্য সর্বাঙ্গে বহন করছে তার প্রমাণ।
এ পর্যন্ত ক্বচিৎ সংস্কৃত-মিশ্রিত ভাষায় কাব্য রচনা করা সম্ভব ছিল, কিন্তু বাঙালি চিরকাল গদ্যভাষায় কথা বললেও গদ্য রচনা করতে গিয়ে দেখা গেল, শব্দসম্পদের প্রচুর অভাব রয়েছে। আরো রয়েছে শব্দের পারস্পরিক অন্বয়সাধক প্রত্যয় ও বিভক্তির অপ্রতুলতা। তাই য়ুরোপীয় মিশনারি ও বাঙালি পণ্ডিতগণ যখন ধর্মপ্রচারে, শাসনকার্যে ও ব্যবহারিক প্রয়োজনে বাঙলা গদ্য সৃষ্টির তাগিদ অনুভব করলেন, তখন এ দুটো সমস্যা তাদের কাছে দেখা দেয় তীব্রভাবে।
এখানে বিশেষভাবে স্মরণীয় যে, দুনিয়ার কোনো লিখিতভাষা তথা সাহিত্যের ভাষা অকৃত্রিম নয়। বাঙলা পদ্যের ভাষাও অকৃত্রিম ছিল না; অর্থাৎ সাহিত্যের ভাষায় তথা লিখিত ভাষায় কোনো কালে, কোনো দেশে কেউ ঘরোয়া কথা বলেনি।
আমাদের যে-চলিতভাষা বা কথ্যভাষায় সাহিত্য রচিত হয়, তাও কী অকৃত্রিম? কাজেই নিতান্ত প্রয়োজনে বাঙলায় কৃত্রিম গদ্য সৃষ্টি হল সাধুভাষা নামে।
বাঙলা গদ্য সৃষ্টি করতে গিয়ে কেউ আরবি-ফারসি বা ইংরেজি ভাষার সাহায্য নেবে তা ভাবা অস্বাভাবিক নিশ্চয়ই। তাই কেরী-রামমোহন-মৃত্যুঞ্জয়-বিদ্যাসাগর-মধুসূদন প্রভৃতি সবাই সংস্কৃতের আশ্রয় নিলেন। প্রাকৃতজাত বাঙলাকে জ্ঞাতিত্ব সূত্রে তার প্র-প্র-প্রমাতামহী সংস্কৃতের উত্তরাধিকারিণী দাঁড় করিয়ে তারা বাঙলা ব্যাকরণ ও শব্দসম্পদ সংস্কৃতানুগ করে তুললেন। এছাড়া ব্যবসাদারী ও অনভিজ্ঞ নূতন লেখকদের উপায়ই বা কী ছিল! বরং এরূপ না করে অন্য কোন পন্থা গ্রহণ করলে অস্বাভাবিক হত। বস্তুত সে-যুগে সে-অবস্থায় সংস্কৃতের সাহায্য না নিয়ে বাঙলা গদ্যকে একটা সুষ্ঠু ও শালীন রূপদান করা ছিল অসম্ভব। সে-যুগের কথাই বা বলি কেন, এ-যুগে আমাদের সাহিত্যে ব্যবহৃত চলতি ভাষায়ও কী সংস্কৃত শব্দ বাদ দেওয়া সম্ভব হয়েছে? এ ব্যাপারে আমরা উড়িয়া ও আসামী ভাষার দিকে লক্ষ্য করলেও বুঝতে পারব, সংস্কৃত শব্দ আমদানি কেরী মৃত্যুঞ্জয়-বিদ্যাসাগরের স্বেচ্ছাচারিতার ফল নয়! ভাষাকে সাবলীল করার জন্যে অপরিহার্য ছিল সংস্কৃত ভাষার সাহায্য। অনাত্মীয় আরবি-ফারসি-ইংরেজির চেয়ে রক্তসম্পর্কিত সংস্কৃতির সম্পদ আত্মস্থ করা যে সহজ ও শোভন হয়েছে তা কে অস্বীকার করতে পারে? এখানে স্মরণীয় যে, বাঙলা ভাষার আদিকাল থেকেই আমাদের পদ্যরচনায় প্রয়োজনমতো সংস্কৃত শব্দ গৃহীত হয়েছে। আজকের দিনে ইংরেজি শব্দের পরিভাষাও সংগৃহীত হচ্ছে সংস্কৃত থেকেই।
কিন্তু সংস্কৃত শব্দের প্রয়োগ আর সংস্কৃত রীতির আমদানি যে এক কথা নয়, তা প্রথমদিককার লেখকগণ সহজে বুঝে উঠতে পারেননি। আমি Daily morning walk করি এতে অধিকাংশ শব্দ ইংরেজি হলেও এ বাঙলা; Daily he walks in the প্রভাত বাংলা মিশ্রিত হলেও যে ইংরেজি তা কোনো শিক্ষিতলোককে বুঝিয়ে বলতে হয় না।
তাই ইংরেজদের প্রয়োজনে ফরমায়েশি গদ্য রচনা করতে গিয়ে পণ্ডিতগণ সংস্কৃত অভিধান ঘেঁটে শব্দ বের করে সংস্কৃত ব্যাকরণানুগ যে-গদ্য সৃষ্টি করলেন, তা সেকালের বাঙালি জনসাধারণও হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ গৌড়ীয় ভাষাতে অভিনব যুবক সাহেব-জাতের শিক্ষার্থে কোনো পণ্ডিত (মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার) প্রবোধচন্দ্রিকা নামে যে গ্রন্থ রচিতে ছিলেন তাঁর ভাষা এবং সংস্কৃত সম্বন্ধে তাঁর ধারণা নিম্নরূপ :
‘অস্মদাদির ভাষার যুগপৎ বৈখরী রূপতামাত্র প্রতীতি সে উচ্চারণ ক্রিয়ার অতি শীঘ্রতা প্রযুক্ত উপর্বধোভাবাস্তিত কোমলতর-বহুল-কমলদল সূচীবেধন ক্রিয়ার মত এতদ্রূপে প্রবর্তমান সকল ভাষা হইতে সংস্কৃত ভাষা উত্তমা, বহুবর্ণময়ত্ব প্রযুক্ত একদ্ব্যক্ষর পশুপক্ষি ভাষা হইতে বহুত-রাক্ষর মনুষ্য ভাষার মত ইত্যনুমানে সংস্কৃত ভাষা সর্বোত্তমা ইহা নিশ্চয় …’।
কিন্তু আশ্চর্য যে, এমন ওকালতির পরেও স্বয়ং মৃত্যুঞ্জয়ও এ ভাষায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তার প্রমাণ পাচ্ছি তাঁরই অন্য রচনায় :
‘মোরা চাষ করিব, ফসল পাবো রাজার রাজস্ব দিয়া যা থাকে তাহাতেই বছর শুদ্ধ অন্ন করিয়া খাব, ছেলে পিলাগুলিন পুষিব। যে বছর শুকা হাজাতে কিছু খন্দ না হয়, সে বছর বড় দুঃখে দিন কাটি, কেবল উড়ি ধানের মুড়ি ও মটর মসুর শাকপাতা শামুকগুলি সিজাইয়া খাইয়া বাঁচি। …. এ দুঃখেও দুরন্ত রাজা, হাজা শুকা হইলেও আপন রাজস্বের কড়াগণ্ডা ক্রান্তি বট ধূল ছাড়ে না। এক আধ দিন আগে পিছে সহে না, যদ্যাপিস্যাৎ কখন হয়, তবে তার সুদ দাম বুঝিয়া লয়, কড়াকপর্দকও ছাড়ে না। যদি দিবার ক্ষেতে না হয়, তবে সোনা মোড়ল পাটোয়ারি ইজারাদার তালুকদার জমীদারেরা পাইকপেয়াদা পাঠাইয়া হাল যেয়াল ফাল হালিয়াবলদ দামড়াগরু বাছুর বকনা কাঁথা পাথর চুপড়ী কুলা ধুচুনী পর্যন্ত বেচিয়া গোবাড়ীয়া করিয়া পিটিয়া সর্বস্ব লয়। মহাজনের দশগুণ সুদ দিয়াও মূল আদায় করিতে পারিনা। কত বা সাধ্য সাধনা করি–হ্যাঁতে ধরি, পায়ে পড়ি, হাত জুড়ি, দাঁতে কুটা করি। হে ঈশ্বর দুঃখির উপরেই দুঃখ। ওরে পোড়া বিধাতা আমাদের কপালে এত দুঃখ লিখিস। তোর কী ভাতের পাতে আমরা ছাই দিয়াছি?’
শুধু বিদ্যালঙ্কারই নন; রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কালীপ্রসন্ন সিংহ, প্যারীচাঁদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি সবাই বাঙলা গদ্যকে স্বাভাবিক ও শালীন করে তুলবার চেষ্টা করেছেন।
রাজা রামমোহন রায় যথার্থই বুঝেছিলেন-প্রথমতঃ বাঙলা ভাষাতে আবশ্যক গৃহব্যাপারের নির্বাহযোগ্য কেবল কতকগুলি শব্দ আছে। এ ভাষা সংস্কৃতের যেরূপ অধীন হয়, তাহা অন্য ভাষার ব্যাখ্যা ইহাতে করিবার সময় স্পষ্ট হইয়া থাকে। দ্বিতীয়তঃ এ ভাষার গদ্যতে অদ্যাপি কোনো শাস্ত্র কিংবা কাব্য বর্ণনে আইসে না। ইহাতে এতদ্দেশীয় অনেক লোক অনভ্যাস প্রযুক্ত দুই তিন বাক্যের Sentence গদ্য হইতে অর্থবোধ করিতে পারেন না, ইহা প্রত্যক্ষ কানুনের তরজমার অর্থবোধের সময় অনুভব হয়। (বেদান্তগ্রন্থের অনুষ্ঠান প্রকরণ)।
ভিন্ন ভিন্ন দেশীয় শব্দের বর্ণগত নিয়ম ও বৈলক্ষণ্যের প্রণালী ও অন্বয়ের রীতি যে গ্রন্থের অভিধেয় হয়, তাহাকে সেই সেই দেশীয় ভাষার ব্যাকরণ কহা যায়। (বাঙলা ব্যাকরণ)
অতএব রামমোহন এ ভাষা সংস্কৃতের যেরূপ অধীন হয় অর্থে সংস্কৃত অভিধানের অধীনতার কথা বলেছেন, ব্যাকরণের নয়। সুতরাং তিনি বাঙলা ও সংস্কৃত ভাষার প্রকৃতিগত পার্থক্য স্বীকার করেছিলেন। তার ব্যাকরণের অপর দুটো উদ্ধৃতি থেকে আমাদের সিদ্ধান্তের সমর্থন পাওয়া যাবে : ১. সংস্কৃত সন্ধি প্রকরণ ভাষায় উপস্থিত করিলে তাবৎ গুণদায়ক না হইয়া বরঞ্চ আক্ষেপের কারণ হয়। ২. এরূপ (দীর্ঘ সমাসবদ্ধ) পদ গৌড়ীয় ভাষাতে বাহুল্য মতে ব্যবহারে আসে না। এমনকি, অত্যধিক সংস্কৃত শব্দের ব্যবহারকেও সংস্কৃত রীতির অনুসরণ বলে আখ্যাত করা চলে না। কারণ সংস্কৃত ভাষায় শব্দ বিচ্ছিন্নভাবে ব্যবহৃত হয় না, সন্ধি ও দীর্ঘ সমাসবদ্ধ হয়েই পদ্যে ও গদ্যে ব্যবহৃত হয়। বাঙলায় দুয়ের অধিক শব্দে সন্ধি বা সমাস সাধারণত হয় না। সুতরাং বাঙলাকে সংস্কৃত শব্দে ভারাক্রান্ত করা চলে কিন্তু সংস্কৃত বাক্যরীতির অনুগত করা সম্ভব নয়।
এসব দেখেশুনেই রামমোহন তাঁর রচনাবলীতে, মৃত্যুঞ্জয় তার প্রবোধচন্দ্রিকার কোনো কোনো কুসুমে, কালীপ্রসন্নসিংহ হুতোম প্যাচার নকসায়, বিদ্যাসাগর বেতাল পঞ্চবিংশতিতে, প্যারীচাঁদ আলালের ঘরের দুলালে, বঙ্কিমচন্দ্র সীতারামে বাঙলা গদ্যের একটা বিশিষ্টরূপ দানের প্রয়াস পেয়েছেন।
ইতিপূর্বেও সহজিয়াদের জ্ঞানাদি সাধনা, গোলক শর্মার হিতোপদেশ, কেরীর ইতিহাসমালা, গৌরীকান্তের কামিনী কুমার, রজীব লোচনের কৃষ্ণচন্দ্র চরিত, প্রমথ নাথ শর্মার নব বাবুবিলাস, ও নববিবি বিলাস, বৃটিশ মিউজিয়ামে প্রাপ্ত রূপকথা, (ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক আবিষ্কৃত), রামরাম বসুর প্রতাপাদিত্য চরিত, তারিণীচরণ মিত্রের ঈসপের গল্পাবলী, চণ্ডীচরণ মুন্সীর তোতা ইতিহাস, হরপ্রসাদ রায়ের পুরুষ পরীক্ষা, রামকিশোর তর্কালঙ্কারের হিতোপদেশ, ভবানীচরণের কলিকাতা কমলালয় প্রভৃতি গ্রন্থে ও মার্সম্যান, জোন্স, ভরস্টার উইলকিন্স প্রমুখ সাহেবদের ভাষায় সংস্কৃতানুগত্যের নিদর্শন দুর্লক্ষ্য। ইতিপূর্বেকার চিঠিপত্র ও দলিল দস্তাবিজের ভাষায় ব্যতীত এ সময়কার সাহিত্যিক রচনায় আরবি-ফারসি শব্দের বাহুল্যও দৃষ্টিগোচর হয় না। শুধু প্রতাপাদিত্য চরিতে মাত্রাতিরিক্ত আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কেরী প্রভৃতি ধর্মপ্রচারের জন্যে ও রাষ্ট্রীয় কারণে জনসাধারণের সহজবোধ্য রীতির যে পক্ষপাতী ছিলেন, সে-যুগের ইতিহাস তারও ইঙ্গিত দিচ্ছে। অতএব, সংস্কৃতানুরাগী পণ্ডিতগণের সৃষ্ট ভাষা বাঙলাদেশে স্থায়ী হয়নি।
এ পর্যন্ত যা বললাম তাতে বোঝা যাবে বাঙলাভাষার গদ্যে ও পদ্যে একটা নিজস্ব রীতি বা শৈলী ছিল। তাতে মাত্র দুবার বিপর্যয় আসে–একবার দোভাষী রীতির প্রচলনে, আর একবার সংস্কৃত ব্যাকরণানুগ গদ্য রচনার ফলে। সৌভাগ্যবশত কোনোটাই স্থায়ী হয়নি।
প্রাগুক্ত গ্রন্থসমূহের ভাষায় গ্রাম্যতাদুষ্ট (Slang) শব্দ আর কিছু আরবি-ফারসি শব্দও রয়েছে, কিন্তু সমাসবদ্ধ সংস্কৃত শব্দ নেই। অপরিহার্য রূপে কয়েক হাজার আরবি-ফারসি শব্দ বাঙলাভাষায় চালু আছে। আরো দু-দশটা শব্দ হয়তো আসবে কিন্তু তা প্রয়োজনের তাগিদে স্বাভাবিকভাবেই আসবে, জোর করে চালু করলে চলবে না।
বিদেশাগত মুসলমান শাসকগোষ্ঠী ঘরে তুর্কী, দপ্তরে ফারসি, মসজিদে আরবি এবং সামাজিক ব্যবহারে আরবি-তুকী-ফারসি মিশ্রিত হিন্দুস্তানী ভাষা ব্যবহার করতেন। তাই মুসলমান আমলে যেমন ব্যবহারিক ও দরবারি জীবনে আরবি-ফারসি-তুর্কী শব্দ ঘরোয়া ও পোশাকি কথায় প্রতিশব্দ বা পরিভাষার অভাবে অপরিহার্যরূপে ব্যবহৃত হয়েছে, ইংরেজ আমলেও তেমনি আমাদের কথাবার্তায় অসংখ্য ইংরেজি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, এবং ক্রমে ক্রমে পরিভাষা সৃষ্টি করে বা সংস্কৃত থেকে শব্দ সগ্রহ করে আমরা ইংরেজি শব্দের ব্যবহার সংকুচিত করেছি, অন্তত সাহিত্যের ভাষায় আমরা পারতপক্ষে ইংরেজি ব্যবহার করিনে। হাসপাতালে Admission নেওয়া, স্কুল-কলেজে পড়া, Examine দেওয়া, পাস করা, Refer করা, Report বা Return দেওয়া, Graduate হওয়া point বলা, Suggestion নেওয়া প্রভৃতি আজো শিক্ষিত বাঙালির ঘরোয়া কথাবার্তার ও চিঠিপত্রের ভাষার অপরিহার্য অঙ্গ। কিন্তু সাহিত্যে এদের যে-পরিভাষা গ্রহণ করেছি, তার একটাও বাঙলা বা দেশী শব্দ নয়–সবগুলোই সংস্কৃত। যেমন ভর্তি, পরীক্ষা, স্নাতক, প্রবেশিকা, উত্তীর্ণ, বিশ্লেষণ, সমীক্ষণ, পর্যবেক্ষণ প্রভৃতি। এমনকি আরবি-ফারসি ভাষার ঐতিহ্যবাহী মুসলমানদের সৃষ্ট পরিভাষাও আরবি-ফারসি নয়, বরং সংস্কৃত। এখন যেমন অসাহিত্যিক বাঙালি জনসাধারণ কথাবার্তায় ও চিঠিপত্রে প্রায় প্রতি বাক্যে দু-একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে, তেমনি পূর্বে এরূপক্ষেত্রে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করা হত। এখনকার যুগের জনসাধারণের কথাবার্তার বা চিঠিপত্রের ভাষা যেমন সাহিত্যে স্থান পায়নি, তেমনি তখনকার যুগেও মিশ্রভাষাও সাহিত্যে স্থান করে নিতে পারেনি, তার প্রমাণ আমাদের সেকালীন পদ্যসাহিত্য। যে-সব আরবি-ফারসি বা ইংরেজি শব্দের প্রতিশব্দ বাঙলা-সংস্কৃতে পাওয়া যায়নি অথবা পরিভাষা সৃষ্টি সম্ভব হয়নি সেগুলো এখনও আমাদের সাহিত্যের ভাষায় চালু রয়েছে এবং খুব সম্ভব থাকবেও।
সুতরাং চিঠিপত্র বা দলিল-দস্তাবিজের অসাহিত্যিক ভাষার দ্বারা কোনো ভাষার গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করতে যাওয়া অসমীচীন। অতএব কেরী-বিদ্যাসাগরী প্রচেষ্টার পূর্বে বাঙলা সাহিত্যের ভাষা আরবি-ফারসি মিশ্রিত হবার প্রবণতা লাভ করেছিল বলে যারা মনে করেন, তাঁদের ধারণা তথ্যভিত্তিক নয়। এ যুগে কেউ বলে যে বাঙলা ভাষা ইংরেজি শব্দের দ্বারা পুষ্ট ও সুষ্ঠু হবার প্রবণতা দেখাচ্ছে, তা যেমন ভুল, পূর্ব-ধারণায়ও রয়েছে তেমনি ধরনের অসঙ্গতি। বস্তুত বিদেশী বিভাষার শব্দ গ্রহণ যে-কোনো ভাষার দীনতারই পরিচায়ক। সগোত্রীয় সংস্কৃতের ঋণ স্বীকার করে বাঙলা সে-দীনতা ঘুচিয়েছে; কাজেই বিদেশী শব্দে তার প্রয়োজন সামান্য।
.
০২.
এবার আঠারো শতকের শেষার্ধে আমাদের জাতীয় অধঃপতন যুগে উর্দু-বাঙলা মিশ্র শৈলীতে রচিত দোভাষী পুথি সম্বন্ধে আমাদের অনুসন্ধান-লব্ধ ধারণা পেশ করে আমাদের আলোচনা শেষ করব।
নবাব সরফরাজ খান রাজ্যশাসনে উদাসীন ছিলেন। তার শাসন-শৈথিল্যের সুযোগে রাজ্যের প্রধানগণ উচ্ছল, লোভী ও আত্মপরায়ণ হয়ে উঠে। খলশ্রেষ্ঠ জগৎ শেঠের নেতৃত্বে স্বার্থপর অমাত্যগণ উড়িষ্যার নায়েব-সুবাদার আলীবর্দী খাঁকে বসালেন বাঙলার মসনদে। এদের সহায়তায় নবাবী লাভ হল বলে তিনি এঁদের মন যুগিয়ে চলতেন। ফলত এসব স্বার্থপর, উচ্ছল অত্যাচারী সামন্তগণই ছিলেন প্রকৃতপক্ষে রাজ্যের ভাগ্যনিয়ন্তা। তদুপরি বর্গীয় উৎপাত তো ছিলই। শাসক যেখানে দুর্বল, শাসিতগণ সেখানে যথেচ্ছাচারী হবেই। সিরাজদ্দৌলা আমীরদের মন ও মান রক্ষা করে চলতে জানলেন না বা পারলেন না। কাজেই পলাশীতে অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয় ঘটল।
মানুষ চিরকাল আদর্শপ্রবণ ও পরানুকারী। ধনে-জনে-মানে যারা প্রধান, জনজীবনে তাদের আচার-আচরণই অনুকৃত হয়। ফলে এ সময় দেশব্যাপী স্বার্থপরতা, নীতিহীনতা এবং ভোগ ও নগ্ন লালসার স্রোত বয়ে চলেছিল। এ কদর্যতার স্রোত অবশ্যম্ভাবীরূপে প্রবেশ করেছিল সাহিত্যেও। এজন্যেই তারল্য, কৃত্রিমতা, বর্ণনায় নির্জীবতা–অলঙ্কারের ঘটা ও ছন্দের বহু বিচিত্র সম্ভার সত্ত্বেও ভারতচন্দ্রের রচনাকে করেছে কলঙ্কিত। ভারতচন্দ্রের পরে বাংলার রাষ্ট্রিক, নৈতিক ও সামাজিক অবস্থা আরো খারাপ–আরো ক্লেদাক্ত হয়ে উঠেছিল, সে-প্রমাণ শুধু ইতিহাস থেকেই নয়, সাহিত্য থেকেও পাচ্ছি। আঠারো শতকের এই শাসনতান্ত্রিক শৈথিল্যের, রাষ্ট্রিক ভাগ্য-বিপর্যয়ের এবং নীতি-নিষ্ঠাহীন বাঙালির অবনতি-প্রবণ সমাজের বিকৃতির অভিব্যক্তি স্বরূপ আমরা হিন্দু রচিত কবি গান, পীর পাঁচালী এবং মুসলমান রচিত দোভাষী পুথিগুলো পাচ্ছি। হিন্দুকবি রচিত পীর পাঁচালীর অনেকগুলোই দোভাষী পুথির অন্তর্গত। নির্বীর্য বাঙালির সামাজিক রুচিবিকৃতি ও নৈতিক অধঃপতনের দিনে মানসিক বিপর্যয় ও সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের সুযোগে নতুন বন্দর কলকাতা এবং পুরোনো শহর মুর্শিদাবাদকে কেন্দ্র করে হিন্দু ও মুসলমানের গড়ে উঠে যথাক্রমে উক্ত দু-ধারার সাহিত্য। হিন্দুদের যেমন ধর্মসংপৃক্ত কবিগান, সত্যনারায়ণ পাঁচালী, মুসলমানদেরও তেমনি হামজা-হোসেন-হানিফা প্রভৃতি জেহাদ কাহিনী ও পীর-দরবেশের উপকথা নিয়ে গড়ে উঠে এ সাহিত্য। তখন রাজশক্তির লীলাভূমি কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও এদের সন্নিহিত অঞ্চলের হিন্দু মুসলমানদের আধ্যাত্মিক দেউলে ভাবও প্রকট হয়ে উঠে। মানুষ যখন উচ্চ নৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শ হারিয়ে ফেলে তখন আত্মবিশ্বাস রক্ষা করে আত্মনির্ভর হতে পারে না। তখন সে হয়ে পড়ে একান্তভাবে দৈবনির্ভর, ভীরু এবং শক্তি-পূজক। এজন্যে এসময় এখানকার হিন্দুদের মধ্যে দক্ষিণরায়, সত্যনারায়ণ, কালুরায় ও ধর্মঠাকুরের পূজা ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়, মুসলমানদের মধ্যেও সত্যপীর, বড় খাঁ গাজী, ইসমাইল গাজী, মোবারক গাজী, বনবিবি প্রভৃতি মানবভাগ্য নিয়ন্তা বলে শ্রদ্ধা-শিরনি পেতে থাকেন। রাজধানীর অধিবাসীরাই সৌভাগ্য-দুর্ভাগ্য দুটোই সমভাবে ভোগ করে। বাঙলার কলঙ্কিত দুর্দিনের সাক্ষ্য রেখে গেছে এরাই।
ইতিপূর্বেও পালদের পতন-যুগে আমরা বৌদ্ধ বজ্ৰমান, সহজ যান (তন্ত্র ও যোগ) প্রভৃতি পেয়েছি। সেন-রাজাদের দুর্দিনে পেয়েছি একদিকে চণ্ডী-মনসা প্রভৃতি, অপরদিকে শেখশুভোদয়া, গীতগোবিন্দ ইত্যাদি। (রাধাকৃষ্ণ লীলারূপ পঙ্ক থেকে পঙ্কজ হল বৈষ্ণব মত)। পাঠান পরাজয়ে পেলাম ধর্মঠাকুর, দক্ষিণরায়, কালুরায়, বড়গাজী, সত্যপীর প্রভৃতি আর মুঘল-শক্তির পতনে পেলাম বিদ্যাসুন্দর, কবি-গান, পুথিসাহিত্য। এ হচ্ছে স্রোতে ভেসে যাওয়া লোকের তৃণ ধরে বাঁচবার প্রয়াস।
নবাবী আমলে চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ ও কলকাতা শহরে, শহরতলীতে ও তৎসন্নিহিত অঞ্চলে সিপাহী, রাজকর্মচারী, ব্যবসায়ী এবং আরো নানা পেশার অবাঙালি লোক-লস্কর এসে বসবাস করেছে! উর্দু-হিন্দি তথা হিন্দুস্তানীই ছিল তাদের মাতৃভাষা, স্বদেশের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবে ও দেশীলোকের প্রভাবে বিকৃত হয়ে গেল তাদের বুলি। ঐ ভাষা এদেশে অবজ্ঞার্থে খ্যাত হল খোট্টাভাষা নামে। এসব খোট্টাভাষী বিদেশীরা প্রাত্যহিক জীবনের গরজে এদেশীয় লোকের ভাষাও আয়ত্ত করল অপটুভাবে। ফলে যে-কারণে [ অর্থাৎ প্রয়োজনানুরূপ শব্দসম্পদ আয়ত্ত করতে না পারার ফলে] ফরাসি-হিন্দির মিশ্রণে উর্দুর সৃষ্টি হল, অনুরূপ কারণে খোট্টাদেরও একটি বাঙলাভাষার উৎপত্তি হল। এর বিশেষত্ব হচ্ছে বাঙলা শব্দের বিকৃত উচ্চারণ এবং অপরিমেয় হিন্দুস্তানী শব্দের ব্যবহার ও বাভঙ্গির প্রয়োগ। এ ভাষা এখনো চালু রয়েছে উক্ত শহরগুলোতে।
হিন্দুস্তানী ও বিদেশাগতদের পারস্পরিক অক্ষমতার ফলে ফারসি-হিন্দি মিশ্রিত যে ভাষা চালু হল Linguafranca হিসেবে, তা ফারসি অক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে নতুন নামে আলাহিদা ভাষারূপে দাঁড়িয়ে গেল। উর্দুর (তবু) ভাষা পরিণামে কয়েক কোটি লোকের ঘরোয়া বুলিতে পরিণত হল। কালে সাহিত্যের বাহন হবার গৌরব অর্জন করেছে উর্দু।
এভাবে দক্ষিণভারতেও সৃষ্টি হয়েছে দাখিনী উর্দু। খোট্টা বাঙালিরাও হয়তো ফারসি হরফে তাদের মিশ্রবাঙলা লিপিবদ্ধ করে উর্দুর মতো পৃথক একটা ভাষা তৈরি করতে পারত; কিন্তু বাঙলা দেশে বিদেশাগত হিন্দু-মুসলমানের সংখ্যাল্পতার দরুন এবং বাঙলা ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি কিংবা এর জন্য নওয়াবী আমল দীর্ঘায়িত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে আরবি-হরফে অনুলিখিত যে-কয়টি বাঙলা পুথি মরহুম আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কর্তৃক সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলো দোভাষী পুথি নয়, সুতরাং একে উর্দুর মতো আলাহিদা ভাষা সৃষ্টির প্রয়াস বলে মনে করবার হেতু নেই। আরবি হরফে বাঙলা লিখবার অন্য স্থানীয় ও পারিবেশিক কারণ ছিল। ওগুলো বাঙলা বর্ণজ্ঞানহীন মাদ্রাসা-শিক্ষিত মৌলবাদীদের জন্যই। প্রতিবর্ণীকৃত। সে আলোচনা এখানে অবান্তর।
সুতরাং খোট্টা বাঙালির শহুরে বাঙলায় যে-সাহিত্য পলাশীযুদ্ধের পাঁচ-সাত বছর পর থেকে কলকাতা, হাওড়া, হুগলী ও মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে রচিত হতে থাকে, তার সাথে বাঙালির কোনো যোগ ছিল না। চৌদ্দ-পনেরো শতক থেকে বিশুদ্ধ বাঙলায় যে-সাহিত্য রচিত হচ্ছিল এরা সে ভাষাশৈলীই সাম্প্রত কাল পর্যন্ত অনুসরণ করে চলেছে। দোভাষী পুথির কোনো প্রভাব যে পল্লীবাসী মুসলমানদের উপর পড়েনি, তার প্রমাণ এদের রচিত পুরোনো বা নতুন গানে, গাথায়, ছড়ায়, রূপকথায়, কাহিনী-কাব্যে সে ভাষার কোনো নিদর্শন নেই। আমাদের উক্তির সমর্থন পাওয়া যাবে হারামণি, ময়মনসিংহ ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা প্রবাদ-সংগ্রহে এবং পাঁচালিগুলোতে।
পল্লী অঞ্চলে দোভাষী পুথি বহুলপঠিত হত বলে বিশ্বাস করবারও কারণ নেই। চকবাজার ও শহুরে বস্তিতে এর উদ্ভব ও প্রচার সীমাবদ্ধ বললে সত্যের বিশেষ অপলাপ হবে না। উনিশ-বিশ শতকের দোভাষী উপাখ্যানগুলো কারা, কাদের আদেশে, কোনো প্রেরণায় রচনা করেছেন ও করছেন তার উল্লেখ অনেক পুথির সমাপ্তিভাগে রয়েছে–বটতলার প্রকাশকের আদেশ, আর্থিক প্রেরণা এবং খোট্টা পাঠকদের চাহিদাই রয়েছে এগুলো রচনার মূলে। অতএব এ-সাহিত্যের সঙ্গে বাঙালির আন্তর বা বাহ্য যোগ কোথায়? অবশ্য বিশুদ্ধ ভাষায় রচিত ছাপা পুথির অভাবে গাঁয়ের লোকেরাও দোভাষী পুথি পড়েছে–শুনেছে কিন্তু সে-ভাষা অনুকরণ করেনি। কাজেই দোভাষী পুথি সাহিত্যের ঐতিহ্য-উত্তরাধিকারের প্রশ্নই অবান্তর। কল্যাণকর ইসলামী আবেশ বা মুসলিম ঐতিহ্যের আবহ পুথিতে দুর্লভ ও দুর্লক্ষ্য। দোভাষী পুথির আদি রচয়িতা ফকির গরীবউল্লাহ্ স্বয়ং ছিলেন পীর পূজারী। দেবগুণাধিকারী বড় খান গাজী ছিলেন তাঁর জীবন-নিয়ন্তা। এখানে উল্লেখযোগ্য যে মুঘল আমলে আগত ধনিক ও বণিক অভিজাত মুসলমানগণের ঘরোয়া ভাষা আজো উর্দু, এবং বাঙালি মুসলমানদের মুখপাত্র হয়ে তাঁরাই উনিশ শতকে ও বিশ শতকের প্রথমদিকে প্রচার করেছিলেন যে, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা উর্দু।
সতেরো শতকের কবি কৃষ্ণরাম দাস তাঁর রায়মঙ্গলে সংস্কৃত নাটকের অনুকরণে সংলাপে বাস্তবরূপ দান করবার বাসনায় সত্যপীরের মুখে হিন্দুস্থানী ভাষা দিয়েছিলেন। ভারতচন্দ্র রায়মঙ্গলের সে দৃষ্টান্ত স্মরণ করেই লিখেছেন :
মানসিংহ পাদসায় হইল যে বাণী।
উচিত যে আরবি পারসী হিন্দুস্তানী ॥
পড়িয়াছি যেই মত বর্ণিবারে পারি।
কিন্তু সে সকল লোকে বুঝিবারে ভারি ॥
না রবে প্রসাদ গুণ না হবে রসাল।
অতএব কহি ভাষা যাবনী মিশাল।
ভারত চন্দ্র-রামপ্রসাদ ছাড়া বিদ্যাপতি, শ্রীকবি বল্লভ, কৃষ্ণহরি দাস প্রভৃতি সত্যনারায়ণ পুথি রচয়িতাগণ এবং জঙ্গনামা রচয়িতা রাধাচরণ গোপ তাদের পাঁচালিতে মিশ্রভাষা প্রয়োগ করেছেন। বলা বাহুল্য, এঁরাও কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের লোক।
কৃষ্ণরামদাসের হিন্দির নমুনা :
শোতে হো দক্ষিণরায় এছা দাগাবাজী।
বাধকে নে আনেছে তবে হাম গাজী ॥
কালানল শেরকু তোড়নে কহে কান।
সিতাব দেখনে চাই কেছাই সয়তান ॥
বিদ্যাপতির রচনা :
হইআ বান্দার বান্দা নুঙাইয়া শির।
বন্দিব বড় খা গাজী পীর দস্তগীরা
একদিলে বন্দিব দরদস্তা পীব।
বড় খাঁ গাজী যেই করিল জাহির ॥
শ্ৰীকবি বল্লভের রচনা :
শুনহ বেইমান রাজা বাত কহু তোরে।
রাখ্যাছ গোলাম মেরা কিসের খাতিরে ॥
সাত হাজারের মার্তা লইয়াছে ভাড়া।
মহল ভিতরে নাচে সাতশত ন্যাড়া
জঙ্গনামা রচয়িতা রাধাচরণ গোপের রচনা :
ইলাহি কহেন জীবরিল কর আর কি।
আছামান জমীন ডুবাইছেন রসুলের ঝি
সিতাব করিয়া এখন দুনিয়াকে যাও।
বিবি ফাতেমাকে তুমি যাইঞা সমজাও ॥
সম্ভবত এঁদেরই অনুকরণে গরীবউল্লাহ ১৭৬০ থেকে ১৭৮০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে তার কাব্যগুলো রচনা করেন। দ্বিতীয় কবি মুহম্মদ এয়াকুব (?) গরীবুল্লাহর অসমাপ্ত হোসেন মঙ্গল বা জঙ্গনামা সমাপ্ত করেন ১৭৯৪ খ্রীস্টাব্দে। তৃতীয় কবি সৈয়দ হামজা ১৭৮৯-১৮০৫-৮ খ্রীস্টাব্দে তাঁর গ্রন্থগুলো রচনা করেছেন। আঠারো শতকের শেষার্ধে মাত্র এই তিনজন দোভাষী পুথি লেখকের আবির্ভাব হয়েছে। উনিশ শতকে, বিশেষ করে বিশ শতকে প্রায় শতাধিক কবি বটতলার প্রকাশকদের অনুরোধে অর্থের বিনিময়ে নানা বিষয়ক পুথি রচনা করে দিয়েছেন। এদের অনেকেই পেশাদার লেখক। তাই পুথিগুলো প্রায় সবদিক দিয়েই বিশেষত্ব বর্জিত। পদ্যে কোনোরকমে কাহিনী বা বক্তব্য লিপিবদ্ধ হয়েছে মাত্র। বহুগ্রন্থ প্রণেতা হিসেবে এদের মধ্যে উড়িষ্যার অবদুল মজিদ খান ভূঁইয়া, জনাব আলী, মালে মুহম্মদ, মুহম্মদ খাতের, আবদুর রহিম, মুহম্মদ মুনশী, শেখ আয়েজুদ্দিন, মনিরুদ্দিন প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। এবং এঁদের অনেকেরই নিবাস দক্ষিণরাঢ়ে তথা হাওড়া, হুগলী ও চব্বিশ পরগনাঞ্চলে।
এসব দোভাষী পুথি কাদের জন্যে লিখিত হয় তার আভাস পাওয়া যাবে কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে।–কবি মালে মুহম্মদ তার সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল পুথি রচনার কারণ স্বরূপ বলেছেন:
এই পুথি সায়ের ছিল আগুন যমানায়।
সংস্কৃত সাধু ভাষায় হৈল তৈয়ার ॥
পড়িতে বুঝিতে লোকে বড়ই কাছেল্লা।
তেকারণে অধীন করে চলিত বাঙ্গালা।
রসিক লোকের দেখে বহুত কাগতি।
বারশও পঁয়ত্রিশ সালে লেখি এই পুথি ॥
বারোশ পঁচাত্তর বাঙলা সনে হুগলী সন্তোষপুর নিবাসী কবি বেলায়েতকে তাঁর ফেসানায়ে আজায়েব বা আঞ্জুমান আরা জানে আলম রচনাকালে তার বন্ধু ভাষা সম্বন্ধে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা এরূপ :
বোলচাল সব তুমি লেখ আমাদের।
সকলের বুঝিতে পারে কী কহিব ফের ॥
রঙ্গিন করিতে তুমি এই যে কাহিনী।
শক্ত শক্ত লভূজো কিছু না লেখ আপনি ॥
এমত না হয় যেন আমা সবাকায়,
মানে পুছে ফিরি মোরা পণ্ডিত সবায় ॥
কলকাতা শহরের কড়োয়া নিবাসী কবি শেখ আমীরুদ্দিন মনসুর হাল্লাজ পুথির প্রারম্ভে লিখেছেন :
মাসাএখ মনসুরের কেচ্ছা ফার্ছিতে।
লিখিয়াছিলেন কোনো ফাজেল লোকেতে।
সেই তো রেছেলা ফের এছলামি বাঙ্গালায়।
লিখিতে এরাদা হইল খাহেস আমায় ॥
বাঙ্গালা লোকের কেচ্ছা শুনিতে বাসনা।
তেকারণে বাঙ্গালাতে করিনু রচনা ॥
এতেই বোঝা যাবে এঁরা কোনো বাঙালির জন্যে কোনো বাঙলায় পুথি রচনা করেছেন। আজ পর্যন্ত যারা দোভাষী পুথি রচনা করে চলেছেন, যাঁরা এ-পুথির প্রকাশক আর যারা পাঠক, তাঁদের সঙ্গে যে শিক্ষিত বা অশিক্ষিত বাঙালির সাংস্কৃতিক ও ভাবগত কোনোপ্রকার সম্পর্ক নেই তা কে না স্বীকার করবেন?
এসব পুথি দেখেই সম্ভবত উনিশ শতকের হিন্দু সাহিত্যিকগণ মুসলমান লেখকের রচনার সমালোচনা প্রসঙ্গে মুসলমান হইয়া এমন বিশুদ্ধ বাংলা লিখিয়াছেন ইত্যাদি উক্তি করতেন। অবশ্য দোভাষী পুথির অধিকাংশ উর্দু সাহিত্যের অনুবাদ। বাঙলা তর্জমায় উর্দুভাষার প্রচুর আরবি ফারসি শব্দ ও বাঙ্গি রক্ষা করার ফলে কবিগণের পক্ষে অনুবাদ কার্য সহজ হয়েছিল। কিন্তু আমাদের পুথিকারদের কেউ কেউ উর্দু-হিন্দি শব্দ এতই বেশি প্রয়োগ করেছেন যে, তাঁদের রচনার কোনো কোনো অংশ বিকৃত হিন্দুস্তানী বলে ভ্রম হয়।
এখানে আমরা ব্রজবুলি নামক কৃত্রিম ভাষার কথা স্মরণ করতে পারি। মৈথিল ভাষার অনুকরণে বৈষ্ণব যুগে (১৬১৭ শতকে) ব্রজবুলি (বাঙলা-মৈথিল মিশ্রিত) ভাষায় পদ রচনার রীতি দেখা দেয়, কিন্তু কৃত্রিম বলে তা বাঙলা সাহিত্যে টিকতে পারেনি। শেষপর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো সময়েই বাঙলাদেশে এর বহুল প্রচলন হয়নি। কেবল গোবিন্দ দাসই মনেপ্রাণে সাধনা করেছিলেন ব্রজবুলির। ফলে তাঁর রচনা (পদাবলী) হৃদয়াবেগহীন বাসর্বস্ব বাঁচাতুর্যে পর্যবসিত হয়েছে–ভাষার ঐশ্বর্য ঘুচাতে পারেনি ভাবের দীনতা। ভাষার জাদুকর হয়েও তাই তিনি আন্তরিকতার অভাবে কবিপ্রাণতায় বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস বা জ্ঞানদাসের সমকক্ষ হতে পারেননি। অথচ মৈথিল ভাষা (তথা ব্রজবুলি) ছিল বাঙলা ভাষার বৈপিত্রেয় বোন–সহোদরা। এজন্যেই এ-যুগে ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলীও অনুকৃত হয়নি। কৃত্রিম ভাষায় হালকা রচনার বিলাস করা চলে, কিন্তু সারবান মহিমময় সাহিত্য সৃষ্টি করা চলে না। অক্ষম লোকের কৃত্রিম ভাষা প্রয়োগের ফলে পুথি-সাহিত্য সৌন্দর্য ও শালীনতা হারিয়ে ফেলেছে। গাম্ভীর্যের কথা তো ওঠেই না। বাঙালির ব্রজবুলি-চর্চার পরিণতি থেকে আমাদের শিক্ষা পাওয়া উচিত। ইতিহাসের ইঙ্গিত অবহেলার ফল কখনো শুভ হয় না।
বৈষ্ণব আমলের কৃত্রিম ব্রজবুলি টেকেনি, পুথির কৃত্রিম মিশ্ররীতিও কোথাও স্বীকৃতি পায়নি।
এখানে ভাষা সম্বন্ধে দুটো কথা বোধ করি অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কোনো ভাষায় বিদেশী শব্দ আসে দুপ্রকারে। প্রথমত, নতুন বস্তু নির্দেশক হয়ে, দ্বিতীয়ত নতুন ভাব প্রকাশক রূপে। বাঙলা দেশে যে-বস্তু ছিল না বা নেই, সে-বস্তু যদি দেশে আসে, তবে তার নামবাচক বিদেশী বিভাষার শব্দগ্রহণ করতে বাধ্য হই আমরা। দ্বিতীয়ত বাঙালির মন-মননে যে-চিন্তা বা ভাব পূর্বে জাগেনি– যা ব্যক্ত হয়নি, সে-সব ভাব-চিন্তাব্যঞ্জক শব্দও বিদেশী ভাষা থেকে ধার না করে উপায় নেই আমাদের। অকারণে মূল-না-জানা ঐতিহ্য ও ব্যঞ্জনাবিহীন কতগুলো বোবা শব্দ এনে নিজের মুখের বুলিকে–সাহিত্যের ভাষাকে জড় করে তুলে লাভ কী? বিশেষত ঋণমাত্রেই দৈন্যের পরিচায়ক।
তবে রসবৈচিত্র্য দান করবার জন্যে এক-আধটা চরিত্র-মুখে মিশ্রভাষা বা প্রাদেশিক বুলি বলানো সমর্থন করা যায়। এ রীতিও প্রচলিত আছে–যেমন নাটক, গল্প ও উপন্যাসের সংলাপে দেখা যায়। এতে অবশ্য গভীর ও গুরুতর ভাব প্রকাশ করা চলে না। চরিত্রকে হাস্যাস্পদ করে তোলাই লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু বিদেশী কাহিনী বর্ণনার জন্যে বিদেশী ভাষাও আমদানি করলে স্বদেশী সাহিত্য সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। আমাদের দোভাষী পুথিও তাই শালীন ভাষায় শালীন সাহিত্য বলে শিক্ষিতসাধারণের স্বীকৃতি পায়নি। যারা বাঙলাকে সংস্কৃতানুরূপ বা ফারসি-ঘেঁষা করতে চান, তাঁরা বাঙলাভাষাকে রেহাই দিয়ে সহজেই যথাক্রমে হিন্দি বা উর্দুকে বরণ করে নিতে পারেন, তাহলে সব দিক রক্ষা পায়।
অবশ্য যে-পটভূমিকায় কাহিনী বিবৃত হবে, তার স্থানীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে বস্তুবাচক বা ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বিশেষ বিশেষ শব্দপ্রয়োগে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। য়ুরোপীয় কথা বর্ণনায় পদ্ম, চকোর, খঞ্জন আঁখি, মেঘবরণ কেশ, আলতা-রাঙা পা, কাজল-কালো চোখ প্রভৃতি কেউ আশা করে না। তেমনি ইরানি কাহিনীতে সবাই গোলাপ, বুলবুলি, সুর্মা, দ্রাক্ষা প্রভৃতির প্রত্যাশা করে। এতে ভাষা- বিকৃতির আশঙ্কা কেউ করে না।*
[*ইরানী ভাষায় ইসলামধর্মের মৌলিক শব্দেরও অনুবাদ হয়েছিল–যেমন : আল্লাহ–খোদা, সালাত নামাজ, সিয়াম–রোজা, জান্নাত–বেহেস্ত, জাহান্নাম–দোজখ, মলক–ফিরিস্তা ইত্যাদি। ইরানের মাধ্যমে এগুলো এদেশেও গৃহীত হয়েছে। কিন্তু ইমানের ভিত্তি নষ্ট হল বলে কেউ ভাবেনি। মুসলিম তমদুনও এতে খর্ব হয়েছে বলে কেউ প্রশ্ন তোলেনি।]
পুথি সাহিত্যের ইতিকথা
০১.
পুস্তিকার বিকৃতিতে পুথি শব্দের উদ্ভব। নাসিক্য উচ্চারণে হয় পুঁথি। ছাপাখানা প্রবর্তিত হবার আগে গ্রন্থমাত্রই পুথি অভিধায় চিহ্নিত হত। বেদ-উপনিষদ-রামায়ণ-মহাভারত অথবা জ্যোতিষ বৈদ্যক-গণিতশাস্ত্রের গ্রন্থ কিংবা পদ্মাবতী-সতীময়না-সয়ফুলমূলক প্রভৃতি সর্বপ্রকারের গ্রন্থেরই সাধারণ নাম ছিল পুথি। অতএব পুথি ছিল সেকালের গ্রন্থের বা একালের বই-এর প্রতিশব্দ।
ছাপাখানার বহুল ব্যবহার এবং প্রসারের ফলে এদেশে ছাপাবই গ্রন্থ, পুস্তক কিংবা বহি নামে অভিহিত হতে থাকে, আর হাতে-লেখা পুরোনো গ্রন্থগুলো পুথি অভিধায় নতুন তাৎপর্য লাভ করে। যেমন, কৃত্তিবাসী রামায়ণের ছাপাকপি হল পুস্তক, গ্রন্থ কিংবা বহি, এবং এর হাতে-লেখা পুরোনো প্রতিলিপি অভিহিত হলে পুথি নামে। এমনি করে, পুথি হয়ে উঠল ইংরেজি Manuscript-এর বাঙলা পরিভাষা। হিন্দুসমাজে নতুন-উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অভিধা-নিরূপণ পর্ব এখানেই শেষ হল। যদিও সাধারণ অর্থে Manuscript বা Script নামে যে-কোনো আধুনিক রচনার পাণ্ডুলিপি নির্দেশ করাও অবিহিত নয়।
কিন্তু মুসলমান সমাজে নাম-নিরূপণের জের চলে ১৯৪০ সাল অবধি। তার কয়েকটি কারণ ছিল। প্রথমত ১৮৫০-এর পরে বটতলার মুদ্রণ ও প্রকাশনার ক্ষেত্রে বহু মুসলমান এগিয়ে আসেন। মুসলমান সমাজে তখনো ইংরেজিশিক্ষার প্রসার ঘটেনি বলে আধুনিক সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ও প্রয়োজন দেখা দেয়নি। কাজেই স্বল্প-শিক্ষিত ও অশিক্ষিত লোকের চাহিদা মেটানোর জন্যে তারা মধ্যযুগের সাহিত্য এবং মধ্যযুগীয় রসে ও আঙ্গিকে রচিত ফরমায়েশি গ্রন্থ ছেপে বাজারে ছাড়তে থাকেন। আবার একই গ্রন্থ শায়েরের নাম পালটে তথা ভণিতা বদল করে ছাপানো অর্থলোভী প্রতিযোগী প্রকাশকদের পেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এ কারণে ছাপাগ্রন্থেও ছহি বড়–পুঁথি কথাগুলো মুদ্রিত থাকত। তাই এই ছাপাপুথি আর হাতে-লেখা পুরোনো প্রতিলিপি বা পাণ্ডুলিপির পার্থক্য নির্দেশক শব্দ নির্মাণের কিংবা চয়নের প্রয়োজন অনুভূত হয়। ফলে ছাপাপুথি অর্থে পুঁথি আর হাতে-লেখা পুথি বলতে কলমীপুঁথি নাম চালু হল। আবার বটতলার পুথি বলতে মধ্যযুগের এবং মধ্যযুগীয় ধারার যাবতীয় ছাপাগ্রন্থকেই নির্দেশ করে।
তাছাড়া অবিমিশ্র বাঙলায় রচিত পুথি এবং মিশ্রভাষারীতিতে লিখিত পুথির পার্থক্য বোঝানোর জন্যে শেষোক্তরীতির পুথিগুলোকে দোভাষী পুথি নাম দেয়া হয়। এই নাম কবে থেকে চালু হল, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না–তবে মুনশী রিয়াজউদ্দীন আহমদ ও মীর মশাররফ হোসেনকে দোভাষী পুথি কথাটি যেভাবে ব্যবহার করতে দেখি, তাতে মনে হয় উনিশ শতকের শেষ দশকেও তা নিত্য উচ্চারিত নাম। অবশ্য পাদ্রী লঙ এর নাম দিয়েছিলেন মুসলমানী বাঙলা মাঝি-মাল্লার ভাষা। ব্রুমহার্ট, দীনেশচন্দ্র সেন, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুকুমার সেন প্রমুখ মৃত ও জীবিত অমুসলমান বিদ্বানেরা এই নামেই এই রীতির উল্লেখ করেছেন, আজো করেন।
.
০২.
বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে কাজী দৌলত, আলাউল, সৈয়দ মুহম্মদ আকবর, আবদুল হাকিম, হায়াত মাহমুদ প্রভৃতির অবিমিশ্র বাঙলায় রচিত কাব্যগুলোর প্রকাশনার আগ্রহ দোভাষীরীতি-প্রিয় প্রকাশকদের কমে যায়, সম্ভবত পাঠক-শ্রোতা মহলেও এগুলো জনপ্রিয়তা হারায়। এর অনুমিত কারণ দুটো। এক. এসব কাব্যের কলেবর স্থূল, ভাষা পরিসুত ও সংস্কৃতঘেঁষা, ভাব ক্ষেত্রবিশেষে দুরূহ, এবং অলঙ্কার বৈদগ্ধ্যাঙ্কিত। দুই. দোভাষীরীতি-প্রিয় প্রকাশকরা তর্জমা নয়–উর্দু রোমান্সগুলোর কাহিনীর সংক্ষিপ্ত পদ্যায়ন প্রকাশ করে ছাড়লেন বাজারে। পাঠক ও শ্রোতারা বিকল্প পাঠ্য-উপকরণের অভাবেই হয়তো নতুন রীতির পুথিগুলো কিনতে বাধ্য হল, কিংবা দোভাষী পুথির আদর বেড়ে গিয়েছিল তাদের কাছে। কেননা এগুলো অবসরের এক বৈঠকেই শেষ করা সম্ভব, ভাবের দুর্বোধ্যতাও ছিল না, ছিল না শব্দের দুরূহতা। (কারণ শতেক হিন্দুস্তানী শব্দের পৌনঃপুনিক প্রয়োগেই এসব পুথি রচিত। ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে প্রয়োগের আনুমানিক হার শতকরা ৩২টি)। তারপর এই আদলে নানা বিষয়ে কয়েকশত গ্রন্থ রচিত হয়েছে গত দেড়শ বছরের মধ্যে। আলাউল প্রভৃতির কাব্যগুলোকে বাজারছাড়া করে এগুলোই।
গণচাহিদা মিটানোর জন্যে রচিত প্রাকৃতজনের এ সাহিত্য যখন নগর-গ্রামের সর্বত্র চালু, তখন ইংরেজি শিক্ষার প্রসারের ফলে আধুনিক জীবনচেতনা প্রবল হয়ে উঠে বাঙালি মুসলিম সমাজে। এই শতকের চতুর্থদশকেই তার শুরু। মুসলিম সমাজের দারিদ্র্য, মহাজনি, জমিদারি ও চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দু-সমাজের একাধিপত্য এবং সুদে-ঘুষে হিন্দু-সাধারণের সাচ্ছল্য মুসলমানদের ক্ষোভ, ঈর্ষা ও দারিদ্র্যদুঃখ বৃদ্ধি করে।
অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে এই অসম প্রতিযোগিতা হৃতসর্বস্ব পরাভূত মুসলমান সমাজে রাজনৈতিক চেতনা করে তীক্ষ্ণ আর সংস্কৃতিক্ষেত্রে স্বাতন্ত্রবোধ হয়ে ওঠে তীব্র। তখন বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যক্ষেত্রে মুসলিম স্বাতন্ত্র্য ও ঐতিহ্য-সূত্র আবিষ্কারের প্রেরণাবশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজে এবং আজাদ পত্রিকা-অফিসে গড়ে ওঠে পাকিস্তান রেনেসা শোসাইটি। এখানেই শুরু হয় পুথির চর্চা। তাঁরাই মুসলিম রচিত আধুনিক সাহিত্য থেকে দোভাষী পুথির পার্থক্যজ্ঞাপক পুথি-সাহিত্য নামটি চালু করেন। এর প্রয়োজন ছিল। কেননা এ ভাষাকেই বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা তথা ঘরোয়া আটপৌরে ভাষা বলে প্রচার করলেন তাঁরা! কাজেই দোভাষী পুথি বলার আর উপায় ছিল না, সেক্ষেত্রে তাদের আন্দোলন ও উদ্দেশ্য দু-ই হত ব্যর্থ!
সেই থেকে গত পঁচিশ-ত্রিশ বছর ধরে পুঁথি সাহিত্য বলতে মুসলমানেরা দোভাষী পুথিকেই নির্দেশ করে। অভিধার দিক দিয়ে পুঁথি সাহিত্য কথাটি অর্থহীন। কেননা, বই সাহিত্য যেমন হয় না, পুথি সাহিত্যও হওয়া উচিত নয়, কিন্তু এটি এখন একটি যোগরূঢ় বিশেষ নাম। সেজন্যে আর আপত্তি করা চলবে না। আজ পুথি সাহিত্য আর দোভাষী পুথি সমার্থক এবং একটি অপরটির প্রতিশব্দ।
ইদানীং দোভাষী পুথি নামটার ব্যবহার বেড়ে গেছে। কেননা যে প্রয়োজনে এ নামটি পরিবর্তিত বা লোপ করবার প্রয়াস ছিল, পাকিস্তানোত্তর যুগে তা অনুপস্থিত। কিন্তু এ রীতিকে দোভাষীরীতি বলতে কোনো কোনো বিদ্বানের আপত্তি আছে। তাঁদের মতে তথাকথিত দোভাষীরীতিতে মিশ্রণ ঘটেছে আসলে,–আরবি-ফারসি-তুর্কী, হিন্দুস্তানী ও বাঙলা শব্দের অতএব দ্বিভাষা নয়, অন্তত পঞ্চভাষার মিশ্রণ রয়েছে। কাজেই একে মিশ্ররীতি আখ্যাত করাই যৌক্তিক।
কিন্তু তাঁদের ধারণা যথার্থ নয়। কেননা এ-কথা আজকাল কেউ অস্বীকার করে না যে ভারতীয় ভাষায় কোনো আরবি শব্দই সোজাসুজি আসেনি, এসেছে ফারসির মাধ্যমে। ফারসি ও তুর্কী এদেশের ভাষায় গৃহীত হয়েছে শাসকদের প্রয়োগে ও প্রভাবে। ফারসি (কিছু তুর্কী) শব্দের আধিক্যে গড়ে উঠেছে আধুনিক উর্দু ভাষা, আর এর বিপুল প্রভাব রয়েছে হিন্দিভাষায়। এ দুটোর আদি সাধারণ নাম ছিল হিন্দুস্তানী এবং মুসলিম আমল থেকেই দিল্লী সাম্রাজ্যে Lingua Franca হিসেবে চালু ছিল এ ভাষা। এই হিন্দুস্তানী তথা উর্দুর সঙ্গে বাঙলার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে আমাদের দোভাষীরীতি। অতএব, দোভাষীরীতিই এর যোগ্য ও যথার্থ অভিধা। একটি উদাহরণ নেয়া যাক। যদি বলি : There stands a rickshaw in front of Gulistan restaurant in the Jinnah Avenue.–এ বাক্যে জাপানি, ফরাসি, গুজরাটি, ফারসি ও ল্যাটিন শব্দ থাকা সত্ত্বেও একে ইংরেজি বলে জানি ও মানি। শব্দের জাতিনির্ণয় কিংবা ব্যুৎপত্তি নিরূপণ করা বক্তা কিংবা শ্রোতার সাধ ও সাধ্যের অন্তর্গত নয়। অপর ভাষার শব্দ আত্মস্থ করেনি, তেমন ভাষা জগতে নেই। কিন্তু তাতেই কোনো ভাষা মিশ্রভাষা হয় না। দোভাষীরীতিতে মিশ্রণ ঘটেছে বাঙলা ও হিন্দুস্তানীর। আর হিন্দুস্তানীতে আগেই মিশেছিল প্রচুর আরবি-ফারসি-তুর্কী শব্দ ফারসির মাধ্যমে। এখন বিদ্বানের বিশ্লেষণে যদি দোভাষীরীতির ভাষা অলক্ষ্যে প্রবিষ্ট আরবি, ফারসি ও তুর্কীশব্দ বের হয়, তাতে এ রীতির নাম পালটানোর কারণ ঘটে না। রচনায় আরবি-ফারসি তথা বিদেশী শব্দের বাহুল্যই রচনাশৈলীকে দোভাষী করে না, যদি তা-ই হত তাহলে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ–সবাই দোভাষী শায়ের বলে পরিচিত হতেন। অতএব দোভাষী রীতির বৈশিষ্ট অন্যবিধ। একে মুসলমানী বা ইসলামী বাঙলা কিংবা খিচুড়ি বাঙলা বলাও ঐ একই কারণে অসঙ্গত।
.
০৩.
সত্যনারায়ণ এদেশের লৌকিক দেবতা। মুসলিম প্রভাবেই এ দেবতার উদ্ভব। শাসিত হিন্দুশাসক মুসলমানের প্রীতি ও প্রসন্নদৃষ্টি লাভের বাঞ্ছবশে এ দেবতা সৃষ্টি করেছে। মুসলমানেরা এঁকে পীরের মর্যাদা দিতে দ্বিধা করেনি। আসলে প্রমূর্ত সত্যই (Truth) সত্যনারায়ণ তথা সত্যপীর। সত্যপীরের পূজা-শিরনী উপলক্ষে এদেশের দুঃখী জনগণ এক মিলন-ময়দানে একত্রিত হতে চেয়েছে, খুঁজেছে দুর্যোগে-দুর্ভোগে যন্ত্রণায়-নির্যাতনে নিশ্চিত আশ্রয়,জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা। সত্যনারায়ণ মূলত মুসলমান পীর, সে কারণে অবাঙালি,–এ ধারণা ছিল হিন্দুমনে বদ্ধমূল। তাই সতেরো শতকে কবি কৃষ্ণরামদাস যখন রায়মঙ্গল (১৬৮৭) রচনা করেন, তখন দক্ষিণরায়ের প্রতদ্বন্দ্বী বড় খা গাজী এবং উভয়ের মান্যজন সত্যনারায়ণের উক্তিতে ভাঙা হিন্দুস্তানী ও বিকৃত বাঙলা ব্যবহার করেন তিনি। পাত্রপাত্রীর শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সামাজিক মর্যাদা অনুযায়ী সংলাপের ভাষা প্রয়োগ নাটকের বিশেষ আঙ্গিক। কৃষ্ণরামদাসের রায়মঙ্গলে এই নাট্যরীতির অনুসরণ ছিল! তাঁর প্রদর্শিত রীতি প্রায় নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করেছেন সত্যনারায়ণ পাঁচালির পরবর্তী রচয়িতারা। ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ প্রমুখ কবি বিদ্যাসুন্দর কাব্যেও মাধবভাটের জবানিতে এমনি ভাষা প্রয়োগ করেছেন, যখন মাধবভাট বিদ্যার পণের কথা ঘোষণা করেছে উত্তরভারতীয় রাজদরবারগুলোতে। ভারতচন্দ্রের মানসিংহ খণ্ডেও মানসিংহ-জাহাগীরাদির সংলাপের ভাষা এমনি মিশ্র করে তৈরি। এখানে উল্লেখ্য যে কৃষ্ণরাম, ভরতচন্দ্র, রামপ্রসাদ, বিদ্যাপতি, রাধাচরণ গোপ প্রভৃতি হুগলী, বর্ধমান, হাওড়া ও চব্বিশ পরগনার লোক তথা বন্দর এলাকার অধিবাসী।
এভাবে দোভাষীরীতি হিন্দুকবিদের লেখনীপ্রসূত হলেও এর বহুল প্রচলন ও জনপ্রিয়তার জন্যে ফকির গরীবুল্লাহর (১৭৬০-৮০) প্রতিভা ও পরিচর্যার প্রয়োজন ছিল। তিনিই প্রথম দোভাষীরীতি প্রয়োগে তার সব-কয়টি গ্রন্থ রচনা করেন। একে তো তাঁর নিজের বুলি ছিল এ রীতির পরিপোষক, তার উপর ব্রজবুলির মাধুর্য আর উপযোগও হয়তো তার অবচেতন প্রেরণার উৎস ছিল। তাকে প্রথম অনুসরণ করেন সৈয়দ হামজা (১৭৮৮–১৮০৫)। তারপরে মালে মুহম্মদ, মুহম্মদ খাতের, জনাব আলী, আবদুর রহিম, মনিরুদ্দিন, আয়েজুদ্দিন, মুহম্মদ মুন্শী, তাজউদ্দিন, দানিশ, আরিফ, রেজাউল্লাহ, সাদ আলী, আবদুল ওহাব প্রভৃতি প্রায় শতাধিক শায়ের আজ অবধি কয়েকশ কাব্য রচনা করেছেন এ ভাষা-শৈলীর প্রয়োগে।
.
০৪.
হ্যালহেড ১৭৭৮ সনে রচিত তার বাঙলা ব্যাকরণের ভূমিকায় বলেছেন, বাঙলা ক্রিয়াপদযোগে আরবি-ফারসি শব্দবহুল বাক্য ব্যবহারই ছিল তাঁর সমকালে সংস্কৃতিবানতার পরিচায়ক।
আবার ১৮৫৫ সনে পাদ্রী লঙ তাঁর গ্রন্থ-তালিকায় (Descriptive catalogue of Bengali Books) লিখেছেন : আরবি-ফারসিবহুল ভাষা মাঝিমাল্লাদের মধ্যেই প্রচলিত এবং এটি মুসলমানী বাঙলা, আর এ ভাষায় রচিত সাহিত্য মুসলমানী বাঙলা সাহিত্য।
সময়ের দিকে লক্ষ্য রাখলে দুটো তথ্যই নির্ভুল বলে মানা যাবে। ১৭৭৮ সনেও দেশে মুসলিম প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল, তাই সে-যুগের শিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান ফারসি মিশ্রিত ভাষায় কথা বলতে গৌরববোধ করত, আর তা দরবাররি ভাষার বহুল চর্চায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, যেমনটি একালে ইংরেজি শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি মিশানো বাঙলা বলে : ডাক্তার blood examine করে report দিয়েছেন, একটা medicine ও prescribe করেছেন। কিন্তু তবু মনে হয় exact diagonosis হয়নি। আজকাল হাসপাতালে admission না নিলে ভালো treatment আর regular diet ও নিখুঁত nursing-এর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। রাজনারায়ণ বসুদের মতো রুচিবান রক্ষণশীলদের নিন্দা সত্ত্বেও আজও শিক্ষিত লোকমাত্রই ঘরে-বাইরে এমনি মিশ্রভাষাতেই কথা বলে। ১৮৩৫ সনে ফারসি নিঃশেষে হারায় দরবাবি ভাষার মর্যাদা ও অধিকার। আর ১৮৫৫ সনে কলকাতা শহরে নগণ্য ছিল না ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষিত লোকের সংখ্যা। তার উপর সুন্দর গদ্যশৈলী সৃষ্টি-লক্ষ্যে কেরী থেকে বিদ্যাসাগর অবধি লিখিয়ে লোকদের অর্ধশতাব্দব্যাপী সচেতন ও সুপরিকল্পিত সাধনা বাঙলাকে কেবল সংস্কৃত-ঘেঁষা নয়–করে তুলেছিল প্রায় সংস্কৃত-সম। কাজেই নগরের মুসলমান ও গঙ্গাভাগীরথীর মাঝিমাল্লাদের মুখেই এ এককালের নগরবন্দরের বহুল প্রচলিত জনপ্রিয় ভাষা সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে, তাতে বিস্ময়ের নেই কিছু।
.
০৫.
দোভাষীরীতির উদ্ভবের একটি অনুমিত ইতিহাস আছে। যে-কারণে এবং যেভাবে উর্দুভাষা অবয়ব পেয়েছে, এও গড়ে উঠেছে অনেকটা সেভাবেই।
তুর্কী বিজয়ের পর থেকেই ধীরে ধীরে মুসলিম সংস্কৃতির ও ধর্মের প্রভাব পড়তে থাকে এদেশে। তেরো-চৌদ্দশতক থেকেই ফারসি দরবাবিভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছিল। ফলে, জনগণের প্রাত্যহিক জীবনের বুলিতেও নতুন ভাব ও বস্তু নির্দেশক কিছু সংখ্যক ফারসি-তুর্কী এবং সেগুলোর মাধ্যমে আরবি শব্দ মিশে যায়। তাই শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের সাহিত্যিক ভাষাতেও আমরা পাচ্ছি গোটা বারো ফারসি-তুর্কী শব্দ। এদেশে ফারসির চর্চা বৃদ্ধি পায় মুঘল শাসনকালে; শিক্ষিতমাত্রই একালের ইংরেজি-জানা লোকের মতোই জানত ফারসি। তার উপর প্রশাসক ও পদস্থ চাকুরেরা ছিল সাধারণত উত্তরভারতীয় ও ইরানি। এদিকে হিন্দুস্তানী ভাষায় বিপুল হয়ে উঠে ফারসি প্রভাব এবং কথ্য উর্দু চালু হয় সতেরো শতকেরও আগে, আর শালীন সাহিত্যের বাহনের মর্যাদা পায় উর্দু সতেরো শতকের শেষার্ধ থেকেই। দক্ষিণভারতে দাখিনী উর্দুর উদ্ভবও ঘটে এভাবে।
আবার গৌড়, পাণ্ডুয়া, চট্টগ্রাম, ঢাকা, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি নতুন-পুরোনো শাসন-কেন্দ্রের মতো নতুন-জাগা বন্দর হাওড়া-হুঁগলী-কলকাতায়ও ঘটে বিদেশী লোকের সংখ্যাধিক্য! স্থায়ী বাসিন্দাও হয়ে যায় এদের অনেকেই। ফারসি-উর্দুভাষী বিদেশীর প্রভাবে স্থানীয় জনগণের মাতৃভাষাও হতে থাকে বিকৃত। আজো সেই বিকৃত বাঙলা ও বিকৃত হিন্দুস্তানী চালু রয়েছে উক্ত সব অঞ্চলে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে। বড়র অনুকরণ করা মানুষের স্বভাব। এজন্যেই বন্দর এলাকায় একদা পর্তুগীজ ভাষাও শিখেছিল আত্যন্তিক আগ্রহে। হুগলীতে নাকি ইরানি ব্যবসায়ী শিয়াদের আড্ডা ও বসতি শুরু হয় মুর্শিদাবাদেরও আগে এবং ইরানি ভাষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবেও হুগলীর খ্যাতি ছিল দূর-বিস্তৃত। উল্লেখ্য যে, দোভাষীরীতির আদিকবি ফকির গরীবুল্লাহও ছিলেন হুগলীর বালিয়া হাফিজপুরের লোক।
ইরানি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব সর্বগ্রাসী ও সর্বাত্মক হয় আঠারো শতকে যখন উটের পিঠে শেষ তৃণখণ্ডের মতো বাঙলার শাসনভার পেলেন শিয়া-মুর্শিদকুলি খান। বংশানুক্রমিক নওয়াবীতে পরিণত হয় তাঁর সুবাদারী। ইরানে শিয়া সাফাভী বংশীয় রাজত্বের অবসান ঘটে সতেরো শতকে। ফলে কৃপাবঞ্চিত ও পীড়ন-ভীত বহু শিয়া তখন দেশত্যাগ করে। শিয়া মুর্শিদকুলি খানের অনুগ্রহকামী বহু ইরানি শিয়া আশ্রয় নেয় বাঙলাদেশে। এ সময়ে শহর অঞ্চলে তথা মুর্শিদাবাদ ও হাওড়া-হুঁগলী বন্দর এলাকায় ফারসি-উর্দু ও শিয়া-সংস্কৃতির প্রভাব হয় গভীর ও ব্যাপক। এই প্রভাবেরই সাক্ষ্য রয়েছে হালহেডের উক্তিতে, চিঠিপত্রের ভাষায়, সত্যনারায়ণ পাঁচালি ও মর্সিয়ার জনপ্রিয়তায় এবং পাঞ্জাতন, পাঁচপীর প্রভৃতির সংস্কারে, মহররমের তাজিয়া-উৎসবের পার্বণিক প্রতিষ্ঠায় এবং ফকির গরীবুল্লাহ প্রবর্তিত দোভাষী রীতিতে। উত্তরভারতীয় আদলে যখন একটি দেশী মুসলিম সংস্কৃতি প্রকাশমান এবং উর্দুর মতো একটি মুসলিম ভাষা সৃজ্যমান, তখন হঠাৎ নতুন দিগন্তের সন্ধান দিল পলাশীর প্রান্তর। পালে লাগল সেই দিগন্তমুখী বাতাস। পরিণামদর্শী স্বস্থ হিন্দুরা বরণ করে নিল নতুনকে; দ্বিধাগ্রস্ত মুসলমান আকর্ষণ হারাল পুরাতনে, কিন্তু আগ্রহ জাগল না নতুনেও, তাই অর্ধ শতাব্দ ধরে তারা রইল নিঃস্ব ও বিমূঢ়। তখন তারা মনেও কাঙাল, ধনেও কাঙাল। যে-নওয়াবীর প্রচ্ছায় একদা শহর-বন্দরের মুসলমানরা নতুন জীবনস্বপ্ন রচনা করছিল, তা অলক্ষ্যে লাটগিরিতে পরিণত হওয়ায় এভাবে ব্যর্থ হল তাদের স্বপ্ন। স্বপ্ন উবে গেল, কিন্তু ঘোর কাটল না অনেকদিন। যদিও সম্ভাবনাটা উদ্ভাসিত হয়েছিল উত্তরভারতীয় আদলেই, কিন্তু সৌভাগ্যটা আর মিলল না। কেননা রূপায়ণের আর সাফল্যের সব আয়োজন যখন সমাপ্ত, তখন আকাশে দেখা দিয়েছে নতুন সূর্য। নতুন দিনে পুরোনো রচনা অতীতের ঘটনা।
অতএব দোভাষীরীতির উদ্ভব, পরিচর্যা ও বিকাশক্ষেত্র হচ্ছে কলকাতা, হাওড়া ও হুগলীর বন্দর এলাকা। এখানকার এটিই ছিল চলিত বাঙলা। রেজাউল্লাহ (১৮৬১), মালে মুহম্মদ, বেলায়েত ও দানিশ তাই দোভাষী রীতিকে বলেছেন এছলামি বাঙলা, কেউ অভিহিত করেছেন চলিত বাঙলা বলে, আর এর বিকাশ ও বিস্তারকাল হল ইংরেজ আমল। যা উচ্চবর্গের অভিজাতের পরিচর্যার অপেক্ষা রাখত, তা-ই নিম্নবিত্তের স্বল্পশিক্ষিত লোকের অনুশীলনে টিকে রইল শহরের সংকীর্ণ-সীমায়। এ যেন দুধের প্রত্যাশায় ঘোলের সাধনা অথবা দুধের সাধ ঘোলে মিটানো। কেননা এ সাধনায় যারা ব্ৰতী রইলেন, তাঁদের অসম্পূর্ণ শিক্ষা ও অপরিসুত শিল্পরুচি যোগ্য ছিল না কোনো সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করার সামর্থ্য ছিল না তাদের লক্ষ্য-চেতনা মনে জাগিয়ে রেখে এগিয়ে যাবার। এভাবে ব্যর্থ হল একটি জাতীয় স্বপ্ন, একটি ইপ্সিত সম্ভাবনা ও একটি মহৎ প্রয়াস।
উনিশ শতকের শেষপাদ থেকেই কেবল কলকাতা, হাওড়া ও হুগলী অঞ্চলের বাইরের লোক বটতলার প্রকাশকদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়ে ফরমায়েশি রচনায় দোভাষী রীতি প্রয়োগ করতে থাকেন। এ রীতি আজো অনুসৃত হচ্ছে প্রাকৃত মুসলমানদের জন্যে সৃষ্ট বটতলা সাহিত্যে–এমনকি মাওলানা আকরম খানের পাকিস্তান নামায় কিংবা কাজী আবুল হোসেনের জিন্নানামায় এবং আবুল মনসুর আহমদের আসমানি পর্দায়ও।
গৌড়, পাণ্ডুয়া, ঢাকা, চট্টগ্রাম, হাওড়া, হুগলী, কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি শাসনকেন্দ্র ও বন্দর এলাকা ছাড়া, অন্যান্য অঞ্চলের দেশজ মুসলমানের কথ্য ভাষা তো বটেই, লেখ্যভাষাও চিরকাল অবিমিশ্র বাঙলা।
.
০৬.
বিদেশী শব্দের বহুল প্রয়োগ নয়–হিন্দুস্তানী বাঙ্গির অনুকৃতিই এ রীতিকে দোভাষী করেছে :
সর্বনাম–তেরা, মেরা, তুঝে, মুঝে ইত্যাদি।
বিশেষণ–এয়ছা, যেয়ছা, তেয়ছা, কেয়ছা, কব, কাহে, এত্তা, কেত্তা, হোড়া, ভি, আভি।
সংখ্যাবাচক–পয়লা, দোছরা, তেছরা প্রভৃতি।
অনুসর্গ বা কর্মপ্রবচনীয়–বিচে, খাতেরে, হুজুরে ইত্যাদি।
হিন্দুস্তানী ক্রিয়াপদ-তোড়, ডাল, ছোড়, নিকাল, গির, উতার, ভেজ, কিয়া, পাকড়, ঘুম ইত্যাদি।
ফারসি নামধাতু-খেসালিত, নেওয়াজিয়া, গোজারিয়া ইত্যাদি।
আরবি-ফারসি বহুবচন-বেরাদরান, এজিদান, শহীদান, মোমেনিন, চাকরান!
পুংলিঙ্গে স্ত্রীলিঙ্গের প্রত্যয় প্রয়োগ-বালা, প্রিয়া, উদাসিনী। পুরো
হিন্দুস্তানী বাক্যের প্রয়োগ :
তেরা মেরা শাদী হোগা আয়েন্দা জুমারাত
কাদের রহিম আল্লা রহমানের রহিম,
আলমের পালনে ওয়ালা হক্কের হাকিম।
নেক কামে রাজি সেহ বদি কামে দেক।
পহেলা দাওত ভেজে রসুল খাতেরে।
খানা বেগর দো ইমাম বড়া পেরেসান।
সেতাবি এ মোছফেরে লেহ পাকড়িয়া।
সুন্দর করে বলা কথাই কাব্য তথা সাহিত্য। শায়েরদের রচনায় সে-সৌন্দর্যের অভাব। কে না জানে, ধ্বনিমাধুর্য সৃষ্টি হয় সূচিত শব্দের সুবিন্যাসেই। এ চেতনা স্বল্পশিক্ষিত পুথি শায়েরদের মধ্যে দুর্লক্ষ্য। তাই অনবরত শব্দের নির্লক্ষ্য বিশৃঙ্খল প্রয়োগে বক্তব্যের অনর্গল প্রকাশই ছিল তাদের লক্ষ্য। ফলে, অমার্জিত সুরুচির প্রলেপে ঐ ভাষায় এবং ভঙ্গিতে একটা সামগ্রিক অশ্লীলতা যেন প্রকাশমান। অবশ্য এ হচ্ছে বিরূপ শিক্ষিত মনের কথা। কিন্তু যারা এ সাহিত্যের লেখক আর যাদের জন্যে লেখা তাদের মধ্যে এসব ব্যাপারে কোনো বিচলন হয়তো নেই। বহুকালের অনুশীলনে এটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বীকৃত ও সমাদৃত রীতি, বিশেষত বিকল্প রীতি যখন অনুপস্থিত এবং পাঠকেরও শিক্ষা আর রুচির হ্রাস-বৃদ্ধি হয়নি।
মিশ্রভাষায় হালকা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক রচনারীতির ঐতিহ্য এদেশেও সুপ্রাচীন। আমীর খসরু (ফারসি-হিন্দি), ভারতচন্দ্র (বাঙলা-ফারসি-হিন্দুস্তানী), দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত সেন (বাঙলা ইংরেজি), আহসান হাবীব (দোভাষীরীতি : ফরমান, হকনাম ভরসা, জঙ্গনামা), আবুল মনসুর আহমদ (দোভাষী রীতি : আসমানী পর্দা) প্রমুখ কবির রচনা তার সাক্ষ্য।
আবার ইরানি কবি নিজামীর সিকান্দরনামা এবং বাঙালি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ প্রমুখ কবির বহু উৎকৃষ্ট কবিতা বিদেশী শব্দবহুল।
অতএব, শব্দের প্রয়োেগ-নৈপুণ্য বা কুশলতার উপরই কাব্যের উৎকর্ষ নির্ভর করে এবং ব্যবহার-যোগ্যতাই ঔচিত্য ও উপযোগের নিয়ামক ও পরিমাপক।
দোভাষী শায়েরা প্রাকৃতজনের কবি। তাই পরিশীলিত মানসের শিল্পরুচি এবং সুন্দর ও মহৎ জীবনের মাহাত্ম্যচেতনা কিংবা জীবন-জিজ্ঞাসা তাদের রচনায় অনুপস্থিত।
.
০৭.
দোভাষী সাহিত্য পাঁচটি ধারায় বিভক্ত?
(ক) প্রণয়োপাখ্যান : সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, ইউসুফ জোলেখা, চন্দ্রভান, চন্দ্রাবতী, গুল-হরমুজ, গুল-সনোবর, গুলে বকাওলি, মধুমালতী, মৃগাবতী-যামিনীভান, লায়লী মজনু, আলেফ লায়লা প্রভৃতি। এগুলো উর্দু গ্রন্থেরকৃচিৎ ফারসি ও হিন্দি-অওধী কাব্যের স্বাধীন অনুবাদ তথা কাহিনীর স্বাধীন অনুসৃতিমূলক। এগুলোর মধ্যে রূপকথা শ্রেণীর গল্প-কথন প্রয়াস আছে, বাস্তব জীবনবোধের কোনো পরিচয় বা জীবনের কোনো তাত্ত্বিক চেতনার বা রূপের উদ্ভাস নেই। বাঙালি রচিত বা অনূদিত এ সাহিত্যে বাঙলার প্রকৃতি বা সমাজ, বাঙালি জীবনের সমস্যা কিংবা যন্ত্রণা বা উল্লাসের কোনো ছাপ নেই। আছে কেবল আঙ্গিকের ও রসের গতানুগতিকতা এবং ব্যক্তিমনের স্পর্শনিরপেক্ষ যান্ত্রিক পরিচর্যা।
(খ) যুদ্ধকাব্য : জঙ্গে খয়বর, জঙ্গে ওহুদ, জঙ্গে বদর, শাহনামা, আমির হামজা, সোনাভান, জৈগুন, কারবালা যুদ্ধ, কাসাসূল আম্বিয়া প্রভৃতি কাব্যে রসুল, আলি, হামজা, হানিফা, হোসেন প্রমুখ ইসলামের উন্মেষযুগের বীরদের কাফের-দলন এবং ইসলাম প্রচারকাহিনী বিবৃত। এসব যুদ্ধকাব্যে রোমান্সের তথা প্রণয়-রসের অবতারণা থাকলেও এগুলো মূলত জেহাদী প্রেরণার কাব্য। কোনো স্বার্থবুদ্ধি নয়–ইসলাম প্রচার-প্রীতিই প্রেরণার উৎস। তাঁদের এক হাতে কোরআন আর এক হাতে তরবারি, মুখে রয়েছে বেদীনের প্রতি তাদের আহ্বান : হয় কোরআন বরণ কর, নয়তো তরবারির মোকাবেলা কর। তাঁরা কাফের-পূজ্য দেবতাদের বিজয়ী প্রতিদ্বন্দ্বী। এসব কাব্যে স্বধর্মের ও স্বজাতির অতীত গৌরব স্মরণে উল্লাসবোধের আভাস আছে, অবশ্য সে-উল্লাস হচ্ছে আত্মপ্রত্যয়হীন নিঃস্ব দুর্বলের আত্মীয়-গৌরবে আত্মপ্রসাদলাভের বাঞ্ছাজাত এবং এতে রয়েছে বর্তমান আর্তনাদকে অতীত আস্ফালনে ঢাকা দেবার প্রয়াস–দুর্দিনে আত্মপ্রবোধ ও স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা।
(গ) পীর পাঁচালী : পীর পাঁচালিগুলো শায়েরদের মৌলিক সৃষ্টি, যে-অর্থে মঙ্গল কাব্যগুলো মৌলিক সে-অর্থেই অবশ্য। কেননা এখানেও রয়েছে পুচ্ছগ্রাহীর অনুসৃতি। পীর পাঁচালি দুই শ্রেণীর : (১) ঐতিহাসিক ব্যক্তি নির্ভর ও (২) কাল্পনিক।
(১) মোবারক, গোরাচাঁদ, ইসমাইল গাজী, খাঞ্জা খা গাজী (খান-ই জাহাঁ খান), সফি খা গাজী শাহ শফিউদ্দিন (খা?)] ঐতিহাসিক ব্যক্তি। এঁরা হিন্দুর লৌকিক দেবতার প্রতিদ্বন্দ্বী কাফের-মর্দন ও ইসলামপ্রচারক পীররূপে কল্পিত। অতএব এঁরা মঙ্গল কাব্যের দেবতার আদলে সৃষ্ট এবং এঁদের ভূমিকাও অভিন্ন।
(২) শাসক-শাসিতের তথা হিন্দু-মুসলমানের ধর্ম সমন্বয়, সদ্ভাব ও প্রীতির ভিত্তিতে এসব মৌলিক তথা কাল্পনিক পীর সৃষ্ট। জীবন ও জীবিকার এবং পীড়ন ও নিরাপত্তার অভিন্নতাবোধ থেকেই এই প্রীতি ও মিলন-প্রয়াসের জন্ম। তাই এসব পীর হিন্দুদেবতারই প্রতিরূপ : সত্যনারায়ণ-সত্যপীর, কালুরায়-কালুগাজী, বনদেবী-বনবিবি, মছন্দর-মছলন্দি, ওলাদেবী-ওলাবিবি, দক্ষিণরায়-বড় খাঁ গাজী, উদ্ধারদেবী-উদ্ধার বিবি, বাস্তদেবী-বাস্তুবিবি। এঁদের মধ্যে সত্যপীরই আদি ও প্রধান ঐক্যদূত। তাঁকে কেন্দ্র করে তৈরি হল মিলনসেতু। মিলন-ময়দানের তিনিই ইমাম।
(ঘ) ধর্মশাস্ত্রীয় রচনা : শরীয়ত ও মারফত বিষয়ক বহু গ্রন্থও রচনা করেছেন এরা? মোহাম্মদী বেদতত্ত্ব, ফকির বিলাস, নসিয়তনামা, মুর্শিদনামা, তম্বিয়াতুন্নেসা, আহকামুল জুমা, সেরাতুল মুমেনীন, একশত বত্রিশ ফরজ, নামাজ মাহাত্ম্য, হাজার মোসায়েল, তরিকতে হক্কানি, হকিকতে সিতারা প্রভৃতি এ শ্রেণীর গ্রন্থ।
(ঙ) বিবিধ :তাজকিরাতুল আউলিয়া, আবু সামা, ইরিস নামা, যুগীকাঁচ, ফালনামা, গান, কিয়ামতনামা প্রভৃতি।
প্রণয়োপখ্যান ছাড়া অন্য শ্রেণীর রচনাগুলো কম-বেশি ধর্ম-সংপৃক্ত। এবং প্রাকৃতজনের এ ইসলাম হচ্ছে লৌকিক ইসলাম। অর্থাৎ স্থান-কালে প্রভাবজ এবং দেশী মুসলমানের মানস-প্রসূত এ ইসলাম নতুন অবয়বে প্রকাশমান। এই তথ্য মনে রেখে বলা যাবে দোভাষী সাহিত্য স্বধর্মনিষ্ঠ, আদর্শবাদী ও জাতীয় ঐতিহ্যগর্বী এবং অদ্ভুত কল্পনাপ্রিয় স্বাপ্নিক কবির রচনা। অসম্পূর্ণ শিক্ষার দরুন নীতিবোধ ও জীবনাদর্শ সম্বন্ধে একটি লোকায়ত স্কুলবোধের প্রতিচ্ছবি পাই এঁদের রচনায়। দেশ, জাতি ও ধর্মের ইতিকথা এবং সমাজ-সংস্কৃতির একটি অতি স্কুলবোধ ও রূপ এ সাহিত্যে প্রতিফলিত।
অতএব, আঠারো-উনিশ শতকী দোভাষী সাহিত্য আমাদের নগর-বন্দর এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মন-মানসের তথা জীবনচর্যার প্রতিচ্ছবি ও প্রতিভূ! এ সাহিত্যই উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে আজ অবধি, শতকরা নিরানব্বইজন বাঙালি মুসলমানের মনে জাগিয়ে রেখেছে ইসলামী জীবন ও ঐতিহ্য চেতনা। সাহিত্য রচনার শেষ লক্ষ্য যদি সমাজকল্যাণ হয়, তাহলে মানতেই হবে দোভাষী সাহিত্যই গত একশ বছর ধরে অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত মুসলমানের জগৎ ও জীবন ভাবনার নিয়ামক। এই দিক দিয়ে এ সাহিত্যের সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিমেয়! এ ভাষাও দাখিনী উর্দু ও উত্তরভারতীয় উর্দুর মতো একটি মুসলিম ভাষা হতে পারত–এ উল্লাসবোধ, কিন্তু হল না–এ ক্ষোভই দোভাষী রীতি চিরকাল জাগিয়ে রাখবে স্বজাতি ও সংস্কৃতিপ্রিয় মুসলিম ঐতিহাসিকের মনে।
বাংলা সাহিত্যের ইসলামমুখী ধারা
মুসলমানদের ভারত অধিকার ভারতবর্ষের সামাজিক ও কৃষ্টির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইতিপূর্বে শক-হুঁণদল এসেছিল; ভারতবাসীরা অনায়াসে তাদের গ্রহণ করতে পেরেছিল। কিন্তু বহিরাগত পাঠান-মুঘলকে এদেশীয় সমাজ আত্মস্থ করতে পারেনি। তার কারণ মুসলমানেরা শুধু বিশেষ আকৃতি, প্রকৃতি ও বাহুবল সম্বল করে আসেনি, এনেছিল যুক্তি-নির্ভর এবং প্রত্যয়-দৃঢ় ধর্ম, সমাজ, আচার আর রাষ্ট্রাদর্শ–যার সামাজিক ও পারমার্থিক প্রভাব ছিল অসাধারণ–এত অসাধারণ যে, তা আজকের দিনের বোলশেভিকবাদের চাইতেও সর্বগ্রাসী এবং আণবিক বোমার চাইতেও বিস্ময়কর। ফলে মুসলমানদের এক দেহে লীন করা সম্ভব হয়নি কোনোমতেই। কিন্তু আচার-নিষ্ঠ ব্রাহ্মণ্যধর্মও পর্যদস্ত হবার নয়; এর অন্তর্নিহিত শক্তিই এই নবশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবার যোগ্য ছিল। তাই ভারতীয় সনাতন ধর্ম জখম হল নানাভাবে কিন্তু লুপ্ত হল না। ফলে ব্রাহ্মণ্যধর্ম না হল ইসলামে বিলীন, না পারল মুসলমানদের বিলীন করতে। বিজেতা ও বিজিতদের তথা শাসক ও শাসিতদের মধ্যেকার এ স্নায়ুবিক দ্বন্দ্ব দেখা দিল বড়ই তীব্র হয়ে। কেউ কাকেও না পারে গ্রহণ করতে, না পারে গ্রহণ করাতে। অবস্থাটা যেন কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান। উভয় পক্ষই বুঝল–এ অবস্থা অসহ্য, এর আশু সমাধান প্রয়োজন। বর্ণাশ্রম কণ্টকিত অনুদার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজেও ভাঙন ধরল ইসলামের সাম্য-ভ্রাতৃত্বের চুম্বকাকর্ষণে।
এ সমস্যার সমাধানার্থ শুরু হল সমাজ-চেতন মনীষীদের সাধনা। ধর্ম সমন্বয়ের ও ঐক্যের বাণী ভারতের সর্বত্র ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। রামানন্দ, নানক, কবির, একলব্য, দাদু, চৈতন্য ও সম্রাট আকবর থেকে গান্ধী পর্যন্ত এ ধারার সাধনা অব্যাহত ছিল। এ পথে গান্ধীর রামধূন সঙ্গীতকে শেষ প্রয়াস বলে ধরে নেয়া চলে। এইসব মনীষীদের যা ছিল সচেতন প্রয়াস, অশিক্ষিত জনসাধারণের অবচেতন মনে তার প্রতিক্রিয়া ছিল শ্লথ ও মন্থর। তাই সাতশ বছরের এ একাগ্র সাধনা আশানুরূপ ফলপ্রসূ হয়নি। মনীষীদের দূরদৃষ্টি জনসাধারণের মধ্যে ছিল একান্তই দুর্লভ। তাই সমঝোতা হল, বন্ধুত্ব হল, আত্মীয়তাও না হয়েছে তা নয়, কিন্তু এ বন্ধনসূত্র দৃঢ় ছিল কোথাও। ফলে যেহেতু গড়ন ভঙ্গিতে পারে আছে কত খল, সেহেতু অল্লোপরিষদ থেকে রামধূন সঙ্গীত পর্যন্ত সবকিছুর আবেদন কার্যক্ষেত্রে বারবার ঠুনকো কাঁচের মতো অসার প্রতিপন্ন হয়েছে।
বলেছি, অশিক্ষা ও অদূরদর্শিতার দরুন জনসাধারণের মনে ঐক্য ও সমন্বয় প্রয়াস সচেতনভাবে কার্যকর হয়নি। সেইজন্যে যদিও এখানে সেখানে পারস্পরিক প্রভাবে অজান্তে সংস্কার ও কৃষ্টিগত সংমিশ্রণ ঘটেছিল, তথাপি আচরণে না হোক উভয়পক্ষের স্বধর্মনিষ্ঠা ও স্বধর্ম মাহাত্মগর্ব প্রবল ছিল। ফলে তারা ঘাটে-মাঠে ও হাটে-বাটে মিলেছে, কেননা জীবিকা ছিল তাদের অভিন্ন, কিন্তু জীবনদর্শনে মেলেনি। কাজে মিলেছে, ভাগ্যও ছিল একসূত্রে গাঁথা; তাই পণ্য দিয়েছে, কিন্তু প্রেম দেয়নি; সহায়তা করেছে কিন্তু সোহাগ দেখায়নি। একে অপরের পাশে ছিল, কেউ কেউ কাকেও মনের কাছে পায়নি। কেননা মন ছিল বিচ্ছিন্ন ও বিপরীতমুখী।
এইরূপে অধিকাংশের গোঁড়ামির ফলে স্বল্প-সংখ্যকের উদারতার ক্ষীণধারা কখনও সুপ্ত কখনও বা লুপ্তই হয়ে গিয়েছে। তবু যাঁরা আশাবাদী, তারা কোনোদিন হাল ছাড়েননি। তাই মধ্যযুগের ধর্মসাধকগণ থেকে বাঙলাদেশের বাউল-মুর্শিদপন্থীরা পর্যন্ত এবং সে-যুগের রাষ্ট্রসাধক আকবর থেকে এ যুগের গান্ধী তক্ সকলেই আন্তরিকভাবে সমঝোতা-সমন্বয় সাধনা করে গেছেন।
চণ্ডীদাস বলেছেন : সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই। আর একজন লোক-সঙ্গীতকার বলেছেন :
নানা বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ।
জগৎ ভ্রমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।
কিন্তু জনসমাজে এসব বাণী আশানুরূপ সমাদর পায়নি। নাড়া দেয়নি মস্তিস্কে, সাড়া জাগায়নি হৃদয়ে, আলোড়ন আনেনি সমাজে। তাই হিন্দুর ধর্মশাস্ত্রের কাহিনী মাতৃভাষায় অনুবাদ করতে গিয়ে উদারপন্থীরা প্রবল বাধা পেয়েছিলেন–অস্টাদশ পুরাণানি রামর্শ চরিতানি চ ভাষায়াং মানবঃ শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ।] তেমনি মুসলমান লেখকরাও স্বজাতি থেকে কম ধমক খাননি। ষোলো শতকের কবি সৈয়দ সুলতান বলেন–না বুঝে বাঙ্গালী সবে আরবি বচন তাই আপনা দীনের বোল এক না বুঝিলা। এবং
যে সবে (মৌলবীরা) আপনা বোল না পারে বুঝিতে।
পঞ্চালী রচিলু করি আছএ দূষিতে ॥
মোনাফেক বলে মোরে কিতাবেতু কাড়ি।
কিতাবের কতা দিলুম হিন্দুয়ানি করি ॥ ….
তেকারণে কত কত পশুবুদ্ধি নরে।
কিতাব ভাঙ্গিলু করি দোষএ আমারে।
কিন্তু কোনো বাধাই টিকল না, কারণ কবির আত্মবিশ্বাস ছিল দৃঢ় এং সত্যোপলব্ধি সম্বন্ধে ছিলেন স্বয়ং নিঃসন্দেহ-মমাহোর মনের ভাব জানে করতারে। এবং এজন্যেই তিনি পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে বলেছেন–নবীবংশ ও সবে মেরাজ —
এ দুই পুস্তক যেই পালিবারে পারে।
আল্লার গৌরব হৈব তাহার উপরে ॥
এমনি বিশ্বাস নিয়ে মালাধর বসুও বলেছেন :
পুরাণ পড়িতে নাই শূদ্রের অধিকার।
(তাই) পাঁচালী পড়িয়া তর এ ভব সংসার ॥
এইরূপে বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে মধ্যযুগে জায়নুদ্দিন, সৈয়দ সুলতান মোহাম্মদ খান, শেখচান্দ, সাবিরিদ খান, আবদুল হাকিম প্রভৃতি বহু মুসলমান কবি একদিকে যেমন রসুল ও ইসলাম বিষয়ক নানা গ্রন্থ রচনা করেছেন, তেমনি আবার তারা গোরক্ষবিজয়, জ্ঞানপ্রদীপ, সুরতনামা, যোগকালন্দর, হরগৌরী-সংবাদ, নুরজামাল, জ্ঞানসাগর প্রভৃতি তত্ত্ব-সাহিত্য এবং রাধা কৃষ্ণবিষয়ক পদাবলী রচনা করে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মের মৌলিক ঐক্য সন্ধানে প্রয়াস পেয়েছেন। সুতরাং সেইযুগে একদিকে উদারপন্থীদের সমন্বয় ও মিলন মোহ এবং অপরদিকে গোড়াদের বঙ্গভাষাপ্রীতির অভাব বাংলা সাহিত্যের ইসলামমুখিনতার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ইংরেজ আমলে পাশ্চাত্যাদর্শে আধুনিক সাহিত্যধারা শুরু হল। এই যুগেও আমরা মীর মশাররফ হোসেন প্রভৃতির মধ্যে স্বধর্ম ও স্বজাতিনিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় জাতীয়তা আর সংস্কারের প্রভাবও দেখতে পাই। বিষাদ-সিন্ধুতে স্বর্গমর্তের হিন্দুয়ানি কল্পনা প্রশ্রয় পেয়েছে। তারই সমসাময়িক কবি শামসুদ্দিন সিদ্দিকীর ভাবলাভ কাব্যের পারমার্থিক সংগীতের কালার সাক্ষাৎ মিলে। আশ্চর্য এই যে, এঁরা বঙ্কিমচন্দ্রের সমসময়ের হলেও বঙ্কিমের তথাকথিত মুসলমান বিদ্বেষের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ হিন্দুর অকল্যাণ কামনা করেননি।
আবার সৈয়দ সুলতান সে-যুগে যে-বাধা পেয়েছিলেন, এ-যুগে কোরআনের বঙ্গানুবাদেও সে বাধা বেশ কিছুকাল প্রবল ছিল। তাই আধুনিক যুগে কোরআনের প্রথম অনুবাদ ও রসুলের জীবনী রচিত হয় হিন্দুর দ্বারা। কৃষ্ণকে মুসলমান-লেখক অন্যতম পয়গম্বর বলে স্বীকৃতি দিতেও কুণ্ঠিত হননি। এভাবে নজরুল ইসলামের কাব্যে আমরা শেষবারের মতো হিন্দু-মুসলিমের মিলন-প্রয়াস লক্ষ্য করি। তবু এ-যুগের বিকাশোন্মুখ ধর্ম ও জাতীয়তাবোধের ফলস্বরূপ আমরা মোজাম্মেল হকের জাতীয়ফোয়ারা, কায়কোবাদের অমিয়ধারা এবং ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মুসলিমঐতিহ্যপ্রধান স্পেনবিজয়, অনল প্রবাহ প্রভৃতি কাব্য-কবিতা পেয়েছি। কিন্তু তাদের এ প্রয়াস খুব সচেতন ছিল না, মূলত হালীর মুসদ্দস ও সৈয়দ আহমদের আলীগড় আন্দোলনের পরোক্ষ প্রভাবেই তাদের সাধনা শুরু হয়। কিন্তু মুসলমানদের আচরণে না হোক, আস্থার দিক থেকে এতটুকু স্বধর্মচ্যুতি ঘটেনি কোনোদিন। এই সময়েই ইমাম গাজ্জালীর কিমিয়া-ই সাদৎএর অনুবাদ সৌভাগ্য স্পর্শমণিও প্রচারিত হল। শুধু তাই নয়, তিতুমিরের আযাদীস্বপ্নের এবং যুক্তিবাদীদের ওহাবী আন্দোলনের প্রভাবও তাঁদের উপর কিছু কম ছিল না।
এইরূপ দুই বিরুদ্ধ আদর্শের ঠেলাঠেলিতে অবশ্য ইসলামও টিকে ছিল, মুসলমানও বেঁচে ছিল, কিন্তু ইসলামমুখী মনোভাবের তীব্রতা কোথাও ফুটে ওঠেনি। তাই আমাদের সাহিত্যে সাম্প্রত পূর্বযুগে নিরবচ্ছিন্ন ইসলামমুখিতার নিদর্শন নেই।
অত্যাধুনিক যুগে নজরুল ইসলাম ইসলামবিষয়ক অনেকগুলো গান এবং কয়েকটি কবিতা লিখেছেন। এগুলো থেকে অনেক মুসলমান পাঠক ও কয়েকজন লেখক ইসলামী প্রেরণা পেয়েছেন। তবে অপ্রিয় হলেও এখানে বলা আবশ্যক যে, নজরুল ইসলাম প্রথমত বাঙালি তথা ভারতীয় জাতীয়তায় (হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে) বিশ্বাসী ছিলেন। দ্বিতীয়ত তার মধ্যে বিশ্বমুসলিম জাতীয়তাবোধ ছিল না। তার কারণ, তাঁর কাব্য-প্রেরণার উৎস ও লক্ষ্য ছিল মানবনিষ্ঠা। তার ধর্মবোধও ছিল মানবনিষ্ঠ। তিনি ছিলেন একান্তভাবে স্বদেশপ্রেমিক, স্বজাতি (ভারতবাসী)-নিষ্ঠ ও নিপীড়িত মানবতার দরদী কবি। এই স্বদেশ ও মানবনিষ্ঠ কাব্যসাধনার আনুষঙ্গিক ফলস্বরূপ আমরা তাঁর কাছে ইসলামী কবিতা ও গানগুলি পেয়েছি। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা ও প্রেরণা ইসলাম-প্রীতিপ্রসূত নয় বরং তীব্র আযাদী-বাঞ্ছা ও মানবতাবোধের পরিচয় ও পরিপূরক। সুতরাং কবির জিঞ্জির মুসলিম কবিতার সমষ্টি বলে বিজ্ঞাপিত হলেও আসলে ওটা তা নয়।
যা হোক, কয়েকজন লেখক এর মধ্য থেকেই ইসলামের শিক্ষায় ও মুসলিম ঐতিহ্যে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এঁদের মধ্যে নজরুলের সমসাময়িক গোলাম মোস্তফাই প্রথম। কিন্তু তার রচনায় গণচিত্তে প্রেরণার তরঙ্গ তুলবার মতো তীব্রতা ছিল না। তিনি নিজে উদ্বোধিত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু পাঠকসাধারণকে অনুপ্রাণিত করবার সামর্থ্য ছিল না তাঁর কলমের। শাহাদৎ হোসেনের লেখার আবেদনও পাঠকচিত্ত স্পর্শ করেনি। তারপর অনেক পরে বাঙলা সাহিত্যক্ষেত্রে এলেন বেনজীর আহমদ। তিনি বিপ্লবী কবি বলে একসময় পাঠকসাধারণের অকুণ্ঠ অভিনন্দন পেয়েছেন। তার ইসলাম ও মুসলমান বিষয়ক কবিতাগুলো কিশোর ও তরুণ-হৃদয়ে সাড়া জাগাতে সমর্থ হয়েছিল। ভাবে ও ভাষায় তিনি নজরুলেরই মানসসন্তান। কিন্তু নজরুলের মতো অফুরন্ত প্রাণময়তা ও উচ্ছ্বাস-প্রাচুর্য তাঁর ছিল না। ফলত তিনি যেমনি অতর্কিতে সাহিত্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তেমনি অকস্মাৎ যেন আত্মগোপন করেছেন। ইসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্যানুসারী আর দুজন কবি হচ্ছেন ফররুখ আহমদ ও সৈয়দ আলী আহসান। ফররুখ আহমদের মধ্যে ইসলাম ও মুসলিম ঐতিহ্যমোহ তীব্র আবেগ জাগিয়েছিল। অনুরাগের সঙ্গে অবচেতন ভাবালুতা তাঁকে আবেগমুখর এবং সংবেদনশীল সৃষ্টিপ্রবণ করেছে। ইসলামের উন্মেষযুগের মুসলমানদের প্রাণময়তা ও জীবনবাদ মুগ্ধ করেছে তাকে। তাই তিনি হেরার রাজ তোরণের ও নারঙ্গীবনের স্বপ্ন দেখেন এবং সে-স্বপ্ন আজকের দিনে বাস্তবে রূপায়িত করবার অভিলাষও যেন পোষণ করেন। এইজন্যে তাঁকে Revivalist বলা যেতে পারে। কোনো জিনিসের Form ও Spirit এক বস্তু নয় এবং তাদের অনন্যপেক্ষ সত্তা উপলব্ধি সম্ভব। ইসলামকে যে-অর্থে আমরা চিরকালের সর্বদেশের চিরমানবের ধর্ম বলি, তা হচ্ছে ইসলামের spirit বা শিক্ষার মূলসূত্রগুলোর চিরমানবের সমাজে প্রযোজ্য হবার যোগ্যতা। অর্থাৎ আমাদের প্রয়োগবিধি ও জীবনপ্রণালী বদলাবে কিন্তু আদর্শ, উদ্দেশ্য ও নীতি অপরিবর্তিত থাকবে। কালে কালে প্রয়োগ-ধারা পালটাবে, কিন্তু নীতি ও লক্ষ্য থাকবে স্থির-অচঞ্চল। কাজেই Revival-এর প্রয়াস শুধু অবান্তর নয়, অনভিপ্রেতও বটে। যারা শুধু আত্মা (spirit) নয়, বহিঃরূপেরও (Form) পুনরাবর্তনের পক্ষপাতী, আজকের দুনিয়ায় তাঁদের অভিলাষ হয়তো পূর্ণ হবার নয়। ফররুখ ইসলাম-পূর্ব ও ইসলামোত্তর আরবি ঐতিহ্যের গৌরব-গর্বী। ফররুখের এই আরব ঐতিহ্য-প্রেরণাজাত সাতসাগরের মাঝি, হাতেম ও নৌফেল, হাতেমতায়ী, সিরাজুমমুনিরা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। যে-ঐতিহ্যানুগ অবচেতন ভাবালুতা ফররুখের কাব্যপ্রেরণার উৎস, সৈয়দ আলী আহসানের মধ্যে সে-ভাবালুতা ছিল না, অর্থাৎ তিনি ইসলাম বা মুসলিম ঐতিহ্যের প্রতি মোহগ্রস্ত নন, তাঁর কাব্যসাধনা ছিল আদর্শানুশীলনের সচেতন প্রয়াস মাত্র। এ কারণে তাঁর কবিতা আবেগমুখর নয় বরং বিদগ্ধমনের প্রয়াসচিহ্নিত। এজন্যেই বোধ হয় তাঁর এ ধারার কাব্যসাধনা চাহার দরবেশের সাথী হয়ে গহন বনে পথ হারিয়ে ফেলেছে।
এদেরই প্রায় সমসময়ে আমরা তালিম হোসেনকে পেলাম। তাঁর প্রেরণার উৎস ইসলাম বা মুসলিম ঐতিহ্যবোধ নয়–বরং মুসলিম জাতীয়তাবোধ। তাঁর আযাদীর স্বপ্ন ও উল্লাসজাত পাকিস্তানী কবিতা ও গান বিভাগপূর্ব বাঙলাদেশে পাঠকসাধারণের অজস্র প্রশংসা অর্জন করেছে।
নজরুলোত্তর এ ধারার কবিগণ ১৯৩০ সালের মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব ও ১৯৪০ সালের পাকিস্তান পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে কাব্যসাধনা আরম্ভ করেন। এইক্ষেত্রে ইকবালের কাব্যসমূহ তাদের প্রেরণার পরিপোষক ছিল। ধর্মবোধের পরিসরে বিশ্বমুসলিম জাতীয়তা ও সমাজবোধ অর্জনই ছিল ইকবাল-কাব্যের মূল সুর। তিনি যথার্থই উপলব্ধি করেছেন–আচারিক ও আনুষ্ঠানিক ধর্ম সবসময় সমাজকেন্দ্রিক; এবং পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক সাধনা জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে প্রজ্ঞাদৃষ্টি লাভের সহায়ক। আমরাও স্বীকার করি যে, ধর্মবোধ সামাজিক প্রয়োজনে অপরিহার্য। ইকবালের শেকওয়া, আরারে খুদী ও রমুজে বেখুদী প্রভৃতির লক্ষ্যও এই। ইকবালের কর্ম ও কাব্য-প্রেরণায় হালী ও সৈয়দ আহমদের প্রভাব প্রবল ও প্রকট। বস্তুত তিনি তাদের স্বপ্নকেই সার্থক করে তুলতে চেয়েছেন। ইকবাল তাদের যোগ্যতম মানস-সন্তান।
মধ্যযুগে ও নজরুলপূর্ব আধুনিক যুগে বাঙলা সাহিত্যের ইসলামমুখী যে-ধারার কথা উল্লেখ করেছি, তা মুখ্যত ধর্মানুরাগজাত। নজরুলের সম-সময়ে তা ছিল প্রধানত সমাজবোধানুষঙ্গিক এবং পরবর্তীকালে অর্থাৎ বেনজীর আহমদের কাল থেকে তা হল নিছক জাতীয়তা, সমাজবোধ ও আযাদী প্রেরণাপ্রসূত। আযাদী-উত্তর যুগে এ আবার শুধু রাষ্ট্র ও সমাজাদর্শের বাহনই যে হয়েছে, তা আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং এ ধারার কাব্য-সাহিত্যকে যদিও আমরা ইসলামমুখী ধারা নামে অভিহিত করেছি, তবু বিভিন্ন যুগে এ সাহিত্যের প্রেরণা, ব্যঞ্জনা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ভিন্ন। ভিন্ন ছিল। অতএব আপাতদৃষ্টিতে বিষয়সাদৃশ্যে এ সাহিত্য একক ধারার অন্তর্গত বলে মনে হলেও আসলে বিভিন্ন যুগের এ সাহিত্যের মধ্যে কোনো ভাবগত মৌলিক ঐক্য নেই।
পাকিস্তান অর্জনের পর থেকে জনসাধারণের ইসলাম ও মুসলিম তমদুন-প্রীতি সর্বত্র আলোড়ন জাগিয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ইসলামমুখী কর্মপ্রেরণা ও সাহিত্য সাধনার অভাবে ঘোচেনি। আজকের যুগে জীবন-সমস্যা উৎকট আকারে দেখা দিয়েছে, তাতে নিতান্ত বেঁচে থাকার সাধনা ছাড়া অন্য সাধনা ঠাই পাবার কথা নয়। জাতি ও শ্রেণীসংগ্রামে আজকের পৃথিবী জর্জরিত ও মুমূর্ষ। যে-দেবতা বর দিতে পারে না, তার পূজা হয় না। আজকের অধার্মিকতা আস্থাহীনতার জন্য তত নয়, যতটা ক্ষোভ, নৈরাশ্য ও জেদজাত! এই সব কারণেই ইসলামমুখী সাহিত্য-সাধক আজ দেশে নিতান্ত বিরল।
বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের খসড়াচিত্র
০১.
বাঙালি যে গোত্র-সঙ্কর জাতি তা সবই স্বীকার করেন। সঙ্করজাতির ভাষাও মিশ্রভাষা হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা পুরোপুরি হয়নি। বাঙলা ভাষায় এদেশের সব গোত্রীয় অধিবাসীর বুলির উপাদান থাকলেও এর মূল কাঠামো গড়ে উঠেছে আর্যভাষার এক বুলি ভিত্তি করে।
নৃতাত্ত্বিক পরিভাষা ব্যবহার না করে সাধারণভাবে বলা যায়, এদেশের অধিবাসী হচ্ছে কোল, মুণ্ডা, দ্রাবিড় ও মোঙ্গল গোত্রীয় লোক। কাজেই অনুমান করতে হবে যে আধুনিক বাঙলা নামের আর্যবুলির আগে এদেশে বিভিন্ন গোত্রীয় বুলিগুলো চালু ছিল; এবং গোত্রগুলোর পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের ও লেনদেনের প্রয়োজনে হয়তো কোনো প্রবল কিংবা সংখ্যাগুরু গোত্রের ভাষা Lingua Franca-রূপে ব্যবহৃত হত। কিন্তু তার কোনো আভাস পাইনে। এতে বোঝা যায় তাদের যে কেবল লিখন-পদ্ধতি জানা ছিল না তা নয়, তাদের সাংস্কৃতিক মানও নিতান্ত আদিম পর্যায়ে ছিল। মুণ্ডা, কুরুক, বোরো, সাঁওতাল, নাগা, খাসী, কুকী প্রভৃতি গোত্রের আজকের দিনের ভাষায় ও আচারে-সংস্কারে তার পরোক্ষ আভাস মেলে। কবে যে এদেশে আর্য-বসতি ও আর্যপ্রভাব শুরু হয়, ইতিহাস তা সঠিক বলতে পারে না। তবে খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে বিশেষ করে জৈন-বৌদ্ধ মত প্রচারের জন্যেই বাঙলা দেশে আর্য অনুপ্রবেশ ঘটে। সম্প্রতি ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন এদেশে আর্যভাষা অন্ততপক্ষে খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম-সপ্তম শতাব্দী হতে প্রচলিত আছে। তার এ মতের সমর্থনে তিনি ইরান হইতে ভারতবর্ষে আর্যভাষা ও সংস্কৃতি দুই বা ততোধিক ধারায় আসিয়াছিল এবং অর্বাচীন ধারার কাছে ব্রাত্য নামে অভিহিত প্রাচীন ধারার ব্রাত্যরাই বাঙলা দেশে আর্য-সংস্কৃতির প্রথম বাহক ছিল বলিয়া মনে করেন। অনার্য ভাষা ও সংস্কৃতির নিদর্শনের বিরলতাই তাঁকে সম্ভবত অনুমানে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের ধারণায়, জৈন-বৌদ্ধমত প্রচারসূত্রেই বাঙলা দেশে উল্লেখ্য আৰ্যবসতি ঘটে এবং এ সময় থেকেই জৈন-বৌদ্ধমতের মাধ্যমে এদেশবাসী আর্যভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে। এই দুই মতবাদের উদ্ভব-ক্ষেত্র ছিল বিহার। আধুনিক বিহার গড়ে উঠেছে সেকালের অঙ্গ, বিদেহ ও মগধ রাজ্য নিয়ে। দেব-দ্বিজ ও বেদদ্বেষী জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মমত হচ্ছে আর্য ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অনার্য অভ্যুত্থান। গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং অনার্য বংশ-সস্তৃত; তা তার জন্মস্থান, বংশের নাম ও চেহারা থেকে বোঝা যায়। অনেক জৈন তীর্থঙ্করের জন্মস্থান, সাধনা আর প্রচারক্ষেত্রও বাঙলা দেশ তথা পশ্চিমবঙ্গ। অতএব কারুর অস্বীকৃতির আশঙ্কা না করেই বলা চলে, আজীবক ও জৈন-বৌদ্ধমত সম্বল করেই উত্তর-পূর্ব ভারতের আর্যভাষা ও সংস্কৃতি বাঙলা দেশে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে আর অশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েই তা স্থায়ী প্রতিষ্ঠা পায়। জৈনমত সম্ভবত উত্তর-পশ্চিমবঙ্গের বাইরে যায়নি, কিন্তু বৌদ্ধমত বাঙলার সর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে পাল আমলে বৌদ্ধমত রাজধর্মের মর্যাদা ও অধিকার পেয়ে বিচিত্র বিকাশের সুযোগ লাভ করে। এ কারণে পাল রাজত্ব বাঙলার ও বাঙালি সংস্কৃতির সোনার যুগ।
তাহলে আমরা অনুমান করতে পারি খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে বাঙলা দেশে আর্যভাষা চালু হয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এ ভাষার নাম রেখেছেন প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত। তাঁর অনুমান গৌতম ও মহাবীর এ ভাষায় কথা বলতেন। অতএব জৈন ও বৌদ্ধ শাস্ত্রে এ ভাষারই লিখিত রূপ পাই। আমরা জানি কোনো বুলিরই লেখ্য ও কথ্যরূপ এক হতে পারে না। লেখ্যভাষা গভীর ও বিচিত্রভাববাহী হয়ে শালীন ও মার্জিত রূপ ধারণ করে। এ যদি সত্য হয়, তাহলে এ সময়কার কথ্য প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত কিছুটা বিকৃত ছিলই। ডক্টর শহীদুল্লাহ্ সম্প্রতি অর্ধমাগধী ও মাগধী প্রাকৃতের সমস্তরের গৌড়ী প্রাকৃতকেই বিহারী, উড়িয়া ও বঙ্গকামরূপী বুলির জননী বলে সিদ্ধান্ত করেছেন। তার মতে :
আর জর্জ গ্রিয়ার্সন ও ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ভাষাতাত্ত্বিকগণের মতে মাগধী প্রাকৃত থেকেই বাঙলা ভাষার উদ্ভব। ডক্টর শহীদুল্লাহর গৌড়ী প্রাকৃতে ও অন্যান্য মাগধী প্রাকৃতে কেবল নামেই তফাৎ, কেননা ডক্টর শহীদুল্লাহ্ বিহারকে গৌড়ী- প্রাকৃতের আওতাভুক্ত করেছেন। অথচ এই বিহারের এক অংশই ছিল মগধ। বিশেষ করে তার গৌড়ী-প্রাকৃত এবং গিয়ার্সন ও সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের মাগধী প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত ভাষাগুলো অভিন্ন। তাঁর এই মত প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে তিনি মাগধী প্রাকৃতকে দেশছাড়া করেছেন, বেদিয়া-জিপসির ভাষাতেই খুঁজেছেন এই ভাষার জীবন্ত বিবর্তন। আর্যভাষা বাঙলা দেশে যখনই আসুক, এসেছে বিহার হয়েই। মৌর্য ও গুপ্তবংশের শাসন-কেন্দ্র আর্যাবর্ত ঘেঁষা বিহারের আর্যসংস্কৃতি পুষ্ট ও আভিজাত্য-গী অধিবাসীরা গৌড়ীয় আসুরিক ভাষার প্রভাবে পড়েছিল, এই কথা ভাবতে অদ্ভুত ঠেকে। এমনকি পাল আমলে বাঙলার সংস্কৃতি-কেন্দ্র ছিল বাঙলার বাইরে–বিক্রমশীলা, উড্ডিয়ানা ও নালন্দায়। কাজেই প্রাচ্য প্রাকৃতের আদি মঞ্জিল মগধের নামে একে মাগধী প্রাকৃত বলাই সঙ্গত। ভাষা হচ্ছে বহতা নদীর মতো; জনে জনে, যুগে যুগে ও অঞ্চলে অঞ্চলে তার বিচিত্র বিকৃতি ঘটেছে। সেই বিকৃতির উপর আত্যন্তিক গুরুত্ব আরোপ করেই° ডক্টর শহীদুল্লাহ গৌড়ী-প্রাকৃত কল্পনা করেছেন এবং দণ্ডী প্রমুখ পণ্ডিতের উক্তিতে সমর্থন খুঁজেছেন। আজকের বাঙলা দেশের আঞ্চলিক বুলিগুলোর ধ্বনি ও রূপে এত তফাৎ যে, এগুলো যে একই জননীর সন্তান তা প্রমাণ করা দুঃসাধ্য; তাই বলে কি আমরা প্রত্যেক অঞ্চলের জন্যে পৃথক প্রাকৃত, অপভ্রষ্ট ও অবহট্ঠ কল্পনা করব?
ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন, কথ্য সংস্কৃত হইতে কথ্য প্রাকৃত এবং তাহা হইতে বাঙলার উৎপত্তি। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে কথ্য সংস্কৃতের যে রূপ চলিত ছিল তাহা ক্রমে প্রাচ্য-প্রাকৃতে রূপান্তরিত হয় খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দের আগেই। এই প্রাচ্য-প্রাকৃত কালক্রমে বাঙলা-বিহার উড়িষ্যায় যে রূপ ধারণ করিয়াছিল, তাহাকেই বলা হয় প্রাচ্য অপভ্রংশ।
এই প্রাচ্য অপভ্রংশের অর্বাচীনরূপ অবহটঠ। অবহটঠ পরে (আনুমানিক ১০০০ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি) তিনটি আঞ্চলিক আধুনিক আর্যভাষায় পরিণত হয়। পশ্চিমে বিহারী, উত্তর-পশ্চিমে মৈথিলী এবং পূর্বে বাঙলার উড়িয়া। বিহারী ভাষা হইতে আধুনিক ভোজপুরী (পশ্চিম-বিহারে) ও মগহী (দক্ষিণ-বিহারে) আসিয়াছে। বাঙলা হইতে আরো পরে অসমীয়া উৎপন্ন হইয়াছে।
সংস্কৃত এ নামেই প্রকাশ এটি কথ্য হতে পারে না। এ বিষয়ে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতই সুচিন্তিত ও সুযৌক্তিক বলে মনে করি। তাঁর মতে লেখ্যবৈদিক ভাষার পাশে কথ্য যে সমকালীন ভাষা ছিল, সেই প্রাচীন বুলি থেকে ক্রমবিবর্তনে আমাদের বাঙলা ভাষা গড়ে উঠেছে। পীঠিকায় এরূপ দাঁড়ায়২৪ :
১. প্রাচীন ভারতীয় আর্য (১২০০ –৮০০ খ্র. পূ.)।
২ প্রাচীন ভারতীয় কথ্য আর্য বা আদি প্রাকৃত (৮০০ –৫০০ খ্রী. পূ.)
৩. প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত (৫০০ খ্র. পূ. –২০০ খ্র.)
৪. গৌড়ী প্রাকৃত (অপর মতে মাগধী) (২০০ –৪৫০ খ্র.)
৫. গৌড়ী অপভ্রংশ (অপভ্রষ্ট) (৪৫০ –৬৫০ খ্রী.)
৬. প্রাচীন বাঙলা যুগ (৬৫০ –১২০০ খ্রী.)
ডক্টর সুনীতকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে :
১. ১৫০০/১২০০ –৫০০ খ্র. পূর্বাব্দ। ২. ৬০০ –২০০ খ্র. পূর্বাব্দ। ৩, ২০০ খ্রী. পূ. –২০০ খ্রীস্টাব্দ ৪. ২০০ –৬০০ ৫. ৬০০-১০০০ ৬. ১০০০-১২০০
কথ্যভাষা বিভিন্ন স্তরের, গোত্রের ও অঞ্চলের লোকের মুখে বিচিত্র বিকৃতি লাভ করে। আর কথ্য ভাষা যখন লিখিতও হয়, তখনো কথ্য ও লেখ্য কথায় তফাৎ কম থাকে না। লিখিত কথ্যের ব্যাকরণ চেতনাজাত বিশুদ্ধি ও শব্দচয়ন ও বিন্যাস প্রসূত লাবণ্য কথ্য বুলিতে দুর্লভ এবং কথ্যভাষা বা বুলিই দ্রুত পরিবর্তনশীল। লেখ্য ভাষা কৃত্রিম উপায়ে অবিকৃত রাখার চেষ্টা চলে। তাই লেখ্য ভাষার রূপান্তর অত্যন্ত মন্থর। সেজন্যে আমাদের ধারণায় প্রাচীন ভারতিক কথ্য বুলি থেকে কথ্য প্রাচীন প্রাচ্য প্রাকৃত; তার থেকে কথ্য মাগধী প্রাকৃত এর গৌড়ীয় বিকৃতি, অপভ্রষ্ট; তার থেকে অর্বাচীন অবহটঠ, তার থেকে প্রাচীন বাঙলা, উড়িয়া ও আসামী ভাষা উদ্ভূত হয়েছে।
আমাদের বাঙলা কিংবা সংস্কৃত অবিমিশ্র আর্যভাষা নয়। অনেক অনার্য শব্দ, ধ্বনি, রূপতত্ত্ব বা পদরূপ Morphology ও বাক্যরীতি বা পদক্রম syntax এ ভাষা গোড়া থেকেই আত্মস্থ করেছে। এগুলোর উত্তরাধিকার তো রয়েইছে, তাছাড়া প্রাকৃত, অপভ্রষ্ট ও নব্য ভারতীয় বুলিও বিভিন্ন স্তরে নানা অনার্য উপকরণ-উপাদান নিয়ে হয়েছে পুষ্ট। এমনি করে সংস্কৃত যুগে উত্তরভারতীয় অনার্য, বিদেশী পহলভী ও গ্রীক শব্দ সংস্কৃত শব্দ-সম্ভারকে ঋদ্ধ করেছে। বাঙলায় এসব ছাড়াও দেশী কোল, দ্রাবিড়, মোঙ্গল, মুণ্ডা, বিদেশী ফারসি এবং এর মাধ্যমে আরবি ও তুর্কী; আর পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজি এবং এর মাধ্যমে ইয়োরোপীয় ল্যাটিন আদি যাবতীয় ভাষার শব্দ, একালে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠার ফলে পৃথিবীর উল্লেখ্য সব ভাষারই দু-চারটি করে শব্দ বাঙলা ভাষায় প্রবেশ করেছে বা করছে। বাঙলা শব্দসম্পদকে পাঁচ শ্রেণীতে ভাগ করে দেখানো হয়: তৎসম. (সংস্কৃত সম), তদ্ভব (সংস্কৃত জাত), অর্ধ বা ভগ্ন তৎসম (বিকৃত সংস্কৃত সম), দেশী (কোল, মুণ্ডা, দ্রাবিড়, মোঙ্গল) ও বিদেশী। এদের মধ্যে ফারসি শব্দের সংখ্যা প্রায় চার হাজার, এবং বাঙলা শব্দকোষের শতকরা চার ভাগ, ইয়োরোপীয় তথা ইংরেজি শতকরা প্রায় দুই ভাগ (চিকিৎসা ও যন্ত্রবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রায় পঞ্চাশ ভাগ)।
.
০২. – আশ্চর্যচর্যাচয় বা চর্যাগীতি
মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজ-গ্রন্থাগার থেকে এক পুথি আবিষ্কার করেন। এটি একটি পদ বা গীতির সঙ্কলন গ্রন্থ। প্রকাশকাল ১৩২৩ সন। পুথিটি মুনি দত্ত নামের এক পণ্ডিতের সংস্কৃত টীকা সম্বলিত। এই সঠিক গ্রন্থের টীকাকার-প্রদত্ত নাম চর্যাচর্যবিনিশ্চয় (অবস্য চর্যাচর্য বিনিশ্চয় রূপে লিপীকৃত)। এজন্যে পদসগ্রহের শুদ্ধ নাম আশ্চর্যচর্যাচয় ছিল বলে অনুমান করা হয়। আমাদের আলোচনার ভাষায় চর্যাগীতি বা চর্যাকোষ। সঙ্কলন গ্রন্থে মোট একান্নটি গান ছিল। মুনিদত্ত একটা বাদ দিয়েছেন। প্রাপ্ত পুথিতে তিনটি পদ খোয়া গেছে; অপর একটির অর্ধেক নেই। কাজেই সাড়ে ছেচল্লিশটি পদ ও তেইশ জন পদকারের নাম পাচ্ছি। তবে ভণিতায় যার নাম রয়েছে তিনিই রচয়িতা এমন অনুমান করা চলে না। কেউ কেউ গুরুর নামে ভণিতা দিয়েছেন। তা বুঝি নামের সঙ্গে গৌরবসূচক পা-এর যোগে। কতগুলি স্পষ্টতই ছদ্মনাম। যেমন কুকুরী, বীনা, তন্ত্রী, ডোম্বী, তাড়ক, কঙ্কন, শববৃ°। এঁদের কেউ কেউ প্রখ্যাত চোরাশী সিদ্ধার অন্তর্ভুক্ত (চোরাশী অঙুলি পরিমিত দেহে সাধনায় সিদ্ধ যে, সে-ই চোরাশী সিদ্ধা]।
চর্যাগীতি বৌদ্ধ মহাযান মতের উপশাখ তান্ত্রিক বজ্রযান সম্প্রদায়ের বামাচারী-সহজিয়া যোগী-শৈব পন্থের সাধন-ইঙ্গিত সম্বলিত রূপক রচনা। এতে তৎকালীন বিভিন্ন মতের মিশ্রণ ঘটেছে। এ রূপকাশ্রিত হেঁয়ালি সান্ধ্যভাষায় রচিত। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এর নাম দিয়েছেন আলো আঁধারী ভাষা। এই ধর্মমত, সাধনতত্ত্ব ও রচনারীতির অনুবর্তন রয়েছে নাথপন্থী, বৈষ্ণব সাহজিয়াং ও বাউলদের মধ্যে! গোরক্ষ-বিজয়ে, বৈষ্ণব সহজিয়া পদে ও বাউল গানে তা আজও সুলভ।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পরে বিজয় চন্দ্র মজুমদার, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মণীন্দ্র মোহন বসু, ডক্টর অবোধচন্দ্র বাগচি, ডক্টর বিনয়তোষ ভট্টাচার্য, ডক্টর সুকুমার সেন, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, সুখময় মুখোপাধ্যায় ও উড়িয়া-আসামী বিদ্বানেরা চর্যাগীতি সম্বন্ধে বিশেষ আলোচনা করেছেন। এঁদের মতে লঘু-গুরু অনৈক্য রয়েছে বহুবিষয়ে। ডক্টর সুনীতিকুমার ও তাঁর অনুসারীরা চর্যার ভাষার উপর গুরুত্ব আরোপ করে চর্যাগীতিকে দশ থেকে বারো শতকের রচনা বলে মত দিয়েছেন। ডক্টর শহীদুল্লাহ ও তাঁর মতের সমর্থকেরা তিব্বতী সূত্রে প্রাপ্ত চৌরাশী সিদ্ধার আবির্ভাবকালের উপর আস্থা রেখে মনে করেন সাত থেকে এগারো শতকের মধ্যেই চর্যাগীতি রচিত হয়েছিল।
রাহুল সাংকৃত্যায়নের পুরাতত্ত্ব নিবন্ধাবলী, বিনয়ভোষ ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস Dev-ther snon-Po-এর জর্জ রোরিককৃত অনুবাদ The Blue Annals আর Bu Ston Rin-Po. Che-এর E. Obermiller-কৃত অনুবাদের আলোকে সুখময় মুখোপাধ্যায় চর্যালেখক সিদ্ধাচার্যদের আবির্ভাবকাল নির্ণয় করতে প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর অনুমান ৭৫০-১০৫০ সনের মধ্যে চর্যাগীতিগুলো রচিত হয়েছিল। আমরাও তাঁর অনুমান যৌক্তিক বলে মনে করি।
.
০৩.
বাঙালিরা চর্যাপদকে বাঙলা বলেই জানে। এবং বারো শতক অবধি চর্যাপদের রচনাকাল বলে মানে। এর পরে তেরো শতক থেকে চৌদ্দশ পঞ্চাশের মধ্যেকার কোনো বাঙলা রচনার নিশ্চিত নিদর্শন মেলে না; তাই বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসকারগণ মনে করেন, এ সময় বাঙলার কিছুই রচিত হয়নি এবং তারা তুর্কী বিজয়কেই এজন্যে দায়ী করেন। তাঁরা বলেন, বিজয়ের ফলে দেড়শ দুশ কিংবা আড়াইশ বছর ধরে বাঙলা দেশে হত্যা ও ধ্বংসের তাণ্ডব লীলা চলে। তাদের জীবন জীবিকা এবং ধর্ম-সংস্কৃতির উপর বেপরওয়া ও নির্মম হামলা চলে। উচ্চবিত্ত ও অভিজাতদের মধ্যে অনেকেই মরল, কিছু পালিয়ে বাঁচল, আর যারা এর মধ্যে মাটি কামড়ে রইল, তারা ত্রাসের মধ্যেই দিন- রজনী গুনে গুনে রইল। কাজেই নতুন করে কিছু তো হলই না, সাহিত্য-সংস্কৃতির যা ছিল, তাও লোপ পেল। এই হল তাঁদের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত। এসব উক্তির মূলে যে কোনো তথ্য নেই, তা বাঙলার রাজনৈতিক ইতিহাসের সাহায্যেই প্রমাণ করা চলে।
এক, উত্তরভারতে আগেই তুকী বিজয় ঘটেছিল, সেখানে শতাব্দব্যাপী রক্ত ও আগুনের বিভীষিকার কথা শোনা যায় না; বাঙলা তো দিল্লীর সুলতানের অভিপ্রায় ক্রমেই বিজিত হয়। লক্ষণসেন বাধা দেয়ার চেষ্টা না করেই পালিয়ে গেলেন, কাজেই বখতিয়ার বিনাযুদ্ধেই পেলেন উত্তরবাঙলার অধিকার। যেখানে রাজা কিংবা প্রজা রুখে দাঁড়ায়নি, সেখানে অহেতুক পীড়ন চালানোর কথা নয়। প্রায় একশ বছরেরও অধিককাল ধরে তুর্কীরা বাঙলা দেশের এক তৃতীয়াংশেরও কম অঞ্চলেই আধিপত্য করেছে। পশ্চিমবঙ্গ ছিল উড়িষ্যার গঙ্গাবংশীয় রাজাদের শাসনে আর পূর্ববঙ্গও ছিল সেন-সামন্তদের অধীনে। বাঙলা ভাষায় তখন সাহিত্যরচনার রেওয়াজ থাকলে হিন্দুশাসিত এসব অঞ্চলের সাহিত্য পাওয়া যেত।
দুই, ১২০৪ থেকে ১৫৩৮ সন অবধি ৩৫৫ বছরের মধ্যে বিখতিয়ার খলজী থেকে গিয়াসুদ্দীন মাহমুদ শাহ্ ওর্কে আবদুল বদর অবধি, History of Bengal vol II-এর অনুসরণে] হিন্দু পীড়ক ও অত্যাচারী শাসক হচ্ছেন বখতিয়ার খলজী (১২০৪-০৬), আলী মর্দান (১২১০-১৩), মালিক তাজুদ্দীন আরসালান খান (১২৫৯-৬৫), সোনার গাঁয়ের ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ (১৩৩৮ ৫০) এবং শামসুদ্দীন মুজাফফর ওর্ফে সিদিবদর (১৪৯১-৯৩)। এঁদের রাজত্বকালে একুনে বিশ বছর। অবশিষ্ট ৩১৫ বছরের ফসল কী!
তিন, সেনরাজারা নিম্নবর্ণের লোকদের লেখাপড়া করার সুযোগ দেননি।
চার, ব্রাহ্মণ্যবাদী ও উচ্চবর্ণের বৌদ্ধেরা সংস্কৃতেই লিখতেন, তাই তুর্কী বিজয়ের আগেকার কোনো বাঙলা রচনার উল্লেখ কোথাও পাওয়া যায় না।
পাঁচ, শৌরসেনী ছাড়া অন্য কোনো অবহট্ঠেই লিখবার রেওয়াজ ছিল না। গৌড়ী অবহট্ঠে লিখবার রেওয়াজ চালু না হয়ে থাকলে বাঙলাতেও থাকার কথা নয়।
ছয়, এ সময় বাঙলা পদাদি রচিত হলে প্রাকৃত পৈঙ্গল ও সদুক্তি কর্ণামৃতে সংকলিত হত। অথবা এরূপ বাঙলা সংকলন থাকত।
সাত, মুসলমানেরা নিশ্চয়ই বেছে বেছে বাঙলা বইগুলোই নষ্ট করেনি, বাঙলায় বই থাকলে সেন-দরবারে রচিত কাব্য ও শাস্ত্রগ্রন্থের সঙ্গে এগুলোও থাকত। তুর্কী অধিকারেও নিশ্চয়ই সব বাড়ি ও সব মন্দির জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়া হয়নি। এছাড়া হিন্দুশাসিত অঞ্চল তো ছিলই।
আট, এ সময় বাঙলায় কিছু রচিত হলেও আগুন-পানি-উই-কীটে ধ্বংস করেছে অথবা জনপ্রিয়তা হারিয়ে তথা পাঠকের অভাবে অযত্নে লোপ পেয়েছে। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, শেখ শুভোদয়া বা চর্যাগীতির একাধিক পুথি পাওয়া যায়নি।
.
০৪.
এবার বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের কথায় আসা যাক। চর্যাগীতি যে বাঙলা এ বিশ্বাস থেকেই বাঙলা সাহিত্যের তামস-যুগ তত্ত্বের উদ্ভব। অথচ চর্যাগীতি যে প্রাচীন বাঙলা তা আজো সর্বজন-স্বীকৃত সত্য নয়। হিন্দি, মৈথিল, উড়িয়া, অসমীয়াও এর দাবীদার। ডক্টর শহীদুল্লাহ, ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর সুকামার সেন, অধ্যাপক প্রিয়রঞ্জন সেন প্রমুখ বাঙালি বিদ্বানেরাও ওদের দাবীর আংশিক স্বীকৃতি দিয়েছেন। সব সিদ্ধার বাড়ি বাঙলায় নয়, বাঙলা তখনো শালীন ও লেখ্য সাহিত্যের ভাষা নয়–আঞ্চলিক বুলি মাত্র। কাজেই উড়িষ্যা, মিথিলা কিংবা আসামের লোকের বাঙলা পদ রচনা করার তখনো সাধ-সাধ্য থাকার কথা নয়। অতএব মানতে হয় যে, চর্যাপদ অর্বাচীন প্রাচ্য (গৌড়ী?) অবহট্ঠে রচিত। সে সময় আঞ্চলিক বিকৃতিজাত সামান্য প্রভেদ থাকলেও উড়িয়া-বিহারী-বাঙলা-আসামী অবহট্ঠ মোটামুটি অভিন্ন ছিল। নাথ-সহজিয়া পন্থের অন্যতম প্রসারক্ষেত্র চন্দ্ররাজদের রাজ্য পূর্ববঙ্গ। কাজেই মানিকচাঁদ-ময়নামতী-গোপীচাঁদের দেশে (আধুনিক কুমিল্লাদি জেলা) বহুল চর্চার ফলে (নেপালেও চর্যাগীতি সম্ভবত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশাদি পূর্ববাঙলার লোকেরাই নিয়ে যান) চর্যাগীতিতে বঙ্গ-গৌড়ীয় বিকৃতি এসেছে। এতেই জোরালো হয়েছে বাঙলার দাবী।
মুনিদত্তের টীকাযুক্ত চর্যাগীতি নেপালে পাওয়া গেছে নেওয়ারী হরফে লিখিত পুথিতেই। বিদেশে বিভাষীর পক্ষে ভিন্ন ভাষার অলিখিত শাস্ত্রের চর্চা সম্ভব নয়। কাজেই চর্যাগীতি নেপালে স্বাভাবিকভাবেই লিখিত ও টীকা-সম্বলিত হয়েছে। কিন্তু আসাম-বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যাতেও তার লেখ্যরূপ ছিল বলে মনে করার সঙ্গত কারণ নেই। নাথ-সহজিয়া পন্থ যোগতান্ত্রিক বজ্রযান বৌদ্ধদের বিকৃত উপশাখা। কাজেই এই উপসম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা বেশি ছিল না এবং তারা স্বাভাবিক সামাজিক জীবন যাপন করেনি। অতএব সেকালের বাঙালি–বিহারী-আসামী-উড়িয়া সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বের দাবী বা যোগ্যতা এদের ছিল না। সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদীরা পাল আমলের মধ্যকাল থেকেই সংস্কৃত চর্চা করত। শাস্ত্রচর্চার ও শাসন পরিচালনের বাহন ছিল সংস্কৃত। তাই প্রাচ্য অবহটঠেরও লেখ্যরূপ মেলে না। গৌড়ী-মাগধী অবহট্ঠেই যদি লেখার রেওয়াজ না থাকে, তাহলে তখনো নিতান্ত অবজ্ঞেয় আঞ্চলিক মুখের বুলি আসামী-বাঙলা-উড়িয়া-বিহারীতেই বা লেখ্য রচনার সম্ভাব্যতা কোথায়? কাজেই এদেশে চর্যাগীতির কোনো লেখ্যরূপ ছিল না এবং এগুলো মুখে মুখে রচিত ও গীত লোকসাহিত্য বা লোকায়ত শাস্ত্ররূপেই চালু ছিল বলে আমাদের ধারণা।
অতএব আমাদের অনুমান এই যে, চর্যাগীতি লিখিত রচনাও নয়, বাঙলাও নয়–অর্বাচীন গৌড়ী-মাগধী অবহট্ঠ এবং মৌখিক রচনা। কেবল ডক্টর শহীদুল্লাহ আর ডক্টর সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ই নন, ডক্টর সুকুমার সেনও বলেছেন, অসমীয়া ভাষীদের দাবী অযৌক্তিক নয়, কেননা ষোড়শ শতাব্দী অবধি বাঙলা ও অসমীয়া দুই ভাষায় বিশেষ তফাৎ ছিল না এবং উড়িয়া আসামীদের সঙ্গে বাঙলার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। আদিতে এই তিনটি একই ভাষা ছিল। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতাব্দীর পর হইতে মূল ধারা হইতে ওড়িয়া বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে। কাজেই ভাষার এক সাধারণ স্তর থেকে বাঙলা, ওড়িয়া, মৈথিল ও অসমীয়ার উদ্ভব। ডক্টর সুকুমার সেন এর নাম দিয়েছেন প্রত্ন-বাঙলা-অসমীয়া-ওড়িয়া। এই সাধারণ স্তর আমাদের ধারণায় অর্বাচীন অবহট্ঠ বা আধুনিক ভাষাগুলোর লক্ষণ ফুটনকালীন অবহট্ঠ। অতএব চর্যাগীতি কেবল বাঙলার নয়, উক্ত অপর ভাষাগুলোরও সাধারণ ঐতিহ্য এবং এর ভাষা আলোচ্য সবকয়টি ভাষার জননী।
তবে অধিকাংশ চর্যাগীতি বাঙলা দেশের আবহে এবং বাঙালি র রচিত তাতে সন্দেহ নেই। বাঙলাদেশ, বঙ্গাল জাতি, পঁউয়া (পদ্ম) খাল, বঙ্গ প্রভৃতির উল্লেখ, সাধারণের প্রাত্যহিক জীবন থেকে নেয়া রূপপ্রতীক-তুলা-ধূনা, নৌকা চালান, মদ চোলাই করা, নদীঘাট থেকে জলভরা, সাঁকো তৈরি করা, দাবা খেলা, শবরবৃত্তি, গোয়ালবৃত্তি প্রভৃতির রূপক সেকালের নিম্ন ও নিঃস্ব শ্রেণীর সমাজ-চিত্র দান করছে। এমনটি বৈষ্ণব পদাবলীতেও মেলে না, সেখানে রাধা-কৃষ্ণ সমাজ ও বাস্তব জীবনকে আড়াল করে দাঁড়িয়েছেন।
ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্যশাসনের বাহন না হলে আগের যুগে কোনো বুলিই লেখ্য সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হত না। আদি যুগে সংস্কৃতই ছিল পাক-ভারতের ধর্মের, শিক্ষার, দরবারের, সাহিত্যের, সংস্কৃতির ও বিভিন্ন অঞ্চলে লোকের ভাব-বিনিময়ের বাহন। তাই কোনো অঞ্চলের মধ্যে আর্য-ভারতিক বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা কিংবা শালীন সাহিত্যের বাহন হবার সুযোগ পায়নি। বৌদ্ধ ও জৈন মত প্রচারের বাহনরূপেই প্রথম দুটো বুলি–পালি ও প্রাকৃত সাহিত্যিক ভাষার স্তরে উন্নীত হয়। তারপর অনেক কাল রাষ্ট্র শাসন কিংবা ধর্মপ্রচারের কাজে লাগেনি বলে আর কোনো বুলিই লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি। পরে সাহিত্যের প্রয়োজনে নাটকে শৌরসেনী, মারাঠী ও মাগধী প্রাকৃত ব্যবহৃত হতে থাকে। আরো পরে রাজপুত রাজাদের প্রতিপোষকতায় শৌরসেনী অপভ্রষ্ট বা অবহট্ঠ সাহিত্যের ভাষার রূপ পায়।
এর পরে মুসলমান আমলে ফারসি হল দরবারি ভাষা। মুসলিম ধর্ম ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে এদেশী জনজীবনে যে ভাববিপ্লব এল, বিশেষ করে তারই ফলে আধুনিক পাক-ভারতিক আর্যভাষাগুলোর দ্রুত সাহিত্যিক বিকাশ সম্ভব হল। এক্ষেত্রে ধর্মমত প্রচারের বাহনরূপেই সব কয়টি আঞ্চলিক বুলি লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হবার সৌভাগ্য লাভ করে। এ ব্যাপারে রামানন্দ, কলন্দর, কবীর, নানক, দাদু, একলব্য, রামদাস, চৈতন্য, রজব প্রভৃতি সন্তগণের দান মুখ্য ও অপরিমেয়।
এদিক দিয়ে পূর্বী বুলিগুলোর ভাগ্যই সবচেয়ে ভালো। এসব বুলি যখন সৃজ্যমান তখন এদের জননী অর্বাচীন অবহট্ঠ বৌদ্ধ বজ্রযান সম্প্রদায়ের যোগ, তন্ত্র ও শৈবমত প্রভাবিত এক উপশাখার সাধন-ভজনের মাধ্যম হবার সুযোগ পায়–যার ফলে আধুনিক আর্যভাষার (অবহট্ঠ থেকে ভাষাগুলোর সৃষ্টিকালের বা দুই স্তরের অন্তর্বর্তীকালের বা সন্ধিকালের) প্রাচীনতম নিদর্শন-স্বরূপ চর্যাগীতিগুলো পেয়েছি।
তুর্কী আমলে রাজশক্তির পোষকতা পেয়ে বাঙলা লেখ্য শালীন সাহিত্যের বাহন হল। আর এর দ্রুত বিকাশের সহায়ক হল–চৈতন্য প্রবর্তিত মত। আবার আঠারো-উনিশ শতকে খ্রীস্ট ও ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের, হিন্দু-সমাজ সংস্কারের এবং কোম্পানির শাসন পরিচালনের প্রয়োজনে বাঙলা গদ্যের সৃষ্টি ও দ্রুত পুষ্টি হয়। এসব আকস্মিক সুযোগ-সুবিধা পেয়েও বাঙলা ভাষা স্বাভাবিক ও স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করেনি, কারণ পর পর সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজির চাপে পড়ে বাঙলা কোনোদিন জাতীয় ভাষার বা সাংস্কৃতিক জীবনের প্রধান ভাষার মর্যাদা পায়নি। আজ অবধি বাঙলা একরকম অযত্নে লালিত ও আকস্মিক যোগাযোগে পুষ্ট।
শিক্ষার, সাহিত্যের ও দরবারের ভাষা শিক্ষিত লোকের ভাষা। সেকালে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা ছিল নগণ্য। কাজেই প্রাকৃতজন তাদের ভাব-ভাবনা ও অনুভূতি-উপলব্ধি প্রকাশ করত নিজেদের মুখের বুলিতেই। এভাবে তারা গান, গাথা, ছড়া, বচন ও রূপকথা-রসবার্তা তৈরি করে মুখে মুখে প্রচার করতে থাকে। বহু মুখের স্পর্শে ওগুলো রূপ ও রস বদলায়, ফলে ও-সবকে ব্যক্তির রচনা বলে চিহ্নিত করা যায় না। তাই আজকাল ঐ সাহিত্যকে গণরচনা বলে নির্দেশ করা হয়। আমাদের আধুনিক সংজ্ঞায় ঐগুলোই লোক-সাহিত্য বা পল্লী-সাহিত্য। আঞ্চলিক বুলিতে রচিত বলে লোক-সাহিত্য সাধারণত অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে দেশময় ব্যাপ্ত হতে পারত না। পল্লী-সাহিত্য সাহিত্য-সৃষ্টির সচেতন প্রয়াস-প্রসূতও নয়। তবু মানবমনের কোমল অনুভূতির আন্তরিক প্রকাশ বলেই এগুলো সুন্দর এবং স্থানে স্থানে শিল্পগুণে মণ্ডিত। মুখের বুলির পুষ্টি ও বিকাশ হয়েছে প্রাকৃতজনের রচনা লোক-সাহিত্যের মাধ্যমেই। বাঙলা লোক-সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে শেখশুভোদয়া ও প্রাকৃত পৈঙ্গলের কয়েকটা পদ, ডাক ও খনার বচন, ছড়া, প্রবচন, প্রবাদ, রূপকথা, উপকথা, ব্রতকথা, যোগাপাল-ভোগীপাল-মহীপাল গীত (অপ্রাপ্ত), ময়নামতী মানিকচাঁদ-গোপীচাঁদ গীত, মীননাথ, গোর্শ্বনাথ-হাড়িপা-কাহিনী, শিবের ছড়া, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, রাম পাঁচালি, ভারত কথা প্রভৃতি আর শিলা বা তাম্রলিপিতে এবং বন্দ্যঘটীয় সর্বানন্দের টীকা সর্বম্বে, সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে, শূন্য পুরাণে প্রাপ্ত কিছু শব্দ। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে ব্রাহ্মণ্য সমাজের কাহিনীগুলো রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত ও মঙ্গলকাব্যাদিতে পরিণতি লাভ করেছে। কিন্তু বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ কাহিনী ময়নামতী-গোপীচাঁদ কথা গাথা রূপেই রয়ে গেছে, এবং পালগীতি লোপ পেয়েছে।
অন্যান্য দেশের বুলি যেমন ধর্মমত প্রচারের বাহন বা রাজ্যশাসনের বাহন কিংবা প্রাকৃতজনের রচনার অবলম্বন হয়ে ক্রমে সাহিত্যের শালীন ভাষায় উন্নীত হয়েছে, বাঙলার বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। এখানে বলে রাখা ভালো, মুসলমান সুলতান-সুবেদারেরাও শাসিতদের জানবার ও শাসন পরিচালনার গরজেই বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির পোষকতা করেন। লেখ্য-ভাষা বইপত্র ছাড়া শেখা যায় না। কাজেই গ্রন্থ লিখিয়ে নিতে হল–ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যেমনটি হয়েছিল। আর ভাষার বুনিয়াদ দ্রুত গড়ে ওঠে এবং ভাষা পুষ্টি লাভ করে অনুবাদের মাধ্যমে! বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি।
অতএব আলোচ্য দুশ বছরের মধ্যেকার বাঙলা সাহিত্যের কোনো নিদর্শন না মেলার অনুমিত কারণ এই :
ক. ধর্মমত প্রচারের কিংবা রাজ্য শাসনের বাহন হয়নি বলে বাঙলা তুর্কী বিজয়ের পূর্বে লেখ্য-ভাষার মর্যাদা পায়নি।
খ ফলে, তেরো-চৌদ্দ শতক অবধি বাঙলা ভাষা উচ্চবিত্তের লোকের সাহিত্য রচনার যোগ্য হয়ে ওঠেনি। এ সময় প্রাকৃতজনের মুখে মুখে গান, গাথা ও ছড়া-পাঁচালিই চলত।
গ, সংস্কৃতের কোনো ভাষাতেই রস-সাহিত্য চৌদ্দ শতকের পূর্বে রচিত হয়নি। ভাষাকে লৌকিক দেবতার মাহাত্ম প্রচারের বাহনরূপেই প্রাকৃতজনেরা গ্রহণ করে। সাহিত্যের ভাষা তখনো সংস্কৃত ও প্রাকৃত ও শৌরসেনী অবহট্ঠই ছিল। ব্রাহ্মণ্যশাস্ত্র ভাষায় রচন, পঠন ও শ্রবণ ছিল নিষিদ্ধ। সংস্কৃতের মাধ্যমে বৌদ্ধশাস্ত্রেরও চর্চা প্রথায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আর অপরিণত বাঙলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির কল্পনা ও সম্ভাব্যতা কোনো উচ্চশিক্ষিত লোকের মনে জাগেনি। পাল ও সেন আমলে সংস্কৃত চর্চা হয়েছে এবং মুসলমান বিজয়ের পর প্রাকৃতজনেরা প্রশ্রয় পেয়ে বাঙলা রচনা করেছে মুখে মুখে। তাই লিখিত সাহিত্য অনেককাল গড়ে ওঠেনি। কিন্তু এতেই ভাষা বিকশিত হয়েছে; তার প্রমাণ মেলে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে তথা শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে। এ গ্রন্থেই দেখা যায়, ইতিমধ্যে এক ডজন ফারসি-তুর্কী শব্দ বাঙলা-সাহিত্যের ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে।
ঘ. তেরো-চৌদ্দ শতকে সংস্কৃতচর্চার কেন্দ্র ছিল হিন্দুশাসিত মিথিলায়। তাই এ সময় বাঙলা দেশে সংস্কৃতচর্চা বিশেষ হয়নি, কেবল কিছু কিছু শাস্ত্রগ্রন্থের অনুশীলন হয়েছিল। মিথিলার পণ্ডিত চক্ৰায়ুধের মৃত্যুর পর নবদ্বীপ সংস্কৃতচর্চার তথা শাস্ত্রচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠে।
ঙ, তর্কের খাতিরে যদি স্বীকারও করা যায় যে আলোচ্যযুগে বাঙলায় কিছু কিছু পুথিপত্র রচিত হয়েছিল, তাহলেও জনপ্রিয়তার অভাবে, ভাষার বিবর্তনে এবং অনুলিপিকরণের গরজ ও আগ্রহের অভাবে তা নষ্ট হয়েছে। যত্ন করে রক্ষা না করলে অপ্রিয় বা বাজে ছাপা বইও লোপ পায়। আগুন-পানি-উই-কীট তো রয়েইছে। কিন্তু আলোচ্য যুগে যে ভাষায় কিছু লিখবার রীতি ছিল না, তার বড় প্রমাণ পনেরো শতকের শেষাবধি নানা মঙ্গল গীতি, রামায়ণ গান, ভারত পাঁচালি এবং বিশ শতকেও পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়নামতীর গানের লিখিতরূপ পাওয়া যায়নি। অথচ এগুলো সুপ্রাচীন।
চ. আবার লিখিত হলেও কালে লুপ্ত হওয়ার বড় প্রমাণ চর্যাগীতি শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ (শ্রীকৃষ্ণকীর্তন), শেখশুভোদয়া প্রভৃতির একাধিক পাণ্ডুলিপির অভাব।
ছ. চর্যাগীতি রচনার শেষ সীমা যদি বারো শতক হয়, তাহলে তেরো-চৌদ্দ শতক বাঙলা ভাষার গঠন-যুগ তথা স্বরূপ প্রাপ্তির যুগ। কাজেই এ সময়ে কোনো লিখিত রচনা না থাকারই কথা। চর্যাগীতি ছাড়াও বারো শতকের বাঙলা-ঘেঁষা রচনার নমুনা মেলে শেখশুভোদয়ার আর্যার ও প্রাকৃত পৈঙ্গলের কোনো কোনো পদে। বাঙলা তখন সমাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠল, লক্ষণ সেনের সভায় আমরা বাঙলা কবিও দেখতে পেতাম। এবং পূর্ববঙ্গ ও রাঢ়ের মতো হিন্দুশাসিত অঞ্চলে তেরো শতকে লিখিত বাঙলা রচনার নিদর্শন পাওয়া যেত।
. জ. দেশজ মুসলমানের ভাষা চিরকালই বাঙলা। বাঙলায়-লেখ্য রচনার রেওয়াজ থাকলে তুর্কী বিজয়ের পূর্বের বা পরের মুসলমানের রচনা নষ্ট হবার কারণ ছিল না। এবং মুসলিম বিজয়ে তাদের মূৰ্ছাহত হবার কথাও নয় বলে তাদের রচনার ধারাবাহিকতা ছিন্ন হবার কারণ ঘটেনি। কেবল তা ই নয়, বাঙলা লেখ্য-ভাষা হলে গৌড় সুলতানের দরবারে রাজ্য-শাসনের প্রয়োজনে গোড়া থেকেই অন্তত বাঙলা ফরমান লিখিয়ে মুসলমান পাওয়া যেত। হিন্দুরা যে অশ্রদ্ধাবশত বাঙলায় কখনো সাহিত্য সৃষ্টি করতে চায়নি, লৌকিক দেবতার পূজা-প্রচার প্রয়াসীই ছিল, তার প্রমাণ রয়েছে আঠারো শতক অবধি লিখিত হিন্দুর রচনায়।
অত্যাচার যতই তীব্র হোক, তা দেড়শ-দুশ বছর অবধি চলতে পারে না। সাত-আট পুরুষ ধরে পীড়ন চালানোর পরেও দেশে হিন্দু প্রজা রইল; তাদের খাওয়া-পরার, বিয়ে করার আর ধর্মরক্ষার অধিকারও রইল; আর আনুষঙ্গিক উৎসব-পার্বণও চলছিল নিশ্চয়ই প্রাকৃত পৈঙ্গল, সদুক্তি কর্ণামৃতও সংকলিত হল এ-সময়ে; কেবল বাধা পেল গান-গাথা রচনায় ও কথকতায়–এমন অদ্ভুত ধারণা পোষণের জন্যে কল্পনার অতিপ্রাকৃত প্রসার প্রয়োজন। আমরা দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ আর দাঙ্গার দিনেও সাহিত্য রচিত হতে দেখেছি; পারিবারিক ও সামাজিক আনন্দ-উৎসবও চলতে দেখেছি অবাধে। সাত-আট পুরুষ ধরে মানুষ এস্ত ও স্তব্ধ থাকতে পারে না। বাঙলায় লিখিত রচনার রেওয়াজ থাকলে তার নিদর্শন আমাদের হাতে আসতই।
পরাধীনতার গ্লানি হিন্দুর মনে অবশ্যই ছিল। তেমন অবস্থায়ও যে উৎকৃষ্ট সাহিত্য রচিত হতে পারে তার সাক্ষ্য রয়েছে উনিশ-বিশ শতকের বাঙলা সাহিত্যে। বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের যে চারশ বছরেও আশানুরূপ উন্নতি ও বিকাশ হয়নি, বাঙলা দরবাবি কিংবা জাতীয় ভাষার মর্যাদা পায়নি বলেই।
অতএব আমাদের অনুমান এই যে : বাঙলা বারো, তেরো ও চৌদ্দ শতকের মধ্যভাগ অবধি লেখ্যভাষার স্তরে উন্নীত হয়নি। এই হচ্ছে বাঙলার স্বাকার প্রাপ্তির কাল ও মৌখিক রচনার যুগ।
.
০৫.
বাঙলা সাহিত্যের পরিচয় পেতে হলে বাঙালি র পরিচয় নিতে হবে। নইলে এ সাহিত্যের স্বরূপ ধরা যাবে না।
আর্যেরা ছিল প্রাকৃত শক্তির পূজক। তাদের প্রভাবেই হয়তো এদেশে প্রাকৃত শক্তিকে জয় করবার প্রয়াস বিশেষ দেখা যায়নি। সে-শক্তিকে তোয়াজে তুষ্ট রেখে জীবন যাপনের চেষ্টাই হয়েছে চিরকাল। অরি ও ইষ্ট শক্তির পূজাই বাঙালি র ধর্ম। বাঙলা দেশের ভোগেছু অনার্য মানস একান্তভাবে জীবনমুখী। তাই এদেশে বৃহৎ ও মহৎ আদর্শচেতনা কিংবা আধ্যাত্মবোধ তত তীব্র ছিল না কখনো, যত প্রবল ছিল জীবনোপভোগের প্রয়াস। উপনিষদের মহৎ বাণী, নির্বাণের সূক্ষ্মতত্ত্ব কিংবা গীতার জীবনবোধ বা শঙ্করের জ্ঞানবাদ তাদের নিশ্চিন্ত করতে পারেনি। তাই এদেশে বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ্য ও ইসলামি আদর্শ এত বিকৃত হয়েছে! অনার্য বাঙালি র প্রাচীন বিশ্বাস-সংস্কারই বারবার বহিরারোপিত শাস্ত্র ও নীতিবোধের উপর জয়ী হয়েছে। বাঙালি ভোগেচ্ছ কিন্তু কর্মকুণ্ঠ, তাই দৈবশক্তি ও তুকতাকের উপরই তার ভরসা। পৌরুষ প্রয়োগে তার উদ্যোগ কম। ইহ জীবনবাদী এসব মানুষের দেবতাও ইহকালীন জীবন-বিধাতা। মনসা, শীতলা, শনি প্রভৃতি অরি দেবতার পূজায় যেমন একদিকে পার্থিব অকল্যাণ এড়ানোর ভরসা পেয়েছে; তেমনি লক্ষ্মী, চণ্ডী, ধর্মঠাকুর, সত্যনারায়ণ প্রভৃতির সেবায় সুখ, শান্তি ও ঐশ্বর্যের আশ্বাস লাভ করেছে। তাই ইহলৌকিক ও পরলৌকিক জীবনের নিয়ন্ত্ৰী মহৎ ধর্মশাস্ত্রে তারা খেই পায়নি।
অতএব আদিকাল থেকেই দেখা যাচ্ছে কোনো বহিরারোপিত ধর্মমত বা জীবনাদর্শ বাঙলা দেশে টেকেনি, বাঙালি রা সবসময় নিজেদের জীবন-জীবিকার গরজমত ধর্মমত ইষ্টদেবতা এবং জীবনদর্শন তৈরি করে নিয়েছে। যখনই জীবন-জীবিকায় বিপর্যয় বা বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে তখনই বাঙালি নিজের পসন্দমতো দৈব আশ্রয় খুঁজেছে।
এতে বাঙালি চরিত্রের স্বরূপ ধরা পড়েছে। সাহিত্য মানুষের মানস-মুকুর। তাই সাহিত্য থেকেই জাতির অকৃত্রিম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। বাঙলা সাহিত্যে বাঙালি চরিত্রের যেরূপ প্রতিফলন হয়েছে, তাতে নানা বিরুদ্ধ-গুণের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। ভাবপ্রবণতা ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, ভোগলিপ্সা ও বৈরাগ্য, কর্মকণ্ঠা ও উচ্চাভিলাষ, ভীরুতা ও অদম্যতা, স্বার্থপরতা ও আদর্শবাদ, বন্ধন ভীরুতা ও কাঙালপনা প্রভৃতি দ্বান্দ্বিক গুণই বাঙালি চরিত্রের বৈশিষ্ট্য।
আমাদের মধ্যযুগীয় পাঁচালি সাহিত্যে বিশেষ করে বাঙালি র এই চরিত্র–এই মানসই ফুটে উঠেছে। আমাদের সাহিত্যে তাই ইষ্ট-দেবতাই প্রধান হয়ে উঠেছেন। কারণ তিনি জীবন-জীবিকার অবলম্বন। তবু তার প্রাণপ্রাচুর্যের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে তার স্বধর্মে সুস্থিরতায়। বহিরাগত কোনো ধর্ম, কোনো নীতি-আদর্শ সে মনেপ্রাণে বরণ করে নেয়নি। সে তর্ক করে, যুক্তি মানে, কিন্তু হৃদয়ানুভূতি গোচর না হলে কিছুই গ্রহণ করে না। তাই সে মুখে বড় বড় বুলি আওড়ায় কিছু আচরণে প্রয়োজনকেই কেবল স্বীকৃতি দেয়।
ভাবপ্রবণ বলেই বাঙালি মুখে আদর্শবাদী ও বৈরাগ্যধর্মী, কিন্তু প্রবৃত্তিতে সে আধ্যাত্মবাদীর ভাষায় বস্তুবাদী, গণভাষায় জীবনবাদী এবং নীতিবিদের ভাষায় ভোগবাদী। এজন্যেই নৈরাশ্য ও নিরীশ্বরবাদী নির্বাণকামী বৌদ্ধধর্ম বাঙালি স্বীকার করে নিলেও বৌদ্ধচৈত্য হয়ে উঠেছিল দেবদেবীর আখড়া।
বৌদ্ধযুগে নির্বাণের জন্যে নয়–অমরত্বরও চিরসুখের প্রত্যাশায় সুকঠোর যোগতান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমে দৈবশক্তিধর হয়ে নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘ্নে জীবনোপভোগের প্রয়াসী হয়ে উঠল বাঙালি। মহাজ্ঞান, তুকতাক, ডাকিনী-যোগিনী প্রভৃতির দ্বারা সিসম ফাঁক আয়ত্ত করে খিড়কীদের দিয়ে জীবনের ভোগ্য সম্পদ আহরণের অপপ্রয়াসই তাদের কর্মাদর্শ বা জীবনের লক্ষ্য হল। যোগ ও সাংখ্য–এই দুই অনার্য দর্শনজাত যোগতান্ত্রিক সাধনাই হল একশ্রেণীর লক্ষ্য। এরই নমুনা পাচ্ছি। চর্যাগীতিতে।
পাল আমল এমনি করেই কাটল। আবার সেন আমলে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রসার লাভ করে তখন বাঙালি বাহ্যত ব্রাহ্মণ্য মতবাদ গ্রহণ করল। কিন্তু মায়াবাদ, পরব্রহ্মপ্রীতি, জীবাত্মা পরমারাত্মার রহস্য প্রভৃতিতে তার কোনো উৎসাহ ছিল না। তাই নিজের জীবনের নিরাপত্তা ও ভোগের দেবতা সৃষ্টি করে সে আশ্বস্ত হয়। এভাবে সে চণ্ডী, মনসা, শীতলা, ষষ্ঠী, শনি, লক্ষ্মী, সরস্বতী প্রভৃতি দেবতার পূজা দিয়ে জীবন ও জীবিকার ব্যাপারে হয় নিশ্চিত। জয়দেবের গীতগোবিন্দই প্রমাণ করে যে, এ সময় বৈষ্ণব মতবাদও জনপ্রিয় হয়ে উঠে, যদিও ব্রাহ্মণ্যবাদ দৃঢ়মূল করবার জন্যে সমাজকাঠামো স্থায়ীভাবে তৈরি করবার প্রয়াসে সেন রাজারা উচ্চবর্ণের লোক আমদানি করে কৌলীন্যপ্রথা প্রবর্তনে তৎপর হয়ে ওঠেন।
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এই লৌকিক দেবতারা তার পরলৌকিক মুক্তির কিংবা আত্মিক বা আধ্যাত্মিক জীবন উন্নয়নের কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন না। ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন, সেন-রাজাদিগের সময় হইতেই ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও সংস্কৃতি সাধারণের মধ্যে বিস্তৃত হইতেছিল সত্য, কিন্তু এতকালের একটা দেশীয় ধর্ম-সংস্কৃতিও–যাহা জাতির একেবারে মজ্জাগত হইয়া পড়িয়াছিল–মুখ্যত না হউক গৌণত হইলেও এই সমাজ-দেহেই রহিয়া গেল। সেকালের বাঙালি হিন্দুর সামাজিক জীবনের এই সন্ধিযুগে, দেশীয় প্রাচীন সংস্কার ও ব্রাহ্মণ্যধর্মের নতুন আদর্শ–এই উভয়ের সংঘাত মুহূর্তে বাঙলা পুরাণ ও মঙ্গলকাব্যগুলি সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করিয়াছিল। তাহারা (বাঙালি রা) নূতনকে (ব্রাহ্মণ্যধর্মকে) যেভাবে গ্রহণ করিল, তাহা পুরাতনেরই রূপান্তর মাত্র হইল। এই দেশীয় প্রচলিত ধর্মসংস্কারই যুগোচিত-পরিমার্জনা মাত্র লাভ করিয়া সমাজের অন্তঃস্থলে প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজ করিতে লাগিল। মঙ্গলকাব্যগুলি এই নূতন ও পুরাতনের মধ্যে সুন্দর সামঞ্জস্য বিধান করিয়া দিয়া পরস্পরমুখী দুইটি সংস্কারকে একসূত্রে গাঁথিয়া দিবার চেষ্টা করিয়াছে। বাঙলার জলবায়ুতে দেশীয় লৌকিক সংস্কারের সহিত ব্রাহ্মণ্য সংস্কার যে কীভাবে একদেহে লীন হইয়া আছে, মঙ্গলকাব্যগুলি পাঠ করিলে তাহাই জানিতে পারা যায়। ….. তাহারই ফলে বর্তমান বাঙলার। হিন্দুসমাজের পঞ্চোপাসক হিন্দুসম্প্রদায়ের সৃষ্ঠি।
একই কারণে ইসলামোত্তর যুগে বিশেষত মুঘল আমলে বাঙলাদেশে হিন্দুর পুরোনো দেবতা ও ইসলামের নির্দেশকে ছাপিয়ে ওঠেন সত্যপীর-সত্যনারায়ণ, বনদেবী-বনবিবি, কালুগাজী কালুরায়, বড় খাঁ গাজী-দক্ষিণরায়, ওলাবিবি-শীতলা প্রভৃতি জীবন ও জীবিকার এবং নিরাপত্তা ও কল্যাণের ইষ্ট ও অরিদেবতা। মধ্যযুগে চৈতন্য প্রবর্তিত প্রেমধর্ম এবং গত শতকের রামমোহন প্রচারিত ব্রাহ্মমত এবং শিক্ষিত সাধারণের পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনানুগত্য বাঙালি র এই বন্ধনমুক্ত মনোভাবের ধারা অব্যাহত রেখেছে। অতএব কোনো বৃহৎ ও মহতের সাধনা বাঙালি র কোনোকালে ছিল না। সে একান্তভাবে জীবনসেবী ও ভোগবাদী। এ ব্যাপারে সে আত্মপরমাত্মাকে তুচ্ছ জেনেছে, স্বর্গ-নরককে করেছে অবহেলা। বৈষ্ণব সমাজের বিকৃতিও এই একই মানসের ফল। এ কারণে বাঙলার সংস্কৃতি চিরকালই পনেরো আনা বাঙালি সংস্কৃতি। চন্দ্ৰশাসনে ও পাল আমলে বৌদ্ধদের যোগতান্ত্রিক সাধনায় আগ্রহের প্রমাণ মেলে চর্যাগীতিতে, ডাকিনী ও যোগিনীর কিংবদন্তিতে, ময়নামতি-মাণিকাদ-গোপীচাঁদ গাথায়, গোরক্ষ-বিজয় প্রভৃতি পাচালিতে এবং যোগীপাল, মহীপাল, ভোগীপাল গীতির ঐতিহ্যে। [যোগী, মহী ও ভোগী নামেতেই রূপকাশ্রিত তত্ত্ব-সিদ্ধান্তের আভাস রয়েছে।]
সেনদের স্বল্পকাল রাজত্বের সময়কার শূন্য-পুরাণতত্ত্বে, শেখ-শুভোদয়ায়, গীত-গোবিন্দে ব্রাহ্মণ্য-বিকৃতি লক্ষণীয়। রাজধর্মে ও ক্ষাত্রশক্তিতে এসেছিল শিথিলতা। মন্ত্রতন্ত্র প্রভৃতি আধিদৈবিক শক্তির উপর একান্ত নির্ভরতা এ যুগের প্রাসাদ ও কুটির বাসীর চিত্ত-দৌর্বল্যের সাক্ষ্য দিচ্ছে। বৌদ্ধদের উপর এ সময়ে উৎপীড়ন চলছিল; নিরঞ্জনের রুম্মাই তার সাক্ষ্য। বৌদ্ধেরা তখন শৈব, সহজিয়া, নাথযোগী ও ধর্মপন্থী হয়ে হিন্দুসমাজে আত্মগোপন করতে প্রয়াসী হয়। সেন আমলে নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও দুর্ভোগের সীমা ছিল না। এ সময়ে শূদ্রমাত্রেরই উচ্চশ্রেণীর লেখাপড়ার অধিকার কাড়িয়া লওয়া হইল। … এই জনসাধারণ অজ্ঞ ও মূর্খ রহিয়া গেল। দেশীলোক ও দেশী ভাষার প্রতি অবজ্ঞাবশে সেনেরা বিদেশী ব্রাহ্মণ আনয়নে এবং সংস্কৃত-চর্চার প্রসারে উৎসাহী ছিলেন। এসব কারণে বাঙলাভাষায় লিখিত সাহিত্য সৃষ্টি হতে দেরি হল অনেক। তার জন্যে তুর্কী বিজয়ের প্রয়োজন ছিল। কাজেই তুর্কী বিজয়ে কেবল সধর্মীদেরই পীড়নমুক্তির নিশ্বাস পড়েনি, বাঙলা ভাষারও সুদিনের শুরু হয়েছে। তুর্কী অধিকারে সেন-আমলের বৈষম্যমূলক শাসন রহিত হয়। রাজ্য শাসনে ও রাজস্বব্যবস্থায় এমনকী সৈনাপত্যেও হিন্দুর প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। অধিকাংশ আফগানই তাঁহাদের জায়গীরগুলি ধনবান হিন্দুর হাতে ছাড়িয়া দিতেন। … এই জায়গীরগুলির ইজারা সমস্ত ধনশালী হিন্দুরা লইতেন এবং হঁহারাই ব্যবসায় বাণিজ্যের সমস্ত সুবিধা ভোগ করিতেন। বাঙলা দেশে পাঠান প্রাবল্যের যুগ এক বিষয়ে বাঙলার ইতিহাসে সর্বপ্রধান যুগ। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু স্বাধীনতার সময়ে বঙ্গদেশে সভ্যতার যে শ্রী ফুটিয়া উঠিয়াছিল এই পরাধীন যুগে সেই শ্ৰী শতগুণে বাড়িয়া গিয়াছিল। … এই পাঠান যুগে সর্বপ্রথম হিন্দুসমাজে নূতন বিক্ষোভ দৃষ্ট হইল। জনসাধারণের মধ্যে শাস্ত্রগ্রন্থের অনুবাদ প্রচারিত হওয়াতে তাহারা গরুড় পক্ষী হইয়া ব্রাহ্মণের নিকট করজোড়ে থাকিতে দ্বিধাবোধ করিল। ব্রাহ্মণেরা বাধ্য হইয়া শাস্ত্রগ্রন্থ বাঙলায় প্রচার করিলেন; তাহারা ঘোর অনিচ্ছায় ইহা করিয়াছিলেন। এই অনুবাদ কার্য শেষ করিয়া তাঁহারা শাস্ত্রের অনুবাদক ও শ্রোতাগিদের বাপান্ত করিয়া অভিশাপ দিতে লাগিলেন, অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানি চ। ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। একদিকে মুসলমান ধর্মের প্রভাব, অপরদিকে বাঙলা ভাষায় ধর্ম প্রচার–এই দুই কারণে বঙ্গীয় জনসাধারণের মন নব্যভাবে জাগ্রত হইল। শাসন ও রুচি হইতে মুক্ত হইয়া চিন্তাজগতে হিন্দুরাজগণ তান্ত্রিক হইয়া পড়িল। ব্রাহ্মণেরাও রাজ্য শাসন হইতে মুক্তি পাইয়া অবাধে স্বীয় মত সমাজে চালাইতে লাগাইলেন। এই পাঠান-প্রাধান্য যুগে চিন্তাজগতে সর্বত্র অভূতপূর্ব স্বাধীনতার খেলা দৃষ্ট হইল। এই স্বাধীনতার ফলে বাঙ্গালার প্রতিভার যেরূপ অদ্ভুত বিকাশ পাইয়াছিল, এদেশের ইতিহাসে অন্য কোনোও সময়ে দ্রুপ বিকাশ সচরাচর দেখা যায় নাই।
অনার্য সংস্কার বশে নিম্নশ্রেণীর জনগণ কীভাবে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য যুগে রাজশক্তির প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নিজেদের পূর্বতন ধর্ম, আচার ও সংস্কার জিইয়ে রেখেছিল, তা আমরা দেখেছি। বৌদ্ধ তারিতা, বজ্রতারা, অবলোকিতেশ্বর শিব কিংবা ধর্মঠাকুর লোক-মানস প্রশ্রয়ে বৌদ্ধ আবরণে যেমন পূজিত হয়েছেন, তেমনি ব্রাহ্মণ্য যুগে তাঁরা যথাক্রমে মনসা, চণ্ডী, লৌকিক বিষ্ণু, শিব, ধর্মঠাকুররূপে নতুন পোশাকে হিন্দুদেবতা রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন; নাথ ও সহজিয়াপন্থও বৌদ্ধ এবং হিন্দুর সাম্প্রদায়িক মত রূপে গৃহীত হয়। এসব সুপ্রাচীন মতের উদ্ভবের স্থান ও কাল সম্বন্ধে মতভেদ আছে। তবে এগুলো যে অতি প্রাচীন অনার্য মানস-সদ্ভূত ও জাদুবিশ্বাস যুগের সৃষ্টি তাতে কেউ সন্দেহ পোষণ করে না।
বৌদ্ধ-হিন্দু যুগে রাজশক্তির বিরূপতায় বহিরাগত বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যবাদী আর্যদের মধ্যে তথা অভিজাত ও উচ্চবর্ণের মধ্যে এসব লৌকিক মত ও দেবতার প্রতিষ্ঠা ছিল না। তুর্কী আমলে রাজভয় থেকে মুক্ত হয়ে জনসাধারণ উচ্চবিত্তের সমাজেও তাদের ধর্ম ও দেবতার সার্বভৌম প্রতিষ্ঠাদানে প্রয়াসী হয়। এ কারণেই তখন থেকে শুরু হয় দেব-মানবের সংগ্রাম। রবীন্দ্রনাথ বলেন, এককালে পুরুষ-দেবতা যিনি ছিলেন; তাঁর বিশেষ কোনো উপদ্রব ছিল না। খামকা মেয়ে দেবতা জোর করে এসে বায়না ধরলেন, আমার পূজা চাই। অর্থাৎ যে-জায়গায় আমার দখল নাই সে-জায়গা আমি দখল করবই। তোমার দলিল কী? গায়ের জোর। কী উপায়ে দখল করবে? যে উপায়েই হোক। তারপর যে-সকল উপায় দেখা গেল মানুষের সদ্বুদ্ধিতে তাকে সদুপায় বলে না। কিন্তু পরিণামে এইসকল উপায়ের জয় হল। ছলনা, অন্যায় এবং নিষ্ঠুরতা কেবল মন্দির দখল করল তা নয়, কবিদের দিয়ে মন্দিরা বাজিয়ে চামর দুলিয়ে আপন জয়গান গাইয়ে নিলেই। মনসা চাঁদের দ্বন্দ্ব, কালকেতু-ধনপতির উপর চণ্ডীর অহেতুক নির্যাতন ও অনুকম্পা, লাউসেনের সৌভাগ্য, ঈছাই ঘোষের বিপর্যয় প্রভৃতি এরই ফল। কবিরাও স্বপ্নদিষ্ট হয়ে মহিমা কীর্তনে তৎপর হয়েছেন। পাঠক-শ্রোতাও বংশনিপাতের ভয়ে শ্রদ্ধা নিয়ে পঠন-শ্রবণে মনোযোগী হয়েছে। এমনি করে উচ্চবর্ণের লোকেরা লৌকিক দেবতার কাছে হার মেনেছে। বাঙলা সাহিত্যের বারোআনা রচনাই নিয়োজিত হয়েছে এই লৌকিক দেবতার প্রতিষ্ঠা প্রয়াসে।
এভাবে তেরো-পনেরো শতকের মধ্যে বাঙলার নিম্নবর্ণের গণদেবতা জাতীয় ইষ্টদেবতার মর্যাদায় উন্নীত হলেন। তখন এসব লৌকিক দেবতায় আভিজাত্য দানের জন্যে আর্যীকৃত প্রাচীন দেবতা সূর্য ও শিবের সঙ্গে এদের সম্পর্ক পরিকল্পিত হল। এভাবে ধর্মঠাকুর হলেন স্বয়ং সূর্য; চণ্ডী বা কালী হলেন শিবপত্নী; মনসা, লক্ষ্মী, সরস্বতী হলেন শিবকন্যা।
কাজেই বৌদ্ধযুগ থেকেই লৌকিক দেবতার পূজা-পদ্ধতি ও মাহাত্ম্য-কথা মুখে মুখে চালু ছিল। পাল আমলের শেষের দিকে তাঁদের কেউ কেউ পৌরাণিক মর্যাদা লাভ করেন এবং তুর্কী শাসনকালে নির্বিঘ্ন প্রচার পেয়ে উন্নীত হন জাতীয় দেবতার স্তরে, সে-সঙ্গে তাদের মাহাত্ম্য-কথাও বৈচিত্র্য এবং বিপুলতা লাভ করে। চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকালে তাই —
ধর্ম কর্ম লোক সবে এই মাত্র জানে
মঙ্গলচণ্ডীর গীত করে জাগরণে।
দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোনো জন
পুত্তলি করএ কেহ দিয়া বহু ধন।
বাশুলী পূজএ কেহ নানা উপহারে
মদ্য মাংস দিয়া কেহ যক্ষ পূজা করে।
যোগিপাল ভোগিপাল মহীপাল গীত
ইহা শুনিবারে সলোক আনন্দিত।
কিন্তু পাল আমলে অবহট্ঠে কিংবা সেন আমলের বাঙলা বুলিতে এগুলো লিখিত হয়নি। একে তো সেনরাজারা নিম্নবর্ণের লেখাপড়া শেখার বিরোধী ছিলেন, তার উপর সমাজের উচ্চবিত্তের লোকেরা রাজশক্তির প্রভাবে পড়ে লৌকিক দেবতা ও প্রাকৃতজনের ভাষা এড়িয়ে চলতেন এবং তাঁদের সংস্কৃত-প্রীতিও এসময়ে বিশেষভাবে বৃদ্ধি পেল; তাই জয়দেব, সন্ধ্যাকর নন্দী, সর্বানন্দ,– হলায়ুধ মিশ্র, ঘোয়ী, মুরারি মিশ্র প্রভৃতি অবহটঠের বাক্-রীতিতে রচনা করেছেন সংস্কৃত।
কাজেই বাঙলায় লেখার রেওয়াজ যত আগে চালু হওয়া সম্ভব ছিল, তত আগে হয়নি। তবে এই সময়ে মনসার কাহিনী, ধর্মের কাহিনী, চণ্ডীর কাহিনী ইত্যাদি দেশীয় বস্তু এবং রামায়ণ কাহিনী, কৃষ্ণলীলা কাহিনী ইত্যাদি পৌরাণিক বস্তু ছোট বড় গানে অথবা পাচালিতে বাদ্য ও নৃত্যের যোগে পরিবেশিত হইত গ্রামোৎসবে অথবা দেবপূজা উপলক্ষে দেবমন্দিরে। ….. রামায়ণ মহাভারত কাহিনী ও কৃষ্ণলীলা গান রাজসভায় ও সামন্তসভায় প্রধানভাবে অনুশীলিত ছিল। সমাজের নিম্নস্তরে অর্থাৎ দেশী-ভাষাবলম্বী লোকসাহিত্যে বিশেষভাবে কৃষ্ণের ব্রজলীলা এবং মনসা চণ্ডী ধর্মদেবতার মাহাত্ম্য কাহিনী প্রচলিত ছিল। এই অনুমানের সমর্থন মিলে ভাষাতত্ত্বের সাহায্যে। যুধিষ্ঠির অর্জুন ভীম দ্রেীপদী দশরথ রাম সীতা ইত্যাদি মহাভারত রামায়ণ কাহিনীর নামগুলি তৎসম (সংস্কৃত) রূপেই প্রচলিত। কিন্তু কানু বা কানাই (কৃষ্ণ), রাই (রাধিকা), আয়ান (অভিমন্যু), গোই, গুই (গোপী, গোপিকা), ফুল্লরা, খুল্লনা (ক্ষুদ্র), লহনা (লোভনা), বেহুলা (বিহ্বলা) ইত্যাদি নামগুলি, তদ্ভবরূপেই মিলিতেছে। ইহা হইতে এ অনুমান অপরিহার্য যে শেষের সব কাহিনী ধারাবাহিকভাবে প্রাকৃত অপভ্রংশ অবহট্ঠ ও প্রাচীন বাঙ্গালার মধ্যে দিয়াই আসিয়াছে।
লিখিত বাঙলা সাহিত্য
বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ দেব-গাথাগুলো পাঁচালি পর্যায়ে উন্নীত হয়ে লিখিত রূপ পায়নি। কিন্তু হিন্দু দেব-কাহিনী চৌদ্দ শতক থেকে লিখিত রূপ পেতে থাকে। মানিকদত্ত, কানাহরি দত্ত প্রভৃতির নামসার স্মৃতি থেকে এবং শূন্য পুরাণের ভাষার কাঠামো থেকে এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের (শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ) পুঁথি প্রাপ্তি থেকে আমরা তা অনুমান করতে পারি। আমরা নাথ কাহিনী-বিধৃত সমাজ পরিবেশের আভাস থেকেও আমাদের এ অনুমানের সমর্থন পাই। লিখিত বাঙলা সাহিত্যের নিদর্শন হিসেবে তথা আদি বাঙলা কাব্য হিসেবে শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা কাহিনী স্বীকৃতি পাচ্ছে সম্প্রতি। কিছুটা তথ্য ও কিছুটা অনুমানের উপর নির্ভর করে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক মনে করেন এটি সুলতান গিয়াসুদ্দিন আযম শাহের আমলে (১৩৮৯-১৪১০) রচিত হয়। ভাষা কিন্তু শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মতো প্রাচীন নয়। তবে শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ের ভাষা স্মরণে রেখে এর প্রাচীনত্ব স্বীকার করতে দ্বিধা হয় না।
মহানরপতি গ্যেছ পিরথিম্বীর সার।
ঠাঁই ঠাঁই ইচ্ছে রাজা আপনা বিজএ
পত্র সিস্য হন্তে তিই মাগে পরাজএ।
মোহাজন বাক্য ইহ পুরন করিয়া
লৈলেন্ত রাজ্যপাট বঙ্গাল গৌড়িয়া।
এর মধ্যেই সোনারগাঁয়ের যুদ্ধে পিতৃহন্তা গিয়াসুদ্দীন আযম শাহকে নির্দেশ করা হয়েছে বলে ডক্টর হক অনুমান করেছেন।
লিখিত বাঙলা সাহিত্যের সর্বজন-স্বীকৃত আদি নিদর্শন হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। এটি সম্পাদক প্রদত্ত নাম। রচয়িতা বাসুলীর সেবক অনন্ত বড় চণ্ডীদাস। আনুমানিক রচনাকাল চৌদ্দ শতকের শেষার্ধ বা পনেরো শতকের প্রথমার্ধ। জয়দেবের গীতগোবিন্দেই প্রথম রাধাকৃষ্ণলীলার পর্বানুগ বিভাগ লক্ষ্য করা যায়। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রসানুগ লীলাবিভাগ এবং পর্ব বিন্যাস রয়েছে। এতে ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক রাগানুগ সুফী সাধনা-পদ্ধতির প্রভাব লক্ষ্য করেছেন। তবে এসময়ে যে শাসক-শাসিতের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল, তার, আভাস পাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের সাহিত্যিক ভাষায় তুর্কী-ফারসি-আরবি শব্দের মিশ্রণে। এই রাধাকৃষ্ণলীলা মহাভারতীয় নয়, লৌকিক কাহিনী প্রসূত। আভীর জাতির লোকগাথার নায়ক কৃষ্ণ কালে লোকস্মৃতিতে মহাভারতের নায়ক কৃষ্ণের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে ওঠেন। নয়-দশ শতক থেকেই এ লীলার লিখিত সাক্ষ্য মেলে। যদিও লৌকিক ধামালী ভিত্তি করেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের গীতিনাট্য রচিত এবং এর সঙ্গে বৈষ্ণবীয় রাধাকৃষ্ণ লীলাতত্ত্বের ভাব ও তত্ত্বগত তফাৎ বিস্তর, তবু পরবর্তী বৈষ্ণবতত্ত্বে ও সাহিত্যের এ গ্রন্থের প্রভাব বিপুল। এটি পৌরাণিক আবরণে লৌকিক প্রণয়-কাহিনী। নায়ক দেবকল্প বলে মধ্যে মধ্যে আধ্যাত্মিকতার আভা আছে। কেবল পদাবলী নয়, রাধাকৃষ্ণ লীলারস কল্পনাও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আদলে গড়ে উঠেছে। রূপ-সনাতন-জীব-রঘুনাথ আদি গোস্বামীর তাত্ত্বিক রচনায় এর প্রভাব দৃশ্যমান। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন মূলত আধ্যাত্মিকতা বর্জিত আদিরসাত্মক রচনা হলেও এর বিশেষ গুরুত্ব অবশ্য স্বীকার্য। এটি গীতিনাট্য, বিভিন্ন ছন্দ ও রাগ-রাগিণীযুক্ত এবং ভাষা প্রাথমিকতার আড়ষ্টতা মুক্ত। এতে বোঝা যায়, এর আগে মুখে মুখে বাঙলা ভাষা শব্দে সমৃদ্ধি এবং প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেছে। অবশ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনও মূলত লোকসাহিত্য এবং কথকতারই লেখ্যরূপ। তাই বক্তব্যের ভাষা ও ভঙ্গি প্রায়ই পৌনপুনিকতা দোষে দুষ্ট।
এর পরের রচনা হচ্ছে কৃত্তিবাসের রামায়ণ। আমাদের অনুমান কৃত্তিবাস রুকনউদ্দীন বরবক শাহর প্রতিপোষণ পেয়েছিলেন, যেমন পেয়েছিলেন গুণরাজখান মালাধর বসু। কৃত্তিবাসের বিকৃত আত্মবিবরণীর অংশ পাওয়া গেছে। তা দিয়ে তার পৃষ্ঠপোষক রাজা ও সময়কাল নিয়ে পণ্ডিতে পণ্ডিতে লড়াই চলছে গত ষাট বছর ধরে। কৃত্তিবাসী রামায়ণ অতি জনপ্রিয় গ্রন্থ। তাই ভাষায় প্রাচীনতার কোনো ছাপ রক্ষিত হয়নি। বাঙালি র ধর্মবোধ মহাভারত প্রভাবিত এবং বাঙালি র উপর রামায়ণের ধর্মাচরণ সংপৃক্ত প্রভাব নিতান্ত সামান্য। বাঙলাদেশে রাম-মন্দির নেই। কোথাও কোথাও প্রথা-রক্ষাগোছের রামনবমী উদযাপিত হয়। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাঙালি হিন্দুর কাছে রামকে একান্ত আপন করে তুলেছে। বাঙালি হিন্দুর পারিবারিক জীবনে রয়েছে এর সর্বাত্মক প্রভাব। বাঙালি হিন্দুর জীবনের আদর্শ হচ্ছে রামায়ণের পাত্রপাত্রীগণ। তাছাড়া আধুনিক হিন্দুর সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং মননের উৎস হয়েছে রামায়ণ আর মহাভারত।
রামায়ণ তিনটে স্বাধীন কাহিনীর সমষ্টি। যোগসূত্র কেবল নায়ক রাম। প্রথমটিতে ঘরোয়া জীবনে ঈর্ষা-অসূয়া জাত বিপর্যয়, দ্বিতীয়টিতে গৃহবিবাদে বা ভ্রাতৃবিরোধকালে রাষ্ট্রিক জীবনে পরাশ্রিত হওয়ার পরিণাম এবং তৃতীয়টিতে দর্প ও দাপট বশে নারী সম্পর্কে নীতিভ্রষ্টতার পরিণাম স্বতোউঘাটিত। অবশ্য আর্য গৌরবগবী কবি বাল্মীকি স্বগণ-ও স্বদেশদ্রোহী সুগ্রীব-বিভীষণকে অনুগতের সম্মান দিয়েছেন যেমনটি সাম্রাজ্যবাদী-সম্প্রসারণবাদীরা এ-যুগে দিয়ে থাকে।
মালাধর বসু বরবক শাহর আগ্রহে ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশের অনুসরণে শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা করেন। বরবক শাহ তাঁকে গুণরাজ খান উপাধি দিয়েছিলেন। কবি বলেছেন :
স্বপ্নে আদেশ দিলেন প্রভু ব্যাস।
তাঁর আজ্ঞামত গ্রন্থ করিনু রচন।
আদিযুগে হিন্দুরা বাঙলা লিখতে গিয়ে সমাজের ভয় করেছেন। তাই স্বপ্নে প্রাপ্ত দেবাদেশের দোহাই পেড়েছেন, মুসলমানেরা করেছেন পাপের ভয়, তাই পাপ-ভয় খণ্ডন করতে চেয়েছেন যুক্তি দিয়ে। আর একটি তথ্য এই :
পুরান পড়িতে নাই শূদ্রের অধিকার
পাঁচালি পড়িয়া তর এ ভব সংসার।
পাঁচালি লেখার সাহস ও পড়ার এই অধিকার তুর্কী শাসনের দান।
কবি বলেছেন –ভাগবত শুনিল আমি পণ্ডিতের মুখে।
লৌকিকে কহিয়ে সার বুঝ মহাসুখে ॥
কাব্যরচনার কাল–তেরশ পঁচানই শকে গ্রন্থ আরম্ভন।
চতুর্দশ দুই শকে হৈল সমাপন ॥
১৩৯৫-১৪০২ শক বা ১৪৭৩-১৪৮০ খ্রীস্টাব্দ। অতএব গ্রন্থ বরবক শাহর আমলে শুরু হয়ে সমাপ্ত হয় ইউসুফ শাহর আমলে। কবি ছিলেন বর্ধমানের কুলীন গ্রামবাসী কায়স্থ।
জৈনুদ্দীন নামের এক কবির রসুল বিজয় কাব্যের খণ্ডাংশ পাওয়া গেছে। এতে রসুলের সঙ্গে ইরাকরাজ জয়কুমের কাল্পনিক যুদ্ধকথা বর্ণিত হয়েছে। ভণিতায় রাজর, সুনায়ক ও রাজেশ্বর ইউসুফ খানের প্রশস্তি আছে। কেউ কেউ এই ইউসুফ খান ও সুলতান শামসুদ্দীন ইউসুফ শাহকে অভিন্ন মনে করেন।
এরপরে পাচ্ছি বিজয়গুপ্তের পদ্মাপুরাণ বা মনসার ভাসান। বরিশালের ফুল্লশ্রী গায়ের কবি বিজয়গুপ্ত —
ঋতু শূন্য বেদ শশী পরিমিত শক।
সুলতান হোসেন সাহা নৃপতিতিলক ॥
–এই শ্লোকে কাব্যরচনাকাল নির্দেশ করেছেন। এতে ১৪০৬ শক বা ১৪৮৪-৮৫ সন মেলে। অতএব এই হোসেন শাহ আসলে সুলতান জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ যার সাধারণ্যে ডাক নাম ছিল হোসেন শাহ। এঁর কোনো কোনো মুদ্রায় হোসেন শাহী কথাটি লেখা রয়েছে।
বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল কাব্য হিসেবে সুন্দর ও সুখপাঠ্য। বিদ্যাপতি কীর্তিলতায়, বিজয়গুপ্ত তাঁর মনসামঙ্গলে, জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গলে একইভাবে হিন্দুর উপর মুসলমানের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়েছেন, এতে মনে হয়, শাসক-শাসিতের সম্পর্কসূচক একটা গাধা কথা সর্বত্র চালু হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যাপতি মিথিলার হিন্দুরাজার আশ্রয়পুষ্ট কবি। মুসলমান অত্যাচারের কাহিনী তাঁর কাছে শোনা কথা-মাত্র। অথচ কীর্তিলতার বর্ণনা দেখে মনে হয় তার চারপাশে এমনি ঘটনা অহরহই ঘটছে এবং তিনি নিজেও সে বিভীষিকায় ত্রস্ত। বিজয়গুপ্ত হাসন হোসেন পালায় একইরূপ অত্যাচার কাহিনী বর্ণনা করেছেন; অথচ তিনিই গ্রন্থের অন্যত্র বলেছেন, রাজার পালনে প্রজা সুখ ভুঞ্জে নিত এবং ফুলিয়া গাঁয়ের হিন্দু ও মুসলমান সবাই সজ্জন এবং সুখে বাস করে। জয়ানন্দও চৈতন্যদেবের অনেক পরে জন্মগ্রহণ করেও চৈতন্য-সমকালে হিন্দুপীড়নের বাঁধাগতে বর্ণনা দিয়েছেন অথচ চৈতন্যভাবগত কিংবা চৈতন্যচরিতামৃতে তেমনটি নেই।
পনেরো শতকের অপর কবি হচ্ছেন মনসা বিজয় রচয়িতা বিপ্রদাস পিপিলাই। তিনি ছিলেন পশ্চিমবাঙলার কোনো অঞ্চলের বাদুড্যা বা নাদুড্যা গ্রামবাসী। তাঁর গ্রন্থ রচনাকাল —
সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ
নৃপতি হোসেন শাহা গৌড়ের প্রধান।
এতে ১৪১৭ শক ১৪৯৫ খ্রীস্টাব্দ হয়।
এই হোসেন শাহ অবশ্য সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)।
বৈষ্ণব সাহিত্য
বাংলার ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষা-সাহিত্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চৈতন্যদেবের আবির্ভাব।
মুসলমানদের সিন্ধু বিজয়ের ফলে নূতন জাতি, সমাজ ও সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিন্দুসমাজে যে মানস-আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল এবং এই বিদেশী, বিজাতি, বিধর্মী ও বিভাষীর ধর্মাদর্শ, বৈষম্য-মুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা ও মানবিকতার মোকাবেলা করতে গিয়ে হিন্দুসমাজে যে বিপর্যয় দেখা দিল, তার সমাধান খুঁজলেন শঙ্কর তাঁর জ্ঞানবাদ বা মায়বাদ বলে পরিচিত অদ্বৈততত্ত্বে। ইসলাম অধ্যাত্ম হেঁয়ালি-মুক্ত প্রত্যক্ষ জীবনের ব্যবহার বিধি। একেশ্বরবাদ তার শিক্ষার উৎস। শঙ্করের বৈরাগ্যবাদে বাস্তব জীবনের গুরুত্ব অস্বীকৃত রইল বটে, তবে অদ্বৈতবাদের আবরণে একেশ্বরবাদে ও মানবিক যুক্তিবাদে আস্থা রেখে ইসলামের মোকাবেলায় তিনি এগিয়ে এলেন। তাঁর এ মতবাদ জীবনচর্যার সহায়ক না হলেও সেদিন একদিকে ইসলামের প্রসার রোধে এবং অপরদিকে বৌদ্ধ উচ্ছেদে ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রাবল্যের সহায়ক হয়েছিল। এবং তাঁর দর্শনের পরোক্ষ প্রভাবে অর্থাৎ অদ্বৈত তত্ত্বের ভিত্তিতে দাক্ষিণাত্যে ভক্তিবাদ প্রসার লাভ করতে থাকে। ভাস্করের ভেদাভেদবাদ, রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, মধ্বের দ্বৈতবাদ, নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদ ও বল্লভের শুদ্ধাদ্বৈতবাদ এ ধারার বিকাশ ও বৈচিত্রের ফল। একেশ্বরবাদ, ভক্তিবাদ, বৈষ্ণব ধর্ম ও শৈব ধর্মের জন্ম হল দ্রাবিড় দেশে। নবীন ইসলামধর্মের সঙ্গে নব্য হিন্দুধর্মের ঘাত প্রতিঘাতের ফলেই দক্ষিণভারতে এই নূতন ধর্মের সমন্বয় ও সংস্কৃতি সমন্বয়ের ধারা প্রবর্তিত হয়েছে। …. ইসলামের এক দেবতা ও এক ধর্মের বিপুল বন্যার মুখে দাঁড়িয়ে শঙ্কর আপসহীন অদ্বৈতবাদ প্রচার করেছেন। …… ইসলাম ধর্মের প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে শঙ্করাচার্যের কেবলাদ্বৈত্য বাদ থেকে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ও নিম্বার্কের দ্বৈতাদ্বৈতবাদের প্রগতির ধারা বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার বিষয়।…. ইসলামের আত্মনিবেদন, ইসলামের প্রেম, ইসলামের সমানাধিকার ও সাম্যের বাণী, ইসলামের গণতন্ত্রের আদর্শ মুসলমান-সাধকেরা সহজ ভাষায় সোজাসুজি যখন এদেশে প্রচার করছেন; রামানুজ ও নিম্বার্ক তখন শঙ্করের শুদ্ধজ্ঞানের স্তর থেকে শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রীতির স্তরে নেমে এলেন।
মুসলিম বিজয়ের পরে উত্তরভারতেও ইসলামের সাম্যবাদ ও উদার মানবিকতা নিম্নশ্রেণীর নিপীড়িত জনমনে নতুন আশা জাগাল, এক নয়া সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে গেল তাদের সামনে। তারা বুঝল জন্মসূত্রে নয়, যোগ্যতা দিয়েই হবে জীবন নিয়ন্ত্রিত। তখন স্বধর্মে সুস্থির থাকা তাদের পক্ষে আর সম্ভব হল না, আবার ইসলাম গ্রহণেও ছিল সমাজ-সংস্কারের বাধা। ফলে ঘরের বাঁধন হল আলগা, কিন্তু গন্তব্য ছিল না স্থির, তাই দেখা দিল পথ চলে পথের দিশা পাওয়ার প্রয়াস।
রামানন্দ, কবীর, নানক, একলব্য, দাদু, রামদাস প্রভৃতি সন্তদের ধর্মান্দোলনের ব্যবহারিক উদ্দেশ্য ছিল বর্ণভেদ লোপ, সমাজে ও শাস্ত্রে নিম্নবর্ণের অধিকার প্রতিষ্ঠা আর মনুষ্য-সত্তায় মর্যাদা দান এবং সে-সঙ্গে শাসক-শাসিতের মধ্যে প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্যে ধর্ম সমন্বয় ও ঐক্যের বাণীও প্রচারিত হল। এরূপে দক্ষিণভারতে ভক্তিবাদের ও উত্তরভারতে সন্তধর্মের উদ্ভব ঘটে ইসলামের প্রত্যক্ষ প্রভাবে।
বাঙলা দেশে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের অব্যবহিত পূর্বে ইসলামের প্রভাবে হিন্দুসমাজে যে ভাঙন ধরে তা রোধ করবার জন্য স্মার্ত রঘুনন্দন, রঘুনাথ শিরোমণি প্রভৃতি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে ব্রতী হন। তারা শাস্ত্রের উদার ও শিথিল ব্যাখ্যায় জনচিত্ত আকর্ষণে প্রয়াসী হলেন। সমাজে নতুন মেলবন্ধনের সাড়াও পড়ে গেল। এই প্রতিরোধমূলক আন্দোলনের প্রতি জনমনে আস্থা সৃষ্টির জন্যে গৌড়ে ব্রাহ্মণ রাজা হবে হেন আছে বলে ভবিষ্যদ্বাণীও রটিয়ে দেয়া হল, তবু এতে ভাঙন রোধ করা গেল না দেখে চৈতন্য দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের সন্তদের অনুসরণে এখানেও ভূক্তিধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হলেন। চৈতন্যের সাধনাতেই ভক্তি প্রেমরূপে মহিমান্বিত হল।
১৪৮৬ খ্রীস্টাব্দে চৈতন্যদেবের জন্ম হয় নবদ্বীপে এবং ১৫৩৩ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যু ঘটে। চৈতন্যদেব অল্প বয়সেই পাণ্ডিত্য, তর্কপটুতায়, চরিত্র-মাধুর্যে ও ব্যক্তিত্বে নদীয়ার গুণী-জ্ঞানী বয়স্কদেরও শ্রদ্ধা আকর্ষণ করেন। তাঁর পিতামহের বয়সী অদ্বৈতাচার্য, বয়োজ্যেষ্ঠ রামানন্দ প্রমুখ গুণীব্যক্তিদের আনুগত্যই তার প্রমাণ। যখন তিনি হরি সংকীর্তনের মাধ্যমে তাঁর নব মতবাদ প্রচারে ব্রতী হয়েছেন, তখন তাঁর বয়স বিশ-বাইশের বেশি নয়। এতেই তাঁর প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের অসামান্যতা বোঝা যায়। মুসলিম রাজশক্তি পাছে তার উদ্দেশ্য সিদ্ধির অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, এই ভয়ে তিনি হিন্দুরাজ্যান্তৰ্গত নীলাচলে গিয়ে আখড়া করলেন। পদস্থ রাজ-কর্মচারী রূপ-সনাতন প্রমুখ অনেক গুণী-জ্ঞানী তাঁর শিষ্য হয়ে দেশে দেশে নতুন প্রেমধর্ম প্রচারে ব্রতী হলেন। বাঙলা দেশে অদ্বৈতাচার্য ও রামানন্দ রয়ে গেলেন তার প্রতিনিধিরূপে। বাস্তব জীবনকে আড়াল করে চৈতন্যদেব এক অধ্যাত্ম-মনোজীবন সৃষ্টির প্রয়াসী ছিলেন। এ কারণেই সম্ভবত বাঙলায় বৈষ্ণব মতবাদ বিশেষ প্রসার লাভ করেনি।
কিন্তু বৈষ্ণবসাহিত্য একসময়ে জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মনে রসের তরঙ্গ তুলেছিল। মুসলমান সুলতান-সুবাদারের প্রতিপোষণে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের বুনিয়াদ তৈরি হয়, আর বৈষ্ণব রচনার দ্বারা ভাষা ও সাহিত্যের দ্রুত প্রসার ও বিকাশ ঘটে। কেবল সাহিত্য সৃষ্টি ও ভাষার পুষ্টির ক্ষেত্রেই নয়, সামগ্রিকভাবে বাঙলার ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি এবং মননেও এর প্রভাব ও দান অপরিমেয়। পরবর্তীকালের পাশ্চাত্য প্রভাবের বিপুলতা ও বৈচিত্রের সঙ্গেই কেবল এর তুলনা চলতে পারে। বৈষ্ণবের প্রেমবাদের মাধ্যমে নরে নারায়ণ ও জীবে ব্রহ্ম-দর্শনের দীক্ষা পেল বাঙালি। এই প্রীতিধর্মের প্রভাবে বাঙালি র মানবতাবোধ হল তীব্র, তীক্ষ্ণ ও উদ্দীপ্ত। ষোলো শতক তাই বাঙালি র ও বাঙলা সাহিত্যের রেনেসাঁসের যুগ। বৈষ্ণব ধর্মান্দোলনের ফলে এদেশের হিন্দু মুসলমান বৈষ্ণব মতবাদ গ্রহণ করে। এ মতবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে সহজিয়া ও বাউল মতবাদ পুষ্ট হয়। বৈষ্ণব-তত্ত্বের প্রত্যক্ষ প্রভাবে শাক্ত-সম্প্রদায়ে ভক্তিবাদ প্রবল হয়ে ওঠে এবং প্রধানত বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্ত পদাবলী রচিত হয়। মুসলমানেরাও রাধাকৃষ্ণকে আত্মা-পরমাত্মা, দেহ মন এবং ভক্ত-ভগবানের রূপক হিসেবে গ্রহণ করে পদ রচনা ও আস্বাদন করেছে। লৌকিক প্রণয়গীতিতেও নায়িকা অর্থে রাই এবং নায়ক অর্থে কালা সাধারণভাবে গৃহীত হয়েছে। ব্রজবুলি নামে একটি কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষার সৃষ্টিও হয় এ সময়ে। ভাগবতাদির কথা বাদ দিলে চোখে দেখা রক্ত-মাংসের মানুষের চরিতাখ্যান রচনাও শুরু হয় এ সময় থেকেই। বাঙলায় গীতিকবিতা রচনার এবং অলঙ্কার ও দর্শনশাস্ত্রের আলোচনার সূত্রপাতও করেন বৈষ্ণবেরাই। বৈষ্ণবীয় ভক্তি ও উদার মানবিকতার প্রভাবে কুর, নিষ্ঠুর, ঈর্ষা ও প্রতিহিংসাপরায়ণ লৌকিক দেবতাও বৈষ্ণবোত্তর যুগে উদার কৃপাশীল এবং ভক্তবৎসল রূপে চিত্রিত হয়েছেন।
চৈতন্যপূর্ব যুগের রাধাকৃষ্ণলীলার পদকার ছিলেন সংস্কৃতে জয়দেব এবং বাঙলায় বড়চণ্ডীদাস, মিথিলার বিদ্যাপতি, হোসেন শাহর কর্মচারী যশোরাজ খান এবং ত্রিপুরার রাজপণ্ডিত। চৈতন্যোত্তর যুগে প্রায় দশ হাজারের মতো বাঙলা ও ব্রজবুলি পদ রচিত হয়েছে, তার মধ্যে পাঁচ-ছয়শ পদই গীতিকবিতা হিসেবে উৎকর্ষ লাভ করেছে, বাকি পদগুলো পুচ্ছগ্রাহিতা দোষে দুষ্ট ও কৃত্রিম অনুশীলনে আড়ষ্ট। মিথিলার কবি বিদ্যাপতির পদও বাঙালি র মুখে মুখে বাঙলা পদে পরিণত হয়েছে। ফলে বিদ্যাপতিও এখন বাঙলার ও বাঙালি র প্রিয় কবি।
বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দ দাস, জ্ঞান দাস, বলরাম দাস, রামানন্দ বসু, বংশীবদন, জগদানন্দ, বৃন্দাবন দাস, লোচন দাস, বাসুদেব ঘোষ, মুরারি গুপ্ত, নরহরি দাস, নরোত্তম দাস প্রভৃতি এবং মুসলমানদের মধ্যে ফয়জুল্লাহ, সৈয়দ সুলতান, আলাউল ও সৈয়দ মর্তুজা শ্রেষ্ঠ পদকার। প্রেমানুভূতির ও প্রেমের আনুষঙ্গিক ভাবের সূক্ষ্ম ও বিচিত্র অভিব্যক্তির আধার হয়ে পদাবলী হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে অতুল্য।
চৈতন্যদেবের বাঙলা জীবনীগ্রন্থের মধ্যে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত (১৫৪১-৪২) এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের চৈতন্য চরিতামৃত (১৫৬০-৮০) শ্রেষ্ঠ। চরিতামৃতের মূল্য বৈষ্ণবতত্ত্বগ্রন্থ হিসেবেই সমধিক। লোচনদাসের চৈতন্য মঙ্গলও জয়ানন্দের চৈতন্য মঙ্গল (১৫৫০-৬০) অতিরঞ্জিত বর্ণনায় দুষ্ট। চূড়ামণি দাসের গৌরাঙ্গ বিজয়ের খণ্ডাংশও সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়া বৈষ্ণব মোহান্ত তথা চৈতন্য পার্ষদাদির জীবনীগ্রন্থও আছে–অদ্বৈত মঙ্গল, অদ্বৈত প্রকাশ ও সীতা চরিত্র প্রভৃতি। সতেরো শতকে রচিত হয় প্রখ্যাত প্রেম বিলাস, বীর রত্নাবলী, রসিক মঙ্গল, জগদীশ বিজয়, অনুরাগ বল্লী, অভিরাম লীলামৃত প্রভৃতি; আবার আঠারো শতকে পাচ্ছি চৈতন্য চন্দ্রোদয় কৌমুদী, উদ্ধব দাসের ব্রজমঙ্গল, ভক্তিরত্নাকর, নরোত্তম বিলাস প্রভৃতি।
॥ মহাভারত।
আগেই বলেছি বাঙালি হিন্দুর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক নীতিবোধের সঙ্গে সঙ্গতি রয়েছে বলে রামায়ণ বা রাম পাঁচালি তাদের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মহাভারত যদিও ব্রাহ্মণ্য ধর্মাদর্শের কুঞ্জী তবু তা ধর্মাদর্শের উঁচু মঞ্চ থেকে সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের ক্ষেত্রে নেমে আসেনি। কেননা মহাভারতের কুন্তী, দ্রৌপদী, ভীষ্ম, কর্ণ প্রভৃতির কাহিনী এবং অন্য নানা উপকাহিনী বাঙালি র নীতিবোধের অনুকূল নয়। তাই গোটা মহাভারত অনেককাল বাঙলায় অনূদিত হয়নি। পরেও তুলনায় কম হয়েছে। অথচ আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের বারোআনা উপকরণই মহাভারতীয়। রাজকীয় কূটনীতি ও যুদ্ধশাস্ত্র সম্বলিত হওয়ায় মহাভারত রাজা ও রাজপুরুষদের প্রিয় ছিল। এরূপ কৌতূহলই ছিল পরাগল ও ছুটি খানের। তাই অশ্বমেধাদি পর্বই তাঁরা শুনতে চেয়েছেন। কামতা দরবারেও তাই এর আধিক্য দেখতে পাই। পরাগল পরমেশ্বরকে বলেছেন :
কুতুহল বহুল ভারত কথা শুনি
কেমতে পাণ্ডবে হারাইল রাজধানী।
বনবাসে বঞ্চিলেক দ্বাদশ বৎসর …
কেমত পৌরুষে পাইল নিজ বসুমতী
এহি সব কথা কহ সংক্ষেপ করিয়া
দিনেকে শুনিতে পারি পাঁচালি পড়িয়া!
তাই এর কাব্যের নাম পাণ্ডব বিজয়।
বাঙলা ভাষায় আদি মহাভারত অনুবাদক কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী। গৌড় সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহর উত্তর-চট্টগ্রামস্থ সেনানী শাসক পরাগল খানে (আনু. ১৫১৩-৩২) আগ্রহে পরমেশ্বর সংক্ষেপে মহাভারত কাহিনী বর্ণনা করেন এবং সম্ভবত তাঁর পুত্র নসরত খানের ওরফে ছুটিখানের প্রবর্তনায় শ্রীকর নন্দী অনুবাদ করেন অশ্বমেধ পর্ব। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে শ্রীকর নন্দীর আদেষ্টাও পরাগল–ছুটিখান নন।
মহাভারতের তৃতীয় অনুবাদক সম্ভবত রাঢ় অঞ্চলের রামচন্দ্র খান। ইনি সম্ভবত ১৫৫২-৫৩ সনে তার কাব্য রচনা করেন। এ তিনজনের কাব্য অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। বাঙলা দেশের সর্বত্র এঁদের পুথি পাওয়া গেছে। সম্ভবত সতেরো শতকের কবি কাশীরাম দাসের মহাভারত এঁদের কাব্যযশ ম্লান করে দেয়।
কামতা-কামরূপের রাজসভায় মহাভারতের চর্চা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। অনেক কবিই বাঙলায় মহাভারত অনুবাদ করেছেন বিভিন্ন রাজা ও রাজকুমারের আগ্রহে। কামতা-কামরূপের রাজা বিশ্বসিংহের পুত্র সমরসিংহের অভিপ্রায় অনুসারে কবি পীতাম্বর উষাপরিণয় (১৫৩৩) ও নলদময়ন্তী (১৫৪৪) রচনা করেন। দুটোই যথাক্রমে বিষ্ণু পুরাণ, ভাগবত ও মহাভারত অবলম্বনে রচিত। পীড়াম্বর মার্কণ্ডেয় পুরাণ কাহিনীও (১৫০৩) বাঙলায় লিখেছিলেন। এছাড়া কামতা কামরূপের পরবর্তী রাজা শুক্লধ্বজের সভাকবি অনিরুদ্ধ মহাভারত, তাঁর পুত্র গোপীনাথ মহাভারতের দৌণপর্ব এবং অনিরুদ্ধের জ্যেষ্ঠভ্রাতা কবিচন্দ্রও নানা গ্রন্থ রচনা করেছেন। কামতা রাজ্যে মহাভারত রচয়িতা আর আর কবি হচ্ছেন বিশারদ চক্রবর্তী, রুদ্রদেব, গোবিন্দ কবিশেখর (১৬২৭-৩২), শ্রীনাথ (১৬৩২-৬৫), দ্বিজ রঘুরাম, জয়দেব, হরেন্দ্র নারায়ণ, ব্রজসুন্দর কৌশারি, দ্বিজ বলরাম, বৈদ্যনাথ, পরমানন্দ, মহীনাথ, রামবল্লভদাস, লক্ষ্মীরাম, বৈদ্য পঞ্চানন, রামনন্দন প্রভৃতি।
এদিকে মহাভারত কাহিনীর অনুসরণ পাচ্ছি সতেরো শতকে। এই শতকের কবিদের মধ্যে কাশীরামদাস সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাঁর কাব্য আজো হিন্দু বাঙালির ঘরে ঘরে পরম আগ্রহে পড়াশুনা হয়। কাশীরামের আত্মপরিচয় থেকে জানা যায় তাঁর পিতার নাম কমলাকান্ত, পিতামহ সুধাকর ও প্রপিতামহ প্রিয়ঙ্কর। নিবাস বর্ধমান জেলার সিঙ্গি বা সিদ্ধি গ্রামে। তাঁর জ্যেষ্ঠভ্রাতা গদাধরও কবি ছিলেন। কনিষ্ঠ কৃষ্ণদাস রচনা করেন শ্রীকৃষ্ণ বিলাস এবং গদাধর লেখেন জগন্নাথ মঙ্গল। কাশীরাম বিরাট-পর্বের কতকাংশ অবধি লিখে পরলোক গমন করেন।
আদি সভা বন বিরাটের কতদূর।
ইহা রচি কাশীদাস গেল স্বর্গপুর।
তারপর তার ভ্রাতুস্পুত্র নন্দরাম দাস অবশিষ্টাংশ রচনা করেন। তাঁর উক্তি এরূপ :
ভ্রাতৃপুত্র হই আমি তিহে খুল্লতাত
প্রশংসিয়া আমারে করিল আশীর্বাদ।
আয়ুত্যাগে আমি বাপু যাই পরলোক
রচিতে না পাইল পোথা রহি গেল শোক।
রচিবে পাণ্ডব কথা পরম সাদরে।
তাহার প্রসাদে আমি পুরাণ রচিল।
কিন্তু নন্দরাম দাস অবশিষ্টাংশ পুরো রচনা করেছিলেন কিনা বলা যায় না। কেননা কাশীদাসী মহাভারতের শান্তি পর্ব ও স্বর্গারোহণ পর্বের পুথির পাঠে যথাক্রমে কৃষ্ণানন্দ বসু ও কাশীরামের পুত্র জয়ন্ত দাসের ভণিতা মেলে। কাশীদাসের কাব্যের মাধ্যমেই মহাভারত ও তার ঐতিহ্যের সঙ্গে বাঙালি র পরিচয়। সেজন্যে কৃত্তিবাসের রামায়ণের মতো কাশীরাম দাসের মহাভারতের দানও বাঙালি জীবনে অপরিমেয়। মহাভারতের অপর এক রচয়িতার নাম বিশারদ। রচনাকাল ১৬১৩ সন। সতেরো শতকে মহাভরাতের অন্যান্য রচয়িতা হচ্ছেন নিত্যানন্দ ঘোষ, কৃষ্ণানন্দ বসু, রামনারায়ণ দত্ত, অনন্ত মিশ্র, দ্বিজ হরিদাস, ঘনশ্যাম দাস, দ্বিজ প্রেমানন্দ, দ্বিজ অভিরাম, কৃষ্ণরামদাস, জ্ঞানদাস, ষষ্ঠীবর সেন, তৎপুত্র গঙ্গাদাস সেন, রাজেন্দ্র দাস, রামেশ্বরী নন্দী, রামলোচন প্রভৃতি। এঁরা সম্ভবত মহাভারতের খণ্ডাংশের অনুবাদক।
আঠারো শতকের কবি দুর্লভসিংহ, গোপীনাথ দত্ত (বা নন্দী বা পাঠক), সুবুদ্ধি রায়, অম্বষ্ঠ বল্লভ, পুরুষোত্তম দাস, ভবানী দাস, দ্বিজরাম লোচন, দ্বিজ গোবর্ধন, শ্রীকৃষ্ণ প্রসাদ ঘোষ, অকিষ্ণন দাস, বসুদেব, নিমাই, রাজীব সেন প্রভৃতির কাব্যের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে।
মানুষের চরিত্রের, আচরণের, সমস্যার ও সম্পদের হেন দিক নেই, যা মহাভারতে চিত্রিত ও বর্ণিত হয়নি। তাই বলা হয়–যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই জগতে। পাত্র-পাত্রী ও ঘটনা কাহিনীভারে ভারী বলেই নাম মহাভারত! গীতাও মহাভারতের একটা সর্গ।
॥ রামায়ণ ॥
কৃত্তিবাসের পরে পনেরো-ষোল শতকে রামায়ণ কেউ রচনা করেননি। বৈষ্ণব প্রভাবে তখন সবাই কৃষ্ণলীলা-রসের তরঙ্গাঘাতে দিশাহারা। কাজেই রামায়ণ রচন-শ্রবণের দিকে কারুর উৎসাহ ছিল না। সতেরো শতকে যখন বৈষ্ণবীয় নেশা কিছুটা মন্দা হল তখন আবার নতুন করে রামায়ণ গান শুরু হয়েছে। এ সময়কার উত্তরবঙ্গের খ্যাতিমান রামায়ণ-রচক হলেন নিত্যানন্দ আচার্য। ইনি সতেলের রাজা রামকৃষ্ণের সভাকবি ছিলেন, পৈত্রিকনিবাস পাবনা জেলার বড়বাড়ী বা অমৃতকুণ্ডা। ইনি সতেরো শতকের শেষার্ধের কবি। অদ্ভুত রামায়ণ অবলম্বনে রচিত বলে এই গায়েন-কবিও অদ্ভুতাচার্য নামে পরিচিত হন। আঠারো শতকের গোড়ার দিকে রামশঙ্কর দত্ত নামের এক কবিও অদ্ভুতাচার্য বলে কলমী নাম গ্রহণ করেছিলেন। দ্বিজ ভবানী নাথ, দ্বিজ লক্ষ্মণ প্রভৃতিও রামায়ণ : রচনা করেন আঠারো শতকে।
॥ ভাগবত ও কৃষ্ণ বিষয়ক রচনা ৷
মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণ বিজয় কাব্যের পরে ষোলো ও সতেরো শতকীয় অনেক কবিরই ভাগবত কৃষ্ণ বিষয়ক বাঙলা রচনা পাওয়া গেছে। বৈষ্ণবেরা তো লিখেইছেন, তাঁদের প্রভাবে পড়ে অবৈষ্ণবেরাও পৌরাণিক ও মহাভারতীয় কৃষ্ণের মহিমা কীর্তন করেছেন উচ্চকণ্ঠে।
সম্ভবত ষোলো শতকের প্রথমার্ধে রচিত হয় দ্বিজ গোবিন্দের কৃষ্ণমঙ্গল, এটি ভক্ত বৈষ্ণবের রচনা। এ শতকের দ্বিতীয় রচনা রঘু পণ্ডিতের কৃষ্ণপ্রেম তরঙ্গিণী। মাধব আচার্যের শ্রীকৃষ্ণ– মঙ্গল, কবিশেখরের গোপাল বিজয়, শ্যামদাসের গোবিন্দ মঙ্গল, কৃষ্ণদাসের শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গলও ষোলো শতকের রচনা। এ সময়কার একটি বৈষ্ণব সিদ্ধান্ত গ্রন্থ তথা তাত্ত্বিক গ্রন্থ হচ্ছে কবিবল্লভের রসকদম্ব। সতেরো শতকে এই ধারায় আরো কয়েকখানি কাব্য রচিত হয়েছে। এগুলোতে পৌরাণিক প্রভাব ক্ষীণ হয়ে বৈষ্ণবীয় প্রভাবই প্রকট হয়েছে বেশি। সতেরো শতকের বৈষ্ণবতত্ত্বগ্রন্থ হচ্ছে ব্রজমোহনদাসের চৈতন্যতত্ত্ব প্রদীপ। এ শতকের শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণলীলাবিষয়ক কাব্য হচ্ছে ভবানন্দের হরিবংশ। পরশুরাম, জীবন, অভিরাম দাস, হরিদাস, যশশ্চন্দ্র, বাণীকণ্ঠ, বংশীদাস প্রভৃতি শ্ৰীকৃষ্ণলীলার পূর্ণ বা খণ্ড বিবরণ-কাব্য রচনা করেছিলেন। আঠারো শতকের কৃষ্ণবিষয়ক কাব্যের মধ্যে উল্লেখ্য হচ্ছে বলরাম দাসের কৃষ্ণলীলামৃত, দ্বিজ রামনাথের শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, শঙ্কর চক্রবর্তীর গোবিন্দ মঙ্গল, মাধবেন্দ্রের ভাগবত সার, দ্বিজ রামেশ্বরের গোবিন্দ মঙ্গল, প্রভুরামের শ্রীকৃষ্ণ মঙ্গল, গঙ্গারামের গোপাল চরিত, রামদাসের শ্রীকৃষ্ণ চরিত, শিবানন্দের শ্রীকৃষ্ণ বিজয়, যুগল কিশোরের শ্রীকৃষ্ণ বিজয় ও মনোহর সেনের শ্রীকৃষ্ণ বিজয় এবং এমনি আরো অনেকের কাব্যের সন্ধান মিলেছে। এ ধারা উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি অব্যাহত ছিল।
॥ লৌকিক দেবতার পাঁচালি।
রামায়ণ-মহাভারত-ভাগবত হচ্ছে আদর্শ অনুশীলনের কৃত্রিম প্রয়াসজাত সৃষ্টি। তাই গোটা মহাভারত অনেককাল জনসমাজে সমাদৃত হয়নি। রামায়ণ বৈষ্ণব-প্রভাবের যুগে বিস্মৃতপ্রায় কাব্য, এবং যদিও ভক্তিবাদ সুফীমতের মিশ্রণে প্রেমরূপের মহিমান্বিত রূপ লাভ করে চৈতন্যমতবাদে, তবু তা জীবনকে আড়াল করে অধ্যাত্মলোক সৃষ্টির প্রয়াস বলে বাঙালি র স্বভাব-ধর্মের সঙ্গে এর অকৃত্রিম সঙ্গতি ছিল না। তাই বাঙালি চরিত্রের খাঁটি পরিচয় রয়েছে তার মানসপ্রবণতার অনুগ লৌকিক দেব-কল্পনায়। তার জীবন-জীবিকার ইষ্ট ও অরি দেবতা সৃষ্টির কল্পনায়, আদর্শে ও তত্ত্বে প্রকটিত হয়েছে তার চারিত্রিক স্বরূপ লক্ষণ, অঙ্কিত হয়েছে তার সমাজ-সংস্কৃতির নকশা। এখানে দেবতাও প্রবল-প্রতাপ মানুষ। মঙ্গলকাব্যে তাই মানুষ আর মানবিক রমই মেলে। মঙ্গল কাব্যগুলো বাঙালি হিন্দুর মন-মনন ও সংস্কৃতির প্রসূন।
অর্থই হচ্ছে শক্তির উৎস, ধন যার আছে মান তারই। ধনী বলেই তো রাজা শক্তিমান, রাজার পরে সমাজে সদাগরই ধনী। তাই মধ্যযুগের বাঙলায় বণিক চাঁদ সদাগর-ধনপতি সদাগরেরাই ছিল সমাজের নিয়ামক। বহির্বাণিজ্যে তাদের বাধা ছিল না। তারাই ব্রাহ্মণ্য আদর্শের ধারক ও রক্ষক। তাই লৌকিক দেবতার লক্ষ্যও তারা। মানুষ মুখে যতবড় মহৎ কথাই বলুক, বুকে পোষণ করে জীবন-জীবিকায় নিরাপত্তার ভাবনা। তাই প্রাকৃত শক্তির প্রসন্নতাকামী কৃষি-নির্ভর, রোগভীরু, অজ্ঞ এবং অসহায় মানুষের জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রে নিয়তিরূপ দেবতার প্রভাব অনুভব করল যখন, তখন দেবতার কাছে বশ্যতা স্বীকার না করে উপায় রইল না তাদের। মধ্যযুগের বাঙলায় লৌকিক ধর্মের ইতিহাস হচ্ছে এই পার্থিব জীবনে সুখ ও নিরাপত্তাকামী মানুষের উপ ও অপদেবতা সৃষ্টির ও পূজার কাহিনী। এর ভিতরে কোনো অপার্থিব সুমহৎ আদর্শ বা লক্ষ্য নেই। আছে এই মাটিকে–এই জীবনকে ভালোবাসার স্বাক্ষর; সুখ ও শান্তি লাভের নিদারুণ প্রয়াস। মঙ্গলকাব্যগুলোতে তাই। দেবলীলার আবরণে বর্ণিত হয়েছে সমকালীন বাঙলাদেশের ও বাঙালি জীবনের অন্তরঙ্গ ইতিকথা। ফুল্লরা-খুল্লনা-বেহুলা-রঞ্জাবতী-লখাই-গৌরী, কিংবা লহনা-দুর্বলা-হীরা-মনসা-চণ্ডী অথবা শিবাদ ধনপতি-শ্ৰীমন্ত-কালকেতু-লাউসেন-কর্ণসেন-কালুডোম আর মহামদ-মুরারিশীল-ভাড়দত্ত ভালোয়ময় নামভেদে আমাদেরই প্রতিবেশী–আমাদেরই ঘরের লোক।
॥ চণ্ডীমঙ্গল ॥
চণ্ডীদেবী এক নন, অনেক। তাঁদের মধ্যে যিনি পরে তারা-গৌরী-পার্বতী-দুর্গা প্রভৃতি নামে পৌরাণিক আভিজাত্য লাভ করেন, সেই শিবপত্নী চণ্ডীই চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের উপজীব্য। চণ্ডী কাব্যের দুটো উপাখ্যান। একটি আদি, যা নিম্নবর্ণের কালকেতু-ফুল্লরা কাহিনতে রূপ পেয়েছে। আর একটি পরবর্তী-ধনপতি সদাগর নামেতেই তা তুর্কী আমলের প্রভাব স্বীকার করেছে। চণ্ডী মাহাত্ম্যের জড় পাই বৃহদ্ধর্ম পুরাণে। আসলে এক অনার্য নারীদেবতা-চণ্ডী নামই যার সাক্ষ্য বহন করছে–বৌদ্ধসমাজে বজ্রতারা রূপে পূজিতা হন, সেই বজ্রতারাই ব্রাহ্মণ্য সমাজে তারা বা চণ্ডী নামের আবরণে গৃহীত হয়েছেন।
প্রাচীন অনার্য নারীদেবতা এই চণ্ডী, ইনি শক্তিস্বরূপা, শতাধিক নামে চণ্ডী অনার্যসমাজে পূজিতা হতেন। ক্রমে আর্যসমাজে তিনি শিব বা হর-গৃহিণীরূপে শিবানী, উমা, গৌরী, তারা প্রভৃতি নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, পৌরাণিক যুগে এর মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা অসামান্যরূপে বেড়ে যায়। দশ প্রকার শক্তির আধার-রূপে তার দশ মহাবিদ্যার দশমূর্তি পরিকল্পিত হয়েছে, যথা : কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলা। চণ্ড-চণ্ডী নামের মধ্যেই তাদেরকে প্রচণ্ড শক্তির আধার-রূপে স্বীকার করা হয়েছে। চণ্ডী মুখ্যত পশ্চিমবঙ্গীয় তথা রাঢ় অঞ্চলের দেবতা।
একসময় ব্রাহ্মণ্য দর্শনে শিব আশুতোষ-ভোলানাথ নামে যোগী-তপস্বী হিসেবে নিগুণ শক্তি স্বয়ম্ভুরূপে বিশেষ প্রতিষ্ঠা পান। আর চণ্ডী কালো বলে কালিকা, কালী বা শ্যামা নামে শক্তিদেবতারূপে পূজিতা হতে থাকেন। সম্ভবত বৌদ্ধপ্রভাবে পরে পরে তার উগ্র রৌদ্র-রূপ কমনীয় করুণাময়ী-রূপে পরিণত হয়। তখন তিনি অন্নপূর্ণা, কমলা ও দুর্গারূপে বাঙলা দেশে পূজিতা হতে থাকেন। দূর্গারূপে দশদিক রক্ষার প্রতীক দশপ্রহরণধারিণী হিসেবে তাঁর দশভূজা মূর্তি পরিকল্পিত হয়। দুর্গারূপে তিনি শ্যামা নন–গৌরী। অনার্য প্রভাবে এককালে তিন-অনার্য দেবতা–বিষ্ণু, শিব ও কালী (চণ্ডী) সর্বভারতিক দেবতারূপে পূজিত হন। ফলে ব্রাহ্মণ্যসমাজ বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বৈষ্ণবীয় প্রেমবাদের প্রভাবে বাৎসল্য রসাশ্রিত শাক্ত মত তথা সন্তানবৎসল জননী রূপিণী শ্যামা-ভক্তিবাদ বাঙলা দেশে আঠারো শতক থেকে প্রসার লাভ করতে থাকে। এভাবে চণ্ডীমাহাত্মজ্ঞাপক চণ্ডীমঙ্গল, কালিকা মাহাত্ম্যসূচক কালিকামঙ্গল, গৌরী পরিচায়ক সারদামঙ্গল ও গৌরীমঙ্গল দুর্গামহিমা জ্ঞাপক দুর্গামঙ্গল এবং মাতৃরূপিণী শ্যামার স্তুতির জন্যে শ্যামাসঙ্গীত রচিত হয়েছে। এতে গৌরী-দুর্গা-উমা-কালী এ চার স্বরূপে তাঁর মহিমা বর্ণিত। বৈষ্ণব পদাবলীতে যেমন মধুর রসের প্রাধান্য, এখানে তেমনি মান-অভিমানের সুরই প্রবল। এই শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠকবি রামপ্রসাদ সেন।
চণ্ডী মুখ্যত রাঢ় অঞ্চলের দেবতা। পশুর ইষ্টদেবী চণ্ডীমঙ্গলের কালকেতু উপাখ্যানে ব্যাধের ইষ্টদেবীতে পরিণত হয়েছেন। তাঁর বাহন গোধিকা। মনসা, চণ্ডী প্রভৃতির কাহিনী পাঁচালিরূপে লিখিত হওয়ার আগে কথকতার মাধ্যমে চালু ছিল :
ধর্মকর্ম লোক সবে এই মাত্র জানে
মঙ্গল চণ্ডীর গীত করে জাগরণে,
দম্ভ করি বিষহরি পূজে কোনো জন…..
মদ্যমাংস দিয়া কেহ যক্ষপূজা করে।
যোগীপাল ভোগীপাল মহীপাল গীত
এই সব শুনিতে লোক আনন্দিত।
চণ্ডীমঙ্গলের প্রথম লিখিত পাঁচালির উল্লেখ রয়েছে মুকুন্দরামের ও মাণিক দত্তের কাব্যে। তারা এক মাণিক দত্তকে চণ্ডীগীতির আদি রচয়িতা বলে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। দ্বিতীয় এক মাণিক দত্তের পাঁচালি পাওয়া গেছে। ইনি মালদহ অঞ্চলের কবি। তাঁর কবিত্ব-সম্পদ ছিল না বটে, তবে চণ্ডী পাঁচালির প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তাঁর কাব্যেই পাচ্ছি। তাঁর কাব্যও রচিত হয় দেবীর স্বপ্নদেশে এবং বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এই যে, কাব্যের উপক্রমণিকায় কবি স্বয়ং দেবীর বরপুষ্ট নায়ক। ইনি সম্ভবত আঠারো শতকের লোক। দ্বিজ মাধব বা মাধবাচার্য হচ্ছেন চণ্ডী পাঁচালির তৃতীয় কবি। এর কাব্য রচনাকাল ১৫০১ শক বা ১৫৭৯-৮০ খ্রীস্টাব্দ।
ইন্দু বিন্দু বাণ ধাতা শক নিয়োজিত
দ্বিজ মাধবে কহে সারদা চরিত।
তাঁর কাব্যে অর্জুন-তুল্য বাদশাহ আকবরের স্তুতি আছে।
মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং ষোলো শতকের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের যুগ রূপকথার আমল। আলৌকিক দেব-মহিমার কাহিনী বর্ণনা করতে বসেও মুকুন্দরাম তার প্রতিবেশ ভুলতে পারেননি। তাঁর অসামান্য কৃতিত্ব এখানেই। তিনি কাব্যে এক গ্রাম্য পরিবেশে যুগদুর্লভ ঘরোয়া আবহ সৃষ্টি করেছেন।এ হয় তার কল্পনাশক্তির অভাবপ্রসূত, নয়তো তাঁর যুগোত্তর অসামান্য জীবনবোধ, লোকচরিত্র জ্ঞান ও শিল্পীসুলভ তীক্ষ্ণ রসিকদৃষ্টির সুফল। চিত্র, নকশা এবং আধুনিক উপন্যাসের আদল এতে আশ্চর্য নৈপুণ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে। পরবর্তীকালে আমরা নাট্যকার দীনবন্ধুর মধ্যে এমনি কবি-দৃষ্টি প্রত্যক্ষ করেছি। জীবনে-রসে রসিক এই কবির কাব্যের সুষমা তাই আজো অম্লান। বৈষ্ণব প্রভাব-পুষ্ট কবিচিত্তের স্নিগ্ধ সহানুভূতির প্রলেপে চণ্ডীমঙ্গল রসশ্রীমণ্ডিত হয়েছে। অবশ্য মুকুন্দরাম দ্বিজ মাধবাচর্যের কাছে নানা বিষয়ে ঋণী। মুকুন্দরাম ষোলো শতকের শেষপাদে কাব্য রচনা করেন।
এরপর সম্ভবত বৈষ্ণবমতের ও সাহিত্যের প্রভাববশত চণ্ডীমঙ্গল কাব্য বিশেষ বিকাশ লাভ করেনি। রামানন্দ, যতি লালা, জয়নারায়ণ রায়, দ্বিজ কমললোচন, দ্বিজ জনার্দন প্রভৃতি দু-চার জনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রচনাই সতেরো শতকে এই ধারার ক্ষীণ ও ম্লান অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। হরিরাম, ভবানী শঙ্কর, অকিঞ্চন চক্রবর্তী, রামদেব প্রভৃতিও চণ্ডীর মাহাত্ম্য-কথা রচনা করেছেন।
এরপর চণ্ডী নাম ও কালকেতু-ধনপতি-উপাখ্যান বর্জিত হয়েছে। কালিকা নাম ও বিদ্যাসুন্দরের প্রণয়োপাখ্যান দিয়ে নতুন করে কালিকা মঙ্গল রচিত হতে থাকে। এতে মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য কিছুই নেই। কেবল কালিকার বরে সন্তান লাভ এবং কালিকার স্তুতির দ্বারা সুন্দরের জীবন রক্ষা ছাড়া এতে কালিকার মঙ্গলকাব্য-সুলভ কোনো ভূমিকা নেই। এখানে কালিকা সুপ্রতিষ্ঠিত তথা স্বীকৃত ইষ্ট দেবতা মাত্র।
অবশ্য কালিকামঙ্গলও ষোলো শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকেই রচিত হয়েছে। এর প্রথম কবি দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ যুবরাজ (ও সুলতান) ফিরোজ শাহর (১৫৩২-৩৩) প্রতিপোষণ পেয়েছিলেন। আর শাবারিদ খানও এই শতকের প্রথমার্ধে কাব্য রচনা করেন। আঠারো শতক অবধি কালিকামঙ্গলের অন্যান্য কবি হচ্ছেন বলরাম চক্রবর্তী, গোবিন্দ দাস, কৃষ্ণরাম দাস, রাধাকান্ত মিশ্র, রামপ্রসাদ সেন, কবীন্দ্র চক্রবর্তী, প্রাণরাম চক্রবর্তী, নিধিরাম আচার্য প্রভৃতি। ভারতচন্দ্র রায়ের অন্নদামঙ্গলও একটি কালিকামঙ্গল। তাঁর কাব্য তিন খণ্ডে বিভক্ত–দেবী খণ্ড, বিদ্যাসুন্দর খণ্ড ও মানসিংহ-ভবানন্দ খণ্ড। শেষোক্ত কাহিনী তার মৌলিক সৃষ্টি। গোটা মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে ভারতচন্দ্রের স্থান নানা কারণে অনন্য। তাঁর কাব্যের নামও অভিনব। আঠারো শতকে বগী হার্মাদের হামলা, য়ুরোপীয় বেনের দৌরাত্ম্য, পতনোখ মুঘল সাম্রাজ্যের বিশৃঙ্খল শাসন, অমাত্য ও সামন্ত প্রাধান্য ও তজ্জাত স্বৈরাচার প্রভৃতি যখন জন-জীবনে অভিশাপরূপে নেমে এসেছে, তাদের জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা ব্যাহত করেছে, তেমনি পরিবেশে ভারতচন্দ্রের জন্ম। তিনি নিজেও প্রথম জীবনে ভাগ্যবিড়ম্বিত হয়ে নানা দুঃখ-কষ্ট পেয়েছেন। তাই তাঁর দেবী অন্নদা– অন্নপূর্ণা। আশ্রয়দাতা রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আগ্রহে তিনি কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদারের কীর্তিকথা দেবীমাহাত্মের আবরণে রচনা করেছেন। কিন্তু অখ্যাত ভবানন্দের ঘটনা-বিরল জীবন কাহিনী কাব্যরস সৃষ্টির অনুকূল নয় বলেই ইনি দেবী খণ্ড এবং বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যান সুকৌশলে কাব্যান্তর্ভুক্ত করেন। ভারতচন্দ্র বিদগ্ধ কবি, শহুরে কবি, দরবারি কবি, রসিক কবি। তার চেয়েও বড় কথা–ভাব, ভাষা, ছন্দ ও ভঙ্গির উপর তার অসামান্য কর্তৃত্ব। জগৎ ও জীবন, সমাজ ও ধর্ম, মানুষের দোষ ও গুণ, আশা ও হতাশা তাঁর বিকারহীন রস-দৃষ্টিতে তামাশার মতো প্রতিভাত হয়েছে। উদার ও সহিষ্ণু রসিকের মতো তিনি জনজীবনের সর্বপ্রকার অসঙ্গতি থেকে কেবল বিদূষক-সুলভ রসিকতার উপাদানই খুঁজে পেয়েছেন। বলা চলে এক বেপরোয়া বাঁচালতার কাব্য এই অন্নদামঙ্গল। এ কাব্য রচিত হয় :
বেদ লয়ে ঋষি রসে ব্রহ্ম নিরূপিলা।
সেই শকে এই গীত ভারত রচিলা ॥
১৬৭৪ শকে বা ১৭৫২-৫৩ খ্রীস্টাব্দে।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় রাজসভা কবি রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল গান রাজকণ্ঠের মণিমালার মতো, যেমন তাহার উজ্জ্বলতা তেমনি তাহার কারুকার্য।
মুক্তারাম সেনের সারদামঙ্গল (১৬৬৯ শকে বা ১৭৪৭-৪৮ খ্রীস্টাব্দে), কৃষ্ণজীবন দাসের দুর্গামঙ্গল (১৭ শতকের শেষার্ধে), কবিচন্দ্র মিশ্র (১৪৯৩-১৫১৯) ও দ্বিজ শিব-চরণের গৌরীমঙ্গল প্রভৃতি চণ্ডীরই বিভিন্ন রূপ ও গুণের পরিচায়ক কাব্য।
॥ শিবায়ন ॥
এই চণ্ডীমঙ্গল ও নাথসাহিত্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শিবের স্বতন্ত্র মাহাত্ম্য-কাহিনী শিবায়ন নামে রচিত হতে থাকে। শিব অতি প্রাচীন সর্বভারতীয় অনার্য দেবতা। তাই তাকে কেন্দ্র করে নানা গোত্রীয় ধারণা অসমন্বিত ও বিচিত্ররূপে প্রকটিত হয়েছে। এ জন্যে শিব নানা বিরুদ্ধ-গুণে, বিভিন্ন আকারে ও অসংলগ্ন জটিল তত্ত্বে অদ্ভুত মূর্তি লাভ করেছেন। বাঙলা শিবায়নে তাঁর দুইরূপ দুইধারা। একটি পৌরাণিক, অপরটি লৌকিক। পৌরাণিক ধারায় শিব-চতুর্দশীর গুরুত্ব জ্ঞাপক উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। চট্টগ্রামের রতিদেবের মৃগলুব্ধ (১৬৭৪) ও রাম রাজার মৃগলুব্ধ সংবাদ এই ধারার রচনা।
কৃষির দেবতা চাষী শিবের লৌকিক কাহিনীতেই দরিদ্র বাঙালি র গার্হস্থ্য জীবনের অকৃত্রিম আলেখ্য বিধৃত। মেনকা কন্যাবিদায়কালে জামাতা শিবকে মিনতি করে বলছেন : কুলীনের পো-কে অন্য কী বলিব আমি, (আমার মেয়েকে) আঁঠু ঢাকি বস্ত্র দিও পেট ভরি ভাত-কন্যার ভাগ্য সম্বন্ধে পিতামাতার চিরন্তন উৎকণ্ঠার এমন মর্মস্পর্শী আন্তরিক প্রকাশ সুদুর্লভ। এই লৌকিক শিবায়ন কাব্যের মধ্যে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের (১৭১০ খ্রী.) কাব্য সর্বশ্রেষ্ঠ। কবিচন্দ্র রামকৃষ্ণ রায়, শঙ্কর, কবিচন্দ্র, দ্বিজ কালিদাস, দ্বিজ মণিরাম প্রভৃতিও শিবায়ন রচনা করেছেন। মধ্যযুগে দেবকাহিনী প্রায়শ মঙ্গল নামে পরিচিত ছিল। আলোচ্য প্রধান শাখাগুলো ছাড়াও বহু উপ ও অপদেবতার মঙ্গল রচিত হয়েছে, যেমন গঙ্গামঙ্গল, সূর্যমঙ্গল, সরস্বতী মঙ্গল, লক্ষ্মী মঙ্গল, ষষ্ঠী মঙ্গল, কপিলা মঙ্গল, শনি মঙ্গল, শীতলা মঙ্গল প্রভৃতি।
॥ মনসামঙ্গল ॥
মনসামঙ্গলের কাহিনী দেব-মানবের সংগ্রামের ইতিকথা। সে-সংগ্রামে মানুষ পরাজিত হয়েছে বটে, কিন্তু মানব ও মানবিকতা হয়েছে মহিমান্বিত। চাঁদ সদাগর ও বেহুলা গোটা বাঙলা সাহিত্যে অনন্য সৃষ্টি। মনসামঙ্গল কাব্য মুখ্যত পূর্ব বাঙলার দান। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র তীরের সংগ্রামী মানুষের অদম্য অধ্যবসায়ের ও মুসলমানের একেশ্বরবাদের প্রভাব রয়েছে চাঁদ-বেহুলার চরিত্র কল্পনায়। চাঁদ দেবীর কাছে মাথা নত করেনি, সে আত্মসমর্পণ করেছে এক বালিকার অসামান্য সাহস, অধ্যবসায় ও কৃসাধনার কাছে। আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন ও কৃতসঙ্কল্প মানুষের ও মনুষ্যত্বের এমনি চিত্র সাহিত্যে বিরল।
পনেরো শতকের কানা হরিদত্ত, বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপিলাইর পরে মোলো শতকে কোনো মনসার ভাসান রচয়িতার সন্ধান পাইনে; আমাদের বিশ্বাস বৈষ্ণবপদাবলীর রস-বন্যায় কিছুকালের জন্যে অন্য তত্ত্বচিন্তা চাপা পড়েছিল। তাই আবার সতেরো শতক থেকেই মনসামঙ্গল রচয়িতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি। এই শতকে আমরা দ্বিজ বংশীদাস রামায়ণের কবি চন্দ্রাবতী এঁরই কন্যা] নারায়ণদেব, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, বিষ্ণুপাল, কালিদাস, রসিক মিশ্র, দ্বিজ কবিচন্দ্র, সীতারাম দাস প্রভৃতি কবিদের পাচ্ছি। এদের মধ্যে দ্বিজ বংশীদাস, নারায়ণ দেব ও ক্ষেমানন্দ শ্রেষ্ঠ।
আঠারো শতকের কবি হচ্ছেন জগজ্জীবন ঘোষাল, জীবনকৃষ্ণ মৈত্র, রামজীবন বিদ্যাভূষণ, হরিদাস, কৃষ্ণানন্দ, জানকীনাথ, জগন্নাথ, ষষ্ঠীবর সেন, গঙ্গাদাস সেন, বাণেশ্বর প্রভৃতি।
॥ পীর পাঁচালি।
সত্যপীর মাহাত্ম্য-কথা ষোলো শতক থেকেই রচিত হতে থাকে। মোলো শতকে শেখ ফয়জুল্লাহ সত্যপীর বিজয়, কঙ্ক বিদ্যাসুন্দর এবং কৃষ্ণরাম দাস রায়মঙ্গল রচনা করেন। সত্যপীরের হিন্দু চেলা দক্ষিণের রায় (রাজা) এবং মুসলমান-ভক্ত বড় খাঁ গাজী। প্রায় ষাট-সত্তর জন হিন্দু কবি ও কিছু মুসলমান কবি সতেরো থেকে উনিশ শতক অবধি সত্যপীর পাঁচালি রচনা করেছেন। সত্যপীর তত্ত্বের প্রভাবে অনেক লৌকিক দেবতা বা কাল্পনিক পীর কাহিনীও লিখিত হয়েছে, যেমন বনবিবি-বনদেবী, শীতলা, ওলা, দক্ষিণরায় বড়খগাজী, ষষ্ঠীদেবী, কালুগাজী-কালুরায় প্রভৃতি। আবার ঐতিহাসিক ব্যক্তিকেন্দ্রী পীর-পাঁচালি যথা–মোবারক, গোরাচাঁদ, ইসমাইল গাজী, খাঞ্জা খা, সফী গাজীর কাহিনী প্রভৃতিও রচিত হয়েছে এ সূত্রে। পীর পাঁচালি নিম্ন ও পশ্চিম বঙ্গের সৃষ্টি। বাউলমতের মতো পীর-নারায়ণ সত্যকে কেন্দ্র করেও নিম্ন ও পশ্চিম বাঙলার সাধারণ ও দুস্থ হিন্দু মুসলমানের এক মিলন-ময়দান তৈরি হচ্ছিল। হিন্দুর দেবতা হৈল মুসলমানের পীর। দুইকুলে সেবা লয় হইয়া জাহির। পীর-নারায়ণ সত্য এমনকি অল্লোপরিষদের মতো একসময়ে সর্বভারতীয় ও সর্বজনীন দেবতা হয়ে উঠেছিলেন। ভৈরবচন্দ্র ঘটক, ঘনরাম চক্রবর্তী, রামেশ্বর চক্রবর্তী, ফকির রাম দাস, বিকল চট্টো, কৃষ্ণকান্ত, শিবচরণ, রামশঙ্কর, গিরিধর, অযোধ্যারাম, দ্বিজ বিশ্বেশ্বর, জনার্দন, ফকির চাঁদ, ভারতচন্দ্র রায়, ফকির গরীবুল্লাহ, কঙ্ক, আরিফ, ফৈজুল্লাশাহ প্রভৃতি অনেকেই সত্যনারায়ণ পাঁচালি লিখেছেন উনিশ শতক অবধি।
॥ প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্য।
শঙ্করাচার্যের আবির্ভাবের ফলে ব্রাহ্মণ্য সমাজে যে রেনেসাস আসে তার ফলে নব ব্রাহ্মণ্যধর্মের দ্রুত প্রসার ঘটে। বৌদ্ধ বিলুপ্তি তার অনিবার্য ফল। বাঙলাদেশের বজ্রযান, কালচক্র্যান ও সহজ যানভুক্ত বিলুপ্তপ্রায় বৌদ্ধ সম্প্রদায় হিন্দুয়ানি আবরণ গ্রহণ করেই প্রচ্ছন্নভাবে স্বধর্মে সুস্থির থাকতে চেষ্টা করে। এই চেষ্টারই পরিণতি দেখতে পাই পশ্চিমবঙ্গের ধর্মমতবাদে, নাথ-যোগী-পন্থে, বৈষ্ণব সহজিয়াবাদে ও বাউল মতে।
বৌদ্ধ বিলুপ্ত সত্ত্বেও নাথ-সাহিত্য লুপ্ত হয়নি, কারণ যোগতাত্ত্বিক বিষয় বলে হিন্দু যোগী ও মুসলমান সূফীর কাছে তা সমাদৃত ছিল। তাই ময়নামতী-মানিকচাঁদ-গোপীচাঁদের গান, গোরক্ষবিজয়-যোগীকাঁচ প্রভৃতি হিন্দু-মুসলমান কর্তৃক রচিত হয়েছে। ফয়জুল্লাহর গোরক্ষবিজয় (১৫৭৫), সতেরো শতকের কবি ভবানীদাসের ময়নামতীর গান, আঠারো শতকের দুর্লভ মল্লিক ও শুকুর মুহম্মদের গোপীচাঁদের সন্ন্যাস এবং পুরোনো গাথা প্রভৃতি এই ধারাকে প্রবহমান রেখেছে।
সহজযানপন্থী প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধেরা এই সময়ে ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। কিন্তু তাদের বিশ্বাস-সংস্কার তখনো তারা জিইয়ে রাখে। ফলে বৈষ্ণব থেকে বৈষ্ণব-সহজিয়া, মুসলমান ও প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ থেকে বাউল মত গড়ে উঠে। চর্যাগীতি এদেরই ঐতিহ্য এবং বৈষ্ণব সহজিয়াপদ ও বাউল গান চর্যাগীতিরই আধুনিক রূপান্তর। হিন্দু সমাজের নাথ-যুগীরা (পেশায় তাঁতি) পুরোনো বৌদ্ধ নাথপন্থরই ধারক।
বৌদ্ধ আদিনাথ ও বজ্রতারাকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধেরা শিব-তারা নামের আবরণে পূজা করতে থাকে এবং গোরক্ষনাথ, মীন নাথ বা মৎস্যেন্দ্র নাথ প্রভৃতি বৌদ্ধ সিদ্ধা প্রবর্তিত সাধনপন্থও শৈবনাথপন্থরূপে পরিচিত হয়। ফলে এগুলো শৈবমতের শাখারূপে ব্রাহ্মণ্য সমাজে গৃহীত হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ধর্মঠাকুর পূজারীর ধর্মঠাকুর মূলত অনার্য সূর্যদেবতা। বৌদ্ধ আমলে বৌদ্ধের ত্রিশরণের অন্যতম প্রমূর্ত ধর্মরূপে এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনরুত্থানের পর নিম্নবর্ণের দেবতা ধর্মঠাকুর নামে পূজিত হচ্ছেন। তার মাহাত্ম্য-কথাই ধর্মমঙ্গল কাব্যে বর্ণিত হয়েছে।
মনসা ও চণ্ডীমঙ্গলের সঙ্গে ধর্মমঙ্গলের পার্থক্য এই যে, ধর্মঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃত নির্বিবাদী দেবতা। কাহিনীতেও বৈচিত্র্য এবং বিস্তার আছে। এক বিস্তৃত পরিসরে রাজা আর ভিখারি, অভিজাত ও ডোম, ন্যায়নিষ্ঠা ও শাঠ্য, বাহুবল ও কূটকৌশল, বিদ্রাহ ও বিগ্রহ, গার্হস্থ্য সমস্যা ও রাজসভার দুশ্চিন্তার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এসব কারণে ধর্মমঙ্গলগুলো বিশিষ্ট রচনা। এখানে বাঙলার বিশেষ করে প্রাচীন রাঢ় অঞ্চলের সর্বস্তরের নারী-পুরুষের জীবনযাত্রার বাস্তব চিত্র বিধৃত রয়েছে। রাজসভার ছল-চাতুরী, প্রতারণা-বিশ্বাসঘাতকতা, নির্যাতন-বিদ্রোহ, সন্ধি-বিগ্রহ, বীরত্ব-মহত্ত্ব প্রভৃতির চিত্র যেমন আছে, তেমনি রয়েছে ধনী-নির্ধনের ঘরোয়া জীবনের প্রেম-ঈর্ষা, ক্ষমা-প্রতিহিংসা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, উল্লাস-যন্ত্রণা ও আশা-হতাশার আলেখ্য। কাহিনী সুসংবদ্ধ নয় বটে, কিন্তু মহামদ-কর্ণসেন-কালু-লখাই-রঞ্জাবতী- লাউসেন-ইছাই প্রভৃতি স্ব স্ব বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্যের লিখিতরূপ অর্বাচীন। কিন্তু এগুলোতে যেসব কাহিনী ও সমাজ-সংস্কৃতির চিত্র রয়েছে, তা প্রাচীন। এদিক দিয়ে এ সাহিত্য বাঙলা ও বাঙালি র প্রাচীন ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ।
রামাই পণ্ডিতের শূণ্যপুরাণ ও ধর্ম পূজাবিধান হচ্ছে এ মতের শাস্ত্রগ্রন্থ। নিরঞ্জনের রুম্মাটি কিলিমা জলাল] এই শূন্যপূরাণেই পাওয়া গেছে। ফিরোজ শাহ তুগলকের উড়িষ্যা বিজয় উপলক্ষে এটি রচিত। এ উপাখ্যানে কেউ কেউ বিস্মৃত সামাজিক ইতিহাসের ছায়া লক্ষ্য করেন। ধর্মমঙ্গলের আদি লেখক বলে ময়ূর ভট্ট নামে এক ব্যক্তির উল্লেখ দেখা যায়। যাদের পাঁচালি পাওয়া গেছে তাঁদের অনেকেই ব্রাহ্মণ। উচ্চবর্ণ থেকে ধর্মঠাকুরের স্বীকৃতি আদায়ই হচ্ছে এসব মঙ্গল রচনার পরোক্ষ উদ্দেশ্য। সতেরো শতক থেকেই ধর্মমঙ্গল রচিত হতে থাকে। খেলারাম চক্রবর্তীও ধর্ম পাঁচালরি আদি লেখক বলে পরিচিত। কিন্তু তাঁর কাব্যও পাওয়া যায়নি। সতেরো শতকের আর যে-সব কবির নাম মেলে তাঁরা হচ্ছেন শ্রীশ্যাম পণ্ডিত, যাদবনাথ, রূপরাম চক্রবর্তী, রামদাস আদক, সীতা রামদাস প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে রূপরাম চক্রবর্তী প্রধান। আঠারো শতকে পাচ্ছি ঘনরাম চক্রবর্তী, দ্বিজ রামচন্দ্র, নরসিংহ বসু, দ্বিজ প্রভু রাম, হৃদয়রাম সাধু, শঙ্কর চক্রবর্তী, নিধিরাম গাঙ্গুলী, দ্বিজ গোবিন্দ রাম, দ্বিজ ক্ষেত্ৰনাথ, মাণিকরাম গাঙ্গুলী, রামকান্ত রায়, দ্বিজ রাজীব প্রভৃতি। এঁদের মধ্যে ঘনরাম চক্রবর্তী কবিত্বে ও জনপ্রিয়তায় শ্রেষ্ঠ।
.
০৬.
॥ লোকসাহিত্য ॥
বাঙলা লোক-সাহিত্যের আদি নিদর্শন হচ্ছে চর্যাগীতি, ডাক ও খনার বচন, ছড়া, প্রবচন, প্রবাদ, রূপকথা, ব্রতকথা, যোগীপাল-ভোগীপাল-মহীপাল গীত (অপ্রাপ্ত), ময়নামতী-মানিকচাঁদ-গোপীচাঁদ গীত, মীননাথ-গোখনাথ-হাড়িপা কাহিনী, ধর্মঠাকুরের কথা, চণ্ডী-মনসার কথা, যজ্ঞকথা, শিবের পাঁচালি, রাধাকৃষ্ণ ধামালী, রাম পাঁচালি, ভারত পাঁচালিত প্রভৃতি। এগুলো মুখে মুখে ফিরেছে বলে এগুলোর ভাষা কালে কালে পরিবর্তিত হয়েছে কিন্তু কাহিনী প্রাচীন। তেমনি তুর্কী-মুঘল আমলের নিদর্শন হচ্ছে ব্ৰত কথা, গাজীর গান, সত্যপীর, ওলা বিবি প্রভৃতি কাহিনী, মৈমনসিংহ গীতিকা, পূর্ববঙ্গ গীতিকা, পীর-মাহাত্ম্য কথা, বাউলগান, আদ্যের গম্ভীরা, ঝুমুর, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া প্রভৃতি এবং ব্রিটিশ যুগের ও হাল আমলের লোক-সাহিত্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাউল, ভাটিয়ালী ও কবিগান এবং সাময়িক ঘটনা অবলম্বনে রচিত নানা গান, গাথা, কবিতা ও লোকসাহিত্য নামে পরিচিত। এর মধ্যে কবিওয়ালার ও কবিগানের উদ্ভবের আলাদা সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। এ হচ্ছে যুগসন্ধিকালের বিপর্যস্ত জীবনের সাক্ষ্য অথবা পূর্ব-প্রভাতিক অন্ধকারের (Predawn darkness-এর) প্রতিরূপ।
স্থানীয় কবি, গায়েন ও কথক কর্তৃক আঞ্চলিক বুলিতে স্থানীয় নিরক্ষর লোকের উদ্দেশে মুখে মুখে রচিত বলে লোকসাহিত্য অঞ্চলের সীমা অতিক্রম করে সর্ববঙ্গীয় হতে পারেনি। এজন্যে লোকসাহিত্য মাত্রই আঞ্চলিক এবং কালে কালে বহু মুখের স্পর্শে ও পরিচর্যায় এগুলো ভাবে বিচিত্র, ভাষায় কালোপযোগী, ভঙ্গিতে চাহিদানুসারী এবং কল্পনায় পল্লবিত হয়েছে বলে লোকসাহিত্য ব্যক্তিনিরপেক্ষ গণরচনা-রূপে পরিচিত। অতএব ভাবে, ভাষায়, ভঙ্গিতে ও কাহিনী বিন্যাসে লোকসাহিত্য যুগে যুগে নবকলেবর পরিগ্রহ করে যুগের চাহিদা মিটিয়েছে, এবং নতুন বিষয়ে হয়েছে পুষ্ট।
পূর্ববঙ্গ গীতিকা ও ময়মনসিংহ গীতিকা লোকসাহিত্যের তথা বাঙলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। বাস্তবতায়, মানবিকতায় ও জীবনচেতনায় এগুলো অনন্য। এতে ইতিহাস, সমাজ, সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতিচ্ছবি বিধৃত রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের ইতিহাসের মূল্যবান উপকরণ মেলে গাথাগুলোতে। গীতিকাগুলোর রচনাকালের পরিধি ষোলো থেকে আঠারো শতক অবধি বিস্তৃত।
বলেছি, এদেশে তুকী-মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার আগে ধর্মচর্চার, সাহিত্যের ও দরবারের ভাষা ছিল সংস্কৃত। বাঙলা তখন মুখের বুলির স্তর পার হয়নি। এ ভাষায়-যে কিছু লেখা যায়, এ ভাষাও-যে সাহিত্যের ভাষা হতে পারে তা কখনো কোনো গুণীজন ভাবেননি। অশিক্ষিত জনগণ তাদের বুলিতে মুখে মুখে গান, গাথা, ছড়া, ব্রতকথা, রূপকথা ও উপকথা রচনা করে মনের ভাব প্রকাশ করত। এছাড়া দেবতার পূজা করবার কিংবা তাঁর কাছে সুখ-দুঃখ-বেদনার কথা নিজে নিবেদন করবার এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মশাস্ত্র রচনে-পঠনে-শ্রবণে শূদ্রের ও নারীর অধিকার ছিল না বলে। জনগণ কথকতার মাধ্যমে দেবকথা ও ধর্মকথা জানবার চেষ্টা করত। এভাবে রামের ছড়া, ভারতকথা, কৃষ্ণ ধামালী, মনসা ও চণ্ডীর কথা, ব্রতকথা প্রভৃতি মুখে মুখে রচিত হয়েছিল। কিন্তু অষ্টাদশ পুরাণানি রামস্য চরিতানিচ ভাষায়াং মানব শ্রুত্বা রৌরবং নরকং ব্ৰজেৎ।–ব্রাহ্মণ্য সমাজপতিদের এরকম কঠোর পতি ছিল বলে কেউ সেসব লিখবার ও পড়ে শুনবার সাহস পায়নি।
তাছাড়া সেন আমলে সাধারণ লোকের বিশেষ করে শূদ্রের লেখাপড়া শেখার অধিকার ছিল না। অতএব মুসলিম বিজয়ের আগে এদেশে বাঙলায় কিছু লিখিত হয়নি। চর্যাগীতিরও এদেশে লিখিত রূপ চালু ছিল বলে মনে করবার কারণ নেই। কাজেই আমাদের বিশ্বাস মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই বঙ্গভাষার এই লেখ্য ও সাহিত্যের ভাষা হইবার] সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। তাই নিরঞ্জনের রুম্মাতে°৬ কেবল নিপীড়িত বৌদ্ধদের স্বস্তি ও উল্লাস ধ্বনিত হয়নি, বাঙলা ভাষারও সুদিনের আভাস সূচিত হয়েছে। মুসলিম শাসকের প্রশ্রয়ে ও প্রতিপোষণে সম্ভবত চৌদ্দ শতকের শেষ বা পনেরো শতকের গোড়া থেকেই বাঙলা রচনা লিখিত রূপ পেতে থাকে। এজন্যে এ সময় থেকেই কৃষ্ণ ধামালী, মনসার ভাসান, রামায়ণ কথা ও ভারতকথা পাঁচালিরূপে গড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু বৌদ্ধ বিলুপ্তির ফলে বৌদ্ধ পাল গীতি লুপ্ত হয়েছে এবং ময়নামতী-গোপীচাঁদকথা যোগ-সম্বন্ধীয় হওয়ায় যোগপ্রিয় হিন্দু-মুসলমান দ্বারা রক্ষিত হয় এবং মুসলমানদের হাতে যোগীর কাহিনী বলে গোরক্ষ কাহিনী কিংবা ময়না-গোপীচাঁদ কাহিনী যথাক্রমে ষোলো ও আঠারো শতকে পাঁচালি পর্যায়ে উন্নীত হল। মৌখিক রচনায়ও ভাষা স্বাভাবিকভাবেই বিকশিত হয়েছিল। নইলে শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে (শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে) কিংবা শ্রীকৃষ্ণ বিজয়ে ভাষার এমন অর্থবহ বিকশিত রূপ পেতাম না। শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে ব্যবহৃত গোটা বারো আরবি-ফারসি শব্দ থেকে বোঝা যায় এ সময়ে দরবার আর দরবারি ভাষাও লোকপরিচিত এবং লোকপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অতএব মুসলমানেরাই লেখ্য বাঙলার সৃষ্টি সহায় ও পোষ্টা।
.
০৭.
॥ রাজকীয় প্রতিপোষণ ॥
এ-কথা না বললেও চলে যে মুসলিম সুলতান-সুবাদারের প্রতিপোষণেই প্রকৃতপক্ষে বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য লেখ্যরূপ লাভ করে। যেমন ধর্মপ্রচার ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্রিটিশ আমলে বাঙলা গদ্যের চর্চা হয়।
গঠনযুগে ভাষার বুনিয়াদ দ্রুত গড়ে ওঠে এবং ভাষা পুষ্টি লাভ করে অনুবাদের মাধ্যমে। বাঙলা ভাষার ক্ষেত্রেও এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। মুসলমান সুলতান-সুবাদারের আগ্রহে সংস্কৃত, ফারসি ও হিন্দি সাহিত্যের উৎকৃষ্ট গ্রন্থগুলোর বাঙলা অনুবাদ শুরু হয়। কেবল তা-ই নয়, এ ব্যাপারে বাঙালি মুসলমানও অগ্রণী ছিল। গৌড় সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহর আমলে (১৩৮৯-১৪০৯ খ্র.) তাঁর কর্মচারী শাহ মুহম্মদ সগীর কিতাব চাহিয়া ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করেন। রুকনউদ্দীন বরবক শাহর (১৪৫৯-৭৪) অভিপ্রায় অনুসারে কৃত্তিবাস অনুবাদ করেন রামায়ণ ৫° বরবক শাহ ও তাঁর পুত্র সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহর আমলে গুণরাজ খান মালাধর বসু শ্রীকৃষ্ণ বিজয় নামে ভাগবতের অংশবিশেষের অনুবাদ করেন (১৪৭৪-৮০ খ্র.) আর জায়নুদ্দিন রচনা করেন রসুল বিজয়।
বরিশালের ফুলিয়া (ফুল্লশ্রী) গাঁয়ের বিজয় গুপ্ত (১৪৮৫ খ্রী.)৫২, জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ ওর্ফে হোসেন শাহর আমলে (১৪৮২-৮৬ খ্রী.) পদ্মাপুরাণ অবলম্বনে মনসার ভাসান রচনা করেন। মধ্য বঙ্গে বিপ্রদাস পিপলাই (১৪৯৪ খ্রী.) মনসামঙ্গল ও কবিচন্দ্র মিশ্র গৌরীমঙ্গল রচনা করেন সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহর আমলে। সৈয়দ আলাউদ্দীন হোসেন শাহর চট্টগ্রামস্থ অধিকারের সেনানী শাসক (Military Governor) পরাগল খানের সভাকবি কবীন্দ্র পরমেশ্বর পরাগলী মহাভারত এবং তাঁর পুত্র ছুটি খানের সভাকবি শ্রীকর নন্দী ছুটি খানী অশ্বমেধ পর্ব রচনা। করেন। হোসেন শাহর পৌত্র ফিরোজ শাহর আদেশে সংস্কৃত কাহিনীর অনুসরণে বিদ্যাসুন্দর কাব্য রচনা করেন দ্বিজ শ্রীধর কবিরাজ (১৫১৯-৩৩ খ্রী.)৫৩। কবিশেখর বিদ্যাপতি আর যশোরাজও তাঁদের পদে নাসির শাহ (নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ) ও আলাউদ্দীন হোসেন শাহর স্তুতি করেছেন।
চট্টগ্রাম ছিল আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত। আর আরাকানের রাজধানী ছিল মোহং (Mrauhang)। এর বিকৃত বাঙলা নাম রোহাং বা রোসাঙ। রোসাঙের বাঙালি মুসলমান রাজসচিব আশরাফ খানের আগ্রহে কাজী দৌলত (১৬২২-৩৫) অনুবাদ করেন হিন্দি কবি মিয়া সাধনের অধ্যাত্ম-রূপক কাব্য ময়নাসৎ। এর বাঙলা নাম সতী ময়না-লোর-চন্দ্রানী। মাগন ঠাকুর, সোলায়মান, সৈয়দ মুসা, সৈয়দ মুহম্মদ খান, নবরাজ মজলিস প্রমুখ রাজসচিবের আদেশে পদ্মাবতী, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, রতন কলিকা-আনন্দ বর্মা, তোহফা, সপ্ত পয়কর ও সেকান্দর নামা অনুবাদ করেন আলাউল। এভাবে কারো-না-কারো প্রতিপোষকতায় মধ্যযুগীর ধারায় অনুবাদের কাজ উনিশ শতকের প্রথমার্ধ অবধি চলেছে।
মধ্যযুগে পাক-ভারতের হিন্দুরা সংস্কৃতের ভাষাকে ধর্মকথা তথা লৌকিক দেবতার মাহাত্ম্য প্রচারের বাহনরূপেই কেবল ব্যবহার করতেন। মালাধর বসুর কথায়, পুরাণ পড়িতে নাই শূদ্রের অধিকার। পাঁচালি পড়িয়া তর এ ভব সংসার। এ উদ্দেশ্য স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। অতএব তাঁরা গরজে পড়ে ধর্মীয় প্রচার-সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সাহিত্যশিল্প গড়ে তুলবার প্রয়াসী হননি। দেবতার মাহাত্ম্যকথা জনপ্রিয় করাবার জন্যে তারা প্রেম ও বিরহ কাহিনীর আশ্রয় নিয়েছেন এবং এতে সাহিত্য-শিল্প যা গড়ে উঠেছে তথা সাহিত্যরস যা জমে উঠেছে তা আনুষঙ্গিক ও আকস্মিক, উদ্দিষ্ট নয়। কাজেই বলতে হয় মধ্যযুগে হিন্দুদের বাঙলা সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ছিল না, লৌকিক ধর্মের প্রচারই লক্ষ্য ছিল। এর এক সম্ভাব্য কারণ এ হতে পারে যে শিক্ষা ও সাহিত্যের বাহন ছিল সংস্কৃত। কাজেই শিক্ষিতমাত্রই সংস্কৃত সাহিত্য পাঠ করত। তাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টির গরজ কেউ অনুভব করেনি। তারা অশিক্ষিতদেরকে ধর্মকথা শোনানোর জন্যে ধর্ম সংপৃক্ত পাঁচালি রচনা করতেন। পরে সংস্কৃতের প্রভাব কমে গেলেও এবং বাঙলা প্রাথমিক শিক্ষায় গুরুত্ব পেলেও পূর্বেকার রীতির বদল হয়নি আঠারো শতক অবধি। কেবল আঠারো শতকেই কয়েকজন হিন্দু-প্রণয়োপাখ্যান রচয়িতার সাক্ষাৎ পাচ্ছি৫৫।
আর্যেরা প্রকৃতিপূজক ছিল। আর্যভাবে পাক-ভারতিক জনগণ প্রাকৃত শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে তোয়াজে-তারিফে তুষ্ট করে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তা খুঁজেছে চিরকাল। ফলে প্রাকৃতিক শক্তিকে পদানত করে জীবনকে বিপন্মুক্ত করবার চেষ্টা দেখা যায়নি কখনো। এভাবে বাঙালি হিন্দুর মন-মানসে সাহস স্বাভাবিকভাবে জন্মাতে পারেনি। ফলে দেবতা ও অপদেবতার কাল্পনিক অনুকম্পানির্ভর জীবনের স্বাভাবিক স্ফুর্তিও ব্যাহত হয়েছে অনেকাংশে। এ বিকৃত মনমানসের স্বাক্ষর রয়েছে পুরাণমিশ্ৰিত মঙ্গলকাব্যে ও অন্যান্য পাঁচালিতে। সংস্কারমুক্ত একেশ্বরবাদী মুসলমানের সংস্পর্শে আসার ফলে এদেশী হিন্দুর প্রাণে-মনে মানবাত্মার মহিমা এবং মানবিক শক্তি, সামর্থ্য ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে অভিনব বোধ জাগে। মুসলিম প্রভাবে এই মানব মহিমা ও মানবিকতার উদ্বোধনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে উদ্ভূত হয়েছে মানবাত্মার অপরিসীম মহিমা ও সম্ভাবনার বাণীবাহী বৈষ্ণব মতের, আর পূর্ব বাঙলার নদী-নির্যাতিত সগ্রামী মনে জেগেছে পৌরুষ, দেবদ্রোহিতা, আত্মনির্ভরশীলতা ও মর্যাদাবোধ; যেমন হয়েছিল দক্ষিণ ও উত্তর ভারতে অদ্বৈতবাদ ও ভক্তিভিত্তিক সন্তধর্মের উদ্ভব। তাই মনসামঙ্গলের বিকাশ-ভূমি পূর্ব বাঙলা। মনসার ভাসান দেবতার বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রামের কাহিনী। সে-সগ্রামে মানুষ পরাজিত হয়েছে বটে, কিন্তু তার আত্মা হয়েছে মহিমান্বিত। চাঁদ সদাগর আত্মবিশ্বাস ও আত্মিক শক্তির প্রতীক। তিনি মাথা নোয়ালেন দেবতার পায়ে নয়, একটি কিশোরীর অনমনীয়কৃচ্ছু সাধনার কাছে। চাঁদ বেনে ও বেহুলা বাঙালি পুরুষ ও নারী। মানুষকে এ স্বরূপে ইতিপূর্বে বাঙালি র রচনায় আর দেখা যায়নি। ইসলামি সংস্কৃতির বিস্তার যে বাঙালি র চিত্তলোকে বাসন্তী হাওয়া বয়ে আনে, তাদের মানস জগৎ
যে নবজীবনের সংস্পর্শে বিপ্লবমুখী ও সৃজনশীল হয়ে উঠে, তার প্রমাণ মঙ্গলকাব্য আর বৈষ্ণব। মতবাদ ও সাহিত্য। মধ্যযুগের মুসলিম-রচিত সাহিত্য দেশ-দুর্লভ নতুন ভাব, চিন্তা, রস ও আত্মবিশ্বাস-পুষ্ট জীবনবোধের আকর।
.
০৮.
॥ মুসলিম–রচিত বাঙলা সাহিত্য।
বাঙলা দেশের প্রায় সবাই দেশজ মুসলমান। তাই বাঙলা সাহিত্যের উন্মেষ- যুগে সুলতান সুবাদারের প্রতিপোষকতা পেয়ে কেবল হিন্দুরাই বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টি করেননি, মুসলমানেরাও তাঁদের সাথে সাথে কলম ধরেছিলেন এবং মধ্যযুগের বাঙালি মুসলমানগণের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব এই যে ধর্মপ্রেরণাবিহীন নিছক সাহিত্যরস পরিবেশনের জন্যে তাঁরাই লেখনী ধারণ করেন। আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধ সাহিত্য আমরা তাদের হাতেই পেয়েছি। কাব্যের বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য দানের গৌরবও তাদেরই। কেননা সবরকমের বিষয়বস্তুই তাঁদের রচনার অবলম্বন হয়েছে। মুসলমানের দ্বারা এই মানব-রসাশ্রিত সাহিত্যধারার প্রবর্তন সম্ভব হয়েছে ইরানি সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে। দরবারের ইরানি ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় এদেশের হিন্দু ও মুসলমানের একই সূত্রে এবং একই কালে হলেও একেশ্বরবাদী মুসলমানের স্বাজাত্যবোধ তাদের ইরানি সংস্কৃতি দ্রুত গ্রহণে ও সাঙ্গীকরণে সহায়তা করেছে প্রচুর। কিন্তু গোঁড়ামিপ্রবণ হিন্দুর পক্ষে ছয়শ বছরেও তা সম্ভব হয়নি। তাই মুসলমান-কবিগণ যখন আধুনিক সংজ্ঞায় বিশুদ্ধ সাহিত্য প্রণয়োপাখ্যান রচনা করেছিলেন, হিন্দু-লেখকগণ তখনো দেবতা ও অতিমানব জগতের মোহমুক্ত হতে পারেননি।
মুসলমান-রচিত সাহিত্যের বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানবিকতা, যা মানুষ সম্বন্ধে কৌতূহল বা জিজ্ঞাসাই নির্দেশ করে অর্থাৎ বিস্ময়-ব্যাকুল কল্পচারী মানুষের প্রকৃতি, নিসর্গ ও মানস-সৃষ্ট দেব দানব সম্বন্ধীয় আদিম কৌতূহল চোখে-দেখা মানুষের প্রতি নিবদ্ধ হল। অর্থাৎ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে ওরাও রইল, মানুষকেও জিজ্ঞাসার বিষয় করে নিল। প্রাকৃত ও অপ্রাকৃত, লৌকিক ও অলৌকিক, স্বপ্ন ও কল্পনা এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষের কোনো সীমারেখা স্বীকৃত নয় এ জগতে। নদী নগরী, গিরি-মরু-কান্তার ও স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পরিসরে দেব-দানব-রাক্ষস, ভূত-প্রেত-জ্বিন এবং বুনো পশুপাখি-সরীসৃপের সমবায়ে গড়ে উঠেছে এ জগৎ। বাহুবল, মনোবল, আর বিলাস-বাঞ্ছাই সে জীবনের আদর্শ, সগ্রামশীলতা ও বিপদের মুখে আত্মপ্রতিষ্ঠা সে জীবনের ব্রত এবং ভোগই লক্ষ্য। এক কথায় সংঘাতময় বিচিত্র দ্বান্দ্বিক জীবনের উল্লাসই এ সাহিত্যে পরিব্যক্ত।
পাক-ভারতে মুসলমান অধিকার যেমন ইরানি সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে এ দেশবাসীর পরিচয় ঘটিয়েছে, তেমনি একচ্ছত্র শাসন ভারতের অঞ্চলগুলোর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। এরূপে বাঙালি রা ইরানি ও হিন্দুস্তানী ভাষা-সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ পেয়ে এ দুটোর আদর্শে ও অনুসরণে নিজেদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পরিচর্যা করে সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ঋদ্ধ হয়েছে।
.
০৯.
॥ উপাখ্যান ॥
হিন্দুরচিত সাহিত্য যেমন মুখ্যত অনুকৃতি, বাঙালি মুসলমান রচিত সাহিত্যও প্রধানত অনুবাদ। গোটা মধ্যযুগব্যাপী হিন্দু-মুসলমানের বাঙলা রচনা অনুকৃতি ও অনুবাদে সীমিত। এ অসম্পূর্ণ শিক্ষা ও অসামর্থ্যেরই সাক্ষ্য। এঁদের রচনা পরিমাণে প্রচুর কিন্তু উৎকর্ষে বিশিষ্ট নয়। আমাদের মুকুন্দরাম যখন চণ্ডীমঙ্গল লিখছেন তখন শেক্সপিয়র লিখেছেন তাঁর কালজয়ী নাটক। এতেই বোঝা যায় উনিশ শতকের আগে বাঙলা কখনো প্রতিভার পরিচর্যা পায়নি। তাই তারা লাটিমের মতো কেবলই ঘুরেছে, কিন্তু পাঁচশ বছরেও ভাষায় ও সাহিত্যে এতটুকু অগ্রসর হয়নি। মূলত, ফরাসি ও হিন্দি গ্রন্থের অনুবাদের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছে আমাদের উপাখ্যান-সাহিত্য এবং আরবি ও ফারসি থেকে অনূদিত হয়েছে আমাদের ধর্ম ও যুদ্ধ বিষয়ক গ্রন্থগুলো। অনুবাদ সাধারণ তিন প্রকারের হত– কায়িক, ছায়িক ও ভাবিক অর্থাৎ আক্ষরিক, স্বাধীন অনুসৃতি ও ভাবানুসরণ। সেকালে অনুবাদ কৃচিৎ আক্ষরিক হত। হিন্দি ও ফারসি প্রণয়োপাখ্যানগুলো সাধারণত সূফীতত্ত্বের তথা জীবাত্মা-পরমাত্মার রূপকাশ্রিত হলেও বাঙলায় তর্জমা হয়েছে লৌকিক প্রণয়োপাখ্যান রূপেই। তত্ত্বকথাকে এভাবে রস কথায় রূপান্তরের প্রবণতার মধ্যে ঐহিক জীবনবাদী বাঙালি মানসের স্বরূপ ধরা পড়েছে। চর্যাপদ, বৈষ্ণবগান, বাউল-মুর্শিদা-মারফতি প্রভৃতি অধ্যাত্মগীতির দেশে এ মানবিক রস-প্রীতি লক্ষণীয় ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এ বাঙালি চরিত্রের একটি নতুন দিগদর্শন। এদিক দিয়ে শাহ মুহম্মদ সগীরের (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রী.) ইউসুফ-জোলেখাই সম্ভবত গোটা আধুনিক পাক-ভারতিক সাহিত্যে প্রথম লৌকিক প্রণয়োপাখ্যান।
সে-যুগের হিসেবে বাঙলা রোমান্টিক সাহিত্য পরিমাণে প্রচুর, যদিও বৈশিষ্ট্যে বিচিত্র নয়। চৌদ্দ শতকের শেষ দশকে যার শুরু, বটতলার বদৌলতে আজ অবধি তার ইতি ঘটেনি। অধিকাংশ রোমান্স উনিশ-বিশ শতকে দোভাষী রীতিতে রচিত এবং রূপে-রসে নিতান্তই তুচ্ছ আর ভাবে-ভঙ্গিতেও বৈশিষ্ট্যহীন। বিশেষ করে পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত লোকের সাহিত্য সৃষ্টি হওয়ার পর ওসব রচনার আর কোনো সাহিত্যিক মূল্যই নেই। আর সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক মূল্যও নগণ্য। তাই আমরা ওগুলো বাদ দিয়ে আঠারো শতক অবধি রচিত জ্ঞাত রোমান্সগুলোর নাম করছি।
চৌদ্দ শতকের শেষের দিকে কিংবা পনেরো শতকের প্রথম দশকে রচিত হয় শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা। ষোলো শতকে পাচ্ছি দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী মজনু, মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী, শা বারিদ খানের বিদ্যাসুন্দর। সতেরো শতকের উপাখ্যান হচ্ছে দোনা গাজীর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল; কাজী দৌলতের সতীময়নালোর-চন্দ্রানী, আলাউলের পদ্মাবতী সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, সপ্ত পয়কর, রতন কলিকা; মাগন ঠাকুরের চন্দ্রাবতী, আবদুল হাকিমের লালমতি সয়ফুলমুলক, ইউসুফ জোলেখা; নওয়াজিস খানের গুলে বকাউলি, পরাগলের শাহ পরী, মঙ্গলাদের শাহজালাল-মধুমালা, সৈয়দ মুহম্মদ আকবরের জেবল মূলক সামারোখ, আবদুল করিম খোন্দকারের তমিম আনসারী, শরীফ শাহর লালমতি সয়ফুলমুলুক। আর আঠারো শতকে রচিত হয়েছে মুহম্মদ মুকিমের কালাকাম, মৃগাবতী, গুলে বকাউলি; মুহম্মদ রফিউদ্দিনের জেবল মূলক শামারোখ, শাকের মাহমুদের মনোহর মধুমালা, নুর মুহম্মদের মধুমালা, ফকির গরীবুল্লাহর ইউসুফ জোলেখা; সৈয়দ হামজার মধুমালতী, জৈগুনের কেচ্ছা; মুহম্মদ আলী রজার তমিম গোলাম চতুন্নছিলাল, মিশরীজামাল, মুহম্মদ আলীর শাহপরী মল্লিকাজাদা, হাসান বানু; আবদুর রাজ্জাকের সয়ফুলমুলুক লালবানু, শমসের আলীর রেজওয়ান শাহ এবং মুহম্মদ জীবনের বানু হোসেন বাহরাম গোর, কামরূপ-কালাকাম, খলিলের চন্দ্রমুখী প্রভৃতি। মুসলিম প্রভাবে আঠারো-উনিশ শতকের কয়েকজন হিন্দুও প্রণয়োপাখ্যান লিখেছেন। সুশীল মিশ্রের রূপবান-রূপবতী উপাখ্যান, বাণীরাম ধরের শীত-বসন্ত কাহিনী, রামজী দাসের শশিচন্দ্রের পুথি, দ্বিজ পশুপতির চন্দ্রাবলী, মহেশ চন্দ্র দাসের সয়ফুল তমিজ জরুখভান, গোপীনাথ দাসের মনোহর মধুমালতী, এ যাবৎ আমাদের হাতে এসেছে। এসবের মধ্যে ইউসুফ জোলেখা, লায়লীমজনু, সতীময়না-লোর-চন্দ্রানী, পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলুক, লালমতী সয়ফুলমুলুক, মধুমালতী, গুলেবকাউলি ও চন্দ্রাবতী কাব্যগুণে, কাহিনী-মাধুর্যে কিংবা বৈদগ্ধ্যে শ্রেষ্ঠ।
.
১০.
॥ তত্ত্বসাহিত্য।
মানুষের মনে জগৎ ও জীবন সৃষ্টির রহস্য এবং জগৎ ও জীবনের মহিমা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য সম্বন্ধে যে চিরন্তন ও সর্বজনীন জিজ্ঞাসা রয়েছে তারই মনোময় জবাব খোঁজা হয়েছে আমাদের ধর্ম ও অধ্যাত্মজীবন সম্পর্কিত রচনায়। বাস্তবধর্মী শক্তিমানের জিজ্ঞাসা মানুষকে করেছে বিজ্ঞানী; ভাববাদী দুর্বলকে তা-ই করেছে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক। একই জিজ্ঞাসা আপাতবিরোধী দু-কোটির চিন্তা ও কর্মের প্রেরণা ও জন্ম দিয়েছে। এই একই জিজ্ঞাসা কাউকে দিয়েছে বহিষ্টি, কাউকে দিয়েছে অন্তদৃষ্টি। বহিদৃষ্টি মানুষকে করেছে বিষয়ী ও বিজ্ঞানী। অন্তদৃষ্টি মানুষকে করেছে রহস্যবাদী; গড়ে তুলেছে আধ্যাত্মবাদ, দিয়েছে বৈরাগ্য বা ইহবিমুখতা, জাগিয়েছে জীবনের জীবনের পিপাসা। বৈরাগ্য প্রাচ্যের মানস-সম্পদ আর বিজ্ঞান পাশ্চাত্যের ঐশ্বর্য। দু-টোরই মূল প্রেরণা জিগীষা। একটার লক্ষ্য আত্মজ্ঞান, অপরটার কাম্য দুনিয়ার জয়। একটা সম্বল হৃদয় ও মনোবল, অপরটার হাতিয়ার বুদ্ধি ও বাহুবল। একটি হৃদয়বৃত্তিক লীলা, অপরটি প্রাণধর্মের অভিব্যক্তি।
তত্ত্বচিন্তা মানুষকে তিন মার্গের সন্ধান দিয়েছে–জ্ঞানের, কর্মের ও ভক্তির। জ্ঞানবাদ আস্তিক্য, নাস্তিক্য ও সংশয়প্রবণ দর্শনের জন্ম দিয়েছে। কর্মবাদ সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রবিধি গড়ে তুলেছে। আর ভক্তিবাদ হয়েছে নিষ্ঠা ও বৈরাগ্যের উৎস এবং ভক্তিবাদের উপজাত (by product)-কারুর কারুর মতে পরিণতি হচ্ছে প্রেমবাদ।
বাঙলা ভাষারও এই তত্ত্বজিজ্ঞাসা তিন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির উৎস হয়েছে, এগুলো: ধর্মসাহিত্য, তত্ত্বসাহিত্য ও অধ্যাত্ম প্রেমগীতি।
ক. ধর্মসাহিত্যে উল্লেখ্য হচ্ছে : নেয়াজ ও পরানের (১৬ শতক) কায়দানী কেতাব; খোন্দকার নসরুল্লাহর (১৭ শতক), হেদায়তুল ইসলাম, শরীয়তনামা; শেখ মুতালিবের (১৬৩৯ খ্রী.) কিফায়তুল মুসল্লিন, আলাউলের তোহফা, খোন্দকার আবদুল করিমের (১৮ শতক) হাজার মোসায়েল, দুল্লামজলিস; আশরাফের (১৭ শতক) কিফায়তুল মুসল্লিন, আবদুল্লাহর (১৮ শতক), নসিয়ত নামা, আলী রজার (১৮ শতক) সিরাজকুলুব, কাজী বদিউদ্দীনের (১৮ শতক), সিফৎ-ই ইমান, সৈয়দ নাসিরউদ্দীনের (১৮ শতক) সিরাজ সবিল, বালক ফকির ও মুহম্মদ মুকিমের (১৮ শতক) ফায়দুল মুকতদী, সৈয়দ নূরুদ্দিনের (১৮ শতক) দাকায়েতুল হাকায়েক, রুহুনামা, রাহাতুল কুলুব; মুহম্মদ আলীর (১৮ শতক) হায়রাতুল ফেকাহ্, হায়াৎ মাহমুদের হিতজ্ঞানবাণী, সর্বভেদ বাণী প্রভৃতি।
খ. তত্ত্ব সাহিত্যে সাধারণত যোগ ও সূফী সাধন-তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। সমাজ ও ধর্মের আচারগত প্রভেদ সত্ত্বেও শাসক-শাসিত সম্পর্কের অন্তরালে দুটো ভিন্নাদর্শ জাতির মধ্যে কী নিবিড় প্রাণের যোগ সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ মেলে এ ধরনের রচনায়। জীবনের যে চিরন্তন প্রশ্নে আত্মার আকুলতা, উদার পটভূমিকায় ও বিস্তৃত পরিসরে তার সমাধান খুঁজতে চাইলে জাত, ধর্ম ও সমাজচেতনার ঊর্ধ্বে উঠতেই হয়। মানস-সংস্কৃতির এরূপ লেনদেন, এমনি আত্মিক যোগাযোগ চিরকালই মানুষের চিত্ত-প্রসারের ও আত্মবিকাশের সহায়ক হয়েছে।
ইরানি সূফী সাধনাও যৌগিক প্রক্রিয়া-নির্ভর। পাক-ভারতের যোগসাধনার সঙ্গে পরিচয়ের পরে সূফীদের দেহতত্ত্বের সঙ্গে যোগশাস্ত্রের সার্থক মিশ্রণ ঘটিয়ে উভয় প্রক্রিয়ার সমন্বয় সাধন করে যিনি পাক-ভারতে মুসলিম সমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, তাঁর নাম শেখ শরফুদ্দীন বু আলী কলন্দর শাহ (মৃত্যু ১৩২৪ খ্র.)। তাঁর প্রবর্তিত সাধনপদ্ধতির বাঙলা নাম যোগ কলন্দর। পানিপথে তার সমাধি আছে। উত্তরভারতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর তাঁর খ্যাতি আজো ম্লান হয়নি। একসময়ে বাঙলায় কলন্দরপন্থী বৈরাগীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে, কলন্দর বলতে মুসলিম বৈরাগীই বোঝাত। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে আছে :
কলন্দর হৈয়া কেহ ফিরে দিবারাতি।
ঋণ কড়ি নাহি দাও, নহ কলন্দর।
এই তত্ত্ব বা সূফী সাহিত্যে পাই ষোলো শতকের শেখ ফয়জুল্লাহার গোরক্ষ বিজয়, সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানপ্রদীপ, অজানা কবির যোগকলন্দর, কবি হাজী মুহম্মদের সুরতনামা বা নুরজামাল; সতেরো শতকের কবি শেখচান্দের হর-গৌরীসম্বাদ, শাহদৌলপীর বা তালিবনামা, আবদুল হাকিমের শিহাবুদ্দীননামা ও চারিমোকামভেদ, মীর মুহম্মদ সফীর নুরনামা; আর আঠারো শতকের কবি আলি রজার আগমজ্ঞানসাগর, কাজী মনসুরের শিনামা, শেখ জেবুর আগম, শেখ জাহেদের আদ্য পরিচয়, রমজান আলীর আদ্য ব্যক্ত, মোহসীন আলীর মোকাম মঞ্জিলের কথা প্রভৃতি।
গ. সওয়াল সাহিত্য : এ ধরনের গ্রন্থে জগৎ ও জীবনের নানা রহস্য-চিন্তা, হেঁয়ালি ও সাধারণ ইতিহাস, ভূগোল, জীবতত্ত্ব, বস্তুতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তর রয়েছে। শেখ সাদীর গদামল্লিকা, সেরবাজ চৌধুরীর ফক্করনামা বা মল্লিকার সওয়াল, এতিম আলমের আবদুল্লাহর হাজার সওয়াল, আবদুল হাকিমের নুরনামা, আকিলের নুরনামা, মুসানামা, সৈয়দ নূরুদ্দীন ও নসরুল্লাহ খোন্দকারের মুসার সওয়াল প্রভৃতি এ জাতীয় গ্রন্থ।
ঘ. সাধন ও ভজনসঙ্গীতরূপে পাচ্ছি : রাধাকৃষ্ণরূপক গীতি, বাউল গান ও অন্যান্য আধ্যাত্ম সঙ্গীত।
রাধাকৃষ্ণ রূপকে জীবাত্মা-পরমাত্মার প্রেমবিষয়ক সূফীমতের অধ্যাত্ম সঙ্গীত যারা রচনা করেছেন, তাঁদের মধ্যে মীর ফয়জুল্লাহ, মির্জা কাঙালী, সৈয়দ মোর্তুজা, নসির মাহমুদ, সৈয়দ সুলতান, চাঁদ কাজী, আলাউল, ফাজিল নাসির মুহম্মদ, সৈয়দ আইনুদ্দীন, মোহসেন আলী, আবাল ফকির, পীর মুহম্মদ, বকশা আলী, এবাদুল্লাহ, শেখ ভিখন, শেখ ফতন (ফতেহ), আলিমুদ্দিন, মনোহর, আফজল, শমসের আলী, আলি রজা এশাদুল্লাহ, সফতুল্লাহ, আলি মিয়া, মোহাম্মদ হানিফ, কমর আলি, চম্পা গাজী, মোহাম্মদ হাসিম প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য।
বাউল গান আমাদের তত্ত্ব-সাহিত্যের অন্যতম শাখা। মুসলিম প্রভাবে তথা সূফী মতবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবে ও সংযোগে বাউল মতের আধুনিক রূপান্তর হয়েছে সত্য, কিন্তু এর মূল রয়েছে প্রাচীন ভারতে। আদিকাল থেকেই যে-কোনো ধর্মে দৈহিক শুচিতাকে মানস শুচিতার সহায়ক বলে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মনে হয় এই বোধেরই পরিণতি ঘটেছে দেহাত্মবাদে ও দেহতত্ত্বে। সাংখ্যে, যোগে, বৌদ্ধ দর্শনে ও সূফী সাধনতত্ত্বে দেহের বিশেষ মূল্য রয়েছে। দেহের আধারে যে-চৈতন্য, সে-ই তো আত্মা। এ নিরূপ-নিরাকার আত্মার স্বরূপ মানুষকে করেছে কৌতূহলী। এ থেকে মানুষ বুঝতে চেয়েছে–দেহযন্ত্র নিরপেক্ষ আত্মার অনুভূতি যখন সম্ভব নয়, তখন আত্মার রহস্য ও স্বরূপ জানতে হবে দেহ-যন্ত্র বিশ্লেষণ করেই। এভাবেই সাধনতত্ত্বে যৌগিক প্রক্রিয়া অসামান্য গুরুত্ব পেয়েছে। তাই এদেশের অধ্যাত্ম সাধনায় যোগাভ্যাস একটি আবশ্যিক আচার। সাংখ্য, যোগ ও তন্ত্র পাক-ভারতের আদিম অনার্য শাস্ত্র। বৌদ্ধযুগে এর বহুল চর্চা দেখা যায়। বাঙলার পাল আমলের তান্ত্রিক বৌদ্ধমতের একটি শাখাই প্রাচীন যুগে সহজিয়া গানে ও মধ্যযুগে বৈষ্ণব-সহজিয়া পদে আর পরবর্তীকালে বাউলগানে রূপ পেয়েছে।
উনিশ শতকের আগে রচিত বাউলগান দুর্লভ। বাউলগানের প্রধান কবি ফকির লালন সাঁই, শেখ মদন, পাগলা কানাই, তিনু, আতর চাঁদ, শ্রীনাথ, নলিন চাঁদ, হীরালাল, মেছেল চাঁদ, সদাই সাই, খেদমত সাঁই, ইরফান সাঁই, শীতলাং সাঁই, গোপাল প্রভৃতি।
মুরশিদা-মারফতি গানের কবি হচ্ছেন সৈয়দ শাহানুর, মুন্সী হোসেন আলী, রহিমুদ্দিন ফকির, রজবউদ্দিন, মিয়াধন, মোতালেব, নজির হোসেন বুরহানি, ফজলুল শিকদার, সাওয়াল শাহ (রমজান আলী), খতিশাহ (আবদুল মজিদ), উসমান, উমর আলী, হেকিম আবদুল মালেক, সৈয়দ আবদুল বারী, হাসান উদাস, শেখ কিনু প্রভৃতি। এবং চট্টগ্রামের মাইজভাণ্ডার খানকার ভক্তগণের রচিত গানগুলোও এ শ্রেণীর অন্তর্গত। অধিকাংশ মুর্শিদা-মারফতি গানে বাউল প্রভাব লক্ষণীয়।
মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু ও মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিণভারতে পরে উত্তরভারতে এবং সবশেষে বাঙলা দেশে হিন্দুসমাজে যে আলোড়ন হয় তার বাহ্যরূপ ছিল ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দুর মায়াবাদ তজ্জাত ভক্তিবাদ ও ইসলামের সূফীতত্ত্বই এসব আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের ভক্তিধর্ম, উত্তরভারতের সন্তধর্ম, এবং বাঙলার বৈষ্ণবধর্মও বাউল মত সূফীমতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল।
আত্মা পরমাত্মার অংশ। কাজেই আত্মাকে জানলেই পরমাত্মাকে জানা যায়। তাই দেহাধারস্থিত আত্মাকে জানাই বাউলের ব্রত।
ক. সখীগো জন্ম-মৃত্যু যাহার নাই
তাহার সঙ্গে প্রেম গো চাই।
উপাসনা নাই গো তার
দেহের সাধন সর্ব সার।
তীর্থব্রত যার জন্য
এই দেহে তার সব মিলে।
খ. খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনোবেড়ী দিতাম তাহার পায়।
গ. এ দেহের মাঝে আছেরে সোনার মানুষ
ডাকলে কথা কয়।
বাউলেরা তাদের ভাষায় অচিন পাখি অলখাই (অলক্ষ্য স্বামী), মনের মানুষ বা মানুষ রতন-রূপ আত্মা তথা পরমাত্মাকে জানবার সাধনা করেন। বৈষ্ণব বা সুফীর মতো এঁরা প্রেমিক নন, যোগীর মতো তাত্ত্বিক। মুর্শিদা-মারফতি ও বাউল গান আমাদের লোকসাহিত্যের অন্তর্গত। বাউলেরা উদার মানবতাবাদী। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তাদের মধ্যে দুর্লক্ষ্য। বাউল মত ও সত্যপীরকে কেন্দ্র করে বাঙলার নিম্নবিত্তের হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মিলন সম্ভব হয়েছিল।
॥ জীবনী সাহিত্য।
মুসলমান কবিগণ এক বিরাট জীবনীসাহিত্যও সৃষ্টি করেছেন। চৈতন্যদেব ও তাঁর অনুচরদের চরিতকথাগুলো যেমন একাধারে জীবনী, ইতিহাস, দর্শন, ধর্মকথা, ও কাহিনীকাব্য; এসব চরিতাখ্যান তেমন নয়। এখানে বাস্তব-অবাস্তব, লৌকিক-অলৌকিক কিংবা প্রাকৃত-অপ্রাকৃতের সীমারেখা মানা হয়নি। এখানে কল্পনা ইতিহাসাশ্রিত নয়। চরিতাখ্যানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে জৈনুদ্দিনের রসুল বিজয় (১৪৭৩ খ্রী.) সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ (১৫৮৬ খ্র.), শাহ বারিদ খানের হানিফার বিজয় ও রসুল বিজয়, শেখ ফয়জুল্লাহর গাজী বিজয়, শেখ চাঁদের রসুলবিজয়, নসরুল্লাহ খোন্দকারের জঙ্গনামা, আবদুল নবীর আমীর হামজা, গরীবুল্লাহ (পশ্চিমবঙ্গ) ইউসুফ-জোলেখা; আমির হামজা; সৈয়দ হামজার (পশ্চিমবঙ্গ) আমীর হামজা, হাতেম তাই; উজীর আলীর নসলে উসমান ইসলামাবাদ (ইতিহাসমূলক) এবং বিভিন্ন কবির কাসাসুল আম্বিয়া, সিফাতুল আম্বিয়া ও অন্যান্য আউলিয়া কাহিনী প্রভৃতি। এগুলো রচিত হয়েছে। মুখ্যত মুসলমানদের মুসলিম ঐতিহ্য-গর্বে উদ্বুদ্ধ করে তাদের মনে স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগিয়ে তোলার উদ্দেশ্যেই।
॥ জঙ্গনামা ॥
কারবালা কাহিনী নিয়েও অনেক যুদ্ধকাব্য ও মর্সিয়া-সাহিত্য গড়ে উঠেছে। এগুলো সাধারণত জারি ও জঙ্গনামা নামে পরিচিত। এ বিষয়ক ফারসি কেতাব মক্তুল হোসেনকে আদর্শ করেই বাঙলা জঙ্গনামাগুলো রচিত হয়েছে। বাঙলায় মত্তুল হোসেন বা জঙ্গনামার আদি কবি দৌলত উজির বাহরাম খান (১৬ শতক)। দ্বিতীয় কবি শেখ ফয়জুল্লাহ, ইনি জয়নবের চৌতিশা নামে বিলাপ রচনা করেন। তৃতীয় কবি মোহাম্মদ খান। ইনিই জঙ্গনামার শ্রেষ্ঠ কবি; তার কাব্যের নাম মক্তুল হোসেন। এর পরে যারা জঙ্গনামা রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে হায়াত মাহমুদ, জাফর, গরীবুল্লাহ ইয়াকুব, সফীউদ্দিন, সাদ আলী, আলি মোহাম্মদ, জিন্নাত আলী, হামিদুল্লাহ খান, আবদুল ওহাব, রাধাচরণ গোপ, মুহম্মদ মুন্সী, আবদুল হামিদ ও জনাব আলীর নাম উল্লেখযোগ্য। কারবালা যুদ্ধ ঐতিহাসিক কাহিনী। কিন্তু আমাদের পুথিকারেরা অলৌকিক ও অপ্রাকৃত কাহিনী সংযোগে তাকে রূপকথায় পরিণত করেছেন। এছাড়াও বিভিন্ন যুদ্ধকাহিনী রয়েছে–রসুল বিজয়, আলির জঙ্গনামা, জয়কুমরাজার লড়াই, হানিফার লড়াই, হামজার দিগ্বিজয়, জঙ্গে বদর, জঙ্গে খয়বর প্রভৃতি। ইসলামের উন্মেষযুগের এসব গৌরবগাথা রচনা করে মুসলমানকে স্বাজাত্যগর্বী ও স্বধর্মনিষ্ঠ করার প্রয়োস ছিল কবিদের।
॥ বিবিধ রচনা ॥
এ ছাড়া, রাগ-তাল, জ্যোতিষ, চিকিৎসাশাস্ত্র, তুক্তা প্রভৃতি নানা বিষয়ক অনেক রচনা পাওয়া যায়। বারোমাসী কিংবা চৌত্রিশা কোনো বিশেষ বিষয়ক রচনা নয়। বারোমাসীতে মাস ও ঋতুর পরিবর্তনের সাথে সাথে নায়িকার (কৃচিৎ নায়কের) হৃদয়ের বৃত্তি-প্রবৃত্তির রূপান্তরের, বিশেষ করে বিরহ ব্যথার, চিত্র অঙ্কিত হয়। আর বাঙলার চৌত্রিশটি বর্ণের প্রত্যেকটিকে এক বা একাধিক পঙক্তির আদ্যক্ষর রূপে প্রয়োগ করে যে-পদবন্ধ রচনা করা হয় তাকেই চৌত্রিশা বলে। প্রায় সব পুথিতে বারোমাসী ও চৌত্রিশা পাওয়া যায়। এগুলো সেকালের সাহিত্য-শিল্পের বিশেষ অঙ্গ ছিল।
॥ দোভাষীরীতি ॥
সতেরো শতকের কবি কৃষ্ণরাম দাস তাঁর রায় মঙ্গল নামক কাব্যে বড় খা গাজীর মুখে ভাঙা হিন্দি প্রয়োগ করেছিলেন, সেই থেকে প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন সত্যনারায়ণ পাঁচালিকার ও ভারতচন্দ্র, রামপ্রসাদ প্রমুখ কবি অবাঙালি পাত্র-পাত্রী মুখে বিকৃত হিন্দুস্তানী ব্যবহার করেছেন। আঠারো শতকের শেষার্ধে হাওড়াবাসী কবি ফকির গরীবুল্লাহই (১৭৫৭-৮০ ) প্রথম বাঙলা ও হিন্দুস্তানী বাকধারার মিশ্রণে তার ইউসুফ জোলেখা, সোনাভান, মদন কামদেব পালা (সত্যপীরের পাঁচালি) ও জঙ্গনামা (হোসেন মঙ্গল) রচনা করেন। এই রীতির নাম দোভাষী রীতি। এ ভাষার লক্ষণ ও বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হিন্দুস্থানী (অর্থাৎ আরবি-ফারসি ও হিন্দি শব্দাধিক্য) শব্দ এবং হিন্দি বাক্য গঠন-রীতির প্রভাবপ্রসূত তেরা, মেরা, এয়সা, যেএসা প্রভৃতির বহুল প্রয়োগ। আঠারো শতকে গরীবুল্লাহ অনুসরণ করেন হাওড়াবাসী সৈয়দ হামজা (১৭৮৮-১৮০৫ খ্র.)। উনিশ-বিশ শতকে হাওড়া-হুঁগলীবাসী কবি মালে মুহম্মদ, জনাব আলি, মুহম্মদ খাতের প্রমুখ বহু কবি দোভাষী রীতিতে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্তু হাওড়া, হুগলী ও কলকাতা অঞ্চলের বাইরে কোথাও মুসলমানেরা এ রীতির অনুকরণ চর্চা করেনি।
কাজেই দোভাষী রীতি ব্রজবুলির মতো একটি কৃত্রিম সাহিত্যিক ভাষা। নতুন বন্দর কলকাতাকে কেন্দ্র করেই এর উদ্ভব এবং তার চতুম্পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের অধিবাসীরাই এর স্রষ্টা এবং ধারক। দোভাষী সাহিত্য ইংরেজ আমলের রাজধানী ও বন্দর অঞ্চলের অর্থাৎ কলকাতা-হাওড়া হুগলী এলাকার নির্জিত আধাবাঙালি মুসলমানের মন, মনন ও সংস্কৃতির প্রসূন। রোমান্স থেকে শরিয়ত-কথা অবধি সব বিষয়েই দোভাষী গ্রন্থ রয়েছে। কিন্তু এগুলো ভাষায়, ভাবে ও ভঙ্গিতে সাহিত্য হয়নি। তবু গত দেড়শ বছর ধরে বাঙলার অশিক্ষিত জনসাধারণের রস-পিপাসা ও জিজ্ঞাসা মিটিয়ে আসছে এ সাহিত্য। বিকল্প পাঠ্যপুস্তকের অভাবে সবাইকে পড়তে-শুনতে হয়েছে বলে একে জনপ্রিয় সাহিত্য বলে মনে করার হেতু নেই। অকালে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে মানুষ যা খায়, তাকে পুষ্টিকর সুখাদ্য বলে না ওতে ধড়ে প্রাণ যদি-বা টিকে থাকে, কিন্তু স্বাস্থ্যরক্ষা হয় না। দোভাষী পুথিও মানস-আকালের সাহিত্য। যারা এ সাহিত্য রচনা করেছেন, তাদের বর্তমান ছিল অনিশ্চিত আর ভবিষ্যৎ ছিল অন্ধকার। তাই তাঁরা আশ্রয় খুঁজেছেন কল্পলোকে এবং অতীতের গৌরবময় ও আনন্দোচ্ছল জগতে একটু শ্রান্তিহর ও গ্লানিমুক্ত স্বস্তির ভরসায়। অতএব, জীবনবিমুখ কল্পনাশ্রয়ী এ সাহিত্যের সঙ্গে মন বা মাটির যোগ ছিল না, এ হল পরগাছা।
দোভাষী পুথিতে কেউ কেউ মুসলমানদের গৌরবের সামগ্রী খুঁজে পান। কিন্তু মনে রাখতে হবে, গরীবুল্লাহর আবির্ভাব পলাশী যুদ্ধের পরে এবং তাঁর গ্রন্থগুলি রচিত হয় ১৭৬০-৮০ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে। নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সমাজ-সংস্কৃতির পরিবর্তনের এবং রাষ্ট্রীয় ও অর্থনীতিক ভাঙাগড়ার এ সময়টিতে জীবন-জীবিকায় যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল, বগীর হাঙ্গামা ও কোম্পানির দেওয়ানী লাভের ফলে ধন-প্রাণের উপর আকস্মিক বিপদপাতের যে-শঙ্কা জেগেছিল তাতে কারো পক্ষেই রসচর্চা করা সম্ভব ছিল না। তবু মানুষ যেহেতু স্থবির নয় এবং নাড়ির ক্ষুধার মতো মানস ক্ষুধাও মিটাতে হয় সেহেতু নিতান্ত গরজে পড়ে কাজ চালানো গোছের রসচর্চা তাকে করতেই হয়েছে। সুখ-সৌভাগ্যে যেমন রাজধানীর লোকেরই অগ্রাধিকার, দুঃখ-নির্যাতনেরও তেমনি তারাই প্রথম শিকার। এ রাষ্ট্রিক, আর্থিক, তজ্জাত নৈতিক, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পুরোনো শহর মুর্শিদাবাদ ও নতুন বন্দর কলকাতা ও তার উপকণ্ঠের লোক যখন দিশেহারা, তখনো দূরাঞ্চলে সে হাওয়া পৌঁছেনি। কলকাতায় তখন বুদ্ধিমান ও উদ্যোগী কিন্তু চরিত্রহীন, ঘরছাড়া, বেপরোয়া লোকের ভিড় জমেছে। কলকাতা তখন দালাল, বেনিয়া, জোচ্চোর ও ঠকের আড়া। এ বাজারে ইংরেজ-বাঙালি র চারিত্রিক ভেদ ছিল না। অযোগ্য ও দুশ্চরিত্র লোকের হাতে টাকা এলে যা হয়, তাই হল; এসব হঠাৎ-নবাবেরা ধরাকে সরা-জ্ঞানে উদ্দাম হয়ে উঠল। স্বল্প লোকের এ শ্ৰেণীটা ছাড়া বাকি লোকের জীবন তখন সর্বপ্রকার অনিশ্চয়তায় ম্লান। এমনি পরিবেশে কলকাতার হিন্দুসমাজে কবিওয়ালা আর মুসলমান সমাজে শায়ের-এর উদ্ভব। দুটো নামই তাচ্ছিল্য জ্ঞাপক। প্রশ্ন হতে পারে, কোম্পানির প্রত্যয়-পুষ্ট, কৃপা-জীবী হিন্দুরা যখন কোম্পানির অযাচিত অনুগ্রহে উদ্দাম হয়ে উঠছিল, তখন হিন্দুসমাজে কেন বন্ধ্যা যুগ এল? উত্তরে এটুকু বললেই চলে যে আপামরে বিলাবার মতো কৃপার পুঁজি তখনো কোম্পানির হাতে আসেনি; বিশেষত দেশের কোটি মানুষের জীবনে যখন দুর্যোগ-দুর্দিন নেমে এসেছে, তখন গুটিকয় সুখী মানুষের অন্তৰ্জীবনেও স্বস্তি থাকতে পারে না। দূষিত আবহ তাদের অবচেতন মনে নিশ্চিতই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ভারতচন্দ্রের ভাষায় বলা যায় নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?
দোভাষী পুথিতে যে ইসলামি আবহ সৃষ্টির তথাকথিত প্রয়াস আছে, তাও লজ্জাকর। নিন্দা বা প্রশংসা করবার জন্যেও যোগ্যতা চাই। অযোগ্য মুখে নিন্দা বা প্রশংসা দু-ই ব্যাজস্তুতি হয়ে পড়ে। ফকির গরীবুল্লাহ ছিলেন পীর-পূজারী, তাও লোক-শ্রুতির কাল্পনিক পীর দেবকল্প বড় খাঁ গাজী। তাঁর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব স্বীকৃত নয়। সত্যপীরও তাঁর অন্যতর জীবন-নিয়ন্তা। দোভাষী শায়েরেরা ইসলামের উন্মেষ যুগের নানা বীরের ও দেবকল্প নানা পীরের কাহিনী নিয়েই প্রধানত পুথিগুলি রচনা করেছেন। যে-কথা বিজাতিরা বললে মুসলমানেরা রুষ্ট হয়, সেই একহাতে কোরআন আর হাতে তরবারি নিয়ে রসুল, হযরত আলী, হামজা, হানিফা প্রমুখ দিগ্বিজয়ীরা পরাজিত রাজা ও অধিকৃত রাজ্যের মানুষকে বলপ্রয়োগে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে মুমিনের কর্তব্য করলেন বলে উল্লাস ও কৃতার্থ বোধ করেছেন, তাঁদের পুরনারীরা পরপুরুষের সঙ্গে দ্বন্দ্বে ও মল্লযুদ্ধে নেমেছেন। হিন্দুর দেব-কাহিনীর অনুকরণে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের পটভূমিকায় আল্লাহ, রসুল ও ফেরেস্তার সমবায়ে দেবকল্প মুসলিম বীরের ও পীরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ যেন বাস্তবজীবনে গ্লানি ভুলবার জন্যে ইসলামের গৌরবদিনের স্বপ্নলোক সৃষ্টি করে পর-পীড়িত জাতির আত্মপ্রবোধ লাভের অপপ্রয়াস।
সূফীভাবের নানা কাহিনী রচনায়ও আদর্শচেতনা সর্বত্র দেখা যায় না। আবার শঙ্কা ও অনিশ্চয়তাবোধ থেকে জীবন-জীবিকার নিরাপত্তার সহায় হিসেবে উপদেবতার উদ্ভব হয়েছে। কেবল সত্যপীর নয়; বনবিবি, ওলাবিবি, কালুগাজী, বড় খা গাজী, উদ্ধার বিবি, বাস্তুবিবি প্রভৃতির পূজা শিরনীও চালু হল একেশ্বরবাদী মুসলমান সমাজে। এঁদের সম্বন্ধে কাহিনী গড়ে উঠে ষোলো শতকে, কিন্তু এঁদের মাহাত্মকথা তথা পীর-পাঁচালি রচিত হয়েছে মুখ্যত উনিশ-বিশ শতকে। কাজেই এ সাহিত্য আমাদের জাতীয় জীবনে দুর্যোগ-দুর্দিনের ঐতিহাসিক দলিল–গৌরবের কিংবা গর্বের সামগ্রী নয়। এ Predawn darkness নয়–অমাবস্যার তমিস্রা। রেনেসাঁসের নয়–পতনের ও গ্লানির প্রতিচ্ছবি। অতএব, এ আত্মবিকাশকল্পে আত্মবিস্তার-প্রয়াস নয়। এমনি দুর্দিনের সাক্ষ্য বাঙলার ইতিহাসে আরো রয়েছে, এমনি দুর্যোগের ঘনঘটা আগেও বাঙালি র ভাগ্যাকাশে দেখা দিয়েছে, তখনো অসহায় বিমূঢ় বাঙালি অনুরূপ দিশেহারা ভাব দেখিয়েছে।
॥ বাঙালি র জীবন ও মননধারা ॥
যখনই সামাজিক ও আর্থিক জীবনে নিরাপত্তা ও স্বস্তির অভাব ঘটেছে, তখনই বাঙালি অধ্যাত্মজীবনের বৃহৎ ও মহৎ আদর্শ ত্যাগ করে জীবন-জীবিকার সহায় শক্তিদেবতার সন্ধান করেছে; আর দেবতার কৃপাজীবী হয়ে বাঁচতে চেয়েছে। তাই আমরা পালরাজাদের পতন যুগে নৈরাত্ম-নিরীশ্বরবাদী নির্বাণকামী বৌদ্ধসমাজকে অসংখ্য দেব-দেবীর স্তব-স্তুতিতে মুখর দেখতে পাই। মাটির মায়ামুগ্ধ জীবনবাদী বৌদ্ধেরা অমরত্বের ও চিরসুখের প্রত্যাশায় যোগতান্ত্রিক সাধনার মাধ্যমে দৈবশক্তিধর হয়ে নিশ্চিন্তে ও নির্বিঘ্নে জীবনোপভোগের প্রয়াসী হয়ে উঠল। তুকতাক দারু-টোনার শক্তি আয়ত্ত করে বৌদ্ধ ডাকিনী-যোগিনীরা কামাচার-সর্ব যে বীভৎস জীবনলীলা শুরু করল, তা রূপকথার আকারে আজো ভয়ঙ্কর, চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর হয়ে চালু আছে। রাঢ় অঞ্চলের সাধারণ বৌদ্ধের জীবন-জীবিকার সহায়ক দেবতা হিসেবে এক আদিম সূর্যদেবতা ধর্মঠাকুর নামে পূজিত হতে থাকেন।
শঙ্করের প্রচারিত অদ্বৈতবাদ ও জ্ঞানবাদের প্রভাবে বাঙলাদেশেও ব্রাহ্মণ্যধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটে। ব্রাহ্মণ্যবাদী সেন-শাসনকালে তাদের প্রতিপোষকতায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম বাঙলার লোকধর্মে পরিণত হল, আর তাদের বিরূপতায় বৌদ্ধমত লোপ পেল। এই সেনদের মন্দার দিনে তুর্কী বিজয়ের কিছু আগে থেকেই সুমহৎ বেদান্ত দর্শনে আস্থা হারিয়ে বাঙালি জনসাধারণ আবার তাদের অনার্য সংস্কারানুসারী পার্থিব জীবন-জীবিকার ইষ্ট ও অরি দেবতার পূজায় ব্রতী হয় আত্মরক্ষার ও আত্মপ্রসারের গরজে। মনসা ও চণ্ডীই এঁদের মধ্যে প্রধান। অপরদিকে গীতগোবিন্দে ও শেখ শুভোদয়ায় বাঙালি র চারিত্রিক শৈথিল্য ও কাঙাল মনের পরিচয় পাচ্ছি।
তুর্কী পরাজয়ে পেলাম সত্যপীর, দক্ষিণরায়-বড় খা গাজী, কালুরায়-কালু গাজী, বনদেবী বনবিবি, শীতলা-ওলা-ষষ্ঠী-বাস্তুদেবী প্রভৃতি; আর মুঘলশক্তির পতনে পেলাম বিদ্যাসুন্দর ও পীর পাঁচালি আর কবিওয়ালা ও শায়ের।
বাঙলা দেশে তথা পাক-ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে প্রথমত ও প্রধানত সূফী সাধকদের মাধ্যমে। দেশী প্রাকৃতজন ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নয়, দরবেশ প্রচারকদের কেরামতির আকর্ষণে ও প্রভাবেই ইসলাম বরণ করেছিল। কাজেই শরিয়তি ইসলামের সঙ্গে তাদের নিবিড় পরিচয় হয়নি। তবু গৌড় সুলতানদের আমলে ইসলাম জনমনে কিছুটা জাগ্রত ছিল। কিন্তু ১৫৭৫ খ্রীস্টাব্দে বাঙলাদেশে নামত মুঘল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মুঘলে-পাঠানে তথা রাজশক্তি ও সামন্তশক্তির মধ্যে বহুবর্ষব্যাপী যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত চলছিল এবং তার ফলে যে শাসনতান্ত্রিক বিপর্যয় ও রাষ্ট্রিক অনিশ্চয়তা দেখা দিল আসলে শেরশাহর বঙ্গবিজয় (১৫৩৯ খ্রী) থেকেই এর শুরু। তাতে প্রাকৃতজনের ধন-প্রাণ নিরাপদ ছিল না। আকবর-জাহাঙ্গীরের আমল এভাবে কেটে যাওয়ার পর যদিও শাহজাহান-আওরঙ্গজীবের আমলে দেশে শক্তির দ্বন্দ্ব ছিল না, তবু সাত সমুদ্র না হোক, তেরো নদীর ওপারের দিল্লী শাসনে জনগণের আর্থিক দৈন্য ঘোচেনি। কেননা আর সব সাম্রাজ্যবাদীর মতো মুঘলেরাও ছিল কেবল শাসনে তৎপর ও শোষণে উৎসুক, প্রজার হিতসাধনের দায়িত্ব নেয়নি তারা। শাহজাহানের আমলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এবং মগ-হার্মাদ দৌরাত্ম্যে মানুষ ত্রাসের মধ্যে বাস করত আর আওরঙ্গজীবের আমলে বেনে স্বেচ্ছাচার বেড়ে গিয়ে নতুন উপসর্গ হয়ে চেপেছিল, এসবের সঙ্গে ক্রমে যুক্ত হল বিদ্রোহ-বিগ্রহ, বগী বর্বরতা, সুবাদারের স্বেচ্ছাচার, সামন্ত স্বৈরাচার ও বেনে দৌরাত্ম। তারপর পলাশী-উত্তর অর্ধ-শতাব্দীর শাসনতান্ত্রিক অব্যবস্থা ও আর্থিক দুর্গতি মারাত্মক হয়ে দেখা দিল।
এমনি বিপর্যয়ের মুখে দেশজ মুসলমানেরা ও হিন্দুরা রাজশক্তির উপর আস্থা হারিয়ে অগত্যা জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তার জন্যে উপদেবতা সৃষ্টি করে পূজা-শিরনী, দিতে থাকে। এরূপে ষোলো শতকের শেষপাদ থেকে সত্যনারায়ণ-সত্যপীর, বনদেবী-বনবিবি, কালুরায়-কালুগাজী, দক্ষিণরায় বড় খ.গাজী, শীতলা-ওলা, ষষ্ঠী-উদ্ধার-বাস্তুদেবী হিন্দু-মুসলমানের পূজা পেতে থাকে। অন্যদিকে নিম্ন ও উত্তর-পশ্চিম বাঙলার কিছুসংখ্যক বাঞ্ছত লোক বাউল-বৈরাগী জীবনে আত্মপ্রসাদ খুঁজতে থাকে। অবশ্য রাজধানী থেকে দূরে এবং সুফলা বলে পূর্ববাঙলায় এসব উপদেবতার প্রভাব কমই পড়েছে এবং চট্টগ্রামে শরীয়ত-অনুগ ধর্মসাহিত্য ষোলো শতকের শেষপাদ থেকেই রচিত হতে থাকে। অবশ্য ১৬৬৬ সন অবধি উত্তর চট্টগ্রাম এবং ১৭৫৬ সন অবধি দক্ষিণ চট্টগ্রাম রোসাঙ্গ রাজ্যভুক্তই ছিল, কাজেই সেদিক দিয়ে চট্টগ্রাম বাঙলার বাইরে এবং সে কারণে উপদ্রুত অঞ্চলও নয়।
ষোলো শতক থেকে বাঙালি র প্রধান দেবতা সত্যনারায়ণ বা সত্যপীর। হিন্দু যে-কিছুকে নারায়ণ ভাবতে পারে, কিন্তু একেশ্বরবাদী মুসলমানের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই মুসলমান নারায়ণকে পীরের মর্যাদা দিয়েছে। একে অবলম্বন করেই মুঘল আমলে দুঃখী ও বিমূঢ় হিন্দু মুসলমান জীবনের ও জীবিকার দুর্দিনে এক মিলন-ময়দানে এসে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। তাদের এ। মিলন-রাখী হল সত্য (Truth) এবং প্রমূর্ত সত্যই যুগপৎ সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর নামে পূজা শিরনী পেতে থাকেন দুঃখীর দেবতারূপে। ষোলো শতক থেকে আজ অবধি ষাট-সত্তর জন সত্যনারায়ণ পাঁচালিকারই এঁর অপ্রতিহত প্রভাবের সাক্ষ্যদান করছেন। অল্লোপনিষদের মতো। সত্যপীরও হিন্দুর মানস-প্রসূত। শাসক-শাসিতের মধ্যেকার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ঘোচানোর উদ্দেশ্যেই শাসিত হিন্দু কর্তৃক এ মুসলিম-দেবতা পরিকল্পিত। এমনি সমন্বয় প্রয়াস বৈষ্ণব সহজিয়া ও বাউলদের মধ্যেও প্রত্যক্ষ করি। চৈতন্যাবতার মুসলিম ফকির আউলচাঁদ ও মদিনার মাধব বিবিই তাদের সাধন-পন্থার প্রবর্তক ও প্রচারক বলে পরিকীর্তিত। নিত্যানন্দ তাঁর পুত্র। বীরদ্রকে বলেছেন :
শীঘ্র করি যাহ তুমি মদিনা সহরে……
তথা যাই শিক্ষা লহ মাধব বিবির সনে,
তাহার শরীরে প্রভু আছেন বর্তমানে।
মাধব বিবি বিনে তোর শিক্ষা দিতে নাই
তাঁহার শরীরে আছেন চৈতন্য গোঁসাই।
—(বীরভদ্রের শিক্ষামূলক কড়চা)
ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আপোস ও ঐক্যের এ প্রয়াস নিম্নবর্ণের ও নিম্নবিত্তের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অনেকাংশে সফল হয়েছিল। দেশজ মুসলমানেরাও ইসলামের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সহজপন্থা হিসেবে হিন্দুর দেবতার গুণসম্পন্ন কিন্তু প্রবলতর প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে দাঁড় করাল কয়েকজন কাল্পনিক পীর ও কয়েকজন ঐতিহাসিক বীরযোদ্ধাকে, যারা দেবকল্প পীরের মর্যাদায় তাদের জাতীয় বীর ও ধর্মীয় নেতারূপে পরিকল্পিত। জাফর খা গাজী (দরাফ খা), মোবারক গাজী, ইসমাইল গাজী, খানজাহাঁ খাঁ গাজী, সফীউদ্দিন গাজী প্রভৃতি সেননী-শাসক এবং গোরাচাঁদ, বাবা আদম, পীর বদর প্রমুখ দরবেশ আর বড়খা গাজী, কালুগাজী, মানিক পীর, মছলন্দ পীর, বনবিবি, প্রভৃতি কাল্পনিক পীরের সঙ্গে হিন্দু রাজার ও দেবতার দ্বন্দ্ব-মিলনের উপাখ্যান মাধ্যমে হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমঝোতা ও মিলন সম্ভব হয়েছিল। দরাফ খার মহাত্মকথা, মানিকপীরের কেচ্ছা, গাজীকালু চম্পাবতী উপাখ্যান কিংবা দক্ষিণ রায়, বনবিবি, সত্যপীর প্রভৃতির কাহিনী তার সাক্ষ্য।
কিন্তু স্বার্থসচেতন, জাত্যভিমানী, বিত্তবানেরা স্বাতন্ত্রের মধ্যেই খুঁজেছেন স্বস্তি ও প্রতিষ্ঠা। যেহেতু এঁরাই দেশের ধন-জনের মালিক, জয় হল তাদেরই। সত্যনারায়ণ মুসলমান পীর, তাই শিরনীই তাঁর ভোগ। বাঙলার বাইরেও এঁর প্রতিষ্ঠা ছিল। লালমনের কিসসায় গৌড় সুলতান হোসেন শাহর (১৪৯৩-১৫১৯) উল্লেখ রয়েছে। কেউ কেউ সত্যপীরকে হোসেন শাহর রক্ষিতা গর্ভজাত বাস্তবপুরুষ বলে বিশ্বাস করে। সতেরো শতকের কবি রূপরাম চক্রবর্তী ধর্মঠাকুরের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে ধর্মকে করেছেন আদর্শপীর আর নিজে হয়েছেন ফকির। হিন্দুদের ফকির চাঁদ, ফকির দাস, ফকির রায় প্রভৃতি নাম থেকেও হিন্দুসমাজে মুসলমান ফকিরের প্রভাব অনুমান করা যায়। সত্যপীর রচয়িতা উত্তরবঙ্গের কবি কৃষ্ণ হরিদাসের গুরু ছিলেন মুসলমান কবি তাহের মুহম্মদ। ইনিও সত্যপীর পাঁচালির রচয়িতা :
তাহের মামুদ গুরু শমস নন্দন
তাহার সেবক হয়ে কৃষ্ণ হরি গান।
এভাবে দক্ষিণ রায়, কালুরায়, সত্যপীর, বড় খা গাজী প্রভৃতি হিন্দু-মুসলিম দেবতা-পীরের বিরোধ-মিলনের মধ্যদিয়ে বাঙলার হিন্দু ও মুসলমান সামাজিক ও ধর্মীয় মতাদর্শের রফা খুঁজেছে–বিষ্ণু আর বিসমিল্লাহ কিছু ভিন্ন নয়। কর্মকুণ্ঠ, পরনির্ভরশীল, ভীরু ও ভোগবাদী বাঙালি চিরকালই শক্তির উপাসক। যেখানে ইষ্ট বা অরি শক্তির প্রকাশ দেখেছে সেখানেই সে পূজায় তৎপর রয়েছে। অপ্রত্যক্ষ দেবতার সঙ্গে তাই অসামান্য শক্তিধর মানুষকেও সে পূজা করেছে। ঐতিহাসিক যুগে এর আরম্ভ জৈন-বৌদ্ধ ভিক্ষু-সাধু সেবায় এবং সমাপ্তি বীর-পূজায়। এদেশে ইসমাইল গাজী, খানজাহান খান, জাফরখান প্রভৃতি সেনানী-শাসক পর্যন্ত দেবকল্প হয়ে পূজা শিরনী পাচ্ছেন।
কেবল ধর্মের ক্ষেত্রে নয়, ব্যবহারিক জীবনেও নানাভাবে নানাদিকে হিন্দু-মুসলমানের যুক্ত সাধনা সেদিন নতুন সমাজ ও সংস্কৃতি-সৃষ্টিতে সহায়তা করেছিল প্রচুর। সাহিত্যে-শিল্পে-স্থাপত্যে সঙ্গীতে সর্বত্র এর সাক্ষ্য মেলে। এ ধারায় চললে আজ বাঙলার সংস্কৃতি কী রূপ নিত কল্পনা করা সম্ভব কিন্তু নিরর্থক। কারণ ইংরেজ আমলে অভিজাত ব্রাহ্মণ্যবাদীদের চেষ্টায় রামায়ণ-মহাভারত ও বেদান্তের বহুল চর্চা হিন্দু-মানসকে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্যবাদমুখী করে দিল, আর ওহাবী-ফারায়েজী আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলমানেরাও শরীয়ত-অনুগ জীবনাদর্শ গ্রহণে প্রয়াসী হল এবং আরব-ইরানি তমদুনের প্রতি অনুরাগ তাদের রক্ষণশীল করে তুলল। অথচ এখানেই একদা মানবতার মহত্তম বাণী উচ্চারিত হয়েছিল :
নানাবরণ গাভীরে ভাই
একই বরণ দুধ
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম
একই মায়ের পুত।
নিম্নবিত্তের এ মিলনমুখী প্রাকৃত মননধারা প্রবল হলেও অভিজাতদের মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র এবং স্বধর্ম রক্ষার একটি সদা সচেতন প্রয়াস ছিল। উনিশ শতকে খ্রীস্টধর্ম প্রচার প্রতিরোধে ব্রাহ্মমতের যে ভূমিকা ছিল, পনেরো শতকে স্মার্ত রঘুনন্দনাদি প্রবর্তিত নবস্মৃতি তজ্জাত নবশাখ ব্রাহ্মণ্যমতও ইসলামের মোকাবেলায় সে-ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। মুসলমান বিতাড়নও নাকি তাদের লক্ষ্য ছিল, যথাসময়ে গৌড়-সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ তা টের পেয়ে তাঁদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দিলেন। এ ব্যর্থতা থেকেই হিন্দুর ধর্ম ও সমাজ রক্ষার নতুন উপায় উদ্ভাবন করলেন শ্রীচৈতন্য। যদিও হিন্দুসমাজে বাহ্যত বিরোধ ও বিভেদ সৃষ্টি হবে বলে সুলতান খুশি হয়ে শ্রীচৈতন্যকে প্রশ্রয় ও সর্বপ্রকার সহায়তা দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তবু ইসলামের প্রসার-প্রতিরোধই লক্ষ্য ছিল বলে চৈতন্যদেব মুসলিম অধিকারে থেকে তার মত প্রচারে সাহসী হননি। তাই উড়িষ্যার হিন্দুরাজ্যে (নীলাচলে) বসেই তিনি তাঁর মত প্রচার করেন। এজন্যে বাঙলাদেশে বৈষ্ণব সাহিত্য যত প্রসার লাভ করেছে, বৈষ্ণব মত তত গৃহীত হয়নি। তবু চৈতন্যদেবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছিল; ইসলাম সত্য সত্যই আর প্রসার লাভ করেনি বরং কিছুসংখ্যক মুসলমান বৈষ্ণবমত গ্রহণ করে। বৈষ্ণবমত মুসলমান সমাজ-মানসকেও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করেছিল। আগেই বলেছি সূফীমতের অনুকরণেই বৈষ্ণব মতের উদ্ভব; সে সাদৃশ্যের ছিদ্রপথেই মুসলিম-মানসে রাধাকৃষ্ণ সূফীতত্ত্বের দেশী রূপক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এদিকে শিক্ষিত মুসলমানেরা ইসলামের প্রতি মুসলমানের আনুগত্য দৃঢ়মূল করবার উদ্দেশ্যে, ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে পরিচয় নিবিড় করবার প্রয়াস পায়। তাই নবী বংশ, রসুল চরিত, ও নানা মসলা-মসায়েল গ্রন্থ রচিত ও প্রচারিত হয়েছে। এ সঙ্গে তাদের ধর্মের ও সংস্কৃতির উৎসভূমি আরব-ইরানপ্রীতি জাগানোর চেষ্টাও ছিল। হয়তো এভাবে মুসলমানদেরকে বহির্মুখী করে রেখে তাদের ধর্মানুরাগ ও আরব-ইরান প্রীতির সুযোগে শাসকরা নির্বিঘ্ন শাসন কায়েম রাখার প্রয়াসী ছিল। এর আভাস মেলে বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষার প্রতি বিরূপতায় এবং সগীর, সৈয়দ সুলতান, আবদুল হাকিম প্রভৃতির মাতৃভাষার প্রতি প্রীতিজাত বিদ্রোহে এবং মাতৃভাষা ও উর্দু নিয়ে উনিশ-বিশ শতকের শিক্ষিত মুসলমানের মানসদ্বন্দ্বে ও বাহ্যাচরণে°২। পুরুষানুক্রমে তাদের মুখের বুলি বাঙলা। তারা উর্দু জানত না, দু-চারজন উর্দুভাষী বিত্তবানের নেতৃত্বে তারা স্বপ্ন দেখত উর্দুর। এবং সভা ডেকে এই বাঙালি রাই বাঙলা বক্তৃতার মাধ্যমে ঘোষণা করত–উর্দুই তাদের মাতৃভাষা ও জাতীয় জবান। কেবল বিজাতির ষড়যন্ত্রেই তাদের এ সাময়িক বিস্মৃতি ঘটেছে। শেষ অবধি এই অভিজাত দলেরই জয় হল। কেননা আজো হিন্দু ও মুসলমান স্ব স্ব স্বাতন্ত্রে সমুন্নত রয়েছে।
কিন্তু উচ্চবিত্তের মুসলমানের এ প্রয়াস বাঙালি মুসলমানের মানস ও সাংস্কৃতিক জীবন আটশ বছর ধরে পঙ্গু করে রেখেছে। তারা আজো স্বদেশে প্রায় প্রবাসী হয়েই আছে। অজ্ঞতা-অশিক্ষার জন্যে আরব-ইরানি সংস্কৃতিও তারা আয়ত্ত করতে পারেনি, মানস-বিরূপতা বশত দেশী সংস্কৃতিও স্বাভাবিক বিকাশ পায়নি তাদের জীবনে। তাই কোনো মৌলিক চিন্তা, মননের কোনো ঐশ্বর্য তাদের মধ্যে দেখা যায়নি। তাদের ভাব-ভাবনা কোথাও কোনো স্পষ্টরেখায় ফুটে উঠেনি। এজন্যে তারা আজো না ঘরকা, না ঘাটকা অবস্থায় রয়েছে, আজাদী-উত্তর এ বিশ বছরেও তাদের মনের দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঘোচেনি এবং যদিবা মাতৃভাষা সম্পর্কে দ্বিধামুক্ত হয়েছে, তবু তার রূপ সম্পর্কে নির্ঘ হয়নি। তাই রব উঠেছে : হরফ বদলাও, শব্দ বদলাও, নাম বদলাও, বদলাও ভাব, বদলাও ভঙ্গি, বদলাও বিষয়। তারা বাঙলার মানুষ, কিন্তু দৃষ্টি তাদের আরব-ইরানে। অস্বীকৃত বাস্তব ও অসফল স্বপ্নের টানাপড়েনে তারা আজো দিশেহারা। এ বিশ বছরেও তারা দেশ ও ধর্মের সমন্বয় ঘটিয়ে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও মননের ক্ষেত্রে পথ ও পাথেয় খুঁজে পেল না। এমন মানস-বিপর্যয় পৃথিবীর আর কোনো দেশের মুসলমানের জীবনে দেখা যায়নি।
কেউ কেউ মুসলমানের রচনায় সংস্কৃত সাহিত্য ও হিন্দু পুরাণের প্রভাব লক্ষ্য করে থাকেন। এ-কথা মোটামুটি স্বীকার্য যে হিন্দু-মুসলমানের রচনায় আঙ্গিক ও ভাষাগত প্রভেদ ছিল না। এর কারণ, অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত হিন্দু-মুসলমান বাঙালি অবিশেষের জন্যে বাঙলায় সাহিত্য সৃষ্টি করতে যেয়ে মুসলমান লেখকেরা ভারতের classic ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতেরই দ্বারস্থ হয়েছেন। জনগণের অপরিচিত আরবি-ফারসি শব্দ, অলঙ্কার ও প্রতাঁকের শরণাপন্ন হয়নি। যাদের জন্যে। লেখা, তাদের অজ্ঞাত অলঙ্কার ও রূপ-প্রতীক প্রয়োগে রচনা ব্যর্থ হত। এজন্যেই আমরা আজো পারত পক্ষে ইংরেজি সাহিত্যের রূপ-প্রতীক বাঙলায় ব্যবহার করিনে। এক কথায় খ্রীস্টান য়ুরোপ যে-গরজে ও যে-মনোভাব নিয়ে সাহিত্যে Pagan Greek ও Latin উপাদান গ্রহণ করেছে, মুসলমান লেখকগণও অনুরূপ কারণে অতিপরিচিত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উপাদান নিয়ে বাঙলায় সাহিত্য-সৌধ গড়ে তুলেছেন। একে হিন্দুয়ানী প্রভাব বলা অসমীচীন। এ হিন্দু-সংস্কৃতির প্রভাব নয়, দেশী উপাদান গ্রহণ–যাতে এঁদেরও উত্তরাধিকার ছিল। বাঙলা ভাষা তার পুষ্টির জন্যে জ্ঞাতি সংস্কৃতের থেকে ঋণ নেবে, এ-ই তো স্বাভাবিক। তা চর্যাপদের কাল থেকে চলেও আসছে। আজকের দিনে পরিভাষা নির্মাণের কাজেও লাগছে সংস্কৃতই।
সাহিত্য ব্যবহারিক জীবনের চিত্র না হোক, চিরকালই মানস-জীবনের আলেখ্য। এ অর্থেই সাহিত্য জীবন-মুকুর। এক এক দেশ, কাল ও মানুষের বিচিত্র জীবনের রূপ ফুটে উঠে সাহিত্যে। সে সে দেশ, কাল ও মানুষের পটভূমিকায় বিবর্তনশীল জীবনপ্রবাহে সমাজ ও সংস্কৃতি যেখানে যখন যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সাহিত্যের আঙ্গিকে, বিষয় নির্বাচনে, ভাবকল্পে আর ভঙ্গিতে অনুরূপ পরিবর্তন আসছে। আগের যুগের মানুষ ভূত-প্রেত-দেও-দানুতে বিশ্বাস রাখত, ঝাড়-ফুক-তুক তাক-দারু-টোনাতে ভরসা পেত; তাই তাদের রচনায় এ সবের ভয়, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধানিষ্ঠ চিত্র পাই। যেহেতু মানুষের কোনো আচরণ কিংবা মানস-অভিব্যক্তিই স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক প্রভাবমুক্ত নয়, সেহেতু আগের কালের মানুষের রচনায় তাদের বিশ্বাস-ভরসা-ভয়-ভাবনা-আশা আরজু, ভাব-কল্পনার আন্তরিক প্রকাশ ঘটেছে। সেদিক দিয়ে তাঁদের সাহিত্যও বাস্তব আর জীবনানুগ। বিশ্বাস-সংস্কার ভেদে আজ আমাদের কাছে অলৌকিক ও অস্বাভাবিক। আজ আমরা তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে এসেছি অনেক দূর, অনেক ব্যাপারেই তাদের সঙ্গে হারিয়ে ফেলেছি জ্ঞাতিত্ব, যোগসূত্র হয়ে এসেছে ক্ষীণ ও স্বাজাত্যবোধও হয়ে উঠেছে আবছা; তাই তাঁদের রচনা আজ আমাদের নিকট আজগুবি। মাটির মায়ামুগ্ধ, বস্তুনিষ্ঠ, মনস্তত্ত্ব প্রিয় ও জীবনরসিক আজকের পাঠক তাই সেকালের অলৌকিক-অবাস্তব জগতের বিবরণ পড়তে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠে। সেকালের বিস্ময়বোধ আমাদের উপহাসের সামগ্রী, সেকালের রোমান্টিক ভাব-কল্পনা আমাদের চোখে অজ্ঞ অপরিণত শিশুমনের হাস্যকর বিলাসমাত্র। তাঁদের স্থূলতা পীড়াদায়ক এবং তাঁদের আন্তরিকতায় উজ্জ্বল বর্ণনভঙ্গিও বাল-ভাষণের মতো তুচ্ছ মনে হয়। এছাড়াও আজকের পাঠকের কাছে মধ্যযুগের সাহিত্য পরানুকরণ আর পুচ্ছগ্রাহিতা দোষে ক্লান্তিকর। তবু কালিক ব্যবধান মনে রেখে যদি শ্রদ্ধা নিয়ে মধ্যযুগের বৈচিত্র্যহীন সাহিত্য পাঠ করি, তাহলে সেকালের কবি ও কাব্যের প্রতি পুরো না হোক, কিছুটা সুবিচার করা সম্ভব হবে। তখন দেখা যাবে এ পুচ্ছগ্রাহিতার মধ্যেও কোনো কোনো কবি বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল এবং আন্তরিকতায় স্নিগ্ধ।
সবচেয়ে বড় কথা–বাঙালি র চরিত্র, মানস ও জীবনধারার অন্তরঙ্গ ঐতিহাসিক ক্ৰম বিধৃত রয়েছে এ সাহিত্যে। কাজেই নিজেদের জানবার-বুঝবার জন্যেই এ সাহিত্যের সঙ্গে নিবিড় পরিচয় প্রয়োজন।
বাঙালি র জীবনের ও স্বভাবের পটে আমরা মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য পরিক্রমা শেষ করলাম। অবশ্য একই সঙ্গে এ সাহিত্যের মুকুরে বাঙালি কে প্রত্যক্ষ করবার সুযোগও পেলাম। কেননা ফল দিয়ে কর্মের এবং কর্ম দেখে কর্তার ধারণা পাওয়া সম্ভব। পরিচয়ের ক্ষেত্রে কোনো জাতিকে তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের মাধ্যমেই জানতে হয়। কেননা মানুষের যথার্থ প্রকাশ ও পরিচয় থাকে তার মানস-অভিব্যক্তির মধ্যেই। দূরের ও অতীতের মানুষকে জানবার এছাড়া অন্য উপায় নেই। আমরা দেখলাম–বাঙালি র চেতনা-চঞ্চল জীবন, বুদ্ধির চমক, অনুভবের বৈচিত্র্য, মননের দ্যুতি, তরঙ্গিত জীবন-ভাবনার অভিনবত্ব, সৃজনশীলতা ও গীতোচ্ছাস এ সাহিত্যের সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু তা কখনো সার্থক ফলপ্রসূ হয়ে তাদের জীবনে ও সমাজে সুষ্ঠু অগ্রগতির সহায়ক হয়নি। তার কারণ, যারা দেশের নেতা ও সমাজের প্রতিভূ, তাদের জাত্যভিমান তাদের দেশাত্মবোধকে ছাপিয়ে উঠেছিল। বৰ্ণহিন্দু ছিল উত্তর ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির অনুধ্যানে নিরত, আর বিত্তবান মুসলমান ছিল আরব-ইরানির জ্ঞাতিত্ব স্বপ্নে বিভোর আর হয়তো তুর্কী-মুঘল গৌরবগর্বেও স্ফীত। দেশগত জীবন ও পরিবেষ্টনীগত প্রয়োজন সম্পর্কে কেউ তেমন সচেতন ছিল না। ফলে স্বাদেশিকবোধ ও স্বাধীনতার স্পৃহা কখনো জাগেনি তাদের মনে। কাজেই আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠা তথা দেশ-নির্ভর স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্যে তাদের আকাক্ষা ও কর্ম কখনো নিয়ন্ত্রিত হয়নি। তারা সুস্থ ছিল না, কাজেই সুস্থ চিন্তা সম্ভব হয়নি তাদের পক্ষে। এর ফলে পরিণামে পূর্ববঙ্গ হয়েছে পাকিস্তান আর পশ্চিমবঙ্গ হয়েছে উত্তর-ভারতের কাছে বিক্রিত।
তবু বাঙলাদেশে ইসলামী সংস্কৃতির বিস্তারই যে বাঙালি র মনোরাজ্যে নবচেতনা এনে দিয়েছিল এবং এতে যে তাদের মানস-জগৎ বিপ্লবমুখী ও সৃজনশীল হয়ে উঠেছিল অর্থাৎ ইসলাম ও তুর্কী মুসলমানের সান্নিধ্য যে এ চেতনার ও প্রেরণার উৎস তা অস্বীকার করা যাবে না। এ ছিল অনেকটা এ যুগের প্রতীচ্য প্রভাবের মতো।
প্রতীচ্য প্রভাবে ও প্রতিভার পরিচর্যায় মাত্র চৌত্রিশ বছরে–১৮৪৭ সনে বিদ্যাসাগরের হাতে শুরু হয়ে ১৮৮০ সনে রবীন্দ্রনাথে উত্তরণে–আধুনিক বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের যে-বিস্ময়কর বিকাশ সম্ভব হয়েছে, সেরূপ প্রতিভার স্পর্শ পায়নি বলে আটশ বছরেও মধ্যযুগের বাঙলাভাষা ও সাহিত্যের তেমন দ্রুত ও বিচিত্র বিকাশ হতে পারেনি। তবু এ ভাষা ও সাহিত্যকে হিন্দু মুসলমানের মানস-ফসলরূপে গ্রহণ করব।
মধ্যযুগের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্য বাঙালি মুসলমানের বিশেষ গর্বের অবলম্বন হতে পারে। কেননা, এ ভাষা ও সাহিত্যের চর্যায় বাঙালি কে প্রবর্তনা দেন সুলতান-সুবাদার। এর অন্যতম আদিকবি ও প্রণয়োপখ্যানের আদি-লেখক শাহ মুহম্মদ সগীর (১৩৮৯-১৪০৯ খ্রী.)। রোমান্সের সর্বশ্রেষ্ট রচক ও মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কাজী দৌলত। বাঙলার প্রথম মৌলিক ও রূপক কাব্য সত্যকলি বিবাদ সম্বাদ-এর (১৬৩৫ খ্রী.) রচয়িতা মুহম্মদ খান। বাস্তব প্রতিবেশে মাটির মানুষের জীবনচিত্র ও প্রণয় কাহিনী রচনা করেছেন লায়লীমজনুর কবি দৌলত উজির বাহরাম খান ও পূর্ব-বাঙলার গাথাকারগণ। বাঙলাকাব্যের ভাষাকে পরিশ্রুত ও নাগরিক লাবণ্যদান করেন। শাবারিদ খান ও আলাউল। মুসলমান কবিও সংখ্যায় হয়তো অমুসলমান কবির চেয়ে কম ছিলেন না। এভাবে বাঙলা সাহিত্যের সৃষ্টি, পুষ্টি ও বৈচিত্র্যের মূলে রয়েছে মুসলমানের বিশেষ সাধনা ও দান।
বুর্জোয়া সাহিত্য বনাম গণসাহিত্য
অত্যাধুনিক যুগে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রাদর্শের পরিবর্তন সাধনার্থ বিশেষ মত প্রচারের জন্যে এক ধারার সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে বলা হচ্ছে প্রচার সাহিত্য, বিপ্লবী সাহিত্য বা গণসাহিত্য। অধুনা দুনিয়াব্যাপী এই ধারার সাহিত্য-সৃষ্টিরই সাধনা চলছে। আধুনিক যুগে মানুষ ব্যবহারিক জীবনে শোষণ, অত্যাচার, পীড়ন ও অভাব-অনটন-জর্জরিত হয়ে নিছক বস্তুতান্ত্রিক হয়ে উঠতে বাধ্য হয়েছে। অধিকাংশ লোকের ডাল-ভাতের সংস্থান না থাকায় যেন তারা বুনিয়াদী শিল্প-কলা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য প্রভৃতির উপর মনের উত্তেজনায় মারমুখী হয়ে উঠেছে। বস্তুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও কলকারখানা স্থাপিত হওয়ার ফলে ধনবৈষম্য মানুষের ব্যবহারিক জীবনে এনেছে ক্ষোভ আর গ্লানি, মনন-জীবন করেছে পঙ্গু। বেঁচে থাকাই যখন দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে, তখন মনুষ্যত্ব-বিকাশক বৃহৎ ও মহতের সাধনায় আত্মনিয়োগ করা বা শিল্পকলা ও রুচি-সৌন্দর্যে অনুরাগ প্রদর্শন সম্ভব নয়।
তাই অধিকারবাদের লড়াই শুরু হয়েছে দুনিয়াময়। ব্যবহারিক জীবনে যে মনো-জীবন রয়েছে, তা দুঃখ-দৈন্য, অভাব-উৎপীড়নের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আজ লাঞ্ছিত ও উপেক্ষিত।
এইজন্যে সাম্প্ৰত-পূর্বযুগের সাহিত্যকে বলা হচ্ছে বুর্জোয়া সাহিত্য। প্রাক্তন জীবনবোধের মুকুরস্বরূপ এই সাহিত্য এবং সাহিত্যাদর্শ এখনকার পাঠকের নিকট সুপ্রাচীন ভগ্ন ইমারতের মতো পরিহার্য এবং উপেক্ষণীয়। প্রত্নতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক এবং প্রাচীনের প্রতি শ্রদ্ধাবানদের কাছে যেমন নতুন হর্মের চেয়ে পুরোনো ভাঙা ইমারতের কদর অনেক বেশি, তেমনি মননধর্মীদের কাছেও প্রাক্তন সাহিত্যের মূল্য কম নয়। কিন্তু গণসাহিত্যবাদীরা বলেন–জীবন ধারণ ও জৈব-ক্ষুধা নিবারণের পক্ষে যা অপরিহার্য, তা-ই শুধু সাহিত্যে প্রতিফলিত হবে–এর অতিরিক্ত কিছু থাকলে তা হবে মাতলামি। সুতরাং এদের মতে শুধু তন্ময় (objective) বিষয়েই সাহিত্য রচিত হবে, মন্ময় (subjective) বিষয় নিয়ে বিলাস করবার দিন আর নেই। সরাব আর সাকি, প্রিয় আর প্রেয়সীর কাহিনী শুধু অবান্তর নয়–অনর্থ সৃষ্টিকারীও বটে। এঁরা বুঝতে চান না যে, যাকে আমরা জীবন বলি, তা-ও একটা অদৃশ্যবস্তু। দেহ নিশ্চয়ই জীবন নয়; জীবন মানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সময়-পরিধিতে উখিত অনভূতির সমষ্টিমাত্র। সে-অনুভূতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য-জগৎ থেকে শুধু উপাদান সংগ্রহ করে। এছাড়া জীবনের সাথে জগতের সম্পর্ক আর বিশেষ কিছুই নেই। নেই বলেই জগৎ ও জীবনের কোনো সর্বজনীন রূপ নেই, কেননা একই বস্তু বা ঘটনা বা দৃশ্য থেকে বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ও বিচিত্র অনুভূতি লাভ করে। তাই প্রত্যেকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র জগৎ ও জীবন। গাছের কোনো দুটো পাতা একরূপ নয়–তবু তাদের মধ্যে সাদৃশ্য ও সামঞ্জস্য রয়েছে। তেমনি মানুষের মধ্যেও ভাব ও রুচির সাদৃশ্য আছে। এই সাদৃশ্যই হচ্ছে আমাদের পারস্পরিক মিলনের ভিত্তিভূমি। সে মিলন সামাজিক, ধর্মীয়, বা রাষ্ট্রীয় মিলন-আদর্শের ও অনুভূতির মিলন। সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনা অনুভব করে যে-মন, তার চেয়ে অনুভূতির উপলক্ষ দেহ কী বড় হতে পারে? সুতরাং ডাল ভাতের জীবন অপরিহার্য হলেও সে-জীবন মানুষের কাম্য নয়। যেমন বৃক্ষমূল বৃক্ষ-জীবনের ভিত্তি হতে পারে, কিন্তু ফল ফলায় যে-অংশ, সে-অংশের রসদ জোগানোতেই এর সার্থকতা। যে-মাটির উপর তাজমহল দাঁড়িয়ে, সে-মাটির গুরুত্ব অনেকখানি–তবু তার গুরুত্ব শুধু তাজমহলের ভিত্তিভূমি বলেই। তাজমহলই কাম্য-মাটি নয়, অতএব আদর্শ বা মতপ্রচার বিরহিত সাহিত্যের যে utility নেই বলা হয়–তাতে সত্যি কতটুকু?
এমনিতেই আমরা দেখতে পাই, সৌন্দর্য বস্তুটাই প্রয়োজনাতিরিক্ত। যেমন ইটের গাঁথুনিতেই ঘর তৈরি হয়, এতেই থাকা চলে অর্থাৎ প্রয়োজন মিটে, চূণকাম করে যে অনর্থক পরিশ্রম করা হয়, তাতে কোনো ব্যবহারিক প্রয়োজন সিদ্ধ হয় না। যেমন আমরা কাপড় পরি আব্রুরক্ষার জন্যে, রঙ আর কারুশিল্পের ঠিক প্রয়োজন নেই। সুতরাং সৌন্দর্য সৃষ্টিটা সবসময়েই ব্যবহারিক প্রয়োজনের বাইরে। কিন্তু সে-কি আরো গভীরতর প্রয়োজনের তাগিদ নয়? বস্তুত জৈব প্রয়োজনের যেখানে শেষ, সেখান থেকেই আসল জীবনের চাহিদা আরম্ভ হয়। যারা art for arts sake আদর্শকে গহিত বলে নিন্দা করেন তারাও বক্তব্য বিষয়কে উপমা-অলঙ্কার সহযোগে সুন্দর (অর্থাৎ সাহিত্য) করে তুলতে চান! এই সৌন্দর্য-প্রীতির কারণ ও প্রেরণার উৎসের সন্ধান করলে অনেক অবোধ্য অস্বীকৃত কথাই উপলব্ধ ও স্বীকৃত হবে। বিশেষত প্রত্যেক কথারই একটা প্রতিক্রিয়া আছে, সেভাবে বিচার করলে নিছক রস সৃষ্টির জন্যে যে-সাহিত্য, তা-ও হৃদয়মনের বিকাশে ও প্রসারে সাহায্য করে নিশ্চয়ই।
বুভুক্ষাপীড়িত নির্যাতিত নিপীড়িত মানবতার বঞ্চিত বুকের সঞ্চিত ব্যথার অভিযান চালানোর জন্যে প্রচার সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা এ-যুগে অস্বীকার করা চলে না। নিতান্ত বেঁচে থাকার জন্যে ডাল-ভাতের দাবী স্বীকৃতি না পেলে দুনিয়ার অধিকাংশ মানুষ অকালে অপমৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবে না–এ অতি সত্যি কথা। সুতরাং গণসাহিত্যের সৃষ্টি ও পুষ্টি এ-যুগে অপরিহার্য। কিন্তু তবু রোগ-শোক, অভাব-উৎপীড়ন, অতৃপ্তি-অনটন, জরা-মৃত্যু, দুঃখ-বেদনা মনুষ্যজীবনে এবং জগতে নতুন কিছু নয়। এদের অনেকগুলো দুরতিক্রম্য বা অনতিক্ৰমণীয়। যদি কেউ ব্যবহারিক জীবনের এ দুঃখ-বেদনা-লাঞ্ছনাকে ভুলে থাকবার জন্যে মনোময় কল্পজগৎ সৃষ্টি করে মনকে মুক্তপক্ষ এবং হৃদয়কে বল্গাহীন করে ক্ষণেকের জন্যে হলেও জগতের রূপ-রস ও আনন্দ পরিপূর্ণ তৃপ্তির সাথে উপভোগ করে, তবে তা-ই কী তার যথালাভ নয়? ব্যবহারিক জীবনের অভাবে উৎপীড়নে পৃষ্ট দেহের সাথে মন-প্রাণকেও বিক্ষত করে যন্ত্রণা বাড়ানোতে কী জীবন-রসের উৎস শুকিয়ে যায় না? তার চেয়ে কেউ যদি দেহকে পিষ্ট হতে দিয়ে মন-প্রাণকে যন্ত্রণার কবলমুক্ত রেখে কল্পনার রসলোকে আশ্রয় খোঁজে, তবে তার সেই পলাতক মনোবৃত্তি নিন্দনীয় হবার হেতু কী? মোহিতলাল বলেছেন :
জীবন যাহার অতি দুর্বহ দীনদুর্বল সবি
রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ–সে-জন বটে কবি। (বিধাতার বর)
রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ
জীবনে যে সাধ হয়েছে বিফল
সে সাধ ফুটিছে (এবং মিটেছেও) গানে।
বরং এ আদর্শ জীবনীশক্তি বর্ধক ও সগ্রাম-শক্তি (resisting power) প্রদায়ক। যারা আজ ক্ষোভে-উত্তেজনায় নিতান্ত বস্তুতান্ত্রিকতার উপাসক হয়ে উঠেছেন, সে-ই অধিকারবাদের সংগ্রামীদলও উপলব্ধি করেন–জৈবক্ষুধার চেয়ে মনের ক্ষুধা অনেক তীব্র এবং স্কুল দৈহিক জীবনের যে-মনোজীবন রয়েছে, সেই অনুভূতির জীবনই সত্যিকার জীবন এবং সে-জীবন রসলোক-বিহারী–ডাল-ভাতের কাতর নয়। জগতের রূপ-রস সে-জীবনেরই সাধ-আহ্লাদের উৎস এবং ডাল-ভাত সে-জীবনে পুষ্টির সহায়ক মাত্র।
এ-কথা স্বীকার করার উপায় নেই যে, জীবনে শত অভাব-দুঃখের মধ্যেও এমন মুহূর্ত আসে, যখন —
আকাশ আমারে আকুলিয়া ধরে
ফুল মোরে ঘিরে বসে; কে
মনে না জানি জ্যোৎস্না প্রবাহ
সর্বশরীরে পশে।
ভুবন হইতে বাহিরিয়া আসে
ভুবনমোহিনী মায়া,
যৌবনভরা বাহু পাশে তার
বেষ্টনন করে কায়া।
জীবনকুঞ্জে–মনের বনে যে-বসন্ত আসে, তাকে ঠেকায় কে! বস্তুত গণ-সাহিত্যবাদী আর রস-সাহিত্যপন্থীদের উদ্দেশ্য এক এবং অভিন্ন–তা হচ্ছে জীবনকে নির্বিঘ্নে উপভোগ করা। অতএব গণসাহিত্যবাদীদের ডাল-ভাতের সংগ্রাম সেই মনো-জীবন বা মনন-জীবনকে স্বচ্ছন্দে-নির্বিঘ্নে উপলব্ধি ও উপভোগ করবার জন্যেই। তারা আজ means (উপায় বা উপলক্ষ)-এর জন্যেই সংগ্রামরত, এই means (উপায় বা উপলক্ষ) যে end-এ (সিদ্ধিতে) পৌঁছাবে, তা অনুভূতির জীবন বা মনন-জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তুলবে। সুতরাং তাদের গণসাহিত্য অস্থায়ী সংগ্রামী সাহিত্য মাত্র–স্থায়ী রস-সাহিত্য নয়। যেদিন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন হবে–তাঁদের দাবীদাওয়া মিটবে, সেদিন তাদের হাতে যে-সাহিত্য পাব, তা হবে উপেক্ষিত বিগত যুগের সাহিত্যেরই পুনরাবর্তন। সেদিন আবার শিউলি, বকুল, যূথী, গোলাপ, নার্গিস, হাসুহানার গন্ধে এবং দ্রাক্ষাবনের বুলবুল ও বসন্তের কোকিলের ধ্বনিতে সাহিত্যকুঞ্জ মুখরিত হয়ে উঠবে! তাও হবে নতুন-পুরাতনের অনুবর্তন নয়। কেননা নতুন মানুষের মনে পুরোনো কখনো ফিরে আসে না স্বরূপে।
ভাষার কথা
কাছের মানুষকে আভাসে-ইঙ্গিতে মনের কথা–কাজের কথা হয়তো বুঝিয়ে দেয়া যায়, কিন্তু দূরের মানুষকে–ভবিষ্যতের মানুষকে–কাজের কিংবা মনের কথা কীভাবে বলা যায়? এ সমস্যা একদিন মানুষকে বিব্রত করেছে। এর সমাধান পেয়েছে মানুষ মুখ-নিঃসৃত ধ্বনি সৃষ্টি করে।
সেই আদিকালে এক জায়গার বা এক গোত্রের মানুষ মিলে চুক্তি করেছে, অতঃপর বিশেষ বিশেষ ধ্বনি দ্বারা বিভিন্ন বস্তু বা ভাব কিংবা আচরণ নির্দেশিত হবে। যেমন গরু বললে এক বিশেষ জীবকে বুঝব, ঘাস ধ্বনিতে বিশেষ বস্তুকে নির্দেশ করব, সুন্দর ধ্বনি দিয়ে এক বিশেষ ভাব ব্যক্ত করব, খাব বলে এক বিশেষ উদ্দেশ্য জানিয়ে দেব। এভাবে মানুষের ভাষা সৃষ্টি হল।
তাহলে ধ্বনি আসলে বোবা। মানুষের অভিপ্রায়ই তাকে অর্থ দান করে। ধ্বনিগুলোর অর্থবহতা একান্তভাবে স্থানিক বা গোত্রিক চুক্তি-নির্ভর। এইজন্যেই দুনিয়াতে এত ভাষা এবং একের ভাষা অপরের অবোধ্য। যে-লোক যে-ভাষাতে জন্ম থেকেই চুক্তিবদ্ধ হয়, সে-ভাষাই তার মাতৃভাষা। সে-ভাষা তার দেহের রক্তমাংসের মতোই একান্ত নিজের। আমরা যা কিছু অনুভব করি, যা কিছু ভাবি, তা এই ভাষার মাধ্যমেই হয়। কাজেই ভাষা হচ্ছে জীবনানুভূতির বাহন, বেশি করে বললে বলতে হয়, ভাষাই জীবন। তাহলে মাতৃভাষা থেকে বিচ্যুত হওয়া মানে অনেকাংশে জীবনকেই খণ্ডিত করা, ক্ষুদ্র করা, হয়তোবা ব্যর্থ করা। কচ্ছপকে উল্টিয়ে দিলে যেমন সে না চলতে পেরে আর না-খেতে পেয়ে মারা যাবে, তেমনি মানুষের মুখের ভাষা-ভাব-ভাবনার ভাষা কোনো কৌশলে ভুলিয়ে দিলে মানুষ হিসেবে তার অপমৃত্যু অনিবার্য।
এ-যুগে নয় শুধু, চিরকাল মানুষ অবচেতন মনে এ-কথা উপলব্ধি করেছে। তাই প্রত্যেকের স্ব স্ব ভাষা এত প্রিয়। তিনটে ধর্ম দুনিয়াময় পরিব্যাপ্ত হয়েছে : বৌদ্ধধর্ম, খ্রীস্টধর্ম এবং ইসলাম। বিজাতির ও বিদেশীর এসব ধর্ম মানুষ সাগ্রহে বরণ করে নিয়েছে; কিছু ধর্মের ভাষা কেউ নেয়নি, এসব ধর্মভাষা মন্দির, মসজিদ ও গীর্জার প্রাচীর পার হয়ে কারুর মুখের বুলি কিংবা মনের ভাষা হয়ে ওঠেনি এতকাল পরেও।
আগেই বলতে চেয়েছি, একটি বা একাধিক ধ্বনি-সমষ্টিতে হয় শব্দ, এবং শব্দের সঙ্গে শব্দের সুযোজনায় পাই ভাষা। ধ্বনি, শব্দ বা বাক্য বক্তার অভিপ্রায় অনুসারেই অর্থবহতা লাভ করে, নইলে ওগুলো বোবা। যেমন : খা, যা, ধূ, কৃ, হ প্রভৃতি প্রকৃতি বা ধাতুমূল বক্তার কোনো অভিপ্রায় নির্দেশ করে না, এগুলোর সঙ্গে বক্তার পরিচায়ক ও তার অভিপ্রায়-সূচক পুরুষ (Person), কাল ও ভাব (Mood) জ্ঞাপক চিহ্ন যুক্ত হলেই তা অর্থবহ শব্দ বা পদ হয়। তেমনি মানুষ শব্দের সঙ্গে বচন, লিঙ্গ, পুরুষ ও কারক চিহ্ন যোগ করলেই তা বক্তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করবার যোগ্য হয়। এতেও হয় না, বক্তার অভিপ্রায়-অনুগ কণ্ঠস্বরও উচ্চারিত ধ্বনির সঙ্গে যুক্ত হওয়া চাই, তা হলেই শব্দ বা বাক্য অর্থগ্রাহ্য হয়। লিখিত ভাষায় বিভিন্ন চিহ্ন যোগে এবং পৌর্বাপর্য সূত্রে এ অভিধা পাওয়া যায়, তাই আমরা বর্ণ-নির্ভর ভাষার অর্থ গ্রহণে সমর্থ হই। অর্থাৎ বক্তার উদ্দিষ্ট অভিপ্রায় বুঝে নিই। যেমন বিভিন্ন চিহ্ন যোগে একই শব্দের–আদেশ, নির্দেশ, অনুনয়, প্রশ্ন, বিস্ময় প্রভৃতি সূচক অর্থ পাই। একটি দৃষ্টান্ত দিই : যাও। যাও! যাও? যাও, ইত্যাদি চিহ্নযুক্ত যাও পদটি বিভিন্ন অর্থ-ব্যঞ্জনা দান করছে।
অতএব আমাদের পুরোনো কথায় ফিরে যেতে হয় : ভাষা হচ্ছে ভাবের বাহন। ভাবই আসল, ভাষা হচ্ছে আনুষঙ্গিক। ভাব থাকলে ভাষা আপনিতেই আসে। ভাব ও ভাষায় আধেয় আধার সম্পর্ক। আধারের পরিবর্তনে আধেয় আকৃতি বদলায়, প্রকৃতি হারায় না। অতএব ভাষা, গৌণ, ভাবই মুখ্য।
এই উক্তির সার্থকতা ইসলামের ইতিহাসেও পাই। নবলব্ধ ইসলামি ধ্যান-ধারণার প্রভাবে, আরবি ভাষা পুরোনো কলেবরে নতুন অভিধা লাভ করে। এভাবেই আগুন-পূজক ইরানির ভাষা হয় ইসলামি। তারা আরবের ধর্ম নিল, কিন্তু নিজের ভাষা রাখল। তাই ইসলামের মৌল শব্দগুলোরও নিজেদের ভাষায় তর্জমা হল, তাতেই আরবের আল্লাহ, সালাৎ, সিয়াম, মক ও জান্নাত শব্দগুলো। ইরানে হল খোদা, নামায, রোযা, ফেরেস্তা আর বেহেস্ত।
এমনিই হয়। মাতৃভাষায় তর্জমা না হলে কোনো কথাই,–কোনো ভাব-ভাবনাই মনের কথা–প্রাণের কথা হয়ে ওঠে না। তাই তর্জমার প্রয়োজন ও আয়োজন। তাই ইসলামি ভাষা বলে। স্বীকৃত আরবি, ইরানি ও উর্দু ভাষায় লিখিত কেতাব তথাকথিত হিন্দুর ভাষা বাংলায় অনুবাদের প্রয়াস। আমরা তর্জমা করি, কেননা আমরা জানতে চাই, বুঝতে চাই। আমরা রচনা করি, কারণ আমরা নিজেদের জানাতে চাই, বোঝাতে চাই। অতএব, আমাদের শ্রদ্ধেয় ইসলামি ভাষাতে– আমাদের অভিপ্রায় পূর্ণ হয় না, উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় না। তাই বিজাতির ও বিধর্মীর ভাষা বলে মেনে নিয়েও পবিত্র ইসলামের বাণী, মুসলিম-মনীষার ফসল নাপাক মাতৃভাষার মাধ্যতে পেতে চাই। নইলে হৃদয়ঙ্গম হয় না যে! তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য ইসলামের বাণী ও বুলিকে পবিত্র রাখা নয়, মাতৃভাষার মাধ্যমে পরিপাক করা। কাজেই ভাষার ইসলামিরূপের কথা এক্ষেত্রে উঠানই। নিরর্থক।
আর একটি কথা বলেছি, আমরা কথা রচনা করি; কেননা আমরা যা ভাবি, যা জানি তা অপরকে জানাতে চাই, অপরের হৃদয়-মনে সঞ্চারিত করে দিতে চাই। সে কী শুধু মুসলমানকে? সে কী কেবল স্বদেশবাসীকে? যদি বিশ্ববাসীকেও তা জানাতে চাই, তা হলে আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের আচারিক ও আনুষ্ঠানিক ইসলামের কথা আর কেউ শুনতে চাইবে না, তার বিশ্বজনীন মর্মবাণীই কেবল অপরকে আকৃষ্ট করবে। এর তাজা প্রত্যক্ষ প্রমাণ য়ুরোপ। সচেতন বা অচেতনভাবে আমরা প্রতিমুহূর্তে য়ুরোপ থেকে মানস-খাদ্য গ্রহণ করছি, কিন্তু কিরিস্তানীকে সযত্নে পরিহার করি–এড়িয়ে চলি। অথচ ভাব-জগতে যা কিছু য়ুরোপের দান–তার কতকাংশ নাস্তিক্যজাত হলেও অধিকাংশ আস্তিক্য বুদ্ধির ফল। সে-আস্তিক্য বুদ্ধি নিশ্চয়ই খ্রীস্ট-মত ভিত্তিক। তাদের আচারিক ও আনুষ্ঠানিক ধর্মবোধ ছাপিয়ে যা বিশ্বজনীন রূপ নিয়েছে, অর্থাৎ যা সর্ব-মানবিক হয়ে উঠেছে, তা-ই আমাদের গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তাতেই আমাদের অধিকার বর্তেছে। অতএব, বিশ্বজনীন মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে হলে আমাদের ইসলামি ভাব ও বাণীকে অপরূপ করে তুলতে হবে, কেননা আগেই বলেছি স্কুলস্বরূপে তা অমুসলিমের শ্রদ্ধা পাবে না। এজন্যে আমাদের লক্ষ্য হবে-Form-এর পরিচর্যা নয়, Spirit-এর প্রতিষ্ঠা।
আবার বলছি, শব্দ হল ভাষা-সৌধের–বাক্য-দেহের বোবা উপাদান। বক্তা বা লেখকের অভিপ্রায় অনুযায়ী তা অভিধা পায়। এজন্যে প্রয়োগভেদে শব্দ অর্থান্তর লাভ করে। যেমন, গৌরব স্নেহ–pride, শ্রদ্ধা–ইচ্ছা, আকর্ষণ–respect, গঙ্গা–গঙ্গানদী, গাঙ–যে-কোনো নদী, যবন—Ionian-মুসলমান, পাষণ্ড-ধর্মসম্প্রদায়-দুবৃত্ত। এরূপ পঙ্কজ, গোপাল, করী। এছাড়া শব্দের একাধিক অর্থ তো রয়েইছে। যে-কোনো ভাষা সম্বন্ধে একথা সত্যি! আবার ভাব-বিবর্তনে অর্থাৎ নতুন ভাব-চিন্তার অনুপ্রবেশের সাথে সাথে বাক্-ভঙ্গিও বদলায়। ভাষা ও ভঙ্গি যে একান্তভাবে বক্তা বা লেখকের মনোভঙ্গির অনুগ, তার বিশিষ্ট প্রমাণ রবীন্দ্রনাথের রচনা। রবীন্দ্রনাথও পয়ার-ত্রিপদীতে কবিতা লিখেছেন, কিন্তু রূপে-রসে আগের ও তার সমকালের অনুরূপ কবিতার সঙ্গে এদের পার্থক্য কত! কথায় বলে Style is the man. তাই ব্যক্তিক-ভঙ্গিই সাহিত্যে বৈচিত্র্য আনে। আর ব্যক্তিক ভঙ্গি বিশিষ্ট হয় কেবল তখনই, নতুন ভাব-চিন্তার বীজ উপ্ত হয় যখন বক্তার মনোভূমে।
মানুষের মনন-চিন্তন নিত্য বিকাশমান। কাজেই তার নতুন ভাব-চিন্তা ধারণে সমর্থ পুরোনো শব্দগুলো স্ব-অর্থে টিকে থাকে, অন্যগুলো হয় বাদ পড়ে, নয়তো পুরোনো দেহে নব অভিধা নিয়ে বেঁচে থাকে। এতেও কুলোয় না, তাই অর্থগর্ভ ও ব্যঞ্জনাবহ নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়। সৃষ্টি প্রতিভা-সাপেক্ষ, তাই প্রয়োজনে উদ্দিষ্ট ভাব-বাহী শব্দ অপর ভাষা থেকে ধার নিতে হয়। এভাবে সৃজনে এবং ঋণে-ঋথে ভাষা পুষ্টি ও সমৃদ্ধি পায়। সভা করে এ গ্রহণ, বর্জন ও সৃজন চলতে পারে না। সৃষ্টির মুহূর্তে স্রষ্টার মন্ময় গরজেই তা সম্ভব হয়। শব্দের এই অভিধা, বিবর্তন ও শব্দ সৃষ্টির জগৎ এক বিচিত্রলোক। ব্যক্তির ভাব-চিন্তার ও অনুভূতি-উপলব্ধির মানস-সত্তার সংস্পর্শে শব্দ প্রাণময় ও বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। এ অনুভূত সত্য, কিন্তু অনির্বচনীয়। এ রহস্য একদা ভারতীয় ঋষিদের চমকে দিয়েছিল, তাই বিস্ময়-বিমুগ্ধ ঋষি-মুখে উচ্চারিত হয়: বাক্ ব্ৰহ্ম–শব্দই ব্রহ্ম। শব্দের অবয়বে মানুষের ভাব-সত্তা যে জীবন্ত মূর্তি পায়, এবং সুবিন্যস্ত শব্দ যে অসামান্য শক্তির আধার হয়ে ওঠে, আর এজন্যেই বাক যে জীবন-নিয়ন্তা ব্রহ্মস্বরূপ, তা ঋষিদের মন্ত্রদ্রষ্টা খ্যাতি থেকেই বোঝা যায়। গুঞ্জন ও মুখরতাতেই বাক্য-বদ্ধ শব্দের পরিচয়–বাক্যই মানসকে মূর্তি দেয়, ভাবকে দেয় মুক্তি–এভাবে বাথুদ্ধ হয় মানুষের আন্তসত্তা, ফুটে ওঠে জীবনের প্রতিচ্ছবি। ফলে। ভাষা অনুভূত-জীবনকে দেয় মূর্তি আর জীবনানুভূতিকে দেয় মুক্তি। এবং জীবন হচ্ছে জাগ্রত মুহূর্তের কতগুলো অনুভূতির সমষ্টি। তাই বলেছিলাম যেহেতু ভাষাই বোধের বাহন, ভাষাই জীবন।
দুটো কারণে শব্দের সৃজন ও ঋণ গ্রহণ চলে : নতুন ভাব-চিন্তার উদ্ভাবনে এবং বস্তুর আবিষ্কারে। স্বদেশে যদি নতুন ভাব-চিন্তার উদ্ভব বা উন্মেষ হয়, কিংবা নতুন বস্তু তৈরি বা আবিষ্কৃত হয়, তা হলে নিজের ভাষাতেই সে-মনন প্রকাশক বা সে-বস্তু নির্দেশক শব্দ তৈরি হয়। আর যদি বিদেশী ভাব বা বস্তু নেয়া হয়, তা হলে প্রাসঙ্গিক বিদেশী শব্দকে নিজের ভাষায় ঠাঁই দিতেই হয়। একে রোধ করতে যাওয়া যেমন নিরর্থক, এ-গরজ ছাড়া বি-ভাষার শব্দ আনার অপচেষ্টাও তেমনি অসার্থক।..
সবলের পরিচয় আত্মপ্রসারে আর দুর্বলের স্বস্তি আত্মগোপনে। সবল পরাক্রান্ত আর দুর্বল সন্ত্রস্ত। সবল জানতে চায়, জানাতে চায়, সে বুঝতে উৎসুক আর বোঝাতে প্রয়াসী। সে দিকে-দিকে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়ার অভিলাষী, ব্যাপ্তিতেই তার আনন্দ, তার জীবনোল্লাস, তার আরাম। তাই মানুষের মানসোল্লাস আজ গ্রহে-গ্রহে জীবন ও জীবিকার প্রসার খুঁজছে। দুর্বলের ধর্ম আত্মসংকোচন আর সবলের বিলাস আত্মবিস্তারে। দুর্বল Self-preservation-এ বা আত্মরক্ষায় ব্যস্ত, আর সবল Self-expansion-এ বা আত্মপ্রসারে রত। দুর্বল স্থবির, সবল চঞ্চল। একজন প্রাণহীনতায় অচল, অপরজন প্রাণপ্রাচুর্যে উল্লোল। দুর্বলের নিয়তি আত্মবিলোপে, সবলের তৃপ্তি আত্ম-উল্লাসে–মহিমার উজ্জ্বলতা সাধনে। আত্মার অপমৃত্যুতে দুর্বলের লয়, আর আত্ম-প্রতিষ্ঠায় সবলের জয়। তাই দুর্বলতা সমাজে ঘৃণ্য, আইনে অপরাধ ও ধর্মে পাপ।
আমরা রেনেসাঁ-দীপ্ত জাগ্রত জাতি। আমাদের তো দুর্বলতা থাকার কথা নয়। তাহলে। আমাদের ডর কিসে, আমাদের ভয় কাকে? দ্বন্দ্বে ভীত হয় কারা? আমরা তো দুর্বল নই! আমাদের তো দেবার-নেবার পালা সবে শুরু হল! এ বেনে-যুগে মানস-বাণিজ্যে পিছিয়ে পড়লে কিংবা তাল ঠুকে চলতে না জানলে আমাদের জান নিয়ে টানাটানি পড়বে, তাতে জান যদি বাঁচে মন নিশ্চিতই হারাব। আর কে না জানে, মন-হারানো জান-হারানোর চাইতেও ক্ষতিকর। উঠতির লক্ষণই হচ্ছে নির্ভীকতা, উদারতা, প্রাণময়তা, মুখরতা, জিজ্ঞাসা, কর্মনিষ্ঠা ও চিন্তা ভাবনার প্রবহমানতা। আমরা নতুন জাতি, আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মব্যাপ্তিই আমাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও ব্রত। এতকালের আত্মসংকোচন ও জড়তার গ্লানি মুছে আত্মপ্রসারে ব্রতী হওয়াই তো কাম্য।
যে-প্রসঙ্গে এ আবেগের বন্যা ছুটল, সে-কথাই বলি : বুতপরস্তের আরবি, আগুন-পূজকের ফারসি এবং পৌত্তলিকের উর্দু ভাষা-বিজ্ঞান মতে বাক্যরীতির (Syntax) ধরন দিয়েই ভাষার জাত বিচার হয়, এই দৃষ্টিতে উর্দু ভারতীয় আর্যভাষাভুক্ত] যদি ইসলামি ভাষায় পরিণত হতে পারে, তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানের ভাষা অবিকৃতভাবেই ইসলামি হতে বাধা কী? মুসলমানের মাতৃভাষা, মুখের বুলি হিন্দুয়ানি হতে পারে? আমরা না বলি–
চীন ও আরব হামারা
হিন্দুস্তা হামারা
মুসলিম হায় হাম
ওয়াতন হায় সারে জাহাঁ হামারা!
সাময়িকপত্র
পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ও মফস্বল থেকে প্রকাশিত সাময়িকপত্রের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। পাঠকসংখ্যা অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায় কম হলেও এদেশের পক্ষে যথেষ্টই বলতে হবে। কিন্তু এসব পত্রিকার বৈচিত্র্যহীনতা রসজ্ঞ সুরুচিসম্পন্ন পাঠকের পক্ষে পীড়াদায়ক–এ-কথা অবশ্য স্বীকার্য।
প্রথমেই ধরা যাক, ধর্মসম্বন্ধীয় পত্র-পত্রিকাগুলোর কথা। আমাদের বাঙলা ভাষায় ধর্মসম্বন্ধীয় যেসব পত্রিকা বের হয়, তার ভেতরকার লেখাগুলোতে কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তিধারার অবতারণা করা হয় না। ভাবপ্রবণতা, একদেশদর্শিতা, মনোমতো সত্য ও অর্ধসত্য শাস্ত্রবচন উদ্ধৃতির কচকচি, যুক্তিহীন বিশ্বাসপ্রবণতা, অলৌকিকতা প্রভৃতির জাল-জঞ্জালে ওসব লেখা প্রায় সুরুচিসম্পন্ন লোকের অপাঠ্য। এ পর্যন্ত ইসলামিক রিভিয়ু ধরনের একটি পত্রিকাও বাঙলার মুসলমান সমাজে বের হয়নি, ফলে ধর্মকথা সম্বলিত যে-কোনো কাগজের প্রতিই ভদ্রলোক মাত্রই বিরূপ।
তারপর সাহিত্য পত্রিকা। সাহিত্য-বিষয়ক পত্রিকাই আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি চলে। কিন্তু নিছক সাহিত্য-আলোচনায় সীমিত থাকে না এসব কাগজের লেখাগুলো। বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম ও ইতিহাস প্রভৃতি হরেক রকমের বিষয়বস্তু এতে সন্নিবেশিত হয়, ফলে এসব পত্রিকা এমন একটা রূপ ধারণ করে যে, বিশেষ সূক্ষ্ম-দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া আর কারো চোখে এগুলোর বিকৃতি ধরা পড়ে না। প্রথমেই হয়তো প্রেম-সম্পর্কিত একটা কবিতা পড়লেন, পরপৃষ্ঠায় দেখলেন কোয়ান্টাম থিওরি সম্বন্ধে এক আলোচনা যেখানে আপনি সম্পূর্ণ অনধিকারী। এর পরেই হয়তো পড়লেন একটি রোমান্টিক গল্প; গল্পের রেশ হয়তো আপনার মনে লেগেই আছে; এমনি সময়েই পরপৃষ্ঠায় দেখলেন শাহজাহানের সিংহাসন লইয়া বিবাদ অথবা ইসলামে পর্দার বিধান গোছের কোনো আলোচনা। তারপর আবার গেলেন কবিতার সাক্ষাৎ যেখানে প্রকাশ পেয়েছে সর্বহারার নিপীড়িত হৃদয়ের মর্মান্তিক বিক্ষোভ। কোনো কোনো পত্রে, শেষের দিকে রাজনীতিচর্চার কসরৎও দেখা যায়। এমনি করে আমাদের মাসিক বা সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো এক বিচিত্র বস্তুতে পরিণত হয়!
এমন লোক আছেন, যাঁদের কেউ শুধু গল্প পড়েন, কেউ শুধু কবিতা পড়েন, কেউ বা শুধু প্রবন্ধ পড়েন আর কেউবা রাজনৈতিক আলোচনা পড়েন; অন্যকিছু পসন্দই করেন না। এতে অসুবিধাটা দেখুন। হয়তো আপনি গল্প পড়তে ভালোবাসেন, অথচ কাগজে গল্প আছে মাত্র দুটো। এখন দুটো গল্পের জন্যে আট আনা পয়সা খরচ করা উচিত কি-না, তা-ই আপনাকে পাঁচ মিনিট ভাবিয়ে তুলল। যদি কিনলেন হয়তো পরে পস্তালেন, না কিনেও হয়তো আপনার মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। তেমনি যারা কবিতা পড়তে চান, তারা দেখেন মাত্র চারটে কি পাঁচটা কবিতা আছে, এর জন্যে আটআনা খরচ করলেও পোষায় না, আবার না-পড়েও উপায় নেই। ধরুন, বিজ্ঞান কি ইতিহাসের কোনো একটিমাত্র বিষয় আলোচিত হয়েছে, বিষয়টা আপনার প্রিয়, কিন্তু শুধু ঐ একটা বিষয়ের জন্যে ছা-পোষা গরিব লোক আপনার পক্ষে আট আনা ব্যয় করা সম্ভব হল না, ফিরেই গেলেন–কিন্তু মনে মনে আফসোস রয়ে গেল। সেদিন আট আনা দিলেন না, অথচ আর একদিন তিন-চার আনা বাসভাড়া দিয়ে কোনো Public Library-তে পড়ে এলেন। লাভ-ক্ষতি মিলিয়ে দেখুন। সমস্যাটা কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেবার মতো নয়। প্রকাশক ও পাঠক উভয়পক্ষেরই ক্ষতি, তলিয়ে দেখুন।
কোনো কোনো সাহিত্য-পত্রিকার প্রথমে একটা চিত্রও সন্নিবেশিত হয়। চিত্রকলার এমন কী সার্থকতা, বুঝা দুঃসাধ্য। যদি চিত্রটি ব্যাখ্যা করে দেবার ব্যবস্থা থাকত, তবু নাহয় চিত্রকলায় হাতেখড়ি দেবার প্রয়াস বলে ধরে নেয়া যেত।
শুধু বৈজ্ঞানিক আলোচনার জন্যে এদেশে কোনো কাগজ আগে বের হত না, এখন হয়, কিন্তু চলে না। দর্শন বা ইতিহাস সম্বন্ধেও তাই। ভাস্কর্য, স্থাপত্য, চিত্রকলা প্রভৃতি বিষয়ে পত্রিকা বের করার কথা চিন্তাও করা যায় না। তবে সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার মতো প্রত্নতত্ত্বমূলক আলোচনার বিশেষ পত্রিকা আছে; কিন্তু দু-একটি মাত্র।
সম্প্রতি চলচ্চিত্র ও যৌনবিষয়ক বিশেষ পত্র বের হচ্ছে। রুচি ও আদর্শ সম্বন্ধে আমরা কিছু বলতে চাইনে, তবে বিশেষ বিশেষ বিষয়ের আলোচনার জন্যে বিশেষ বিশেষ পত্রিকার প্রকাশ-রুচি ও রসবোধের পক্ষ থেকে নিশ্চয়ই শুভ লক্ষণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু গল্প বা শুধু কবিতার জন্যেও কাগজ বের হতে দেখা যায়, এ অবিমিশ্র একাগ্র সাধনা মার্জিত মনের পরিচায়ক।
তারপর আমাদের দেশে শিশু-সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াসও দুর্লক্ষ্য নয়; এজন্যে কয়েকখানা মাসিক বের হয়েছে, দৈনিক পত্রে সাপ্তাহিক আসরও রয়েছে। কিন্তু এদেশে শিশু-সাহিত্যের লেখক ও সম্পাদকের এত অভাব যে, শিশু-সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা কোনো নির্দিষ্ট পথ করে নিতে পারেনি। দুই বঙ্গে মাত্র জনকয়েক লেখক অবশ্য কিছুটা সফলতা অর্জন করেছেন, কিন্তু বাঙলাভাষী বিশাল শিশুসমাজের পক্ষে তাঁদের দান নিতান্ত সামান্য। যে-প্রতিভা ও সাধনা এ ব্যাপারে প্রয়োজন, এ পর্যন্ত তা আমাদের দেশে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সবচেয়ে যে-অভাবটা বেশি চোখে পড়ে, তা হচ্ছে কাগজগুলো আকর্ষণীয় করে বের করার অসামর্থ্য। শিশু পত্রিকায় রঙ বেরঙ-এর কার্টুন, খবরের ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্য প্রভৃতি না থাকলে গল্প (যা প্রায় চির–পুরাতন), কবিতা, ব্যঙ্গ কবিতা, জ্ঞানের কথা বা উপদেশের মুরুব্বিয়ানা শিশুচিত্তে প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হবে না। য়ুরোপ-আমেরিকার। কাগজগুলোতে চিত্র, কার্টুন ছাড়া একটা পৃষ্ঠাও নেই। আমাদের মনোভাবও এর অভাবের জন্যে দায়ী। আমরা বিজ্ঞতা দেখাতেই ব্যস্ত, বোকা সাজতে জানিনে। ফলে হালকা কথা, হালকা হাসি আমাদের মুখে ফোটেই না। জ্ঞানগর্ভ কথা ছাড়া অন্য কথা আমাদের মনোমতো হয় না। আমরা যা পসন্দ করি, তাই শিশুকে পরিবেশন করতে চাই। এজন্যে আমাদের দেশে উৎসাহী শিশুপাঠকের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অনেকেই অভিভাবকের উপদেশ রক্ষার জন্যেই শিশু-পত্রিকাগুলো নাড়াচাড়া করে।
ছোটদের কথা গেল, বড়দেরও চিত্র, কার্টুন ও ফটোর প্রতি আকর্ষণ কম নয়। আমাদের দেশে ইংলন্ড-আমেরিকা থেকে যে-সব কাগজ আসে, তাদের অধিকাংশই চিত্র, কার্টুন ও ফটোতে পূর্ণ। এজন্যে আমাদের দেশে Illustrated weekly-র এত কদর। অথচ আজ পর্যন্ত বাঙলাভাষায় এরূপ একটা কাগজের কথা কল্পনাও করতে পারি না। দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে!
আমরা আগেই বলেছি, রুচি আদর্শের কথা বলব না; কেননা সম্পাদকের যোগ্যতা, রুচি ও আদর্শ পাঠকের রুচি ও আদর্শকে মার্জিত, সুস্পষ্ট ও বিকশিত করে তুলবে। স্বদেশী-বিদেশীর অনুকরণ-স্বীকরণ প্রভৃতি সম্পাদকের প্রতিভা ও যোগ্যতার উপরই নির্ভরশীল এবং পাঠকগোষ্ঠীর রুচি ও আদর্শ গঠনও সম্পূর্ণ নির্ভর করে সম্পাদকের উপর।
আমাদের শেষ বক্তব্য হচ্ছে; আমাদের দেশেও বিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস প্রভৃতির জন্যে বাঙলাভাষায় পৃথক পৃথক সাময়িকপত্র বের হোক। সিনেমা, চিত্রশিল্প, যৌনবিজ্ঞান, দেহতত্ত্ব প্রভৃতি সবকিছুরই আলোচনা হোক পাঠকের রুচি গরজ ও ঝোঁক অনুসারে। পাঠক এতে একান্তভাবে তার নিজের জ্ঞাতব্য নিয়ে বিশেষভাবে অধ্যয়নের সুযোগ পাবে। সাহিত্য-পত্রিকাগুলোর পরিবেশিত খিচুড়ি গেলার দায় থেকে পাঠকসাধারণ মুক্ত হোক–আমরা এ-ই চাই।
সাহিত্য রূপপ্রতীক
কিছুকাল আগে মুসলমান লিখিয়েদের বে-ইসলামি রূপপ্রতীক ব্যবহারের অনৌচিত্য সম্বন্ধে লেখা একটি প্রবন্ধ পড়েছিলাম। ওটি পড়ে আমাদের মনে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জেগেছে :
প্রথমত, আমাদের ধারণায় ইসলাম হচ্ছে একটি ভাব বা আদর্শ কিংবা জীবন-বিধান বা জীবন-সংস্থা, যার সাধারণ নাম ধর্ম। কাজেই বিশ্বাস ও আচরণের ব্যাপারেই কেবল ইসলামি কিংবা বে-ইসলামি শব্দ বা সংজ্ঞার প্রয়োগ চলতে পারে। অন্যত্র ইসলাম শব্দের ব্যবহার অপপ্রয়োগ বই কিছুই নয়। নারঙ্গী কিংবা খোরমা বললে ইসলামি হবে, আর কমলা বা খেজুর বললে বুতপরস্তী হবে–এমন হাস্যকর যুক্তি শিক্ষিত মনে কী করে জাগে, ভেবে পাইনে।
দ্বিতীয়ত, ইসলাম পৃথিবীময় পরিব্যাপ্ত হয়েছে। তাই বলে মুসলমানের দেশ বা ব্যবহৃত সামগ্রীর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কী? আরবি মুসলমান গেঁও খায়, বাঙালি মুসলমান খায় ভাত। তাই বলে কী গেঁও আর ভাত ইসলামি হল? আরবের কোরআন আর রসুলই কেবল মুসলমানমাত্রেরই সাধারণ ঐতিহ্য, আর সে-সূত্রে এবাদতের ভাষা আরবিও। এ ছাড়া আরবের সঙ্গে মুসলমানদের অন্য কোনো সম্বন্ধ থাকার তো কথা নয়।
তৃতীয়ত, আরবেরা কোরআন গ্রহণ করল আর রসুলকে বরণ করল বটে কিন্তু তারা স্বদেশের ও স্বজাতির কুফরী ঐতিহ্যের গর্ব ছাড়েনি। ইরানেও দেখি তাই। য়ুরোপের খ্রীস্টানরাও গ্রীস রোমের pagan ঐতিহ্য ভোলেনি। আমরা যে ইসলাম ও ইসলামের উদ্ভব-ভূমির দোহাই দিয়ে স্বাদেশিক ও স্বাজাতিক ঐতিহ্য ভুলে আরবের বিয়াবান ও বসোরাই গোলাবের দিকে তাকিয়ে থাকবার নসিহত জারি করতে চাই–এরূপ চিন্তা দুনিয়ার কোনো জাগ্রত জাতি করে কী?
চতুর্থত, ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক কিংবা জাতিক জীবনে উঠতির ও পড়তির কতগুলো সাধারণ লক্ষণ দেখা যায়। উঠতির লক্ষণ প্রাণময়তা, আত্মজিজ্ঞাসা, আত্মপ্রত্যয় ও আত্মপ্রসারের অবিরাম প্রয়াস। পুরোনোর পুচ্ছগ্রাহিতা নয়; নতুনের উদ্ভাবনে ও উদঘাটনে, ক্ষয়-ক্ষতির ঝুঁকি নিয়ে চিন্তার ও কর্মের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন ও বিচিত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাওয়ার নির্ভীক উদ্যমেই এর প্রকাশ ও বিকাশ। আর পড়তির লক্ষণ হচ্ছে পুচ্ছগ্রাহিতা, যোগ্যজ্ঞাতি প্রীতি, কুটুমের গৌরব বশ্যতা, আত্মবিস্মৃতি, দেহে-মনে পরপোষ্যতা, অতীতমুখিতা, নিষ্প্রাণতা, আর চিন্তায় ও কর্মে উদ্যমহীনতা।
দুটো দৃষ্টান্ত নিলেই আমাদের বক্তব্য পষ্ট হবে। ইহুদির জাত আছে, ধর্ম আছে, ছিল না কেবল দেশ; তাই বলে তারা আত্মবিস্মৃত ছিল না। এ কারণেই জনসংখ্যায় নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও আজকের য়ুরোপীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে তাদের দান গুরুত্বে বিশিষ্ট। আর পাক-ভারতে প্রায় আড়াইশ বছর আগে দেশী ও ইঙ্গ-ভারতীয় খ্রীস্টান সমাজ গড়ে উঠলেও আত্মসচেতনতার অভাবে তাদের অস্তিত্বের ছাপ জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই ফুটে ওঠেনি। তারা শাসকজাতির জ্ঞাতিত্বের গর্বে, স্বধর্মীর স্বদেশ য়ুরোপ-মুখিতায় এবং য়ুরোপীয় সংস্কৃতিতে স্বকীয়তার স্বপ্নে নির্বোধ আত্মপ্রসাদ লাভ করে যে-আত্মপ্রবঞ্চনা করেছে, তাতে তাদের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যহীন তথা সাধনাহীন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে কেবলই Snobbery প্রকট হয়ে উঠেছিল জাতি বা সম্প্রদায় হিসেবে সুস্থ। হয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠ হতে পায়নি। শিক্ষায়-সাহিত্যে-দর্শনে-বিজ্ঞানে কিংবা চারিত্রিক মহত্ত্ব-মাহাত্ম্যে তাদের কেউ গণ্য হয়ে ওঠেনি। স্বাধীন পাক-ভারতে তাদের মোহ-মুক্তির অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠছে, এখন হয়তো তাদের সত্যকার জীবন-সাধন শুরু হবে।
হাজার বছর ধরে উচ্চবিত্তের বাঙালি মুসলমান এরূপ বহির্মুখী মনের পরিচয় দিয়েছে। তাই বিগত হাজার বছরে বাঙালি মুসলিম উচ্চবিত্তের দ্বারা আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতিতে শ্লাঘ্য, কোনো কীর্তি গড়ে ওঠেনি। নিম্নবিত্তের অজ্ঞ অশিক্ষিত লোকের মাটির মায়া ছিল, কিন্তু অজ্ঞতা-অশিক্ষার দরুণ তাদের স্বকীয় আদর্শ ও লক্ষ্য চেতনা ছিল না, তাই তারাও পর-প্রভাবমুক্ত হয়ে স্বস্থ হতে পারেনি। আর তাই তারা গড়ে তুলেছিল লৌকিক ইসলাম–যার কল্পছায়ায় তারা জগৎ ও জীবনের মনোময় ব্যাখ্যা খুঁজেছে এবং পেয়েছে। তাদের ভক্তিবাদ, বৈরাগ্য ধর্ম ও মানবতাবোধ এক : অভিনব মরমীয়া তত্ত্বের জন্ম দিয়েছে, যাতে দেহাত্মবাদ, মুরশিদ পন্থ, অলখ সই (অলক্ষ্য স্বামী) জীবন- জিজ্ঞাসার নিবৃত্তি ও জৈবধর্মের বিকৃতি ঘটিয়েছে। তবু এ কারুর কাছে গর্বের, আবার কারুর কাছে লজ্জাকর।
যারা বসুধৈব কুটুম্বকম-পন্থী তাদের কাছে মানুষের প্রাকৃত-মানসের এই সহজ ও অকৃত্রিম প্রকাশ গর্বের ও আনন্দের সামগ্রী। আর যারা স্বধর্মনিষ্ঠ আদর্শবাদী তাদের কাছে এ স্বধর্মভ্রষ্টতা– আদর্শচ্যুতি লজ্জার ও ক্ষোভের বিষয়। এ প্রাকৃতজনেরা জীবন-ভাবনার প্রয়োজনে উচ্চারণ করেছে। মানবতা ও মানব মহিমার চরম বাণী : নানা বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ :
জগৎ ভরমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।
আর– লামে আলিফ লুকায় যেমন
মানুষে সাঁই আছে তেমন
তা-না হলে কী সব নূর-ই-তন
আদম তনকে সেজদা জানায়!
কিংবা, আহাদ আহমদ মাঝে
কেবল মিমে ফরক রয়।
আবার এরাই বাঁচবার গরজে করেছে নানা উপদেবতা ও অপদেবতার পূজা।
অতএব যারা ইসলাম-অনুগ জীবন, আদর্শ ও সংস্কৃতির পক্ষপাতী, তারা বিগত হাজার বছরের বাঙলার ইতিহাসে নিছক ইসলামি সংস্কৃতির কোনো নিদর্শন পাবে না। অবশ্য সুফীতত্ত্ব প্রভাবিত এই সংস্কৃতিকে দেশী মুসলিম সংস্কৃতি বলে স্বীকৃতি দিয়ে সহজেই গৌরব করা যায়।
সংস্কৃতি মাত্রেই স্বস্থ জীবনবোধের প্রকাশ এবং প্রাণময়তার অভিব্যক্তি। আর চিন্তায় ও কর্মে সুন্দরের সাধারণ নাম সংস্কৃতি। এর চর্চা এবং স্বরূপে এর প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের নাম সাংস্কৃতিক চর্চা। কাজেই তা বহু বিচিত্র ও নতুন হয়েই ফুটে ওঠে। নিতান্ত আদর্শানুগত্য কোনো সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারে না, এমনকি সুষ্ঠু লালনেও অক্ষম। এইজন্যেই সাধারণত আমরা ইসলামি সংস্কৃতি বলতে যা বুঝি ও বুঝাই তাও আরব-ইরান-তুরানের দেশজ ও গোত্রজ সংস্কৃতির পাঁচমিশেলী রূপ মাত্র। তাই এর পরিচায়ক নাম হওয়া উচিত মুসলিম সংস্কৃতি এবং যেহেতু এ সংস্কৃতির উদ্ভব মুসলিম মানসে এবং এর প্রতিফলন হয়েছে মুসলমানেরই আচরণে ও কর্মে, সেজন্যে রূপকল্পে ও ভাবরসে তা ইসলামি জীবনবোধের দ্বারা প্রভাবিত। তাই বলে একে ইসলামি বলার যৌক্তিকতা নেই।
আগেও বলেছি, আবার বলছি; ধর্ম এক জিনিস, আর স্বাদেশিকতা, স্বাভাবিকতা ও স্বাজাতিকতা অন্য বস্তু। মানুষ চিরকাল বিদেশের ও বিজাতির ধর্ম গ্রহণ করেছে, কিন্তু স্বদেশ, স্বভাষা ও স্বাজাত্য ছাড়েনি। তাই পৃথিবীর তিনটে বহুল প্রচারিত ধর্মের ভাষা হিব্রু, পালি এবং আরবি–মসজিদ, মন্দির ও গীর্জার প্রাচীর ডিঙিয়ে বিদেশে কারো মুখের বুলি হতে পারেনি। হৃদয়বৃত্তির প্রাবল্য-বশে ধর্মের উদ্ভবভূমি, ধর্মীয় ভাষা এবং ধর্মপ্রবর্তকের গোত্র শ্রদ্ধেয় হতে পারে, তাই বলে নির্বিকার ও নির্বিচার আত্মসমর্পণ তথা আত্মবিলয় দাবী করতে পারে না। প্রত্যেক মানুষের যেমন ব্যক্তিক দাবী আর পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব রয়েছে, অর্থাৎ ব্যক্তি যেভাবে। নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও পরিবারের ও সমাজের সদস্য, তেমনি মানুষ বা জাতিবিশেষ তার স্বাদেশিকতা এবং স্বাভাষিক আর স্বাজাতিক স্বার্থ ও স্বাতন্ত্র্য অটুট রেখেই ধার্মিক ভ্রাতৃত্বে আস্থাবান থাকবে ও এর অনুসারী হবে; আমরা যেমন একাধারে নিজের কাজও করি, দেশের কথাও ভাবি এ দুটোতে কোনো অসঙ্গতি বা বিরোধ নেই। ইসলামি ভ্রাতৃত্বের রূপ কার্যত এভাবেই ফুটে উঠেছে–মুসলিম জগতের ইতিহাস সর্বত্র এ সাক্ষ্যই বহন করছে। Pan Islamism বা বিশ্বমুসলিম ঐক্যবাদের যদি কোনো সদর্থ ও ব্যঞ্জনা থাকে, তবে তা এখানেই এবং এরূপই। . এজন্যেই দেখতে পাই বুতপরস্ত আরব ইসলাম বরণ করল, আগুন-পূজক ইরানি ইসলামে দীক্ষা। নিল; কিন্তু স্বদেশের ও স্বজাতির কুফরী ঐতিহ্য ত্যাগ করেনি, কিংবা স্বাদেশিকতা, স্বাভাবিকতা ও স্বাজাতিকতা ভোলেনি, অথবা আত্মস্বাতন্ত্র্য বিলোপ করে বিশ্বমানবতায় বা আন্তর্জাতিকতায় লীন হয়ে যায়নি। আত্মরতিতে নয়, আত্মপ্রেমেই অবশ্য বিশ্বপ্রেমের বীজ নিহিত থাকে। তাই দেখতে পাই, আদর্শ মুসলিম সুলতান মাহমুদ গজনবী মোমেন কবি ফিরদোসীকে দিয়ে লেখালেন শাহ্নামা যাতে রয়েছে অমুসলিম ইরানি বাদশাহ্ ও বীরের কাহিনী। কাজেই ইসলামানুগ আত্মজীবন চর্যার মাধ্যমেই বিশ্বমানব পরিচর্যার পাঠ গ্রহণ করতে হবে।
কোনো ভাষাতেই ধর্মীয় রূপ থাকতে পারে না, থাকে ধার্মিকভাব। মোমেন স্বেচ্ছায় যে কথা বলবে, যা ভাববে বা করবে, তাতে–এক কথায় তার চলনে-বলনে-করণে ইসলামি ভাব বা আদর্শ থাকবেই। সে যেখানেই থাকুক, যে-ভাষায়ই বলুক আর যে হাতিয়ারেই করুক। এ বিষয়ে তর্কের অবকাশ নেই। কাজেই মাতৃভাষার সঙ্গে ধর্মের ভাষা মিশালেই ভাষা ও সাহিত্যের ধর্মীয় রূপ মেলে না। কে না বোঝে যে আরবি ভাষায়ও আল্লাহর নিন্দা করা যায়, আবার সংস্কৃত ভাষায়ও আল্লাহ্র বন্দনা সম্ভব।
আমাদের দুর্ভাগ্য, একটা অহেতুক মোহবশে আমরা যুক্তি ও বিবেচনা পরিহার করে একপ্রকার আদর্শ-মরীচিৎকার পিছু ধাওয়া করছি। তার ফলে আমরা আমাদের স্থানিক, কালিক ও ব্যক্তিক গরজ ও উপযোগ ভুলে অর্থাৎ বাস্তব জীবনের পরিবেশ ও প্রয়োজন বিস্মৃত হয়ে মনোময় স্বপ্নলোক সৃষ্টির হাওয়াই আদর্শের রূপায়ণে উধ্বমুখে ছুটে চলেছি। এই আকাশচারিতা যে আমাদের শক্তি-সামর্থ্যের কেবল অপচয়ই ঘটাতে পারে, জীবনে কোনো সাফল্য কিংবা স্বাচ্ছন্দ্য দিতে পারে না, তা আমরা ভাবতেও চাই না। সত্যকে অস্বীকার করা যে দায়িত্বকে এড়িয়ে যাওয়া তথা জীবনকেই ফাঁকি দেওয়া–এ বোধ আমাদের যতদিন সহজভাবে না জাগবে ততদিন আমাদের মন-মানসের মুক্তি নেই। ফলে এগিয়ে চলার পথ নির্ণয়ের সমস্যাও থেকে যাবে। অতএব রুদ্ধ থাকবে অগ্রগতিও।
আমাদের কাছে যুক্তি-বুদ্ধি কীভাবে অবহেলিত এবং মোহাবেগ কত বেশি প্রবল তার একটি দৃষ্টান্ত দিলেই হবে।
উপমাদি অলঙ্কার তথা রূপ-প্রতীক ব্যবহৃত হয় বক্তব্যকে পষ্ট, সুষ্ঠু ও ঋদ্ধ করবার জন্যেই শিল্প-সৌন্দর্যও ফুটে ওঠে এভাবেই, কেননা পরিচিত বস্তু বা ভাবের ব্যঞ্জনা ও ঐশ্বর্য বক্তব্যের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাকে অসামান্য করে তোলে। মাতৃভাষার শব্দ ও স্বদেশের বস্তুই বক্তার বা শ্রোতার মানসলোকে এ গুণ নিয়ে বিরাজ করে। অপরিচিত বিদেশী শব্দ, ভাব বা বস্তু তার ব্যঞ্জনা ও লাবণ্য নিয়ে ভিন্নদেশীর কানে-মনে সহজে এবং স্বাভাবিকভাবে প্রবেশ করতে পারে না। সত্যি কিনা জানিনে, শুনতে পাই কেবল বিদগ্ধ জনের পক্ষেই বিজাতীয় ভাষার রস-রূপ আয়ত্ত করা সম্ভব।
এ যদি সত্যি হয়; সাধারণের জন্যে রচিত সাহিত্য আরবি, ফারসি, ইংরেজি শব্দ বা বস্তুনাম বসালে তার ধ্বনি-সৌন্দর্য ও অর্থব্যঞ্জনা বৃদ্ধি পাবার কথা নয়। কেননা, ওগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের অভাব রয়েছে এবং তাই কল্পনার দৃষ্টিও অতদূর না- পৌঁছাই স্বাভাবিক। তেমন অবস্থায় বিয়াবান, কাফেলা, মঞ্জিল, নারঙ্গী, খোর্মা, শব্ব-ই-গুল, কোহ্ কিংবা ইংরেজি বা গ্রীক পৌরাণিক শব্দ প্রভৃতি রচনা-গৌরব বৃদ্ধি করার কথা নয়। আর একটি কথা আগেই বলেছি, আরব-ইরানিরা তাদের কাফের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য-রিথ অবহেলা করেনি, পরম শ্রদ্ধায় বরণ করে নিয়েছে। আমরা কিন্তু আমাদের অমুসলমান পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ভুলবার সাধনা করেছি, আর অবজ্ঞা করেছি আমাদের স্বকীয় ও স্বাদেশিক সম্পদকে।
আমাদের শ্রদ্ধা-ভক্তি-প্রীতি যা-ই হোক না কেন, তা থাকবে (এবং থাকা বাঞ্ছনীয়ও) মুসলিম আরব ও ইরানির প্রতি। তাদের কাফের পূর্বপুরুষের জন্যে আমাদের কোনো শ্রদ্ধা-সমীহের ভাব থাকার কথা নয়, থাকা উচিতও নয়, অথচ এ ব্যাপারে আমাদের মনোভাব অদ্ভুত ও আত্মদ্বেষী। পাক-ভারতের দশ কোটি মুসলমানের কিছুসংখ্যক লোক আরব-ইরানি-তুরানির বংশধর হলেও নিশ্চয়ই আর সব মুসলমান দেশজ, তাহলে দাতার উপমা দিতে হলে বিদেশী বিজাতি কাফের হাতেমতাইর চেয়ে দেশী এবং সম্ভবত জ্ঞাতি কর্ণের উপমা মনে জাগাই স্বাভাবিক ও শোভন। তেমনি কাফের কবি ইমরুল কায়েসের চেয়ে কালিদাসের দাবী কম নয়।
নওসেরওয়া, জানান, শাহরিয়ার হলেন বিদেশী অমুসলমান, আর বিক্রমাদিত্য-ভোজরাজা আমাদের প্রতিবেশী এবং নানা সূত্রে চেনা লোক। বিদেশী কাফের শাহনূরীমান, রোস্তম-সোহরাব আমাদের আপন হলে আমাদের পাশের বাড়ির ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ কিংবা ভীমার্জুনকে পর ভাবা কষ্টসাধ্য। এ কতবড় আত্মলাঞ্ছনা ও আত্মপ্রবঞ্চনা, আমরা ভেবে দেখছি কী? আমাদের রূপপ্রতাঁকে যদি বাছবিচার করতেই হয়, তাহলে আমাদের নীতি হবে–আমরা দেশী-বিদেশী মুসলিম ঐতিহ্য ও আদর্শপ্রসূ রূপপ্রতীকই কেবল গ্রহণ করব। দেশী বিদেশী কোনো মুসলমানেরই জ্ঞাতি অমুসলিমের কিছু গ্রহণ করব না। আর যদি সাহিত্য-শিল্পের উৎকর্ষের জন্যে নির্বিচারে রূপপ্রতীক ব্যবহার করতে চাই, তা হলে দেশীগুলোকেও হেলা করব না, কোনো বিরূপতা দেখাব না।
বিদেশী ভাব, বস্তু, শব্দ ও রূপপ্রতীক গ্রহণ ও বরণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে তখনি, যখন জাতির ভাষা ও ভাবে তার অভাব থাকে অর্থাৎ নতুন বস্তুর নাম ও ভাবের বাহন হিসেবেই শুধু এক ভাষায় অপর ভাষার শব্দ গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। যেমন এ যুগে বিভিন্ন নতুন বস্তু পরিচায়ক ও ভাব। প্রকাশক ইংরেজি শব্দ এসেছে আমাদের ভাষায়। এ না হলে ঋণ গ্রহণ নিরর্থক ও অসার্থক।
আমরা এভাবে আড়াই থেকে তিন হাজার আরবি-ইরানি ও তুর্কী শব্দ আগেও গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি, প্রয়োজনমতো চিরকালই করব এবং তা শুধু এসব ভাষা থেকেই নয়, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের যে-কোনো ভাষা থেকেই করব। কেননা, তাতে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য এবং মন-মানস সমৃদ্ধই হবে। কিন্তু অহেতুক মোহবশে করলেই কেবল আপত্তি উঠবে এবং সে-আপত্তি নিশ্চয়ই কল্যাণ-বুদ্ধিপ্রসূত হবে। বিশেষত, এখন আন্তর্জাতিকতার যুগ; চিত্ত প্রসারের এবং জীবনকে বিস্তৃত পরিসরে ছড়িয়ে দেবার যুগ। অতএব যেখানে যা-কিছু ভালো, যা-কিছু সুন্দর ও কল্যাণকর, তা-ই কুড়িয়ে নেব, সাদরে গ্রহণ করব, আর আগ্রহে বরণ করব। আমাদের ধর্ম-ভাই আরব-ইরানির অবদান গ্রহণ করতে কোনো কুণ্ঠা থাকার কথা নয়। কিন্তু সংকীর্ণ চিত্তের মোহ ও বিকৃতিবশে জগতের উদার বিস্তারের আলো-হাওয়া থেকে নিজেদের গা-বাঁচিয়ে আদিম গোত্র ও কোটারি প্রীতির বশে পুরোনোকে ও বিশেষকে আঁকড়ে ধরার মনোভাবেই আমাদের আপত্তি। তা জীবন বিমুখিতার লক্ষণ তথা প্রগতির পরিপন্থী।
সাহিত্যে আর্দশবাদ বা অর্ডিন্যান্স
সাহিত্যের রূপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে সঠিক অভিব্যক্তি দেওয়া আজো সম্ভব হয়নি, যদিও এ পথে সাহিত্য সৃষ্টির সাথে সাথেই চেষ্টা চলে আসছে। তার প্রধান কারণ বোধ হয় এই যে, সাহিত্য মূলত উপভোগের বস্তু; অনুভূতিজাত উপলব্ধিই এর চরম কথা; ব্যাখ্যা করে বুঝে নেয়া বা বুঝিয়ে দেয়ার বস্তুই এ নয়। এমনও অনেক রচনা আছে যার বস্তু আছে–ভাষাও ত্রুটিহীন অথচ তা সাহিত্যই নয়! যেমন দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয় প্রবন্ধাবলি। সুতরাং সাহিত্য যে কী বস্তু, তার স্বরূপ কী প্রকার, তা ব্যক্ত করা ব্যাখা করা সম্ভব নয়। শুধু বলা চলে, সাহিত্য রস-স্বরূপ। সে-রসের বহু সংজ্ঞা প্রচলিত আছে সত্যি, কিন্তু বুদ্ধিগ্রাহ্য একটিও নয়; শুধু উপলব্ধি এবং উপভোগ-সম্ভাব্যতাই এর একমাত্র পরিচয়। এছাড়া প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ও রসগ্রাহিতামূলক যত সংজ্ঞা আছে সবগুলোই বাহ্য-অন্তরপরিচয়বাহী নয়। এগুলোকে আহা-আহা মরি-মরি ধাচের আবেদনমূলক সংজ্ঞা বললে একটু খটকার কারণ ঘটে বটে–কিন্তু আসলে এগুলো তা-ই।
অতএব, সাহিত্য বিচারে সার্বজনিক কোনো নিরিখ নেই। পাঠকের রুচি, বিদ্যাবুদ্ধি, জ্ঞান প্রজ্ঞা ও প্রকৃতি-প্রবৃত্তি অনুসারে সাহিত্যের রসরূপ উপলব্ধ হয়। এখানে ভালো লাগাটাই বড় কথা। ইংরেজি গানের সুর-তাল যতই উৎকৃষ্ট হোক, সাধারণ বাঙালির কাছে তার কোনোই আবেদন নেই। তার কাছে–বাঙলা গান জগতের সর্বসঙ্গীতের বাড়া। তেমনি শেলির কবিতার বা শর নাটকের তীক্ষ্ণ মনীষাদীপ্ত সংলাপের মূল্য ইংরেজি ভাষার ব্যুৎপত্তিহীন পাঠকের কাছে কানাকড়িও নয়। এমন পাঠকের কাছে নজরুল কী দ্বিজেন রায়েরই কদর। শেলি বা শ অপাঠ্য, অন্তত দুম্পাঠ্য তো বটেই। সুতরাং পাঠকসাধারণের মতামতের উপর নির্ভর করে সাহিত্যের উত্তৰ্ষ-অপকর্ষ সম্বন্ধে ডিগ্রি-ডিসমিস দেয়া চলে না। এমন দেখা গেছে, সবেচেয়ে ভালো বইয়ের কদর সবশেষে হয়েছে। তবে সাহিত্য ব্যাপারে প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে–যেসব পাঠকের বিদ্যা-বুদ্ধি, রুচি-প্রকৃতি ও রস-জ্ঞানে বিশ্বাস ও ভরসা আছে, তাদের মতামতকে চরম এবং যথার্থ মনে করে সাহিত্যের সাধারণ পাঠকগোষ্ঠী বুঝে বা না-বুঝে রচনা-বিশেষের সমাদর করে। কিন্তু এমন বিজ্ঞ সমালোচক ও রসবেত্তারাও শুধু ভালো লাগা বা মন্দ লাগার বড় জোর কারণ দর্শাতে পারেন, কিন্তু নির্দেশ দিয়ে সৃষ্টি করাতে পারেন না–যেমন যেসব উপাদানে বৃক্ষের জীবন ও দেহ গঠিত, সে-সব বিশ্লেষণ করা সম্ভব, কিন্তু বৃক্ষ তৈরি করা অসম্ভব।
এ পর্যন্ত গেল রসের কথা। তারপর আসে আদর্শবাদের বিষয়।
স্রষ্টা নিজের ভাব-চিন্তা এবং বুদ্ধি ও বোধি দিয়ে সৃষ্টি করেন। তাঁর স্বকীয় অনুভূতি-উপলব্ধি বাণীরূপ লাভ করে হয় সাহিত্য। বস্তুত মানুষের অনুভূতি ও উপলব্ধি বাহ্যবস্তু-নিরপেক্ষ নয়। লেখক তাঁর রুচি, প্রকৃতি-প্রবৃত্তি ও বুদ্ধি-বোধিজাত আত্মদৃষ্টি দিয়ে জগৎ ও জীবনকে প্রত্যক্ষ করেন এবং এভাবে সর্বসমন্বয়ে মনের মধ্যে জগৎ ও জীবনের যে একটি সংহতরূপ গড়ে উঠে, তা-ই প্রকাশিত হয় তাঁর রচনায়। তার মতামতও একান্তভাবে তাঁরই। অপরের সাথে সে মতামতের মিল ঘটে নিতান্ত আকস্মিকভাবে। অতএব ব্যক্তি-বিশেষের মনের উপর বাহ্য প্রভাব যতই গভীর ও ব্যাপক হোক না কেন, তা যদি স্বাঙ্গীকরণ ব্যতীত প্রকাশিত হয়, তবে একে অজীর্ণরোগের সাথেই তুলনা করা উচিত। তা রচনা হবে–রসায়ত্ত সাহিত্য হবে না। সুতরাং তার জন্যে কারো ভাবনার প্রয়োজনই নেই। অতএব দেখা যাচ্ছে–লেখক-বিশেষের স্বকীয় ভাব-চিন্তা-জ্ঞান ও প্রজ্ঞালব্ধ যে মতামত রচনায় প্রকাশিত হয়, তা-ই লেখকের আদর্শ। এদিক দিয়ে বিচার করলে আমরা দেখতে পাব–প্রত্যেক লেখকেরই এক একটি আদর্শ রয়েছে। কারো রয়েছে সমাজাদর্শ, কারো রাষ্ট্রাদর্শ, কারো বা ধর্মাদর্শ। তবে এ-কথায় বোধ হয় দ্বিমত নেই যে, হোমার থেকে শ অবধি কেউ সভা ডেকে পরামর্শ করে তাদের সাহিত্যাদর্শ স্থির করেননি। তাঁদের যিনি যেভাবে জগৎ ও জীবনকে দেখেছেন-বুঝেছেন, সেভাবেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এ যুগে যে-কোনো আদর্শ সম্বন্ধে কিছু বলা মানেই বিপদ ঘাড়ে করা। সুতরাং আমি সে-চেষ্টা করব না। আমি অন্য উপায়ে আমার বক্তব্য পেশ করব। এতে অবশ্য কথাগুলো কিছুটা অবৈজ্ঞানিক হবে, তবু হয়তো বুঝতে কষ্ট হবে না।
পূর্বেই বলেছি, সমাজে-ধর্মে-রাষ্ট্রে বা সাহিত্যে যখন যিনি যা প্রচার করেন তাতে বাহ্য প্রভাব যতই থাক না কেন, তাকে প্রচারকের নিজের অনুভূতি-উপলব্ধি বা বিশ্বাসের ফল বলেই ধরে নিতে হবে। বহু পুরাতন পরিত্যক্ত আদর্শ কেউ যদি নতুন করে প্রচার করে, তবে বুঝতে হবে তা পুরাতনের পুচ্ছগ্রাহিতা নয়, স্বকীয় নতুন উপলব্ধির প্রকাশ মাত্র। এখানে আমাদের আরো একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন, তা হচ্ছে মানুষের রুচি-প্রকৃতির যতই বৈচিত্র্য থাক না কেন, মানুষের বুদ্ধি-প্রজ্ঞা অপরিসীম নয়। ফলে মানুষ এ-পর্যন্ত জগৎ ও জীবন ব্যাপারে যে-কয়টি মৌল-শক্তির উৎসের ধারণা করতে সমর্থ হয়েছেন, আমার অবৈজ্ঞানিক অভিধায় সেগুলোর নাম দেওয়া যাক সমাজসত্তা, ব্যক্তিসত্তা, রাষ্ট্রসত্তা, ধর্মসত্তা, নাস্তিক্যসত্তা, নীতিসত্তা, নৈর্ব্যক্তিক রসসত্তা (মানে দার্শনিকতা), নীতিলেশহীন বিচিত্রসত্তা ইত্যাদি। স্ব স্ব জ্ঞান-মনীষা দিয়ে কেউ ব্যক্তি-মহিমা, কেউ ধর্ম-মহিমা, কেউ রাষ্ট্র-মহিমা, কেউ সমাজ-মহিমা, কেউবা নাস্তিক্য-মহিমা, আবার কেউ বা ব্যষ্টির বিচিত্র অনুভূতিরস-মহিমা প্রচার করেছেন। এ-কথা যথার্থ যে, প্রত্যেকেই স্ব স্ব উপলব্ধিরই অভিব্যক্তি দিয়েছেন, কেউ কারো আদেশ-নির্দেশ বা উপদেশ-পরামর্শ গ্রহণ করেননি। কেননা নিজের বুদ্ধিগ্রাহ্য বা হৃদয়গ্রাহ্য না হলে কেউ কারো অনুকরণও করতে পারে না। অন্ধের হস্তীদর্শনের মতো হয় আমরা সবাই ভুল ধারণা পোষণ করছি অথবা আমরা সবাই সত্য কথাই বলছি। এ-নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু মীমাংসা পাওয়া যাবে না, সুতরাং সিদ্ধান্তে পৌঁছা অসম্ভব। কাজেই ধরে নেয়া যাক মানব-বুদ্ধি ও প্রকৃতি যেমন বিচিত্র, সত্যও তেমনি একক নয়–বহু ও বিচিত্র এবং সত্য অরূপ অর্থাৎ তার বিশিষ্ট কোনো রূপ নেই। কেননা জগৎ, জীবন, বস্তু ও অনুভূতি নিছক বাস্তব নয়, বাস্তব সম্পর্কে ব্যক্তিক ধারণার প্রসূনমাত্র। তাই কোনো দুইজনের দুনিয়া এক রকম নয়।
অতএব, যে-কেউ কিছু বলবেন বা লিখবেন তাতে তার অচেতন, অবচেতন বা সচেতন মনের বিশেষ দৃষ্টি বা মত বা আদর্শ প্রকাশ পাবে। এ হচ্ছে নিতান্ত স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি–প্রয়াস বা প্রভাবপ্রসূত নয়। মানুষের ব্যবহারিক গতিবিধিকে অর্ডিন্যান্স যোগে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব তো বটেই, সহজও। কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ত মনন-চিন্তন ধারাকে কোনো আদেশ-নির্দেশ-উপদেশের অর্ডিন্যান্স প্রয়োগে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। অর্ডিন্যান্স প্রয়োগ করলে মননধারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে কোনো বিশিষ্ট খাতে প্রবাহিত তো হবেই না, বরং বলপ্রয়োগে তা লুপ্ত বা ধ্বংস হতে বাধ্য। মানুষের মন-মননের উপর অর্ডিন্যান্স মারাত্মক অভিসন্ধি। আগের যুগেও এরূপ অর্ডিন্যান্স জারির লিপ্সা কারো কারো হয়েছিল। ফল কী হয়েছিল কারো অজানা নেই।
এ যুগে–এই জ্ঞানপ্রবুদ্ধ যুগেও নানা দেশে যেসব বিজ্ঞলোক মানুষের মনন-চিন্তনের উপর অর্ডিন্যান্স প্রয়োগে প্রয়াসী, তাঁদের বিজ্ঞতায় অশ্রদ্ধা জাগা অস্বাভাবিক নয়। কারণ আমার কাছে যা সত্য ও সুন্দর, তা-ই একমাত্র সত্য এবং একমাত্র সুন্দর, আর সব মিথ্যা ও ক্ষতিকর–এমন ধারণা যার মনে বাসা বাঁধে, তাঁর জ্ঞান-মনীষায় আস্থা বা শ্রদ্ধা রাখা কোনো সুস্থমস্তিষ্ক লোকের পক্ষেই সম্ভব নয়। অপরাপর সামাজিক ও রাষ্ট্রিক বিধানের মতো সাহিত্যেও বিধিবিধান প্রয়োগের ধৃষ্টতা দেখা দিয়েছে। কোনো আদর্শে কী বিষয়বস্তু নিয়ে কিরূপ ভাষায় কোনো ছাদে সাহিত্য সৃষ্টি করতে হবে, পূর্বাহ্নে তার permit নিতে হবে নীতিবেত্তা ও নিয়ামকদের কাছ থেকে!
যারা সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তাঁদের সৃষ্টির মূলে রয়েছে একাগ্র ধ্যান, অবিচলিত নিষ্ঠা, একান্ত বিশ্বাস এবং দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়। মনন ও প্রকাশের স্বাধীনতা জীবনের অন্যক্ষেত্রে স্বীকৃত না হলেও হয়তো তেমন ক্ষতি নেই, কিন্তু সাহিত্যক্ষেত্রে এই-ই হচ্ছে সৃষ্টির উৎসমুখ। এই স্বাধীনতা যদি না থাকে, তবে সাহিত্য-সৃষ্টি অসম্ভব। হোমার, শেকসপিয়ার, শ বা সাদী-রুমীর সৃষ্টি এক আদর্শপ্রসূত নয়; তাতে মানুষের চিন্তা রাজ্যে সংঘাত ঘটেনি বরং মনোসঞ্চরণের ক্ষেত্র বিচিত্রতর ও প্রশস্ততর হয়েছে। বিশেষ করে ব্যক্তিবিশেষের কাছে জ্ঞানরাজ্যের সীমা-পরিসীমা নেই। বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন পথে সে-জ্ঞান আহরণেই আরাম, আনন্দ এবং কল্যাণ। সে-কল্যাণ মানবসাধারণের। সাহিত্যক্ষেত্রে যারা বিধাতার আসনে বসে নির্দেশে ফরমায়েশি সাহিত্য সৃষ্টি করতে চান, তাঁরা জাতির-বৃহত্তর অর্থে মানুষের রসের ও উপলব্ধির ক্ষেত্রকে সংকীর্ণতর করে মনুষ্যসাধারণের সাংস্কৃতিক তথা মানবিক অধিকারই হরণ করছেন। লেখক-পাঠকের প্রতি এরচেয়ে বড় অবিচার, সাধারণভাবে মানুষের কাছে এরচেয়ে বড় বিপত্তি আর কিছুই নেই।
মানুষ প্রতিমুহূর্তে নিজেকে এবং জগৎকে নতুনভাবে উপলব্ধি করছে। তার সেই অপূর্ব বিচিত্র উপলব্ধির প্রকাশে জগৎ ও জীবন বৈচিত্র্যে সুন্দরতর ও বিস্তৃততর হচ্ছে। এভাবে মনোজগতে যে বিপ্লব অহরহ ঘটছে তাকে রোধ করা মানেই জীবনের অপমৃত্যু ঘটানো। জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির বিবর্তন আজকের নতুন ব্যাপার নয়। চিরকাল এমনিই হয়ে আসছে। যারা বিবর্তনকে বাধা দিয়েছে, সহজভাবে অভিনন্দিত করতে পারেনি, তারাই হতভাগ্য। কারণ পরিণামে তারাই ঠকেছে। যা আসবার তা আসবেই, যা ঘটবার তা না ঘটে যাবে না–তা বাধা যত বড়ই হোক, আর সাবধানতা যতই নিখুঁত থাক! সেজন্যেই সাহিত্যে যে-কোনো মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকাই বাঞ্ছনীয় এবং বিশেষ আবশ্যকতা ঈশ্বরবাদ হোক, অথবা ব্যক্তিবাদ, সমাজবাদ, রাষ্ট্রবাদ বা ধর্মবাদ হোক! এর মধ্যে যা রসায়ত্ত, যা সাহিত্য তা টিকে থাকবে, অন্য দশজনকে প্রভাবিতও করবে; যা নিঃসার তা যাবে–আবর্জনার মতোই লোকচক্ষুর আড়ালে ঢাকা পড়বে, তার জন্যে দুশ্চিন্তার কারণ নেই। কারো নিজের বিশ্বাস ও খেয়ালখুশিমতো বিশ্বজগৎ ও বিশ্বমানবকে কোনো বিশেষ নিয়ম-নিগড়ে বাঁধতে যাওয়া শুধু বাতুলতা নয়, অদূরদর্শিতা এবং মুখতাও বটে।
তবু যদি কারো মন বুঝ না মানে, তবে বাধা দেয়া উচিত নিজের কণ্ঠ আরো চড়িয়ে–অন্যের কণ্ঠরোধ করে নয়। আগাছা যদি নষ্ট করতে হয়, তবে নিজেকে বটগাছ হতে হবে, অন্যথায় আস্ফালন ব্যর্থ ও দুঃখবহ হতে বাধ্য।
সাহিত্যের রূপকল্পে ও রসকল্পে বিবর্তনের ধারা
বর্বরতম যুগে মানুষে আর পশুতে কোনো ভেদ ছিল না। পশুর মতো তারও সেদিন একমাত্র কাম্য ছিল ক্ষুন্নিবৃত্তি; তবু তার মন বলে পশুর থেকে উন্নততর একটি বৃত্তি ছিল; ফলে, তার শুধু পেটে ক্ষুধা নয়, মনেও ছিল পিপাসা। সেটাও ভোগে। সেদিন সে শুধু ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রয়াসী ছিল, বাস্তব ব্যবহারিক জীবনে আর কোনো ভোগ্যবস্তুর প্রত্যাশী ছিল না। সে-বোধই জাগেনি তখনো; কাজেই বঞ্চিত জীবনের হতবাঞ্ছার কোনো বিক্ষোভ ছিল না তার মনে। সেজন্যে ব্যবহারিক প্রয়েজনে কোনো চিন্তাই তাকে বিচলিত করতে পারেনি। তাই বাস্তব জীবনোপলব্ধির কোনো গরজ, জীবনকে যাচাই করবার কোনো প্রেরণাই সে বোধ করেনি সেদিন। সে তাকিয়েছিল তার চারদিককার অজানা ও রহস্যাবৃত চিরবিস্ময়কর সৃষ্টি-বৈচিত্র্যের দিকে। তা-ই তাকে করেছিল চকিত, বিস্মিত, ভীত, এস্ত ও উল্লসিত। সেজন্যেই সে–চাটাইয়ে নয়, ঘাস বা পাতায় শুয়ে স্বপ্ন দেখত পাখির মতো দূর-দূরান্তরে উড়ে যেতে; খুঁজত আকাশের কিনারা দুনিয়ার শেষ। সে কল্পনা করত, মানুষের অগম্য হিমালয়-সাহারা-অলিম্পাসে না-জানি কী আছে, কারা আছে! নিশ্চয়ই সেখানে এমন কিছু আছে, এমন কেউ থাকে, যা কাম্য, যা শ্রেয়, বা সুন্দরতর ও মহত্তর এবং আকৃতি-প্রকৃতিতে, রূপে-গুণে, বলে-ছলে যে বা যারা বিচিত্রতর।
মানুষ যা জানে না, যা বোঝে না, যা রহস্যাবৃত, যা অচেনা; তাকে জানবার, বুঝবার ও আয়ত্ত করবার এক উদ্দাম বাসনা, এক অসহ্য ব্যাকুলতা বোধ করে। মন দিয়ে, কল্পনা দিয়ে, বুদ্ধির সাহায্যে, বোধির প্রয়োগে, চিন্তার মাধ্যমে তার একটা যুক্তিসহ বা বুদ্ধিগ্রাহ্য সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা না দিয়ে সে স্বস্তি পায় না। এভাবে সে বাহ্যজগতের সবকিছুর একটি সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দিয়ে আত্মপ্রবোধ পেয়েছিল। লাভ করেছিল আত্মপ্রসাদ।
এমনি করে মানুষ সেদিন কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করেছিল। তাতে ছিল পঙ্খিরাজ ঘোড়া, বিচিত্র হাত-পা-মাথা-মুখ-চোখ-কানওয়ালা দেব-দৈত্য-পরী-জীন রাক্ষস-ড্রাগন। কল্পলোকের এসব জীবের কল্পিত রোমাঞ্চকর জীবনোপখ্যানই ছিল সেদিন মানুষের মনের রস-পিপাসা–মনের ক্ষুধা মিটাবার অবলম্বন। এ মনের প্রতিফলন দেখি রূপকথায়। রূপকথা সে যুগের জীবন্তিকা। রূপকথার জন্ম হল এভাবেই। কথায় বলে–অদারু দারু হয় শিলে পিষিলে। অকথা কথা হয় লোকে। ঘোষিলে। ফলে রূপকথাই যুগান্তরে হয়ে দাঁড়াল মানুষের অতি-শোনা প্রতিবেশী রাজ্যের সত্য কাহিনী। মাটির গড়া রক্তমাংসের মানুষের বাস্তবজীবনে প্রতিবেশীর প্রভাবের মতো সে প্রভাব পড়ল মানুষের মনে-মানসে আর ব্যবহারিক জীবনে। এসব কল্পলোকবাসী মানুষের ব্যবহারিক জীবনের গরজে কল্পিত হয় দুইরূপে-অরি ও মিত্ররূপে। দেবতারা শক্তিমান অতি-মানুষ ও মানুষের সহায়রূপে কীর্তিত; আর সব দেব-মানবের শত্রুরূপে কল্পিত। এদের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষামূলক সগ্রামে দেব-মানব পরস্পরের সহায়ক। বর্বরতম মানুষের শৈশব অতিক্রান্ত হল এভাবে। মানুষের জীবনবোধের কিছুটা প্রসার হল। হতে থাকল জ্ঞানপ্রজ্ঞা-বোধির উন্মেষ। পূর্বের কল্পনালব্ধ ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হয়ে চলল। বিকশিত বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানবমনে জেগে উঠল নতুনতর পিপাসা। জীবন পরিধি হল কিছুটা প্রসারিত। বাহুবলে বলীয়ান মানুষের মনের ক্ষেত্র হল বিস্তৃত। আবার যেখানে অজ্ঞতা সেখানেই মানুষের ভয়, সেখানে মানুষ অসহায়। তাই সৃষ্টির আদিতে মানুষ ভয় করেছে মাটির দূর্বা থেকে আকাশের নক্ষত্র অবধি সবাইকে।
জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ অর্জন করেছে আত্মবিশ্বাস, আত্মশক্তি। কল্পনা ও ভাবপ্রবণতা হয়েছে পরিমিত, কাঁচা মন হয়েছে পাকা। সে বিশেষ মানুষ। ইতরের চাইতে জীবনে তার চাহিদা বেশি, সে দেহে শক্তিমান, কৌশলে কুলীন আর মনে উচ্চাভিলাষী। শিশুমানুষের–পশুমানুষের মন এভাবে একটু একটু করে ক্রমে জেগে উঠেছে। বিস্ময়বিমূঢ় মনে, শঙ্কাকাতর মনে, কল্পনাপ্রবণ মনে, আত্মপ্রত্যয়হীন মনে, ত্রাসদলিত মনে অঙ্কুরিত হয় কামনা–সে কামনা ভোগের, আত্মপ্রসারের-পরাক্রান্ত মনের। উচ্চাভিলাষী শক্তিবিলাসী মনে সাড়া দিয়ে নড়ে উঠল অজ্ঞাতপূর্ব দুটো লোভ-জমির আর জরুর। যেমন-তেমন জমি নয়–রাজ্য, আর যে-সে কন্যা নয়–সুন্দরীতম ডানাকাটা পরী। দুটোই দুর্লভ। তাই শুরু হল অভিযান, বেধে গেল সগ্রাম, দেখা দিল পদে পদে সংঘাত। এ অভিযানে দেবতা হল মানুষের সহায়, আর দেও-জিন-রাক্ষস দাঁড়াল পথরোধ করে। মানুষের মধ্যে এ উচ্চাভিলাষী সগ্রামী দলে রয়েছে শক্তিমান ও বুদ্ধিমান রাজকুমার, মন্ত্রীপুতুর, সদাগর আর কোটাল। এভাবে কল্পলোকের সঙ্গে যুক্ত হল ইহলোক। কল্পরাজ্যে-মনোরাজ্যে ঘটল মিতালি, স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হল জৈব-কামনা। জীবন পরিব্যাপ্ত হল জীবনের লোকে। দেব-মানবে জীবনে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। এবার রূপকথা নয়, কল্পনোক নয়, আবার তাকে বাদ দিয়েও নয়। এবার প্রবুদ্ধ জীবনের জয়যাত্রা–আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার স্পৃহার মূর্তস্বরূপ। এ-যুগ রোমন্সের যুগ। সভ্যতার ইতিহাসে মহাকাব্যের যুগ।–ইলিয়াড-ওডেসী আর রামায়ণ-মহাভারতে বিধৃত রয়েছে তার স্বরূপ। এ থেকে মনুষ্যসমাজেও সৃষ্টি হল শ্রেণী–তুচ্ছ ও উচ্চ মানবশ্রেণী। উচ্চমানুষের আত্মবিকাশ ও আত্মপ্রসার দেখে সেদিন তুচ্ছ মানুষ ঈর্ষা করেনি বরং স্বাজাত্যবোধে সে উল্লসিতই হয়েছিল মানুষের জয়যাত্রায়। নির্বোধ তুচ্ছ মানুষ সেদিন আত্মভোলা হয়ে স্বজাতির প্রগতিতে আত্মপ্রসাদই লাভ করেছিল, উপভোগ করেছিল পরমানন্দ। এভাবে মনুষ্যজীবনে সার্থক হয়ে উঠল স্বপ্ন ও সত্য, কল্পনা ও মনন, মাটি ও আকাশ, আর জীবন ও জিজ্ঞাসা। বাস্তবজীবনই ব্যাপ্ত হল স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে। এ ত্রয়ীর পটভূমিকায় সংঘাতে-ঈর্ষায় বিদ্বেষে ও প্রীতি-অনুকম্পায় দেব-দৈত্য-নর রইল পরস্পরের প্রতিবেশী হয়ে।
এ যুগটি মানুষের জীবনে তথা ইতিহাসে দীর্ঘতম স্থায়ী স্তর। মনুষ্যজাতির কোনো কোনো সম্প্রদায়ে আজো এর পূর্ণ ও প্রবল জের চলছে। এক সমাজেও প্রতিবেশ ও শিক্ষাগত কারণে সব মানুষ একই স্তরে উন্নীত হতে পারে না। তাই আলো-আঁধারি, কায়া-ছায়া, কল্পনা-বাস্তব, জ্ঞান অজ্ঞান, বোধি-প্রজ্ঞা, ভাব-প্রবণতা, ভয়-ভাবনা, চেতনা-অবচেতনা, শঙ্কা-কৌতুক, বিস্ময়-জিজ্ঞাসা মিশ্রিত বহু বিচিত্র এ জীবনলীলার মোহ কোনো ছলেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না মানুষ। যতই ভাবে, যতই দেখে, ততই রহস্যের মায়াজালে আত্মসমর্পণ করে আত্মসমাহিত হতে চায়, গদগদ কণ্ঠে বিমুগ্ধ ও অতৃপ্ত চিত্তের বাণী ধ্বনিত হয়ে উঠে একটি কথায়–আহা! কিংবা একটি উচ্ছ্বসিত নিশ্বাসে। এ যুগে মানবজাতি সাংস্কৃতিক মানানুসারে নানা স্তরে বিভক্ত রয়েছে। আমরা এর সবচেয়ে প্রগতিশীল সম্প্রদায়কেই আমাদের বক্তব্যের অবলম্বন করব।
মনুষ্যের জাতীয় জীবনের তৃতীয় স্তর শুরু হয়ে গেল। এ যুগে আর রাজকুমার, মন্ত্রীপুত্র, সদাগর ও কোটালে জীবনবোধ, উচ্চাভিলাষ ও ভোগেচ্ছা সীমাবদ্ধ রইল না। রাজ-রাজড়াদের সান্নিধ্যে, দেশ-দেশান্তরের অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগে, শিক্ষার প্রসারে জনমনেও ফুটে উঠল প্রসারিত জীবনের মোহময় রূপ। জীবনবোধ হয়ে উঠল সূক্ষ্ম। এবার আর স্বর্গপাতাল নয় শুধু মর্ত, ভাবপ্রবণতা নয়–ভাবনা; পখিরাজের পিঠ নয়, আকাশের কিনারা নয়-জীবনের শারীর চাহিদা মিটাবার আগ্রহই মানুষকে কল্পনার স্বর্গলোক থেকে কঠিন মাটির সংগ্রামে নিয়োজিত করল। এবার আর আকাশ-বিহারের সাধ নয়, জমিচাষের গরজবোধই কর্মমুখর করে তুলল মানুষকে। এবার গানে-গাথায় দেও-জিন-রাক্ষসের কথা নয়, পরী-বিদ্যাধরী অপ্সরীর কামনা নয়; হতবা জীবনের বিক্ষোভ, বঞ্চিত বুকের সঞ্চিত ব্যথার আক্ষেপ, তৃপ্ত হৃদয়ের প্রশান্তি, কৃতার্থ মনের উল্লাস, বিজয়ী বীরের আস্ফালন ও দলিতজনের আর্তনাদই হল সাহিত্যের সামগ্রী। কাম আর অর্থ–এ দ্বিবিধ বর্গীয় ফল লাভেচ্ছাই গণজীবন নিয়ন্ত্রিত করছিল এ স্তরে।
এবার আর বৃহৎ বা মহৎ কোনো জিজ্ঞাসা নয়, নিতান্ত বাসনা চরিতার্থ করাই জীবনের আদর্শ ও লক্ষ্য। জীবন ও জীবিকার তফাৎ আর রইল না, জীবিকাই জীবন অর্থাৎ জীবিকা জীবন দ্বারাই জীবনের স্বরূপ অভিব্যক্তি পেতে শুরু করেছে। আগে মানুষ ছিল কম। পৃথ্বী ছিল বিপুলা, তার উপর। নিতান্ত উদরপূর্তির সামগ্রী ছাড়া অন্য সামগ্রীর প্রয়োজনবোধ তখনো জাগেনি বলে হানাহানির কারণ ছিল না আহার্য নিয়ে। কেননা, তখনো সঞ্চয়-বুদ্ধি জাগেনি, পশুপাখির মতো দিনভর খুঁজে পেতে আহার করাই ছিল কাজ। তখনো মন অবচেতন স্তর পার হয়ে আসেনি, কাজেই কৃত্রিম হয়ে ওঠেনি যৌনবোধ ও যৌন-উত্তেজনা। তবু আহার্য সংগ্রহঘটিত দ্বন্দ্ব আর যৌন-সম্ভোগ-সংক্রান্ত নিতান্ত ক্ষণস্থায়ী সংঘাত যে ঘটেনি তা নয়। তবে তা মনে পুষে রাখার মতো নয়। পশুতে, পাখিতে এসব ব্যাপার যেমন ঘটে এবং যতক্ষণ স্থায়ী হয়, এও তেমনি আর ততক্ষণ ও ততটুকু।
তারপর ক্রমে মানুষ জাগল। মানুষের জীবন-বিলাস বহু বিচিত্ররূপ ধরে বিকশিত হয়ে চলল। মানুষ বাড়ল। টান পড়ল ভোগ্যসামগ্রীতে। প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হল শুরু। লাগল কাড়াকাড়ি, মারামারি আর হানাহানি। পৃথিবী হয়ে উঠল বসবাসের প্রায় অযোগ্য। নিশ্চিত-নির্বিঘ্ন নিরুদ্বেগ জীবন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। দুর্বলের সহায়, কল্যাণ ও শান্তিকামী, করুণা-বিহ্বল মানুষ এমনি সংকটে উচ্চারণ করেন একাধারে সাবধানধ্বনি ও অভয়বাণী; তাদের একচোখের দৃষ্টিতে থাকে ধমক, আর চোখে থাকে আশ্বাসের দীপ্তি! তাঁরা দোহাই কাড়েন। বাহুবল, ধনবল, জনবল নয়, আনবল ও বাক্যবলই তাঁদের মূলধন আর দোহাই-ই তাদের অস্ত্র। আল্লাহর দোহাই ও স্বর্গ নরকের দোহাই, লাভ-ক্ষতির দোহাই, রোগ-শোক-মৃত্যুর দোহাই ও আপদ-বিপদের দোহাই কেড়ে তারা লোকমনে এমন এক ভয়-ভাবনা ও আশা-আশ্বাসের পার্থিব-অপার্থিব পরিবেশ ও সংস্কার সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে, যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে তার সত্যাসত্য নির্ণয় অসম্ভব। এ রহস্যঘন, ত্রাসদুষ্ট, সন্দেহ শঙ্কাপুষ্ট সংস্কারের বেড়াজাল ভেদ করে বের হওয়া দুঃসাহসী লোকের পক্ষেও দুঃসাধ্য হয়ে রইল। তাতেই দ্বন্দ্ব-সংঘাত পরিমিত ও লোভ-লালসা নিয়ন্ত্রিত হয়ে মনুষ্যসমাজের আবহ স্বস্তিকর হয়ে উঠেছে। এ স্তরের মনুষ্যমনের প্রতিচ্ছবি পাই এ যুগে সৃষ্ট সাহিত্যে। সে-সাহিত্য রোমাঞ্চময় ও রোমান্টিক। তাতে রয়েছে বাস্তবজীবনে পাওয়া-না-পাওয়া হৃদয়ের স্বরূপ। জীবনের সাধ-আহ্লাদ, দুঃখবেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, বঞ্চিত বুকের বিক্ষোভ, তৃপ্ত হৃদয়ের মধুর প্রসাদ ও প্রশান্তি অভিব্যক্তি পায় সাহিত্যে। তাতে অলৌকিক-অসম্ভবতা আর রইল না, থাকল জীবনে সম্ভব অথচ অসাধারণ অস্বাভাবিক পরিবেশে ও উপায়ে কামনা পূর্ণ করবার দিশা। এ সাহিত্যের সংজ্ঞা ও আদর্শের স্বরূপ এই জীবনে যে-সাধ মিটাতে পারিনি, সে-সাধ জেগেছে গানে। অথবা জীবন যাহার অতি দুর্বহ– দীনদুর্বল সবি। রসাতলে বসি গড়িছে স্বর্গ সেইজন বটে কবি। যেমন গত শতকে রচিত রোমান্সগুলো।
শুধু জীবনবোধের প্রসারেই মানুষের জৈব চাহিদা বাড়েনি, সভ্যতার দান তথা আবিস্ক্রিয়াও মানুষের প্রয়োজন বাড়িয়ে দিচ্ছে। যতই রকমারি ভোগ্যসামগ্রী বাড়ছে, ততই অসংযত হয়ে উঠছে মানুষের বাসনাও। তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি কিছুতেই হচ্ছে না। চাহিদা মিটাবার উপলক্ষে জীবিকার ধান্দাতেই ছুটোছুটি করে জীবন কাটছে চোখ তুলে চারদিকে দেখবার, ভাববার বা বিস্মিত হবার আগের মতো অবকাশই বা কোথায়! কারো যদি অবকাশ ঘটেও যায়, তবু জ্ঞানে প্রবীণ পৃথিবীর লোক জগৎ ও জীবনের, প্রকৃতি ও নিসর্গের, আকাশের আর পাতালের সব রহস্য, সব খবর এমন করে বিশ্লেষণ করে নগ্ন করে তুলে ধরেছে জনসমক্ষে যে, জগতে আর জীবনে নতুন কিছুই রইল না যা মানুষের ভয়-বিশ্বাস, ত্রাস-শঙ্কা বা আনন্দ-উল্লাস-ঔৎসুক্য জাগাতে পারে। ফলে খাও, গাও আর নাচো এ-ই হয়ে উঠেছে জীবনাদর্শ ও জীবনদর্শন। কেননা জানা গেছে, আর কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই। সব ফাঁকি, সব ভাঁওতা। যুগযুগান্তরে লালিত মানুষের পূর্বাৰ্জিত বিশ্বাস-সংস্কারের ভিত উবে গেছে চোরাবালির মতো। ধসে পড়েছে ধর্মবিশ্বাস, সমাজ-সংস্কার ও নৈতিক মূল্যমানের সৌধ। ভেঙে গেছে পারলৌকিক অস্তিত্বের স্বপ্নে গড়া আশা-আশংকার মনোময় ইমারত। কিসের ভরসায়, কার ভয়ে কোনো মহৎ ও বৃহৎ প্রেরণায় মানুষ ভোগে থাকবে বিরত, বঞ্চিত হৃদয়ে প্রবোধের শান্তি বারি ছিটোবে; আর কেমন করে দিন-রজনীর অভাবে ধৈর্য ধারণ করবে?
মহৎ ও বৃহৎ আদর্শবিহীন, জীবাত্মা-পরমাত্মারহস্য পরাখুখ, পরলোক-বিভ্রান্তিবিমুক্ত জৈব জীবন-সর্বস্ব বস্তু-নির্ভর নাস্তিক্যাদর্শবাদীরা তাই একান্তভাবে ভোগ্যবস্তু লোলুপ। তাদের ধ্যানজ্ঞান আর কর্মভোগেচ্ছা পূরণেই নিয়োজিত। তাদের বুকে বিক্ষোভ, মুখে অভিযোগ, চোখে লোভ।
গাঁয়ে কোনো শক্তিমানের গরুতে যদি গরিব চাষীর ধান খেয়ে যায় তখন সে শক্তিমানের বিরুদ্ধে অভিযোগের সাহস না পেয়ে বা প্রতিকারের উপায় না দেখে, গাঁয়ের আর দশজনের কাছেই আবেদন জানায়–আজ অমুকের গরুতে আমার ধান খেয়েছে, কাল তোমার ধান খাবে। পরশু অমুকের খাবে। অতএব, এস আমরা সবাই মিলে এর প্রতিকারের একটা ব্যবস্থা করি। আজকাল শহরে সংবাদপত্রের মাধ্যমে এমনিভাবেই সবলের বিরুদ্ধে দুর্বলেরা লড়াই করে। এরমধ্যে কোনো মহৎ প্রেরণা নেই। স্ব স্ব স্বার্থে লোক নিতান্ত সহজাতবৃত্তিবশে একজোট হয় মাত্র। একই মামলার আসামিরা যেমন আত্মনিষ্কৃতির জন্যে একমুখো চেষ্টা চালায়।
আজকাল মানুষ দুটো শ্রেণীতে বিভক্ত–ভোগী ও ভোগেচ্ছ, ধনী ও গরিব, ভোগী ধনীরা সংখ্যায় কম, কিন্তু বিত্তে বড়। ভোগেন্দুরা সংখ্যায় অগুণতি। তারা সব একজোট হয়েছে। তাদের বক্তব্য এই–পৃথিবী ও পৃথিবীর ভোগ্যসামগ্রী প্রকৃতির দান, আমরাও প্রকৃতিসৃষ্ট। কাজেই এতে সবার সমান অধিকার রয়েছে, এ কারো বা কোনো দল-বিশেষের একচেটিয়া ভোগ্য হতে পারে না। ধনী, তুমি অট্টালিকায় আছ, রাজা তুমি প্রাসাদে রয়েছ; মধ্যবিত্ত, তুমি ভবনবাসী-আমরা এত গরিব-কাঙাল যখন কুটির আর গাছতলা সার করেছি, আর সবার জন্যে যখন অট্টালিকা ও প্রসাদের ব্যবস্থা করা যাবে না, তখন তোমরাও প্রাসাদ-অট্টালিকা-ভবন থেকে নেমে এস, আমরাও গাছতলা থেকে উঠে যাই। সবার জন্যে সমবিত্ত ও সম-ভাগের ব্যবস্থা হয়ে যাক। সুখে থাকি আর দুঃখে পড়ি তাতে আর ক্ষোভ বা ঈর্ষা থাকবে না। তোমাদের ভোগ দেখে আমাদের ঈর্ষা জাগে, তোমাদের বিত্ত দেখে আমাদের মনে ক্ষোভের উদয় হয়, তোমাদের ঐশ্বর্যে আমাদের লালসা বাড়ে। ভোগেছু বিক্ষুব্ধ দলবদ্ধ বঞ্চিত জনগণ মহৎ-নামের আবরণে এ মনোবৃত্তিকেই মহিমময় করে তুলে ধরেছে। মানবতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, জীবনবাদ প্রভৃতি বুলির আবরণে ও আভরণে এমনি এক নগ্ন অসঙ্গত অথচ যৌক্তিক বাসনার দাবী পেশ করেছে। এ মনের অভিব্যক্তি যে-সাহিত্যে লাভ করেছে, তার নাম গণসাহিত্য। মানবতা, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, গণজীবনে শ্রদ্ধা ও দরদ, প্রচলিত সমাজ ধর্ম ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় অবজ্ঞা, বিত্তশালীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ এসব সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। বাস্তবে জীবনায়ণের গৌরবে মানবতার বাণী প্রচারের দম্ভে, জীবন ও জীবিকার অভিন্ন স্বরূপ উঘাটন-গর্বে, জগৎ ও জীবনের যথার্থ সূত্র আবিষ্কার ও অকৃত্রিম সংজ্ঞা প্রয়োগ-গৌরবে এ সাহিত্য আজ বিশ্বনন্দিত ও গণবন্দিত। এ সাহিত্যের মহান আদর্শ হচ্ছে-মানুষের জন্যে, জীবন-জীবিকার জন্যে, মানবতাবোধ প্রসারের জন্যে, মানবকল্যাণের জন্যে, সমাজ-উন্নয়নের জন্যেই সাহিত্য। মূলত ঈর্ষা, ভোগেচ্ছা, বঞ্চিত বুকের বিক্ষোভ ও অভিযোগ সম্বলিত এ সাহিত্যও রোমান্টিক। এ রোমান্টিকতা আকাশচারী নয়–ভূমি-নির্ভর, কল্পনাসর্বস্ব নয়-ক্লেদাক্ত কামনাপুষ্ট বাস্তব। জীবনভিত্তিক। মহিমময় বুলির আবরণে এরই জয়গানে আমরা মুখর।
মানুষের সাহিত্য মানুষের মন-মননেরই প্রতিচ্ছবি–মানুষের আন্তর্জীবনেরই বাগ-বন্ধ রূপ। এ অর্থে সাহিত্য চিরদিনই বাস্তব-জীবন ও বাস্তববোধ-ভিত্তিক। কাজেই সাহিত্য কোনোকালে। কৃত্রিম অবাস্তব অলৌকিক ছিল না। মানুষের জীবনবোধ যে-যুগে যেমনটি ছিল, সাহিত্যে তেমনটিই বিবৃত হয়েছে।
সাহিত্যের স্বরূপ
সাহিত্যের রূপ ও আদর্শ সম্বন্ধে আজকালকার লোকের প্রশ্ন ও গবেষণার অন্ত নেই। কিন্তু চিরকাল এমনটি ছিল না। পড়তে শুনতে বা ভাবতে ভালো লাগলেই আগেরকার দিনে যে-কোনো রচনাকেই নির্বিচারে সাহিত্য বলে গ্রহণ করা হত। আজকের যুগে মানুষ বড় সচেতন, অত্যন্ত হিসেবী। তারা লাভ-ক্ষতির তৌলে সবকিছুর মূল্য ও সারবত্তা যাচাই করতে চান। ফল দাঁড়িয়েছে এই যে যা-কিছু মানুষের ব্যবহারিক জীবনে অপ্রয়োজনীয় বোধ হয়, তা-ই সাহিত্য থেকে নির্বাসিত করাই বিধেয় বলে ফতোয়া জারি হচ্ছে। মনোজীবন বলে ব্যবহারিক জীবন-নিরপেক্ষ কোনো জীবনের অস্তিত্ব স্বীকার করা তাদের যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানমুখী মন ও মননে অসম্ভব হয়ে উঠেছে। তার কারণও রয়েছে যথেষ্ট। আজকের দিনে ব্যবহারিক জীবন-সমস্যা এমন উকটভাবে দেখা দিয়েছে যে নিতান্ত বেঁচে থাকার সাধনা অন্য সর্বপ্রকার জৈব-সাধনাকে ছাপিয়ে উঠেছে। বৈজ্ঞানিক আবিস্ক্রিয়া, কলকারখানার স্থাপন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এবং যন্ত্রশক্তির বদৌলত বিশাল পৃথিবীর বিশালতা ও বৈচিত্র্য ঘুচে গিয়ে পৃথিবী হয়ে গিয়েছে ক্ষুদ্র ও একাকার। জীবন ধারণের প্রয়োজনানুরূপ সামগ্রীর অভাবে পারস্পরিক হানাহানি কাড়াকাড়ি লেগেই আছে। মূলত সবদেশের সবলোকের সংগ্রামের রূপ একই–তা হচ্ছে জীবন-সংগ্রাম, বেঁচে থাকবার আকুল আগ্রহে-ই তাঁদের চিত্ত হয়ে উঠছে বিদ্বিষ্ট ও হিংস্র। এই সমস্যা-বিমূঢ় সমাধান-কাতর জগতে তাই জাগতিক ও জৈবিক সর্বব্যাপারে সৃষ্টি হয়েছে নানা মত ও পথ। এমনি অবস্থায় কারো দৃষ্টি স্বচ্ছ থাকার কথা নয়। নির্লিপ্ত আর অনাচ্ছন্ন। বিবেক ও চিন্তাপ্রসূত নয় বলেই বিভিন্ন মত ও পথগুলো দেখা দিয়েছে পরস্পরের মারাত্মক। প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে। স্বার্থপ্রসূত এই বিভিন্ন আদর্শগুলোর সমন্বয় সাধন তাই একরূপ অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না।
সাহিত্যেও তাই প্রধানত দুটো আপোষহীন নীতি ও আদর্শের সংঘাত দেখা দিয়েছে। একটা হচ্ছে বাস্তবতা, অপরটা কল্পনা সর্বস্বতা; একটা প্রয়োজনানুগ অপরটা রসবিলাস, একটা গণসাহিত্য অপরটা বুর্জোয়া সাহিত্য; একটি প্রগতিকামী অপরটি রস-লীলাপরায়ণ; একটা ধর্ম ও স্থানীয় বা জাতীয় সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও প্রচারক অপরটা নৈর্ব্যক্তিক সংস্কৃতির ধূরক।
আমরা এই আলোচনার বিষয়টা খোলাসা করে বুঝে নেবার চেষ্টা করব মাত্র কোনো সমাধান পাবার আশা না রেখেই।
প্রথমত, সাহিত্য হচ্ছে অনুভূতির অভিব্যক্তি মাত্র। তা কাব্য হোক, নাটক হোক বা প্রবন্ধ হোক। অনভূতিসঞ্জাত যে-ভাব আমাদের মনে ও মাথায় (তথা হৃদয়ে) আলোড়ন জাগায়, তা-ই বাণীরূপ লাভ করে হয় সাহিত্য। অবশ্য আমাদের সবকথার মূলে ভাব থাকে এবং তার পশ্চাতে থাকে অনুভূতি অর্থাৎ সব প্রকারের ভাবের মূলে থাকে Cognition, Volition ও emotion বা feeling. তথাপি সব বাণীই আমরা যথাযথ সচেতনতা ও যত্নের সাথে প্রকাশ করিনে। সুতরাং যা-কিছু সযত্নে ও স্বচৈতন্যে প্রকাশ করি তা-ই আমাদের সাহিত্য। কারণ তখন আমাদের বাণী অন্য হৃদয়ে সঞ্চারিত হবার যোগ্যতাসম্পন্ন হয় অর্থাৎ তা বিশেষ অর্থে রসাত্মক হয়ে ওঠে। যত্ন ও প্রয়াসের সাথে শক্তি যোগ না হলে তা অপর হৃদয়ে অনুরূপ ভাব বা অনুভূতি সঞ্চারের সামর্থ্য পায় না, তাই সব রচনা সর্বজনগ্রাহ্য সাহিত্য হয় না। এখানে এ-কথা স্বীকার করা ভালো যে সব রচনাই পাঠকের উদ্দেশ্যে রচিত হয়।
দ্বিতীয়ত, অনুভূতি মাত্রেই ভাবের সত্য অর্থাৎ বিশেষ মনের বিশেষ অবস্থার সত্য। সে-সত্যের সাথে বহির্জীবনের সত্যের সামঞ্জস্য থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। যেমন আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, প্রাণ-সখা বন্ধু-হে আমার অথবা পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন জেগে ওঠে। এসব হচ্ছে অনুভূতিজাত ভাবের সত্য–বাস্তবের সত্য নয়। তেমনি শরৎচন্দ্রের মহেশ বা রবীন্দ্রনাথের পোস্টমাস্টার গল্পদ্বয়ে বর্ণিত অবস্থাও ভাবের সত্য। বাস্তবে কত গফুর, কত রতনকার খবর কে রাখে? কিন্তু লেখকের হৃদে-মনে-মাথায় এমনি অবস্থার অনুভূতি যে-ভাব-আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল, তা-ই প্রকাশিত হয়েছে রচনায় এবং সে-রচনা সযত্নে ও স্বচৈতন্যে সম্ভব হয়েছে। শুধু বাস্তব নয়, শুধু কল্পনাও নয়; বাস্তবে-অবাস্তবে, সম্ভব-অসম্ভবে, জ্ঞান প্রজ্ঞা, বুদ্ধি-বোধি সমন্বয়ে সম্ভব হয়েছে এ সৃষ্টি। দার্শনিক তত্ত্বগুলো যেমন বাস্তব-নির্ভর হয়েও বাস্তব নয়–অনুভূতি ও প্রজ্ঞার সত্য; সাহিত্যও তেমনি অনুভূতি-উপলব্ধির সত্য, বাস্তব থেকে পাওয়া কিন্তু বাস্তব-সত্য নয়।
অতএব অনুভূতি বাস্তবাহৃত, বাস্তব-নির্ভর ও বাস্তবানুগ হয়েও তা বাস্তবাতিরিক্ত এবং কল্পনা নির্ভর হয়েও কল্পনা-সর্বস্ব নয়। মূলত তা জীবন-চেতনা-প্রসূত–প্রত্যক্ষভাবে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রচেতনা জাত নয়। কারণ, তা অনুভূতির জারক রসে রসায়িত হয়েই অভিব্যক্তি লাভ করে, তার আগে নয়।
তৃতীয়ত, মানুষের মন স্বভাবত ভাবগ্রাহী, বৃহত্তর অর্থে মানবজীবন ভাবসর্বস্ব। মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, লাভ-ক্ষতি–সবকিছুই অনুভূতি মাত্র। অনুভব করি তো কোনো ঘটনা পর্বত প্রমাণ মনে হবে, আর অনুভব না করি তো তৃণবৎ তুচ্ছই থেকে যাবে। যেমন, শিশুটি উঠানে একপাত্র প্রয়োজনীয় পানি ফেলে দিলে আমার কোনো ক্ষয়-ক্ষতি নেই, তাই আমি নির্বিকার; কিন্তু যদি একপাত্র সদ্যকেনা দুধ ফেলে দেয় তখন? একটি বাঘ নিহত হলে মানুষ খুশি হয়, একজন মানুষের অপমৃত্যু হলে তখন? তখন যে-দুঃখ যে-ক্ষোভ আমি অনুভব করছি তা তো স্বতঃস্ফূর্ত নয়, তা হচ্ছে বিবেচনাপ্রসূত। মানুষের মনন ও অভিজ্ঞতার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই অনুভূতির জীবন বিস্তৃত হয়েছে। তাই বলে কোনো অনুভূতি বাহ্যবস্তু-নিরপেক্ষ নয়, বস্তুত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ থেকেই সব অনুভূতি আসে। কারণ যা স্কুল বা সূক্ষ্ম ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার কল্পনাও সম্ভব নয়।
সুতরাং মানুষের সব কর্ম-চিন্তা ও কামনা-বাসনার মধ্যে জীবন-চৈতন্য রয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করে বললে কথাটা এই দাঁড়ায় : চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক দ্বারা আমরা যথাক্রমে রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ লাভ করি। এর ফলে আমাদের মনে কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, প্রেম, স্নেহ, ভালোবাসা, আনন্দ, বেদনা, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি হরেক রকম বোধ জন্মে। বস্তুত এইসব বোধ বা ভাব কিন্তু অনুভূতি বা ভাবরাশির সঙ্গে আমাদের জীবন-চৈতন্যের কোনো মূলগত পার্থক্য নেই। অন্য কথায় জীবন-চৈতন্য মানে দাঁড়ায় বাহ্যপরিবেশের সঙ্গে মনের গভীরতর যোগ চৈতন্য। এই ব্যাখা যদি মেনে নিই, তবে আমরা দেখতে পাই জীবনচৈতন্য ও সমাজচৈতন্য বলে আলাদা কিছুই নেই। ব্যবহারিক জীবনের অভাব-অভিযোগ, বাধাবিঘ্ন মানসলোকে অর্থাৎ আমাদের অনুভূতির জগতে কিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তার বিশিষ্ট রূপ যদি সাহিত্যে বিধৃত না হয়, তবে তা রসগ্রাহী তথা ভাবসর্বস্ব মনে ভাব বা অনুভূতি সঞ্চার করতে সমর্থ হবে না; এক কথায় বহিরোখিত ঘটনার সংঘাতে আমাদের বৃত্তি-প্রবৃত্তির প্রক্রিয়া কী বিচিত্র রূপ ধারণ করে, তা কার্যকারণপরম্পরায় চিত্রিত না হলে, সব সৃষ্টি-প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হতে বাধ্য।
এই ব্যাখ্যার আলোকে যাচাই করলে আমরা দেখতে পাই সাহিত্যে বাস্তব-অবাস্তব, প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় বা গণ-বুর্জোয়া বলে কোনো বিশিষ্ট ধারা নেই। তবে বস্তুভেদে অনুভূতিভেদ আছে। তা হচ্ছে নিতান্ত স্তরভেদ সুতরাং রূপগত নয় রসগত। শাকের স্বাদ মাছে নেই, আবার মাছের স্বাদ মাংসে অসম্ভব। তাই বলে শাক ও মাছে স্বাদ আছে, মাংসে নেই; অথবা মাছে বা মাংসে স্বাদ আছে, শাকে নেই–এমন কথা কোনোক্রমেই বলা চলে না। প্রত্যেকটাই বিশিষ্টরূপে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবু এদের মধ্যে স্তরভেদ আছে। তেমনি সাহিত্যেও বিষয়বস্তু অনুসারে স্তরভেদ আছে। আমি দেশী সাহিত্য থেকেই কয়েকটি উদাহরণ নিচ্ছি। যেমন জসীমউদ্দীনের কাব্যে রস আছে, তা পাঠকচিত্ত আকৃষ্ট করে। তাই বলে রবীন্দ্রনাথের বলাকার সঙ্গে তার তুলনা চলে না। তেমনি নজরুলের সাম্যবাদী আমাদের ভালো লাগে, কিন্তু এর সঙ্গে নক্সীকাঁথার মাঠের কোনো বিষয়গত ও ভাবগত ঐক্য নেই। তবু আমরা এই তিন প্রকারের কাব্যকেই স্বীকার করে নিয়েছি এবং এই তিন প্রকার রচনায় তিনটি স্তরও স্বীকার করেছি, কিন্তু রসহীন বলিনি। রসের তারতম্য দিয়ে উৎকর্ষ–অপকর্ষ বিচার চলে, কিন্তু অন্য নামে সাহিত্যকে বিচ্ছিন্ন করে চিহ্নিত করা চলে না।
আগেই বলেছি সৃষ্টি মাত্রেই কল্পনাধর্মী। কুলি-মজুরের কথাই লিখি, বা রাজপুত্র-রাক্ষসের গল্পই বলি, বসন্তের জয়গানই করি বা বর্ষার চিত্ৰই আঁকি–সবকিছুই মূলত অনুভূতিজাত ভাবেরই অভিব্যক্তি; বাস্তবের প্রতিকৃতি নয়। তবে অনুকৃতি বটে; তা রাক্ষসের গল্পও বাস্তবের অনুকৃতি বই তো নয়; কারণ পূর্বেই বলেছি-ইন্দ্রিয় বহির্ভূত কল্পনা অসম্ভব। এই অর্থে সাহিত্যে বাস্তবতা বলে কিছুই নেই এবং এই অর্থেই সাহিত্য মাত্রেই কল্পনা বা ভাব বা অনুভূতি আশ্রয়ী। এই কল্পনা, ভাব বা অনুভূতির বৈচিত্র্যানুসারে সাহিত্যে রসবৈচিত্র্য ঘটে। এই বৈচিত্র্য আসে স্রষ্টার জ্ঞান-প্রজ্ঞা, বোধ-বুদ্ধি, রুচি-প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির পার্থক্য থেকে। একই পরিবেশ বা প্রকৃতি থেকেও বিভিন্ন। মনোভঙ্গি গড়ে উঠতে পারে। তাই মন ও মননের পার্থক্যবশত সাহিত্যেও রসবৈচিত্র ঘটে, আদর্শ বৈচিত্র্যও এর আনুষঙ্গিক ফল। সুতরাং সৃষ্টি পরিকল্পনায় কোনো সচেতন প্রয়াস বিশেষ কার্যকর হয় না–মগ্নচৈতন্যের উপলব্ধি–যা অন্য অর্থে লেখকের জীবন-বোধ বা জীবন-চৈতন্য তা-ই রচনায় ব্যক্ত হয়ে পড়ে। অতএব গণসাহিত্য বা বুর্জোয়া সাহিত্য বলে আসলে কিছুই নেই। লেখক বিশেষের স্বকীয় মনোভঙ্গিরই অর্থাৎ রুচি-সংস্কারের রূপ-বৈচিত্র্য বিশেষ। লেখকের কলমের ডগায় যে বিশেষ সামাজিক ও রাষ্ট্রিক মত, পথ বা ধর্মীয় আদর্শ প্রকাশিত হয়, তা নিতান্ত আকস্মিক নয়। আকস্মিক নয় এইজন্যে যে, সেটা লেখকের উপরি পাওয়া জিনিস নয়–মর্মমূল নিঃসৃত সত্য বিশেষ। তথাপি তা সর্বজনগ্রাহ্য নাও হতে পারে, কারণ লেখক ও পাঠক নির্বিশেষের শিক্ষা, রুচি, সংস্কার ও পরিবেশ এক রকমের হয় না। যেমন আবর্জনা দেখলে আমাদের গা ঘিনঘিন করে, কিন্তু একজন মেথরের তেমন হয় না। একজন মুসলিম তরুণীর কাছে বৈধব্য তেমন বড় সমস্যা নয়, কিন্তু হিন্দু তরুণীর বৈধব্য মানে নিজেরও অপমৃত্যু। অতএব উপরোক্ত অবস্থায় উদ্ভূত দুই অনুভূতিতে রসবৈচিত্র্য অবশ্যম্ভাবী।
তারপর কোনো সাহিত্য বা অনুভূতি সর্বজনগ্রাহ্য হতে হলে তা জীবনের তথা হৃদয়ের গভীরতর বৃত্তি-প্রবৃত্তির সাথে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন অর্থাৎ তা দেশ, কাল ও পাত্রের ছাপবিহীন একটি সর্বজনীন রূপ লাভ করবে। যতক্ষণ তা সম্ভব না হচ্ছে, ততক্ষণ তা দেশ-কালের গণ্ডীর মধ্যেই থাকবে আবদ্ধ। যেমন পানি বলতে জগতে যেখানে যত পানি আছে সবগুলোকে বুঝায়। কিন্তু তবু ডোবর পানি, নদীর পানি, দীঘির পানি, পুষ্কণীর পানি বা সমুদ্রের পানি এক নয়। এদের কারো সব-পানির প্রতিনিধিত্ব করবার যোগ্যতা নেই, কারণ এগুলো আধারের ছাপ-মুক্ত নয়! কিন্তু distilled water-এর সঙ্গে সব পানির ঐক্য আছে। অর্থাৎ ঐ পানি নির্বিশেষ পানির প্রতিনিধিত্ব করবার যোগ্যতাসম্পন্ন–কারণ তা বিশেষ আধারের ছাপমুক্ত। সাহিত্য সম্পর্কেও এই নিয়ম। দেশ-কাল জাতি ও ধর্মের ছাপমুক্ত সর্বজনীন অনুভূতি বা ভাব যে-সাহিত্যে প্রকাশ পাবে তা হবে চির-মানবের সাহিত্য। অন্য প্রকারের সাহিত্য হবে বিশেষ দেশের, জাতির, কালের বা ধর্মসম্প্রদায়ের। আধুনিক সাহিত্যে Yeats, রবীন্দ্রনাথ, T.S. Elliot ও ইকবাল–এই চারজনই অধ্যাত্মবাদী। কিন্তু Yeats ও রবীন্দ্রনাথের অধ্যাত্মবাদ জীবন-রহস্য উদঘাটনের প্রয়াসপ্রসূত। পক্ষান্তরে T.S. Elliot ও ইকবালের সাহিত্য বিশিষ্ট আদর্শের ছাপযুক্ত সেজন্যে তা নির্বিশেষ পাঠকের গ্রাহ্য নয়। সুতরাং T.S. Elliot ও ইকবাল বিশেষ দেশ-কাল ও জাতি-ধর্মের কবি ও শিক্ষক; আর Yeats ও রবীন্দ্রনাথ দেশ-জাত নিরপেক্ষ আস্তিক মানুষের কবি।
তারপর আসে প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের কথা। এক হিসেবে সাহিত্য-মাত্রেই অপ্রয়োজনীয় এবং অবান্তর। কারণ সাহিত্য হচ্ছে মূলত মানুষের ভাবলব্ধ সত্য-অনুভূতি ব্যতিরেকে বাস্তবে তার প্রতিচ্ছবি পাওয়া অসম্ভব এবং সাহিত্য কোনো বাস্তব-প্রয়োজন প্রত্যক্ষভাবে সিদ্ধ করে না। আর এক হিসেবে সাহিত্য–মনুষ্য জীবনে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। যে-প্রেরণায়, যে-অব্যক্ত-প্রয়োজনে সাহিত্য সৃষ্টি হয়, সে-প্রয়োজন পরিহার করে চলা মানুষের পক্ষে তেমনি অসম্ভব। আমরা যে হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন, কালিদাস, ভবভূতি, ব্যাস, বাল্মীকি, ফেরদৌসী-রুমী-জামীকে স্মরণে রেখেছি, তাঁদের রচনা পড়ে চলেছি–তা-ই আমাদের প্রয়োজনের যথেষ্ট প্রমাণ নয় কী? পক্ষান্তরে অগ্নি যিনি আবিষ্কার করলেন, কয়লা যিনি যোগালেন, রেডিও-টেলিগ্রাফ-টেলিফোন টেলিভিশন যারা দান করলেন তাঁদের কেন আমরা স্মরণে রাখার গরজ বোধ করিনে! এতেই প্রমাণিত হয় এসবের ব্যবহারিক প্রয়োজন যেমনই হোক, তার সঙ্গে আমাদের অন্তর্জীবনের সম্পর্ক অকিঞ্চিৎকর; পক্ষান্তরে অন্তৰ্জীবন তথা আমাদের অনুভূতির জীবন যতই অবাস্তব মনে হোক, তা ই আমাদের জীবনসর্বস্ব। তবু তা শিল্প মাত্র! অন্য দশ শিল্পকর্মের মতো এ-ও আমাদের প্রয়াসপ্রসূত সুতরাং স্বতঃস্ফূর্ত নয়। সাহিত্যে বাস্তবতা ও কল্পরসবিলাস সম্বন্ধেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। কোনো বিষয়বস্তুই সাহিত্যে নিরর্থক নয়, কারণ যে-কোনো ব্যাপারে মানুষের অন্তর্নিহিত বৃত্তি-প্রবৃত্তির স্ফুরণ হয়। হৃদয়-সংযুক্ত বহির্জীবনের সমস্যার সমাধান-চিত্র যেমন মানুষকে জীবন পথে প্রেরণা দান করে, তেমনি রাক্ষস-রাজপুত্রের কাহিনীতেও মানুষের বৃত্তি-প্রবৃত্তি রূপায়িত হয়দুটোরই প্রয়োজন আছে। ফলত বুর্জোয়া ও গণসাহিত্য বলে সাহিত্যকে দ্বিধা- বিভক্ত করা নিরর্থক। কারণ আমরা বলেছি, মূলত মানুষের জীবন ভাবসর্বস্ব বা অনুভূতি-সমষ্টি মাত্র। কাজেই অনুভূতির জগতে স্ব স্ব স্বাভাবিক প্রবণতানুসারেই সাহিত্য সৃষ্টি হয় এবং মনোভঙ্গির পার্থক্যবশতই আমরা সাহিত্যের বিষয়বস্তুতে ও রসে প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় এবং বাস্তব ও অবাস্তবের সীমারেখা টানতে প্রয়াসী হই। আমাদের সাহিত্য সম্বন্ধে ধারণা ও মতগত অনৈক্যের মূলও এখানে। সাহিত্যে রস-সর্বস্বতা, জীবন-সর্বস্বতা, সমাজ-সর্বস্বতা, রাষ্ট্র-সর্বস্বতা বা প্রয়োজন-সর্বস্বতা বলে কিছুই নেই–যা আছে তা অনুভূতি ও উপলব্ধির সর্বস্বতা। এর প্রকারভেদেই আদর্শ, নীতি, রস ও বিষয় ভেদ ঘটে।
এ পর্যন্ত আমরা যা বলেছি, তা সংক্ষেপে এই-সাহিত্য হচ্ছে ভাবের অভিব্যক্তি মাত্র! সাহিত্যে রসভেদ আছে কিন্তু রূপভেদ নেই! কারণ মানুষের জীবন হচ্ছে অনুভূতির সমষ্টিমাত্র অর্থাৎ ভাবসর্বস্ব সুতরাং সাহিত্যে প্রয়োজন-অপ্রয়োজন, বাস্তব-অবাস্তব, গণ-বুর্জোয়া বলে কোনো সীমারেখা টেনে দেওয়া নিরর্থক। তারপর বলেছি, মানুষের মানস-সংস্কৃতি যখন দেশ, কাল, ধর্ম ও জাতীয়তার ছাপ মুক্ত হয়; তখন সাহিত্যে যে-অনুভূতি বিধৃত হয়, তা হয় সর্বকালের, দেশের ও চিরমানবের সম্পদ। অতএব সাহিত্যে একমাত্র কাম্যবস্তু হচ্ছে বহির্ঘটনার সঙ্গে হৃদয়ের গভীরতর সংযোগ সন্ধান। বাস্তবের ঘটনা সংঘাতে মনে দুঃখ-বেদনা, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দ-উল্লাসের যে-আবেগ সৃষ্টি হয়, তা যতক্ষণ যথার্থরূপে বাণী লাভ না করবে, ততক্ষণ তা মনান্তরে বা হৃদয়ান্তরে সহানুভূতি সঞ্চারে সমর্থ হবে না। এইজন্যে সৃষ্টিমাত্রই নিরর্থক–সাথে হৃদয় নহিলে। অনুভূতি বা ভাবের যথার্থ প্রকাশ মানেই হৃদয়ের বৃত্তি-প্রবৃত্তির বাণী-চিত্র দান করা। এক কথায়, বাহ্যবস্তু বা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জীবনের অন্তর্নিহিত রূপ সাহিত্যে বিধৃত হওয়া চাই। একমাত্র এরই নাম সাহিত্য।