আমাদের সাহিত্যের প্রাচীন উপাদান
মানুষের জীবন-জীবিকা স্থান-কাল নিরপেক্ষ নয়। তাই মানুষের চলনে, বলনে ও আচরণে স্থানি। ও কালিক প্রভাব থাকে অনেকখানি। এজন্যেই স্থান ও কালভেদে মানুষের ভাব-ভাবনায় এবং জীবন-জীবিকায় দেখা যায় বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য, এই বিচিত্রতা ও বিশিষ্টতাই এক এক স্থানিক গোত্রের বা জাতির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। টুকরো টুকরো তুলো দিয়ে যেমন তৈরি হয় অবিচ্ছিন্ন সূতো, তেমনি ব্যষ্টির খণ্ড-ক্ষুদ্র-চিন্তা ও কৃতির সমবায়ে গড়ে উঠে জাতীয় ঐতিহ্য। Politics পুরোনো হলে হয় ইতিহাস আর পুরোনো সংস্কৃতির নাম ঐতিহ্য। এরই সর্বাত্মক সাধারণ অভিধা সভ্যতা।
ঐতিহ্য জাতীয় জীবনে প্রেরণার উৎস ও সংস্কৃতির নবনব বিকাশের ভিত্তি। শিকড় দিয়ে মাটির রস, আর পাতা দিয়ে আলো বাতাসের উপাদান গ্রহণ করে যেমন বেড়ে ওঠে গাছ, জাতিও তেমনি ঐতিহ্য থেকে প্রাণরস এবং সমকালীন পরিবেশ থেকে মানস- সম্পদ আহরণ করে প্রয়াসী হয় আত্মবিকাশে, নতুন পাতার উদ্গমে ঝরে পড়ে পুরোনো পাতা, নতুন চিন্তার উন্মেষে অবহেলিত হয় পুরোনো চিন্তা। পুরোনো অকেজো হল বটে, কিন্তু তাই বলে অসার্থক নয়, কেননা তা নতুনে উত্তরণের সোপান। তার কালে সেও ছিল আজকের সংস্কৃতির মতো জীবন-প্রচেষ্টার সম্বল ও বাহন। বহতা নদীর স্রোত যেমন নিজে এগিয়ে যায় আর টেনে আনে পেছনের পানি, ঐতিহ্যও তেমনি নিজের কোলে জন্ম দেয় নতুনের। পাকানো রশিতে কিংবা বহতা নদীতে আর ঐতিহ্য- পরস্পরায় তফাৎ নেই কিছুই।
চলমান জীবনে আর উত্তরাধিকারের মতো সাহিত্যের উত্তরাধিকারও বিশেষ মূল্যবান সম্পদ। ঐতিহ্যের স্বরূপ স্পষ্টভাবে বিধৃত থাকে সাহিত্যে। তাই জাতীয় জীবনে সাহিত্যিক ঐতিহ্যের প্রভাব অসামান্য। গ্রীকদের উপর হোমারের ইলিয়াড-ওডেসির প্রভাব, ইরানিদের জীবনে শাহনামার গুরুত্ব আর পাক-ভারতের হিন্দুর আচারিক ও মনো-জীবনে রামায়ণ-মহাভারতের প্রেরণা অপরিমেয়।
হোমারের রচনা অবলম্বন করে য়ুরোপে, শাহনামা সম্বল করে মুসলিম জগতে এবং রামায়ণ মহাভারত ভিত্তি করে হিন্দু-ভারতে বিচিত্র রস ও রূপে গড়ে উঠেছে বিপুল আধুনিক সাহিত্য।
পুরোনো কিস্সায় নতুন আঙ্গিক ও অভিধা আরোপিত হলে সে কিস্সার জলুস কত বাড়ে এবং কেমন রসস্ফূর্তি ঘটে তার দৃষ্টান্ত মিলবে মিল্টনের Paradise Lost-এ, টেনিসনের Ulysses-এ, শেলীর Prometheus Unbound-এ আর ম্যাথু আরনডের Sohrab and Rostum-এ। আমাদের দেশে পৌরাণিক উপাখ্যান নিয়ে রচিত কালিদাসের শকুন্তলা নাটক, কুমারসম্ভব কাব্য, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীরামদাসের মহাভারত, মধুসূদনের মেঘনাদবধ, বীরাঙ্গনা, হেমচন্দ্রের বৃত্রসংহার, নবীন সেনের ত্রয়ী, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা, শ্যামা, গান্ধারীর আবেদন, কর্ণ-কুন্তীসংবাদ, বিদায় অভিশাপ প্রভৃতি বহু রচনা এর প্রমাণ। সাধারণভাবে বলতে গেলে উনিশ শতকের হিন্দু রচিত আধুনিক বাঙলা কাব্যের বারো আনা উপাদানই রামায়ণ মহাভারত থেকে নেয়া। আর বাঙলা সাহিত্যের উপমাদি অলঙ্কারের চৌদ্দ-আনা মহাভারতের কাহিনী থেকে পাওয়া।
এদেশে মুসলমানেরাও নিষ্ক্রিয় ছিলেন না এ ব্যাপারে। তারাও আমাদের মধ্যযুগীয়-সাহিত্যের উপাদান সগ্রহ করেছেন পুরোনো সাহিত্য থেকেই। ফারসি ও হিন্দুস্তানী প্রণয়োপখ্যানগুলো কায়িক, ছায়িক ও ভাবিক অনুসরণ যেমন করেছেন, তেমনি রচনা করেছেন ইসলামের উন্মেষ যুগের হযরত আলী, আমির হামজা, হানিফা প্রভৃতির বীরত্বের উপকথা নিয়ে জঙ্গনামাগুলো। আলেফলায়লা ও শাহনামার নানা কাহিনীও হয়েছে আমাদের পুথি-সাহিত্যের অবলম্বন। এসব উপাদানে গড়ে উঠেছিল আমাদের বিপুল সাহিত্য।
এ যুগেও আরবি-ইরানি-উর্দু সাহিত্য এবং আমাদের পুথি অবলম্বনে আধুনিক ভাব-চিন্তার অনুগ সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন ও করছেন কোনো কোনো কবি। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদসিন্ধু, কায়কোবাদের মহরম শরীফ, ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মহাশিক্ষা কাব্য, হামিদ আলীর কাসেমবধ ও জয়নাল উদ্ধার প্রভৃতি কারবালা যুদ্ধভিত্তিক রচনা। সৈয়দ আলী আহসানের অসম্পূর্ণ চাহার দরবেশ, ফররুখ আহমদের নৌফল ও হাতেম, শাহরিয়ার, হাতেমতায়ী, আব্দুর রশিদ ওয়াসেকপুরীর আমীর সওদাগর, আজিমুদ্দিনের মহুয়া প্রভৃতি পুরোনো সাহিত্যেরই আধুনিক রূপায়ণ।
এ কয়জনের গুটিকতক রচনাতেই উজার হয়ে যায়নি সে বিপুল ভাণ্ডার। বলতে গেলে আজো অনাবিষ্কৃতই রয়ে গেছে এর উৎকৃষ্ট সম্পদ। এ কাজে যে শ্রদ্ধা, শ্রম ও সংবেদনশীল মনের প্রয়োজন, তা আমাদের মধ্যে আজো বিরল। অথচ পুরোনো সাহিত্যিক-ঐতিহ্যের সুপ্রয়োগেই সমৃদ্ধ হয় নতুন সাহিত্য ও সুপ্রকট হয় মনন। এজন্যে পুরোনো সাহিত্যের উপাদানই হয়েছে চিরকাল উৎকৃষ্ট কাব্যের অবলম্বন। ঐতিহ্য সচেতনতার ও পুরোনো সাহিত্যের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব আমদের আজকের সাহিত্যের অপূর্ণতা ও দীনতার অন্যতম কারণ। আমাদের মধ্যযুগীয় সাহিত্যের পঠন-পাঠন শিক্ষিত সাধারণ্যে নিতান্ত কম। অথচ এর বহুল চর্চা না হলে একে বুনিয়াদ করে সাহিত্যসৃষ্টির চর্যাগ্রহণ করা সম্ভব নয় কিছুতেই। আমাদের পুথি-সাহিত্যের আধুনিক রূপায়ণের সম্ভাব্যতার একটু আভাস দিয়েই আজকের আলোচনা শেষ করতে চাই। এর সম্ভাবনা যেমন বিপুল, যারা এ পথে এগিয়ে আসবেন তাদের কৃতির ভবিষ্যৎও তেমনি উজ্জ্বল।