অনুযোগটা মিথ্যে নয়। শুয়ে পড়লে ঘুমুতে তার দু মিনিটও লাগে না। তৎক্ষণাৎ উঠে বসে সুখেন্দু নিরীহ মুখে ঘোষণা করেছে, আজ আর বিছানায় গা ঠেকাবো না ভেবেছি।
ছুটির দিনে অর্চনার বাবা মা বরুণা সকলেরই নিয়মিত প্রত্যাশা, ওরা আসবে। কিন্তু প্রথম কটা দিন সে-সময়ও হয়নি ওদের। মা মনে মনে অসন্তুষ্ট হন জেনেও অর্চনা নিরুপায়। ছুটির দিন এলেই দেখা যায়, সুখেন্দু আগে থাকতেই কোথাও না কোথাও প্রোগ্রাম করে বসে আছে। সিনেমা থিয়েটার নয়, দশ-বিশ মাইল দূরে কোথাও বেরিয়ে পড়ার প্রোগ্রাম। আর সত্যি কথা, তখনকার সেই আনন্দের মধ্যে অর্চনারও বাড়ির কথা বা মায়ের কথা মনে থাকত না। এমন কি, সেদিন ডায়মন্ড হারবার থেকে ঘুরে আসার পর মনের আনন্দে মায়ের ঘরোয়া চায়ের আমন্ত্রণে যেতে না-পারার খেদও ভুলতে সময় লাগেনি। অর্চনা যাবে কথা দিয়েছিল, আর মিসেস বাসু তো ওর আসতে না পারার কথা ভাবতেও পারেন না। আগেও দুই-একবার আসবে বলে আসেনি। এটা তার থেকে একটু স্বতন্ত্র ব্যাপার। আরো দু-চারজন ভদ্রলোক ভদ্রমহিলার আসার কথা। কিন্তু দেখা গেল ওকে হঠাৎ খুশী করার জন্য সুখেন্দু আগে থাকতেই ডায়মণ্ড হারবার যাবার ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছে। অর্চনার ভিতরটা খুঁতখুঁত করছিল, মা অসন্তুষ্ট হবেন। কিন্তু সুখেন্দু আমলই দেয়নি।
সেখানে গিয়ে পড়ার পর অর্চনা নিজেই সব ভুলেছিল। সূর্যাস্তের পর ছোট একটা নৌকো ভাড়া করেছিল দুজনে। মাঝির কাছ থেকে নৌকোর হাল ধরতে গিয়ে সুখেন্দু নৌকো ঘুরপাক খাইয়েছে। অর্চনা ঠাট্টা করেছে, টিপ্পনী কেটেছে। হাল আর বৈঠা নিয়ে খানিক দাপাদাপি করে সুখেন্দু ঠাণ্ডা হয়ে বসেছে। বিকালের সূর্যাস্তের শেষ রঙে গোটা নদীটাই যেন অদ্ভুত রাঙানো। চলন্ত নৌকোয় সুখেন্দু একটা হাত জলে ডুবিয়ে বসে ছিল, আর জলের বুকে লম্বা একটা দাগ পড়ছে তাই দেখছিল।
সামনে থেকে কৃত্রিম মোটা গলা শোনা গেল, সুখেন্দুবাবু, ও কি হচ্ছে?
হাত আর মুখ দুই-ই তুলে দেখে, অর্চনা তার দিকে চেয়ে মিটি মিটি হাসছে। সুখেন্দু ভুরু কোঁচকালো।
সঙ্গে সঙ্গে অর্চনাও–ওখানে হাত কেন, একটা কিছুতে ধরে টান দিলে–?
তা বলে তুমি আমার নাম ধরে টান দেবে। দাঁড়াও পিসিমাকে বলছি–
অর্চনা ঘটা করে নিশ্বাস ফেলেছে একটা।-আহা, কি খাসা নাম। সুখেন্দু … মুখের সঙ্গে তো কোনকালে কোন সম্পর্ক ছিল বলে মনে হয় না।
সুখেন্দুর মতলব অন্যরকম, কাছে আসার উদ্যোগ করেছে, হয় না বুঝি…?
ভাল হবে না বলছি। সঙ্গে সঙ্গে জল ছিটিয়েই অর্চনা তাকে বাধা দিতে চেষ্টা করেছে আর তার সেই বিব্রত অবস্থা দেখে খিলখিল করে হেসেছে।
স্বপ্নের ঘোরে দিন কাটছিল যেন।
এই ঘোটা মাঝে মাঝে অর্চনার মা-ই ভেঙেছেন। মেয়ের সাংসারিক ব্যাপারে আর তার কোন দায়িত্ব নেই, এটা তিনি একবারও ভাবতে পারেননি –ভাবতে রাজীও নন। বরং এই অপ্রিয় দায়িত্ব তার আরো বেড়েছে বলেই মনে করেন। মেয়ের বিচার-বুদ্ধি এই বিয়ের থেকেই বুঝে নিয়েছেন। তাই কিছু একটা মনে হলেই তিনি দাশুর হাতে চিঠি দিয়ে মেয়েকে ডেকে পাঠান। অর্চনা না গিয়েও পারে না। না গেলে পরামর্শ দেবার জন্য জন নিজেই এসে হাজির হন। অর্চনা শোনে, শুনতে হয় বলেই শোনে। ভিতরে ভিতরে অস্বস্তি, আর, না কেউ শুনে ফেলে। ফাঁক পেলে জামাইকেও সাংসারিক বিষয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একটু আধটু উপদেশদানে কার্পণ্য করেন না মহিলা। ফলে জামাই শাশুড়ীটির ধারেকাছে ঘেঁষতে চায় না। অর্চনাকে বলে, তোমার মা-টি আমাকে তেমন পছন্দ করেন না।
অর্চনা হেসে উড়িয়ে দেয়। কখনো ছদ্ম সহানুভূতি দেখায়, আহা, এমন পছন্দের মানুষকে পছন্দ করে না…! কখনো বিব্রত বোধ করেও ছদ্মকোপে চোখ রাঙায়, তার মেয়ের পছন্দয় মন ভরছে না?
মায়ের সমস্যাটা কোথায় বা কাকে নিয়ে, অর্চনা মনে মনে সেটা খুব ভাল করেই জানে।
মায়ের সমস্যা পিসিমা।
প্রথমত মেয়ের সংসারের এই সেকেলে পরিবেশটাই মায়ের পক্ষে বরদাস্ত করা কঠিন। একজন গ্রাম্য বিধবা সেখানে কর্তৃত্ব করবেন আর মেয়ে তার কথায় উঠবে বসবে সেটা সহ্য করা আরো শক্ত। তার ধারণা, মেয়ে যে ডাকা মাত্র আসে না বা আসতে পারে না, তার কারণও ওই পিসিমা। পিসিমার কথা উঠলেই মেয়ে তাড়াতাড়ি সে-প্রসঙ্গ চাপা দিতে চায়, সেটা লক্ষ্য করেও তিনি মনে মনে চিন্তিত এবং ওই মহিলাটির ওপর বিরূপ। এর ওপর গোড়ায় গোড়ায় দিদির বাড়ি থেকে ঘুরে গিয়ে বরুণা সপুলকে মাকে ঠাট্টা করেছে, দিদিটা যে মা একদম গেঁয়ো হয়ে গেল, বসে ব্রতকথা শোনে, ছাই দিয়ে নিজের হাতে বাসন মাজে।
কখনো এক আধটা রেকাবি-টেকবি মাজতে দেখে থাকবে। কিন্তু এরই থেকে মা মেয়ের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল দেখেননি। তার ওপর অর্চনা আর য়ুনিভার্সিটিতে যাচ্ছে না শুনে তো রীতিমত ক্রুদ্ধ তিনি। অর্চনা পড়বে না সেটা সুখেন্দুরও আদৌ ইচ্ছে ছিল না, আর সেজন্য তাগিদও কম দেয়নি। তবু মিসেস বাসু সেই বেচারার সঙ্গেই এক-হাত বোঝাপড়া করতে ছাড়েননি। অর্চনা অবশ্য বলেছে, তার ভাল লাগে না। কিন্তু মা সেটা বিশ্বাস করেননি, এও সেই পিসিমারই অনুশাসনের ফল বলে ধরে নিয়েছেন। কোন্ সেকেলে বিধবা চায় ঘরের বউ এম. এ. পড়তে যাক–